1 of 3

১৩. ভাই সচ্চিদানন্দ

॥ ১৩ ॥

“ভাই সচ্চিদানন্দ, তোমার সহিত আর পারিলাম না। বহু দূরে অবস্থান করিয়াও তুমি আমার রোগ নির্ণয় করিয়া নিদান পাঠাইয়াছ। তোমার নাড়ীজ্ঞান প্রখর বলিতেই হইবে। তোমর নিদানটি। গ্রহণ করিলে রোগীর ধাত ছাড়িয়া যাইবে কিনা তাহা অবশ্য ভাবিয়া দেখ নাই। উপরন্তু আমার নানা অক্ষমতা, অপদার্থতার নজির তুলিয়া আমি কোন শ্রেণীর মানুষ তাহাই প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছ।

“বয়স্য সচ্চিদানন্দ, সুখের কথা হইল আমি কোন শ্রেণীর মানুষ তাহা আমার অজ্ঞাত নহে। শৈশবের কিছুই আমি ভুলি নাই। ঈশ্বরকৃপায় আমার স্মৃতিশক্তি ভালই। আপনমনে থাকি এবং স্মৃতি লইয়াই সময় কাটে বলিয়া সহজে কিছু ভুলিয়াও যাই না।

“দুইটি ভাইয়ের মাঝখানে আমি নিতান্তই খাপছাড়া। ভগ্নীদের কথা বাদ দিতেছি। কারণ নারীদের বিচারের মাপকাঠি আলাদা। কিন্তু আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে আমিই যে সব দিক দিয়া অযোগ্য ও অপদার্থ ছিলাম তাহা আমার পিতাঠাকুর হইতে শিক্ষকরা সকলেই আমাকে বারংবার বুঝাইয়াছেন এবং আমিও বুঝিয়াছি।

“আমার জ্যেষ্ঠ বরদাকান্ত বাল্যকালে অত্যধিক দুষ্ট ছিলেন। তাঁহার অনেক অভিযানে আমিও সঙ্গে গিয়াছি। একবার রহিম সাহেবের পাটবোঝাই নৌকায় তিনি রাত্রিবেলা অগ্নিসংযোগ করেন। নিতান্তই দুষ্টামী, অন্য উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু সেই আগুনে একজন ঘুমন্ত মাল্লা, অর্ধদগ্ধ হইয়া মরিতে বসিয়াছিল। ভোরবেলা নৌকা ছাড়িবে বলিয়া মাল্লারা পাটের গাঁটের খাঁজে ঢুকিয়া ঘুমাইয়া লইতেছিল। সেই হতভাগ্য মাল্লাটি সময়মতো জলে লাফাইয়া পড়িতে পারে নাই। আজ বরদাকান্ত সাধু হইয়াছেন। যদি এখন কেহ গিয়া তাঁহাকে সেই শৈশবের দুষ্কার্যটির কথা স্মরণ করাইয়া তিনি যে কত বড় অসাধু তাহা প্রমাণ করিবার চেষ্টা করেন তাহা হইলে কেমন হয়?

“এই যে আজ তুমি কংগ্রেসে নাম লিখাইয়া দেশভক্ত হইয়াছ ইহা তো গৌরবেরই কথা। কালক্রমে একদিন কংগ্রেসের নেতা হইয়া ওঠা তোমার পক্ষে বিচিত্র নহে। কিন্তু সেইদিন যদি কেহ গিয়া তোমাকে বলে যে মহাশয় চামেলী নাম্নী মহিলাটির সঙ্গে একদা আপনার সম্পর্কটি কতদূর ঘনিষ্ঠ ছিল তাহা আমরা জানি। তখন কেমন হইবে?

“তোমাকে আঘাত করিবার জন্য প্রসঙ্গটি উত্থাপন করি নাই। আমি জানি মানুষকে বিচার করিতে হইলে তাহার অতীতেরও খানিকটা বিশ্লেষণ প্রয়োজন এবং তুমি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী বলিয়াই সেই কাজ করিবার চেষ্টা করিয়াছ। কিন্তু আমার বর্তমান সমস্যাটি অত সরল ও লঘু নহে। আমি মানি, সুনয়নীর সহিত আমার সম্পর্ক কিছুটা শীতল ছিল। দোষ তাহার নহে, আমার। আমি নিজেই বরাবর কিছু শীতল স্বভাবের লোক। আমি সৌন্দর্য ভালবাসি, তাহা লইয়া ঘাটাছানা করিতে ইচ্ছা হয় না। সুনয়নীর সৌন্দর্য আমি দূর হইতে উপভোগ করিতে ভালবাসিতাম, যেমন লোকে ফুল বা চাঁদকে উপভোগ করে। তাহার সহিত আমার দূরত্ব ছিল তাহাও স্বীকার করি এবং বলি, জীবনটাকে উপভোগ্য করিয়া তুলিবার জন্য একটু দূরত্বেরও প্রয়োজন আছে। মুখের নিকটে আয়না ধরিলে কি মুখখানা ভাল দেখা যায়? একটু দূরে ধরিতে হয়। সুনয়নীর সহিত আমার সেই দূরত্বটুকু ছিল। কিন্তু তাহা যে তোমাদের কাছে প্রেমহীনতা বা ভালবাসার অভাব বলিয়া প্রতিভাত হইবে তাহা ভাবিয়া দেখি নাই। এখন অবশ্য ভাবিয়াও কিছু করা যাইবে না। যাহা ঘটিয়া গিয়াছে তাহার সবকিছুই আর সংশোধন করা তো সম্ভব নহে।

“তুমি বৌদ্ধ দর্শন অবশ্যই পড়িয়াছ। যে প্রদীপশিখাটি নিষ্কম্প ও স্থির হইয়া জ্বলিতেছে তাহাকে একটিই প্রদীপশিখা বলিয়া মনে হয় বটে, কিন্তু আসলে প্রতিটি নিমেষেই শিখাটি মরিয়া নূতন একটি শিখা জন্ম লইতেছে। কিন্তু তাহা এত দ্রুত ঘটিতেছে যে আমাদের চক্ষু তাহা ধরিতে পারিতেছে না। ভাই সচ্চিদানন্দ, আমার তো মনে হয় মানুষও তাহাই। ক্ষয় ও পূরণ প্রকৃতিরই নিয়ম। সেই নিয়ম অনুসারেই আমাদেরও নিত্য ক্ষয় ও পূরণ ঘটিতেছে। আর তাহারই ভিতর দিয়া চলিতেছে বলিয়া একটি মানুষও আসলে অনেকগুলি মানুষের সমষ্টিমাত্র। আমি যদি আজ বলি, খানু পাগলার তাড়া খাইয়া যে হেমকান্ত পলাইয়াছিল সে আমি নহি তাহা হইলে কি তত্ত্বগতভাবে ভুল হইবে?

“তোমাকে দর্শন বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ার জন্য প্রসঙ্গটির অবতারণা করি নাই। বলিতেছিলাম, মানুষের পরিবর্তন ঘটে। আজিকার মানুষটি যাহা করিতেছে তাহা দিয়া পঁচিশ বছর পরের লোকটিকে বিচার করা সর্বাংশে যথাযথ না হইতেও পারে। পাটের নৌকায় আগুন লাগাইয়াছিল বলিয়া বরদাকান্তের বৈরাগ্য বাতিল হইয়া যায় না। চামেলীভক্ত সচ্চিদানন্দেরও দেশভক্তিতে ভেজাল ঢোকে না।

“কিন্তু বিতর্ক থাকুক। ইহাতে আমাদের কাহারও লাভ নাই। উপরন্তু নানাবিধ ঝামেলায় আমারও মনটা বড় স্থির নাই। কিছুদিন আগে শশিভূষণ গঙ্গোপাধ্যায় নামে একটি ছোকরাকে আমার বাসায় আশ্রয় দিয়াছিলাম। তাহাকে নাকি পুলিশ স্বদেশী মনে করিয়া তাড়া করিয়াছে। বেচারা দিন দুই আমাদের আমবাগানে অনাহারে লুকাইয়া ছিল। কিন্তু আশ্রয় দেওয়ার পরই ছেলেটি সাঙ্ঘাতিক অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছে। ডাক্তার তেমন ভরসা দিতেছে না। সে বলিয়াছিল তাহার বাড়ি বরিশালে, পিতা শিক্ষকতা করেন। কিন্তু পুলিশের ভয়ে তাহার বাড়িতেও খবর দিতে পারিতেছি না। সে বাঁচিবে কি মরিবে জানি না, কিন্তু আপাতত তাহার দায় যে আমার উপর বর্তাইয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।

“কথা হইল আমি এই অজ্ঞাতকুলশীল শশিভূষণের দায় স্কন্ধে নিলাম কেন। দু মুঠা খাইতে দিয়া তদ্দণ্ডেই তাহাকে বিদায় দিতে পারিতাম। বিশেষ করিয়া ইংরাজ রাজত্বে পুলিশের খাতায় নাম-লেখানো লোককে আশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবু দিলাম। কেন দিলাম তাহা জানিলে তুমি হাসিবে। দিলাম তোমার কথা মনে করিয়া।

“ভাই সচ্চিদানন্দ, দেশ কাল পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি তোমার মতো সচেতন নই একথা ঠিক। দেশের কোথায় কী ঘটিতেছে, ইংরাজরা কত টাকার জিনিস বৎসরে এই দেশে রফতানি করিতেছে, স্বদেশীরা কয়টি ইংরাজ মারিল এত খবর বিস্তারিতভাবে আমি রাখি না। তবে মানুষ তাহার বিশেষ সমাজ ও পারিপার্শ্বিকের মধ্যেই বাঁচিয়া থাকে, তাই দেশ কাল পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ এড়াইতেও পারে না। আমার পরিবেশ সীমাবদ্ধ বটে, তবে এখানেও বহির্বিশ্বের তরঙ্গ আসিয়া লাগে। আজকাল আরও বিশেষ করিয়া লাগে, কারণ আদায় উসুল হ্রাস পাইয়াছে, জমিদারীর আয়ে বুঝি আর মর্যাদা রক্ষা হয় না। আয় কেন কমিল তাহা অনুসন্ধান করিতে গিয়া দেশ কাল পরিস্থিতির-আঁচ পাইলাম। আমাদের মতো ঘরকুনো ও আত্মসুখী মানুষরাও তাই সর্বৈব পরিবেশকে এড়াইয়া চলিতে পারে না। তবে দেশ যতই সংঘাতসংকুল ও সমস্যা কণ্টকিত হউক না কেন কিছু লোক নিস্পৃহ ও উদাসীন থাকিবেই। আমি এই দলের। ইহারা আন্দোলন করিতে পথে নামিবে না, বিদেশী দ্রব্যের বহ্ন্যুৎসবে যোগদান করিবে না, ইংরাজ মারিবে না, পতিতোদ্ধার করিবে না, ইহারা কেবল বসিয়া ভাবিবে।

“তোমার এই অপদার্থ বয়স্যটিকে ক্ষমা করিও। তবু শশিভূষণ যখন সামনে আসিয়া দাঁড়াইল তখন মনে হইল, এই তো সচ্চিদানন্দের দেশ কাল পরিস্থিতি আমার সম্মুখে আসিয়া হাজির হইয়াছে। ইহাকে একটু বাজাইয়া দেখিলেই তো স্বদেশীয়ানার প্রবণতাটা বুঝা যাইবে। সম্ভবত স্বদেশের প্রতি যে কর্তব্য আজও না করিয়া পাপ সঞ্চয় করিতেছি, এই ছোকরাকে আশ্রয় দিলে সেই পর্বতপ্রমাণ অপরাধের তিলপ্রমাণ ক্ষয়ও হইতে পারে। এখন সেই কর্মের ফলভোগ করিতেছি। শশিভূষণ বুঝি বাঁচে না।

“আর এক সমস্যা আমার কনিষ্ঠ পুত্রটিকে লইয়া। সে তাহার মাকে দেখে নাই বলিলেই হয়। স্বভাবতই সে আমার কিছু প্রশ্রয় পাইয়াছে। এই সন্তানটির প্রতি আমার দুর্বলতার কথাও সকলেই জানে। এখন তাহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা তাহাকে কলিকাতায় লইয়া গিয়া লেখাপড়া শিখাইতে আগ্রহী। আমি মতামত দিই নাই। যে কোনো বিষয়েই মনস্থির করিতে আমার সময় লাগে। মনে হইতেছে, কৃষ্ণকান্ত চলিয়া গেলে আমার কিছু কষ্ট হইবে।

“পুত্রকন্যারা আমার প্রতি স্নেহাসক্ত কিনা জানি না। তাহাদের সহিতও আমার সেই দূরত্ব। সুতরাং কৃষ্ণকান্তের আমাকে ছাড়িয়া যাইতে কষ্ট হইবে কিনা জানি না, যদি জানিতে পারি যে হইবে না, তবে বোধহয় খুব খুশি হইব না। কিন্তু কথাটা হইল এই, এই পৃথিবীতে আমরা পরস্পরের কতটা আপনজন?

“সচ্চিদানন্দ ভায়া, তোমাকে কোকাবাবুর গৃহে সংঘটিত একটি ঘটনার কথা লিখিয়াছিলাম। দাদু মরিতেছে আর নাতি পাখি শিকার করিয়া ফিরিয়াছে বলিয়া অন্যদিকে খুশির হিল্লোল বহিয়া যাইতেছে। সন্দেহ হইয়াছিল, আমাদের অধিকাংশ শোকই হয়তো কৃত্রিম। বৃদ্ধ পিতার জন্য তাহার পুত্রের তেমন কোনো স্নেহ থাকে না।

“সেই কথা যতবার মনে হয় ততবার শীঘ্র মরিতে ইচ্ছা করে…”

হঠাৎ রঙ্গময়ীর কণ্ঠস্বর পিছন থেকে বলে উঠল, তোমার মরতে ইচ্ছে করে?

হেমকান্ত চমকে উঠলেন। কিন্তু চিঠিটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেন না। বললেন, কখন এলে?

অনেকক্ষণ। পিছনে দাঁড়িয়ে চিঠিটা পড়ছিলাম। আমার শ্বাসের শব্দও পাওনি?

না। হয়তো শ্বাস বন্ধ করে পড়ছিলে।

মরতে ইচ্ছে করে লিখেছো কেন? সত্যিই করে?

হেমকান্ত মৃদু একটু হাসলেন, বললেন, বোধহয় করে।

ছেলেমেয়েরা ভালবাসে না তোমাকে এ কথা কে বলল?

কেউ বলেনি। আমি লিখেছি ভালবাসে কিনা জানি না।

জানোনা কেন? খোঁজ নিলেই তো হয়।

খোঁজ নিলে, কী জানা যাবে বলো তো মনু। বাসে?

আমি বলতে যাবো কোন্ দুঃখে?

তুমি ছাড়া আর তো কেউ বলতে পারবে না।

কৃষ্ণকে ছেড়ে থাকতে যদি কষ্টই হয় তবে সে কথা কনককে জানিয়ে দিলেই তো পারো। সচ্চিদানন্দবাবুকে জানানোর কী?

হেমকান্ত মৃদু মৃদু হাসছিলেন। বিব্রত বোধ করছিলেন। বললেন, সেটা জানানো ভাল হবে। না।

পাছে ছেলের সম্পর্কে তোমার দুর্বলতা ধরা পড়ে যায়? আচ্ছা লোক। বাবা ছেলেকে ভালবাসে এর মধ্যে কি লজ্জার কিছু আছে?

হেমকান্ত একটু বিষণ্ণ হয়ে বললেন, মনু, লজ্জার কিছু আছে কিনা তা তুমি ঠিক বুঝবে না। যদি সত্যি কথা জানতে চাও, তাহলে বলি আছে।

এ রকম উদ্ভট কথা কখনো শুনিনি।

আমি চাই না কৃষ্ণ কথাটা জানতে পারে।

সে জানলে দোষটা কী?

দোষের কিছু নয় তা জানি। তবে হয়তো ভাববে, বাবা এমনিতে ডাকখোঁজও করে না কিন্তু কলকাতায় যাওয়ার বেলায় বাগড়া দিচ্ছে।

শুধু এইটুকু?

না। হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, আরও একটু কথা আছে।

সেটা কী?

আমি মায়া কাটাতে চাই।

তাই বা কেন?

তুমি বুঝবে না।

খুব বুঝবো, একটু বোঝানোর চেষ্টা করে দেখ।

তাহলে বোসো।

রঙ্গময়ী শীতের রোদে পিঠ দিয়ে কারপেটের আর এক অংশে বসল। তার মুখচোখে ক্লান্তির ছাপ, রাত্রিজাগরণের চিহ্ন।

হেমকান্ত বললেন, আমি হঠাৎ বুঝতে পেরেছি পৃথিবীতে আত্মীয়তার বন্ধনগুলো ভারী পলকা।

এ কথা কেন বলছো?

যা সত্যি বলে মনে হয়েছে তাই বলছি।

তুমি তো কখনো সংসারের ভিতরেই ভাল করে ঢুকলে না। ছেলেমেয়েদের কদিন কোলে পিঠে নিয়েছে তাও আঙুলে গোণা যায়। কাউকে তো কখনো আত্মীয় করে তোলার চেষ্টাই করলে না। তাই তোমার ওসব মনে হয়।

হেমকান্ত ব্যথিত হয়ে বললেন, কথাটা ঠিক নয় মনু। সংসারকে যতই আপন করতে চাও না কেন সংসার তোমাকে ফাঁকি দেবেই।

রঙ্গময়ী তার উড়োখুড়ো চুল হাত দিয়ে চেপে মাথায় বসানোর ব্যর্থ একটা চেষ্টা করতে করতে বলল, তোমার মতো করে ভাবলে দুনিয়ার সব নিয়মই উলটে দেওয়া যায়। কিন্তু ওটা হল ভাবের কথা। এখন কাজের কথা শোনো। শশিভূষণের অবস্থা আজ সকালে আরো খারাপ হয়েছে।

হেমকান্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কতটা খারাপ?

টিম টিম করে প্রাণটা আছে এখনো। তবে বেশীক্ষণ নয়। কী করবে?

হেমকান্ত হতাশ গলায় বললেন, কী করব? আমার কী করার আছে?

তোমার তো কখনোই কিছু করার থাকে না, শুধু ভাবার থাকে। আমি সারা রাত ছেলেটার কাছে ছিলাম।

সারা রাত! ঘুমোওনি?

একটা অল্প বয়সের ছেলে চোখের সামনে মরে যাচ্ছে তা দেখেও কি ঘুম আসে?

তা বটে।

আজ সকালে মানুবাবু এসে দেখে ওষুধ দিয়ে গেছেন।

মানুবাবুটা আবার কে?

কদমতলায় যে হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বসে।

সে কী বলল?

কিছু বলল না। ওষুধ দিয়ে গেল। কিন্তু সূর্যবাবু একরকম জবাব দিয়ে গেছেন।

হেমকান্ত মৃদুস্বরে বললেন, কেন যে ছেলেটা মরতে এ বাড়িতে এল!

সে ভেবে এখন আর কী করবে।

কোনো রকমেই কি বাঁচানো যায় না মনু?

রঙ্গময়ী মৃদু হেসে বলল, তা জানি না। তবে বেঁচেও বোধহয় লাভ নেই।

কেন, ওকথা বলছ কেন?

বরিশালে এক পাদ্রীকে খুন করার জন্য ওর ফাঁসি হবে।

কে বলল?

আমি জানি।

কী করে জানলে?

সারা রাত ছেলেটা জ্বরের ঘোরে ভুল বকেছে। সেইসব প্রলাপ থেকেই বুঝতে পেরেছি।

কী বলছিল?

অত খুলে বলার সময় নেই। এখন গিয়ে স্নান করব, চারটি খাবো, তারপর ফের এসে রুগীর কাছে বসতে হবে। খানিকক্ষণের জন্য পিসিকে বসিয়ে রেখে এসেছি। আর কৃষ্ণ আছে। কিন্তু রুগীর অবস্থা তো ওরা ভাল বুঝবে না।

সর্বনাশ!

সর্বনাশের কি হল?

পুলিশ যদি খবর পায়?

খবর কি আর পায়নি!

পেয়েছে?

এসব খবর কি আর গোপন থাকে! পরশু থেকে পুলিশের চর ঘোরাফেরা করছে।

কে বলো তো?

মহেশবাবু। সেই যে বাবরি চুল—

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, জানি।

তাই বলছিলাম ছেলেটার বেঁচেও লাভ নেই।

হেমকান্ত গভীর দৃষ্টিতে রঙ্গময়ীর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তবু ছেলেটাকে বাঁচানোর জন্য তুমি প্রাণপণ করছ। কেন করছ রঙ্গময়ী?

কেন আবার। বাঁচানোর চেষ্টা তো করতেই হবে। কোন মায়ের কোল খালি করে চলে এসেছে। তাকে এমনি এমনি মরতে দেওয়া যায়?

এই যে বললে রোগে না মরলেও ফাঁসিতে মরবে!

সেটা এখনো জানি না। তবে খুনটা বোধহয় ও করেছে।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তাহলে রোগেই কেন ওকে যেতে দাও না?

এ কথায় রঙ্গময়ী হঠাৎ একটু অদ্ভুত হাসল। সেই হাসিতে রোজকার দেখা রঙ্গময়ী বদলে গেল হঠাৎ। ধীর স্বরে বলল, তাহলে ওর কথা তো কেউ জানতে পারবে না। পত্রিকায় ওর নাম উঠবে না। ইতিহাসে নামটা লেখাও থাকবে না।

নামটা চাউড় হওয়াটা কি ভাল?

কে জানে! তবে আমার মনে হয়, ওইটুকু ছেলে একটা সাহসের কাজ যখন করেছে তখন দেশের লোকের সেটা জানা উচিত। ফাঁসিতেই যদি মরে তাহলে হাজার হাজার ওর বয়সী ছেলে খবরটা জেনে এই কাজে নামবে।

মনু! হেমকান্ত আর্তনাদ করে ওঠেন।

কী বলছ! স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো গলায় রঙ্গময়ী জবাব দেয়।

তুমিও কি স্বদেশী করছ নাকি?

আমার তো জমিদারি নেই, করলে দোষ কি?

সর্বনাশ

সর্বনাশের কিছু নেই। মেয়েরা আবার স্বদেশী করতে পারে নাকি? হাতে পায়ে বেড়ি আছে না! বলে রঙ্গময়ী একটু হাসে।

তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু ছোকরা যদি ধরা পড়ে তাহলে আমরাও কি রেহাই পাবো! বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা।

তোমার যে কত রকমের ভয়।

ভয়টা কি মিথ্যে?

তা বলিনি। কিন্তু শশীর যা হবে তোমার তো আর তা হবে না। কেউ ধরে নিয়ে ফাঁসি দেবে না তোমাকে। তুমি তো আর স্বদেশী বলে ওকে আশ্রয় দাওনি।

তুমি পুলিশকে জানো না।

না জানলেই বা। অত ভয় পেও না।

মহেশ কবে এসেছিল?

পরশু থেকেই ঘুরঘুর করছে।

কিছু বলেছে?

আমাকে না। তবে কাছারি বাড়িতে অনেককে নানারকম জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তোমার কাছেও আজ আসার কথা।

কে বলল?

মহেশবাবু নিজেই বলে গেছেন।

হেমকান্ত কিছুক্ষণ উদ্বিগ্ন মুখে ভাবলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী বলব বলো তো মনু!

কী আবার বলবে। আমি হলে তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম।

ওটা কাজের কথা হল না।

তাহলে যা বলবার নিজেই বুদ্ধি করে বোলো। রাত জেগে আমার মাথাটা ঠিক নেই এখন।

একটু বোসো মনু। তোমার সঙ্গে আমার আর একটু কথা আছে।

আবার কী কথা?

আছে।

কাজের কথা, না ভাবের কথা?

হেমকান্ত হেসে বললেন, দুরকমই। যে ভাবে যে নেয়।

রঙ্গময়ী বলল, ভাবের কথা হলে না হয় পরে শুনব।

ভাবের কথাকে এত ভয় কেন মনু?

আমি বাপু, ভাবের কথাকে বড় ভয় পাই। তাছাড়া এখন ভাবের কথা শোনার মতো মন নেই।

তুমি কাজের লোক জানি। তবু আজ একটা কথা জিজ্ঞেস করি। জবাব দেবে?

আগে তো শুনি।

তোমার কি কোনো বিশেষ দুঃখ আছে মনু?

এই কথা! বলে রঙ্গময়ী বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল হেমকান্তর দিকে। বেশ দেখাল তাকে।

হেমকান্ত এই চোখের সামনে বরাবর কুঁকড়ে যান। কিন্তু আজ একটু সাহস করে চোখে চোখ রাখলেন। বললেন, কথাটাকে তুচ্ছ ভেবোনা। কারণ আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি।

রঙ্গময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কারণ ছাড়া তুমি কিছু করবে না জানি। কিন্তু কারণটা কি?

আগে বলো।

বলার কী আছে তাও তো ছাই বুঝছি না। আমি গরূব পুরুতের মেয়ে, আমার তো দুঃখ থাকারই কথা।

সে দুঃখ তোমার নেই। থাকলেও আমি তার কথা বলছি না। আমি জিজ্ঞেস করছি বিশেষ কোনো দুঃখের কথা।

রঙ্গময়ী শ্রান্তমুখেও হাসতে লাগল। বলল, আর একটু বুঝিয়ে না বললে বোকা মেয়েমানুষের মাথায় কি সেঁধোয়?

হেমকান্ত চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, ধরো যদি জিজ্ঞেস করি কোনো পুরুষের প্রতি তুমি আসক্ত কিনা যাকে মুখ ফুটে কখনো কথাটা বলতে পারোনি?

রঙ্গময়ীর কোনো ভাবান্তর বোঝা গেল না। তবে সে চোখ দুটো বুজে স্থির হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর চোখ খুলে হেমকান্তর দিকে তাকাল। স্নিগ্ধ ও গভীর এক দৃষ্টি। আস্তে করে বলল, না তো।

ঠিক বলছ মনু?

রঙ্গময়ী হাসল। বলল, তুমি কি অন্য কিছু শুনতে চেয়েছিলে?

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, না। তবে কিছু লোক অন্য কথা বলে।

তাদের চেয়ে আমাকে তোমার ভাল জানবার কথা।

আমি তো তাই মনে করি। তবু কেন যে লোকের অদ্ভুত সব সন্দেহ।

কী সন্দেহ?

সচ্চিদানন্দ একটা চিঠি লিখেছিল। তাতে কিছু অদ্ভুত কথা ছিল তোমাকে নিয়ে।

রঙ্গময়ী মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, কী কথা?

সেটা তোমাকে বলা যায় না।

কেন বলা যায় না? আমাকে নিয়েই যখন কথা তখন আমার জানা উচিত।

সচ্চিদানন্দটা পাগল।

রঙ্গময়ী হেসে বলল, সচ্চিদানন্দবাবুর মতো ঘড়েল লোক যদি পাগল হয় তবে দুনিয়ায় সবাই পাগল। কী লিখেছে বলো না! কারো প্রতি আমার দুর্বলতা আছে বুঝি?

সেকরমই।

লোকটা কে?

হেমকান্ত বিব্রত হয়ে বলেন, সেটাও উদ্ভট। লোকটা নাকি আমিই।

বটে। রঙ্গময়ী চোখ পাকাল। তারপর হঠাৎ হেসে ফেলে বলল, চিঠিটা চুরি করে আমিও পড়েছি।

পড়েছো! ওঃ! তাহলে—

রঙ্গময়ী ক্লান্ত, তবু শান্ত স্বরেই বলল, কথাটা উদ্ভট কেন হবে? তোমার বিয়ের পর আমি কি তোমাকে কম জ্বালিয়েছি?

হেমকান্ত হঠাৎ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলেন বললেন, সেতো ছেলেমানুষী। কাফ লাভ।

রঙ্গময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই হবে হয়তো। এই কথাটা বলতে তোমাকে এত ভনিতা করতে হল কেন বলো তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *