১৩. ডিহি-কলিকাতা
কিন্তু মূলাজোড়ের ব্রহ্মময়ী মন্দিরের গল্প শুনতে হলে ঐ খালটি তোমাদের পার হতে হবে, বাপু—‘মারহাট্টা ডিচ্’; প্রবেশ করতে হবে ডিহি কলকাতায়।
সুতানুটি-গোবিন্দপুরের ইতিহাসস্বীকৃত আদিম বাসিন্দাদের মধ্যে উল্লেখ করতে হবে জনার্দন শেঠ, আর রাজারাম মল্লিকের নাম, বলতে হবে বসাক আর পঞ্চানন কুশারীর কথা। ইংরেজ ঐতিহাসিকের মতে জনার্দনতনয় বৈষ্ণবচরণ শেঠ ছিলেন The richest and the most honest merchant of his time.” এই ধনকুবের পরিবার যে পণ্যদ্রব্যটি নিয়ে আদি যুগে ব্যবসা ফেঁদে ছিলেন তা হচ্ছে বিশুদ্ধ গঙ্গোদক! ‘কলিকাতার কথা’-য় প্রমথনাথ মল্লিক জানাচ্ছেন, “বৈষ্ণবচরণ শেঠের পিতার শীলমোহর করা গঙ্গাজল দেশে-বিদেশে যাইত ও ত্রৈলঙ্গদেশে শ্রীশ্রী রামচন্দ্রের পূজায় ঐ জল ভিন্ন অন্য কোনও জল ব্যবহৃত হইত না।” বিশুদ্ধ গঙ্গাজল ক্রমে রূপান্তরিত হয়েছিল নিকষিত সুবর্ণে! রাজারাম মল্লিক আদিতে বাস করতেন ত্রিবেণীতে। ব্যবসায় সূত্রে পরে চলে আসেন কলকাতায়। তাঁর দুই পুত্র—দুজনেই আর্থিক মূল্যায়নে স্বনামধন্য : দর্পনারায়ণ ও সন্তোষ মল্লিক। শেষোক্তের নামের বাজারটি আজও বর্তমান।
আমাদের কাহিনীর সূত্র : পঞ্চানন কুশারী। তিনি বাস করতেন আদি গঙ্গার ধারে।
শোনা যায়, তাঁর পূর্বপুরুষ মহেশ্বর এবং তাঁর ভ্রাতা শুকদেব কুশারী পূর্বযুগে বাস করতেন যশোহরের বারোপাড়া গ্রামে। কী কারণে জানা যায় না, দুই ভাই তাঁদের যশোহরের আদি নিবাস ত্যাগ করে গোবিন্দপুর গ্রামে এসে ভদ্রাসন নির্মাণ করেন। এখানেও এক জনশ্রুতি : তাঁদের একজন পূর্বপুরুষকে নাকি মুসলমান সুলতান অথবা কাজী নিষিদ্ধ মাংস ভোজনে বাধ্য করেছিল! সেই সুবাদে নাকি স্বগ্রামে তাঁদের বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ওঁরা উঠে আসেন গোবিন্দপুরে।
পঞ্চানন কুশারী ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির জাহাজী কারবারে যোগ দেন। তাঁর কাজ ছিল দেশী মেহনতি মানুষদের সাহায্যে বিদেশী বণিকদের জাহাজ থেকে মাল খালাস করা। ঐ সঙ্গে আগন্তুকদের প্রয়োজনীয় খাদ্যপানীয় সরবরাহ করা। পঞ্চানন তাঁর কর্মস্থলের কাছাকাছি, অর্থাৎ আদি গঙ্গার ধারে শূদ্র-অধ্যুষিত অঞ্চলে নির্মাণ করেন এক ক্ষুদ্রায়তন ভদ্রাসন। সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। জল-অচল জাতের মানুষ তাদের পাড়ায় একঘর ব্রাহ্মণ পেয়ে যেন হাতে স্বর্গ পেল। ওঁরা পীরালী শ্রেণীর বৈদিক ব্রাহ্মণ। বামুন মানুষ—নাম ধরে তো আর ডাকা যায় না, তাই সবাই তাঁকে ডাকত : ‘ঠাকুর-মশাই’। তা থেকেই উপাধিটা হয়ে গেল : ঠাকুর। ‘কুশারী’ উপাধী পরিত্যক্ত হল। সাহেবদের উচ্চারণে হল : টেগোর।
আমাদের কাহিনীর কালে, 1742 এ—অর্থাৎ মূলাজোড়ে ব্রহ্মময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠার অর্ধশতাব্দী পূর্বে, কলকাতায় জরিপের কাজ শুরু হয়। পঞ্চানন তাঁর দুই পুত্র—জয়রাম ও রামসন্তোষকে লাগিয়ে দিলেন জরীপের কাজে—আমিন হিসাবে। জয়রামের দুই পুত্ৰ—অগ্ৰজ নীলমণি হচ্ছেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের আদিপুরুষ—যে শাখায় কালে আবির্ভূত হবেন রবীন্দ্রনাথ। আর অনুজ দর্পনারায়ণ (1731-93) হচ্ছেন পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা।
আমিন হিসাবে জীবন শুরু করলেও দর্পনারায়ণ পরে চাকুরী নিয়েছিলেন একটি ফরাসী কোম্পানিতে; ক্রমে হুইলার-সাহেবের দেওয়ান। শেষে ইস্তফা দিয়ে নিজ ব্যবসায়। অচিরেই অগাধ সম্পত্তির মালিক। জ্যেষ্ঠভ্রাতা নীলমণির সঙ্গে বিষয় সম্পত্তি নিয়ে কিছু মতান্তর হওয়ায় পৃথক হন। পাথুরিয়াঘাটার সাবেক ভদ্রাসনে রয়ে গেলেন দর্পনারায়ণ, প্রাচীন ক্ষুদ্রায়তন গৃহটির স্থলে নির্মাণ করলেন বিরাট প্রাসাদ; অগ্রজ নীলমণিও তৈরী করলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি।
মূলাজোড়ের ব্রহ্মময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠাতা গোপীমোহন ঠাকুর (1760-1819) দর্পনারায়ণের পুত্র। বস্তুত পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের দ্বিতীয় পুরুষ, অসাধারণ তাঁর পাণ্ডিত্য। অন্তত আটটি ভাষায় তাঁর অধিকার : ইংরাজী, ফরাসী, পর্তুগীজ, সংস্কৃত, ফারসী, উর্দু, হিন্দি ও বাঙলা। ব্রিটিশ সরকারে বরাবর উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রাক-রামমোহন যুগের এক আধুনিকমনা। পাশ্চাত্য-সংস্কৃতিকে চিনবার আগ্রহ তাঁর প্রবল। ইংরাজী শিক্ষার প্রসারকল্পে ‘হিন্দু কালেজ’ স্থাপনের সময় এককালীন দশ-হাজার টাকা দান করেন এবং ‘হিন্দু–কালেজে’র বংশানুক্রমিক গভর্ণর পদও লাভ করেন। সংস্কৃত-চর্চায় উৎসাহী এই ধনকুবের সঙ্গীতজ্ঞ এমনকি ব্যায়ামবীরদেরও প্রতিপালন করতেন। এঁরই কন্যা ব্রহ্মময়ী।
ব্রহ্মময়ীর অনুজ ভ্রাতা প্রসন্নকুমার ( 1801-1868)—কৃতবিদ্য পি. এন. টেগোর। যিনি রক্ষণশীল হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও রামমোহনের সতীদাহ-নিবারণ আন্দোলনে সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর জন্ম হয় জ্যেষ্ঠা ভগ্নী ব্রহ্মময়ীর মৃত্যুর পর।
এতক্ষণ যে-সব কথা বলেছি তা তথ্যনির্ভর ইতিহাস। তোমাদের সঙ্গে ‘ব্লাইণ্ড’ খেলব না বলে সবার আগে হাতের সবকটা তাসই বিছিয়ে দিয়েছি টেবিলে। এবার শোনাই শ্যামনগরে “ব্রহ্মময়ী মন্দিরে সংগৃহীত উপকথা, কথাসাহিত্যিকের কল্পনায় মিশিয়ে :
সন 1793—অর্থাৎ পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর বংশের প্রতিষ্ঠাতা দর্পনারায়ণের মৃত্যু বৎসর। কার্তিকের অমাবস্যা। পাথুরিয়াঘাটা প্রাসাদের দ্বিতলে দক্ষিণ-পূর্বে কর্তামশায়ের শয়নকক্ষ। বৃহদায়তন কামরা। উপরে ঝাড়লণ্ঠন, দেওয়াল-গিরিতে বাতি জ্বলছে। ঘরে বৃহদাকার পালঙ্ক। উপরে টানা-পাঙ্খা, এখন চলছে না। এটির ব্যবহার ধনাঢ্য পরিবারে সদ্য-আমদানি। কায়দাটা শিখিয়েছে ওলন্দাজেরা—যেমন তারা নিজেরা শিখেছে বঙ্গদেশে এসে আলবোলায় তাম্বাকু সেবন। দেওয়ালে প্রকাণ্ড কয়েকটি তেলরঙে-আঁকা প্রতিকৃতি-চিত্র : জয়রাম, নীলমণি আর দর্পনারায়ণের। এগুলি এতদিন ছিল একতলার বৈঠকখানায়। কর্তামশাই শয্যাশায়ী হয়ে পড়ার পর বর্তমানে তাঁর শয়নকক্ষে নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁরই ইচ্ছায়। মানসিকভাবে তিনি ঐ প্রাচীনকালেই থাকতে ভালবাসেন। তৈলচিত্রগুলি এঁকেছেন একজন বিদেশী চিত্রকর, গোপীমোহনের উদ্যোগে। জয়রামের চিত্রটি আন্দাজে, বর্ণনা শুনে শুনে। বাকি দুটি সামনে বসিয়ে।
সন্ধ্যা অতিক্রান্ত। দীপাবলীতে কলকাতা শহর আলোকোজ্জ্বল। খোলা জানলা দিয়ে দেখা যায় আতসবাজির রোশনাই। এটিও ঐ ফিরিঙ্গিদের অবদান। দীপাবলী ছিল—শোনা যায়, শ্রীরামচন্দ্রের লঙ্কাবিজয়ের পর অযোধ্যা প্রত্যাবর্তনের সময়েও শহরে দীপসজ্জা হয়েছিল; কিন্তু ঐ হাউই আর তুবড়ির চল হয়েছে বিদেশীরা আসার পর
দর্পনারায়ণের বয়স এমন কিছু নয়—তিনকুড়ি দুই। কিন্তু শরীর ভেঙে গেছে। বস্তুত বুঝতে পেরেছেন, তাঁর কর্মময় জীবনের শেষ সীমান্তে উপনীত হয়েছেন তিনি। বিদায় নেবার দিন যত এগিয়ে আসছে ততই যেন সংসারের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইদানীং তাঁর সুবৃহৎ পালঙ্কে তিনি একা শয়ন করেন না। তাঁর আদরের নাতনিটি এসে গুটিগুটি শুয়ে পড়ে বৃদ্ধের পাঁজর ঘেঁষে। গোপীমোহনের জ্যেষ্ঠাকন্যা—সপ্তমবর্ষীয়া ব্ৰহ্মময়ী!
‘ব্রহ্মময়ী’। নামটা উচ্চারণ করা শক্ত। কিন্তু কী করবেন? বাপের দেওয়া নাম—সেটাই চালু হয়েছে। পণ্ডিত ছেলে, উপেক্ষা করা যায়নি। সবাই ডাকে ‘বড়খুকি’। উনি ডাকতেন ‘ছোট্ট গিন্নি’। তাতে এতদিন আপত্তি ছিল না ওঁর নাতনির। ইদানীং—কথাটার অর্থ বুঝতে পারার পর, সে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছে। তাই আজকাল ওকে ডাকেন ‘দিদিভাই”। গতবৎসর ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার পর থেকে। ব্রহ্মময়ীর ছোট ভাই নেই। সবাই ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেয়, ও বেচারি দিতে পারে না। তাই বৃদ্ধ সে দায়িত্বটুকু নিয়েছেন—ব্রহ্মময়ীর ‘দাদা’ সেজেছেন। ভারী ন্যাওটা মেয়েটা।
নিচে পূজাদালানে কর্মব্যস্ততা। আজ মধ্যরাত্রে মায়ের পূজা। বাড়িসুদ্ধ সবাই সেখানে জুটেছে। শুধু দলছুট দিদিভাই এসে টুমটুম হয়ে উঠে বসেছে দাদুর পালঙ্কে। সন্ধ্যাহ্নিক শেষ হলে প্রতিদিন বৃদ্ধ ওকে বিগতযুগের গল্প শোনান। আজও তাই চলছিল। কেষ্টা—ওঁর ব্যক্তিগত খিদ্মদ্গার, মার্বেল-মেঝেতে থাপন জুড়ে বসে ঊর্ধ্বমুখে সে গল্প শুনছিল।
—তারপর? তারপর কী হল দাদু?
—তিন-দিন একটানা বৃষ্টির পর শুরু হল ঝড়! উঃ! সে কী ভীষণ ঝড়! গঙ্গার জল ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ডিহি-কলকাতার পথে-ঘাটে শুধু কাদা আর জল। সাহেবদের ব্রহাম, হ্যানসম বের হচ্ছে না, পাল্কি-বেয়ারা পথে নামতে পারছে না। পথঘাট ভোঁ-ভা! যে-যার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তখন তো এমন দোকান-বাজার ছিল না। হপ্তায় দুদিন হাট বসত গোবিন্দপুরে—বেস্পতিবার আর রোব্বার। তা হাট বসবে কোথায়? সব তো জল থৈ-থৈ! যে-যার ভাঁড়ারের চিড়ে-মুড়ি খেয়ে অথবা পেটে কিল মেরে পড়ে আছে! এমন সময় এল ঝড়! তাতেও নিস্তার নেই! সেই প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যেই হল ভূমিকম্প! আমার অল্প অল্প মনে পড়ে সে রাত্রের কথা! মনে হল—এবার সবাইকে একসঙ্গে মরতে হবে। দাদু আমাদের সবাইকে নিয়ে চৌকিতে উঠে বসেছেন। কলকল করে ঘোলা জল ঢুকছে ঘরে…
ব্রহ্মময়ী জানতে চায়, আপনারা দোতলায় উঠে এলেন না কেন?
—কী পাগল মেয়ে রে তুই! তখন কি আমাদের পাকা দালান ছিল? আমরা সবাই থাকতাম খড়ো ঘরে, আদি গঙ্গার ধারে। আমরা তখন যে খুব গরিব-
—ঐ কেষ্টদার মতো?
দিদিমণির এই বোকার মতো প্রশ্নে দারুণ লজ্জা পেয়ে কেষ্টা মুখটা লুকায়। কানটা কিন্তু সজাগই থাকে। কর্তা-মশাই হাসতে হাসতে বলেন, না রে! কেষ্টা তো পাথুরেঘাটা ঠাকুরবাড়ির পেয়াদা—মস্ত বড়লোক—গায়ে পিরান চরায়! আমাদের অবস্থা ছিল আরও খারাপ!
—তারপর? তারপর?
—সব কথা তো আমার মনে নেই। তখন আমার বয়স এই তোর মতো। পরে শুনেছি। সাহেবদের গীর্জার মাথাটা ভেঙে গেসল; গোবিন্দরামের নবরত্নমন্দিরের চূড়োটাও গেল ভেঙে! কত লোক যে ডুবে মরে গেল, কত বাড়ি ভেঙে পড়ল তার আর লেখা-জোখা নেই!
দর্পনারায়ণ বর্ণনা করছিলেন 1737 খ্রীষ্টাব্দের সেই ঐতিহাসিক দিনটির : এগারোই অক্টোবর। তখন তাঁর বয়স ছয়-সাত! তার ঐতিহাসিক বিবরণ পাব ‘অনারে জন কোম্পানির গুড ওল্ড ডেজ’-এ!
হলওয়েল-সাহেব বলেছিলেন মৃতের সংখ্যা তিন লক্ষ। সেটা নেহাৎই বাড়াবাড়ি হলওয়েল-এর বদ-অভ্যাস সব কিছুই বাড়িয়ে বলা। অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে কলকাতার লোকসংখ্যাই এক লাখের কম। তবে হ্যাঁ—বিশ-ত্রিশ হাজার মানুষ ভেসে গেছিল নিশ্চয়। গঙ্গার জলস্ফীতি হয় প্রায় চল্লিশ ফুট! সমকালীন Gentleman’s Magazine-এ প্রকাশিত সংবাদে বোঝা যায় যে, কয়েক হাজার নৌকা ডুবে যায়, অন্তত বারোখানি বড় জাহাজও ডুবে যায়। কলকাতার ইতিহাসে এতবড় প্রাকৃতিক দুর্বিপাক আর কখনো হয়নি। প্রমথনাথ মল্লিকের ‘কলকাতার কথা’ অনুযায়ী “ঝড় থামিবার পর জলমগ্ন জাহাজের গর্ভ হইতে মাল উদ্ধার করিবার চেষ্টা হয়। একে একে তিনজন ডুবুরি নামিয়া গেল, কিন্তু তাহারা আর ফিরিল না। শেষে দেখা যায় যে,এক প্রকাণ্ড কুম্ভীর সেই ডেকের মধ্যে উহাদিগকে জলপান করিয়াছে! পরে উহাকে বধ করিলে উহার উদর মধ্যে হইতে তাহাদের মৃতদেহ দেখিতে পাওয়া যায়।” শুধু কলকাতা নয়, সমগ্র দক্ষিণবঙ্গই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। পর বৎসর রাঢ় অঞ্চলে হয়েছিল অজন্মা ও দুর্ভিক্ষ।
গল্পে বাধা পড়ল। নিভাননী দ্বারের প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। অবগুণ্ঠনে মুখটি আবৃত করে। কর্তার সামনে সে প্রকাশ্যে কথা বলবে না; তাই কেষ্টাকে উঠে গিয়ে কানে-কানে শুনতে হল। কেষ্টা পরিচারিকার বার্তাটিকে বাঙ্ময় করে তোলে, দিদিমণি, বড়মা ডাকছেন। এবার আকাশ-পিদিম তোলা হবে। ছাদে এস!
ব্রহ্মময়ী তার বেড়াবেণীবাঁধা মাথা দুলিয়ে প্রতিবাদ করে, আমি যাব না! আমি যে এখন গপ্পো শুনছি!
দর্পনারায়ণ ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজী করান। কার্তিক মাস ভর ভদ্রাসনের শীর্ষে আকাশ প্রদীপ জ্বালাতে হয়; যাতে স্বর্গত পূর্বপুরুষেরা পথ চিনে এসে তাঁদের অধঃস্তন পুরুষদের আশীর্বাদ করতে পারেন। প্রদীপটি যখন কপিকলের সাহায্যে বংশদণ্ডের শীর্ষে ওঠানো হয় তখন পরিবারের সকলে গৃহশীর্ষে সমবেত হয়ে পূর্বপুরুষদের প্রণাম করেন। এটাই প্রথা। কিন্তু ব্রহ্মময়ীর যুক্তি অন্য জাতের : আজ তো এ-বাড়ির ছাদে শত শত প্রদীপ! দাদুর বাবা-দাদাদের আজ আকাশ-পিদিম দরকারই হবে না! দর্পনারায়ণ তত্ত্বটা ওকে বুঝিয়ে দেন। রাজী করান।
ব্রহ্মময়ী ছাদে উঠে গেলে বৃদ্ধ আবার অতীত কালের স্মৃতিচারণে অবগাহন স্নান করতে থাকেন। এখন তিনি উত্থানশক্তিরহিত—গৃহশীর্ষে যাবার ক্ষমতা নাই। তাই এখানেই বসে বসে উদ্দেশ্যে প্রণাম করেন, প্রপিতামহকে,—পিতামহ, পিতা এবং জ্যেষ্ঠাভ্রাতাকে।
জ্যেষ্ঠাভ্রাতা নীলমণি স্বর্গে গেছেন মাত্র দুই বৎসর পূর্বে।
এককালে সম্পত্তি নিয়ে মনোমালিন্য হয়ে ছিল বটে; কিন্তু পৃথগন্ন হবার পর দু-ভায়ে সম্প্রীতি হয়েছিল পুনরায়। জয়রাম প্রয়াত হয়েছিলেন পলাশী যুদ্ধের পূর্ব বৎসর। তখন তাঁরা ‘ধনসায়রে’ বাস করতেন। অর্থাৎ বর্তমানে যেখানে ধর্মতলা স্ট্রীট এসে পড়েছে এসপ্লানেডে। দর্পনারায়ণের পিতৃদেব এবং খুল্লতাত তাঁদের আমলেই আদিগঙ্গার ধারের পর্ণকুটীর ত্যাগ করে সরে আসেন ‘ধনসায়র’-এ। দুই ভাই-জয়রাম আর রামসন্তোষের সদ্ভাব ছিল আজীবন,ছিলেন একান্নবর্তী পরিবারভুক্ত হয়ে। জয়রামের মৃত্যু-বৎসরে সিরাজউদ্দৌলা আক্রমণ করে বসে শহর কলকাতা। তখন সিরাজের তোপের মুখে যেসব বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার ভিতর ছিল ওঁদের ভদ্রাসন। পলাশীর যুদ্ধের পর মীরজাফর সিরাজের সেই ‘হঠকারিতার প্রায়শ্চিত্ত করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ নবাবের তহবিল থেকে কলকাতা-ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ দিতে হয় ইংরেজ বেনিয়া কোম্পানিকে। ঠাকুর পরিবারও পেলেন খেশারৎ। সে অর্থে ধনসায়রের ভদ্রাসন মেরামত করার উদ্যোগ করতে করতেই এসে গেল ক্লাইভের ফতোয়া। সেটা 1758 খ্রীষ্টাব্দ। হুকুমনামা অনুযায়ী জানা গেল, ইংরেজ লালদীঘির ধারে ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ বানাতে উদ্যোগী। সেই কেল্লার চৌহদ্দির মধ্যে যেসব ‘জেন্টু’-র ভদ্রাসন পড়েছে তাদের অন্যত্র সরে যেতে হবে। এজন্য তারা ক্ষতিপূরণও পাবে।
এইসময় দুই ভাই—পরবর্তী জমানার নীলমণি আর দর্পনারায়ণ—সরে আসেন পাথুরিয়াঘাটায়। গড়ে তোলেন নতুন একটি মোকাম। মাঝারি আকার। কিন্তু তাতেই নির্বিবাদে বাস করতে থাকেন দুই ভাই—একান্নবর্তী হয়ে।
কেটে গেল এক দশক। তারপর নীলমণি ঠাকুর কোম্পানির দেওয়ানী কাজ পেয়ে চলে গেলেন উড়িষ্যায়। কালেক্টারের সেরেস্তাদার হিসাবে। তাঁর পরিবার রয়ে গেল পাথুরিয়াঘাটায়। এ কাজে নীলমণি প্রচুর অর্থোপার্জন করেন। দর্পনারায়ণ সে সময় ছিলেন ইংরেজ হুইলারের দেওয়ান। তিনিও প্রচুর অর্থোপার্জন করেন। অর্থই নাকি সকল অনর্থের মূল! মনোমালিন্য দেখা দিল। বিষয়-সম্পত্তি ভাগ হয়ে গেল। নগদ এক লক্ষ টাকা নিয়ে নীলমণি পাথুরিয়াঘাটার এজমালি বাড়ি ও দেবোত্তর সম্পত্তির উপস্বত্ব দর্পনারায়ণকে লিখে দিলেন। ততদিনে তিনি আবার ফিরে এসেছেন ডিহি-কলকাতায়। জোড়াবাগানের বৈষ্ণবচরণ শেঠের কাছ থেকে এক বিঘা জমি ক্রয় করেন জোড়াসাঁকোতে। নির্মাণ করেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। নির্মিত হল সেই স্বনামখ্যাত—‘দক্ষিণের বারান্দা’।
দর্পনারায়ণও পাথুরিয়াঘাটার মোকামটিকে রূপান্তরিত করলেন প্রাসাদে।
এইসব পুরানো দিনের কথাই বসে বসে চিন্তা করেন দর্পনারায়ণ। তৈলচিত্রগুলির দিকে নির্নিমেষ-নেত্রে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। প্রাসাদশীর্ষ থেকে ভেসে এল শঙ্খধ্বনি। অর্থাৎ আকাশ-প্রদীপ উঠে গেল কার্তিক অমাবস্যার অন্ধকার আকাশে।
দর্পনারায়ণ যুক্তকর ললাটে স্পর্শ করালেন।
.
গোপীমোহন চিন্তিতমুখে বসেছিলেন বার-মহলে। বৈঠকখানায়। হুঁকো-বরদার রূপোর আলবোলায় তামাক সাজিয়ে দিয়ে গেছে, ফরসির নলটা ওঁর হাতে ধরা। কিন্তু টান দিচ্ছিলেন না। কুঞ্চিত ভূভঙ্গে তিনি চিন্তা করছিলেন—সংবাদটা কীভাবে বাবামশাইকে বলবেন? প্ৰায় দেড়-কুড়ি বয়স, সুন্দর সুগঠিত যুবাপুরুষ। সমকালীন প্রথা অগ্রাহ্য করে এই পীরালী ব্রাহ্মণটি একপত্নিক। একটিমাত্র সন্তান—কন্যা ‘ব্রহ্মময়ী’। বড় আদরের। কন্যার নামটি তাঁর দেওয়া। বিচিত্র হেতুতে। এমন নাম এ পরিবারের পক্ষে অপ্রত্যাশিত। তাঁর পিতৃকুল শাক্ত—মেয়েদের নাম হয় তারা, কালী, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, জগদ্ধাত্রী। মাতৃকুল বৈষ্ণব—সে তরফে মেয়েদের নামগুলি লক্ষ্মী অথবা শ্রীরাধিকার ছায়া দিয়ে গড়া; যেমন তাঁর নিজের নামটি দাদামশায়ের দেওয়া। গোপীমোহন দুই–কুলের সমঝোতা করতেই এমন একটি নাম বেছে নিয়েছেন—এটাই ছিল সকলের বিশ্বাস। বাস্তবে তিনি নামটি চয়ন করেছিলেন সম্পূর্ণ অন্য হেতুতে। একটি কিশোরবয়স্ক ক্ষণজন্মা তার্কিকের প্রভাবে।
অপরাহ্ণকালে কবিরাজ-মশাই এসে বাবা-মশায়ের নাড়ি দেখে গেছেন। জনান্তিকে গোপীমোহনকে জানিয়ে গেছেন—আপাতদৃষ্টিতে দর্পনারায়ণকে সম্পূর্ণ সুস্থ দেখাচ্ছে বটে—তিনি উঠে বসছেন, গল্পগাছাও করছেন—কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাঁর জীবনীশক্তি তিল-তিল করে নিঃশেষিত হয়ে আসছে। যে-কোন মুহূর্তে তাঁর কর্ণমূলে ‘তারকব্রহ্ম’ নাম শোনানো শুরু করতে হতে পারে। গোপীমোহনকে পরামর্শ দিয়েছেন, শ্যামা-মায়ের নিরঞ্জন হয়ে গেলেই যেন গঙ্গাযাত্রার আয়োজন করা হয়। দৃঢ় অভিমত জানিয়ে গেছেন—এমন অবস্থায় যেন কর্তামশাইকে পূজা-দালানে কোনক্রমেই নিয়ে আসার চেষ্টা না করা হয়।
এটাই ওঁর দুশ্চিন্তার হেতু। ঠাকুরদালানে মা-কালীর মূর্তিপূজা হবে আর দর্পনারায়ণ সেখানে উপস্থিত থাকবেন না—এটা যেন চিন্তাই করা যাচ্ছে না। বাবামশাইকে রাজী করাতেই হবে। কিন্তু কীভাবে?
পূজা গভীর রাত্রে। আত্মীয়-স্বজনে ভরা বাড়ি। নিমন্ত্রিতেরা এখনো আসতে শুরু করেনি। গোপীমোহন বৈঠকখানায় একটি ইজি-চেয়ারে বসে চিন্তা করছিলেন। দ্বাররক্ষক শিউশরণ এসে নত হয়ে প্রণাম করল, জানায় দক্ষিণপাড়ার চাটুজ্জেমশাই সাক্ষাৎপ্রার্থী। তাঁর সঙ্গে আছে একটি কিশোর।
‘দক্ষিণপাড়া’ বলতে মারহাট্টা-খালের দক্ষিণ পার। সেটা আগাছা আর জঙ্গলে আকীর্ণ শৃগাল প্রচুর, খটাশ ও খরগোশ দেখা যায় সে অরণ্যে। কিছু কিছু অংশ সাফা করে মানুষে ভদ্রাসন তৈরী করছে। কারণ আছে। মানুষজন সেই জঙ্গল অতিক্রম করে আরও দক্ষিণে যায়—ঁমায়ের দর্শন লাভে। “ঁমা” অর্থে কলিতীর্থ কালীঘাট। ‘দক্ষিণপাড়া’ অঞ্চলটার বর্তমান নাম : ভবানীপুর।
গোপীমোহন তাঁদের নিয়ে আসতে বললেন। দক্ষিণপাড়ার চিরসুহৃদ চট্টোপাধ্যায় মশায়ের পরিবারের সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের দীর্ঘ দিনের সৌহার্দ্য।
এলেন ওঁরা দুজন। চিরসুহৃদ পঞ্চাশোর্ধ্ব। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। উত্তরীয়ের ফাঁক দিয়ে দীর্ঘ সামবেদী উপবীত দেখা যায়। নগ্নপদ। মাথায় কাঁচাপাকা চুলের ভিতর থেকে অকফলা পরিদৃশ্যমান, তার শেষপ্রান্তে একটি কলকে ফুল। সঙ্গে তাঁর কিশোরবয়স্ক পুত্র—তাকেও চেনেন : মদনমোহন। তার ঊর্ধ্বাঙ্গে ফাঁস-দেওয়া বেনিয়ান। মাথায় পাগড়ি। গোপীমোহন উঠে এলেন, বৃদ্ধের পদধূলি নিয়ে বলেন, আসুন, আসুন চাটুজ্জেকাকা! কী সৌভাগ্য আমার!—আজ বচ্ছরকার দিনে আপনার পদধূলি পেলাম।
চিরসুহৃদ ওঁকে আশীর্বাদ করে ফরাসের একান্তে ধূলিধূসরিত পদযুগল গুটিয়ে উঠে বসেন। মদনমোহনও গোপীমোহনের চরণবন্দনা করে উপবেশন করে।
বৃদ্ধ প্রথমেই জানতে চাইলেন, দাদার শরীর গতিক এখন কেমন আছে, গোপী?
গোপীমোহন সংক্ষেপে তা জানালেন। কবিরাজমশায়ের শেষ নিদানটা অনুক্ত রইল। ইতিমধ্যে হুঁকো-বরদার কড়ি-বাঁধা হুঁকোয় তামাক দিয়ে গেছে। চিরসুহৃদ দর্পনারায়ণের বন্ধুস্থানীয়। ফলে তাঁর সম্মুখে গোপীমোহন তাম্বাকু সেবন করলেন না আর। পরবর্তী যুগের ‘বাবু কালচারের’ প্রভাবে উচ্চ-নীচের ভেদাভেদ যেভাবে আর্থিক মূল্যায়নে নির্ধারিত হতে শুরু করে, তখনো সেই প্রবণতাটা কলকাতা সংস্কৃতিকে গ্রাস করেনি। রাধাকান্ত দেব (1783-1867) অথবা কালীপ্রসন্ন সিংহ (1840-70)-এর আমলে এ জাতীয় শিষ্টাচার পরিহার্য হয়েছিল। কিন্তু গোপীমোহন তার আগেকার জমানার মানুষ। ফরসির নলটি তিনি সরিয়ে রাখলেন।
প্রশ্ন করলেন, আপনার জামাতা বাবাজীবনের কোন সংবাদ পেলেন, চাটুজ্জেকাকা?
—হ্যাঁ, বাবা, পেয়েছি। সেজন্যই তোমার কাছে আসা।
একটু অবাক হলেন। নিরুদ্দিষ্ট জামাতা-বাবাজীবনের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে গোপীমোহনের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? পুনরায় প্রশ্ন করেন, কী ব্যাপার? সে এখন কোথায়?
—মনে হয়, কলকাতাতেই আছে। ঠিক কোথায়, তা জানি না।
—কোথায় সাক্ষাৎ পেলেন তার?
—নিজেই সে এসেছিল আমার ভদ্রাসনে। দেখা-সাক্ষাৎ করে চলে গেল আবার।
—সন্ন্যাস নেয়নি তাহলে?
—মনে তো হল না। পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে তেমন তো কিছু আশঙ্কা হল না।
—সে কেন গৃহত্যাগ করেছিল তা জানি; তা এতদিন কোথায় ছিল? কী বললে?
বৃদ্ধকে কেমন যেন অসহায় মনে হল। বলেন, শুনলুম সে নাকি হিমালয় ডিঙিয়ে তিব্বতে চলে গেসল।
—তিব্বত! সে তো অনেক দূর। দুর্গম পথ! হঠাৎ তিব্বত কেন?
বৃদ্ধ হতাশার ভঙ্গি করলেন। বোঝা গেল কারণটা তাঁর অজানা। গোপীমোহন অসহিষ্ণু হয়ে প্রশ্ন করেন, কী আশ্চর্য! আপনি তা জানতে চাননি?
চাটুজ্জে-মশাই এবার স্বীকারই করলেন, কী জান বাবা? সম্পর্কে সে আমার জামাই। কিন্তু সত্যিকথাই বলছি গোপী—ওর চোখে-চোখ রেখে কথা বলতে আমার সাহস হয় না!
তা বটে! ঐ বিচিত্র জামাতা বাবাজীবনটিকে গোপীমোহন দেখেছেন। তার বিবাহে। তখন তার বয়স বছর পনের। চাটুজ্জে-মশায়ের কন্যা উমার বয়স নয়। পরেও তাকে একবার দেখেছেন—রাধানগরে। গোপীমোহনের মাতুলালয়ে, খানাকুল কৃষ্ণনগর:সন্নিহিত ঐ রাধানগর গ্রামে। একটি সামাজিক নিমন্ত্রণ রাখতে গিয়ে ঐ কিশোরবয়স্ক ছেলেটির—যার শ্বশুরমশাই তার চোখে-চোখে তাকিয়ে কথা বলতে সাহস পান না—তার সঙ্গে কিছু জনান্তিক আলাপচারীও হয়েছে। গোপীমোহন প্রগাঢ় পণ্ডিত এবং আধুনিকমনা শুনে সেই ষোড়শবর্ষীয় জামাতা বাবাজীবন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আলাপ করতে এগিয়ে আসে। প্রসঙ্গটা ছিল হিন্দুধর্মের তথাকথিত পৌত্তলিকতার বিষয়ে। গোপীমোহন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন সেই কিশোরটির মুখে ক্রমাগত আরবী-ফার্সি উদ্ধৃতি শুনে। হাফেজ, মৌলানা রুমি, শামী.তাব্রিজ প্রভৃতির বয়েৎ শুনে। উনি নিজে ফারসি জানেন ভালই, আরবী জানেন না—যেমন ছেলেটি জানে না ইংরাজী, সংস্কৃত। কিন্তু ভাষা নয়, গোপীমোহন মুগ্ধ হয়েছিলেন তার মৌলিক চিন্তাধারায়, তার ক্ষুরধার যুক্তিতে। ঐ কিশোরটির যুক্তি তিনি মেনে নিতে পারেননি, কিন্তু খণ্ডনও করতে পারেননি। বলেছিলেন, এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসার আগে তোমাকে ভাল করে সংস্কৃত অধ্যয়ন করতে হবে।
—জানি! এবার কাশীধামে যাব তাই। শুধু সংস্কৃত নয়, ইংরাজী, ফরাসীও শিখতে হবে।
পরে শুনেছিলেন, পিতৃদেবের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় কিশোর বিদ্রোহীটি গৃহত্যাগ করে। কিন্তু তিব্বতে গিয়েছিল কেন? যা হোক, এখন শোনা যাচ্ছে ছেলেটি আবার ভারত ভূখণ্ডে প্রত্যাবর্তন করেছে। হিসাব মতো এখন তার বয়স উনিশ-কুড়ি।
গোপীমোহন জানতে চান, আপনার জামাতার আরও দুটি বিবাহ, নয়?
—হ্যাঁ, তিনটি দার-পরিগ্রহ করেছে বটে, কিন্তু প্রথমা পত্নী জীবিতা নাই। দ্বিতীয়া, বর্ধমান জিলার কুড়মন-পলাশী গ্রামের। কনিষ্ঠা আমার কন্যা, উমা।
—যা হোক, তা আমি কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
বৃদ্ধ এবার সে-কথা সবিস্তারে নিবেদন করলেন।
ওঁর বৈবাহিক রাধানগর নিবাসী রামকান্ত বাড়জ্জে—না, বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, ‘রায়’। রামকান্তের পিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদে নবাব সরকারে ‘শিকদার-এর কাজ করতেন। নবাবী খেতাব পান : ‘রায়’। তাঁর নাতি, অর্থাৎ ওঁর বৈবাহিক রামকান্ত রায়ের সঙ্গে দর্পনারায়ণ ঠাকুরের বিশেষ সৌহার্দ্য, দর্পনারায়ণই বয়োজ্যেষ্ঠ,তাঁকে শ্রদ্ধা করেন রামকান্ত। চাটুজ্জে-মশায়ের ধারণা—ওঁর জামাতা বাবাজীবন যে হঠকারিতা করে বসেছে, যে কারণে সে গৃহত্যাগী—তার সুরাহা হতে পারে, যদি রামকান্ত পুত্রকে ক্ষমা করেন। দর্পনারায়ণ কি এ বিষয়ে রামকান্তকে একটি পত্র দিতে পারেন না? পুত্রকে ক্ষমা করার অনুরোধ জানিয়ে?
গোপীমোহন বললেন না যে, তাঁর পিতৃদেবের এখন এ জাতীয় পত্ররচনার দৈহিক ক্ষমতা নেই। বরং বলেন, কিন্তু ডাকলে কি আপনার জামাই যাবে?
এতক্ষণে কিশোর মদনমোহন যোগদান করে কথোপকথনে। বলে, দিদি বলেছিলেন, ওঁর বাবা ডেকে পাঠালে উনি যাবেন।
হিসাব মতো এখন উমারানী ষোড়শী। মদনমোহন তার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। মর্মান্তিক প্রয়োজন না থাকলে সে এই বড়োদের কথায় কথা বলত না। গোপীমোহন আন্দাজ করতে পারেন ব্যাপারটা। ওঁদের প্রতিশ্রুতি দেন, এ বিষয়ে যথাকর্তব্য করা হবে।
স্থির করেন বাবা-মশায়ের জবানীতে পত্রখানি তিনিই লিখে পাঠাবেন।
নিশ্চিন্ত হলেন চাটুজ্জে মশাই।
.
সে রাত্রে অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা হল দর্পনারায়ণের।
কবিরাজ-মশায়ের নির্দেশটা মেনে নিতে হল। উপায় কী? পাথুরিয়াঘাটা- প্রাসাদের ঠাকুরদালানে মায়ের পূজা হবে, কিন্তু তখন কর্তামশাই সেখানে কুশাসনের উপর বজ্রাসনে বসে থাকতে পারবেন না। নাতনি এসে জনান্তিকে প্রশ্ন করেছিল, আপনার মনে মনে খুব কষ্ট হচ্ছে, না দাদু-ভাই?
–না রে। এটাই যে মায়ের ইচ্ছা। মা তো শুধু মৃন্ময়ী নন, তিনি যে চিন্ময়ীও বটে!
–তার মানে?
—তার মানে আমি এই পালঙ্কে বসে বসেই তাঁকে ধ্যান করব। মনে আঁকা হয়ে আছে। সে মূর্তি তো আমার
তা আছে। জয়রাম কুশারীর স্বপ্নে পাওয়া ধ্যানমূর্তি—‘হরউরে ললিতাসনে বসে আছেন জগজ্জননী। দক্ষিণ চরণ প্রলম্বিত—শতদল পঙ্কজের উপর স্থাপিত, বামপদ দক্ষিণজানুর উপর ন্যস্ত। চতুর্ভুজা মূর্তি। খড়্গ, নৃমুণ্ড, বর ও অভয়। নয়ন মুদ্রিত করলেই দেখতে পান
নাতনি যখন তাঁর শয্যায় উঠে দাদুর পাঁজর ঘেঁষে শুয়ে পড়ল তখন বৃদ্ধ বিস্মিত হয়ে বললেন, একি রে? পূজা দেখবি না?
নাতনি বললে, নাঃ।
বৃদ্ধ জানেন তার হেতুটা। বলির ঐ মর্মান্তিক দৃশ্যটি বরদাস্ত করতে পারে না দিদিভাই। তাছাড়া অত রাত পর্যন্ত কি জেগে থাকতে পারে?
বাজি পটকার শব্দ—পূজাদালানে ঢাকের বাদ্যি—তাতে নিদ্রার কোনও ব্যাঘাত হল না সপ্তমবর্ষীয়া নাতনির। দাদুর পাশে চুপটি করে শুয়েই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ল। সারাদিন দৌড়ঝাঁপ, দুরন্তপনা তো কম করেনি। কিন্তু দর্পনারায়ণের চোখে নিদ্রার কোন আভাস নেই। যত মোলায়েম ভাবেই বলে থাক, গোপীমোহনের কথায় উনি বুঝতে পেরেছেন ঠিকই—কবিরাজ-মশাই শেষ নিদান শুনিয়ে গেছেন। এখন বাঁধন ছেঁড়ার পালা। তিল-তিল করে যা সঞ্চয় করেছেন—এই প্রাসাদ, জমিদারী, আসবাব, ঘর-গেরস্থালী সব, সব পিছনে ফেলে একলা চলার পথে রওনা হবার লগ্ন ঘনিয়ে এসেছে। খেদ নেই বৃদ্ধের—যা রেখে গেলেন, অপব্যয় না করলে তা সপ্তপুরুষ নিঃশেষ করতে পারবে না। এই তো দুনিয়াদারীর নিয়ম—উপযুক্ত উত্তরাধিকারের হাতে সব কিছু সমর্পণ করে মায়ের কোলে ফিরে যাওয়া। ভরা সংসার পড়ে রইল পিছনে। গোপী, বধূমাতা, কন্যা-জামাতা, ব্রহ্মময়ী। গোপীমোহনের পুত্রসন্তান এখনো হয়নি; কিন্তু কী-বা বয়স তার? ঘর আলো করে আসবে সোনার চাঁদেরা।
ক্রমে ঘনিয়ে এল রাত্রি। গবাক্ষপথে দেখা যায়, প্রতিবেশীদের ভদ্রাসনে যেসব প্রদীপ জ্বলছিল তা একে-একে নিবে গেল। লক্ষ্য হল, প্রদীপগুলি নির্বাপিত হওয়ার আগে কেমন যেন দপ্-দপ্ করে ওঠে। উনিও কি সেভাবেই প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠবেন নিবে যাবার আগে? ঘনিয়ে এল কার্তিক-অমাবস্যা রাত্রির ঘনান্ধকার। মাঝে-মাঝে হাউই উঠে যাচ্ছে কোনও উৎসববাড়ি থেকে—নৈশাকাশে আলোকের ছটা ছড়িয়ে দিয়ে অনিবার্য নিয়তির টানে ফিরে আসছে একমুঠি ছাই! এ-ঘরেও একটি প্রদীপ জ্বলছে পিলশুজের উপর—সারারাত্রিই জ্বলে। কক্ষটা তাই আলো-আঁধারী। কেষ্টা মেঝের উপর মাদুর বিছিয়ে শুয়েছে। সারারাত সে এঘরে থাকে, কর্তার কখন কী প্রয়োজন হয়।
মধ্যরাত্রি। ঠাকুর-দালানে ঢাকের বাদ্যি প্রবলতর হয়ে উঠল ক্রমে। দর্পনারায়ণ বোধকরি কিছুক্ষণ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ঢাকের বাদ্যিতে ঘুমটা ভেঙে গেল। উঠে বসলেন শয্যায়। পদ্মাসনে। ইতিমধ্যে কক্ষের প্রদীপটিও নির্বাপিত হয়েছে। বারান্দার দেওয়াল-গিরিতে জ্বলছে মোমের বাতি। তাতেই ঘরটা আলো-আঁধারী। নিমীলিত নেত্রে দর্পনারায়ণ মায়ের ধ্যান করতে থাকেন।
কতক্ষণ নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার মতো পদ্মাসনে ধ্যানমগ্ন ছিলেন তার আন্দাজ নেই। পূজা-দালানে ঢাকের বাদ্যি নিরবচ্ছিন্নভাবে শোনা যাচ্ছে। সহসা ঘ্রাণে লাভ করলেন অদ্ভুত একটা পদ্মগন্ধ। বোধকরি ঠাকুর দালানে ওরা যে অগুরু ধূপ জ্বেলেছে তারই সৌরভ ভেসে আসছে দ্বিতলে। ধীরে ধীরে ধ্যানমগ্ন আঁখি-পল্লব দুটি উন্মীলিত হয়ে গেল। সম্মুখে অন্ধকারের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। মসীকৃষ্ণ অন্ধকারের ভিতর মায়ের স্বরূপ অন্বেষণের প্রচেষ্টা। চমকে উঠলেন বৃদ্ধ।
এ কী!
অন্ধকারের ভিতর তাঁর দৃষ্টিসম্মুখে ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠল একটি মাতৃমূর্তি!
না! এ কোন দৃষ্টিবিভ্রম নয়! স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রম নয়! চর্মচক্ষুতেই দেখছেন উনি। অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে যেন রূপান্তরিত হল ওঁর ধ্যানে-দেখা জননীমূর্তিতে।
মা দিগাঙ্গনা নন, বামস্কন্ধের উপর আঁচলের আভাস। চতুর্ভুজাও নন—দ্বিভুজা। খর্পর এবং নৃমুণ্ডকে পরিহার করে দুই হস্তে শুধু বরাভয় মুদ্রা। শয্যার অপরপ্রান্তে, একই পালঙ্কে শিবশবের উপর বসে আছেন জগজ্জননী—ললিতাসনে! জননী যেন বালিকা!
সহসা গবাক্ষ-পথে ভেসে এল এক হঠাৎ-আলোর-ঝলকানি—কোন গৃহশীর্ষ থেকে হাউই বুঝি উঠেছে অমারাত্রির অন্ধকার ভেদ করে। সেই ক্ষণপ্রভার দ্যুতিতে রহস্যভেদ হয়ে গেল বৃদ্ধের। রোমাঞ্চিত তনুদেহ শান্ত হয়ে গেল আবার।
বৃদ্ধ বললেন, দিদিভাই?
—উঁ?
—তুই ওখানে ওভাবে বসে আছিস কেন রে?
উপাধানের উপর ললিতাসনে বসে ছিল ব্রহ্মময়ী—নিথর, নিষ্পন্দ! বললে, আপনার জন্যেই তো আমি মা-কালী হয়ে বসে আছি। নইলে আপনি ধ্যান করবেন কী করে? কী পাগল মেয়ে!
নাতনিকে পাঁজর-সর্বস্ব বুকে জড়িয়ে ধরলেন বৃদ্ধ।
.