ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ৭ই এপ্রিল
নরেন্দ্র, রাখাল প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে বলরাম-মন্দিরে
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রাদি ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দে]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের বাড়িতে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন — বৈঠকখানার উত্তর-পূর্বের ঘরে। বেলা একটা হইবে। নরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল, বলরাম, মাস্টার ঘরে তাঁহার সঙ্গে বসিয়া আছেন।
আজ অমাবস্যা। শনিবার, ৭ই এপ্রিল, ১৮৮৩, ২৫শে চৈত্র। ঠাকুর সকালে বলরামের বাড়ি আসিয়া মধ্যাহ্নে সেবা করিয়াছেন। নরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল ও আরও দু-একটি ভক্তকে নিমন্ত্রণ করিতে বলিয়াছিলেন। তাঁহারাও এখানে আহার করিয়াছেন। ঠাকুর বলরামকে বলিতেন — এদের খাইও, তাহলে অনেক সাধুদের খাওয়ানো হবে।
কয়েকদিন হইল ঠাকুর শ্রীযুক্ত কেশবের বাটীতে নববৃন্দাবন নাটক দেখিতে গিয়াছিলেন। সঙ্গে নরেন্দ্র ও রাখাল ছিলেন। নরেন্দ্র অভিনয়ে যোগ দিয়াছিলেন। কেশব পওহারী বাবা সাজিয়াছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রাদি ভক্তের প্রতি) — কেশব (সেন) সাধু সেজে শান্তিজল ছড়াতে লাগল। আমার কিন্তু ভাল লাগল না। অভিনয় করে শান্তি জল!
“আর-একজন (কু-বাবু) পাপ পুরুষ সেজেছিল। ওরকম সাজাও ভাল না। নিজে পাপ করাও ভাল না — পাপের অভিনয় করাও ভাল না।”
নরেনেদ্রর শরীর তত সুস্থ নয়, কিন্তু তাঁহার গান শুনিতে ঠাকুরের ভারী ইচ্ছা। তিনি বলিতেছেন, “নরেন্দ্র, এরা বলছে একটু গা না।”
নরেন্দ্র তানপুরা লইয়া গাইতেছেন:
আমার প্রাণপিঞ্জরের পাখি, গাও না রে।
ব্রহ্মকল্পতরুপরে বসে রে পাখি, বিভুগুণ গাও দেখি,
(গাও, গাও) ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ,
সুপক্ক ফল খাও না রে।
বল বল আত্মারাম, পড় প্রাণারাম,
হৃদয়-মাঝে প্রাণ-বিহঙ্গ ডাক অবিরাম,
ডাক তৃষিত চাতকের মতো,
পাখি অলস থেক না রে।
গান — বিশ্বভুবনরঞ্জন ব্রহ্ম পরম জ্যোতিঃ ৷
অনাদিদেব জগৎপতি প্রাণের প্রাণ ৷৷
গান — ওহে রাজরাজেশ্বর, দেখা দাও ।
চরণে উৎসর্গ দান, করিতেছি এই প্রাণ,
সংসার-অনলকুণ্ডে ঝলসি গিয়াছে তাও।
কলুষ-কলঙ্কে তাহে আবরিত এ-হৃদয়;
মোহে মুগ্ধ মৃতপায়, হয়ে আছি আমি দয়াময়,
মৃতসঞ্জীবনী দৃষ্টে, শোধন করিয়ে লও।
গান — গগনের থালে রবিচন্দ্র দীপক জ্বলে।
তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে।
ধূপ মলয়ানিল, পবন চামর করে,
সকল বনরাজি ফুটন্ত জ্যোতিঃ রে।
কেমন আরতি হে ভবখণ্ডন তব আরতি,
অনাহত শব্দ বাজন্ত ভেরী রে।
গান — চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় হে।
নরেন্দ্রের গান সমাপ্ত হইল। ঠাকুর ভবনাথকে গান গাহিতে বলিতেছেন। ভবনাথ গাহিতেছেন:
দয়াঘন তোমা হেন কে হিতকারী!
সুখে-দুঃখে সব, বন্ধু এমন কে, পাপ-তাপ-ভয়হারী।
নরেন্দ্র (সহাস্যে) — এ (ভবনাথ) পান-মাছ ত্যাগ করেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভবনাথের প্রতি, সহাস্যে) — সে কি রে! পান-মাছে কি হয়েছে? ওতে কিছু দোষ হয় না! কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগই ত্যাগ। রাখাল কোথায়?
একজন ভক্ত — আজ্ঞা, রাখাল ঘুমুচ্ছেন।
ঠাকুর (সহাস্যে) — একজন মাদুর বগলে করে যাত্রা শুনতে এসেছিল। যাত্রার দেরি দেখে মাদুরটি পেতে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন উঠল তখন সব শেষ হয়ে গেছে! (সকলের হাস্য)
“তখন মাদুর বগলে করে বাড়ি ফিরে গেল।” (হাস্য)
রামদয়াল বড় পীড়িত। আর এক ঘরে শয্যাগত। ঠাকুর সেই ঘরের সম্মুখে গিয়া, কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করিলেন।
[পঞ্চদশী, বেদান্ত শাস্ত্র ও শ্রীরামকৃষ্ণ — সংসারী ও শাস্ত্রার্থ]
বেলা ৪টা হইবে। বৈঠকখানাঘরে নরেন্দ্র, রাখাল, মাস্টার, ভবনাথ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে ঠাকুর বসিয়া আছেন। কয়েকজন ব্রাহ্মভক্ত আসিয়াছেন। তাঁহাদের সঙ্গে কথা হইতেছে।
ব্রাহ্মভক্ত — মহাশয়ের পঞ্চদশী দেখা আছে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ও-সব একবার প্রথম প্রথম শুনতে হয়, — প্রথম প্রথম একবার বিচার করে নিতে হয়। তারপর —
“যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে,
মন তুই দেখ আর আমি দেখি, আর যেন কেউ নাহি দেখে।
“সাধনাবস্থায় ও-সব শুনতে হয়। তাঁকে লাভের পর জ্ঞানের অভাব থাকে না। মা রাশ ঠেলে দেন।
“সোনা গলাবার সময় খুব উঠে পড়ে লাগতে হয়। একহাতে হাপর — একহাতে পাখা — মুখে চোঙ্গ — যতক্ষণ না সোনা গলে। গলার পর, যাই গড়নেতে ঢালা হল — অমনি নিশ্চিন্ত।
”শাস্ত্র শুধু পড়লে হয় না। কামিনী-কাঞ্চনের মধ্যে থাকলে শাস্ত্রের মর্ম বুঝতে দেয় না। সংসারের আসক্তিতে জ্ঞান লোপ হয়ে যায়।
‘সাধ করে শিখেছিলাম কাব্যরস যত ৷
কালার পিরীতে পড়ে সব হইল হতঞ্চ’ ৷৷” (সকলের হাস্য)
ঠাকুর ব্রাহ্মভক্তদের সহিত শ্রীযুক্ত কেশবের কথা বলিতেছেন:
“কেশবের যোগ ভোগ। সংসারে থেকে ঈশ্বরের দিকে মন আছে।”
একজন ভক্ত কন্ভোকেসন্ (বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের বাৎসরিক সভা) সম্বন্ধে বলিতেছেন — দেখলাম লোকে লোকারণ্য!
শ্রীরামকৃষ্ণ — অনেক লোক একসঙ্গে দেখলে ঈশ্বরের উদ্দীপন হয়। আমি দেখলে বিহ্বল হয়ে যেতাম।