2 of 11

১২.০৭ গোস্বামী সঙ্গে সর্বধর্ম-সমন্বয়প্রসঙ্গে

সপ্তম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১১ই মার্চ

গোস্বামী সঙ্গে সর্বধর্ম-সমন্বয়প্রসঙ্গে

আহারের পর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট খাটটিতে বিশ্রাম করিতেছেন। ঘরে লোকের ভিড় বাড়িতেছে। বাহিরের বারান্দাগুলিও লোকে পরিপূর্ণ। ঘরের মধ্যে ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া আছেন ও ঠাকুরের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া আছেন। কেদার, সুরেশ, রাম, মনোমোহন, গিরী ন্দ্র, রাখাল ভবনাথ, মাস্টার ইত্যাদি অনেকে ঘরে উপস্থিত। রাখালের বাপ আসিয়াছেন; তিনিও ওই ঘরে বসিয়া আছেন।

একটি বৈষ্ণব গোস্বামীও এই ঘরে উপবিষ্ট। ঠাকুর তাহাকে সম্বোধন করিয়া কথা কহিতেছেন। গোস্বামীদের দেখিলেই ঠাকুর মস্তক অবনত করিয়া প্রণাম করিতেন — কখন কখন সম্মুখে সাষ্টাঙ্গ হইতেন।

[নাম-মাহাত্ম্য না অনুরাগ — অজামিল]

শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, তুমি কি বল? উপায় কি?

গোস্বামী — আজ্ঞা, নামেতেই হবে। কলিতে নাম-মাহাত্ম্য।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, নামের খুব মাহাত্ম্য আছে বটে। তবে অনুরাগ না থাকলে কি হয়? ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল  হওয়া দরকার। শুধু নাম করে যাচ্ছি কিন্তু কামিনী-কাঞ্চনে মন রয়েছে, তাতে কি হয়?

“বিছে বা ডাকুর কামড় অমনি মন্ত্রে সারে না — ঘুঁটের ভাবরা দিতে হয়।”

গোস্বামী — তাহলে অজামিল? অজামিল মহাপাতকী, এমন পাপ নাই যা সে করে নাই। কিন্তু মরবার সময় ‘নারায়ণ’ বলে ছেলেকে ডাকাতে উদ্ধার হয়ে গেল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হয়তো অজামিলের পূর্বজন্মে অনেক কর্ম করা ছিল। আর আছে যে, সে পরে তপস্যা করেছিল।

“এরকমও বলা যায় যে, তার তখন অন্তিমকাল। হাতিকে নাইয়ে দিলে কি হবে, আবার ধূলা-কাদা মেখে যে কে সেই! তবে হাতিশালায় ঢোকবার আগে যদি কেউ ঝুল ঝেড়ে দেয় ও স্নান করিয়ে দেয়, তাহলে গা পরিস্কার থাকে

“নামেতে একবার শুদ্ধ হল, কিন্তু তারপরেই হয়তো নানা পাপে লিপ্ত হয়। মনে বল নাই; প্রতিজ্ঞা করে না যে, আর পাপ করব না। গঙ্গাস্নানে পাপ সব যায়। গেলে কি হবে? লোকে বলে থাকে, পাপগুলো গাছের উপর থাকে। গঙ্গা নেয়ে যখন মানুষটা ফেরে, তখন ওই পুরানো পাপগুলো গাছ থেকে ঝাঁপ দিয়ে ওর ঘাড়ের উপর পড়ে। (সকলের হাস্য) সেই পুরানো পাপগুলো আবার ঘাড়ে চড়েছে। স্নান করে দু-পা না আসতে আসতে আবার ঘাড়ে চড়েছে!

“তাই নাম কর, সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা কর, যাতে ঈশ্বরেতে অনুরাগ হয়, আর যে-সব জিনিস দুদিনের জন্য, যেমন টাকা, মান, দেহের সুখ; তাদের উপর যাতে ভালবাসা কমে যায়, প্রার্থনা কর।”

[বৈষ্ণবধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা — সর্বধর্ম-সমন্বয়]

শ্রীরামকৃষ্ণ (গোস্বামীর প্রতি) — আন্তরিক হলে সব ধর্মের ভিতর দিয়াই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। বৈষ্ণবেরাও ঈশ্বরকে পাবে, শাক্তরাও পাবে, বেদান্তবাদীরাও পাবে, ব্রহ্মজ্ঞানীরাও পাবে; আবার মুসলমান, খ্রীষ্টান, এরাও পাবে। আন্তরিক হলে সবাই পাবে। কেউ কেউ ঝগড়া করে বসে। তারা বলে, “আমাদের শ্রীকৃষ্ণকে না ভজলে কিছুই হবে না”; কি, “আমাদের মা-কালীকে না ভজলে কিছুই হবে না।”

“এ-সব বুদ্ধির নাম মাতুয়ার বুদ্ধি; অর্থাৎ আমার ধর্মই ঠিক, আর সকলের মিথ্যা। এ-বুদ্ধি খারাপ। ঈশ্বরের কাছে নানা পথ দিয়ে পৌঁছানো যায়।

“আবার কেউ কেউ বলে, ঈশ্বর সাকার, তিনি নিরাকার নন। এই বলে আবার ঝগড়া। যে বৈষ্ণব, সে বেদান্তবাদীর সঙ্গে ঝগড়া করে।

“যদি ঈশ্বর সাক্ষাৎ দর্শন হয়, তাহলে ঠিক বলা যায়। যে দর্শন করেছে, সে ঠিক জানে ঈশ্বর সাকার, আবার নিরাকার। আরও তিনি কত কি আছেন তা বলা যায় না।

“কতকগুলো কানা একটা হাতির কাছে এসে পড়েছিল। একজন লোক বলে দিলে, এ-জানোয়ারটির নাম হাতি। তখন কানাদের জিজ্ঞাসা করা হল হাতিটা কিরকম? তারা হাতির গা স্পর্শ করতে লাগল। একজন বললে, ‘হাতি একটা থামের মতো!’ সে কানাটি কেবল হাতির পা স্পর্শ করেছিল। আর-একজন বললে, ‘হাতিটা একটা কুলোর মতো!’ সে কেবল একটা কানে হাত দিয়ে দেখেছিল। এইরকম যারা শুঁড়ে কি পেটে হাত দিয়ে দেখেছিল তারা নানা প্রকার বলতে লাগল। তেমনি ঈশ্বর সম্বন্ধে যে যতটুকু দেখেছে সে মনে করেছে, ইশ্বর এমনি, আর কিছু নয়।

“একজন লোক বাহ্যে থেকে ফিরে এসে বললে গাছতলায় একটি সুন্দর লাল গিরগিটি দেখে এলুম। আর-একজন বললে, আমি তোমার আগে সেই গাছতলায় গিছলুম — লাল কেন হবে? সে সবুজ, আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আর-একজন বললে, ও আমি বেশ জানি, তোমাদের আগে গিছলাম, সে গিরগিটি আমিও দেখেছি। সে লালও নয়, সবুজও নয়, স্বচক্ষে দেখেছি নীল। আর দুইজন ছিল তারা বললে, হলদে, পাঁশটে — নানা রঙ। শেষে সব ঝগড়া বেধে গেল। সকলে জানে, আমি যা দেখেছি, তাই ঠিক। তাদের ঝগড়া দেখে একজন লোক জিজ্ঞাসা করলে, ব্যাপার কি? যখন সব বিবরণ শুনলে, তখন বললে, আমি ওই গাছতলাতেই থাকি; আর ওই জানোয়ার কি আমি চিনি। তোমরা প্রত্যেকে যা বলছ, তা সব সত্য; ও গিরগিটি, — কখন সবুজ, কখন নীল, এইরূপ নানা রঙ হয়। আবার কখন দেখি, একেবারে কোন রঙ নাই। নির্গুণ।”

[সাকার না নিরাকার]

(গোস্বামীর প্রতি) — “তা ঈশ্বর শুধু সাকার বললে কি হবে। তিনি শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় মানুষের মতো দেহধারণ করে আসেন, এও সত্য, নানারূপ ধরে ভক্তকে দেখা দেন, এও সত্য। আবার তিনি নিরাকার, অখণ্ড সচ্চিদানন্দ, এও সত্য। বেদে তাঁকে সাকার নিরাকার দুই বলেছে, সগুণও বলেছে, নির্গুণও বলেছে।

“কিরকম জান? সচ্চিদানন্দ যেন অনন্ত সাগর। ঠাণ্ডার গুণে যেমন সাগরের জল বরফ হয়ে ভাসে, নানা রূপ ধরে বরফের চাঁই সাগরের জলে ভাসে; তেমনি ভক্তিহিম লেগে সচ্চিদানন্দ-সাগরে সাকারমূর্তি দর্শন হয়। ভক্তের জন্য সাকার। আবার জ্ঞানসূর্য উঠলে বরফ গলে আগেকার যেমন জল, তেমনি জল। অধঃ ঊর্ধ্ব পরিপূর্ণ। জলে জল। তাই শ্রীমদ্ভাগবতে সব স্তব করেছে — ঠাকুর, তুমিই সাকার তুমিই নিরাকার; আমাদের সামনে তুমি মানুষ হয়ে বেড়াচ্ছ, কিন্তু বেদে তোমাকেই বাক্য-মনের অতীত বলেছে।

“তবে বলতে পার, কোন কোন ভক্তের পক্ষে তিনি নিত্য সাকার। এমন জায়গা আছে, যেখানে বরফ গলে না, স্ফটইকের আকার ধারণ করে।”

কেদার — আজ্ঞে, শ্রীমদ্ভাগবতে ব্যাস তিনটি দোষের জন্য ভগবানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এক জায়গায় বলেছেন, হে ভগবন্‌ তুমি বাক্য মনের অতীত, কিন্তু আমি কেবল তোমার লীলা — তোমার সাকাররূপ — বর্ণনা করেছি, অতএব অপরাধ মার্জনা করবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, ঈশ্বর সাকার আবার নিরাকার, আবার সাকার-নিরাকারেরও পার। তাঁর ইতি করা যায় না।


 রূপং রূপবিবর্জিতস্য ভবতো ধ্যানেন যৎ কল্পিতং,
স্তুত্যানির্বাচনীয়তাঽখিলগুরো দূরীকৃতা যন্ময়া।
ব্যাপিত্বঞ্চ নিরাকৃতং ভগবতো যত্তীর্থযাত্রাদিনা,
ক্ষন্তব্যং জগদীশ! তদ্‌বিকলতাদোষত্রয়ং মৎকৃতম্‌।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *