তৃতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ১১ই মার্চ
দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসব
[প্রভাতে ভক্তসঙ্গে]
কালীবাড়িতে আজ শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মমহোৎসব — ফাল্গুন শুক্লা দ্বিতীয়া, রবিবার, ১১ই মার্চ, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। আজ ঠাকুরের অন্তরঙ্গ ভক্তগণ সাক্ষাৎ তাঁহাকে লইয়া জন্মোৎসব করিবেন।
প্রভাত হইতে ভক্তেরা একে একে আসিয়া জুটিতেছেন। সম্মুখে মা ভবতারিণীর মন্দির। মঙ্গলারতির পরই প্রভাতী রাগে নহবতখানায় মধুর তানে রোশনচৌকি বাজিতেছে। একে বসন্তকাল, বৃক্ষলতা সকলই নূতন বেশ পরিধান করিয়াছে; তাহাতে ভক্তহৃদয় ঠাকুরের জন্মদিন স্মরণ করিয়া নৃত্য করিতেছে। চতুর্দিকে আনন্দের সমীরণ বহিতেছে। মাস্টার গিয়া দেখিতেছেন; ভবনাথ, রাখাল, ভবনাথের বন্ধু কালীকৃষ্ণ বসিয়া সহাস্যে আলাপ করিতেছেন। মাস্টার পৌঁছিয়া ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — তুমি এসেছ। (ভক্তদিগকে) লজ্জা, ঘৃণা, ভয় — তিন থাকতে নয়। আজ কত আনন্দ হবে। কিন্তু যে শালারা হরিনামে মত্ত হয়ে নৃত্য-গীত করতে পারবে না, তাদের কোন কালে হবে না। ঈশ্বরের কথায় লজ্জা কি, ভয় কি? নে, এখন তোরা গা।
ভবনাথ ও কালীকৃষ্ণ গান গাহিতেছেন:
ধন্য ধন্য ধন্য আজি দিন আনন্দকারী,
সব মিলে তব সত্যধর্ম ভারতে প্রচারি।
হৃদয়ে হৃদয়ে তোমারি ধাম, দিশি দিশি তব পুণ্য নাম;
ভক্তজনসমাজ আজি স্তুতি করে তোমারি।
নাহি চাহি প্রভু ধন জন মান, নাহি প্রভু অন্য কাম;
প্রার্থনা করে তোমারে আকুল নরনারী।
তব পদে প্রভু লইনু শরণ, কি ভয় বিপদে কি ভয় মরণ,
অমৃতের খনি পাইনু যখন জয় জয় তোমারি।
ঠাকুর বদ্ধাঞ্জলি হইয়া বসিয়া একমনে গান শুনিতেছেন। গান শুনিতে শুনিতে মন একেবারে ভাবরাজ্যে চলিয়া গিয়াছে। ঠাকুরের মন শুষ্ক দিয়াশলাই — একবার ঘষিলেই উদ্দীপন। প্রাকৃত লোকের মন ভিজে দিয়াশলাইয়ের ন্যায়, যত ঘষো জ্বলে না — কেন না মন বিষয়াসক্ত। ঠাকুর অনেকক্ষণ ধ্যানে নিমগ্ন। কিয়ৎক্ষণ পরে কালীকৃষ্ণ ভবনাথের কানে কানে কি বলিতেছেন।
[আগে হরিনাম না শ্রমজীবীদের শিক্ষা?]
কালীকৃষ্ণ ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। ঠাকুর বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাবে?”
ভবনাথ — আজ্ঞা, একটু প্রয়োজন আছে, তাই যাবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি দরকার?
ভবনাথ — আজ্ঞা, শ্রমজীবীদের শিক্ষালয়ে (Baranagore Workingmen’s Institute) যাবে। [কালীকৃষ্ণের প্রস্থান]
শ্রীরামকৃষ্ণ — ওর কপালে নাই। আজ হরিনামে কত আনন্দ হবে দেখত? ওর কপালে নাই!