১২. মূলাজোড়
মূলাজোড় : বর্তমান রেলস্টেশন শ্যামনগরে নেমে যেতে হয়।
স্টেশানের কাছেই ব্রহ্মময়ীর কালীমন্দির। সঙ্গে দ্বাদশ শিবমন্দির। কালীর প্রতিষ্ঠা নিয়ে একটি প্রাচীন লোকগাথা আছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
এই মূলাজোড়েই আমাদের কাহিনীর অন্যতম চরিত্র ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর শেষজীবন অতিবাহিত করেন। এই গ্রামে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর প্রিয় সভাকবিকে কিছু ব্রহ্মোত্তর দান করেছিলেন। কবি সেখানে একটি ভদ্রাসন নির্মাণ করেন। তাঁর আজীবন-প্রোষিতভর্তৃকা পত্নীকে পিত্রালয় থেকে নিয়ে এসে ‘রাধানাথ’ রূপে জীবনের শেষ কয়েকটি বৎসর সানন্দে অতিবাহিত করেন।
মূলাজোড়ের অনতিদূরে রহুতা গ্রাম।
সে গ্রামের দুই পণ্ডিত আমাদের নমস্য। দুই সহোদর ভ্রাতা। জ্যেষ্ঠ রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় (জন্ম : 1840) কিশোর বয়সেই সংসারের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হওয়ায় কোনও প্রসিদ্ধ বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করতে পারেননি, কোন ডিগ্রিও পাননি। কিন্তু অসীম অধ্যবসায়ে স্বীয় প্রচেষ্টায় বাঙলা, ইংরাজী, সংস্কৃত এবং গণিতে সুপণ্ডিত হয়েছিলেন। এবং আর একটি বড় কাজ করেছিলেন : অনুজ ভ্রাতাটিকে সুপণ্ডিত করে তুলেছিলেন। অর্থভাবে নিজ জীবনে যে ইচ্ছা পূরণ হয়নি, অনুজের ভিতর তা পরিস্ফুট করে তৃপ্তি পেয়েছিলেন।
রঙ্গলাল বীরভূমে একটি বিদ্যালয়ে প্রান শিক্ষকরূপে কাজ করতেন। ডিগ্রি থাকা না-থাকা সে-আমলে বিদ্যার কোনও মানদণ্ড ছিল না। ঐ কাজ করতে করতেই 1880 সালে কলকাতায় একটি ছাপাখানা খুলে বসেন। পরে সেটি স্বগ্রামে অপসারিত করেন। দুরন্ত আত্মবিশ্বাসে ঐ ক্ষুদ্র ছাপাখানায় তিনি ছাপতে শুরু করেন বাঙলা ভাষার প্রথম ‘বিশ্বকোষ’! কী দুর্জয় সাহস! অর্থবল নাই, সাহায্যকারী বলতে একমাত্র তাঁর অনুজ। তবু তিনি ঐ বৃহৎ কাজে নেমে পড়লেন।
প্রথম খণ্ডটি সম্পাদনা করলেন তাঁর অনুজ : ত্রৈলোক্যনাথ!
হ্যাঁ, সেই আশ্চর্য মানুষটি। যাঁর কলম থেকে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ ব্যতিরেকেও জন্ম নিয়েছিল : কঙ্কাবতী, ডমরুচরিত! সমকালীন এক মহাপণ্ডিত। বিচিত্র তাঁর ব্যক্তিত্ব ও বহুমুখী প্রতিভা। দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন কলকাতা সংগ্রহশালার (ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ামের) সহকারী কিউরেটার। 1883 সালে সরকার তাঁকে বিলাতে পাঠান। প্রত্যাবর্তন করে লেখেন : ইউরোপ-ভ্রমণ। রঙ্গলাল প্রবর্তিত এবং ত্রৈলোক্যনাথ সম্পাদিত ‘বিশ্বকোষ’-এর সেই প্রথম খণ্ডের অঙ্কুর কালে মহীরূহে রূপান্তরিত হয় আর একজন মনীষীর কৃতিত্বে : নগেন্দ্রনাথ বসু।
আজও গবেষকগণ বারে বারে শরণ নেন ঐ বাইশ খণ্ডে সমাপ্ত মহাগ্রন্থের।
মূলাজোড়ের নিকটবর্তী ঝাউগাছী গ্রামে একটি প্রাচীন গড়ের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। এটি নির্মাণ করিয়েছিলেন বর্ধমানের তদানীন্তন নাবালক-মহারাজ কীর্তিচন্দ্রের জননী—বৰ্গী আক্রমণের আশঙ্কায়। অবশ্য কারও কারও মতে ঐ ধ্বংসাবশেষ একটি প্রাচীন নীলকুঠির। এবার শ্যামনগর স্টেশানের কাছে ঐ “ব্রহ্মময়ী কালীমন্দিরের উপকথাটি শোনাই : তথ্যসূত্র একটি মাত্র পংক্তি : “কথিত আছে, পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহনের সাত বৎসর বয়স্কা কন্যা ব্রহ্মময়ীর মৃত্যু হইলে তাহার শব গঙ্গার স্রোতে ভাসিতে ভাসিতে মূলাজোড়ের ঘাটে গিয়া লাগে এবং সেরাত্রে গোপীমোহন স্বপ্নাদেশ…. পাইয়া এই মন্দির নির্মাণ করেন।”[১]
[১. ‘বাঙলায় ভ্রমণ’, প্রথম খণ্ড; পূর্ববঙ্গ রেলপথের প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত, 1940]