১২ জুন, শোনিবার ১৯৭১
শহরে কলেরার প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে। দেশের অন্যান্য জায়গায় কলেরার কথা আগেই কানে এসেছে। কলকাতার শরণার্থী শিবিরে কলেরা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। মজার কথা, দেশের প্রচার মাধ্যমগুলোতে কলকাতার কলেরার কথা যতটা ফলাও করে বলা ও লেখা হচ্ছে, দেশের কলেরার ব্যাপার ততটাই চেপে যাওয়া হচ্ছে। কলেরা এখন ঢাকাতেও। সবাই সবাইকে বলছে মাছ খেয়ো না। মাছতো কবে। থেকেই খাওয়া ছেড়েছি। সেই নদীতে লাশের বহর ভেসে থাকার পর থেকেই।
টি.এ.বি.সি. ইনজেকশান নেওয়া দরকার। মিয়াকে ফোন করা হয়েছিল গতকাল। সে আজ দুপুর বারোটা নাগাদ আসবে বাসায়। মিয়া অর্থাৎ ডাঃ জহুরুল হক রেবার বড় বোনের দেবর। হেলিফ্যামিলি হাসপাতালে কর্মরত।
দশটার দিকে নিউ মার্কেটে গিয়ে ইনজেকশানের জন্য ওষুধ কিনে মার বাসায় গেলাম। টি.এ.বি.সি. দেবার জন্য মা আর লালুকে নিয়ে এলাম।
পাঁচটার সময় রুমী বলল, গাড়িটা একটু নেব আব্দু।
শরীফ বলল, আমাকে ক্লাবে নাবিয়ে দিয়ে যা।
রুমী গাড়িতে ওঠার আগে আস্তে করে বললাম, সাবধানে।
রুমী একটু হাসল আমার দিকে চেয়ে।
সন্ধ্যার আগ দিয়ে মনু এল, বললাম, রুমীততা একটু বেরিয়েছে। এসে পড়বে এক্ষুণি। যাও, ওপরে ওর ঘরে গিয়ে বস। মনু দোতলায় উঠতে না উঠতে রফিক এল। শরীফ নেই শুনে বেশিক্ষণ বসল না, আমিও চাপাচাপি করলাম না। এখন মনুর সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি।
রফিককে বিদায় দেবার জন্য দরজা খুলতেই দেখি ওয়াহেদ সাহেব ঢুকছেন শরীফের এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু! বলে উঠলাম, শরীফ যে এক্ষুণি ক্লাবে গেল। আপনারও নাকি যাবার কথা?
ভদ্রলোক থতমত খেয়ে বললেন, তাই নাকি? তাহলে ক্লাবেই যাই।
উনি চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে আমি দুদ্দাড় ওপরে উঠে এলাম। মনু আর জামী বসে বসে গল্প করছে। আমাকে দেখে মনু একটু উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসল। বললাম, কি খবর বল।
খবর আর কি! এই চলছে। বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপ ঢাকায় আসছে, আলাদাভাবে নির্দেশমত কাজ সেরে আবার চলে যাচ্ছে। আমরা ইচ্ছে করেই একদল আরেক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি না। অবশ্য দেখা-সাক্ষাৎ হয়েই যায় বন্ধুবান্ধব সব গ্রুপেই আছে।
মনু চুপ করল। আমি আর কোনো প্রশ্ন করলাম না। প্রশ্ন করা নিষেধ। বেশি জানা বিপজ্জনক। আমি অন্য প্রসঙ্গ তুললাম। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা তো খুব খারাপ।
মনু সপ্রশ্ন চোখ তুলে তাকাল। বললাম, তিন মাস থেকে উৎপাদন বন্ধ। রপ্তানি বন্ধ। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের লোন শোধ করার ক্ষমতা নেই, নতুন লোন পাবার কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না। অথচ বাজেট তৈরির সময় এসে গেল। এত ঢাকঢাক করার পরেও গভর্নমেন্ট এতটুকু কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে–মার্চ-এপ্রিলে প্রদেশের। উৎপাদনে যা ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করা কঠিন হবে। গত বছর রপ্তানি খুব ভালো হয়েছিল। এবার একেবারে গোল্লা।
মনু বলল, অথচ পাকিস্তান সরকার কি রকম দুকান কাটা নির্লজ্জ দেখুন, বলছে জাপানের কাছে যে তিন কোটি ডলার ধার পাওয়ার কথা ছিল, সেটা জাপান দেয় নি বলেই পাকিস্তান এখন ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের ধার শোধ করতে পারছে না। মনু দেখছি, দেশের হালচালের বেশ ভালো খবর রাখে।
হঠাৎ একটা আওয়াজে চমকে উঠলাম। দূরে কোথাও বোমা ফাটল বোধহয়। প্রথমটার রেশ মিলাতে না মিলাতেই আরেকটা শব্দ, তারপর আরো একটা।
আমি ছটফট করে উঠে দাঁড়ালাম। ঘড়িতে দেখলাম আটটা বাজে। কথায় কথায় এতটা সময় চলে গেছে।রুমী এখনো ফিরছেনা কেন। ঐ এক দোষ, গাড়ি হাতে পেলে হয়। সময়জ্ঞান তখন আর থাকে না। জামী রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার ধরল। আমি স্থির হয়ে শুনতে পারছিলাম না। তোমরা শোনো বলে ছাদে উঠে গেলাম।
একটু পরেই গাড়িটাকে গেটে ঢুকতে দেখলাম। তরতর করে নিচে নেমে গিয়ে নিজেই দরজা খুললাম। রুমীর মুখে কাঁচুমাচু হাসি। ধমক দিয়ে বললাম, গাড়ি হাতে পেলে হুশ থাকে না, না? ওদিকে মনু এসে বসে আছে সেই সন্ধ্যে থেকে। কোন রাস্তা দিয়ে এলি? কোনো শব্দ পেয়েছিস?
পেয়েছি। ঠিক বঝুতে পারলাম না কোথায়।
একটু পরে শরীফ বাড়ি ফিরল। বলল, ওরা ঢাকা ক্লাব সুইমিং পুলের বারান্দায় বসেছিল। উত্তরদিকে বোমা ফাটার শব্দ পেয়েছে। খুব সম্ভব রেডিও স্টেশনে ফেটেছে। কারণ ঢাকা ক্লাবের উত্তরেই রেডিও স্টেশন।
রুমী হঠাৎ বলে উঠল, না, না, রেডিও স্টেশনে না, রেডিও স্টেশনে না। নিশ্চয় ইন্টারকনে। ওখানে এখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংঙ্ক মিশনের লোকজন আর ইউনাইডেট নেশনস এর প্রিন্স সদরুদ্দিন আছে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি–বোমা ওখানেই ফেটেছে।
আমাদেরও তাই মনে হলো। ওখানে বোমা ফাটানোর যৌক্তিকতাই সবচেয়ে বেশি।
মনু উঠে দাঁড়াল, রুমীর দিকে চেয়ে, ধীর শান্ত গলায় বলল, আমরা পরশুদিন সকালে রওনা দেব।