কটক শহরে ভরতের বাসা-বাড়ির খুব কাছেই থাকেন এক বিশিষ্ট বাঙালি দম্পতি। বিহারীলাল গুপ্ত এখানকার ডিস্ট্রিক্ট জজ, শহরের সবাই তাঁকে মানা করে। এত বড় পদাধিকারী হয়েও বিহারীলাল নিজেকে আড়ালে সরিয়ে রাখেন না, তিনি অতিথি বৎসল, প্রায়ই তাঁর বাড়িতে সান্ধ্য আসর বসে, গান বাজনা হয়। অনেককেই তিনি আমন্ত্রণ জানান, শুধু কোনও উকিল-মোক্তারের সঙ্গে তিনি বাড়িতে দেখা করেন না। আদালত থেকে ফেরার পর আর আইনের কচকচি তাঁর একেবারেই পছন্দ নয়।
বিহারীলালের স্ত্রী সৌদামিনী অতি স্নেহশীলা রমণী। বাড়িতে বাবুর্চি ও দাস-দাসীর অভাব নেই, তবু তিনি প্রায় প্রতিদিনই নিজের হাতে কিছু না কিছু রান্না করেন এবং অতিথিদের ডেকে খাওয়ান। মানুষকে নিজের হাতে কিছু খাইয়ে তাঁর ভারী তৃপ্তি হয়। তাঁর পাতলা ছোটখাটো চেহারা, নিজে খুবই কম খান, কিন্তু অন্যদের খাবার জন্য বারবার জোর করেন। শুধু মানুষদের নন, পশু-পাখিদেরও খাওয়ান তিনি। ভোরবেলা উঠে ছোলা ছড়িয়ে দেন পায়রাদের জন্য। বাগানে একটি পোষা হরিণকে তিনি নিজের হাতে ঘাস খাওয়ান। এমনকী সহিসরা যখন ঘোড়াদের খড়-বিচালি খেতে দেয়, তিনি মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন।
বিহারীলাল এবং সৌদামিনী ব্রাহ্ম এবং কলকাতার ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত। সৌদামিনী এক সময় স্বর্ণকুমারী দেবীর বাড়িতে ‘সখি সমিতি’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কটকে এসেও স্থানীয় মেয়েদের নিয়ে একটি সমিতি গড়েছেন। তিনি মেয়েদের লেখাপড়া শেখা, গানবাজনা, সূচিশিল্প, ছবি আঁকার উৎসাহ দেন। তাঁর বাবহারে এমন একটা সহজ স্বাভাবিকতা আছে, যা সকলকেই আকৃষ্ট করে। নারী-পুরুষের ভেদাভেদ তিনি একেবারেই মানেন না, তাঁর বাড়িতে যেসব মেয়েরা আসে তারা যদি পুরুষদের সামনে ঘোমটায় মুখ ঢেকে, মাথা নিচু করে মাটির দিকে চেয়ে। থাকে, তিনি তাদের ধমক দিয়ে বলেন, হ্যাঁ রে, তোরা কি মাটির পুতুল, কথা বলতে পারিস না? পুরুষ মানুষদের মুখ দেখাবি না, তা হলে ভগবান তোদের এত সুন্দর মুখ দিয়েছেন কেন?
ভরতের মতন একজন সাধারণ ব্যাঙ্ককারীও এ বাড়িতে আমন্ত্রণ পায়। তার কারণ এই নয় যে সে প্রতিবেশী ও বাঙালি, এই গুপ্ত দম্পতি বাঙালি-অবাঙালির কোনও ভেদ মানেন না, উড়িষ্যার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এখানে নিয়মিত আসেন, বেশির ভাগ ওডিয়া মহিলাই সৌদামিনীর সখি সমিতির সদস্যা।
এ বাড়ির লোহার গেটের সামনে দিয়ে ভারতকে যাতায়াত করতে হয়, বিহারীলাল নিজে একদিন ভরতকে ডেকে আলাপ করেছিলেন। ভেতরে এনে বসাবার পর যথারীতি সৌদামিনী এক থালা ভর্তি খাবার দিয়েছিলেন এবং খুটিনাটি প্রশ্ন করেছিলেন। এখন ভরত দুতিনদিন না এলে সৌদামিনী হঠাৎ ভরতের ক্ষুদ্র একতলা বাড়িটিতে হানা দেন, তার রান্নাঘরে উঁকি মারেন, সারাদিন সে কী কী খেয়েছে তার ফিরিস্তি শুনে শিউরে উঠে বলেন, এই খেয়ে মানুষ বাঁচে? জোয়ান ছেলে, বিদেশ-বিভুয়ে একা পড়ে থাকা, কেউ দেখার নেই…।
চতুর্ভুজ নামে একটি লোককে রেখেছে ভরত, সে তার গৃহস্থালি সামদায় ও রান্না করে দেয়। নামের সঙ্গে তার স্বভাবের বড়ই অমিল। একটা ভুজও নাড়াচাড়া করতে তার খুবই আলস্য, এবং সে রান্নাটা খুবই খারাপ করে। সে সর্বক্ষণ শুয়ে থাকতে ভালবাসে। তবে তার প্রধান যোগ্যতা এই, সে চোর নয়।
জজসাহেবের পত্নী ভরতের বাড়ির অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে রান্নাঘরে ঢুকে চতুর্ভুজকে রান্না শেখাবার চেষ্টায় গলদঘর্ম হন, তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে আদেশ করেন, চলো, আমার বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসবে চলো!
ভরতের আপত্তি তিনি কিছুতেই শোনেন না। তাঁর এই স্নেহের অত্যাচার ভরতকে মেনে নিতেই হয়।
ভরত সম্পর্কে দুটি কৌতূহল এই গুপ্ত-দম্পতির এখনও মেটেনি। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ভাল ছাত্র হয়েও ভরত কেন এই কটক শহরে একটা ব্যাঙ্কের চাকরি করতে এল? এবং শিক্ষিত যুবক হয়েও সে কেন ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেনি?
এ দুটি প্রশ্নেরই ভরত ঠিক সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি। সে সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। বিহারীলালের বাড়িতে মাঝেমাঝেই প্রার্থনা সভা হয়, উড়িষ্যার অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিই ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন, এবং যেন সেই ধর্মের অঙ্গ হিসেবেই তাঁরা বাংলায় কথা বলেন, বাংলা গান করেন। ভরত সেই সব সভার এক কোণে বসে থাকে এবং ওড়িয়া ভদ্রলোকদের কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করে। এই গৃহে বাঙালি-ওড়িয়াদের একাত্মতা কিছুটা বিস্ময়করই বটে।
কারণ, ভরত জানে, সে তার কর্মস্থলে এবং হাটে-বাজারে ঘুরে দেখেছে, বাঙালিদের প্রতি ওড়িয়া ভদ্রলোকদের বেশ বিদ্বেষের ভাব আছে। বাঙাসিরাই তার জন্য অনেকাংশে দায়ি।
উড়িষ্যা নামে কোনও আলাদা রাজ্য নেই, তা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত। সেটা ইংরেজরা করেছে প্রশাসনিক কারণে, কিন্তু বাঙালিরা মনে করে, উড়িষ্যা যেন বাংলারই একটা অংশ। ওড়িয়াদের নিজস্ব ভাষার কোনও মর্যাদা নেই। সর্বত্র বাংলা ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সব স্কুল কলেজে বাংলা পড়ানো হয়, অধিকাংশ শিক্ষক, এমনকী প্রধান শিক্ষকরাও বাঙালি। উকিল ব্যারিস্টার-জজ-ম্যাজিষ্ট্রেট-ডাক্তারদের মধ্যেও বাঙালির সংখ্যা প্রচুর। অনেক জমিদারিও বাঙালিদের। এই বাঙালি-প্রভুত্বের বিরুদ্ধে ওড়িয়াদের ক্ষোভ জমছে দিন দিন। তারা যত শিক্ষিত হচ্ছে, ততই নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে মর্যাদাবোধ জাগছে, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির চাপে সেই মর্যাদা হারাতে তারা কিছুতেই রাজি নয়।
অবশ্য উড়িষ্যার কিছু কিছু লেখক প্রথমে বাংলা ভাষাতে সাহিত্য শুরু করেছিলেন, বাংলা সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে তাঁরা বাঙালিদের সমকক্ষ হতে চেষ্টা করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে নিজেদের ভাষায় ফিরে এসেছেন।
বিহারীলালের বাড়ির আসরে প্রায়ই আসেন মধুসূদন রাও, তিনি উড়িষ্যার একজন গণমান্য কবি। তিনি বাংলাতেও কবিতা লিখেছেন, কলকাতার পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। মধুসূদন রাও নির্বিবাদী শান্তশীল মানুষ, কিন্তু ফকিরমোহন সেনাপতি নামে আর একজন লেখকের সঙ্গে ভরতের আলাপ হয়েছে, তিনি অত্যন্ত উগ্র ধরনের। ভরতের ব্যাঙ্কের হেড ক্লার্কের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব আছে। তিনি কেঁওনঝর স্টেটের ম্যানেজার, মধ্যে মধ্যে কটুকে আসেন, তখন ব্যাঙ্কে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে যান। তিনি হাসতে হাসতে এমন সব গল্প বলেন, যার মধ্যে তীব্র বিদ্রুপ আর রাগ ঝকঝক করে।
একদিন তিনি বলেছিলেন, তাঁর অল্প বয়েসের এক কাহিনী। বালেশ্বর জেলায় গভর্নমেন্ট স্কুলে একজন শিক্ষক ছিলেন কান্তিচন্দ্র ভট্টাচার্য, তিনি পড়াতেন ওড়িয়া আর সংস্কৃত। সে ভদ্রলোক ওড়িয়া ভাষা পড়তে পারতেন মোটামুটি, কিন্তু উচ্চারণ করতে পারতেন না একেবারেই। ওড়িয়া ভাষার ন এবং ণ-এর উচ্চারণ আলাদা, বাঙালিরা মূর্ধ ণ-এর উচ্চারণ জানেই না। ওড়িয়াতে ল-এর উচ্চারণও অন্যরকম। ভটচার্যিমশাই এমন বিকৃত উচ্চারণ করেন যে তা ইসির উদ্রেক করে। তিনি হে বালকগণ’ এর বদলে বলেন ‘হে বাড় গনো’, তা শুনে ছাত্ররা হেসে গড়াগড়ি যায়।
ছাত্রদের হাসি থামানো যাচ্ছে না দেখে ভট্টচার্যিমশাই এক বুদ্ধি বার করলেন। একদিন তিনি বলেই ফেললেন, আরে বাপু, ওড়িয়া তো আর আলাদা ভাষা কিছু নয়, বাংলারই বিকৃতি মাত্র, তা হলে আর ওড়িয়া ভাষা পড়ার দরকার কী?
তিনি ঝটপট একটা পৃস্তিকা লিখে ফেললেন, ‘ওড়িয়া স্বতন্ত্র ভাষা নয়’। হেডমাস্টারও বাঙালি, তিনি সেই পুস্তিকাখানি জুড়ে দিয়ে একটা রিপোর্ট পাঠালেন ইনসপেক্টরের কাছে। সেই সময়ে স্কুল বিভাগের ইনসপেক্টর যদিও সাহেব, কিন্তু তার অফিস মেদিনীপুরে এবং সেখানকার সব কর্মচারীই বাঙালি। সবাই মিলে সাহেবকে এমনভাবে বোঝাল যে সাহেব এক সাকুলার দিয়ে দিল, বালেশ্বর গভর্নমেন্ট স্কুলে শুধু সংস্কৃত আর বাংলা পড়ালেই চলবে, ওড়িয়া পড়াবার দরকার নেই। উড়িষ্যার শিক্ষা বিভাগে উচ্চপদস্থ সব কর্মচারীই বাঙালি, সবাই বলল, ঠিক ঠিক। শুধু সরকারি স্কুলে কেন, সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতেও ওড়িয়া ভাষা তুলে দেওয়া হোক।
এইভাবে ওড়িয়া ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার চক্রান্ত চলেছিল।
ছাত্ররাও তখন এর প্রতিবাদ করেনি। কারণ ওড়িয়া ভাষা তখন দ্বিতীয় ভাষা হিসেবেও বাধ্যতামূলক ছিল না। পাস করার কোনও কড়াকড়ি নেই, তা বলে আর শুধু শুধু পড়তে যাওয়া কেন?
ফকিরমোহনই তখন কিছু লোককে বুঝিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সভা করে এর প্রতিবাদ জানাতে আরম্ভ করেন।
এই কাহিনী বলার সময় হঠাৎ এক সময় থেমে গিয়ে তিনি ভরতের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ওহে, তা বলে সব বাঙালির নামেই আমি দোষ দিচ্ছি না। দৈত্যকুলেও প্রহ্লাদ জন্মায়। এই উড়িষাতেই এমন বাঙালিও আছেন, যাঁদের উদ্দেশে আমি শত সহস্র প্রণিপাত করি। যেমন বাবু গৌরীশঙ্কর রায়। তিনি ‘উৎকল দীপিকা নামে পত্রিকা বার করেছেন, সেখানে প্রতি সপ্তাহে আমাদের ভাষার সমর্থনে প্রবন্ধ বার করতেন। অতি যুক্তিপূর্ণ সে সব প্রবন্ধ। তিনি আমাদের চেয়েও অনেক জোরাল ভাষায় আমাদের ভাষার পক্ষ নিয়ে লিখেছেন। তাঁর ভাই রামশঙ্কর রায় ওড়িয়া ভাষায় নাটক লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন।
উড়িষ্যার মানুষজনকে ভরতের বেশ ভাল লাগে। বেশির ভাগ মানুষই অতিথিপরায়ণ এবং ব্যবহারে আন্তরিক। ভরত সবাইকে কথায় কথায় জানিয়ে দেয়, তার জন্ম আসামে। স্থানীয় প্রতিপত্তিশালী বাঙালিরা যখন ওড়িয়াদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, তখন ভরত মানুষের চরিত্রের একটা বিচিত্র দিক দেখতে পায়।
শাসক ইংরেজরা এ দেশের মানুষদের অপমান করে কথায় কথায়। বাঁদর কুকুর এসব বলতেও ছাড়ে না। বাঙালিরা অন্যদের তুলনায় শিক্ষা-দীক্ষায় যতই এগিয়ে থাকুক, তবু তারা ইংরেজদের কাছে অনুগ্রহ-ভিখারি। ইংরেজরা অপমান করলে তারা গায়ে মাখে না, লাথি মারলেও হে-হে করে হাসে। সেই বাঙালিরাই আবার নিজের দেশের মানুষদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে যখন তখন। এমন ভাব দেখায়, যেন তারা সকলের চেয়ে উঁচুতে। যে-বাড়িতে অনেক দাস-দাসী, সেখানে পুরনো ভূতেরা প্রভুর সামনে হাত-জোড় করে তোষামোদ করে, প্রভু লাথি কষালেও সেটাকে মনে করে অনুগ্রহ, আবার সেই ভৃত্যরাই নতুন ভূতাদের দেখলে দাঁত খিচোয়, লাথি-ঝটা মারে।
উড়িষ্যাবাসীদের ভরত নিজের আত্মীয়ের মতন মনে করে। এটা যে ভুমিসূতার দেশ। ভুমিসূতার সন্ধানেই তো সে সাত বছর আগে বাংলা ছেড়ে এতদূরে এসেছিল। কলকাতায় তন্নতন্ন কবে খুঁজেও ভূমিসুতার সন্ধান না পেয়ে সে ভেবেছিল, হয়তো রাগে-অভিমানে ভূ সুতা ফিরে গেছে উড়িষ্যায়।
কিন্তু এখানেই বা কোথায় তাকে খুঁজে পাবে ভরত। সে তো বাড়ি বাড়ি ঢুকে দেখতে পারে না। কয়েক মাস ধরে কটক, পুরী, বালেশ্বর এই সব জায়গায় ঘুরেছে। শেষপর্যন্ত সে ক্লান্ত, রিক্ত, ক্ষুধার্ত অবস্থায় পুবীর মন্দিরের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। কেউ তাকে তোলেনি, কেউ তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। মন্দিরের সামনে কত অনাথ-আতুর কুষ্ঠরোগী-পাগল থাকে, কে কার দিকে তাকায়। দু চারজন পুণ্য সঞ্চয়কারী তার অজ্ঞান অবস্থাটাকে ভিক্ষের নতুন ঢং ভেবে একটা-দুটো পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে গেছে।
ভিক্ষেটাকেই জীবিকা করতে হয়নি অবশ্য। নিছক বেঁচে থাকার জন্য সে পোস্ট অফিসের সামনে গিয়ে বসে থাকত, লোকের মানি অর্ডার ফর্ম লিখে দিয়ে একটা করে পয়সা নিত। কলকাতার তুলনায় এ অতি শস্তার দেশ, দিনে দশবারো পয়সা উপার্জন করলে দিব্যি দুবেলার আহার জোটানো যায়। মন্দিরের চাতালে শুয়ে থাকার কোনও নিষেধ নেই।
ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে। এইভাবে চলেছিল এক বছর। কলকাতায় না গিয়ে সে পুরীতেই পড়ে রইল এই আশায় যে, দৈবাৎ তো ভুমিসূতার সঙ্গে দেখা হয়েও যেতে পারে। কত মানুষই তো জগন্নাথ মন্দিরে পূজা দিতে আসে। ভূমিসুতার যদি ইতিমধ্যে অন্য কারুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়, তাতেও দুঃখ নেই ভরতের। সে শুধু ভূমিসূতার কাছে একবার ক্ষমা চাইতে চায়। ভূমিসূতার মর্মে গভীর আঘাত দিয়েছে সে, নিজে পুরুষ হয়ে সে পৌরুষের মর্যাদা রাখেনি। ভুমিসূতাকে সে নিজের জীবনসঙ্গিনী করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েও সে তাকে তুলে দিতে চেয়েছিল শশিভূষণের হাতে। এ কি কোনও পুরুষ মানুষের কাজ! কিন্তু তখন যে ভারতের মাথার ঠিক ছিল না। ভূমিসূতার কাছে একবার অন্তত ক্ষমা চাইতে না পারলে সে কিছুতেই শাস্তি পাবে না।
কিন্তু দেখা হল না এত প্রতীক্ষার পরেও।
পুরীতেই এক ভদ্রলোক তাকে ব্যাঙ্কের চাকরির প্রস্তাব দেয়। শুধুমাত্র ভরতের হাতের লেখা দেখেই তিনি কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। এমন পাকা যার ইংরিজি লেখা, সে কেন এই সামান্য কাজ করে? কটকে নতুন ব্যাঙ্ক ভোলা হচ্ছে, ইংরিজি জানা লোক দরকার, মোটামুটি স্কুল-পাস হলেই চলে, হাতের লেখাটি ভাল হওয়া চাই। কলকাতায় আর ফিরবেই না, ভরতু ঠিক করে ফেলেছিল, তাই সে চাকরিটা নিয়ে নিল।
এই বছরেই চাকরিতে তার বেশ উন্নতি হয়েছে, সে এখন প্রধান হিসাবরক্ষক। কটকে বেশ কিছু লোকের সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছে তার। গুপ্তদের বাড়িতে সান্ধ্য আসরে তার যোগ দিতে ভান্স লাগে। বিহারীলাল যদিও ইংরেজদের মন জুগিয়ে চলেন, কিন্তু উড়িষ্যার সাধারণ মানুষদের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখান না। তিনি অন্য বাঙালিদের মতন নন।
বিহারীলাল ও সৌদামিনী মাঝে মাঝে ভরতের ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেবার ব্যাপারে ইঙ্গিত করেন, ভরত গা করে না। ধর্ম সম্পর্কে তার আকর্ষণই নেই, সুতরাং এক ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্ম গ্রহণের যৌক্তিকতা খুঁজে পায় না সে। ছোটবেলায় সে শশিভূষণের সঙ্গে একবার ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের চেম্বারে গিয়েছিল। তিনি ভরতকে বলেছিলেন, এই ছোঁড়া, সব সময় এইটা মনে মনে গুনগুন করবি, ‘পঞ্চভূতের ফাঁদে, ব্ৰহ্ম পড়ে কাঁদে! কী ভেবে মহেন্দ্রলান্স এই কথাটা বলেছিলেন, তা ভরত জানে না। কিন্তু এই লাইনটা তার মনে গেঁথে গেছে। শরীরের ফাঁদ থেকে ব্রহ্মেরও মুক্তি নেই? তা হলে আর ব্রহ্মের বন্দনা করা কেন?
ভরত পাটনা থেকে ফিরে আসার পর একদিন সৌদামিনী বললেন, ভরত, তুমি গান জান না? এবারের আঘোৎসবে আমরা রবিবাবুর বাল্মীকি প্রতিভা নাটক করব ঠিক করেছি। পুরুষ গায়কের বড় অভাব। তুমি গলা দাও না!
ভরত লজ্জা পেয়ে প্রবল ভাবে মাথা নাড়ে। গান তার গলায় আসে না। প্রকাশ্যে গান গাইবার তো প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু সৌদামিনী ছাড়বেন কেন? তাঁর মাথায় যখন যে ঝোঁক চাপে, সেটা তিনি করবেনই। তিনি জোর করে ভরতকে এক দস্যুর ভূমিকায় রিহার্সালে বসালেন। গান শেখাবেন বিহারীলাল, তিনি নিজে অভিনয় করবেন না যদিও। জজ সাহেবের পক্ষে মঞ্চে অভিনয় মানায় না। ভারতের গলায় সুর ওঠে না, তবু বিহারীলালের অসীম ধৈর্য, তিনি শিখিয়েই ছাড়বেন।
প্রথম কয়েকদিন না-না বললেও পরে ভরত বেশ মজা পেয়ে গেল। ১নং দস্যুর গান খুব সুরেলা হলেও চলবে। সব্বাই মিলে মহড়া দেবার সময় বেশ হাসি-মস্করা হয়, এসব ভরতের পক্ষে নতুন অভিজ্ঞতা।
নারী-ভূমিকায় স্থানীয় ডাক্তার ও মাস্টার মশাইয়ের দুটি বাঙালি মেয়ে পাওয়া গেছে, অন্যরা ওড়িয়া মেয়ে। সবাই বাংলা বেশ ভাল বলে। এদের মধ্যে এক বালিকা ও সরস্বতী, এই দুই ভূমিকায় যে মেয়েটি মহড়া দিচ্ছে, তার উচ্চারণ ও কণ্ঠস্বর দুইই চমৎকার। মেয়েটির নাম মহিলামণি। সে বালবিধবা। উড়িষ্যায় বিধবাবিবাহের চল হয়নি, নইলে তাকে রমণীরই বলা উচিত। সে কিছু লেখাপড়া শিখেছে, বাবহারেও বেশ সপ্রতিভ, শরীরে লাবণ্য আছে। মহিলামণি এখানকার সখি সমিতির সহকারি পরিচালিকা, সে এই গুপ্ত পরিবারেই দিনের অনেকখানি সময় কাটায়। সৌদামিনী তাকে নিজের কন্যার মতন ভালবাসেন।
মহড়া দিতে দিতে বিহারীলাল বললেন, প্রথম আমি যখন ঠাকুর বাড়িতে এই নাটকের অভিনয় দেখি, তাতে সত্যেন্দ্রনাথ, রবিবাবু সবাই অভিনয় করেছিলেন। হিরোইন হয়েছিল সত্যেনবাবুর আর এক ভাইয়ের মেয়ে, তার নাম প্রতিভা, যেমন তার রূপ, তেমনই গানের গলা। সেই প্রতিভার নামেই তো বাল্মীকি প্রতিভা। সত্যি বলব, আমাদের মহিলামণি যেন সেই প্রতিভাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে অভিনয়ে।
মহিলামণি হাসতে হাসতে মাথা দুলিয়ে বলে, মামাবাবু, আপনি অত বাড়িয়ে বললে কিন্তু পার্ট করব না।
বিহারীলাল বলেন, না গো, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। তোমার মাসিমা সে অভিনয় দেখেননি, না হলে তিনিও স্বীকার করতেন।
দস্যুসর্দার বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করছে সরকারি স্কুলের অঙ্কের মাস্টার হেরম্বচন্দ্র দাস। সে বলল, ইয়োর অনার, আমার পার্টটা সেই তুলনায় কেমন হচ্ছে বললেন না তো!
বিহারীলাল বললেন, তোমারও বেশ ভালই হচ্ছে। কিন্তু সেদিনে বাল্মীকির ভূমিকায় নেমেছিলেন রবিবাবু। তাঁর সঙ্গে তো আর তোমার তুলনা করতে পারি না। তিনি যে সরস্বতীর বরপুত্র।
কয়েকদিন পর রিহার্সালে নতুন করে উৎসাহ সঞ্চারিত হল একটি সংবাদ শুনে। স্বয়ং নাট্যকার রবীন্দ্রবাবু শিগগিরই আসছেন কটকে। বালিয়াতে ঠাকুরদের জমিদারি আছে, তিনি আসছেন সেই জমিদারি পরিদর্শনে। বিহারীবাবু সত্যেন্দ্রবাবুর বন্ধু, সেই সুবাদে রবীন্দ্রবাবু কটকে এসে এ বাড়িতে এসেই উঠবেন।
নাট্যকারকে এই গোষ্ঠীর অভিনয় দেখানো যাবে বলে দারুণ ভাবে রিহার্সাল চলতে লাগল প্রতিদিন। ব্যাঙ্কের কাজকর্ম সেরে আসতে ভরতের এক একদিন একটু দেরি হয়ে যায়, তার জন্য সে সৌদামিনীর কাছে বকুনি খায়। বিহারীলালের তো কোনও অসুবিধে নেই তিনি পাঁচটা বাজতে না বাজতেই আদালতে শুনানি মুলতুবি করে চলে আসেন। হেরম্ব মাস্টারের চারটের সময় ছুটি হয়ে যায়। কিন্তু ভরতকে যে সব হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হয়।
এরই মধ্যে একদিন ভরতের এক আশ্চর্য উপলব্ধি হল। মহিলামণি বলে যাচ্ছে সরস্বতীর পার্ট :
দীনহীন বালিকার সাজে
এসেছিনু এ ঘোর বন মাঝে
গলাতে পাযাণ তোর মন
কেন বৎস, শোন তাহা শোন।
আমি বীণাপাণি, তোরে এসেছি শিখাতে গান…
বলতে বলতে মহিলামণি একদিকে মুখ ফেরাল, সঙ্গে সঙ্গে ভরতের বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল। অবিকল ভূমিসূতার মতন তার মুখের পার্শ্বরেখা!
মহিলামণিকে ভরত প্রায় এক বছর ধরে দেখছে, তেমন সখ্য গড়ে না উঠলেও দুটি-একটি কথাও বলেছে। কখনও তো এমন মনে হয়নি। আজ মনে হচ্ছে কেন? তা হলে কি ভরত তার মুখের ঠিক এই ভঙ্গিটি আগে কখনও দেখেনি?
ইচ্ছে কবে ভরত উঠে গিয়ে অন্য জায়গা থেকেও মহিলামণিকে ভাল করে লক্ষ করল। সামনাসামনি কোনও মিল নেই, ভূমিসূতা আর মহিলামণিকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিলেও কোনও মিল পাওয়া যাবে না। কিন্তু যে-ই সে ডান দিকে মুখ ফিরিয়ে দৃষ্টি নত করছে, অমনি তাকে ভূমিসূতা বলে মনে হয়। হ্যাঁ, কোনও ভুল নেই।
তা হলে কি ভূমিসূতার সঙ্গে মহিলামণির কোনও আত্মীয়তা আছে? ওরা সম্পর্কে বোন হতে পারে। আপন বোন না হোক, মাসতুতো-পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যেও অনেক সময় মুখের মিল থাকে। মহিলামণির কাছে ভূমিসতার সন্ধান পাওয়া যাবে?
পরের দিনও ভরতের পেছতে দেরি হল। সৌদামিনী কৃত্রিম তর্জন-গর্জন করতে লাগলেন তার ওপর। ভরত সেসব কিছু শুনল না। সে দেখল, ডান দিকে মুখ ফিরিয়ে মহিলামণি একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। ঠিক যেন ভূমিসূতা তাকে কিছু বলছে নীরব ভাষায়।