1 of 2

১১. শ্মশান থেকে বাড়িতে ফিরে

শ্মশান থেকে বাড়িতে ফিরে নিজের ঘরে গুম হয়ে বসে ছিল সুদীপ। একটি মানুষ, যিনি তাকে এই পৃথিবীতে এনেছিলেন, যার সঙ্গে তার শৈশব, বাল্যকাল এবং কৈশোর কেটেছে তাকে বিদ্যুৎচুল্লীতে ঢুকিয়ে ছাই করে দিয়ে এসেও বুক ভেঙে পড়ছে না, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে না। তার বদলে বারংবার মনে হচ্ছে, ভালই হল, খুব ভাল, তিনি তো এই চেয়েছিলেন। সুদীপ নিজেকে বুঝতে চাইছিল। সে কি নির্মম হয়ে গেছে খুব? স্নেহ-ভালবাসার সুতোগুলো কি পচে গেছে? মায়ের শরীরটা ছাই হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এই কথাটা মাথায় পাক খাচ্ছিল।

কষ্টেরও কি একটা বয়স থাকে? যেই সেই সীমাটা পেরিয়ে যায় অমনি তার ধার-ভার সব লোপ পায়? যার সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক, যার জন্যে জীবন দিয়ে দেওয়া যায় সে যখন অসুস্থ হয় তখন ঝাঁপিয়ে পড়তে যে ইচ্ছে করে সেই ইচ্ছেটাকে কেন সময় ঠুকরে ঠুকরে খায়? কখন যে ভালবাসা বোঝা হয়ে দাঁড়ায় তাই বোঝা যায় না বলেই গ্লানিবোধ বড় অনুভূত হয় না। সুদীপ এই নিয়ে আর ভাবতে পারছিল না। মাকে দাহ করে এসেও তার কান্না পাচ্ছিল না। মা নেই, কোনদিন আর তার সঙ্গে দেখা হবে না এই ভাবনাটাও মাথায় আসছে না। তবে কি মানুষের মনের একটি অংশ একদম অসাড়? সম্পর্কগুলো যখন সেখানে এসে পৌঁছায় তখন এমনই হয়? এইসময় কার্তিকদা এসে জানাল তার ফোন এসেছে।

উঠতে ইচ্ছে করছিল না। কথা বলতেও না। ঠিক শোক থেকে নয়, সব মিলিয়েই কিছুই ভাল লাগছিল না তার। সুদীপ বাইরে এসে ফোন ধরতেই জয়িতার গলা শুনতে পেল, ঘুমাচ্ছিলি?

না। কি ব্যাপার?

কিছু না। বাড়িতে কেউ নেই। মা এবং বাবা বলে যাদের ডেকে এসেছি এতকাল—তারা কলকাতার বাইরে। আমি কাল ছিলাম কি ছিলাম না তার খোঁজ নেবার কেউ নেই। তোর?

আমার মানে?

কিছু বলেছে কেউ?

আমি বলাবলির বাইরে।

রেডিও শুনেছিস?

না, কেন?

খবরে বলল—ওরা কি করে খবর বানায় আজ বুঝতে পারলাম। হাসতে হাসতে আমার পেটের নাড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছিল। তবে আমরা যা চেয়েছি তাই হয়েছে।

হঠাৎ সচকিত হল সুদীপ, ইটস অলরাইট। সামনাসামনি দেখা হলে এ ব্যাপারে কথা বলব।

তোর মাথায় ওষুধ দিয়েছিস?

ভুলে গিয়েছিলাম। ছাড়ছি।

ভুলে গিয়েছিলাম! মানে? ডোন্ট টেক রিস্ক সুদীপ। এখনই ওষুধ লাগা।

সময় পাইনি রে। বাড়িতে এসে দেখলাম মা মারা গেছেন। এইমাত্র শ্মশান থেকে ফিরছি আমরা। রাখছি, বিকেলে দেখা হবে। রিসিভারটা নামিয়ে রাখল সুদীপ।

হলঘরটায় কেউ নেই। এই ভরদুপুরে কোন শব্দও নেই। সুদীপের খিদেও পাচ্ছিল না। এখন ঠাণ্ডা জলে শরীর ড়ুবিয়ে স্নান এবং তারপর লম্বা ঘুম একমাত্র কাম্য। অবনী তালুকদারের ঘরের দিকে তাকাল সে। মায়ের শরীর বলে যা অবশিষ্ট ছিল তা চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেওয়ামাত্র ভদ্রলোক হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন। অসুস্থ অবস্থায় শ্মশান নিশ্চয় বড় ভীতিকর জায়গা। তড়িঘড়ি গাড়িতে চেপে বসেছিলেন কার্তিকদাকে ভর দিয়ে। বড় দায় চুকে গেল ওঁর। এখন ফ্রি ম্যান। কিন্তু এই বয়সে এত বড় বাড়ি, প্রচুর টাকা (আয়কর বিভাগ তছনছ করার পরও), ভদ্রলোক বোধহয় কখনই একা বোধ করবেন না। টেবিলের পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে আজকের কাগজটা তুলল সে। না, কোথাও নতুন খবর নেই। ভারতবর্ষে রোজ যা হয়ে থাকে তাই ছাপা হয়েছে পাতায়। সেই কংগ্রেসের ঝগড়া, সি পি এমের হুঙ্কার, রেগনের বিবৃতি, রাজীবের প্রশস্তি। একবছর আগের কাগজটা যদি হুবহু ছেপে আজ বের করা হত তাহলে কোন প্রভেদ বুঝতে পারত না কেউ। জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন রাজীব। তার নিচেই সংবাদদাতা লিখেছেন কোন একটা কেন্দ্রীয় অফিসের সদর দপ্তর কি বিহারে উঠে যাবে কলকাতা ছেড়ে। যেন বিহার আর একটা দেশ! দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ছোট্ট একটি সংবাদ আছে। নকশালপন্থী সন্দেহে চারজন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছে জনসাধারণ। পরে পুলিশ আরও দুজনকে গুলি করে মেরেছে। ঠোঁট কামড়াল সুদীপ। ঘেয়ো কুকুর, কুখ্যাত ডাকাত, নারীধর্ষণকারী লম্পট আর নকশালদের মধ্যে যেন কোন ফারাক নেই–এমন ভাব সংবাদদাতার। আনন্দ এই দেশের মানুষের মনে বিবেকবোধ জাগাতে চায়, তাদের প্রতিবাদ করার রাস্তাটা চিনিয়ে দিতে চায়। কাদের? যেসব ছেলেমেয়েরা একাত্তরে গুলি খেয়ে মরেছিল একটার পর একটা ভুল করে তাদের ভূমিকা ছিল তো দধীচির। কিন্তু এখনও এতবছর পবে গ্রামেগঞ্জে যারা তাদেরই অনুপ্রেরণায় কাজ করছে তারা তো মূর্তি ভাঙছে না, জোতদারের গলা কাটছে না! তাহলে তাদের ডাকাত ভাবার কি কারণ আছে? কেন তারা গ্রামবাসীর সহানুভূতি পাচ্ছে না? খবরের কাগজগুলোর ভূমিকা না হয় বোঝা গেল! সুদীপ চোখ বন্ধ করল। নিশ্চয়ই এতক্ষণে ডায়মন্ডহারবার রোডে পুলিশ গিজগিজ করছে, রিপোর্টাররা ছুটোছুটি করছে। আগামীকালের কাগজে যখন খবরটা বেরুবে তখন জনসাধারণের কি প্রতিক্রিয়া হবে?

এইসময় নার্স ভদ্রমহিলাকে অবনী তালুকদারের ঘর থেকে বের হতে দেখল সে। ওঁর হাতে কাঁচের জাগ, তাতে জলের তলানি। চোখাচোখি হতেই ভদ্রমহিলা ঘাড় কাত করে হাসলেন। সুদীপ অবাক হল। মা চলে যাওয়ার পরও ভদ্রমহিলার ছুটি হয়নি? সে দেখল নার্স তার দিকে এগিয়ে আসছেন, উনি ভাল আছেন।

কে? সুদীপের মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল।

আপনার বাবা। ডাক্তার এসেছিলেন। শক থেকে হয়েছে, রেস্ট নিতে বলেছেন।

ও।

আমি ভেবেছিলাম আজ চলে যাব। কিন্তু আপনার বাবা আরও কিছুদিন থেকে যেতে বললেন। বয়স্ক মানুষ, আর এই সময়—! তারপর মুখ ফিরিয়ে ভদ্রমহিলা, কার্তিক, কার্তিক বলতে বলতে আড়ালে চলে গেলেন।

সুদীপের এবার মজা লাগছিল। মা যতদিন বিছানায় শুয়েছিলেন ততদিন এরকম সক্রিয় ছিলেন না মহিলা। যেন হঠাৎ কর্তৃত্ব পেয়ে গেছেন এমন উজ্জ্বল হয়ে গেছে চোখমুখ।

একটু পরেই কার্তিকদা সামনে এসে দাঁড়াল, চা খাবে?

একটু পরে, স্নান করে নিই।

হবিষ্যি করবে কখন?

হবিষ্যি?

এখন তো তোমাকে তাই খেতে হবে কাজ না হওয়া পর্যন্ত।

কেন?

তাই নিয়ম, হিন্দুদের তাই করতে হয়।

আমি যা খাই তাই খাব।

কি বলছ তুমি?

তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই না কার্তিকদা। মা চলে গিয়ে যে ভাল হয়েছে তা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। আর ভাল আমাদেরও। যে মানুষটার থাকাটাই আমরা চাইছিলাম না তার চলে যাওয়ার জন্যে তোক দেখিয়ে শোক করতে হবে কেন? আমি ওসব করলে মা মোটেই সুখী হতেন না। কারণ তিনি মরে যেতে চাইতেন। তাছাড়া এতকাল হিন্দুধর্মের কোন কিছু মানলাম না, ধর্ম ছাড়াই তো বেশ বেঁচে আছি, কোন অসুবিধে হচ্ছে না, তখন আজ ধর্মের চোখ রাঙানো মানববা কেন! ওসব তুমি তোমার বাবুকে করতে বল। ভণ্ডামিটা উনি ভালই জানেন। একটানা কথাগুলো সে কার্তিকদাকে বলল না নিজেকে শোনাল তা তার কাছেই স্পষ্ট নয়।

ঘরে এসে জামাকাপড় ছেড়ে উদোম হয়ে বাথরুমে ঢুকল সে। শাওয়ারটা খুলে দিয়ে দেওয়াল আয়নার দিকে তাকাল। তার স্বাস্থ্য সুগঠিত, কোথাও মেদ নেই, মুক্ত শরীর থেকে একধরনের ভিজে আভা বের হচ্ছে। বৃষ্টির ধারার মতো জলের ফোঁটা সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে নরম আদরের মত। কিছুক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল সুদীপ। গতরাত্রে কি সহজে এই লোকটা মানুষ খুন করে ফেলল! কোনরকম প্র্যাকটিস ছাড়াই খুন করতে একটুও হাত কাঁপেনি। নিজেকে খুনী মনে হচ্ছে কি? নিজের ঠোঁটেই এক রহস্যময় হাসি দেখল সে।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল সুদীপ তা সে জানে না, কিন্তু, এমন মড়ার মত ঘুম অনেকদিন ঘুমায়নি। চোখ মেলে সে দেখল ঘরে ঘন ছায়া এবং প্রচণ্ড খিদে শরীরে। পাঞ্জাবিটা শরীরে গলিয়ে সে ব্যাগ দুটোর দিকে তাকাল। এখনও ওদুটো ভারতীয় পুলিশের কাছে আতঙ্কের বিষয়। ধরা পড়লে চূড়ান্ত ঝামেলায় ফেলতে অসুবিধে হবে না। এগুলোকে বাড়িতে রাখা উচিত নয় কিন্তু রাখার তো তেমন জায়গাও নেই। কার্তিকদাকে ডাকার জন্যে ঘর ছেড়ে বেরিয়েই সে দেখল অবনী তালুকদার ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। তার মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে নার্স কিছু কথা বলছেন। অর্থাৎ একদিনের মধ্যেই ভদ্রলোক বিছানা ছেড়ে বাইরের ঘরে আসতে সমর্থ হয়েছেন। সুদীপের সন্দেহ ছিল, এখন আরও সত্য বলে মনে হল, শরীরের বাহানা দেখিয়ে অবনী তালুকদার শ্মশান থেকে কেটে পড়েছেন। সে চিৎকার করে কার্তিকদাকে ডাকতেই অবনী তালুকদার মুখ ফেরালেন।

সুদীপ। এদিকে এসো। গলার স্বরে নখ আঁচড়ানোর শব্দ পেল সুদীপ।

সে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলছেন? হ্যাঁ। নইলে তোমায় ডাকব কেন!

সুদীপ কয়েক পা এগিয়ে যেতেই মায়ের ঘরের দরজাটা দেখতে পেল। অবনী তালুকদার সেই শূন্য ঘরের দিকে তাকিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়েছিলেন। আপাদমস্তক সময় নিয়ে দেখলেন তিনি। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, তুমি মাতৃদায়গ্রস্ত।

না, আমি মাতৃদায়মুক্ত। অবশ্য যেভাবে মা ছিলেন তাকে যদি দায় বলে মনে করা যায়।

তুমি কি বলতে চাও?

কিছু না। আপনিই বোধহয় কিছু বলবেন বলে আমায় ডেকেছিলেন।

অবনী তালুকদার ছেলের মুখের দিকে এক পলক তাকালেন। তারপর গলার স্বর নামিয়ে বললেন, তোমার মা আমার কতখানি ছিল তা তুমি জানো না। অমন সতী স্ত্রী আমি জীবনে দেখিনি। আমাদের সব অসুখ তিনি একাই ভোগ করে গেলেন। আমি তার মৃত্যু নিয়ে হইচই করতে চাইনি। পাঁচভূতে এসে চুক চুক করে সহানুভূতি জানাবার নাম করে লুটেপুটে খাবে এটা তোমার মা পছন্দ করত না। কিন্তু পুত্র হিসেবে তোমার কর্তব্য আছে। আমাদের হিন্দুশাস্ত্রে যা যা করণীয় বলে স্থির করা আছে তাই কর।

সুদীপ ঘাড় নাড়ল, মা বেঁচে থাকতে যখন কোনও কর্তব্যই আমি করতে পারিনি তখন–।

কোন্ কর্তব্য করতে পারনি?

চোখের সামনে উনি আপনার ব্যবহারে যন্ত্রণা পাচ্ছেন দেখেও আমি তাকে সেটা পেতে দিয়েছিলাম।

সুদীপ!

চিৎকার করে কথা বলবেন না। এখনও আপনার নার্সের প্রয়োজন হচ্ছে।

তুমি, তুমি আমাকে অপমান করছ! সোজা হয়ে উঠে বসলেন অবনী তালুকদার।

সঙ্গে সঙ্গে নার্স ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, আপনি এত উত্তেজিত হবেন না, আপনার এখন রেস্ট প্রয়োজন।

একটা হাত নেড়ে মাছি তাড়ালেন অবনী তালুকদার, ছাড়ো তত তোমার রেস্ট। এমন কুলাঙ্গার পুত্রের মুখদর্শন করাও পাপ। শোন, এই বাড়িতে থাকতে হলে তোমাকে অশৌচ পালন করতে হবেই। শ্রাদ্ধটা তুমি না-হয় কালীঘাটে গিয়ে করে আসতে পার কিন্তু আজ থেকে হবিষ্যি খাও গলায় কাছা নাও। দিস ইজ মাই অর্ডার।

পারলাম না।

মানে?

আপনাকে খুশী করতে পারলাম না।

আচ্ছা! দেন গেট আউট! আমি জানব আমার স্ত্রী স্বর্গে গেছেন, আমার পুত্র মারা গেছে। আমি এখন থেকে একাই থাকব, ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। তারপর নার্সের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, আমি এবার রেস্ট নেব, বুঝলে? আমার একটু ঘুম দরকার। অবনী তালুকদার ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে যেন টলে গেলেন, হাত বাড়িয়ে নার্সের কাঁধ আঁকড়ে ব্যালেন্স রাখলেন। মহিলা পরমযত্নে অবনী তালুকদারকে ঘরে নিয়ে গেলেন।

সুদীপ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। কার্তিকদা বোধহয় অবনী তালুকদারের জন্যেই এতক্ষণ সামনে আসতে সাহস পাচ্ছিল না, এবার এগিয়ে এল, ডাকছ?

না, থাক। যে জন্যে ডাকছিলাম তার আর দরকার নেই।

শোন, বাবুর ওপর রাগ করো না। তুমি তো ওঁকে জানো। সারাদিন কিছু খাওনি, একটু সরবৎ আর মিষ্টি এনে দিই। আর তোমাকেও বাপু আমি বুঝতে পারছি না। মা মারা গেলে সন্তান কাছা নেবে না?

আমার মা অনেকদিন আগে মারা গিয়েছিলেন কার্তিকদা, আজ দাহ করা হল তাকে। আমি নিজের মন থেকে যা সাড়া পাচ্ছি না তা করতে পারব না। তোমাকে আর সরবৎ আনতে হবে না। আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। যেতেই হত, ওই ভদ্রলোক যাওয়াটা সহজ করে দিলেন। সুদীপ টেলিফোনটার দিকে এগিয়ে গেল।

কার্তিকদা ছুটে এল, চলে যাচ্ছ মানে?

ঘুরে দাঁড়াল সুদীপ, আমি আর এই বাড়িতে থাকছি না। তুমি তোমার বাবুকে হবিষ্যি করতে বল।

বাবুর শরীর খারাপ, ডাক্তার পথ্য ঠিক করে দিয়েছেন।

সুদীপ হেসে ফেলল। তারপর রিসিভার তুলে নিয়ে নাম্বার ঘোরাতে লাগল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারল কার্তিকদা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। পায়ের শব্দে তার চলে যাওয়াটা টের পেল সে। তিনবার ডায়াল করেই রিসিভারটা নামিয়ে রাখল সুদীপ। কলকাতার টেলিফোন সিস্টেমটাকে নতুন করে ঢেলে না সাজালে জনসাধারণের উপকারে লাগবে না কখনই। ঠিক এইসময় নিচে বেল বাজল। সুদীপ নিজের ঘরে ফিরে এল।

চটপট ব্যাগ দুটোয় জিনিসপত্র পুরে নিল আবার। তার কাছে এখনও যা টাকা আছে সেটা এমন কিছু নয়। কিন্তু অবনী তালুকদারের ওই কথার পর আর এই বাড়িতে থাকা উচিত নয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি বোলাতে গিয়ে সে ছায়া দেখল। চমকে ফিরে সে দরজায় জয়িতাকে দেখতে পেল। জয়িতার মুখ গম্ভীর, দৃষ্টি উদ্বিগ্ন। ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কখন হল?

কাল রাত্রে। সকালেই দাহ হয়ে গেছে।

ঠোঁট কামড়াল জয়িতা। তারপর ধীরে ধীরে বিছানায় বসে মুখ নামাল।

সুদীপ জয়িতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোর কি হল?

মানে?

তুই অমন শোক-শোক মুখ করে বসে পড়লি কেন?

তোর কষ্ট হচ্ছে না সুদীপ?

আমি জানি না। সুদীপ পলকেই ঘুরে চুল আঁচড়ানো শেষ করল, হঠাৎ এলি?

খবরটা শুনে মনে হল আমার আসা উচিত। তোর মায়ের সঙ্গে অনেকদিন আগে একবার কথা বলেছিলাম, মনে আছে? সেদিন তোকে বলেছিলাম আমার মা যদি এরকম হত! জয়িতা হঠাৎ কেঁদে ফেলল। এই কান্নাটার জন্যে ও মোটেই তৈরি ছিল না। এমন আচমকা শরীর কাঁপিয়ে জল ঢেউ হয়ে নামবে চোখে তা কে জানত।

সুদীপ ঠোঁট কামড়াল, স্টপ ইট জয়, আই ডোন্ট নিড ইট।

তোর কষ্ট হচ্ছে না?

না। আমি কাঁদব না, আমি কোন নিয়ম মানব না। যে মানুষটার জন্যে জীবিত অবস্থায় কিছু করতে পারিনি তার মৃত শরীরটার কথা ভেবে চোখে জল ফেলাটা একধরনের হিপোক্রেসি। লেটাস গো। তুই এসেছিস ভালই হয়েছে। ওদের একটা খবর দেওয়া যাবে। সুদীপ ব্যাগ দুটো তুলতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।

কোথায় যাচ্ছিস? পুরো ব্যাপারটা সহজে নিতে পারছিল না জয়িতা।

এ বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে আমাকে। তুই বোস্ আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। বড় বড় পা ফেলে হলঘরে চলে এল সে। তারপর মায়ের ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল। ঘরের মেঝেতে একটা প্রদীপ জ্বলছে। একটা তীব্র গন্ধ বের হচ্ছে ধূপ থেকে। মায়ের জিনিসপত্রগুলো চোখে পড়ল না। ধীরে ধীরে আলমারিটার কাছে এগিয়ে গেল সে। হাতলটা ঘোরাতেই সেটা আটকে গেল। চাবি দেওয়া আছে। চাবিটা এতকাল মায়ের কাছে ছিল।

মায়ের ঘর থেকে সোজা অবনী তালুকদারের দরজায় চলে এল সুদীপ। অবনী তালুকদার শুয়ে আছেন। আর তার মাথার পাশে বসে নার্স রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়ে শোনাচ্ছেন। ওকে দেখতে পেয়ে ভদ্রমহিলা পড়া থামিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। তাতে মনোযোগ নষ্ট হল অবনী তালুকদারের। চোখ খুলে তিনি পুত্রকে দেখতে পেলেন। সুদীপ বলল, চাবিটা দিন।

চাবি? কিসের চাবি?

মায়ের আলমারির।

সে চাবি নিয়ে তোমার কি হবে?

আমার জন্যে কিছু জিনিস মা রেখে ছিলেন। যাওয়ার সময় সেগুলো নিয়ে যাব।

কোন জিনিস তোমার জন্যে তোমার মা রাখেননি।

ঠিক বলছেন না। বিয়ের সময় তিনি বাপেরবাড়ি থেকে যা এনেছিলেন সেটাই আমার জন্যে রাখা ছিল। আপনার দেওয়া কোন সম্পদ আমি নিতে আসিনি।

বাপেরবাড়ি থেকে এনেছিলেন? নাক দিয়ে শব্দ বের করলেন অবনী তালুকদার, তারা যে কত দেবার ক্ষমতা রাখতেন তা তোমার মা ভাল জানতেন। কিছু হবে না। কোন জিনিস তুমি এ বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। তোমাকে তিনদিন সময় দিলাম তার মধ্যেই ব্যবস্থা করো।

অত কষ্ট দেব না আপনাকে। আমি আজই চলে যাচ্ছি। কিন্তু তার আগে মায়ের আলমারির চাবিটা আমি চাই। উনি সব গয়না আলাদা করে তার উপর লিখে রেখেছিলেন কাকে কি দেবেন। যদি আমার নামে কিছু লেখা না থাকে তাহলে আমি আপনার কথা মেনে নেব।

তুমি আমাকে চোখ রাঙাচ্ছ?

না, ভদ্রভাবে অনুরোধ করছি।

যে মায়ের কাজ করতে চাইছ না তার গয়না চাইতে লজ্জা করছে না?

না। আমি কোনও অন্যায় করছি না। চাবিটা দিন।

গয়নাগুলো আমার কাছে নেই।

কোথায় আছে সেগুলো?

এখনও ইনকামট্যাক্সেই জমা আছে। কেস চলছে।

এতদিন ধরে ওরা আটকে রাখবে কেন? ওগুলো তো বেআইনী গয়না নয়।

কোন প্রমাণ নেই যে তোমার মা বাপেরবাড়ি থেকে পেয়েছিল। আমাকে তো কোনদিন দেখতে দেয়নি তাই আমার রিটার্নে ডিক্লেয়ার করাও ছিল না। আর এইসব কৈফিয়ত তোমাকে আমি দিচ্ছি কেন?

কোন্ অফিসে আপনার ইনকামট্যাক্স হয়?

কেন?

আমি সেখানে গিয়ে খোঁজ নেব।

সার্চ অ্যান্ড সিজার কেস হয় যেখানে সেখানে আমার নাম বললেই জানতে পারবে। মামারবাড়ি, উনি গেলেন আর সঙ্গে সঙ্গে ইনকামট্যাক্স ওঁকে সব খুলে দেখাবেন!

আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি খোঁজ নেব। যদি ওরা অন্য কথা বলে তাহলে আমার কোন কাজের জন্যে আমি দায়ী থাকব না। আমি আমার মায়ের নিজস্ব গয়নাগুলো চাই।

কি করবে নিয়ে?

আর যাই করি আপনার মত যক্ষ হয়ে বসে থাকব না।

সুদীপ আর কথা না বলে বেরিয়ে এল। জয়িতা দাঁড়িয়ে ছিল। ব্যাগ দুটো তুলে সুদীপ বলল, চল্।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

বাইরে বেরিয়ে বলব, এখানে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল সুদীপ। জয়িতা দেখল নিচের দরজায় দাঁড়িয়ে কার্তিকা জিজ্ঞাসা করল, কবে আসবে? সুদীপ কোন জবাব দিল না।

রাস্তায় নেমে সুদীপ যেন আচমকাই সহজ হয়ে গেল। জয়িতার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আমার খুব খিদে পেয়েছে। কাল রাত্রে আনন্দর বাড়ির পর আর খাইনি। চল, ওখানে একটা চাইনিজ দোকান আছে, পেটপুরে চাউমিন খাই।

আমার খিদে পায়নি।

তোকে খেতে বলিনি আমি। বলেই মতটা পালটাল সুদীপ, নাঃ, এখন বেশি খরচ করা উচিত হবে। এখানে আয়। ফুটপাতের ওপর একটা দোকানে খাবার বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি ভিড় আছে সেখানে। একটা বেঞ্চির কিছুটা জায়গা দখল করে সুদীপ জয়িতাকে বসতে ইশারা করে চারটে পরোটা আলুরদম আর দুটো চা দিতে বলল চেঁচিয়ে। জয়িতা লক্ষ্য করল যারা এখানে খাচ্ছে তাদের অধিকাংশই বিহারের মানুষ এবং শ্রমিকশ্রেণীর। তারা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্যান্ট পরা কোন মেয়ে এইরকম পাড়ায় ফুটের দোকানে খেতে আসতে পারে এমনটা বোধহয় ওদের কল্পনার বাইরে ছিল। সে একটু সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করল। সুদীপ ইচ্ছে করেই এখানে খাচ্ছে, চোখে লাগাবার জন্যেই, কিন্তু এই নিয়ে রসিকতা করার লোভটা সে সংবরণ করল।

খুব আরাম করে পরোটাগুলো খেল সুদীপ। তারপর চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলল, কলকাতার ধুলোয় দারুণ একটা মশলা আছে বুঝলি, তরকারির টেস্টই পালটে দেয়। আগে ভাবতাম এইসব খাবার খেলে পেট খারাপ করবে। ফোর্ট। যারা খায় না তাদের জন্যে আমার করুণা হয়। সারাজীবন পিটপিটিয়ে কাটাল তারা।

চায়ের কাপ দেখেই অস্বস্তি হয়েছিল, সুতোর মত ফাটা দাগ ওপর থেকে নিচে নেমে গেছে। চুমুক দিয়েই শরীর গুলিয়ে গেল জয়িতার। এমন অখাদ্য চা সে কখনও খায়নি। বিটকেল গন্ধ বের হচ্ছে। সে কাপটা নামিয়ে রেখে আড়চোখে সুদীপকে দেখল। দুবার চুমুক দিয়েছে সুদীপ। এবার নামিয়ে রেখে হেসে ফেলল সে, বুঝলি জয়, সময় লাগবে, রাতারাতি তো এসবে অভ্যস্ত হওয়া যায় না। তারপর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল সে, তুই তখন জিজ্ঞাসা করছিলি মায়ের মৃত্যুতে আমি কেন শোকগ্রস্ত নই, কেন বাড়ি থেকে চলে এসেছি—এইসব। ব্যাপারটা হল।

সুদীপ প্লিজ? তাকে থামিয়ে দিল জয়িতা, আমি আর কারণগুলো জানতে চাইছি না। তুই নিশ্চয়ই ভাল মনে করায় করেছিস। তোর নিজের কাছে যদি পরিষ্কার থাকে তাহলে আর কিছু বলার নেই। অতএব এই প্রসঙ্গ থাক। এখন বল, তুই কোথায় থাকবি?

অবাক হয়ে জয়িতার দিকে তাকাল সুদীপ। জয়িতা যে এমন দ্রুত নিজেকে পালটাতে পারে তা সে জানত না। কদিনের মধ্যেই মেয়েটা যেন গভীর থেকে গভীরে চলে যাচ্ছে। জয়িতা আবার জিজ্ঞাসা করল, হ করে কি দেখছিস?

কিছু না। আমি কোথায় থাকব ঠিক করে বের হইনি। ভাবছি আনন্দর হোস্টেলে চলে যাব। ওদের ওখানে গেস্ট হয়ে কিছুদিন থাকা যায়! সুদীপ পয়সা মিটিয়ে দিল।

আমার মনে হয় ওখানে তোর না থাকাটাই উচিত হবে।

কেন?

তোর আর আনন্দর একসঙ্গে থাকা উচিত নয় তাই।

সুদীপ ওর মুখের দিকে তাকাল। তারপর নীরবে মাথা নাড়ল, ঠিক বলেছিস। আমি অবশ্য আর এক জায়গায় যেতে পারি কিন্তু ওখানে গেলে দিনের বেলায় রোজ বের হওয়া যাবে না।

কোথায়?

আমার সেই বৃদ্ধা আত্মীয়ার ওখানে।

ওরা হাঁটছিল। বিকেল এখন ঘন। যে কোন মুহূর্তেই টুক করে সন্ধ্যে নেমে পড়বে। ঘড়ি দেখল জয়িতা। তারপর হাত নেড়ে একটা ট্যাকসি দাড় করাল। সুদীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই জয়িতা বলল, আনন্দ আর কল্যাণ বোধহয় অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে। ওদের

ওখানে চল, তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেব।

সুদীপ ব্যাগ দুটো দেখাল, এইগুলো নিয়ে কলেজ স্ট্রীটে যাব?

সেই জন্যেই তো ট্যাকসি নিলাম। তুই ট্যাকসিতে বসে থাকবি, আমি ওদের ডেকে আনব।

 

সংস্কৃত কলেজের সামনে ট্যাকসি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ল জয়িতা। রাস্তার আলো জ্বলে গেছে। জয়িতা ওপরে উঠে এল। এবং তখনই দুপ করে আলো নিবে গেল এই তল্লাটের। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল কফি হাউসে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে যেন এক লক্ষ শেয়াল হায়েনা ডেকে উঠল। বিরাট হলঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে খুব অসহায় চোখে তাকাল জয়িতা। তার সামনে প্রচুর মানুষ অথচ সে কারও মুখ দেখতে পাচ্ছে না। বিকট গলা করছে এক একজন। এই দঙ্গলের মধ্যে কোথাও আনন্দ এবং কল্যাণ আছে। কিন্তু সামান্য আলো না থাকলে ওদের খুঁজে বের করা মুশকিল। কখনও কখনও মানুষ কিরকম অচেনা হয়ে যায়! এইসময় বেয়ারারা মোমবাতি জ্বালাতে শুরু করল। জয়িতা চিৎকার করে আনন্দর নাম ধরে ডাকল। যতটা সম্ভব গলা তুলে সেই আওয়াজটা ছুঁড়তেই কফিহাউসের সমস্ত শব্দ আচমকা থেমে গেল। বিস্ময়ে প্রত্যেকেই ব্যাপারটা বুঝতে চাইছে। এবং তার মধ্যেই কেউ ঝটপট বলে উঠল, কোথায় তুমি চণ্ডালিকা, জল দেবে নাকি?

ঠোঁট কামড়াল জয়িতা। মুখটা দেখতে পেলে সে চড় মারতে। এবং তখনই সে কনুই-এ একটা হাতের স্পর্শ এবং টান অনুভব করল। হলের বাইরে সিঁড়ির কাছে এসে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, চেঁচাচ্ছিস কেন?

তোদের দেখতে পাচ্ছিলাম না।

আশ্চর্য! তাই বলে চেঁচাবি? আফটার অল তুই একটা মেয়ে। কথাগুলো বলল কল্যাণ।

 

ও! কোন ছেলে চেঁচালে দোষ হত না,? আই ডোন্ট থিংক–।

ঠিক আছে। আনন্দ থামিয়ে দিল, দেরি করলি কেন?

একটু আগে অন্ধকার থেকে উড়ে আসা মন্তব্য আর কল্যাণের কথাটা সমস্ত মনে জ্বালা ধরিয়েছিল জয়িতার। সেটা সামলাবার জন্যেই সে কল্যাণকে বলল, কল্যাণ, একটু চোখ খুলে তাকা। পাতি বাঙালির মত ভ্যানভেনে কথা বলা বন্ধ কর। নিচে ট্যাকসিতে সুদীপ বসে আছে আনন্দ।

ট্যাকসিতে বসে আছে কেন? আনন্দ জিজ্ঞাসা করল।

ওর সঙ্গে জিনিস আছে। তাছাড়া ও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। আজ সকালে ওর মা মারা গিয়েছেন। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে ও কথা বলতে চাইছিল না। বোধহয় বাবার সঙ্গে ঝগড়া করেছে। যাই হোক, তোরা নিচে আয়। জয়িতা কথা শেষ করে আর দাঁড়াল না।

ওরা ট্যাকসিতে উঠে এল, সুদীপ ড্রাইভারকে ধর্মতলার দিকে যেতে বলল। তারপর আনন্দর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোন খবর আছে?

না। আমি এগারোটা নাগাদ হোস্টেলে ফিরেছি। সকালটা কল্যাণদের বাড়িতে ছিলাম। এসে শুনলাম সুরথদা আমার খোঁজ করতে এসেছিল দশটা নাগাদ। গ্রাম থেকেও কোন খবর আসেনি। তুই কোথায় থাকবি?

জানি না। তোর হোস্টেলে থাকব ভেবেছিলাম কিন্তু পরে সেটা বাতিল করলাম। আমি ঠাকুরপুকুরেও যেতে পারি কিন্তু সেখানে গেলে দিনের বেলায় বেশি বের হওয়া চলবে না।

তোর আর বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়?

না।

অন্তত আজই ঠাকুরপুকুরে যাওয়া উচিত হবে না। ওদিকটায় নিশ্চয়ই পুলিস নজর রাখছে। ব্যাপারটা থিতিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত।

জয়িতা বলল, আমাদের আর একটু কেয়ারফুল হওয়া উচিত। ট্যাকসিতে এসব কথা বলা ঠিক হচ্ছে না।

সুদীপ বলল, সর্দারজীরা বুঝবে না।

জয়িতা বলল, উই শুড নট টেক রিস্ক।

সুদীপ বলল, ঠিক আছে বাবা। তোর সব কিছুতেই বেশি বেশি! সুদীপ মাথায় হাত বোলালো, ব্যাপারটা থিতিয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের দ্বিতীয় কাজটা করে ফেলা দরকার। তাহলে পুলিশ পাল্ড হয়ে যাবে।

আনন্দ মাথা নাড়ল, না, এখন নয়। আমি আমাদের প্ল্যান মত না এগোবার কোন কারণ দেখছি না। ব্যক্তিগত ঝামেলা এইসময় এড়িয়ে গেলেই পারতিস সুদীপ।

আমি যে কটা ব্যাপারে কখনও আপোস করতে পারব না সেটা নিয়ে কেন কথা বলছিস! ব্যক্তিখুনে যদি আমি বিশ্বাসী হতাম তাহলে ওই লোকটাকে আগে খুন করতাম আমি। আমার মায়ের আটটা সোনার সাপ ছিল। মোট ওজন কত আমি জানি না। বাবা বলছে ইনকামট্যাক্স ওগুলো নিয়ে গেছে। সেটা সত্যি কিনা জানবার জন্যে আমি অপেক্ষা করব। খুব জেদী দেখাচ্ছিল সুদীপকে।

আনন্দ বলল, মাথা গরম করিস না। আগামীকাল আমার সঙ্গে একটা লোকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। যদি সব ঠিক থাকে তাহলে যা পাওয়া যাবে তা এনাফ।

কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, টাকা কত লাগবে?

এমাউন্টটা জানি না।

জয়িতা এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। এবার বলল, সুদীপ আজ আমাদের ফ্ল্যাটে থাকুক। আমার মা নেই এখানে, বাবা নাও ফিরতে পারেন। আর ফিরলেও আমি ম্যানেজ করতে পারব।

আনন্দ বলল, খুব ভাল। তাহলে সুদীপ তুই আজ ওখানেই থাক। আমি কাল সকালে তোদের ফোনে বলব কি করতে হবে। এখানেই নামিয়ে দে আমাদের।

ওয়েলিংটনের মোড়ে ওরা ট্যাকসি থেকে নামল। সুদীপ মুখ বাড়িয়ে বলল, টাকার জন্যে চিন্তা করিস না। ওই ভারটা এবার আমি নিচ্ছি।

গাড়ি চলতে শুরু করলে জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কি ভাবে নিবি?

ঠোঁট টিপে দুটো গাল ফুলিয়ে হাসল সুদীপ, আর চক্ষুলজ্জা নয়। কিন্তু তুই তো আমাকে নিয়ে যাচ্ছিস, গোলমাল হবে না তো?

জয়িতা কাঁধ নাচাল। তারপর বলল, সিগারেট দে একটা।

রামানন্দ রায় আজও ফিরলেন না। খাওয়া দাওয়া করে গেস্টরুমে শুয়ে পড়েছিল সুদীপ। ওর আজ খুব ঘুম পাচ্ছিল। নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল জয়িতা। এই প্রথম সে কোন বন্ধুকে বাড়িতে রাত কাটাতে বলল। সীতা রায় জানলে কি রকম নাটক হবে? ওর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। সুদীপের মধ্যে অদ্ভুত একটা অস্থিরতা আছে। ওরা দুজনে দুজনের পেছনে প্রায়ই লাগে, কিন্তু আজ এই বাড়িতে আসার পর কেমন শান্ত হয়ে গেল। জয়িতা আলো নিবিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। গেস্টরুমের দরজার সামনে এসে সে থমকে গেল। চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে অন্ধকার ঘর থেকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সুদীপ। জয়িতা পা টিপে টিপে ফিরে এল নিজের ঘরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *