1 of 2

১১. পৃথুর গভীর মগ্নতা ছিঁড়ে

১১

পৃথুর গভীর মগ্নতা ছিঁড়ে দিয়ে লাল্লু হঠাৎই এসে ভয়াবহ দুঃসংবাদটা শোনায়।

বলে, আজ মান্দলা থেকে টাইগার প্রজেক্টের পারিহার সাহেব এসেছেন মুক্কিতে। সাবধান! ভারী ঝঞ্ঝাটিয়া লোক হচ্ছে এ। শিকার যে হচ্ছে তা একবার জানতে পারলে হরিণের চামড়ার মতো আমাদেরই চামড়া খুলে নেবে গা থেকে।

লোঃ!

ঠুঠা বলল, তাচ্ছিল্যের গলায়। মুক্কি কি এখানে? এখান থেকে বিলাইত যত দূর মুক্কিভি ততই দূর। আজ অবধি চামড়া আমাদের কত লোকই খুলে নিল! বেশি সাহেব দেখাস না আমাকে লাল্লু!

না। উনি হয়তো শিকারের খবর পেয়ে যাবেন। ওঁদের ওয়্যারলেস টাওয়ার আছে যে। লাল্লু বলল।

তোর মাথা খারাপ রে লাল্লু। শামীম বলল। কামান থেকে এখানে গোলা বেরলেও মুক্কিতে তার শব্দ পৌঁছবে না। মুক্কি কতদূর জানিস? গেছিস তুই কখনও?

নাঃ। কোনদিনও যাইনি।

তবে? তা ছাড়া, হাতে বন্দুক থাকতে জ্যান্ত অবস্থায় তো চামড়া দেব না কাউকেই। মরা মানুষের চামড়া ছাড়ালে, ছাড়াবে।

লাল্লু বলল, পারিহার সাহেব ভারী জবরদস্ত অফসর। হালত্‌ খারাপ হো যায়গা।

ছোড়। ছোড়।

বলল শামীম।

লাল্লু শামীমের সঙ্গে সঙ্গে কথায় এঁটে না-উঠতে পেরে বলল, লোঃ। আশ্চর্য এই মানুষগুলো লাল্লুরা! জীবন বিতিয়ে দিল ওই দূরের পুন্নোয়া বস্তিতেই। খরা, বন্যা, মহামারী, ছেলে-মেয়ে-বউ, মহুয়া, তেওহার, আর বন-পাহাড়ের দিনগুলো নিয়ে। কূপমণ্ডুক বোধহয় এদেরই বলে। অথচ, আশ্চর্য! দুঃখের মতো কোনও দুঃখও নেই এদের। সব-সময়ই গাল-ভরা হাসি। মাদল পিটছে! কার্মা নাচছে, মহুয়া গিলছে।

বেশি জানার, বেশি ভ্রমণের বোধহয় অনেক দোষও আছে। মানুষের এই ছোট্ট জীবনটাতে একই জায়গায়, গুঁড়ি-সুড়ি হয়ে বসে, কাছের মানুষ বলে যাদের জানে, তাদের সঙ্গেই জড়াজড়ি করে সুখে-দুঃখে হেসে-কেঁদে জীবনটা শেষ করার মধ্যেও নিশ্চয়ই অন্যধরনের মজা আছে। নিজেকে যতখানি বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ বলে মনে করে, ততখানি পৃথু আসলে নয়।

রাতে খাওয়াবি কী রে লাল্লু? মোরগা পাওয়া যাবে? শামীম শুধোল।

না মালিক! সব মোঁগাও-এর হাটে চলে গেছে। কাল তো হাট সেখানে। আজকাল বস্তিতে বেচার জন্যে কেউই তেমন কিছু রাখে না।

মুরগির ডিম?

নাঃ!

সে কী রে? দুস্‌স্‌স্‌…চল ঠুঠা, আগে একটা খরগোশই মেরে আনি। যত্বই মানহুষ হোক না কেন! তাই-ই খাব কাবাব করে। শেষে কি পেটে কিল দিয়েই সারা রাত পালসা খেলতে হবে নাকি?

ঠুঠা বলল, দিমাগ খরাব। বলছে লাল্লু যে, পারিহার সাহেব এসেছেন মুক্কিতে। খরগোশ মারবে, চিতল হরিণ মারবে, কত কী মারবে। নিজে মরবার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি? শুধু হরিণই মারব। খামোখা আওয়াজ করে কী হবে?

তাতে কী? আমরা কি কোর-এরিয়ার মধ্যে শিকার করছি? রিসার্ভ ফরেস্টে পথের উপরে শিকার করলে কার কী বলার আছে? কোন শালা কী করবে? ফরেস্ট কি ফরেস্ট ডিপার্টের বাবার?

আছে। বলার আছে। মান্দলাতে ঠিকাদার লড্ডন সিং চিরাইডোংরি থেকে ইন্দ্রাতে আসার পথে বড় রাস্তাতে তার জীপে একটা খররা চাপা দিয়েছিল, তাতেই তার একহাজার টাকা ফাইন হয়ে গেছিল। শিকার করা তো এখন একেবারেই মানা। সবজায়গাতে। জানিস না?

জানব না কেন? গতবছর গরমের সময় হাটচান্দ্রাতে মদ খেয়ে যে রাতের বেলা ভগবান শেঠ-এর ছোট বেটা লালটু সিং পথের পাশের ঝুপড়ির সামনে শুয়ে-থাকা চার-চারটি কামিনকে মেরে দিল গাড়ি চাপা দিয়ে? তার কী হয়েছিল? কী শাস্তি হয়েছিল চারটি মানুষ মারার অপরাধে তা জানা আছে কি?

না।

তার কিছুই হল না। শেঠ মোটা খাম ধরিয়ে দিয়েছিল সবখানে। ব্যাসস্‌। এখানে এরকমই হয়। ছাড় তো! এসব ভয় দেখাস না। চারটে মানুষ মেরে বেমালুম ঘুরে বেড়াচ্ছে চুলে লাল চিরুনি সটাসট ফিরিয়ে। কাঁচ-কালো গাড়ি নিয়ে, ছোকরাবাজি করে, আর একটা খরহা…

তাহলে, খাবার কী হবে বলে?

অসহায় গলায় ঠুঠা বলল।

দিগা বলল চাল-ডাল চাপিয়ে দিই শামীম ভাই?

না। ডিম খাব। আমার আজ খুবই ডিম খেতে ইচ্ছে করছে। কেন জানি না। মাঝে মাঝে এমন হয়।

শঙ্খচিলের ডিম খাবে?

ইনোসেন্ট মুখ করে লাল্লু বলল।

শঙ্খচিল যে গণ্ডায় গণ্ডায় দেখা যায় না আজকাল তা নিয়ে ওর কোনওই মাথাব্যথা নেই।

আজই সকালে চারটে ডিম পেড়েছি আমি। ইয়া ব্বড়, ব্বড়।

তুই পেড়েছিস? শালা বুদ্ধু।

শামীম হেসে বলল।

আরেঃ। আমি মানে কী, গাছ থেকে। বলেই, দু হাতের পাতা গোল করে দেখাল ও।

হা রাম। হা রাম। দিগা পাঁড়ে বলল।

শামীম ফাজলামি মেরে বলল, কী হল?

ডিমের মধ্যে রামকে টানছ কেন?

আরে বলব কী তোমাকে! রামচরিত মানস-এর মুক্তাবলীতে আছে, শঙ্খচিল-এর মতো শুভ পাখি বেশি নেই। তারই ডিম ছিনিয়ে আনলে তুমি? পাপ হবে তোমার।

শামীম বলল, পাপ-এর ট্যান্‌কি ওভার-ফ্লো করছে দেশে। এখন আর কোনও কিছু করলেই কারও পাপ হয় না। তুমি চুপ করো তো রাম ভয়ানকা চেলা!

পৃথু বলল, কেন? শঙ্খচিল শুভ পাখি কেন দিগা?

কেন তা কী করে বলব, মানস মুক্তাবলীতে আছে। বলেই দিগা ওর সুললিত গম্ভীর ভক্তিপূর্ণ গলায়, একবার গলা খাঁকরে নিয়েই, আবৃত্তি করল :

“নকুল সুদর্‌শন দরসনী ছেমকরী চক চাষ।

দস দিসি দেখত সগুণ শুভ পুঁজহি মন অভিলাষ।”

ঠুঠা অধৈর্য গলায় বলল, আরে মানেটা কী বলবে তো? তোমার মতো পণ্ডিত কি সকলেই নাকি?

মানে হল, নেউল, মাছ, আয়না, শঙ্খচিল, চক্রবাক এবং নীলকণ্ঠ পাখি—দশ দিকের যে-কোনও দিকেই যদি দেখা যায়, তাহলে মনে করতে হবে তা অতীব শুভ লক্ষ্মণ। তুমি যাই-ই চাও, তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবেই হবে তাহলে।

শামীম বলল, ভালই হল। শঙ্খচিল না দেখা গেল তো তার আণ্ডা তো দেখা হবে। দোনোমে ফারাক ক্যা? আজ রাতে বারাশিঙা কি শম্বরই শিকার হয়ে যাবে মনে হচ্ছে বুঝলি ঠুঠা। যা লাল্লু, তাড়াতাড়ি তোর গাঁয়ে দৌড়ে যা বাবা। বড় বড় আণ্ডা যখন, তখন এক-একজন এক একটা খেলেই হবে। তাড়াতাড়ি। গিয়েই, আয়। রাত নটা নাগাদ আজ আবার চাঁদ বেরিয়ে পড়বে। তারপর আর জঙ্গলে লুকিয়ে ঢোকা যাবে না। ঝক্কি কি একরকমের? রাত বাড়লেই, ‘নুনির’ সব জানোয়ার চাঁদের আলোয় দূর থেকে আমাদের দেখতে পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যাবে।

দিগা পাঁড়ে আপনমনে হাসল। বিড়বিড় করে বলল, এসব খারাপ কাজ, মানে শিকার-টিকার ছেড়ে দাও শামীম ভাই। সত্যিই এতে গুণাহ হবে। তোমার আল্লাও যা, আমার রামও তাই।

তারপরই বলল, চাঁদের আলোকে কারা ভয় পায়, তা জানো কি শামীম ভাই? তোমার দেখছি বড়ই ভয় চাঁদকে।

কারা?

“চোরহি চন্দিনী রাতি ন ভারা।” তুলসীদাসেরই কথা। মানেটা বুঝলে তো?

আরবি, ফারসী, উর্দু বল তো আমি বুঝব। এ কী যে ঘুমিয়ে পড়ার মতো ভাষায় কথা বলছ তুমি। এ জন্যেই তো আমাদের মুঘল, পাঠান, আফগানরা সব মেরে ঠাণ্ডা করে দিল বারবার। একটু জোস্ত-এর সঙ্গে কথা বল ইয়ার। মাস-মছলি খাও। পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কা খাও। কথা বলবে মনে হবে, গালে থাপ্পড় মারল কেউ। তবেই না!

দিগা বলল, মানে হল, চাঁদনি রাত, চোরের কখনও ভাল লাগে না।

সকলেই হেসে উঠল দিগার কথা শুনে।

লাল্লু তার গ্রামের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল।

বাইরের আগুনেই চাল-ডাল চড়িয়ে দিয়েছে দিগা। কটা ঝিঙে ছিল ঘরে। আলু লাল্লু এনেছিল। সেগুলোও সিদ্ধ দেওয়া হয়েছে। আগুনে ফুটফাট শব্দ হচ্ছে। শামীম্‌ আর ঠুঠা একটু দূরে বসে গাছতলায় মহুয়া খাচ্ছে, শালের দোনা করে। লাল্লুই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল পলিথিনের জেরিক্যানে করে। সেটা সাপ্লাই করেছিল শামীম। পৃথু মদ খায়, তবে আজ খাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে মদ ও নিশ্চয়ই খায়, কিন্তু ছেলেবেলায় পড়া, রবীন্দ্রনাথের ‘তিনসঙ্গী’র রবিবারের অভীক-এর একটি কথা ওর কানে গেঁথে গেছে। “আমি কোনও নেশাকে পেতে পারি, কিন্তু কোনও নেশা আমাকে পাবে, সেটি হচ্ছে না।” এই কথাটাতে বিশ্বাস করে ও।

দিগা কথাটথা বিশেষ বলে না। অনেকে থাকলে তো বলেই না। কখনও পৃথু একা এলে, অন্য কথা। মানুষটার অতীত সম্বন্ধে তার নিজের মুখে কখনও কিছুই শোনা যায়নি। অন্যে যাইই বলে না কেন, ও শুনে হাসে।

বছর তিনেক আগে আঙুরাম কালকাফ (শেলাক) ইন্ডিয়া লিমিটেডের একজন অফিসার এসেছিলেন হাটচান্দ্রাতে। ওঁদেরও ফ্যাক্টরি আছে রাঁচীর কাছে, মুণ্ডা উলগুলানের বিখ্যাত নায়ক বীরসা মুণ্ডার জন্মস্থানের কাছেই, মুরহুতে। এবং পুরুলিয়ার ঝালদাতেও। জার্মান কোম্পানি। ফেরা আইনে, এখন ভারতীয়। ওঁদের রাচী, হাজারীবাগ, পালামৌ অঞ্চলে লাক্ষা সংগ্রহের অনেকই সেন্টার আছে। ওই ভদ্রলোকই একদিন গেস্ট-হাউসে বসে গল্প করছিলেন পৃথুদের কাছে। আসলে মধ্যপ্রদেশে কেউ এলেই ডাকাতদের কথা ওঠেই। মোরেনা, গোওয়ালিয়র, রেওয়া, ভিন্দ্‌ ইত্যাদি জায়গায় যানও অনেকে জায়গাগুলো সম্বন্ধে ফীল্‌ করতে। ডাকাতের গল্পে গল্পেই উনি বলেছিলেন যে, প্রায় বছর তিরিশ আগে হাজারীবাগে দিগা পাঁড়ে বলে একজন কুখ্যাত ডাকাত ধরা পড়েছিল। সে নাকি হাজারীবাগ ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে রীতিমত তাণ্ডব করে বেড়াচ্ছিল। সেই গল্প থেকেই হয়তো আমাদের দিগা পাঁড়ের অতীত জীবনের কাহিনী, “ইমমেটিরিয়াল্‌” ম্যানেজার শর্মার মুখে মুখে পল্লবিত হয়ে এবং অন্যান্যদের মুখে নতুন কিশলয়ে ভরে উঠে পুরো হাটচান্দ্রাতেই ছড়িয়ে গেছিল।

পৃথু শামীমকে বলল, তোমরা কি এখানে মহুয়া খেতেই এসেছ না কি? ভুচু তো জিপ নিয়ে এসে একটু পরই হাজির হবে। এই বেলা বেরিয়ে পড়ে তড়িঘড়ি একটা হরিণ মেরে নিয়ে এসো, নইলে রাতারাতি ফিরবে কী করে হাটচান্দ্রাতে? সকাল হয়ে যাবে যে! তোমাদের জন্যে বেইজ্জৎ হতে পারব না আমি। অনেকবার হয়েছি। আর না। বলে দিলাম।

বেইজ্জৎ না হলে ইজ্জৎ আছে কি নেই তা জানাই যায় না। মাঝে মাঝে বেইজ্জতি ভাল। বলতে বলতে শামীম আর ঠুঠা উঠে এল। ঠুঠা বলল, তাইই ভাল। তুমি আর লাল্লু বরং শঙ্খচিলের ডিমের কালিয়া বানাও, আমরা ততক্ষণে এক চক্কর পালসা ঘুরে আসি। চলো শামীম ভাই।

জঙ্গলে পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে শিকার করাকে পালসা বলে।

শামীম ঘর থেকে বন্দুকটা নিয়ে এল। তার বন্দুকের সঙ্গে ক্ল্যাম্পে লাগানো একটা তিন-ব্যাটারীর বন্ড-এর টর্চ। ঠুঠার হাতেও কাচ-ফাটা একটি পাঁচ ব্যাটারীর। ওর বন্দুকটা লুকোনো আছে দিগার কুঁড়ের পূবদিকে, এক ফার্লং মতো দূরে একটি বড় চাঁর গাছের ফোকরে। সেটা মাটি থেকে অনেকই উঁচু। চেনাজানা কেউ বলে না দিলে, কারও সাধ্যিই নেই যে খুঁজে বার করে সেই গুপ্তধন। আজ ও আর নামায়নি বন্দুক।

চললাম তাহলে আমরা।

ওরা বলল।

এই যে শামীম, কান খুলে শুনে যাও। একটাই মারবে কিন্তু। বেশি নয়। সাবধান। পৃথু বলল। মনে থাকে যেন। আমি কিন্তু রেগে যাব।

হ্যাঁ। হ্যাঁ। একটাই। আমরা কি কসাই নাকি?

শামীম বলল হাত নেড়ে।

কসাই বলেই তো বলা!

ঠুঠার হাতের কাচ-ফাটা টর্চের আলোর বৃত্ত বনের হালকা অন্ধকারে এক্কা দোক্কা খেলার মতো নিঃশব্দে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করতে করতে যাচ্ছিল ওরা। ঠুঠার টর্চের আলো সবে অদৃশ্য হয়েছে ঠিক এমন সময় একসঙ্গে অনেকগুলো ঢোল-এর ডাক ভেসে এল হাঁলো নদীর ওপারের অন্ধকারতর গভীর জঙ্গল থেকে কার্তিকের সান্ধ্য-নিস্তব্ধতা খান খান করে। ঢোল্‌, অর্থাৎ এই জংলি কুকুরগুলো যে কত ক্ষিপ্র এবং সাংঘাতিক তা যাঁরা নিজের চোখে না-দেখেছেন, তাঁরা ধারণা পর্যন্ত করতে পারবেন না। ভাগ্যিস এরা মানুষকে আক্রমণ করে না সচরাচর।

দিগা আর পৃথু চমকে চাইল সেই আলোড়িত অন্ধকারের দিকে, পাথরের উপরেই বসে। ওরা লক্ষ্য করল যে, শামীম আর ঠুঠা টর্চ জ্বেলে কিছুটা এদিকে এসে আবার টর্চ নিবিয়ে দিয়ে অন্ধকারেই দৌড়ে ফিরে গিয়ে নদীর কাছাকাছি যেন দুটো বড় শালগাছের আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। জংলি কুকুরগুলো নিশ্চয়ই কোনও জানোয়ারকে তাড়িয়ে নিয়ে আসছে এই দিকে। পৃথু রাতের বেলা এ-অঞ্চলে কখনওই ঢোলদের দ্বারা কোনও জানোয়ারকে আক্রান্ত হতে দেখেনি। দিনের বেলায় অবশ্য দেখেছে তিনবার।

কী জানোয়ার ওটা? যেটাকে তাড়া করেছে ঢোলরা?

দিগা, ফিসফিস করে পৃথুকে শুধোল।

যতক্ষণে, জানোয়ারটা যে কী হতে পারে তা নিয়ে ওদের ভাবাভাবি শেষ হল, ততক্ষণে ওই পার থেকে ঝড়ের মতো ছুটে এসে একটা প্রকাণ্ড বারাশিঙা ঝাঁপিয়ে পড়ল হাঁলোর কালো জলে। ঝাঁপিয়ে পড়েই, ছুটে আসতে লাগল জল ছিটিয়ে যেন আগুনটা লক্ষ্য করেই। আর তার পেছনে একদল ঢোলও জলে নেমে তাড়া করে আসতে লাগল ছলে ছপ ছপ শব্দ করে।

বারাশিঙাটা নদীর অগভীর জল পেরিয়ে জলভেজা শরীরে এপারে উঠে, আগুন দেখেই মানুষ আছে বুঝতে পেরে মানুষের আশ্রয়ে এসে নৃশংস মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে টলোমলো পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল। দৌড়বার মতো জোর ওর বোধহয় অবশিষ্ট ছিল না। আর ঠিক তখনই অভাবনীয় কাণ্ডটা ঘটাল শামীম।

গুড়ুম্‌ করে বন্দুক গর্জে উঠল। বারাশিঙাটা গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে উছলে উঠল একবার; তার শিং-এর বারো ডালপালা হাত তুলে কী যেন বলতে গেল নীরব প্রতিবাদে। তারা-ভরা আকাশকে। মনে হল, রূপকথার পক্ষিরাজের মতো ও অন্ধকারে উড়েই যাবে বুঝি। ওর সারা শরীরে একটা ঝড়ের কাঁপন খেলে গেল এবং তারপরই কয়েক পা দৌড়ে এসে, মুখ থুবড়ে পড়ল প্রায় আগুনটার সামনেই।

দিগা হতভম্ব তো বটেই, একেবারে স্তব্ধ হয়ে গল। অস্ফুটে বলে উঠল, হা রাম!

পৃথুও কম হকচকিয়ে যায়নি ব্যাপারটার অভাবনীয়তায়। এ তো শিকার নয়, পরের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিয়ে উচ্ছিষ্ট খাওয়া। কেন যে মারল শামীম এটাকে।

শামীমটা ভীষণই রক্তপিপাসু; ট্রিগার হ্যাপী আছে। বিনা কারণেই ও কাক চিল থেকে শুরু করে বাঁদর হনুমান পর্যন্ত মারে, যদি গুলির টান না থাকে তেমন। বিচ্ছিরি!

ততক্ষণে কুকুরগুলোও ডাকতে ডাকতে নদী পার হয়ে চলে এসেছে। তাদের শরীর থেকে তখনও জল গড়িয়ে পড়ছে। গুলির শব্দ শোনার পরই থমকে গেছে। এখন ওরা আর ডাকছে না।

শামীম আর ঠুঠা আলাদা হয়ে গেছে ততক্ষণে। কুকুরগুলোর দুপাশে চলে গিয়ে ওরা ওদের চোখে আলো ফেলে ওদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভয় দেখিয়ে নদীর ওপারে ফেরৎ পাঠাবার মতলবে। মাংসাশী কুকুরগুলোর চোখ লালচে, ভুতুড়ে দেখাচ্ছে টর্চের আলো পড়ে। শামীম্‌রা প্রায় কাছে চলে গেছে ওদের কিন্তু কুকুরগুলো মুখের শিকার ছেড়ে যেতে আদৌ ইচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে না। বন্দুক, শুধুই শামীমের হাতে। ঠুঠার হাতে কাঁচ-ফাটা টর্চ। পৃথুর একবার ভয় করল, কুকুরগুলো ঠুঠাকে আক্রমণ করে বসবে না তো? ভয় হল শামীমের কারণেও। বিনা প্ররোচনায় সে কুকুরগুলোর উপরও গুলি চালিয়েও বসতে পারে। ঢোল এখন খুবই কম দেখা যায় পুরো দেশে। যদিও এ অঞ্চলে আছে। ঢোল শিকার করাটা গর্হিত অপরাধ।

পৃথু চেঁচিয়ে বলল, অ্যাই। শামীম। উপরে একটা গুলি করে কুকুরগুলোকে ভয় দেখাও। যাতে ওরা চলে যায়। খবরদার। কুকুর যেন একটাও না মরে।

শামীমও চেঁচিয়ে বলল, বেফিক্কর রহিয়ে আপ! বলেই, বন্দুক উপরে তুলে গুলি করল একটা।

এবার কুকুরগুলো এক পা এক পা করে ঘুরে ঘুরে পিছু হঠতে লাগল। কিন্তু পেছিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হল না। হাঁলো নদীও পেরল না মোটেই। নদীর এপারেই বসে রইল গুঁড়িসুড়ি মেরে সার বেঁধে, আগুপিছু করে, বারাশিঙাটার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে, যেন বড়লোকের বাড়ির অন্নপূর্ণা পুজোর প্রসাদ-প্রত্যাশী কাঙালি সব।

পৃথু পাথরটা নেমে আসতে আসতেই শামীম আর ঠুঠাও এসে পৌঁছল ওর কাছে।

পৃথু বলল, ঈ ক্যা কিয়া শামীম? ইয়ে কৌনসা বড়া শিকারিকা হরকৎ?

শামীম একটুও অপ্রতিভ না হয়েই বলল, ক্যা করে দাদা? খুদাহনেই ইসিকো ভেজ দিয়েথেঁ সাবীর মিঞাকা মেহমানলোঁগোকে লিয়ে। শিকার, আহি যব পৌঁছা খদুাহকি দোয়াসে, খুদহি দৌড়কে, তব্‌ তামাম জঙ্গল্পে রাতভর পাল্‌সা খেলনেকে জরুরত ক্যা থা? ঔর খুদাহকি কসম, মেরী তবিয়ৎ ভী আজ ঠিক নেহী লাগতা। সুব্বেহেসে!

ঠুঠাও শামীমকে বকল। বলল, ইয়ে কওনসি তারিকা? বদ্‌তমিজ কাঁহাকা।

বারাশিঙাটা তখনও মরেনি। গুলিটা বোধহয় বুকেই লেগেছিল। ব্রডসাইড শট্‌।

শট্‌ গানে শামীম অবশ্য চিরদিনই মারে ভাল। রাইফেলেই বরং ঠিক জুৎ করে উঠতে পারে না।

মুখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল বারাশিঙাটার।

পৃথু কিন্তু কাছে যেতে পারল না। গুলি খাওয়া জানোয়ারের খুব কাছে যেতে কখনও পারেনি ও। যখন নিজে শিকার করত, তখনও পারত না। পৃথুর বাবা বিরক্ত হয়ে বলতেন : হিপোক্রিট। গুলি করে জানোয়ার মারতে পারো, আর কাছে যেতে পারো না? তুই একটা মেয়েমানুষ।

হয়তো তাই। ও হয়তো সত্যিই মেয়েমানুষ। রুষাও সবসময়ই তাইই বলে। পৃথু আজকাল প্রায়ই ভাবে, এবং ভেবে ক্লিষ্ট বোধ করে যে, ওর বাবার জিন আর ওর জিন-এর মধ্যে অনেকই তফাৎ ছিল। ক্রোমোসোম-এর তফাৎ। বরং মায়ের জিন-এর সঙ্গেই হয়তো মিল ছিল বেশি। পৃথুর বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন পৃথুকে কখনও বোঝেননি। এটা নিছকই দুর্ভাগ্য। হিউম্যান জেনেটিকস নিয়ে কিছু শখের পড়াশুনা করেছে ও একসময়। এবং করেছে বলেই এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে।

ঠুঠা এগিয়ে গিয়ে আঁৎকে উঠে বলল, ঈসস্‌। একটা চোখ খুবলে নিয়েছে যে কুকুরগুলো। ঈস্‌স্‌স্‌…

পৃথু ভাবছিল, একটা চোখ সেই তারাই খুবলে নিয়েছিল, প্রকৃতি তাঁর সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখার কারণে যে কুকুরদের স্বাভাবিক খাদ্য করে সৃষ্টি করেছিলেন এই বেচারি বারাশিঙাকে। বারাশিঙার খুবলানো চোখের কারণে দুঃখ হল এত ঠুঠার, আর দোস্ত যখন গুলি করল তার বুকে, তাতে দুঃখ হল না। কুকুরগুলো একটা চোখই নিয়েছিল; শামীম প্রাণটাই নিল।

শামীম ততক্ষণে গাছতলায় ফেলে আসা পলিথিনের জেরিক্যানে রাখা মহুয়ার কাছে আবার পৌঁছে গেছে। গিয়েই সোজা জেরিক্যান থেকেই ঢালতে শুরু করেছে মুখে। সেটাকে মাথার উপরে তুলে ধরে।

ঠুঠা চেঁচিয়ে বলল, এই শামীম! শামীম মিঞা। কি রে! হালাল করলি না? সাবীর মিঞার মেহমানরা খাবে কী করে? তুইও বা খাবি কী করে? আজীব আদমী।

শামীম তা শুনেই জেরিক্যানটা এক ঝটকায় নামিয়ে রেখেই দৌড়ে এল।

ততক্ষণে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারাশিঙাটা চিরন্তন ভোঁর ঘাসের আদিগন্ত লাল মাঠে পৌঁছে গেছে চিরদিনের মতো। যেখানে জংলি কুকুরের দল নেই, বড় বাঘ নেই; চোরের মত আড়াল থেকে প্রাণ নেওয়া বন্দুক হাতে মানুষের মতো বদ্‌বু, বেশরম জানোয়ারও নেই। সেখানে শুধুই ঘুম; শুধুই শান্তি।

শামীম এসে পৌঁছতেই ঠুঠা বলল, হুঁ! শেষ হয়ে গেছে। এখন আর হালাল করবি কাকে? খাবিই বা কী? যা! আরও মহুয়া গেল্‌ গিয়ে। আসল কাজটাই করলি না, ছুন্নৎ-এর নেমন্তন্ন খাওয়াবি!

শামীম ধম্‌কে বলল, শেষ হয়নি, শেষ হয়নি, নির্ঘাৎ বেঁচে আছে।

বলেই, কোমরের চামড়ার খাপ থেকে আমেরিকান ডিসপোজালের রেমিংটনের ছুরিটা বের করে মৃত বারাশিঙাটার শিঙটা বাঁ হাতে ধরে ডান হাতের ছুরি দিয়ে গলায় আড়াই-প্যাঁচ লাগিয়ে দিল।

সহজে কি কাটে! শীতের দিনের পুরুষ বারাশিঙা। চর্বি, গলকম্বল, তার উপর পুরু চামড়ার আর লোমের কম্বল। গলদঘর্ম চেষ্টার পর একটু রক্ত বের করল শামীম। তারপর দু হাতে রক্ত মেখে প্রাগৈতিহাসিক গুহামানবেরই মতো উঠে দাঁড়াল। মুখে বিজয়ীর হাসি নিয়ে।

ঠুঠা বলল, দেখালি বটে। ভড়ং করলি কার কাছে? খুদাহ্ বুঝি দেখতে পান না? খেলে তো এমনিতেই খেতে পারতিস। আমরা তো আর কাউকে বলে দিতাম না!

তাহলে? আর মরা জন্তুটাকে কাটাছেঁড়া করলি কেন? ফালতু যত তোর দেখানো হালাল। বেচারি! বেহেস্তে পৌঁছে যাবার পরও কাটাকাটি।

এই ঠুঠা! জবান সামলকে বাত করনা!

বলেই শামীম রক্তমাখা ছুরি হাতে ঘুরে দাঁড়াল ঠুঠার দিকে।

ঠুঠা, ওকে একটা খারাপ গাল দিয়ে বলল, পেঁয়াজী মারবি তোর ছোটা মসজিদের মহল্লাতে গিয়ে, বুঝলি। আমার নাম ঠুঠা বাইগা। আমি নামে বাইগা, আসলে গোন্দ। তোদের মোগল নবাব রাজবাহাদুর কাদের রাণীর কাছে যুদ্ধে গু-হারান হেরেছিল জানিস? গন্ডোয়ানার রাণী দুর্গাবতী! অত আঁখ দেখাচ্ছিস কাকে? যা বলেছি, ঠিক বলেছি। যা, গিয়ে নদীতে হাত-মুখ ধুয়ে আয়। মাথায় জল দিয়ে মেজাজ ঠাণ্ডা করে আয়। তোর মতো অনেক ফিলমী-হিরো দেখেছি। বেশি ফালতু মেজাজ দেখাবি তো এইখানেই মেরে হাঁলোর কালো জলের নীচে পুঁতে দেব। বাচ্চা, বাচ্চার মতো থাকবি। বুঝলি।

শামীম তখনও ফুঁসে দাঁড়িয়েছিল।

পৃথু বলল, শামীম। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে বড়। যাও, হাত মুখ ধুয়ে এসো।

জংলী কুকুরগুলো তখনও চুপ করে ওইভাবেই বসেছিল। ঠুঠা একবার আলো ফেলল নদীর দিকে। ওদের লাল ভুতুড়ে চোখগুলো আবারও সার সার জ্বলে উঠল।

ঠুঠা শামীমকে বলল, দাঁড়া! দাঁড়া! খালি হাতে একা যাস না হিরো। কখন শয়তানের ভর হয় কার উপর তা কেউ বলতে পারে? বলেই, শামীম যেখানে বন্দুকটাকে গাছে হেলান দিয়ে রেখে এসেছিল মহুয়ার জেরিক্যানের পাশে, সেখান থেকে সেটাকে তুলে নিয়ে, শামীমের গুলির বেল্ট থেকে দুটি গুলি খুলে ব্যারেলে ভরে শামীমকে কভার করে কিছুদূর এগিয়ে গেল নদীর দিকে।

শামীম হাতের রক্ত ধুলো, ছুরি ধুলো, তারপর নিজের খাকি শার্ট-এর আস্তিনে ছুরিটা মুছে আবার কোমরের খাপে পুরে ফেলল।

ও ফিরে আসতেই, টর্চ নিবিয়ে ঠুঠাও ফিরে এল।

দিগা একটুও কথা না বলে পাথর থেকে নেমে, বারাশিঙাটার দিকে একটিবারও না তাকিয়ে হলুদ কাঠের আগুনটাকে জোর করল খোঁচাখুঁচি করে। করেই, বারাশিঙার দিকে পিছন ফিরে সোজা নিজের কুঁড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল।

বেচারি!

অনেকক্ষণ কেউই কোনও কথা বলল না।

ঠুঠা বলল, মারলি কোন গুলি?

শামীম বলল, স্ফেরিক্যাল বল ছিল। মোক্ষম মার হয়েছে। কী বলো ঠুঠা?

পৃথু বিরক্ত গলায় বলল, ভুচু জীপ নিয়ে আসবে কখন?

রাত দশটাতে।

ঠুঠা বলল। ছোট্ট করে।

অনেকই সময় আছে। শঙ্খচিলের ডিমের ঝোল না খেয়ে আমি যাচ্ছি না এখান থেকে।

শামীম বলল।

ওর গলা শুনে মনে হল, হঠাৎ-ওঠা রাগটা পড়ে গেছে। শামীমের এই-ই এক দোষ। ওর রাগটা খুনে। ঠুঠাটাও তেমনি বদরাগী। কোনদিন যে কী ঘটিয়ে বসবে।

ঠুঠাও বলল, মেরে তো দিলি। বেচারি কুকুরগুলোর কথা ভাবলি না একবারও। তাছাড়া, তিনজন মিলে এই পাহাড়ের মতো জানোয়ারকে জীপে ওঠাবিই বা কী করে? বললাম তখন যে, চল মাঝারি দেখে একটা চিতল মারি, ‘নুনি’তে গিয়ে! মাংসও ভাল হত। তা না, তর সইল না। এই রকম ঘোড়ার মতো মাংসই সাবীর মিঞার মেহমানদের খাওয়াবি তো বললেই পারতিস, মুঙ্গালালের বেতো ঘোড়াটাকেই হালাল করিয়ে দিতাম তোকে দিয়ে। তাহলে এতদূর এসে বেচারি দিগার শান্তি নষ্ট করতে হত না। যত্ব সব…

পরিবেশটা লঘু করবার জন্যে পৃথু বলল, হ্যাঁ! ঘোড়া খাইয়ে সাবীর মিঞা তাহলে একেবারে হাতেমতাইও হয়ে যেতে পারত! কী বলো শামীম?

শামীম বলল, তোমরা সকলেই বড় বেশি কথা বলো। আমার মহুয়ার নেশাটাই উৎরে দিলে।

বলেই, চলে গেল আবার স্বস্থানে। পেছন পেছন ঠুঠাও। যেন একটু আগেই ঝগড়া হয়নি, যেন দুজনের মধ্যে কখনও খুনোখুনি হতেই পারে না এরকমভাবে।

যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে শামীম হিরোর মতো বলল, মহুয়াটা শেষ করে গায়ে জোর করে এসে এটাকে এখুনি ছাল ছাড়িয়ে রাং-কেটে ফিট করে নিচ্ছি। নো-প্রবলেম। ঘাবড়াও মত পিরথুদাদা।

নীচে ফুটফাট করে আগুন একা একা কথা কইছে। স্বগতোক্তি। অন্ধকার আকাশে অনেকই তারা। মৃগশিরা, শতভিষা, স্বাতী, রোহিণী, কৃত্তিকা, কালপুরুষ, সব কালের প্রহরীরা। বসার ঘরের অস্পষ্ট ফিসফিসানির মতো ভেসে আসছে হাঁলো নদীর রাতের পায়ের শব্দ, রাতের বনের হরজাই শব্দর সঙ্গে মিশে। আর নদীর এই পারে, ঘাসের মধ্যে, সার সার বসে আছে নিঃশব্দে, কান-উঁচু করে জংলি কুকুরগুলো। ওদের স্তব্ধ নৈঃশব্দ্যে এখন বোঝার উপায়ই নেই যে, ওরা যখন দৌড়ে শিকার তাড়া করে তখন মনে হয় যে, “লু” বইছে জঙ্গলে। তখন বাঘেরাও জঙ্গল ছেড়ে পালিয়ে যায়।

ওদের চোখগুলো এখনও হলুদ কাঠের আগুনের স্বল্প লাল আভাতেও জ্বলছে। ভুতুড়ে লাল, ওরা এদিকে চাইলেই দপ করে কাঠকয়লার আগুনের মতো জ্বলে উঠছে, আবার মুখ ঘুরালেই নিবে যাচ্ছে। আলেয়ার মতো। অন্ধকারে জ্বলছে, নিবছে, নিঃশব্দে। কী ভাবছে, কে জানে, জংলি ঢোলগুলো। হয়তো ভাবছে, এই দুপেয়ে জানোয়ারগুলো ওদের চেয়েও অনেক বেশি মাংসলোলুপ। ওদের চেয়েও অনেক বেশি জংলি। এদের লোভের কোনও সীমা নেই। ক্ষিদেরও নেই। এই মানুষগুলো নিজেদের খাদ্য তো খায়ই, পরকে উপবাসী রেখে, পরের মুখের গ্রাসও কেড়ে নেয়। ঢোলগুলো সব সহজ-বুদ্ধি শিকারি-জানোয়ার। মানুষদের এই ধাঁধার উত্তর ওরা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না।

পৃথু ভাবছিল, মানসিকতার একাধিক এলাকাতেই মানুষ বিংশ শতাব্দীর শেষেও কাঁচা মাংসখেকো গুহামানবই রয়ে গেছে। জামা কাপড়ে বদলেছে; বহিরঙ্গেই বদলেছে শুধু।

গাছতলায় থেবড়ে-বসা, মহুয়া-খাওয়া ঠুঠা বাইগা আর শামীমের টুকরো-কথা ভেসে আসছে। একটা হায়না অট্টহাসি হেসে উঠল নদীর ওপার থেকে। যত দ্রুত মহুয়া যাচ্ছে পেটে, ততই অসংলগ্ন, ঢিলে হয়ে উঠছে শামীমদের কথাবার্তা! এদিকে শঙ্খচিলের ডিমের খোঁজে-যাওয়া লাল্লুরও পাত্তা নেই। কে জানে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট বা টাইগার প্রজেক্টের লোকেদের হাতেই পড়ল কি না! ওদের বস্তির পথটা এখান থেকে মাইল খানেক গিয়েই ফরেস্ট রোডে মিশেছে। আবার ঢুকে গেছে একটা সেগুন প্ল্যানটেশানের মধ্যে। তারপর গভীর শালজঙ্গল পেরিয়ে পুন্নোয়া বস্তি! কে জানে? কী করছে লাল্লু এতক্ষণ! শামীমটাকেও বলিহারি! পৃথু ভাবছিল।

শঙ্খচিলের ডিম খাবে!

কতরকমের চরিত্রই না দেখল এই বনে জঙ্গলে।

পৃথুর মনে পড়ে গেল, একবার ওরা কুমীরের ডিমের ওমলেট খেয়েছিল টিকেরিয়া আর মান্দলার মাঝামাঝি একটি জায়গায়। নর্মদার চরে। পাখি মারতে গেছিল ওরা। বাবা এবং সাবীর মিঞাও সঙ্গে ছিলেন। আরও দু’চারজন খিদমদগার। সে কি আজকের কথা! কুমীরের ডিমগুলো যখন আবিষ্কৃত হল তখন হৈ চৈ পড়ে গেল। কে যে প্রথম দেখেছিল ঠিক মনে নেই। পৃথুর মনে আছে, বাবার প্রবল আপত্তি ছিল, কিন্তু কুমীরের বংশ নাশ করার অসাধু উদ্দেশ্যে সাবীর মিঞা কথাবার্তা বেশি এগুনোর আগেই ফটাফট ডিমগুলো ভেঙে ফেলেছিল। তার মধ্যে পেঁয়াজ কুচি, শুকনো লঙ্কা, আদা; এবং পোলাউ রাঁধার জন্যে নিয়ে-আসা কিসমিস ও বাদাম-পেস্তাও ফেলে দিয়েছিল। ফ্রাই-প্যান ভর্তি হয়ে গেছিল ওমলেট-এ। খেতে যা হয়েছিল! সে বলার নয়। এখনও মনে করলে গা গোলায়।

সেই ওমলেট খাওয়ার পর থেকে কুমীর দেখলেই বমি পায় পৃথুর। কিছুতেই সামলাতে পারে না। চিড়িয়াখানাতে মিলি যখন খুবই ছোট, তখন একবার নিয়ে গেছিল ওকে কুমীর দেখাতে। ওকে নিয়ে কাছে যেতেই একেবারে প্রচণ্ড উলটি। কুমীর দেখে ভয় পায়নি মেয়ে মোটেই কিন্তু পৃথুর অবস্থা দেখে ভয়ে কেঁদে মরে প্রায়।

কুমীরের ডিমের ওমলেট-এর কথা মনে পড়াতে আরও অনেক কথা মনে পড়ে গেল পৃথুর। বাবা আজ নেই, বাবার ভাষায় বলতে গেলে, বলতে হয় যে, “হি হ্যাজ গান টু দ্যা হ্যাপী হাণ্টিং গ্রাউন্ডস।” বাবার চরিত্রের অনেকগুলো দিকই পৃথুর মধ্যে এসেছে। এবং অনেক জিনিস আবার আসেওনি। পৃথু যে পুরোপুরি তার “বাপকা বেটা” হয়নি, সেটা ভাল কি মন্দ তা অবান্তর। সব জাতকের বেলাতেই বোধহয় ওরকমই ঘটে। আধুনিক হিউম্যান জেনেটিকস সত্যিই এক দারুণ সাবজেক্ট। ক্রোমোসোমাল ব্যাকগ্রাউন্ড। জেনেটিক ইনফারেন্স। কনস্যাঙ্গুইনিটি প্রবলেমস অফ মালটিপল লোসি—কত কত সব বিচিত্র ব্যাপার! পড়তে পড়তে ওর মনে হয়, কোনও রহস্য উপন্যাসই পড়ছে বুঝি!

ও যতই বড় হয়েছে বয়সে, বিশেষত মনের বয়সে, ততই বাবার প্রোটোটাইপ না হয়ে, নিজের ওরিজিনালিটির দিকে, নিজের অভ্যন্তরের অভ্যন্তরে, নতুন প্রান্তরে, ওর নিজস্ব দিগন্তর দিকে সরে এসেছে। এইরকমই বোধহয় হওয়া উচিত। নইলে, ঠাকুর্দার ছেলের প্রোটোটাইপ হতেন বাবা, বাবার প্রোটোটাইপ পৃথু। সব পৃথুরাই তাই-ই। প্রোটেটাইপ হতে বাহাদুরি লাগে না কোনও।

পৃথুর অবশ্য কোনওদিনও অন্যের মতো হতে ইচ্ছাই করেনি। বাবার মতো হওয়ার কথা তো ছেড়েই দেওয়া গেল, এমনকী, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি আইনস্টাইনের মতোও হতে বাসনা যায়নি কখনও। চিরদিনই নিজের মতোই হতে চেয়েছিল ও। হয়েওছে। এই-ই আনন্দ! যদিও একটা আকাট অপদার্থই হয়েছে। তবুও, একেবারে নিজেরই মতো অপদার্থ। অন্য পদার্থ এবং অপদার্থদের তুলনায় ওর ব্যক্তিত্ব স্পষ্ট স্বকীয়তায় স্বতন্ত্র। “প্রোটো” শব্দটা একটা গ্রীক শব্দ। প্রোটো মানে ওরিজিনাল। “প্রোটো”ই হতে চেয়েছিল ও ছোট্টবেলা থেকেই; “প্রোটো-টাইপ” নয়।

একটু পরই ফিরে এল ঠুঠা আর শামীম। গাছতলা থেকে মহুয়া নিঃশেষ করে। মনে হল, বেশ তুরীয় অবস্থা। পা যেন ঠিকঠাক পড়ছে না। বারাশিঙাটার পিঠের উপর চড়ে বসে দুবার নাচানাচি করে নিল শামীম। মনে হল, দুজনের মধ্যে ওই-ই বেশি খেয়েছে। ঠুঠা বাইগা অবশ্য মহাদেব। তার কিছুই হয় না। শামীম বলল, আঃ! ক্যা উমদা চিজ গুরু। বড়া-কাবাব যো বনেগা, সাবীর মিঞাকা দিল্ খুশ্‌ হো যায়গা। বেশক্‌। বলেই, জিভ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করল।

ঠুঠা পাথরটার নীচে রেখে-দেওয়া তার ঝুলি থেকে বড় ছুরিটা বের করল কথা না বলে। কাজের সময় ঠুঠা কথা বলে না। কাজের সময় কাজ : খেলার সময় খেলা।

বারাশিঙার বুকের আর মুখের সামনে কার্তিকের শিশির ভেজা ঘাস, রক্তে লাল হয়ে ছিল। নাক গড়িয়ে এসে বার্নট-সীয়েনা-রঙা থকথকে কালো রক্ত জমে ছিল। বারাশিঙার গদিতে-আসীন শামীম নাক উঁচু করে গন্ধ নিল রাতের, রক্তের; মৃত্যুরও। ওর মুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠল। হলদু গাছের গনগনে আগুনে, ওর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে, পৃথুর হঠাৎই মনে হল, শামীম রক্ত খুব ভালবাসে বোধহয়, ভালবাসে খুন খারাপিও। খুন খারাপি করতে পারে না বলেই বোধহয় শিকার নিয়ে এত মেতে থাকে। শিকার বে-আইনী হবার এত বছর পরও। এর পেছনেও বোধহয় ওর ওই রক্ত-পিপাসাটাই কাজ করে। কে জানে? শামীমের জিন-এ কাদের রক্ত আছে? পাঠান? মোগল? শক? হুণ? কোন চেঙ্গিস খান-এর বংশধরের? কেন জানে না, পৃথুর প্রায়ই এ-কথা মনে হয় যে, একদিন এই সুন্দর, প্রাণবন্ত, হিন্দি-সিনেমার ডায়ালগ-বলা, ছলকে-চলা, চলকানো জীবনের রসিক শামীম ওর ভিতরের এই রক্তলোলুপ জিন-এর হাতেই খুন হয়ে যাবে। বেমালুম। বে-হদিস। কত মানুষই যে রোজ নিজেরই রক্ত ছেনে নিজেকে অলক্ষ্যে খুন করছে বিনা রক্তপাতে; সেইসব নিঃশব্দ খুনের খবর কেইই বা রাখে!

এইবারে রৌরব হয়ে উঠবে পৃথুর চোখের সামনে শুয়ে-থাকা, মানুষী-গৌরব; এই সুন্দর, কিন্তু নিথর, মৃত, বারাশিঙাটির জবরদস্তিতে বাজেয়াপ্ত শরীরটা। রক্ত ছুটবে ফিনকি দিয়ে, পেটের মধ্যে থেকে নানারকম শব্দ উঠবে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে। পেটটা ছুরি দিয়ে ফাঁসিয়ে দিলেই বায়বীয়, তরল, ভুতুড়ে সব শব্দ ছুটে যাবে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে-থাকা আতঙ্কিত গাছেদের দিকে, অসহনীয় দুর্গন্ধর সঙ্গে। একটু পরই, রক্তে চান করে, হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যাবে সোয়েটার, শার্ট ট্রাউজার খোলা, প্রায় উলঙ্গ ঠুঠা অথবা শামীম বারাশিঙাটার প্রকাণ্ড পেটের মধ্যে। রক্তক্ষরা লাল-মাংস-গুহার মধ্যে ওদের রক্তাক্ত হাত বারাশিঙাটার যকৃৎ ছিঁড়ে আনবে। তার পিত্তকে পয়সাওয়ালা দাম্ভিক মানুষের ইজ্জৎ-এরই মতো অতি সাবধানে বিমুক্ত করবে দারুণ দক্ষতায়, যাতে মাংস তেতো না হয়ে যায়। কথা যা গোপন, তা যেন ফাঁস না হয়ে যায়।

আরও পরে, একসময় নিথর হরিণটার হৃদয়টাকেও হঠাৎ এক ঝটকায় কব্জি ডুবিয়ে ছিঁড়ে আনবে শামীম। মস্ত প্রাণীর মস্ত হৃদয়!

মানুষের হৃদয় কখনও দেখেনি পৃথু। মানুষীর তো নয়ই! আছে কি আদৌ? থাকলেও বোধহয় খুবই ছোট্ট হয়। পিগমেন্টেশানটা কেমন হয়, তা কে জানে? পুরুষ বারাশিঙাটার হৃদয় দিয়ে উমদা-কলিজা-ফ্রাই হলেও হতে পারে। এ বড়ই দুঃখময় সত্য যে, মানুষের হৃদয় মানুষের অন্য কোনও কাজে তো লাগেই না, খাওয়া পর্যন্ত যায় না তা। কোনও দামই নেই সে হৃদয়ের। নারীর হৃদয়ও খাওয়া যায় না। অথচ পাঁঠার, খরগোশের, শজারুর, হরিণ, শম্বর, বারাশিঙার এমনকী গাধার হৃদয়ও খাওয়া যায়, কোনও না কোনও কাজে লাগে। কেবল ইন্টেলিজেন্ট মানুষের হৃদয়ই ফেলে দিতে হয়। কী দুঃখের ব্যাপার!

বোকা-পুরুষরা, নারীর হৃদয় নিয়ে তবুও কবিতা লেখে। চিরদিনই লিখেছে। এবং ভবিষ্যতেও লিখবে। তারা বলে, শামীমেরই মতো :

“ইয়ে দিল হামহারা সামহালকার হাতমে লেনা,

নজাকৎ ইসমে ইতনী হ্যায়,

যব নজরসে গীড়া; টুটা।”

“আমার এই নাজুক হৃদয়, এই পুরুষ-হৃদয় বড় সাবধানে হাতে নিও গো, বড় সাবধানে নিও; কারণ এ এতই ভঙ্গুর, এতই নাজুক যে, তোমার চোখের একটু আড়াল হলেই, চোখের আদর থেকে বঞ্চিত হলেই, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাবে।”

ভেঙে যাবে, গুঁড়িয়ে যাবে জেনেও তবু পৃথিবীর সব পুরুষ, নারীর হাতে তার হৃদয় তুলে দেয় বারে বারে। বনলতা সেনদের তবুও খুঁজে চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী। পুরুষ মানুষ, বারাশিঙা হরিণদের চেয়ে, শম্বরদের চেয়েও বোধহয় বোকা।

হাঁলো নদীর এপারে, অন্ধকারে, ঘাসের মধ্যে বুনো কুকুরগুলো সারে সারে কান উঁচু করে তখনও বসে থাকে অনন্তকালের প্রহরীর মতো। ওই কুকুরগুলো সময়ের চাকর নয়; সময়ই ওদের চাকর। চোখের ঠারে ঠারে, চোখের চকমকি দিয়ে অন্যর চোখে আলো জ্বালিয়ে, রাতে রাতে আলোর আলেয়া জ্বেলে বসে থাকে ওরা।

পৃথু এবার উঠে দিগার কাছে যাবে। এই রক্তারক্তি, মাংস নিয়ে ছেঁড়াছেঁড়ি চড়চড় ফরফর করে গা থেকে চামড়া ছিঁড়ে ফেলার-শব্দ, এই কালো থকথকে তরল মেটের মতো রক্ত পৃথু দেখতে পারে না। বুনো কুকুরগুলো কিন্তু মানুষের মতো, মৃত্যুকে এমনভাবে অপদস্থ, অপমানিত করে না কখনও। যে জানোয়ারই তারা শিকার করুক না কেন, পুরো দল একই সঙ্গে তার ঘাড়ে-মাথায়, গায়ে-পায়ে পড়ে, তাকে মাংস, রক্ত, লোম-চামড়া সবসুদ্ধ সাবড়ে, সাপটে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে চলে যায়। শুধু শিং আর ক্ষুরগুলো পড়ে থাকে অকুস্থলে। বনের গভীরের একটি স্বাভাবিক মৃত্যুর স্বাভাবিক সাক্ষী হয়ে।

প্রকৃতির নিয়ম, পৃথুর মনে হয়, ঠিক যেন রুষার সংসারেরই নিয়মের মতো। কোথাওই কোনও অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, নোংরা, অগোছালোমি এখানে থাকারই কথা নয়। নেইও। সব কিছুই স্পিক অ্যান্ড-স্প্যান। সব কিছুই এখানে এক অদৃশ্য সুশৃঙ্খল হাতে পরিচালিত হচ্ছে। নিখুঁত! খাদ্য ও খাদক, মৃত্যু ও জীবন; মেঘ ও রোদ্দুর, খরা ও বন্যা সমস্তই। তবে, এই প্রকৃতির মধ্যেই রিপুতাড়িত প্রাণীদের সংসারে আর সবই আছে, শুধু প্রেম নেই। “আহার, নিদ্রা, ভয় মৈথুনমকা সামান্যামেতাৎ পশুভিঃ নরানাং ধর্মহি তেষাম অধিকো বিশেষোঃ ধর্মেনহীনা পশুভিসমানাঃ”।

হিতোপদেশে পড়েছিল।

আহার, নিদ্রা, ভয় এবং মৈথুন পশু আর মানুষ দুইয়েরই। কিন্তু মানুষকে বিশেষ করেছে তার সত্য। তার ধর্ম। তার হিতাহিতজ্ঞান। তার সব অনুভূতি, বন্যপ্রাণীদের জন্যে নয়। না গো! সে প্রাণী যত সুন্দরই দেখতে হোক না কেন! ময়ুর কিংবা চিতা কিংবা চক্রবাক! নাঃ কারও জন্যেই নয়। রুষার ছোট্ট নিখুঁত সংসারের সঙ্গে প্রকৃতির এই বিরাট সংসারের এইখানেই মিল। খিদে আছে, কাম আছে, ঘুম আছে, সৌন্দর্য আছে, শ্লাঘা আছে। শুধু প্রেম নেই।

না, প্রেম নেই। নেই গো!

কুকুরগুলো একটুও নড়ছে না।

স্থির, অনড় বসে আছে বনের অনুষঙ্গরই মতো, ভেজা ঘাসের মধ্যে, তারাদের আর হলুদ গাছের আগুনের আলোয় কান উঁচু করে এই কটি অদ্ভুত প্রাণীকে লক্ষ্য করছে ওরা, খিদে পেটে নিয়ে, মুখের গ্রাস হারিয়েও; মানুষের কাছে শেখার মতো ওদের কিছু কি নেই তাই-ই জানোয়ারসুলভ সারল্যর সঙ্গে বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওদের ভবিষ্যৎ আছে। মনে হয়। কারণ জীবন সম্বন্ধে ওরা এখনও ঔৎসুক্য হারায়নি।

বুনো কুকুরগুলো বসে থাকবে সারা রাত, যতক্ষণ পৃথুরা থাকবে ওখানে। সার সার, বনের অনুষঙ্গর মতো; বনে।

মনেরও অনুষঙ্গর মতো; পৃথুর মনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *