১১৯
ক্রাচে ভর দিয়ে হাসপাতাল থেকে যখন বেরিয়ে এল চয়ন, তখন সকাল। দিন দশেক এক নোংরা হাসপাতালের বন্দীদশা থেকে মুক্তি। সব ক্ষত সারেনি। মাথায় ব্যান্ডেজ আছে, বাঁ পায়ে প্লাস্টার। শরীরে এখনও অন্তহীন ব্যথা। বাইরে সকালটা একটু মেঘলা, বিষন্ন। শীতের বৃষ্টি পড়ছে অশ্রুর মতো টিপটিপ করে। স্যাঁতানো হাওয়া।
বাইরে বেরোনোর আগে একটু দাঁড়াল চয়ন। কোথায় যাবে? যাওয়ার জায়গা তার একটাই। দাদার বাড়ির চিলেকোঠা। কিন্তু সেখানে যেতে আজ তার বড় লজ্জা করছে। অনিচ্ছে হচ্ছে। চেনা ঘরটা আজ যেন তেপান্তরের মতো দূর।
একটু খুঁড়িয়ে চয়ন হাসপাতালের বাইরে এসে দাঁড়াল। শীত করছে। ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু এই চেনা কলকাতা আজ বড় অচেনা ঠেকছে তার। কোথায় যাবে?
তার মান-অপমানের বোধ তেমন নেই। শুধু আছে পশুর মতো মৃত্যু ও যন্ত্রণার ভয়। আছে বেঁচে থাকার অদ্ভুত সাধ।
এবার অনিন্দিতার কথা মনে হয়েছিল তার। কিন্তু না, এভাবে সে-বাড়িতে হাজির হওয়া যায় না। সেটা হবে ওদের ওপর নিজেকে চাপিয়ে দেওয়া। তাকে ফেলবে না চারুশীলাও। কিন্তু এই অবস্থায় তাকে দেখে চারুশীলার প্রবল প্রতিক্রিয়া হবে। খুব লজ্জা করবে চয়নের।
সে কি শেষ অবধি সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় হয়ে গেল? সে বুঝতে পারছে না। দুর্বলতায় তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। অনভ্যাসের ক্রাচ তার বগলে ভীষণ ব্যথা দিচ্ছে। তবু ভাগ্যিস পাড়ার পন্টু তার মৃত জ্যাঠামশাইয়ের দুখানা ক্রাচ দয়া করে পরশু দিয়ে গিয়েছিল তাকে। বলেছিল, এ দুটো তোমার লাগবে। বাঁ হাঁটু তো গুঁড়িয়ে গেছে।
কত কি ভেঙেছে চয়নের তার হিসেব কে রাখে?
আরও একটু হাঁটল চয়ন। হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, সেই চিলেকোঠার ঘরে তার সর্বস্ব রয়েছে। না গিয়েই বা সে করে কি?
একদিন হঠাৎ মোহিনীর পড়ার ঘরে কৃষ্ণজীবন হাজির হয়ে বললেন, চয়ন, গ্রাম তোমার কেমন লাগে?
কৃষ্ণজীবনের গ্রাম সম্পর্কে অবসেশন আছে, চয়ন জানে। সে ভাবল বোধ হয় উনি নতুন একটা কিছু ভেবেছেন, তাই নিয়ে আলোচনা করতে চান। সে বলল, ভালই লাগে।
কৃষ্ণজীবনের পরের প্রশ্নটা অনেক বাস্তবঘেঁষা। বললেন, শুধু ভাল লাগলেই হবে না। গাঁয়ে গিয়ে থাকতে পারবে?
চয়ন অবাক হল। একটু ভেবে বলল, বোধ হয় পারব।
কৃষ্ণজীবন ভ্রু কুঁচকে তার দিকে চেয়েই কিছু চিন্তা করে বললেন, তোমার পক্ষে গ্রামের নিস্তরঙ্গ পরিবেশ ভালই হবে মনে হয়। কলকাতার প্রতি কোনও বিশেষ আকর্ষণ নেই তো!
না তবে আমি জন্মাবধি কলকাতায়।
একটু ভেবে দেখবে নাকি?
আমাকে কি গ্রামে যেতে হবে?
কৃষ্ণজীবন একটু হাসলেন। তারপর বললেন, আমার বাবা একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়াতেন। তখন বেতন খুব সামান্য ছিল। এখন তা নেই। সেই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে আমি আছি। সেখানে একজন অঙ্ক আর ইংরিজি পড়ানোর লোক চাই। চাকরিটা তোমার হতে পারে। করবে?
চয়ন একটুও না ভেবে বলল, করব।
ভাবতে সময় নিলে না। পরে যদি কলকাতার জন্য মন কেমন করে?
আমার তা করবে না।
ঠিক বলছ? তা হলে কাল সকালে তোমার চেক-বইটা নিয়ে আমার কাছে চলে এসো। যে টাকাটা তুমি আমাকে পৃথিবীর ভালর জন্য দিয়েছিলে সেটা আমি তুলিনি। ভেবেছিলাম ভাবাবেগের বশে দিচ্ছ, পরে হয়তো টাকাটা তোমার দরকার হবে। এবার টাকাটা সত্যিই দরকার।
টাকাটা তো আপনাকে দিয়েই রেখেছি। আপনি যা খুশি করতে পারেন।
যা খুশি নয়। টাকাটা তোমার চাকরির জন্যই দরকার। কত বিচিত্র ধরনের ঘুষ যে আজকাল চালু হয়েছে তার লেখাজোখা নেই। তোমার চাকরির জন্য ত্রিশ হাজার টাকা ডিম্যান্ড করছেন ওরা। তাও আমার খাতিরে কিছু কম করে ধরেই। ভাবতে পারো ছাত্রছাত্রীদের চরিত্র গঠনের পবিত্র প্রতিষ্ঠানে তোমাকে ঢুকতে হচ্ছে ঘুষ দিয়ে? অদ্ভুত দেশ!
কিন্তু ও টাকা আমার চাকরির জন্য খরচ হলে তো আমার দান করাটা বৃথা হল।
কৃষ্ণজীবন মাথা নেড়ে বললেন, না, টাকাটা পৃথিবীর উপকারেই লাগল বলে ধরে নিচ্ছি। তোমার প্রতিষ্ঠা হলে পৃথিবীর উপকার হবে বলেই আমি মনে করি। ঘুষটা মানতে পারছিলাম না। কিন্তু উপায় যখন নেই তখন শুচিবাই ত্যাগ করাই ভাল।
পরদিন কৃষ্ণজীবন তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে টাকাটা তুললেন। বললেন, আরও কুড়ি হাজার টাকা গ্রামের ব্যাংকে রেখে দিও। বিপদে আপদে কাজে লাগবে। আপাতত আমার কাছে থাক।
চয়ন ফিরে এসেই একদিন ছাদে চলে এল। হাবভাব বেশ কঠোর, কী রে? জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের দরখাস্ত জমা দিয়েছিলি?
চয়ন দাদার রুদ্রমূর্তি দেখে ভয় খেয়ে গেল। বলল, টাকাটা অন্য কাজে লেগেছে।
অয়ন যেন ভূত দেখছে, এমন চোখে চেয়ে বলল, তার মানে?
আমি একটা মাস্টারির চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। ওরা টাকাটা চাইছে।
থম ধরে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে অয়ন বলল, মাস্টারির চাকরি না মামদোবাজি?
না না, আমি কৃষ্ণজীবনবাবুকে টাকাটা দিয়েছি।
কে কৃষ্ণজীবন?
আমি তাঁর মেয়েকে পড়াই।
লোকটার ঠিকানা দে।
ঠিকানা! ঠিকানা দিয়ে কী হবে?
আমি খোঁজ নিয়ে দেখব তুই সত্যি কথা বলছিস কি না। যদি সত্যিও হয় তা হলে লোকটার কাছ থেকে টাকা ফেরত নিতে হবে।
কেন?
দেখ, তোর চালাকি আমি বুঝতে পেরেছি। পাছে টাকাটা আমাকে দিতে হয় সেই ভয়ে তুই ওটা সরিয়েছিস।
চয়ন হঠাৎ সাহস করে বলল, কিন্তু টাকাটা তো আমার। আমি কি টাকাটা ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারি না?
হঠাৎ অয়নের চোখমুখের চেহারা পাল্টে গেল। খুনীর মতো ঠাণ্ডা গলায় বলল, তাই নাকি রে শুয়োরের বাচ্চা? দুধকলা দিয়ে এতকাল কালসাপ পুষেছি? টাকাটা তোর? আর তুই যে এতকাল বিনা ভাড়ায় এ বাড়িতে বসবাস করছিস! দে শুয়োরের বাচ্চা, বারো বছরের ভাড়া দে।
সে বউদির হাতে প্রতি মাসে আজকাল ঘরভাড়া বাবদ একশ টাকা করে দেয়, কিন্তু সে কথাটা বলতে তার সাহস হল না। সে চুপ করে রইল।
কিন্তু অয়ন চেঁচাতে লাগল, দে শালা, ভাড়া দে। বাপের জমিদারি পেয়েছিস? গায়ের জোরে থাকবি এখানে?
চয়ন একটাও কথা বলতে পারছিল না। এই গনগনে রাগে জল ঢালবে কে? কোন কথায় কাজ হবে? বরং চুপ করে থাকাই ভাল। সে শুধু সম্মোহিতের মতো অয়নের দিকে চেয়েছিল।
আশপাশের ছাদে দু-চারজন লোক জড়ো হচ্ছিল মজা দেখতে। অয়ন লোকলজ্জার ভোয়াক্কা না করেই চিৎকার করতে লাগল, যা আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। আজই যাবি। দেখি কোন কৃষ্ণজীবন তোকে রাখে!
বউদি এই সময়ে উঠে এসে অয়নকে একরকম টেনেই নিয়ে গেল নিচে। চয়ন অর্ধেক রান্না করেছিল। স্টোভ নিবিয়ে দিয়ে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইল। রাতে আর কিছু খেল না।
পরদিন অয়ন বেরিয়ে যাওয়ার পর বউদি এল।
চয়ন, তুমি কাকে টাকা দিয়েছ বলো তো!
কৃষ্ণজীবনবাবুকে।
তিনি কি ভাল লোক?
ভীষণ ভাল বউদি। তিনি বিশ্ববিখ্যাত লোক।
তোমার দাদার ধারণা তুমি হয় ঠগবাজের পাল্লায় পড়েছ না হলে মিথ্যে কথা বলছ। কিন্তু আমি বলি, টাকাটা সরিয়ে ফেলে ভাল কাজই করেছ। তোমাকে তো বলেইছি, শেয়ার মার্কেটের নেশায় ও এখন পাগল।
বউদি, দাদাকে তুমি বুঝিয়ে বোলো, টাকাটা আমার সত্যিই দরকার ছিল। আজকাল মাস্টারির চাকরি পেতে নাকি টাকা দিতে হয়।
জানি তো। আমার পিসতুতো ভাই শিবনাথকেও টাকা দিতে হয়েছে। তোমার কি চাকরি হচ্ছে?
হওয়ার কথা।
চাকরি হলে খুব ভাল হবে চয়ন।
আরও দুদিন পর চয়ন ছাদ থেকে শুনতে পেল দাদা আর বউদিতে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। বউদি বলছিল, কেন ওর টাকা নেবে তুমি? বেচারা কত কষ্ট করে রোজগার করেছে, কেন সে টাকা তুমি শেয়ারে খাটাবে?
ও আমাকে অবিশ্বাস করে কোন সাহসে?
অবিশ্বাস আমিও করি। তুমি আমার বিয়ের হারটা বেচে শেয়ারে খাটিয়েছ। বলেছিলে দুটো হার দেবে। দিয়েছ? আমারটা গেছে যাক, ওরটা নেবে কেন?
ওরে মাগী! খুব যে দরদ! বলি অন্য কিছু আছে নাকি?
শুনে চয়নের শরীর অবশ আর মাথা বিহ্বল হয়ে গেল। অয়ন কি সত্যিই পাগল হয়ে গেল?
দোতলায় ঝগড়াটা তুঙ্গে উঠল, আবার ঝপ করে বন্ধ হয়ে গেল। এই বন্ধ হয়ে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক। অয়ন বউদির গলা টিপে ধরেনি তো।
আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে যখন ব্যাপারটা দেখতে নিচে যাবে বলে উঠে দাঁড়িয়েছে চয়ন, ঠিক তখনই সিঁড়ি দিয়ে রড হাতে দৌড়ে ছাদে উঠে এল অয়ন। দিগ্বিদিগভজ্ঞানশূন্য, রাগে অন্ধ, কাণ্ডজ্ঞানহীন।
জীবনে এত মার খায়নি চয়ন। অবিশ্বাস্য। এভাবে কেউ কাউকে মারতে পারে? এত জোরে? এত নিষ্ঠুরভাবে? পরম সৌভাগ্য তার যে, মারটা বেশিক্ষণ সহ্য করতে হয়নি তাকে, হাঁটুতে লাগতেই সে কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গিয়ে জান্তব চিৎকার করছিল শুধু। যখন মাথায় লাগল তখন পরম শান্তির মতো মূর্ছা এসে নোংরা নিষ্ঠুর পৃথিবীটাকে যবনিকায় ঢেকে দিল।
জ্ঞান ফিরল পরদিন দুপুরে। আশ্চর্য মানুষের জীবনীশক্তি। তার মতো দুর্বল, ক্ষীণজীবী মানুষও যে কি করে মাথায় ওই রডের বাড়ি খেয়ে বেঁচে রইল কে বলবে। পন্টু এবং পাড়ার ছেলেরা অবশ্য বলেছিল, সে পড়ে যাওয়ায় রডটা মাথায় ঠিকমতো লাগেনি। শানের ওপর ঘষটা খেয়ে তারপর লেগেছিল বলে ইমপ্যাক্ট কমে গিয়েছিল। নইলে ঘিলু বেরিয়ে যাওয়ার কথা।
সে পন্টুকে বউদির কথা জিজ্ঞেস করেছিল।
পন্টু বলল, বউদিকে মেরেছিল টর্চ দিয়ে। মাথায় লেগে অজ্ঞান হয়ে যায়। তবে তেমন কিছু হয়নি। সামলে গেছে।
পুলিশ কেস?
পন্টু লাজুক একটু হেসে বলল, ওটা আর করিনি। শালা পুলিশের হাতে তুলে দিলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। কোথায় কোন কলকাঠি নেড়ে খালাস পেয়ে যাবে। পাড়ার লোকই অয়নদাকে টিট করেছে।
মেরেছ তোমরা?
কিছু মনে কোরো না ভাই, ও চিজকে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত। তার বদলে দু-চার ঘা আর বেশি কি? পাড়ার সিনিয়ররা এসে না পড়লে সেদিন অয়নও ইমার্জেন্সি কেস হয়ে যেত। দুটো দাঁত ভেঙেছে, আর কনুই মুচড়ে গেছে। কিল চড় লাথি যা পড়েছিল তাতে দিন চার-পাঁচ শুয়ে থাকতে হবে। তুমি চাইলে পুলিশ কেস করতে পারো।
চয়ন গত দশ দিন যাবৎ ভেবেছে, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর সঙ্গে যুঝবার ক্ষমতাই তার নেই। সে বড় নরম, বড় দুর্বল, বড় ভীতু। মাথার ওপর একটু ছাদের জন্য অয়নকে তার আর বিব্রত করা উচিত নয়। এবার তার চিলেকোঠা ছাড়ার সময় হয়েছে।
হাসপাতাল থেকে তার ছুটি হয়নি। মাথা স্ক্যান করার কথা বলেছে ডাক্তার। আরও কিছু মেরামতি কাজ বাকি।
কিন্তু হাসপাতালে আর থাকতে পারছিল না চয়ন। আজ সকালে কাউকে কিছু না বলে সে বেরিয়ে এল। কেউ আটকাল না। রুগীর ভিড়ে কে কাকে লক্ষ করে!
হাঁটতে তার কষ্ট হচ্ছে। শরীর কাঁপছে, ক্রাচে কষ্ট হচ্ছে। দম পাচ্ছে না। কোথায় যাবে ভেবেও পাচ্ছে না সে।
একটা হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে সে একটা ফোন করল কৃষ্ণজীবনকে। বিরল সৌভাগ্যই বলতে হবে। কৃষ্ণজীবনের ফোন সচল আছে এবং উনি কলকাতায় আছেন। নিজেই ফোন ধরলেন।
স্যার, আমি চয়ন।
কি খবর চয়ন? অনেকদিন আসোনি শুনলাম। শরীর খারাপ নাকি?
হ্যাঁ স্যার। শরীর খারাপ।
কী হয়েছিল?
আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
আজ শনিবার। আমার ছুটি। তুমি কি এখনই আসতে চাও?
চাই স্যার। কিন্তু আমার কাছে এখন গাড়িভাড়া নেই।
চলে এসো ট্যাক্সি করে। মোহিনীকে আমি দশ মিনিট বাদে নিচে পাঠাবো। সে ভাড়া দিয়ে দেবে।
মোহিনী নিচেই দাঁড়িয়ে ছিল। ক্রাচ-সহ তাকে নামতে দেখেই একটা আর্তনাদ করে দৌড়ে এসে তাকে ধরল, কী হয়েছে আপনার? ইস, এ যে সাঙ্ঘাতিক অবস্থা!
ম্লান একটু হাসল চয়ন। বলল, দিজ আর দি উন্ডস্ অফ লাভ। সেলফিস জায়েন্ট মনে আছে মোহিনী?
মোহিনীর চোখ ছলছল করছিল, আপনার কি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল?
হ্যাঁ হ্যাঁ, সেরকমই। না, ধরতে হবে না। আমি পারব।
তাকে দেখে অবাক কৃষ্ণজীবন বলল, এ কী কাণ্ড চয়ন?
ক্লিষ্ট হেসে চয়ন বলল, স্যার, সব কথা বলতে আমার লজ্জা করবে।
তার মানে কি চয়ন? কেউ কি তোমাকে মারধর করেছে? সে কি তোমার দাদা?
চয়ন মাথা নেড়ে জানাল, হ্যাঁ।
কৃষ্ণজীবন কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তুমি হাসপাতালে ছিলে?
হ্যাঁ। আজ পালিয়ে এসেছি।
আমাকে আগেই জানাতে পারতে। তা হলে ব্যবস্থা হয়ে যেত। তুমি তো এখনও সুস্থ নও।
না স্যার, আমি ভাল আছি। আপনি আমাকে একটা গ্রামে পাঠাতে চেয়েছিলেন। এখন আমি সেখানেই চলে যেতে চাই।
কৃষ্ণজীবন একটু হাসলেন, যাবে, তার জন্য তাড়া নেই। কিন্তু আগে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া দরকার। তোমার তো মনে হচ্ছে গায়ে এখনও জ্বর। শরীর কাঁপছে। মুখ সাদা। বোসো। আমাদের বাড়ির কাছেই একটা নার্সিং হোম আছে। একটা ফোন করে দেখি।
লাগবে না স্যার।
লাগবে।
কৃষ্ণজীবন ফোন করলেন। এবং ঘণ্টা খানেক বাদে একটা নার্সিং হোমের পরিচ্ছন্ন ঘরে চয়ন আশ্রয় পেল। একজন ডাক্তার তার ক্ষত পরীক্ষা করে বললেন, আপনি এখনও হসপিট্যাল কেস। কে আপনাকে রিলিজ করল?
কেউ না। আমি পালিয়ে এসেছি।
ডাক্তার একটু হেসে বললেন, এখনও কিছুদিন শুয়ে থাকতে হবে।
তা রইল চয়ন। তিনতলার নির্জন নিরিবিলি ঘরে বেশ শান্তিতে রয়ে গেল সে। দিন কয়েক বাদে কৃষ্ণজীবন এসে বললেন, তুমি মনের দিক থেকে প্রস্তুত তো চয়ন। এখনও ভেবে দেখ, গ্রামে থাকতে পারবে কি না। শহুরে আরাম কিন্তু সেখানে নেই।
চয়ন অত্যন্ত উদ্বেল হয়ে বলল, আমাকে কি ওরা নেবে স্যার?
নেবে। সে জন্য চিন্তা নেই। চিন্তা হল তোমাকে নিয়ে। তুমি পারবে তো?
পারব।
কৃষ্ণজীবন একটু চুপ করে থেকে বললেন, তুমি হয়তো শুনে খুশি হবে না, আমি তোমার দাদার সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করেছি। আমাদের কথা হয়েছে।
অবাক চয়ন বলে, দাদার সঙ্গে?
হ্যাঁ। তুমি কি জানো যে পাড়ার লোকেরা তোমার দাদাকে খুব মার দিয়েছে?
জানি স্যার। আপনার সঙ্গে কোথায় দেখা হল?
আমি তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ভয় পেও না, তারা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি।
আপনি কেন এতটা করলেন? আমার দাদা আপনাকে অপমান করতে পারত।
তা পারত। কিন্তু সে এখন অনুতপ্ত। খুবই অনুতপ্ত। তার ছেলেপুলে নেই, স্বামী-স্ত্রীর সংসার। শেয়ার মার্কেটের নেশায় কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল। সে তোমাকে ও বাড়ি ফিরে যেতে বলেছে। কথা দিয়েছে আর কোনও গণ্ডগোল হবে না। তুমি এখন কয়েকদিন চুপ করে শুয়ে শুয়ে ভেবে দেখ, গ্রামে যাবে, না এখানেই থাকবে। এখনই জবাব দিও না। হাতে সময় আছে। হয়তো এ শহরেই কোনওদিন তোমার একটা চাকরিও হয়ে যেতে পারে। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে হয়তো অসম্ভব নয়। এ শহরের একটা সাঙ্ঘাতিক নেশা আছে! চট করে কলকাতাকে জীবন থেকে মুছে ফেলা যায় না।
আমি পারব স্যার।
তুমি তাজমহল দেখনি, না?
না।
আমি প্রথমবার যখন তাজমহল দেখতে যাই তখন ওরকম একটা মাচ পাবলিসাইজড ইমারত দেখে তেমন কিছু ইমপ্রেশন হয়নি। কিন্তু আশ্চর্য কী জানো? যখন দেখে-টেখে চলে আসছি তখন একটা ম্যাগনেটিক পুল যেন পিছন থেকে টানছিল। বারবার ফিরে তাকাতে হচ্ছিল তাজমহলের দিকে। অ্যাট্রাকশনটা যে কিসের তা আজও বুঝতে পারিনি। কলকাতার আকর্ষণ তাজমহলের মতো নয়। কিন্তু এই শহরেরও একটা মিস্টিরিয়াস অ্যাট্রাকশন আছে। লজ্জার কথা কী জানো, আমি এত গ্রাম-ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও কলকাতাকে কখনও অস্বীকার করতে পারি না। তাই বলছি, কলকাতাকে ডিভোর্স করার আগে ভাল করে ভেবে নাও।
বিচক্ষণ কৃষ্ণজীবন কতখানি সত্যি কথা বলেছিলেন তা তিন-চারদিন ধরে নানা কথা চিন্তা করার পর একটু একটু টের পেতে লাগল সে। হয়ত সত্যিই সে পারবে না অজ পাড়াগাঁয়ে গিয়ে থাকতে। হয়তো বিষণ্ণ লাগবে, একা লাগবে।
তাকে দেখতে এল চারুশীলা, ছেলেমেয়ে নিয়ে। দেখতে এল হেমাঙ্গ। দেখে গেল ঝুমকি আর অনু। রোজ দেখে যায় রিয়া আর তার ছেলেমেয়েরা। তারপর, দিন সাতেক বাদে তাকে আপাদমস্তক চমকে দিয়ে এক বিকেলে এসে হাজির হল দাদা আর বউদি।
অয়নের সামনের দুটো দাঁত উড়ে মুখটা ফোকলা আর বোকা বোকা দেখাচ্ছিল। কেমন একটা সংকুচিত ভাব। বউদি বিষণ্ণ,ছলছলে।
প্রথমটায় কথা আসছিল না কোনও পক্ষেরই। শেষ অবধি অয়ন কষ্ট করেই বলল, আমিও তো মার খেয়েছি, দেখছিস! শোধবোধ হয়ে গেছে।
চয়ন শান্তভাবে বলল, আমি গ্রামে চলে যাওয়ার কথা ভাবছি।
সে যাওয়ার হলে যাবি। কিন্তু কাজিয়াটা মিটিয়ে নে।
বউদি বলল, ছাদের চিলেকোঠাটা একটু বড় করে ছাদ ঢালাই হবে। বুঝলে? তোমার জন্যই।
কেন বউদি?
আমরা অনেক ভেবে দেখেছি, তোমার দাদার বা আমারও আপনজন বলতে কেউ নেই। আমি মা-বাপের একমাত্র সন্তান। আমাদের কে আছে বলো তো! ছেলেপুলেও হল না। বয়স হয়ে যাচ্ছে।
আমি যদি কলকাতায় থাকি তা হলে ওই চিলেকোঠাতেই থাকতে পারব।
বউদি একটু হাসল, পারবে না। চিলেকোঠা ভেঙে ফেলে ঘর করা শুরু হয়ে গেছে। আজ ঢালাইও হয়ে গেল।
কেন করতে গেলে? কত খরচ!
বউদি মাথা নেড়ে বলল, তোমার জন্যই তো নয়। চিলেকোঠাটা এমনিতেই নড়বড়ে ছিল। ভেঙে করতেই হত। শোনো চয়ন, গ্রামে গিয়ে মাস্টারি করতে চাও কেন? সেখানে কোন উন্নতিটা করবে শুনি? টিউশনি করেই তো তোমার বেশ চলে যাচ্ছে।
তোমরা কি আমাকে চাও বউদি? আমার যে বিশ্বাস হতে চায় না। ভাবি, তোমাদের ঘাড়ে পড়ে আছি বোঝা হয়ে।
বউদি একটু বিষণ্ণ হয়ে বসে থেকে বলল, সবকিছুই বুঝতে একটু সময় লাগে। বয়সও লাগে। আমার আজকাল মনে হয়, তোমাকে আমাদের আর একটু বোঝা উচিত ছিল। তুমি বড্ড নিরীহ বলেই বোধ হয় তোমার ওপর অত্যাচারটা বেশি হয়।
অয়ন মিনমিনে গলায় বলল, কবে ছাড়বে এরা?
জানি না।
ঠিক আছে। খবর নেবো। এসে নিয়ে যাবো’খন।
দাদা বউদি চলে যাওয়ার পরই যেন সে বুঝতে পারল, সত্যিই সে কলকাতা ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকতে পারবে না। নিজের হাতের তেলোর মতো চেনা তার এই শহর। প্রতিটি রাস্তাঘাট, এ শহরের সকাল বিকেল, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত এ সবই তার আজন্ম চেনা। এ শহর ছেড়ে কোথায় যাবে সে?
না, গ্রামে গিয়ে সে পারত না। বিচক্ষণ ও জ্ঞানী কৃষ্ণজীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে গেল।
ক্রাচে ভর দিয়ে যেদিন নার্সি হোম থেকে বেরিয়ে এল সে, সেদিনই সে অবাক চোখে দেখল, শীতের সকালে কলকাতা যেন তারই অপেক্ষায় সেজে বসে আছে। সাজ কিছুই নয়, একটু রোদ, লোকজন, একটু ঠাণ্ডা হাওয়া। সেই পুরনো কলকাতাই। তবু যেন এক আবিষ্কারকের চোখে নতুন ভূখণ্ড দেখল চয়ন।
দাদা আর বউদি দু’ধারে, সে ধীরে ধীরে ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠল।