১১৮. একবিংশ শতকে কেমন হবে নর-নারীর সম্পর্ক

আপনি কি ভেবে দেখেছেন যে, এইসব প্ৰেম-টেম এবং বিয়ে-টিয়ে আর কতদিন সমাজপতিরা টিকিয়ে রাখতে পারবেন! একবিংশ শতকে কেমন হবে নর-নারীর সম্পর্ক? দাম্পত্য জীবন বলে কিছু থাকবে? থাকবে লাইফ-লং পার্টনারশিপ?

ঝুমকি খুব সিরিয়াস মুখ করে বলল, কেন থাকবে না?

সামান্য উত্তেজিত হেমাঙ্গ বলে, কী করে থাকবে? ভারতবর্ষের এক কোণে বাস করে কি পৃথিবীর ট্রেন্ড বোঝা যায়?

ঝুমকি বলল, কেন যাবে না? আমরা বুঝি পৃথিবীর খবর রাখি মা?

তাহলে কী করে বলছেন যে, এসব থাকবে?

থাকবে, কারণ মানুষ বারবার তার জীবনে একটা রিনিউয়াল ঘটায়। অনেক প্রথা অভ্যাস ভেঙে ফেলে। কিন্তু আবার সেগুলোকেই আঁকড়ে ধরে।

হেমাঙ্গ যেন চিন্তিতভাবে ঝুমকির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে, আপনি কি প্রগতি পছন্দ করেন?

প্ৰগতি একটা ভোগ টার্ম। স্পেসিফিকালি বলুন, প্ৰগতি বলতে কোনটা!

চিন্তিত হেমাঙ্গ বলে, আমিও কি ছাই জানি! এই যা সব হচ্ছে আর কি।

অনেক কিছু নতুন হচ্ছে, আবার পুরনোও থেকে যাচ্ছে তো। শুধু আমেরিকাই তো নেই, পৃথিবীতে ভারতবর্ষও তো আছে।

হেমাঙ্গর ভাঙা শরীর জোড়া লেগেছে। বাঁ পায়ে সামান্য একটু খোঁড়ানো ছাড়া আর কোনও দৃশ্যমান ক্ৰটি নেই। বী হাত কিছু কমজোরি। ফিজিও থেরাপি চলছে। আশা করা হচ্ছে মাসখানেকের মধ্যেই সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ঝুমকি গত দু মাস ধরে রোজ বিকেলের দিকে আসত, সঙ্গে মাকে নিয়ে। কখনও কখনও একাও। গত সাতদিন হেমাঙ্গ অফিস করছে বলে আসা কমিয়েছে। শনি আর রবিবার সকালের দিকে আসে। দুপুরে চলে যায়। এখনও তাদের মধ্যে আপনি সম্বোধন রয়ে গেছে। দৃশ্যত দুজনে পরস্পরের দিকে এক চুলও এগোয়নি।

ঝুমকি এক কাপ দুধে কফি গুলে এগিয়ে দিল হেমাঙ্গকে। হেমাঙ্গ কফিটায় একটা চুমুক দিয়ে বলল, ভারতবর্ষ কি পাল্টে যাচ্ছে না? ব্রিটিশ আর আমেরিকান কালচার বরাবর ভারতবর্ষকে দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোল করে।

আপনি তো নিশিপুরে গিয়ে মাঝে মাঝে থাকেন। সেখানে কী দেখতে পান বলুন তো?

ওঃ, গ্রামের কথা আলাদা। সেখানে অন্যরকম।

গ্রামই তো ধরে রাখে।

সবেগে মাথা নাড়ে হেমাঙ্গ, গ্রাম দুর্বল। দেশের কালচারে তার প্রভাব খুব কম।

আচ্ছা, আজ আমরা এসব নিয়ে আলোচনা করছি কেন?

হেমাঙ্গ একটু হেসে বলল, আমারই দোষ। কাল রাতে কী হল জানেন। একটা ক্যাসেট চালিয়ে গভীর রাতে মাইকেল জ্যাকসনের রক শুনছিলাম। শোনা এবং দেখা। দেখতে দেখতে মনে হল, এ লোকটা মূর্তিমান অ্যান্টি-কালচার, অ্যান্টিএসথেটিকস, অ্যান্টি-মিউজিক। কী অশ্লীল সব জেসচার। এর জন্য দুনিয়া এত পাগল কেন? এ লোকটা সারা পৃথিবীর কালচারে পচন ধরিয়ে দিচ্ছে না কি? তার পর থেকেই মাথাটা এক লাইনে ভাবতে শুরু করে দিল।

মাইকেল জ্যাকসনেরও হয়তো কিছু গুণ আছে; আমরা তত বুঝি না বলে রস পাই না। কিছু না থাকলে লোকটা কি এত পপুলার হত?

অসহায়ভাবে হেমাঙ্গ ঠোঁট উল্টে বলে, কে জানে! আপনি ওর গান শুনেছেন এবং দেখেছেন কি?

হ্যাঁ। তবে আপনার মতো রেগে যাইনি।

ঝুমকি মুখ টিপে হাসল এবং হেমাঙ্গ অপ্রতিভ বোধ করতে লাগল।

এক একদিন তাদের এক এক বিষয় নিয়ে কথা হয়। যেমন পরের রবিবার বাঁ পায়ের স্বাভাবিকতা যখন অনেকটাই এসে গেছে তখন ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে করতে হেমাঙ্গ বলল, আচ্ছা ঝুমকি নিশিপুর কেমন লাগে আপনার?

ঝুমকি বড় বড় চোখ করে বলল, নিশিপুর! কেন, বেশ তো জায়গাটা।

না, না, ওরকম দায়সারাভাবে বলবেন না। আমি জানতে চাই নিশিপুর একটা রোমান্টিক জায়গা কি না।

ঝুমকি একটু ভেবে বলল, হু। রোমান্টিকই তো। কিন্তু মতলবটা কী? নিশিপুর যাওয়ার ইচ্ছে নাকি?

কতদিন যাইনি বলুন তো!

আগে হাড্রেড পারসেন্ট সেরে উঠুন। তারপর যাবেন।

না, আমার তাড়া নেই। আমার শুধু মনে হয়, নিশিপুরে নদীর ধারে আমার ঘরখানা হা-পিত্যেশ করে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

ঝুমকি একটু হাসল। বলল, নিশিপুর তো আর কেউ কেড়ে নিচ্ছে না।

কতুর চোখে ঝুমকির দিকে তাকিয়ে হেমাঙ্গ বলল, নিশিপুরের বাড়িটার জন্য আমার বড় মায়া। বুঝলেন!

জানি তো!

আমি ওখানে মাঝে মাঝে পালিয়ে যাই বলে সবাই আমাকে বকে। আমার মার তো ধারণা আমি সাধু হওয়ার তালে আছি। আমার পার্টনাররা বলে, আমাকে নাকি নিশি-তে পেয়েছে। চারুদি তো সবসময়ে যাচ্ছেতাই বলছে। অথচ দেখুন, নিশিপুর একটা মুক্তি, একটা ছুটি। আমার যে কী ভীষণ ভাল লাগে!

একটু বিবশ হয়ে গেল ঝুমকি। আবেগতাড়িত, ছেলেমানুষ এই লোকটিকে কি এইজন্যই তার এত ভাল লাগে? মানুষটির ভিতরে একটা গভীর ব্যাপার আছে, মুগ্ধতা আছে। টাকা, কেরিয়ার, সাফল্য একে এখনও ছিবড়ে করে ফেলেনি।

ঝুমকি সামান্য নরম করে বলল, কয়েকটা নতুন ধরনের ফুলের গাছ লাগাতে হবে। গেট-এর ওপর একটা লতা। আর একটা তুলসীমঞ্চ।

হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, কিছু বললেন?

ঝুমকি হেসে ফেলল, বলছিই তো! আপনি শুনলেন না?

নিশিপুরের বাড়ির কথা?

হ্যাঁ। সাজিয়ে নিলে আরও সুন্দর হবে। মাটিটা তো খুব ভাল, কেন যে ভাল ভাল গাছ লাগাননি!

হেমাঙ্গর চোখমুখ আলো হয়ে গেল। আবেগকম্পিত গলায় বলল, উঃ, একটা ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।

কিসের দুশ্চিন্তা?

চারুদি বলছিল, আপনি নাকি নিশিপুর পছন্দ করেন না।

চারুমাসি নিজেই করে না, তাই বলেছে।

আবার এক শনিবার দুজনের দেখা হল হেমাঙ্গর বাড়িতেই। হেমাঙ্গ অনেকটাই সেরে উঠেছে। বাঁ পায়ের খোঁড়ানিটা একদম নেই। মন দিয়ে একসারসাইজ করে সে। গরম-ঠাণ্ডা কমপ্রেস নিচ্ছে। মালিশ করতে বিশেষজ্ঞ আসছে। শনিবার যখন ঝুমকি এল ম্যাসিওর লোকটি তখন বিদায় নিচ্ছে। ঝুমকিকে বলল, আর দিন পনেরো ম্যাসাজ করলেই হবে। অলমোস্ট নরম্যাল।

তাকে দেখেই আজ হঠাৎ খুব লজ্জা পেয়ে হেমাঙ্গ বলল, আমার মা আপনার জন্য একটা জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছেন।

ঝুমকি অবাক হয়ে বলে, তাই নাকি?

এতে কিন্তু আমার কোনও ভূমিকা নেই। আপনি কিন্তু কিছু মনে করতে পারবেন না।

হেমাঙ্গ ড্রয়ার থেকে একটা চ্যাপটা গয়নার বাক্স বের করে ঝুমকির হাতে দিয়ে বলল, এইটে।

ঝুমকি বাক্সটা খুলে অবাক হয়ে গেল। একটা সাবেক ভারী নেকলেস। লকেটে হিরের সেটিং। অন্তত বারো-চোদ্দ ভরি ওজন।

কিছু মনে করলেন না তো!

ঝুমকি জবাব দিল না। নেকলেসটা গলায় পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটু দেখল নিজেকে। তারপর হঠাৎ হেমাঙ্গর দিকে ফিরে বলল, কেমন দেখাচ্ছে?

হেমাঙ্গ সলজ্জ চেখে চেয়ে দেখে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, এসব কি আধুনিক মেয়েরা পরে?

আমি জিজ্ঞেস করেছি কেমন দেখাচ্ছে।

ভালই তো!

ঝুমকি ফের আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল একটু। এমন স্বাভাবিক হাবভাব যেন নেকলেস পেয়ে সে একটুও অবাক হয়নি। হেমাঙ্গর দিকে ফিরে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, একটু পরে থাকি নেকলেসটা?

হ্যাঁ। কিন্তু ওসব জিনিস পরে রাস্তাঘাটে চলাফেরা না করাই ভাল। ছিনতাইবাজরা পিছু নেবে।

নিক না। আজ আমি এটা পরেই বাড়ি যাবো।

হেমাঙ্গ সাভয়ে বলল, সর্বনাশ!

যাবোই।

হেমাঙ্গ বলল, তাহলে আমি গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে আসব।

গাড়ি চালানো এখনও বারণ, খেয়াল আছে?

বারণ ছিল, এখন আর নেই। ডাক্তার কাল বলেছে এখন একটু-আধটু চালাতে পারি।

তার দরকার নেই। নেকলেসটা এখন এখানেই থাকবে।

হেমাঙ্গ নিজের নখ দেখছিল। খুব সলাজ ভাব। হঠাৎ মিনমিন করে বলল, আচ্ছা নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে গুরুজনদের এই যে ঢুকে পড়া এটা আপনার কেমন লাগে?

কে, আমার তো বেশ ভালই লাগে। এরকমই হওয়া উচিত।

আপনি কিন্তু বেশ সেকেলে আছেন।

সেকেলেদের কি অপছন্দ নাকি?

না না, তা বলছি না। বলছি, নরনারীর সম্পর্ককে তো আজকাল তাদের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার বলে ভাবা হচ্ছে পৃথিবীতে। এর মধ্যে আত্মীয় বা গুরুজনদের কোনও ভূমিকা থাকার কথা নয়। সেটাকে ইন্টারফিয়ারেন্স বলে মনে করা হচ্ছে। তাই না?

আমার তা মনে হয় না। আপনার বুঝি মনে হয়?

হেমাঙ্গ খুব লজ্জিত হয়ে পড়ল। তারপর আরও মিনমিনে গলায় বলল, আসলে আমি একুশ শতকের জীবনযাত্রার প্যাটার্নটার কথা ভাবছি। কি কি থাকবে, আর কি কি থাকবে না। পৃথিবী তো আস্তে আস্তে লজ্জাহীন হয়ে যাচ্ছে। সুইডেনে এমন সব দৃশ্য দেখেছি যে আমার একসময়ে নরনারী সম্পর্ক নিয়েই একটা রিপালশন তৈরি হয়েছিল।

একটু কড়া গলায় ঝুমকি বলল, সুইডেনে আর কখনও যাবেন না।

হেমাঙ্গ একটু ভড়কে গিয়ে বলল, আমি মোটেই যেতে চাইছি না। কিন্তু বলছি রোমান্স জিনিসটা তো পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে লোপাট হয়ে যাচ্ছে। দেখুন না, এখন বাঙালি ছেলেমেয়েরাও কত ফিলি মেলামেলা করে। তাদের মধ্যে সেই রোমান্টিক ভীতু-ভীতু ভাবটা আর নেই। দে টক ফ্রিলি অ্যাবাউট এভরিথিং…। অল সর্টস অফ সেক্রেট থিংস।

ঝুমকি একটু হাসল। বলল, আমি কিন্তু সেকেলে।

এ কথায় কে জানে কেন, আর এক দফা লজ্জা পেল হেমাঙ্গ।

হেমাঙ্গ এর পরের তিন দিন ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ল আর একটা সমস্যা। সমস্যাটা হল রোমান্টিক প্ৰেমটা বিয়ের পরই উবে যায়। আর রহস্য-রোমাঞ্চ থাকে না, প্রেমিক-প্রেমিকরা হয়ে যায় সাদামাটা স্বামী-স্ত্রী এবং তখন সহ রহস্যের সমাপ্তি। একটু ফাঁক, একটু দূরত্ব, একটু পিপাসা না থাকলে এই রহস্যময়তা টিকবে কি করে? এমন কোন উপায় আছে যাতে স্বামী এবং স্ত্রী হয়েও নারী-পুরুষ পরস্পরের কাছে প্রেমিক-প্রেমিকার মতো ভীষণ আকর্ষক থেকে যেতে পারে? এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে উপস্থিত হতে পারল না সে এবং ক্রমশ অস্থির হল।

সমস্যাটা অতঃপর টেলিফোনেই সে নিবেদন করল ঝুমকিকে। রাত দশটায়।

ঝুমকি বোধ হয় একটা হাই চাপাবার চেষ্টা করে বলল, আচ্ছা এ ব্যাপারটা ভেবে দেখব।

সুত্যি ভাববেন?

হুঁ।

এটা আপনার কাছেও কি প্রবলেম বলে মনে হয়?

এখন হচ্ছে।

মুগ্ধ আর একটা কথা।

কী?

আমি দুদিন ধরে গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাচ্ছি।

সাবধান কিন্তু। অনেক দিন অভ্যোস নেই।

না, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। বলছিলাম, আগামী কাল অফিসের পর কি আপনাকে পিক-আপ করতে পারি?

পারেন।

তাহলে ছটায়? গোলপার্ক ন নম্বর টার্মিনাসে।

তা কেন? বাড়িতে এলেই তো হয়।

একটু লজ্জা করছে।

কিছু লজ্জার নেই। কাল কী রঙের শাড়ি পরতে হবে?

নীল। কিংবা আপনার যা ইচ্ছে।

না, নীলই পরব।

তাহলে ছটায়?

হ্যাঁ। কিন্তু বাড়িতে আসবেন। মা বোধ হয় কাল আপনার জন্য কোনও খাবার তৈরি করবে।

আরে! উনি কি জানেন যে আমি ফোন করছি?

হ্যাঁ। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

ছিঃ ছিঃ। লজ্জা করছে। আমি কি খুব বেহায়া?

মোটেই নয়। শুধু একটু রোমান্টিক।

যন্ত্রণাটা। তবু হেমাঙ্গকে ছাড়ছে না। ফোন করার পর সে রাতে অনেকক্ষণ জেগে রইল। জীবনের এই একটা সময় কেটে যাবে। শেষ হবে বুকের দুরুদুরু। তারপর শুরু হবে পুরনো হওয়া। বহু বহু পুরনো, ব্যবহৃত, জীর্ণ হয়ে যাওয়া। এর কি কোনও মানে আছে?

শুক্রবার বিনা নোটিসে অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে হেমাঙ্গ চলে এল নিশিপুর। যেন হাজার বছর পর।

বাসন্তী খবর পেয়ে দৌড়ে এল, ওম্মা গো! দাদাবাবু যে!

আহ্লাদে সে আটখানা। ঘরদের সাফ করাই ছিল। তবু আবার ঝোঁটিয়ে, মুছে, বিছানা পাততে পাততে বকবক করতে লাগল মেলা। বলল, এবার এমন কামাই দিলে ভাবলাম বুঝি, দাদাবাবুর নিশিপুরের শখ মিটে গেছে। আর বুঝি এমুখো হবে না।

বাঁকা মিঞা এল আরও রাতের দিকে। একমুখ হাসি।

এলেন তাহলে? খবর সব শুনেছি।

কী শুনলে?

বিডন স্ট্রিটে গেয়েছিলাম গেল। হগুপ্তায়। মা ঠাকরোন সব বললেন।

হেমাঙ্গ লাজুক হাসল। মায়ের ওই দোষ। সব কিছু সবাইকে বলে দেয়।

বাঁকা মিঞা বলল, তা আমিও ঠোকরোনকে বললাম যে, পাত্রী খুব সরেস হয়েছে। আমরা দেখেছি কি না। একটু রোগার দিকে হলেও ভারি মিঠে চেহারাখানা। স্বভাবও ভাল। ঠাকরোন খুব খুশি।

বাসন্তী রুটি সেঁকেতে সেঁকতে গোল গাল চোখ করে শুনছিল। হঠাৎ বলল, সে-ই তো গো দাদাবাবু, না? উঃ, সে বড্ড ভাল। ইস আমার যে কী আনন্দটাই হচ্ছে!

হেমাঙ্গ মৃদু হেসে বলল, আনন্দের চোটে রুটি পুড়িয়ে ফেলিস না।

অনেক রাত অবধি এই শীতে পারঘাটে বসে রইল হেমাঙ্গ। এখানে খুব শীত আর হাওয়া। হেমাঙ্গ গ্রাহ্য করল না। এই শীত। মনের যন্ত্রণা নিয়ে বসে রইল চুপ করে। সামনের অন্ধকার উতরোল নদী। দামাল হাওয়া। একটু কুয়াশার মসলিনে ঢাকা আকাশ। এই বিপুল বিস্তারের সামনে একা, নির্জন, ছোট হয়ে বসে থেকে হেমাঙ্গ অনেক ভোবল। আকাশ-পাতাল। ভাবনার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। পাগলামিতে ঠাসা। তার একটা জীবন শেষ হবে। শুরু হবে কি অন্যতর জীবন? কেমন হবে সেটা? একজনের সঙ্গে জোড় বাধা এমন কি ঘটনা একটা? তবু তার মন ভাল নেই।

উত্তাল বাতাস এসে তার সব এলোমেলো করে দিতে চায় যেন, এই বিপুল বিস্তার আর ওই অন্ধকার থেকে আসে প্ররোচনা; পালাও। কেন বাধা পড়বে সংসারে?

পালিয়েই এসেছে হেমাঙ্গ। ঝুমকিকে কিছুই জানায়নি। কাল শনিবার। ঝুমকি তার বাড়িতে এসে তাকে না-পেয়ে অবাক হবে খুব। বিরক্ত হবে? উদ্বিগ্নও কি? হোক। একটু হোক। হেমাঙ্গ কেন এত দায়ভার নেবে? সে কি মুক্ত মানুষ নয় একজন?

অনেক রাতে ঘরে ফিরে ঘুমালো হেমাঙ্গ। বেলায় উঠল। উঠেই মনে হল, ঝুমকি তার বাড়িতে এসে গেছে কি এতক্ষণে? কেমন হয়েছে তার মুখখানা হতাশায়?

বাসন্তী চা করে দিল, কীগো দাদাবাবু, আমন শুকনো মুখে কী ভাবিছ?

একটা মাথা নেড়ে হেমাঙ্গ বলল, কিছু না।

শরীর খারাপ নয় তো!

হেমাঙ্গ একটু হাসল। বলল, আচ্ছা বাসন্তী, আমি কি একটু পাগল?

বুহি হি করে হেসে ফেলে বলে, তোমার মাথায় পোকা আছে।

তাই?

হ্যাঁ। পোকা না থাকলে কেউ নিশিপুরে এসে পড়ে থাকে? বাকাঁচাচা বলে, তুমি নাকি মস্ত মানুষ। মেলা লেখাপড়া জানো, মেলা টাকা।

দুপুরের দিকে ঝুমকি যখন বাড়ি ফিরে এল তখন তার শুকনো মুখ দেখে অপর্ণা বলল, কী হয়েছে রে? ঝগড়া করেছিস নাকি হেমাঙ্গর সঙ্গে?

ঝুমকি অবাক হয়ে বলল, ঝগড়া করবার জন্য তাকে পাওয়া গেলে তো! কাল অফিস থেকে বেলা বারোটায় বেরিয়ে গেছে, আজও ফেরেনি। কাউকে কিছু বলেও যায়নি। ফটিকদা বলছে, ঠিক নিশিপুরে গেছে।

বড্ড পাগল। কী যে করি ওকে নিয়ে! ওর ঘাড় থেকে নিশিপুরের ভূত নামানো দরকার।

ঝুমকি মাথা নেড়ে বলল, না মা। ওটা ঠিক হবে না। যদি নিশিপুরে গিয়ে থাকে তো ভালই হয়েছে। হয়তো নিজের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করতে গেছে। ওর ওটা দরকার ছিল।

অপর্ণা সামান্য উদ্বেগের গলায় বলল, হ্যাঁ রে, শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যাবে না তো। রশ্মির বেলায় যেমন করেছিল?

ঝুমকি মাথা নেড়ে বলল, জানি না মা। তবে এ ব্যাপারে ওকে কিছু বোলো না তোমরা।

অপর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ঝুমকির কোনও দীর্ঘশ্বাস নেই। একটু উদ্বেগ আছে মাত্র। হেমাঙ্গ যদি নিশিপুরে গিয়ে থাকে তাহলে চিন্তার কিছু নেই। আর কিছু না হলেই হল। তার শুধু ধৈৰ্য ধরে থাকা।

দুপুরের খাওয়ার পর সে চারুশীলার কাছে গেল।

মাসি, কেমন আছ?

চারুশীলা খুশি হয়ে বলল, আয় আয়। কতদিন আসিসনি। আজকাল খুব গর্চায় যাচ্ছিাস, শুনছি।

লজ্জা পেয়ে ঝুমকি বলল, যাই মাঝে মাঝে।

যাস। ও যা পাগল, ঠিকমতো না বাধলে পরে ওকে নিয়ে মুশকিলে পড়বি। হ্যাঁ রে, কেমন বাসিস ওকে? খুব?

তা জানি না।

খুব জানিস।

শোনো, ও আবার কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেছে।

সর্বনাশ।

না না, অত ঘাবড়ে যেও না। কদিন খুব নিশিপুরের কথা বলছিল। বোধ হয়। সেখানেই গেছে। কাউকে পাঠাতে পারো নিশিপুরে? বড্ড চিন্তা হচ্ছে।

একটু ভাবল চারুশীলা। তারপর বলল, কাউকে পাঠালে আবার তার ফিরে আসার অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে। তার চেয়ে একটা কাজ করি চল। আমরাই চলে যাই।

যদি রাগ করে?

পাগল! ওখানে গিয়ে হাঁ করে তোর কথাই তো ভাবছে। গেলে খুশি হবে দেখিস।

না চারুমাসি। থাক, ওকে একটু একাই থাকতে দাও বরং।

চয়নকে পাঠাতে পারি। কিন্তু সে তো কালকের আগে হবে না।

বুকের উদ্বেগ নিয়ে ভেবে ঝুমকি বলল, তাও থাক মাসি। পাঠাতে হবে না। আর একটা দিন যাক।

একটা দিন যে কী করে গেল তা ঝুমকি বোঝাতে পারবে না। কাউকে। অনেক রাত অবধি তার বালিশ ভিজল চোখের জলে। বুকে অনেক ঢেউ উঠল অনিশ্চয়তার। মায়ায় ভেসে গেল বুক। এ কোন সৃষ্টিছাড়ার সঙ্গে জুটল সে?

শেষরাতে একটু ঘুমালো ঝুমকি। তাও বারবার ছিঁড়ে গেল তন্দ্ৰা। বুকের মধ্যে উদ্বেগের ড়ুগড়ুগি।

এল সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ। তখনও ঝুমকির ঘুম ভাল করে ভাঙেনি। কিন্তু একটা প্রত্যাশা আর উদ্বেগ ছিল বলেই টেলিফোন বাজতেই সে উঠে গিয়ে ধরল।

হেমাঙ্গর গলাটা কি সামান্য কাঁপছে? বলল, কাল সারা রাত ঘুমোইনি। জানেন? কাল সারাটা দিন নিশিপুরে সময়টা যেন কিছুতেই কাটছিল না। কাল ছিল আমার জীবনের মন্থরতম দিন, অর্থহীন, রংহীন… কী বলব আপনাকে, বেশি বললে কাব্য হয়ে যাবে।

হুঁ।

রাগ করবেন না। বেচারা হেমাঙ্গর ওপর রাগ করবেন না। কিন্তু। রাত তিনটের সময় পারঘাটে এসে বসে ছিলাম। তখন ভটভটি চালু হয়নি। একটা মেছো নৌকো ধরে ধামাখালি এসে ঝড়ের মতো গাড়ি ছেড়েছি। ঝড়ের মতো।

শুনে আমি মোটেই খুশি হচ্ছি না। একটা অ্যাকসিডেন্টের ধাক্কা এখনও সামলে ওঠেননি, এর ওপর যদি আর একটা হত?

তবু জিজ্ঞেস করলেন না কেন এমনভাবে চলে এলাম?

ঝুমকি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। জানি। কিন্তু খুশি হইনি। ধীরেসুস্থেই আসা যেত।

আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আমার কেন পুরনো হয়ে যাওয়াকে এত ভয়? কেবলই কেন মনে হয় আপনি একদিন পুরনো হয়ে যাবেন, আমিও যাবো। আমরা পুরনো হয়ে যাবো বলে এত ভয় পাই কেন?

ঝুমকি একটু হাসল, আমার নেকলেসটা আপনার কাছে রাখা আছে। খুলে দেখুন। কত পুরনো, তবু কী সুন্দর। যত পুরনো হবে তত দাম বাড়বে।

যেমন ভিডেন্টজ কার? ভিন্টেজ মন্দ?

ওসব উপমা আমার পছন্দ নয়।

আচ্ছা। কিন্তু আপনার কথাটা আমি বুঝেছি। আজ কি একবার দেখা হতে পারে?

পারে।

আমি যদি যাই কেউ কিছু মনে করবে না তো!

আমি করব। আপনাকে আজ আর গাড়ি চালাতে হবে না। একদিনের পক্ষে যথেষ্ট পাগলামি হয়েছে।

তাহলে?

আমিই যাবো।

মেয়েরা ভীষণ দেরি করে।

আমার দেরি হবে না।

ঝুমকি ফোন ছেড়ে দিল। অবিশ্বাসের চোখে কিছুক্ষণ ফোনটার দিকে চেয়ে থেকে খুব ধীরে ধীরে ফোন রাখল হেমাঙ্গ। সে দৌড়োয়নি, পরিশ্রমের কাজও করেনি কিছু, তবু কেন যেন তার হাঁফ ধরে যাচ্ছে আজ। তার মানে হচ্ছে, ঝুমকিকে তার একটা খুব জরুরি কথা বলার আছে। কিন্তু কথাটা সে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না।

ফটিক কফি নিয়ে এল। তার দিকে ভূত-দেখা চোখে চেয়ে রইল হেমাঙ্গ। গরম কফিতে অসাবধানে বড় চুমুক দিয়ে জিব পোড়াল এবং বিষম খেল। তার মনে হচ্ছে যে একটা অর্থহীনতার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ড়ুবে যাচ্ছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

হাতঘড়িটার দিকে সন্দিহান চোখে চাইল সে। না, ঘড়িটা বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে খুব ধীরে চলছে কি? বড্ড বেশি ধীরে?

সামনের বারান্দায় শীতের রোদ খেলা করছে। দুটো বেতের চেয়ার পাতা পাশাপাশি। এই বারান্দায় আজ থেকে চুল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর পর এরকম এক সুকালে এক সাদা দাড়ি-চুলের বুড়োর পাশে একজন পুঙ্ককেশী বৃদ্ধা বসে থাকবে কি? হাঁটুর কাছে দাঁড়ানো নাতি বা নাতনী? সবচেয়ে বড় কথা তখনও কি পরস্পরের জন্য কম্পিত হবে হৃদয়? দুজনেই থাকবে? নাকি মাঝপথে খসে যাবে। একজন? কিংবা দুজনেই?

কে জানে! জীবন এত অনিশ্চিত বলেই না। এত ভাল। এই জীবনযাপন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *