১১৭. নিমাইয়ের পাঠানো টাকা

১১৭

নিমাইয়ের পাঠানো টাকা দু’মাস ধরে নিচ্ছে না বীণাপাণি। ছেলেটা টাকা নিয়ে আসে, বীণা দ্বিতীয় মাসে বলেই দিল, টাকা আর নেবো না। ওকে গিয়ে বোলো আর যেন না পাঠায়।

নিমাইয়ের সঙ্গে একটা মিটমাট তো করতেই চেয়েছিল বীণাপাণি। নির্লজ্জের মতো চাকরি চেয়েছিল ওর কাছে। বিষ্টুপুর থেকে বাবার শ্রাদ্ধের পর ফেরার পথে একটা রাত বনগাঁয়ে থাকতে অনুরোধ করেছিল। তা নিমাই পাত্তা দিল না। টাকা হয়ে লেজ ফুলেছে। সকলেরই হয়, নিমাই কি আলাদা রকমের হবে? অত যার গুমোর তার টাকা হাত পেতে নেবে, এমন বেহায়া এখনও হয়নি বীণা।

একার একটা পেট চলে যায়। কিন্তু বেশিদিন কি যাবে? পয়সাকড়ি তলানিতে এসে ঠেকেছে। এক পয়সাও আয় নেই। বীণা তো আর মানুষের বাড়িতে ঝি-গিরি করতে পারবে না। কুসুম একটা চাকরির প্রস্তাব এনেছিল। বেবি-সিটিং। সারা দিন বাচ্চা সামলাতে হবে, তিন শো টাকা। কিন্তু কেন যেন ইচ্ছে হল না। তার নিজের বাচ্চা নেই, বাচ্চা মানুষ করার অভিজ্ঞতাও হয়নি। কুসুমকে বলল, ও আমি পারব না। বেবি-সিটিং করতে হলে নিজের বাচ্চা মানুষ করার অভ্যাস থাকলে হয়।

কুসুম দুষ্টু হাসি হেসে বলল, তোমারই বা হল না কেন বলল তো?

আহা! তখন নাটক-নাটক করে দম ফেলার সময় নেই। বাচ্চা হলে পারতাম?

কিন্তু এখন তো বুঝছ, একটা কুঁচো কাঁচা থাকলে কত ভাল হত!

কথাটা বীণারও খুব মনে হয়। নিমাই মুখচোরা মানুষ, কিন্তু এক-আধবার সেও বলেছে, একটা বাচ্চা হলে হত।

উল্টে ধমক দিয়েছে বীণাপাণি, দুটো পেটেরই জোগাড় হয় না, আর একটাকে এনে কষ্টের মধ্যে ফেলি আর কি!

আসল কথা তখন ফিগার-টিগারের কথা খুব মনে হত বীণার। যাত্রায় পরিশ্রম তত কম নয়। তার ওপর সিজনের সময় কোথায় কোথায় চলে যেতে হত। বাচ্চা থাকলে পারত ওসব?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হয়নি বলে আমার দুঃখ নেই। অভাবের সংসারে তো কষ্টই পেত।

কুসুম চোখ বড় করে বলল, আর অভাবের দোহাই পারছ কেন গো বীণাদি? নিমাইদার কি পয়সার অভাব?

নিমাইদার পয়সা নিমাইদারই, আমার তো নয়।

তুমি নাও না কেন?

বীণা একটু চুপ করে থেকে বলে, আজ বুঝতে পারছি সে আমাকে ঘেন্না করে। আমার বাতাসটাও সে সইতে পারে না।

কী যে বলল না তুমি! নিমাইদা কি সেরকম মানুষ?

আমি ঠিকই বুঝি। আমি যা বুঝি তা কি তোরা বুঝতে পারবি? এ বুকটায় আজ বড় জ্বালা।

এবারও কি টাকা ফিরিয়ে দিলে?

দিলাম। ওর টাকা আর নেবো না। বাঁধন যখন কেটেই গেছে তখন কোন লজ্জায় টাকা নেবো বল?

এ বাঁধন কি কাটে?

ওসব তোদের সেকেলে ধারণা। অগ্নিসাক্ষী, নারায়ণসাক্ষী ওসবেরও কোনও মানে হয় না। মেয়েদের ভয় খাওয়ানোর জন্য ওসব চালাকি করা হয়। যাতে স্বামীর সঙ্গে যুঝতে না পারে। আজকাল কত ধর্মের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে।

সব বিয়েই তো আর ভাঙছে না।

সব বিয়ে ভাঙবে কেন? সকলের কি সমান কপাল?

কুসুম একটু চুপ করে থেকে বলল, সকলের কথা ছেড়ে দাও। তোমারটা নিয়ে ভাবো।

ভাবাভাবির কিছু নেই। বিয়ে আমার সইল না।

ওরকম করে বোলো না তো! আমার খারাপ লাগে। তোমার বিয়ে মোটেই ভাঙেনি। ছাড়াছাডি হওয়ার মানেই কি ভাঙা? স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কত মন কষাকষি হয়।

এ তো সে নয়। ও আমাকে মন থেকে উপড়ে ফেলেছে।

তাহলে কি ফি মাসে টাকা পাঠাত?

দয়াধর্ম নেই সে কথা তো বলিনি। কিন্তু বউ কি শুধু দয়ার পাত্রী? আর কিছু নয়? আমি তার দয়ার দান নেবো কেন? তার আগে কি একগাছা দড়ি এ গলার জন্য জুটবে না?

বড্ড মন খারাপ করে দাও তুমি। টাকাটা ফিরিয়েই বা দিচ্ছ কেন? ফিরিয়ে দিলে বুঝি নিমাইদার অপমান হয় না? একবার ফিরিয়ে দিয়েছ, তা সত্ত্বেও তো পরের মাসে পাঠিয়েছে!

বললাম তো, এ সব ওর দয়া।

কুসুম আর কিছু বলল না। কিন্তু দিন তিনেক বাদে কাঁচরাপাড়ায় দিদির বাড়ি যেতে হয়েছিল তাকে, দিদির ছেলের অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্নে। পরদিন গিয়ে নিমাইকে তার দোকানে ধরল।

এই যে নিমাইদাদা, কেমন আছ?

ওরে বাবা, এ যে কুসুম! আয় আয় বোস এসে। গরম চপ ভাজা খা দুটো।

খাওয়ার কথা পরে হবে। তোমার সঙ্গে ঝগড়া আছে।

ঝগড়া! না দিদি, সে পেরে উঠব না। জন্মে কারও সঙ্গে ঝগড়ায় এঁটে উঠিনি। তা বৃত্তান্তটা কী?

তোমার বউ তো শুকিয়ে মরতে বসেছে, তা জানো?

নিমাই একটু গম্ভীর হল। একটু বিষন্ন। বলল, তার কর্মফল আমি কি করে খণ্ডাই বল তো! যাত্রার চাকরিটা গেল। আমার টাকা নিচ্ছে না। এখন উপায় কী?

উপায় অনেক আছে।

কী উপায়?

তুমি অন্য লোকের হাতে টাকা পাঠাও কেন? নিজে যেতে পারো না?

কেন, বীণা কি তা নিয়ে কিছু বলেছে?

তা বলেনি, তবে সে অভিমানী মানুষ। মনে হয় ওভাবে টাকা নিতে তার মানে লাগে।

নিমাই একটু ভেবে বলল, কিন্তু আমার যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

কেন হবে না?

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি একজন পরপুরুষই তো হয়ে গেছি এখন। ভাবি, গেলে হয়তো আর কারও আঁতে লাগবে।

ওমা! কার কথা বলছ?

সজলবাবুর কথাই বলছি। এই তো কালও এসে গেলেন। কবিরাজি কাটলেট করে খাইয়ে দিলাম। বীণাকে বিয়ে করবেন বলে বড় উচাটন হয়ে পড়েছেন।

কুসুম একটু স্তব্ধ থেকে বলল, বীণাদিও কি তাই বলেছে তোমাকে?

না। সে উল্টো কথাই বলে। তবে হয়তো লজ্জায়।

নিমাইদা, সজল কিন্তু ঠিক কথা বলছে না।

বেঠিক বলছে?

কুসুম একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল, সজলবাবু যায় আসে ঠিকই। কিন্তু সম্পর্ক ওরকম হলে আমি জানতে পারতাম।

নিমাই উদাস গলায় বলে, আমার তো বেশি কিছু জানারও নেই। বিয়ে করতে চাইলে করুক সজলবাবু বলছেন, বিয়ের পর দুজনে মিলে যাত্রার দল খুলবেন। কিছু টাকা চান। আমি বলেছি, যাত্রাদল খোলার মতো টাকা আমার নেই। তবে দশ-বিশ হাজার হয়তো পেরে যাবো। টাকা যাক, তবু বীণা তো মনের মতো কাজ নিয়ে থাকতে পারবে। তার কাছে আমার মেলা ঋণ।

ছাই ঋণ! তোমাকে দুর্দিনে দেখেছে, সে তো বউ আর বর নিজেদের জন্য করেই। ওরকম ভাবো বলেই তো তোমরা কেউ কারও আপন হতে পারো না। একে অন্যের জন্য করবে বলেই তো বিয়ে, অত ভদ্রতা কিসের? তোমার সব ভাল, কিন্তু ওই বিগলিত ভাবটা ভাল নয় কিন্তু। ঋণ-টিন কিছু নেই তোমার। আর শোনো, যার বউ পরে টেনে নিয়ে যায় সে কিন্তু মোটেই উঁচুদরের লোক নয়। সজল এখানে আসে আর তুমি জোড়হাত করে তাকে কবিরাজি খাওয়াও, এ কেমন কথা! থাপ্পড় কষাতে পারো না।

ওরে বাপ রে! তোর যে দেখি আজ রণচণ্ডী মূর্তি।

আমার বড্ড রাগ হয় তোমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে। যেমন দেবা তেমনি দেবী। আচ্ছা, একটা সত্যি কথা বলবে?

বল না!

তোমার কেউ নেই তো!

তার মানে?

বলি, কাউকে পছন্দ-টছন্দ করে বসোনি তো এর মধ্যে?

নিমাই খুব হাসল, বলে কি রে পাগল! আমি কি মেয়েমানুষের দিকে তাকাই? তবে বিয়ের প্রস্তাব যে আসেনি তা নয়। কিন্তু নাকে খত দিয়ে রেখেছি, ও পথে আর নয়।

যাক বাবা, বাঁচা গেল। ওদিকে বীণাদিদিও এইসব ভেবে ভেবে অস্থির। টাইফয়েডের সময়ে নাকি প্রায়ই স্বপ্ন দেখত যে, তুমি ফের বিয়ে বসেছ। একবার তো ঘুম থেকে উঠেই আমাকে তোমার কাছে তক্ষুনি পাঠায় আর কি। বলল, যা গিয়ে দেখে আয় তো সত্যিই বিয়ে করেছে কি না।

নিমাই হাসল না। করুণ মুখ করে বলল, ওরকম সন্দেহের কোনও কারণ নেই।

সে আমি বলেছি। নিমাইদাদা সেরকম লোক নয়। তবু তার সন্দেহ যায় না। শোনো, কালই যাও। নিজের হাতে টাকাটা দিয়ে দেখ নেয় কি না। তার ধারণা তুমি তাকে ঘেন্না করো।

ছি ছি। কেষ্টর জীব, তাকে ঘেন্না করব কি রে! আমার তো নেড়ি কুকুরটাকেও ঘেন্না হয় না।

সে কথাটাই বুঝিয়ে দিয়ে এসো। তা বলে নেড়ি কুকুরের কথাটা তুলো না। তোমার তো আক্কেল নেই।

যাবো’খন।

না না। খন বললে হবে না। কালই যাও। হাতে একটু সময় নিয়ে যেও। গিয়ে হুটোপাটি করে চলে এসো না। দুটো কথা বলার যেন সময় পায় বেচারি।

আমি গেলে টাকা নেবে?

নেবে। তার অবস্থা ভাল যাচ্ছে না। গিয়ে আবার বলে বোসো না যেন যে আমি কাঁচরাপাড়ায় এসেছি। তাহলে ভাববে আমিই তোমাকে পাঠিয়েছি। তুমি ভাবখানা করবে যেন নিজের গরজেই গেছ।

খুব হাসল নিমাই। বলল, অত শেখাচ্ছিস কেন? আমি তেমন আহাম্মক নই। এখন চপ খা।

দাঁড়াও। কথা এখনও শেষ হয়নি। বীণাদিকে নিয়ে ফের ঘর করবে তো!

নিমাই একটু ভাবিত হল। বলল, দেখ, ওসব তো চুকেবুকেই গেছে। ঘর করার মতো মন বীণার আর নেই। একবার বারমুখো হয়ে পড়লে মেয়েদের আর ঘরে মন বসতে চায় না।

তুমি তো সবজান্তা কি না, খুব মন বসবে। তাকে একটা সুযোগ দাও।

মাথা নেড়ে নিমাই বলে, আমারও মনটা মরে গেছে কি না। আর কেমন যেন সম্পর্কটায় বিশ্বাস হয় না।

কাতর গলায় কুসুম বলে, ওরকম বোলো না গো। বীণাদিকে তো রোজ দেখছি। কত যে কাঁদে, কত যে পোড়ে তা তুমি জানো না।

সে তার যাত্রাদলের জন্য কাঁদে রে। আমার জন্য নয়। আমি যখন তার কাছে থাকতাম তখনও কি আমাকে মানুষ বলে মনে করত? ছিলাম অন্নদাস। অতগুলো ডলার আর পাউন্ড নিয়ে চেপে বসেছিল, একবারটি বিশ্বাস করে আমাকে বলেনি পর্যন্ত।

এখন চপ খাওয়াও তো।

চপ খেয়ে কুসুমের মুখে হাসি ফুটল। বলল, বড্ড ভাল তো। আদাকুচি, হিং আরও কী কী সব দিয়েছ। খুব স্বাদ হয়েছে। এইজন্যই না তোমার দোকান এত চলে। আহ, এরকম একখানা দোকান বনগাঁয়ে থাকলে বেশ হত!

কুসুমকে আরও কয়েকটা পদ খাওয়াল নিমাই। কুসুম আহ্লাদে আটখানা। গরিবের মেয়ে, মরা জিব। ভাল-মন্দ বিশেষ জোটে না। সুখাদ্য খেয়ে আজ যেন মুখখানা আলো হয়ে গেল।

মুখ ধুয়ে মশলা মুখে দিয়ে কুসুম বলল, নিমাইদাদা, তোমার টাকা হয়েছে, সে ভগবানের দয়া। কিন্তু তোমারটা খাবে কে বলো তো! এত তো করলে, জন না থাকলে কি হয়? আমি বলি কি, বীণাদিকে ঘরে নিয়ে এসো। সে তো তোমার চাকরিও করতে চেয়েছিল।

তুই বললেই তো হবে না। তারও মতামত আছে। সেও তো একটা আস্ত মানুষ।

আচ্ছা সে নয় হল। তোমার অমত নেই তো!

আগে ভাবতে দে।

কুসুম চলে যাওয়ার পর সত্যিই ভাবতে বসল নিমাই। খুব ভাবল। ছোট্ট একটা মেয়েকে সেই যে বিয়ে করে আনল সেই দিনের ঘটনা থেকে এ পর্যন্ত সব খুঁটিনাটি ভাবল নিমাই। বিয়ের সময়কার সেই কিশোরীর চোখে ছিল স্বপ্ন। বুকভরা অসহায় ভালবাসা। নিমাইকে পেয়ে যেন উথলে উঠত। তারপর অভাবে কষ্টে সেই ভালবাসা মরল। নিমাইকে বাঁচাতে যাত্রাদলে গেল আর তখনই খানিকটা হাতছাড়া হয়ে গেল বীণা। আবার কিছুটা ফিরে পাওয়া গেল অন্যরকম বীণাকে। তাদের দাম্পত্য জীবনে অনেক রকম সম্পর্কের রদবদল হয়েছে। এখন বড় দূরের হয়েছে সম্পর্ক। বীণাকে এখন ছেড়ে দিতেই পারে নিমাই। কিন্তু তাতে বীণার কতটা ভাল হবে?

পরদিন সকালেই বনগাঁ রওনা হল নিমাই।

বীণার চেহারা এতই খারাপ হয়ে গেছে যে, তাকে দেখে চেনাই যায় না। মুখ শুকিয়ে এইটুকু। শরীরটাও যেন রোগা হয়ে কুঁকড়ে গেছে। বীণা কোনওদিনই লম্বাচওড়া ছিল না। ছোট গড়নের বীণা রোগা হয়ে যাওয়ায় দেখাচ্ছে যেন বালিকার মতো। কিন্তু মুখে গভীর বিষণ্ণতা আর হতাশা তাকে বুড়িয়েও দিয়েছে অনেক।

দেখে বুকে একটা ধাক্কা খেলো নিমাই। সে জিজ্ঞেসই করল না, কেমন আছ? দরকার নেই। বীণা যে ভাল নেই তা তো দেখেই বুঝতে পারছে।

দরজাটা ছেড়ে দিয়ে বীণা বলল, ভিতরে আসবে কি? নাকি নষ্ট মেয়ের ঘরে ঢুকলেও তোমার জাত যাবে!

এই চিমটি-কাটা কথাটার জবাব দিল না নিমাই। জুতো ছেড়ে সে ঘরে ঢুকল। সেই আগের মতোই সব আছে। তবে দৈন্যদশাটা আজ চোখে পড়ল নিমাইয়ের। বোধ হয় সে নিজে আজকাল ভাল থাকে বলে এ ঘরটার দারিদ্র্য তার বেশি করে চোখে লাগছে।

বিছানার একধারে সন্তর্পণে বসল নিমাই। কিছু বলল না।

বীণা জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে বলল, একটা খবর দিয়ে আসা উচিত ছিল। আচমকা দেখে আমি এত চমকে গেছি যে, বুকটা ধড়াস-ধড়াস করছে। স্বাসকষ্ট হচ্ছে।

চমকে গেলে কেন?

তুমি কখনও আসবে বলে ভাবিনি তো!

মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল নিমাইয়ের। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অম্বলটা কি খুব হচ্ছে নাকি আজকাল?

হ্যাঁ। আজকাল যেন জলও সহ্য হয় না।

খুব খালি পেটে থাকো বোধ হয়?

এ কথাটার জবাব দিল না বীণাপাণি। জবাবের দরকারও নেই। মেয়েরা একা হলে খাওয়াদাওয়ার ঠিক থাকে না। নিজের জন্য কে আর কষ্ট করে, এরকম একখানা ভাব নিয়ে হয়তো একবেলা রান্নাই চড়াল না। খিদে পেলে চা খেয়ে খিদে মেরে দিল।

ঠাকুরের আসনের দিকে চেয়ে দেখছিল নিমাই। মেলা পট আর ছবি গাদাগাদি করে রাখা। সামনে ফুল, বাতাসা, জল, নিবে-যাওয়া ধূপকাঠির দানি।

পুজোআচ্চা করো বুঝি আজকাল?

ও আমার পুতুলখেলা।

নিমাই একটু হাসল। চারদিকে চেয়ে দেখে বলল, মেঝেটা এর মধ্যেই ফেটেফুটে গেছে দেখছি।

হ্যাঁ। গাঁথনি তো তেমন নয়। ইট পেতে সিমেন্টের পলেস্তারা দিয়েছিলাম। ও কি টেকে?

ঠাণ্ডা জল আছে?

এ কথায় বীণা একটু শিউরে উঠল যেন। চাপা গলায় বলল, এ মা! ছিঃ ছিঃ! তোমাকে জলই দিইনি।

বলেই আবার থমকাল, আমার হাতে খাবে তো জল?

কেন, দোষ হবে নাকি?

হবে না! আমি তো নষ্ট মেয়ে।

নিমাই কিছু বলল না। বুকটা ব্যথিয়ে আছে। বীণা একটানা স্টিলের পরিষ্কার গেলাসে মাটির কলসি থেকে জল গড়িয়ে দিল।

জলটা খেয়ে নিমাই বলল, ডান হাতের আংটিটা কোথায়?

নতমুখী বীণা একটু চুপ করে থেকে খুব চাপা গলায় বলল, গত মাসে বেচতে হয়েছে।

নিমাই থম ধরে রইল। বিয়ের সময় তারা অনেক কষ্ট করে ওই আংটিটাই নতুন বউকে দিতে পেরেছিল আশীর্বাদ হিসেবে। অল্প সোনার পলকা আংটি। বীণা যখন জল দিত, ভাত দিত তখন বরাবর নজরে পড়েছে নিমাইয়ের।

চা করবো?

নিমাই একটু ভেবে বলল, করতে পারো। তবে শুধু এক কাপ। আমি খাবো। তুমি খাবে না।

বীণা একটু হাসল। বলল, তাই হবে। কিন্তু চা-পাতা ভাল নয়। তোমার ভাল লাগবে না। সস্তা চা তো।

আমার কি বাছাবাছি আছে? নেশাও নেই। তবু করো একটু।

বীণা চায়ের সঙ্গে দুখানা বিস্কুটও দিতে পারল না। কোনওদিন বিস্কুট ছাড়া চা দেয়নি। আজ ভিতরে ভিতরেও বীণাপাণি ক্ষয়ে গেছে। অহংকারটুকু কি আছে এখনও? সেটাই ধরতে পারছে না নিমাই। পোড়া কপালের কথা হল, তার নিজের চোখটাই আজ বড় ঝাপসা। বড় কষ্ট হচ্ছে বীণার জন্য। এ তার বউ ছিল বটে, কিন্তু আজ যেন মাঝখানে গহীন সমুদ্দুর।

চা করার সময়টুকু একটু ফাঁক পেল নিমাই। কী বলার আছে বীণাকে তার? কিছুদিনের সম্পর্কহীনতায় তারা কি পরস্পরের কাছে পর হয়ে গেছে? আড় ভাঙছে না। লজ্জা-লজ্জা করছে। কথা আসছে না।

কমদামী চা-পাতা দিয়ে খুব যত্নে চা করে আনল বীণা। নিমাই বসে বসে চা খেল। খারাপ লাগল না। চা শেষ করে বলল, একটা কথা বলতে আসা।

বলো।

সজলবাবু একটা দল খুলতে চান। টাকার জন্য ঘোরাঘুরি করছেন। তোমার মত আছে বলে বলছেন। এমন কথাও বলছেন যে, আমাকে সেই যাত্রাদলের অর্ধেক হিস্যাদার করে দেবেন।

সভয়ে বীণাপাণি বলল, মা গো! এত মিথ্যে কথাও বলতে পারে মানুষ!

উনি যে সত্যি কথা বিশেষ বলেন না তা বুঝতে পারছি। সেইজন্যই তোমার কাছে যাচাই করে গেলাম।

আর কী বলেছে?

ওইসব পুরনো কথাই।

ও বোধ হয় আমার নামে তোমার কাছে দুর্নামও করে, তাই না?

না তো! সজলবাবু তোমার খুব প্রশংসাই করেন।

ওর কোন কথাই বিশ্বাস কোরো না। কিছু করার জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠেছে যে ওর বুদ্ধি লোপ পেয়েছে।

ও কি তোমার কাছে আসে?

না, আমি ওকে আর বিশ্বাস করি না। আসতে বারণ করে দিয়েছি।

মানুষটা খারাপ নন। তবে অভাবে স্বভাব নষ্ট।

ওকে টাকাপয়সা দিও না। নষ্ট করবে।

বড্ড নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে আছেন পেছনে। কী যে করি। চক্ষুলজ্জা বলেও তো কথা আছে।

চক্ষুলজ্জা! বলে বীণাপাণি রাগের গলায় বলল, চক্ষুলজ্জায় পড়ে একটা জোচ্চোরকে টাকা দেবে! এসব কী কথা!

নিমাই খুব সংকোচের সঙ্গে বলল, আমি বড় দুর্বল মানুষ বীণা। লোক বিপদে পড়ে এলে আমার নিজের অতীতের কথা মনে হয়। ভাবি, কিছু সাহায্য করলে হয়তো এ লোকটা দাঁড়িয়ে যাবে।

বীণা তার দিকে একটু রুষ্ট চোখে চেয়ে বলল, দয়াদাক্ষিণ্য অনেক দেখাতে পারবে। কিন্তু তার জন্য সজল কেন?

নিমাই বীণার চোখে চোখ রাখল। অনেকক্ষণ। তারপর বলল, আমাকে পাহারা দেবে কে বীণা?

বীণা মাথা নত করল। ফের জানালার কাছে গিয়ে বাইরে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আজ তোমার রান্নার জোগাড় তো কিছু দেখছি না!

ক্ষীণ কণ্ঠে বীণা বলল, এখনও তো বেলা হয়নি। মোটে দশটা বাজে। আরও পরে রান্না চড়াই।

আজ কী রাঁধবে?

কেন, তুমি খাবে?

খেলে?

রাঁধব। যা চাও রাঁধব।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হঠাৎ বলল, দোকানপাটে ধারদেনা কত আছে?

বীণা একটু চুপ করে থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আছে কিছু। শ’পাঁচেক হবে বোধ হয়। কেন?

এভাবে চলবে না।

না চললে উপায় হবে।

কী উপায়?

সে আছে।

মরার কথা ভাবছ নাকি?

ভাবলে? বলে জানালার কাছ থেকে ফিরে তাকাল বীণা।

নিমাই বীণার দিকে চেয়ে থেকে বলল, চেহারাটা তো নষ্ট করেছই, রঙটাও কত কালো হয়ে গেছে।

এসব যাওয়ার জন্যই। সব যাবে।

নিমাই দুধারে মাথা নেড়ে বলল, তা হয় না।

ঘণ্টা দুই বাদে পাড়াপড়শিরা দেখল একটা সুটকেস আর গোটানো বিছানা পায়ের কাছে রেখে রিক্সায় পাশাপাশি বসে নিমাই আর বীণাপাণি বাস রাস্তার দিকে যাচ্ছে। ঠিক যেমন গাঁ-গঞ্জের নতুন বিয়ের বর-বউ বিয়ের পর বরের বাড়ি আসে। নটী বীণাপাণির মুখে যে কে নতুন কনের মতো লজ্জা মাখিয়ে দিয়েছে কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *