১১৬
শীতের শুরুতেই দাদা বউদি বেড়াতে গেল দক্ষিণ ভারতে। বাসা পাহারা দিয়ে রাখতে পারত চয়নই। কিন্তু চয়নকে ওদের বিশ্বাস নেই তেমন। বাড়িতে বহাল করে রেখে গেল বউদির এক বিধবা দিদিকে। একতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছে। অল্পবয়সী চাকুরে এক দম্পতি। ভদ্রলোক বড় কোম্পানির সেলসে চাকরি করেন, স্ত্রী রাইটার্সে। এদের সন্তান হয়নি এখনও।
উপরতলায় চিলেকোঠায় চয়ন একা। রাঁধে, খায়, শুয়ে থাকে, কখনও আকাশের দিকে চেয়ে থাকে, কখনও দিগন্তহীন দিগন্তের দিকে। চারদিকে সংসারী মানুষজন। সে ভাল আছে, না মন্দ আছে তা বুঝতেই পারে না। তবে সে যে আছে ভীষণভাবে আছে তা নিত্য টের পায় শরীরের নানা আদি-ব্যাধি আর বেদনার ভিতর দিয়ে। টের পায় মূৰ্ছার পর জ্ঞান ফিরে এলে অসম্ভব দুর্বলতার ভিতর দিয়ে। কেন এই থাকা? কেন মুছে যাওয়া নয়? কেন মিলিয়ে যাওয়া নয়?
চয়ন বুঝতে পারে এ জীবনটাকে আর টেনে নিয়ে যাওয়ার মানেই হয় না। সে কি জীয়ন্ত? তার তো মনে হয় সে নিজের শবদেহ বহন করে চলেছে মাত্র। মৃত এ শরীরটা দিয়ে কী হবে তার?
তবু ভুলে থাকা যেত। ভুলিয়ে রেখেওছে নিজেকে সে বহুকাল। কিন্তু আজকাল বড় বন্ধুহীন, বড় একা হয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় যেন ঠেকে গেছে সে। নর্দমার জালিতে যেমন আটকে থাকে কলার খোসা ঠিক তেমনি।
বিপদটা কে ঘটাল কে জানে! সম্ভবত অনিন্দিতার বাবা। লোকটা বোকা এবং সরল। চয়নের টাকার কথা কোনও সময়ে ওই লোকটাই গল্প করে গেছে অয়নের কাছে।
অয়ন একদিন সন্ধের পর হানা দিল ছাদে। অপ্রত্যাশিত।
কি রে তোর খবর-টবর কি?
চয়ন খুবই অবাক হল। তাকে কুশল প্রশ্ন করার মানুষই নয় অয়ন। তুলনায় বরং বউদি কিছুটা ভাল ব্যবহার করে, কিন্তু অয়ন নয়। সে বলল, ভালই আছি।
শরীর ভাল আছে তো? সেই যে অজ্ঞান হয়ে যেতিস?
ওটা তো সারার রোগ নয়।
অয়ন যেন চিন্তিত হয়ে বলল, তা হলে তো তোর জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করে রাখা উচিত।
জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট শুনে কিছুই বুঝতে পারল না চয়ন। হঠাৎ জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট কথাটা আসছে কেন? সে বলল, তার মানে কি?
এসব অসুখ থাকলে সাধারণত জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করে রাখাই সেফ।
চয়ন বলল, ও।
ব্যাঙ্কে তোর কত টাকা আছে?
এ প্রশ্নেও থতমত খেতে হল চয়নকে। সে বলল, আছে সামান্যই।
যত সামান্যই হোক, তোর একটা কিছু হলে টাকাটা জলে যাবে। বুঝেছিস?
তা হলে কী করা উচিত?
বলছি তো জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করে নে, আইদার অর সারভাইভার।
চয়ন একটু ভড়কে গেল, জবাব দিতে পারল না।
অয়ন বলল, সেভিংস অ্যাকাউন্ট নাকি?
হ্যাঁ।
মুখটা বিকৃত করে অয়ন বলল, সেভিংসে আর কীই বা সুদ দেয়! টাকাটা পড়ে পড়ে পচে যাচ্ছে। তুই এত বোকা কেন? চারদিকে কত নতুন নতুন স্কিম চালু হয়েছে।
আমি তো খবর রাখি না।।
অয়ন বলল, সবচেয়ে ভাল অবশ্য স্টক এক্সচেঞ্জে টাকাটা খাটানো। শেয়ারের বাজারটা এখন খুব তেজি। একটু ক্যালকুলেশন করে লাগাতে পারলে ছাক্কা লাভ।
কিন্তু চয়ন এ কথাতেও উদ্বুদ্ধ হল না। চুপ করে রইল। তার টাকার দরকার ঠিকই, কিন্তু টাকা-মনস্ক সে নয়। টাকার পিছনে ছুটতেও তার ভাল লাগে না।
অয়ন বলল, তোর তো আর নেক্সট টু কিন কেউ নেই, আমরা ছাড়া। তুই তোর বউদি বা আমাকে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে নিয়ে নে। তাতে টাকাটা অন্তত বেহাত হবে না। বুঝেছিস?
না, চয়ন বোঝেনি। আবার বুঝেছেও। তার মাথাটা একটু ভো ভো করছিল। সে চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না।
অয়ন একটু ওপরওয়ালার মতো আদেশের সুরে বলল, বেশি দেরি করাটাও ঠিক হবে না। দু-চারদিনের মধ্যেই যা করার করে ফেলতে হবে। কোন ব্যাঙ্কে তোর অ্যাকাউন্ট?
চয়ন অসহায়ের মতো বলে দিল। না বলে করেই বা কি? শত হলেও সে তো অয়নের বাড়িতেই থাকে। শত হলেও অয়ন তার আপন দাদা।
অয়ন বলল, অত ভাবছিস কেন? টাকাটা ওভাবে ফেলে রেখে ভুল করছিস। টাকা-পয়সা সবসময়ে খাটাতে হয়। আজকাল বোকারাই ওভাবে টাকা ব্যাঙ্কে ফেলে রাখে।
চয়ন কী বলবে ভেবে না পেয়ে হঠাৎ বলে ফেলল, আমি একটা ব্যবসা করব বলে ভাবছিলাম।
ব্যবসা! কিসের ব্যবসা?
এখনও ঠিক করিনি।
কত টাকা আছে তোর?
খুব বেশি নয়।
লাখ টাকা তো আর নেই?
না, না, হাজার পঞ্চাশেক হবে।
ও টাকায় কিসের ব্যবসা হবে? ওসব বুদ্ধি করতে যাস না। টাকা মার হয়ে যাবে। আমি ব্যাঙ্কের লোক, সব জানি। ব্যবসা করার অনেক হ্যাপা আছে। বরং শেয়ারে খাটালে লাভ, সেটাও ব্যবসা।
চয়ন মাথা নেড়ে বলল, ভেবে দেখব।
এতে ভাবাভাবির কী আছে? টাকাটা আপাতত জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করে রাখ। আমি শেয়ারে খাটিয়ে তোর অ্যাকাউন্টেই আবার জমা করে দেবো। বুঝেছিস?
চয়ন বুঝেছে এবং হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। ঘাড় নাড়ল।
অয়ন সেদিনকার মতো চলে গেলেও, আবার দুদিন পরে এল। হাতে একটা ফর্ম। ফর্মটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা পূরণ করে ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিস। ব্ল্যাঙ্কগুলো সবই আমি ফিল-আপ করে দিয়েছি। তুই শুধু অ্যাকাউন্ট নম্বর বসিয়ে সই করে জমা দিবি।
অয়ন চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ ফর্মটা হাতে নিয়ে বসে রইল চয়ন। সে জানে তার টাকাটা আর তার থাকবে না। অয়ন তাকে বোকা এবং অসহায় বলে ধরে নিয়েছে। কিন্তু তার মতলবটা খুব পরিষ্কার। অয়নের টাকাটা সে শেয়ারে খাটিয়ে কিছু ঘরে তুলতে চায়। তার পর টাকাটা শোধ না দিলেও চয়ন কিছু বলতে বা করতে পারবে না। অয়ন এসব ধরেই নিয়েছে। আত্মরক্ষার কোনও উপায় চয়ন ভেবে পেল না। ফর্মটা সে আনমনে ছিড়ে ফেলে দিল।
কিন্তু অয়ন আবার হানা দিল দুদিন পর, কি রে, ফর্মটা জমা দিয়েছিস?
বুক দুর দুর করছিল চয়নের। বলল, ছাত্রের পরীক্ষা ছিল, বড্ড ব্যস্ত ছিলাম।
অয়ন একটু অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, দুদিনেও সময় পেলি না? নাকি অন্য কিছু ভাবছিস?
কী ভাবব?
মানুষের মনে কত কী থাকে!
চয়ন ভয় পেয়ে চুপ করে গেল।
অয়ন রাগ করল না। বলল, ওরে শোন, টাকাটা যদি মারও যায় তা হলে সেটা মায়ের পেটের ভাইই তো মারবে! অত ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি ছাড়া তোর নেক্সট টু কিন তো কেউ নেই। ভাল করে ভেবে দেখ, তোর কিছু হলে টাকাটা ব্যাঙ্কেই পড়ে থাকবে সাসপেন্স অ্যাকাউন্টে, আমি তো জানতেই পারতাম না বাই চান্স খবরটা না পেলে। টাকার জন্য ভয়ের কিছু নেই। আখেরে তোর লাভই হবে। আমি নিজেও শেয়ারে টাকা খাটাচ্ছি। তাতে ঠকছি না।
চয়ন তবু চুপ করে রইল।
ফর্মটা জমা দিয়ে দিস কিন্তু। বলে অয়ন চলে গেল।
পরদিন রবিবার সকালে এল বউদি। মুখভর্তি হাসি। হাতে এক বাটি মুড়িঘণ্ট। গরম। বলল এটা আজ ভাতের সঙ্গে খেও। বুঝলে?
চয়ন অবাক হল। বলল, আবার ওসব কেন বউদি?
এমনিই। খাবে তো?
খাবো। রেখে যাও। এক কাজ করো আমার বাটিতে ঢেলে দিয়ে যাও।
ওমা! তা কেন? তুমি খাও, পরে আমার ঝি এসে এঁটো বাটি নিয়ে যাবে।
বউদি ঢাকা দেওয়া বাটিটা তার ঘরের একধারে রেখে হঠাৎ চাপা গলায় বলল, তোমার দাদা তোমার টাকাগুলো শেয়ারে খাটাতে চাইছে, না?
হ্যাঁ।
বউদি চাপা গলাতেই বলল, আজ ও সকালেই বেরিয়ে গেছে। বলে গেছে তোমাকে যেন রাজি করিয়ে রাখি। তুমি কি রাজি?
চয়ন বিমর্ষ মুখে বলল, আমার কেমন ইচ্ছে হচ্ছে না বউদি।
বউদি বলল, দিও না চয়ন। টাকাটা ও জলে দেবে। মাথায় আজকাল কেবল শেয়ার ঘুরছে। মাথায় কে যে শেয়ারের পোকা ঢুকিয়েছে! তুমি অ্যাকাউন্ট অন্য ব্যাঙ্কে ট্রান্সফার করে নাও!
তা হলে দাদা খুব রেগে যাবে।
তা রাগবে। তোমাকে বলি, সাত দিন বাদে আমরা মাসখানেকের জন্য বেড়াতে যাচ্ছি। এই সাত দিন কোনওরকমে ঠেকিয়ে রাখো। পারবে না?
চেষ্টা করব।
তোমার কষ্টের টাকা এভাবে নষ্ট হবে ভাবতেই আমার খারাপ লাগছে।
চয়ন তার বউদির দিকে একটু অবাক চোখে তাকাল।
বউদি বলল, আমি তোমার চোখে কেমন তা জানি। আমাকে খুব খারাপ ভাবো তে! ভাল আমি নইও। তবু জেনো, আমি তোমার শত্রু নই। সংসারের নানারকম অশান্তিতে নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। তোমার দাদার সঙ্গে আজকাল রোজ ঝগড়া হচ্ছে। কেন যে ও এত টাকা টাকা করে বেড়াচ্ছে আজকাল কে জানে!
দাদাকে কী বলব বউদি?
তা কি আমি জানি? তুমিই ভেবে দেখো।
আমার মাথায় কোনও বুদ্ধি আসছে না।
আমি একটা রিস্ক নিতে পারি।
কী রিস্ক?
আমি তোমার দাদাকে বলব যে, তুমি রাজি হয়েছ এবং সব ঠিক আছে। তাতে তোমার দাদা একটু নিশ্চিন্ত থাকবে। বেড়াতে যাওয়ার আগে বোধ হয় টাকাটা তুলবার চেষ্টা করবে না। কারণ এ সপ্তাহটা ওর নানা কাজ আছে। ব্যস্ত থাকবে। বুঝেছ?
হ্যাঁ।
আমি যে বারণ করেছি তা বোলো না কিন্তু।
না বউদি। দাদা কিন্তু ঠিকই বলে। তোমরা ছাড়া আমার তো আপনজন কেউ নেই। দাদা বলছিল, হঠাৎ আমার কিছু যদি হয় তা হলে টাকাটা মার যাবে।
মাগো! অমন কথা বলেছে ও? ছিঃ মৃগীরোগ নিয়ে কত লোক কত কি করছে। মৃগী রুগী বলেই ওরকম ভাবতে হয় নাকি?
চয়ন চুপ করে থাকে।
বউদি বলে, ও খুব খারাপ কথা বলেছে তোমাকে। মোটেই ওরকম বলা উচিত হয়নি।
বউদি চলে যাওয়ার পর আকাশপাতাল ভাবতে বসল চয়ন। টাকাটা এক মাসের জন্য বাঁচালেও শেষ অবধি অয়নের থাবা থেকে টাকাটা বাঁচানো যাবে না, চয়ন জানে। তার তেমন প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই। টাকাটা শেয়ারের বাজারে গাঁটগচ্চা যাওয়ার চেয়েও কি কোনও মহৎ উপায়ে ব্যয় হতে পারে না? টাকাটা জলে গেছে ধরে নিয়েই সে চিন্তা করল, টাকাটার একটা ভাল গতি হওয়া দরকার।
আজ সে অনেকটাই তৃপ্ত। টাকাটা যোগ্য হাতে গেছে। কৃষ্ণজীবন এই পৃথিবীটাকে ভালবাসেন। প্রাণপণে তিনি মানুষের সর্বনাশকে বাঁধ দিয়ে আটকানোর একটা চেষ্টা করছেন। পঞ্চাশ হাজার টাকা হয়তো কিছুই নয়, তবু এই পৃথিবীর জন্য তো কিছু একটু অবদান থাকল চয়নেরও।
আজ সকালে শীতের কবোষ্ণ রোদ নেই। হাওয়া দিচ্ছে, আকাশ মেঘলা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে মাঝরাত থেকে। চয়নের মন ভাল নেই।
আজ সকাল থেকে ঘরে শুয়ে শুয়ে মরার কথাই ভাবছিল চয়ন। বেঁচে থাকার প্রলম্বিত যন্ত্রণা তাকে রোজই পীড়িত করে আজকাল। এই জীবন যাপন করে যাওয়ার অর্থ কি? কেন তাকে বেঁচে থাকতেই হবে?
ভাবতে ভাবতে মৃত্যুর এমন প্রেমে পড়ে গেল যে সে নিজের মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করতে পারল। নিশ্চিত তার মৃত্যু ঘটবে আত্মহননের পথে। সবচেয়ে সহজ উপায় কোনও হাইরাইজ বাড়ির ছাদে উঠে চোখ বুজে লাফিয়ে পড়া। সেইভাবেই মরবে সে। ঠিক করে ফেলল।
বেলা নটা নাগাদ যখন বিছানা ছেড়ে উঠল তখনই সিঁড়িতে লঘু পায়ের শব্দ। এবং তার পরেই তার দরজায় এসে যে দাড়াল তাকে এই মেঘলা দিনে প্রত্যাশাই করেনি সে। অনিন্দিতা।
অনিন্দিতা ঝলমলে হাসি হেসে বলল, কেমন আছ চয়ন?
চয়নের মনটা হঠাৎ আনন্দে ভরে গেল। সত্যিকারের খুশির হাসি হেসে বলল, তুমি এই বৃষ্টি মাথায় করে কোথা থেকে এলে?
চৌকির এক পাশে বসে অনিন্দিতা আগে বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাল। তারপর বলল, গতকাল পিসির বাড়িতে এসেছিলাম। আজ ফিরে যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাচ্ছি। অনেক দিন তোমাকে দেখিনি।
তোমাকেও কতদিন দেখিনি অনিন্দিতা! তুমি চলে যাওয়ার পর থেকেই আমি একদম বন্ধুহীন।
সত্যি? আমি না থাকায় তোমার খারাপ লাগে?
খুব খারাপ লাগে।
তোমার কি শরীর খারাপ?
মুখটা একটু বিকৃত করে চয়ন বলল, শরীরই তো আমাকে খেয়ে ফেলছে। সারাক্ষণ শরীরের কথা ভাবতে ভাবতে আমি কি পাগল হয়ে যাবো অনিন্দিতা?
কেন, তোমার নতুন করে আবার কী হল?
আজকাল ফ্রিকোয়েন্ট অ্যাটাক হয় এপিলেপসির! কেন হয় তা বুঝতে পারি না। আজ একটু আগেই ভাবছিলাম, বেঁচে থাকা মানে যন্ত্রণাই যদি হয় তা হলে যন্ত্রণাকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি? আমি সুইসাইডের কথা ভাবছিলাম।
ছিঃ চয়ন! তোমাকে আমি খুব বকব আজ। কেন ওসব ভেবেছ তুমি? তোমার বেঁচে থাকাটা বুঝি শুধু তোমারই প্রয়োজন?
আর কার?
ভাল করে ভেবে দেখ তো, তোমাকে কেউ সত্যিকারের ভালবাসে কি না।
চয়ন অনাবিল হেসে বলল, তুমি বাসো।
তা হলে? বলে সেই ঝলমলে হাসিটা হাসল অনিন্দিতা।
কে জানে কেন আজ অনিন্দিতাকে বড় ভাল দেখাচ্ছে। স্বাস্থ্য হয়তো ভাল হয়েছে কিছুটা। একটা চটক এসেছে মুখশ্রীতে।
অনিন্দিতা বলল, ওখানে গিয়ে কিন্তু আমরা বেশ ভাল আছি। একটা বাগান করেছি। আমি ফুলের চর্চা করি, মা করে তরকারির চাষ। পলিউশন নেই। গ্রাম-গ্রাম ভাব। বেশ লাগে। সবচেয়ে ভাল লাগে কী জানো?
কী?
সকালে পাখির ডাক। কত পাখি যে আসে!
তোমার শরীর একটু সেরেছে।
সেরেছে মানে? মাঝখানে তো মুটিয়ে যেতে শুরু করেছিলাম। আমাদের নার্সিং হোমে একজন যোগ টিচার আসেন। তার কাছে রেগুলার ব্যায়াম আর আসন শিখছি।
মানুষ বেঁচে থাকতে ভালবাসে বলে বেঁচে থাকার জন্য কত কিছু করে। ব্যায়াম, আসন, ডায়েটিং। চয়নও কি বেঁচে থাকতে ভালবাসে না? খুব বাসে। কিন্তু তার জীবন তো অন্যের মতো নয়।
কী ভাবছ চয়ন?
কত কি! আমি তো সারা দিন ভাবি।
আমার সব অপরাধ কি ক্ষমা করেছ চয়ন?
অপরাধ! বলে চয়ন অবাক হয়ে চেয়ে থাকে, কিসের অপরাধ?
ভুলে গেছ বুঝি? বাঁচলাম। আমি তো ভাবি চয়ন আমার সব খারাপ স্মৃতি মনে রেখেছে, আমার ভালটুকু ভুলে গেছে।
আমার স্মরণশক্তি খুব ভাল। তোমার কিছুই ভুলিনি। ভাবতে গেলেই সব ফোটোগ্রাফের মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রোগা-ভোগা লোকদের বোধ হয় শরীরের কারণেই স্মৃতিশক্তি প্রখর হয়।
স্মৃতিশক্তি এমনিতেই অনেকের ভাল হয়। তুমি কবে আমাদের বাড়ি বেড়াতে যাবে চয়ন?
কবে যাবো? যাবো একদিন।
নাঃ ওসব এড়ানো কথা। চলো না একদিন, তোমার খারাপ লাগবে না, এখানে তো একা মুখ বুজে পড়ে থাকো। ওখানে গেলে একটু কথা-টথা তো বলতে পারবে। আজ যাবে?
আজ? নাঃ আজ মেঘলা করেছে।
তাতে কি? মেঘলা দিনে কি লোকে ঘরে বসে আছে? আমিও তো যাবো বাড়ি। চলো না চয়ন।
চয়ন ভাবছিল। সিদ্ধান্ত নিতে তার দেরি হয়।
অত ভেবো না, ভাবলে আর হবে না। চলো তো, উঠে পড়ো।
তা হলে একটু বোসো। আমি এখনও মুখে চোখে জলও দিইনি।
ঠিক আছে, বসছি। তুমি যাবে ভাবতেই এত আনন্দ হচ্ছে আমার। মা-বাবা ভীষণ খুশি হবে।
উত্তর চব্বিশ পরগনায় গঞ্জ মতো জায়গায় অনিন্দিতাদের বাড়ি। পাকা বটে, কিন্তু চেহারার দৈন্য তাতে ঘোচেনি। কিন্তু দৈন্য ঘুচিয়েছে সতেজ গাছপালা, দুর্বোঘাস আর আলো-হাওয়া। বাড়িটাকে কী যত্ন করে পরিষ্কার রাখে ওরা।
চয়নকে দেখে সত্যিকারেরই খুশি হলেন অনিন্দিতার মা আর বাবা। মা বারবার বলতে লাগলেন, তোমাকে ছেলের মতোই দেখি বাবা, ছেড়ে এসে মনটা খারাপ লাগত। চোখে জল এসেছে কতবার!
সত্যি?
সত্যি নয়? ওদের জিজ্ঞেস করো। ভাবতাম চয়নটা কী খায় কী পরে কে জানে! শরীর খারাপ হলে তো কেউ খোঁজও নেবে না।
চয়নের মন থেকে মৃত্যুচিন্তা উবে গেল। পৃথিবীর এই একটা কোণে এখনও তার জন্য তিনটি উত্তপ্ত হৃদয় উন্মুখ হয়ে থাকে। তার আর বেশি দরকার কি? এটুকুর জন্যই কি বেঁচে থাকা যায় না?
যায়। হয়তো যায়। ভেবে দেখবে চয়ন।