১১৫
বিষ্ণুপদর শ্রাদ্ধাদি মিটে যাওয়ার এক মাস পর বলডিং হেডের শেষাংশ লেখা সাঙ্গ হল। কপি সংশোধনের জরুরি কাজটা দিনরাত খেটে করতে হচ্ছিল কৃষ্ণজীবনকে। প্রকাশক আমেরিকা থেকে তাগিদ দিচ্ছে টেলিফোনে। প্রোগ্রাম এবং শিডিউল নিয়ে তাদের কারবার। টার্গেট ডেট তারা পেরোতে দেবে না। ভূতের মতো খাটছিল কৃষ্ণজীবন।
ঠিক এই জরুরি কাজের মাঝখানে রামজীবন একদিন এসে হাজির।
দাদা, একবার বিষ্টুপুর না গেলেই নয়।
কেন রে, কী হল?
ছোড়দা বড় হুজুত করছে। বাড়ির দোতলাটা নাকি বাবা ওকেই দিয়ে গেছে। এখন পারলে মাকে তাড়িয়ে দোতলার দখল নেয়। গাঁয়ের কিছু লোকও ওর পিছনে আছে।
কৃষ্ণজীবনের মুখ রাগে রাঙা হয়ে উঠল। বলল, দোতলায় ওর তো কোনও দাবি থাকতে পারে না।
সে কথা বুঝছে কে! দিনরাত এমন অশান্তি, গালাগাল, চেঁচামেচি যে, মা বলেছে, ওরে, আমাকে ওদিককার দালানটায় নিয়ে যা। ও-ই এখানে থাকুক।
তা তো হতে পারে না। মা যতদিন বেঁচে আছে দোতলা ভোগ করবে মা।
তুই একবার চল। তোকে একটু ভয় পায়। মাঝে মাঝে আবার এও বলছে, আমাকে দু’লাখ টাকা দিয়ে দে, আমি দাবি-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছি।
মজা মন্দ নয়।
সরস্বতীও তার বরকে নিয়ে মাঝখানে এসেছিল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলল, তার ভাগ সে ছাড়বে না। বাড়ির একটা অংশ তারও চাই। সেও বলে গেছে, লাখখানেক টাকা পেলে দাবি ছেড়ে দিতে পারে। ওর বরটা খুব বিষয়ী লোক। পঞ্চায়েতে জিতেছে নিজের গাঁয়ে।
কৃষ্ণজীবন কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকে।
রিয়া আলোচনাটা শোনেনি। চা দিতে এসে বলল, কী ব্যাপার রামজীবন, বিষয়সম্পত্তি নিয়ে গণ্ডগোল লেগেছে নাকি?
তটস্থ হয়ে রামজীবন বলল, আর বোল না বউদি, বাবা যেতে না যেতেই কুরুক্ষেত্র।
ওইজন্যই তো ওকে বলেছিলাম বড় বাড়ি করতে যেও না। অত বড় বাড়ি দেখেই সকলের দাবি-দাওয়া উঠছে।
রামজীবন গম্ভীর হয়ে বলে, বিষয় হল বিষ। দোতলাটা একটেরে রেখে দেবো ভেবেছিলাম, তা আর হল না। দাদা যদি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পারে।
ওকে আর এ সবের মধ্যে টানা কেন? জরুরি কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। তোমরা একটা মীমাংসা করে নাও।
রামজীবন বলল, আমার পরামর্শ হল, দাদা নিজেই দোতলাটা দাবি করে রাখুক। তা হলে বামাচরণের আর কিছু বলার থাকবে না।
কৃষ্ণজীবন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার একটা ইচ্ছেও ছিল যে, কয়েক বছর পর বিষ্টুপুরেই গিয়ে থাকব। তা আর সম্ভব নয় দেখছি।
কেন সম্ভব নয় দাদা? খুবই সম্ভব। তুই শুধু নিজের ভাগটা বুঝিয়ে দিয়ে আয়। বামাচরণ যদি বুঝতে পারে যে, দোতলাটা তুই নিজের জন্য করেছিস তা হলে আর রা কাড়বে না।
মাকে শান্তিতে রাখতে হলে এরকমই কিছু একটা করতে হবে। কৃষ্ণজীবন বলল, তুই যা, আমি রোববারে যাব। আমি আপাতত বামাকে একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, ওকে গিয়ে দিস।
রামজীবন চিঠি নিয়ে চলে গেল।
সেই চিঠিতেই কাজ হল। রবিবার কৃষ্ণজীবন বিষ্টুপুরে পৌঁছে দেখে, বামাচরণ রামজীবনের তোলা পাকা ঘরখানায় আশ্রয় নিয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর আর গোলমাল করেনি। কৃষ্ণজীবনকে এসে একটা প্রণাম করে বলল, তুই যদি থাকিস তা হলে তো কথাই নেই।
বামার বউও এসে পায়ের ধুলো নিয়ে হাসি-হাসি মুখ করে বলল, আপনিই এখন আমাদের গার্জিয়ান। আপনি যা বলবেন তা-ই হবে।
সমস্যাটা যে এত সহজে মিটে যাবে তা ভাবেনি কৃষ্ণজীবন। সে খুশিই হতে যাচ্ছিল। কিন্তু রামজীবন তাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলল, আমাকে যে দোকান করার টাকা দিয়েছিস এখন সেটা নিয়েই ওরা খুব ভাবছে।
ভাবছে?
ভাবছে মানে আলোচনা করছে। বউদি ছোড়দাকে বোঝাচ্ছে, এক ভাইকে দোকান করার টাকা দিলে আর এক ভাইকেও দেওয়া উচিত। ওরা তোর কাছে টাকা চাইবে।
কিন্তু বামা তো চাকরি করে।
তা করলেই বা। দোকান বউদি দেখবে। সে কথাও হয়েছে।
কৃষ্ণজীবন একটু দমে গেল।
রামজীবন বলল, আমি বলেছি দাদা দোকান করার টাকা আমাকে ধার হিসেবে দিয়েছে, দোকান থেকে যা লাভ হবে তা থেকে সুদ সমেত ফেরত দেবো। কথাটা বিশ্বাস করেনি। বলছে আমরাও না হয় ধার হিসেবেই চাইব। টাকাটা একবার হাতে পেলে আর শোধ দেবে না কিন্তু। তই একটু শক্ত থাকিস।
কৃষ্ণজীবন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দৃঢ় মানসিকতা বলতে যা বোঝায় তার তা নেই। সংসারের বিকট চেহারাটা তার কোনওদিনই ভাল লাগে না। সে সহ্যই করতে পারে না লোভ, লালসা, মিথ্যাচার, সঙ্কীর্ণতা।
বামাচরণের হাঁড়ি আলাদা। সেখান থেকে আজ কৃষ্ণজীবনের জন্য নানা ভাল ভাল পদ রান্না করে দিয়ে গেল শ্যামলী। বলল, ও বেলা আমার ওখানেই যদি দুটি ডালভাত খান হলে ভীষণ খুশি হই। আপনার সেবা করার সুযোগ তো পাইনি কখনও।
আপত্তি করার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না কৃষ্ণজীবন। ভিতরে ভিতরে যদিও তার একটা অনিচ্ছে হচ্ছিল। শুধু বলল, রাতে আমাকে কাজ করতে হয় বলে বেশির ভাগ সময়েই আমি নামমাত্র খাই। হয়তো একটু স্যুপ, না হয় তো একটু ডাল। আজকাল রাতের খাওয়াটা কমিয়ে দিয়েছি খুব।
না হয় স্যুপই করে দেবো।
পারবে? বলে একটু হাসল কৃষ্ণজীবন। বলল, তার দরকার নেই। দু’খানা রুটি আর একটু ডাল সেদ্ধ হলেই হবে।
মোটে? ওটুকু খেয়ে থাকলে তো শরীর পাত হয়ে যাবে।
তা কেন? কম খেলেই শরীর ভাল থাকে। বেশি খেলেই নানারকম ট্রাবল হয়। আর একটা কথা শোন, আমি আজকাল মাছ মাংস একদম খাই না। ওসব কোরো না বরং একটু স্যালাড কোরো। তা হলেই হবে।
আচ্ছা, তাই করব।
রাতে খাওয়ার সময়েই কথাটা তুলল বামাচরণ, দাদা, আমি একটা কথা ভাবছিলাম ক’দিন ধরে।
কী কথা?
আমার চাকরিটা তো কিছুই নয়। পিওনের আর কতই বা বেতন? তা ছাড়া মাঝে মাঝে শরীরটাও খারাপ করছে আজকাল। যাতায়াতের ধকল সহ্য হয় না।
কৃষ্ণজীবন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কথাটা মিথ্যে নয়। বামা অনেক রোগা হয়ে গেছে। চেহারাটা একসময়ে বেশ ভাল ছিল। সুপুরুষ বলতে যা বোঝায়। এখন দড়কচা মেরে গেছে। মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হয়ে যায়, তখন শরীর জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে পড়ে।
শ্যামলী বলল, জানেন তো, রামজীবনের গুণ্ডারা ওকে বেদম মেরেছিল। তখন মাথায় চোট হয়েছিল খুব। আর সেই থেকেই মাথার গণ্ডগোল।
কৃষ্ণজীবনের ভিতরটা একটা ব্যথায় ভরে গেল। ঘটনাটা সে শুনেছে। বামা যেমনই হোক, মার খাওয়ার কথা শুনে বড় কষ্ট হতে থাকে কৃষ্ণজীবনের। পৃথিবীতে কত অনভিপ্রেত ঘটনাই যে রোজ কত ঘটে? কেন যে ঘটে। সভ্যতার ইতিহাস তো কম পুরনো নয়, তবু মানুষ সভ্যতার এলাকাতেই ঢুকতে পারল না এখনও। শুধু বস্তুপুঞ্জ দিয়ে কি কিছু প্রমাণ করা যায়?
শ্যামলী ধরা-ধরা গলায় বলল, এ বাড়িতে আমাদের পক্ষে তো কেউ নেই। আমরা হলাম একঘরে। ওকে মারার পর ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। শ্বশুরমশাই ভরসা দেওয়ায় ফিরে এসেছি। কিন্তু আপনার ভাইয়ের শরীরের অবস্থা ভাল নয়। অনেক ছুটি নিতে হয়েছে বলে আজকাল মাইনে কাটে। ওরও চাকরির আর ধকল পোষাচ্ছে না।
চোখ তুলে কৃষ্ণজীবন বলল, কী করতে চাও?
শ্যামলী চুপ করে রইল। বামাচরণ বলল, রেমো তো দোকান দিয়ে বসেছে। চলছেও ভাল। বিষ্টুপুর এখন বেশ গঞ্জ জায়গা। লোকজনের গতায়াত আছে। ব্যবসা করতে পারলে চলে।
শ্যামলী বলল, আপনার অনেক টাকা বাড়ির পিছনে খরচ হয়ে গেছে, রামজীবনকেও দোকান করতে টাকা দিয়েছেন। কোন মুখে যে আপনার কাছে হাত পাতব তা ভেবে পাচ্ছি না। আপনার ভাইয়ের ইচ্ছে একটা স্টেশনারি দোকান দিয়ে বসে। কিন্তু অত টাকা আমরা কোথায় পাব বলুন! আমার গয়না বেচে দু-চার হাজার টাকা হতে পারে। কিন্তু তাতে তো হবে না!
কৃষ্ণজীবন বড় বিব্রত বোধ করতে লাগল।
বামাচরণ বলল, লাখ খানেক টাকা ঢালতে পারলে ভালই হবে। কিন্তু আপাতত যদি কমের মধ্যেই করি তা হলেও পঞ্চাশ হাজারের নিচে হবে না।
কৃষ্ণজীবনের মুখে রুটির টুকরো বিস্বাদ ঠেকছিল। তার কারণ, সে জানে, শেষ অবধি সে এদের সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না। লোভী, হয়ত অভাবে পড়েই হয়েছে, হয়ত টাকাটা শোধ দেওয়ার ইচ্ছে নেই, তবু কি পারবে কৃষ্ণজীবন না দিয়ে? রামজীবন বারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু সে কি করে ঠেকাবে এদের?
কৃষ্ণজীবন শান্ত গলায় বলল, তুই পারবি দোকান করতে?
কেন পারব না? রেমো পারলে আমিও পারব। দোকান করা তো সোজা কাজ। আমার বিশ্রামও হবে।
শ্যামলী বোধ হয় ভাবল, টাকার অঙ্কটা বেশিই বলা হয়ে গেছে। হয়ত তত টাকা কৃষ্ণজীবন দিতে চাইবে না। সে বলল, আমরা ধারই চাইছি। দু-দশ হাজার কম হলেও কষ্টেসৃষ্টে দোকান খুলতে পারব।
কৃষ্ণজীবন খাওয়া শেষ করে বলল, ভেবে দেখব’খন। তবে একটা কথা বলে রাখি, রামজীবন কিন্তু মাত্র চল্লিশ হাজার টাকায় দোকানটা খুলেছে। তারও দশ হাজার টাকা দিয়েছে ও নিজেই।
বামাচরণ বলল, চল্লিশ হাজারেও হয়। দু-পাঁচ হাজার টাকা আমরাও জোগাড় করতে পারব। চাকরি ছেড়ে দিলে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটাও পাওয়া যাবে।
ভাল করে ভেবে দেখ। ভেবে বলিস। আমি মাসখানেকের জন্য বিদেশে যাচ্ছি। ফিরে এসে একবার আসব।
বামাচরণ আর শ্যামলীকে নিয়ে মাথা ঘামাতে আর ইচ্ছে হল না কৃষ্ণজীবনের। মানুষের অগুণ আর দোষঘাটের কথা ভাবলেই তার মন খারাপ হতে থাকে। এসব ভাবনাকে তাড়ানো দরকার।
শীত পড়তে শুরু করেছে। তবে তেমন তীব্র কিছু নয়। খেয়ে এসে মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে ছাদে উঠে এল সে। এখন কোনও মহান চিন্তা ছাড়া এইসব জাগতিক চিন্তাভাবনা থেকে মনকে মুক্ত করা যাবে না। কিছু অর্থক্ষতি কপালে আছে। যাক, কিছু টাকা যাক। তবু মনটা যেন নীচুতলায় না থিতিয়ে থাকে।
আকাশ এখানে বড় পরিষ্কার। নক্ষত্রমণ্ডলী হীরের ঝাঁপির মতো ঢাকনা খুলে দিয়েছে। আকাশ তার প্রিয় বিষয়। ওই অন্ধকার ও নিস্তব্ধ জগতে আর কোথাও কি আছে পৃথিবীর মতো একটি সজীব গ্রহ? থাকলেই বা তা জানা যাবে কি করে? মানুষের বৈজ্ঞানিক প্রয়াস সীমাবদ্ধ রয়েছে সামান্য পরিধিতে। পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্রটিও চার আলোকবর্ষ দূরে। কোনওদিনই মানুষ আলোর গতি সঞ্চার করতে পারবে কি কোনও মহাকাশযানে? যদি-বা পারে তা হলে আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী সেই মহাকাশযান যেইমাত্র আলোর গতি পাবে অমনি সে নিজেই পর্যবসিত হবে এনার্জিতে। সে আর বস্তু থাকবে না। যদি দুর্মরতর কল্পনায় ধরে নেওয়া যায়, মানুষ তাও পারল, তা হলেই বা লাভ কি? সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রটির পরিমণ্ডলে পৌঁছতেই লেগে যাবে চার বছর। মানুষ পারবে না যেতে ওই গতিতে। কারণ মানুষের শরীর ওই অবিশ্বাস্য গতিবেগ সহ্য করার উপযুক্ত নয়। তা হলে কোটি কোটি অর্ব-খর্ব আলোকবর্ষ দূরে দূরে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে কোনওদিনই পৌছবে না মানুষ। কখনও নয়। কিছুতেই নয়। কল্পবিজ্ঞানে কত কী হয়। কিন্তু মানুষের বিজ্ঞান এখনও সেই অসম্ভব কল্পনার ধারেকাছে পৌঁছয়নি। তার বিজ্ঞান ততদূর পৌঁছতে না পৌছতেই শেষ হয়ে আসবে পৃথিবীর আয়ুষ্কাল। আর সেই অন্ধকার গ্রহে চাপা পড়ে যাবে মানুষের কাব্য-দর্শন-বিজ্ঞান, কোপনিকাস-আর্কিমিডিস-প্লেটো-শেকসপীয়ার-সক্রেটিস-রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইন, সবাই এবং সব কিছু। তবে কি বৃথাই মানুষের এই বেঁচে থাকা? বৃথা এই প্রকৃতির এত আয়োজন? বৃথা প্রাণ? বৃথা এই অন্বেষণ? ব্যর্থ ও মূল্যহীন মানুষের যতেক সঞ্চয়? বাণিজ্য ও নির্মাণ? প্রেম ও পরিবার? আত্মীয়তা-গৃহ-কর্মকাণ্ড?
ঠিক বোঝাও যায় না সব কিছু। হাতের নাগালেই যেন কোথাও রয়েছে সেই অমোঘ সত্য। একটু আড়ালে। কিন্তু কিছুতেই তার অবগুণ্ঠন মোচন করা যায়নি আজও। আজও জানা গেল না মৃত্যু কি, জন্ম কেন? আজও জানা গেল না এই প্রাণবন্যার অর্থ কি! সেইজন্যই কি আকুল মনুষ্যকণ্ঠ প্রশ্ন করেছিল, হে সূর্য, উন্মুক্ত করো তোমার সত্যের মুখ, আমাকে দেখতে দাও সেই সত্যকে।
অনেক রাত অবধি ঝুম হয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে রইল কৃষ্ণজীবন। যখন ঘরে এল তখন ভোর হতে আর বাকি নেই। মন প্রশান্ত। মন ভাসমান। না, বামাচরণ বা শ্যামলী সেখানে পৌছবে না কোনওদিন।
আর বিছানায় গেল না কৃষ্ণজীবন। ভোররাতে মাকে জাগিয়ে বলল, আমি যাচ্ছি মা।
ও মা! কিছু খেয়ে যাবি না?
না মা। দেরি হয়ে যাবে। তুমি ঘুমোও। আমি আবার আসব।
‘আবার আসব’ কথাটা আজ তার পিছু নিল। আবার আসব! সত্যিই কি আবার আসা যায় একবার এ জীবন ছেড়ে চলে গিয়ে? কে জানে! কিন্তু কেবলই মনে হয়, অলক্ষে একটা আসা-যাওয়ার বৃত্তাকার চংক্রমণ চলেছে কোথাও। প্রাণ থেকে প্রাণে, দেহে দেহান্তরে। আবার আসব—এ কথাটা মানুষের বড় প্রিয়।
কলকাতায় তার জন্য অপেক্ষা করছিল কয়েকটা ক্লাস, কিছু মিটিং, কনফারেন্স। অপেক্ষা করছিল কয়েকটা ছোটখাটো কিন্তু গুরুতর ঘটনাও। খাদে বাস পড়ে যাওয়ায় মরতে মরতে বেঁচে ফিরে এসেছে হেমাঙ্গ। আপাতত ঘরবন্দী। দ্বিতীয় খবর হল, সরকার বাহাদুর কৃষ্ণজীবনকে তিন বছরের জন্য জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত করেছেন। তৃতীয় খবর হল, চয়ন তার কষ্টে অর্জন করা কিছু টাকা পৃথিবীর ভালর জন্য দান করতে চায়।
তৃতীয় খবরটাই তাকে চমকে দিল সবচেয়ে বেশি। এক সন্ধেবেলা তার মুখোমুখি দীন ভঙ্গিতে বসে এপিলেপটিক, টিউশনি-নির্ভর ছেলেটা যখন অস্ফুট গলায় তার ইচ্ছেটা প্রকাশ করল তখন বিশ্বাসই হল না তার। বলল, কী করতে চাও বললে?
দান করতে চাই। পৃথিবীর যাতে ভাল হয় এমন কাজে।
কত টাকা চয়ন?
প্রায় পঞ্চাশ হাজার।
এ টাকা তুমি জমিয়েছ?
হ্যাঁ। দশ বছর ধরে টিউশনি করছি। আমার বিশেষ খরচ তো নেই। টাকাটা জমে গেছে।
এই ভাবপ্রবণ, আবেগতাড়িত প্রস্তাবে কৃষ্ণজীবন একটু হাসল। বলল, পৃথিবীর কিসে ভাল হবে তা কি তুমি জান?
আপনার কাছে শুনেছি। খানিকটা পড়েওছি ডারলিং আর্থ বইতে।
কৃষ্ণজীবন মাথা নেড়ে বলে, আমার এক ছাত্রও আমেরিকা থেকে ডলার পাঠিয়েছিল যাতে আমি পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য টাকাটা ব্যয় করি। আমি ভেবেই পাইনি কী করব! টাকাটা তাকে ফেরত পাঠতে বাধ্য হই।
কাতর গলায় চয়ন বলে, আমার টাকাটা আপনি নিন। এ টাকাটা আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে।
কেন চয়ন, জ্বলাচ্ছে কেন? এরকম অদ্ভুত কথা আমি জীবনে শুনিনি।
চয়ন লজ্জিত একটু হাসি হেসে বলল, টাকাটা আমি এমনিতেও রাখতে পারব না। আমার দাদা টাকাটা চাইছে।
কৃষ্ণজীবন অবাক হয়ে চেয়ে থাকে তার দিকে। তারপর বলে, কেন চাইছে?
বলছে কি সব শেয়ারটেয়ার কিনবে। আমাকে লোভ দেখাচ্ছে, তাতে নাকি অনেক টাকা লাভ হবে।
কষ্ট করে টাকা জমিয়েছ, সে টাকা তোমার দাদা নেবে কেন? এ তো অদ্ভুত কথা।
ও টাকা আমি রাখতে পারব না, দাদা নিয়ে নেবে।
তোমার চিকিৎসার খরচ আছে, দুর্দিনের জন্য কিছু সঞ্চয়ও রাখা দরকার। টাকাটা দান করলে তোমার চলবে কি করে? তা ছাড়া টাকাটা খুব কমও নয়, ইচ্ছে করলে এ টাকা দিয়ে একটা ছোটখাটো ব্যবসাও করতে পার।
চয়ন মাথা নেড়ে বলল, হেমাঙ্গবাবু আমাকে তাই বলেছিলেন। ব্যবসা আমার দ্বারা হবে না। আর আমার নিজের চলে যাবে। আমি চাই টাকাটা একটা ভাল কাজে লাগুক। আমি চেক কেটেই এনেছি। আপনার নামে।
দাও। বলে কৃষ্ণজীবন হাত বাড়াল। চেকটা হাতে নিয়ে দেখে বলল, তা হলে তোমার অ্যাকাউন্টটায় আর কিছু রইল না?
না।
ঠিক আছে। বলে চয়নের লম্বাটে শীর্ণকায় মুখখানার দিকে চেয়ে কৃষ্ণজীবন যেন একটি পবিত্র ভাবকে অনুভব করার চেষ্টা করল। গরিব যখন দান করে তখন বোধ হয় স্বর্গে ঘণ্টাধ্বনি হয়।
কৃষ্ণজীবন অবশ্য চয়নের আড়ালে চেকটা কুচিকুচি করে ছিড়ে ফেলে দিল। আজ আবেগবশে টাকাটা দান করলেও, কে জানে, কখনও আশু ভবিষ্যতে ও বিপদে পড়বে কি না, টাকাটা ওরই থাক, তবে ওর অজান্তে।
পৃথিবীর ভাল কিভাবে হবে তা কি চট করে নির্ধারণ করা সম্ভব? পৃথিবীর ভালর জন্য চাঁদার খাতা খোলার তো দরকার নেই। চাই শুধু আরও একটু চৈতন্য। নড়েচড়ে বসা। বুদ্ধি শানিয়ে নিয়ে নয়, হৃদয়বত্তা দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করা, মানুষের যতেক কর্মকাণ্ড কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীকে।
সম্প্রতি লন্ডনের একটি বিখ্যাত ম্যাগাজিনে ডার্লিং আর্থ বইয়ের রিভিউতে এক সাহেব-পণ্ডিত কিছু প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করার পরই অভিযোগ করেছেন, এই বইয়ের লেখক নিজে বিজ্ঞানের মানুষ হয়েও মহাকাশ গবেষণার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ইনি পৃথিবীকে পিছিয়ে নিতে চান পঞ্চদশ শতকে। মানুষ এতখানি এগিয়ে আসার পর কি আবার পিছু হটতে পারে?
রিভিউটা পড়ে কৃষ্ণজীবন সামান্য উত্তেজিত হয়ে একটা জবাবী প্রবন্ধ খাড়া করার চেষ্টা করছে। নাম দিয়েছে : ব্যাক টু ফিউচার, অ্যাডভান্স টু পাস্ট। গোটা মনুষ্য সভ্যতার ইতিহাসে যে মানুষের সভ্যতার অগ্রগমন ঘটেছে প্রযুক্তির ঘাড়ে চেপে সেটাকেই আক্রমণ করেছে সে। সে বলতে চেয়েছে, এগোনো মানে কী? এগোনো মানেই কি আরও কলকারখানা? আরও যন্ত্র-নির্ভরতা? আরও আরাম-আয়েস? অগ্রগমন মানে কি সমকামিতা আর বিবাহ বর্জন? অগ্রগমন কি মানুষকে বাঁচতে শিখিয়েছে? অনুধাবন করতে শিখিয়েছে প্রকৃতির নিয়মানুসারে জীবনের ধাঁচ গড়ে নিতে? সভ্যতা কি কাণ্ডজ্ঞান লোপাট করতে চায়? সভ্যতা কি মানুষের ঠোঁটে তুলে ধরা এক পাত্র হেমলক?
প্রবন্ধে সে এক জায়গার সভ্যতার অভ্যন্তরে স্ববিরোধের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছে, টিভিতে দেখতে পাচ্ছি ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি, মর্টার, রকেট, বোমার আক্রমণে গুড়িয়ে যাচ্ছে শহর, মরছে মানুষ! আবার তার ভিতরেই রেডক্রস এসে তুলে নিয়ে যাচ্ছে হতাহতদের, মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে মানুষ দুটো কাজই করছে কি করে? মারা এবং বাঁচানোর চেষ্টা? এখনও পৃথিবীতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যুদ্ধাস্ত্র তৈরি হচ্ছে, চলছে মারণাস্ত্র তৈরির গভীর গবেষণা। এখনও অন্ত্রের বাজার রমরম করছে দক্ষিণী দেশগুলিতে। সভ্যতা তা হলে কত দূর এগোল? কোনদিকে এগোল?
আজকাল বড় অস্থির লাগে তার। ছুটে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। সে কি মানুষকে বোঝাতে পারছে না তার কথা?