১১৪
রাওয়াত নামে এক বন্ধু ছিল হেমাঙ্গর। কলকাতায় ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি করত। দেশে ফিরে যাওয়ার মোহে সে একদিন চাকরি ছেড়ে দেশে গিয়ে নিজের বাড়িতে একটা স্কুল খুলে বসল। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। সরকারি সাহায্য দূরের কথা, অনুমোদন পর্যন্ত নেই। সেই থেকে খবরবার্তা বন্ধ ছিল হেমাঙ্গর সঙ্গে। কিছুদিন ধরে রাওয়াত তাকে চিঠি লিখছিল, একবার চলে এসো। হিমালয়ের কোলে আমার ছোট স্কুল দেখে যাও। দেখে যাও আনন্দ কী মহান হতে পারে।
দিল্লির অশোক হোটেলের পাঁচতলার ঘরের বারান্দায় রাত আটটার সময় চেয়ার টেনে বসে নানা কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রাওয়াতের কথা মনে পড়ে গেল হেমাঙ্গর। দিল্লির কাজ শেষ হয়েছে। কলকাতায় ফিরবার তেমন তাড়া নেই। দু-চারদিন দেরি হলেও ক্ষতি হবে না। কাল কর্ণপ্রয়াগ রওনা হলে কেমন হয়? বছর সাতেক আগে একবার কেদার-বদ্রী গিয়েছিল সে। তারপর আর ও পথে যাওয়া হয়নি। কাল রাতটা হরিদ্বারে কাটানো যায়। বাজারের মধ্যে একটা রাবড়ির দোকান আছে। দারুণ করে জিনিসটা। রাবড়ি খাবে, হর কি পৌড়ির চাতালে বসে থাকবে সন্ধেবেলা, আরতি দেখবে। পরশু হরিদ্বার থেকেই রওনা দেবে কর্মপ্রয়াগ। দুটো দিন রাওয়াতের ওখানে কাটিয়ে ফিরে আসবে। মন্দ কী?
ঘরে এসে কলকাতায় এস টি ডি করল সে। সিনিয়ার পার্টনারকে জানিয়ে দিল, ফিরতে দেরি হবে তিন দিন।
পরদিন রওনা হল হরিদ্বার। সেই রাবড়ি খাওয়া, হর কি পৌড়িতে বসে থাকা সবই হল, কিন্তু কেন যেন ভাল লাগল না আগের মতো। আগে যখন এসেছিল তখন দুজন বন্ধু ছিল সঙ্গে। খুব জমেছিল। একা একা জমল না একদম।
ভোর রাতে বাস ধরল সে। বিচ্ছিরি চেহারার বাস। চলতে ঘরঘর শব্দে মাথা ধরিয়ে দিল। তার ওপর গন্ধমাদন ভিড়। অনেকদিন কষ্ট করা অভ্যাস নেই তার। ভিড়টা সহ্য হচ্ছিল না। জানালার ধারে সিট পেয়েছিল বলে রক্ষা। বাস চলতে শুরু করার পর তার মনে হল, রাওয়াত আর তার স্কুল বা কর্ণপ্রয়াগ কেউ তাকে টানছে না। তার যাওয়াটা হচ্ছে জোর করে। নিজেকে সে এক অনিচ্ছুক যাত্রায় বাধ্য করছে যেতে।
শীতের মুখে এসব জায়গায় খুব ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। যত বাস ওপরে উঠবে তত বেশি ঠাণ্ডা। সকালে কুয়াশাও পড়েছে খুব। একটা মাফলারে মাথা আর কান ঢেকে একটু ঢুলছিল বসে হেমাঙ্গ।
ঘটনাটা ঘটল দেবপ্রয়াগ পার হয়ে চড়াইয়ে ওঠার পর। হেমাঙ্গ তখনও ঢুলছিল। সহযাত্রীরা কেউ কথা বলার মতো স্ট্যান্ডার্ডের নয়। বেশির ভাগই পাহাড়ে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ, ব্যবসাদার, তীর্থযাত্রী। সুতরাং একা বসে ঢোলা ছাড়া উপায় কি?
বিকট টায়ার ফাটবার একটা আওয়াজে কেঁপে উঠল হেমাঙ্গ। কিছু বুঝে উঠবার আগেই বাসটা একটা অস্বাভাবিক বাঁক নিয়ে ধাঁ করে ঘুরে গেল। তার পরই বাসসুদ্ধু লোকের প্রচণ্ড চিৎকার সমেত সোজা নেমে যেতে লাগল নিচে, নিরালম্ব।
নিরালম্বের এই বোধ জীবনে ছিল না হেমাঙ্গর। হাত-পা যেন ভারহীন, শরীর যেন হঠাৎ একখন্ড পালক। বাসটা একটা পাথর বা কিছুতে প্রচণ্ড শব্দে ধাক্কা খেয়ে উল্টে গেল এবং উল্টো অবস্থাতেই গড়িয়ে যেতে লাগল নিচে। কপালে আর পায়ে দুটো সাঙ্ঘাতিক ব্যথা পেল হেমাঙ্গ, চোখ আর মাথা ব্ল্যাক আউট হয়ে যাওয়ার আগে শুধু তার মনে হল, ভগবান! ট্যাংকটায় আগুন লাগবে না তো! তাহলে তো সব শেষ!
তার পরই জ্ঞান হারাল সে।
জ্ঞান ফিরল দু’দিন বাদে।
এত ক্লান্তি আর এত ব্যথা জীবনে কখনও আর বোধ করেনি সে। সর্বাঙ্গই যেন অচল। যেন আর কোনওদিনই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না। চারদিকে চেয়ে দেখে সে একটু অবাক হল। এ তো নোংরা, ভিড়াকার হাসপাতাল নয়। এ যে বেশ ঝকঝকে তকতকে একখানা সিঙ্গল বেডের ঘর। ড্রিপ চলছে। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ, নাকে অক্সিজেনের নল!
জ্ঞানটা বেশিক্ষণ থাকল না। আবার ঘুমিয়ে পড়ল সে। বারকয়েক সারা দিনে জ্ঞান ফিরল তার। কিছু বুঝতে না পেরে ফের ঘুমিয়ে পড়তে লাগল।
তৃতীয় দিনের সকালে অসহ্য ব্যথার বোধ নিয়ে চোখ মেলল সে। কেউ তাকে মৃদু স্বরে নাম ধরে ডাকছিল। যে মুখটা দেখতে পেল সেটা প্রথমে আউট অফ ফোকাস। তার পর চোখ তীক্ষ্ণতর হলে সে বলল, রাওয়াত!
বলল, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোল না তার। শুধু ঠোঁট নড়ল।
রাওয়াত ঝুঁকে পড়ে বলল, আর ইউ ওকে?
না। আমি বোধ হয় মারা যাচ্ছি।
এ কথাটাও শুনতে পেল না রাওয়াত। শুধু বলল, থ্যাংক গড। ইউ সারভাইভ।
কোন স্মৃতি নেই সেই দুর্ঘটনার। একটা বিকট শব্দ, নিরালম্ব ভাব, তার পরই আছড়ে পড়া। কিন্তু নানা ব্যথা-বেদনার ভিতর দিয়েও বিদুৎচমকের মতো অদ্ভুত একটা ঘটনা মনে পড়ল তার। বাসটা যখন উল্টে যাচ্ছিল, যখন ভিতরে যাত্রীরা পরস্পরের সঙ্গে তালগোল পাকাচ্ছিল আর দুমদাম বাক্সপ্যাটরা এসে পড়ছিল তাদের ওপর তখন একটা শিশু কোথা থেকে ছিটকে এসে তার বুকে ধাক্কা খেয়েছিল। ওই সাংঘাতিক অবস্থাতেও বাচ্চাটার জন্য হাত বাড়িয়েছিল হেমাঙ্গ। কিন্তু পারেনি। মাথাটা অন্ধকার হয়ে গেল নিজের অজান্তে। বাচ্চাটা কি বেঁচে আছে? বোধ হয় না। এইসব ঘটনায় বাচ্চারাই তো আগে মরে।
চারদিনের দিন গলায় স্বর এল তার।
রাওয়াত! তুমি কি করে জানলে যে আমার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে?
রাওয়াত মাথা নেড়ে বলে, কি করে জানব? জানতাম না তো। তুমি আসবে বলে খবরও দাওনি। তবে অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার খবর পেয়ে আমরা অনেকেই চলে এসেছিলাম স্পটে। এই পথে আমাদের চেনাজানা আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবসময়ে যাতায়াত করে। এসে রেসকিউতে হাতও লাগিয়েছিলাম। ঠিক পঁচিশ জনের পর তোমাকে তোলা হয়।
কতজন মারা গেছে?
একত্রিশ জন। আরও দু-চারটে যাবে।
আমার অবস্থা কেমন?
ইউ আর ওকে। দিল্লিতে নিতে পারলে মাথাটা স্ক্যান করা যেত।
আমি কোথায়?
হরিদ্বার। খুব রিস্ক নিয়ে এতদূর এনেছি। কিন্তু না আনলে মুশকিল ছিল।
আমি বাঁচব?
বেঁচে গেছ। থ্যাংক গড। তুমি যাচ্ছিলে কোথায়? আমার কাছে?
হ্যাঁ।
সরি হেমাঙ্গ। ভেরি সরি। আমার কপালটাই খারাপ। এই ঘটনার পর তুমি আর বোধ হয় কোনওদিনই আমার ওখানে যাবে না?
কে বলল? নিশ্চয়ই যাবো।
আচ্ছা। নাউ টেক রেস্ট।
আমার ইনজুরি কতটা?
কিছু ফ্র্যাকচার আছে। ব্যস।
এনি ভাইটাল উন্ড?
না না।
ভয়ে আর জানতে চাইল না হেমাঙ্গ। চোখ বুজে থেকে বলল, অ্যাকসিডেন্টের সময় একটা বাচ্চা আমার বুকে এসে পড়েছিল। বোধ হয় বাঁচেনি।
একটু বিস্মিত গলায় রাওয়াত বলল, একটা বাচ্চার কথা বলছ? দু-আড়াই বছর বয়স?
তা জানি না। ওই ভয়ংকর অবস্থায় কিছু ভাল করে দেখেছি নাকি?
অবাক কাণ্ড হল, তোমাকে যখন বের করা হয় তখন তোমার দু’হাতে একটা বাচ্চা ধরা ছিল। সে বেঁচে গেছে।
বেঁচে গেছে?
খুব আশ্চর্যভাবে। লোকে তো ধরে নিয়েছিল ওটা তোমারই বাচ্চা। আমি তাদের ভুল ভাঙাই। তবে বাচ্চার মা বাঁচেনি।
আমি কিভাবে বাঁচলাম রাওয়াত?
ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছেন ভাই। একটা পাথরের চাঙড়ে আছড়ে পড়ে বাসটা দু’খণ্ড হয়ে যায়। একটা খণ্ড গড়িয়ে নিচে চলে গিয়েছিল। ওটায় যারা ছিল কেউ বাঁচেনি। তুমি পিছনের পোরশনে ছিলে বলে বেঁচে গেছ। এখন বলো, তোমার বাড়িতে কী খবর পাঠাবো! তারা হয়তো চিন্তা করছে।
একটু চিন্তা করে হেমাঙ্গ বলল, বাড়িতে অ্যাকসিডেন্টের খবর দেওয়া ঠিক হবে না। বরং আমার পার্টনারদের জানিয়ে দিও। আমার জিনিসপত্র কিছুই কি পাওয়া যায়নি?
এখানে লুটপাট বিশেষ হয় না। পাহাড়ি লোকেরা এখনও ততটা খারাপ হয়ে যায়নি। তোমার একটা সুটকেস ছিল কি? ইনিশিয়াল মিলে যাচ্ছে, চারকোল ব্ল্যাক রঙের?
হাঁ। দরকারি কাগজপত্র আছে।
ঠিক আছে। আর কিছু?
আমার রিকভারি হতে কত সময় লাগতে পারে?
ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে দেখব। ইট উইল টেক টাইম।
সেক্ষেত্রে আমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া যাবে কি?
মে বি আফটার সাম টাইম। তার আগে তোমাকে দিল্লিতে শিফট করা দরকার। ফর দি স্ক্যান।
ব্যথা আর ব্যথা। আর অবসন্নতা। আর হতাশা। আর নিঃসঙ্গতা। হেমাঙ্গ সারা দিন স্থবিরের মতো পড়ে থাকে। নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। ডাক্তার বা নার্স কিছু বলতে চায় না। সে অনুমান করে, তার বাঁ হাত আর বাঁ পা ভেঙেছে। সম্ভবত গোটা দুই পাঁজরও। মাথার ব্যান্ডেজ থেকে অনুমান সেখানকার চোটও সামান্য নয়। অনেক রক্তপাত হয়ে থাকবে, নইলে শরীরের এই অবসন্নতা হত না।
রাওয়াত, আমাকে কি রক্ত দেওয়া হয়েছে?
অফ কোর্স। ইউ ব্লেড লাইক হেল।
শঙ্কিত হেমাঙ্গ বলে, সেই রক্ত কি এইচ আই ভি ফ্রি? আজকাল ব্লাড থেকে কত এইডস হয় তুমি জানো?
রাওয়াত হাসল, চিন্তা কোরো না। তোমার রক্তের গ্রুপ ইজি, আমি তোমাকে রক্ত দিয়েছি। আর দুজন বন্ধুকে ধরে এনেছিলাম। তাদের কারও এইডস্ নেই।
হেমাঙ্গর তবু একটু অস্বস্তি রয়ে গেল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ক্ষণে ক্ষণে একজনের কথা মনে পড়ছে। ভাবতে ভাল লাগছে। যদি অ্যাকসিডেন্টে মরে যেত তাহলে কী করত ও? কাঁদত নাকি? মন খারাপ করত? তা হয়তো করত। কিন্তু স্বাভাবিক হয়ে যেতে এবং তাকে ভুলে যেতে কতই বা সময় নিত?
দিন সাতেক বাদে একটানা অ্যাম্বুলেন্সে দিল্লি নিয়ে আসা হল তাকে। দুজন পার্টনার কলকাতা থেকে উড়ে এসেছে তার জন্য। খুব ভাল একটা নার্সিং হোমে ভর্তি করা হল তাকে। স্ক্যানে তেমন কিছু ধরা পড়ল না।
বাচ্চা ছেলের মতো সে মাঝে মাঝেই বলতে লাগল, বাড়ি যাবো।
পার্টনার দাশগুপ্ত বলল, বাড়ি বলতে তো গর্চা। সেখানে কে দেখবে তোমাকে? যা অবস্থা করেছ, বেশ কিছুদিন নার্সিং দরকার।
না দাশগুপ্ত, এভাবে হবে না। তোমরা আমাকে কলকাতায় নিয়ে যাও।
তোমার মায়ের পক্ষে কিন্তু ব্যাপারটা শকিং হবে। আমরা ওঁকে অ্যাকসিডেন্টের খবর দিইনি। শুধু বলেছি অফিসের জরুরি কাজে আটকে গেছে, ফিরতে দেরি হবে।
হেমাঙ্গ চোখ বুজে গভীর ক্লান্তির সঙ্গে বলল, শোনা দাশগুপ্ত, রিকভারির জন্য মানসিক স্বস্তিও দরকার। এখানে আমার ভীষণ একা লাগছে। আমাকে নিয়ে যাও।
কিন্তু এখনও যে তুমি বিছানা থেকে উঠতে পারছ না।
স্ট্রেচারেই নেবে।
দাশগুপ্ত একটু ভাবিত মুখে বিদায় নিল।
রাওয়াত কর্ণপ্রয়াগে ফিরে গিয়েছিল। আবার এল। বলল, আরে ভাই, ব্যস্ত হচ্ছ কেন? সাত আটটা দিন থাকো। তারপর একটু ফিটনেস এসে গেলে যেও।
একটা সত্যি কথা বলবে রাওয়াত?
কী?
আমার কোনও ভাইটাল ইনজুরি হয়নি তো? হয়তো আমি টের পাচ্ছি না।
আরে না ভাই। হলে টের পেতে না?
আমার কোমরে একটা ব্যান্ডেজ রয়েছে। আগে বুঝতে পারিনি। আমার স্পাইনাল কর্ড ভাঙেনি তো?
উঃ, তোমাকে নিয়ে পারা যায় না। ইউ আর অলরাইট ম্যান। আউট অফ ডেনজার।
অ্যাকসিডেন্টের প্রায় পনেরো দিন বাদে হাতে পায়ে প্লাস্টার, মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে হুইল চেয়ারে বসে সে প্লেনে উঠল এবং ফিরে এল কলকাতায়। নিজের ডেরায়।
ফটিক যে আর্তনাদটা করল সেটা মাইলখানেক দূর থেকেও লোকে শুনতে পেল বোধ হয়। এ কী দাদাবাবু! আপনি যে খুন হয়ে এসেছেন! অ্যাঁ। এ কী কাণ্ড?
ওরকম কোরো না ফটিকদা। আমি ভাল আছি।
নিজের ঘরে দোতলায় এসে একটা আরামের শ্বাস ছাড়ল হেমাঙ্গ। স্থানেরও মায়া কেন তা সে বুঝতে পারে না। এই যে ঘরদোর, বারান্দা, চেয়ার টেবিল, চেনা আসবাব এদের কি সত্তা আছে? নইলে এত টানে কেন? কেন এই চেনা বাড়িতে ফিরে এসে তার এত স্বস্তি? কী আছে এখানে?
যারা সঙ্গে এসেছিল তারা বিদায় নেওয়ার পর হেমাঙ্গ অনেকক্ষণ ক্যাসেটে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনল। মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই সে কথা যে যাই পাসরি। পায়ের কাছে আগাগোড়া ছলোছলো চোখে ফটিক বসে আছে।
অত মন খারাপ করছ কেন? মরেই তো যেতে পারতুম। কিন্তু মরিনি তো!
কালকেই কালীঘাটে পুজো দিয়ে আসব।
এই ভালবাসাটাকেও ব্যাখ্যা করতে পারে না হেমাঙ্গ। রক্তের সম্পর্ক নয়, মনিব-ভৃত্যের সম্পর্ক, তবু তার কিছু হলে ফটিক কাঁদে কেন? এইসব সামান্য সামান্য জিনিসের জন্যই বোধ হয় আজও মানুষের বাঁচতে ভাল লাগে। বড় বড় জিনিসের জন্য যারা বাঁচে বাঁচুক, কিন্তু এই সামান্য তুচ্ছগুলির জন্যই হেমাঙ্গর বুক তেষ্টায় কাঠ হয়ে আছে।
না, আজ কাউকে কোনও খবর দিল না হেমাঙ্গ। ফটিক আজ যত্ন করে রান্না করল। হেমাঙ্গ অঘোরে ঘুমোলো রাতে। শরীরের সব অস্বস্তি সত্ত্বেও মনটা ভারি ভাল।
এ বাড়িতে হুইল চেয়ার নেই। বেডপ্যান দেওয়ার লোক নেই। কিন্তু একটা দুটো ফোন করলেই সব ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারে। সকালে উঠে হেমাঙ্গ ভাবল, দেখা যাক কতটা পারা যায়। বাঁ হাতটা কনুই থেকে নিচের দিকটা ভেঙেছিল। বাঁ পা ভেঙেছে হাঁটু বরাবর। দুটোর কোনওটাই ভাঁজ করার উপায় নেই। ডান পায়ে ভর দিয়ে সে দাঁড়াল এবং বাঁ পা মেঝেয় রেখে অল্প একটু ভার রাখল সে। কেমন একটা অবশ বিহ্বল হয়ে রয়েছে পাটা। কোনও সাড়া নেই যেন। ভয় হল, হয়তো বেশি ভর দিলে আবার মচাক করে প্লাস্টারের মোড়ক সহই ভেঙে পড়বে। বোধ হয় এখনই এতটা অ্যাডভেঞ্চার না করা ভাল।
ফটিক অবস্থা দেখে বলল, দাদাবাবু, বিডন স্ট্রিটে একটা খবর দিন।
পাগল! মা এ অবস্থা দেখলে হার্ট ফেল করবে। আমি যে কলকাতায় ফিরেছি সেটাই মাকে জানানোর দরকার নেই।
তাহলে চারুদিদিকে?
দূর! চারুদি চতুর্দিকে রাষ্ট্র করে বেড়াবে। ও পেটে কথা রাখতে পারে না।
ফটিক একটু ইতস্তত করে লাজুক মুখে বলল, তাহলে অন্তত দিদিমণিকে তো জানানো দরকার।
দিদিমণি! সে কে?
ওই যে। গত কয়েকদিন যাবৎ কেবল খোঁজ নিচ্ছেন ফোনে।
ও। বলে হেমাঙ্গ ভিতরে ভিতরে একটা উথলে ওঠা কিছু টের পেল। বলল, কী বলছিল?
খোঁজ নিচ্ছেন রোজ, আপনি ফিরলেন কি না জানতে।
তাকে খবর দিয়ে কী হবে?
একজন কাউকে জানানো দরকার।
থাক ফটিকদা, জানানোর দরকার নেই। কয়েকটা দিন যাক না।
কিন্তু হেমাঙ্গ বুঝতে পারছিল, তার টয়লেটে যাওয়া বা গা মোছানো, মাথা বোয়ানোর জন্য একজন নার্স গোছের কাউকে দরকার। আবার বাইরের কেউ এলে তার স্বস্তিরও অভাব ঘটবে। কী করবে তা বুঝতে পারছিল না সে।
খানিকটা বেলায় সে টয়লেটে গেল বেশ কষ্ট করে। বাঁ পায়ে ভর না দিয়ে। একজোড়া ক্রাচ হলে কি সুবিধে হবে?
সারা দিন নিজের অবস্থাটা পর্যালোচনা করে দেখল সে। তারপর ক্রাচের সিদ্ধান্ত নিল। সিদ্ধান্ত নিল, নার্স রাখবে না। যতটা পারে নিজেই করবে। পারবে ঠিক।
কতকাল আর নিশিপুর যাবে না সে! এখনও কত কাল। নিশিপুর যেন দূরের এক রূপকথার জগৎ হয়ে গেছে এখন। সে যেন অলীক, মিথ্যে এক সাজানো জায়গা।
রাত আটটা নাগাদ টেলিফোনটা এল, ফটিকই ধরল। বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ এসেছেন। কী কাণ্ড! পাহাড় থেকে বাস সুদ্ধু পড়ে গিয়েছিলেন খাদে। শরীরের একটা হাড়ও আর আস্ত নেই। … অ্যাঁ, হ্যাঁ দিচ্ছি। ধরুন।
ভূকুটি করে হেমাঙ্গ বলল, কাকে ওসব বৃত্তান্ত দিলে?
একগাল হেসে ফটিক বলল, দিদিমণি। বড্ড ভাল মেয়ে। ধরুন ফোনটা।
কর্ডলেস টেলিফোনটা হাতে ধরিয়ে দিল ফটিক। হেমাঙ্গর শ্বাসকষ্ট হতে লাগল। বুকটার মধ্যে তোলপাড়।
ওপাশ থেকে কান্নাভরা একটা গলা বলল, কী হয়েছে? কথা বলছেন না কেন?
হেমাঙ্গ একটু হেসে বলল, আর বলবেন না! একটা বিচ্ছিরি অ্যাকসিডেন্ট।
পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েছিল বাস?
হ্যাঁ।
উঃ। কী হয়েছিল বলবেন তো!
যা হয় আর কি। খবরের কাগজে যেমন বেরোয়, খাদে বাস, নিহত একত্রিশ, ঠিক ওরকম।
আপনার কী কী হয়েছে আমি জানতে চাই।
বাঁ হাত আর পা ভেঙেছে।
কি রকম ভাঙা?
প্লাস্টার করা হয়েছে। ভালই ভাঙা। মাথায় চোট হয়েছিল। পাঁজরেও। কোমরেও।
ও পাশের কণ্ঠস্বরে কান্নার কাঁপন আর চাপা রইল না, ইস! মা গো! আমি এখনই যাচ্ছি।
না না, এখন না। রাত আটটা বেজে গেছে।
তাতে কি? আমি মাকে নিয়ে যাব।
আচ্ছা, কাল সকালে এলেই তো হয়।
আমার ভীষণ খারাপ লাগছে যে!
তা জানি। কিন্তু রাতে আসার দরকার নেই। কাল সকালে এলে কিছুক্ষণ থাকলে খুশি হবো। থাকবেন কিছুক্ষণ?
মাকে নিয়ে যাবো? না একা?
একটু হাসল হেমাঙ্গ। তারপর বলল, একা।
হাঁটাচলা করছেন কি ভাবে?
কোনওরকমে। কাল থেকে ক্রাচ নিতে হবে।
ইস। কী কষ্ট!
আপনি কাঁদবেন না। কাঁদবার মতো কিছু হয়নি।
একটু হলেই তো মারা পড়তেন।
হ্যাঁ। বেঁচে আছি দেখে সবাই অবাক।
ইস!
একটা অদ্ভুত ঘটনা কি জানেন?
কী?
ওই সাঙ্ঘাতিক অ্যাকসিডেন্টেও নাকি আমি একটা বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাঁচিয়ে দিয়েছি।
সত্যি?
আমি তো জানি না। যারা প্রত্যক্ষদর্শী তারা বলছে।
আমি সব শুনতে চাই।
অনেক সময় নিয়ে আসবেন। কাউকে বলবেন না কিন্তু।