১১২. এইভাবেই দান উল্টে যায় পৃথিবীর

১১২

এরকমও হয়? এইভাবেই দান উল্টে যায় পৃথিবীর? একতাল কাদার মত একটা মানুষ ছিল তার হাতে। বশংবদ, জোরে কথা কইতে জানত না, সর্বদা বিগলিত হয়ে থাকত। একটা জায়গায় শুধু শক্ত ছিল। ধর্মভয়। কিন্তু তবু তাকে ইচ্ছেমতো চালিয়েছে বীণা। ছিল অন্নদাস।

এখন সেই ছোট মানুষটা যে পাহাড় হয়ে দাঁড়াল। উচু, কঠিন, গায়ে আঁচড় বসানো যায় না।

শ্রাদ্ধের পর দিন একসঙ্গে ফিরছিল তারা। বাসে পাশাপাশি বসে। ঘটনাটা এমনি ঘটেনি। বীণা ঘটিয়েছিল। কেন ঘটাল? তার বড় ইচ্ছে হয়েছিল জানবার, নিমাইয়ের পরিবর্তন কতটা হল বা সত্যিই হল কিনা। তাই রওনা হওয়ার আগে সে গিয়ে বলল, তুমি যাচ্ছ? আমিও তো যাবো, একসঙ্গে গেলে হয় না?

নিমাই উদাস গলায় বলল, যাবে? তা কথা কি?

বাসে পাশাপাশি খানিকক্ষণ নীরবে বসে থাকার পর বীণা বলল, তোমার খুব মন খারাপ, না?

নিমাই জানালার বাইরে চেয়ে ছিল। একবার মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখে নিয়ে বলল, বড় উঁচু মানুষ ছিলেন। লোকে এ সব মানুষকে ঠিক বুঝতে পারে না।

বাবা তোমাকে খুব ভালবাসত। খুব ভরসা ছিল তোমার ওপর।

হুঁ।

বীণা আর এক ধাপ এগিয়ে বলল, বাবা যে তোমার ওপর ভরসা করত তুমিও তার দাম দিয়েছ। তাই না?

নিমাই একটু চুপ করে থেকে বলল, টাকাপয়সা কামাই করার কথা যদি বলো তা হলে বলতে হয়, সে রকম ভরসা উনি করেননি। ভরসাটা ছিল সততার ওপর, ধর্মভয়ের ওপর। তার দাম দিয়ে থাকলে সেটাই কাজের কাজ হয়েছে। কত চোর ডাকাত পাজিরাও তো পয়সা কামাই করে।

বীণা হঠাৎ বলল, তুমি কি সৎ থেকেই বড়লোক হয়েছো বলো?

নিমাই মৃদু হেসে বলে, একে বড়লোক বলে না। বড়লোকের রকম আলাদা। আসল বড়লোক তুমি দেখইনি। আমার একখানা হোটেল। ভগবানের দয়ায় চলে বলে রক্ষা। আর ধাবাটা কিন্তু আমার নয়। নিরঞ্জনবাবুর। উনিই টাকা ঢেলেছেন, আমার কিছু অংশ আছে। আমাকে বলে ওয়ার্কিং পার্টনার।

আর রিক্সা অটোরিক্সা?

দুটো রিক্সা আর একখানা অটোরিক্সা আমার আছে। তাও কেন জানো? মালপত্র আনা-নেওয়ার জন্য। বাকি সময়টা সওয়ারি টানে। আমার কোনও চুরিটুরির পয়সা নেই বীণা। তোমার বাবার বিশ্বাস বৃথা যায়নি এখনও। তবে আয়ু এখনও পড়ে আছে। যদি কখনও পা পিছলে যায় তখন এসে দুয়ো দিও।

তোমাকে দুয়ো দিলেই বুঝি আমার সুখ?

তা নয়। জানতে চাইছিলে তাই বললাম।

বীণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জেনে খুশিই হচ্ছি। আমার মতো তুমি নও। আমি তো পাপীতাপী মানুষ। চোরও।

কে জানে কেন নিমাই এ কথাটার প্রতিবাদ করল না। বাইরের দিকে চেয়ে রইল নীরবে।

খানিক বাদে বীণা বলল, টাকাটা তো তুমি কাকাকে ফেরত দিয়েই দিলে, তাতেও কি আমার পাপ কাটে না?

ফেরত তুমি দাওনি বীণা। তোমাকে বাঁচাতে সেই ডলার আর পাউন্ড আমি মেঝে খুঁড়ে বের করে ফেরত দিই।

কেন দিলে? কাকার কি ওতে অধিকার? কার টাকা কাকে ফেরত দিলে বলো তো! ওই ডলার আর পাউন্ড বেচে কাকা মস্ত দল করেছে জানো? চিৎপুরে ঘর ভাড়া করা হয়ে গেছে। পড়তি একজন ফিল্মস্টারকে অবধি নিয়েছে দলে। ওই টাকা তো চোরের ওপর বাটপাড়ি হল!

নিমাই ব্যথিত মুখে বলল, জানি। কিন্তু আমি কাজটা করেছি তোমাকে বাঁচাতে। কাউকে বিপদ থেকে রক্ষা করাটাই ধর্ম। কাকার দল তোমাকে মেরে ফেলত বীণা।

অত সোজা নয়। থানাপুলিস আছে। তুমি কাজটা ঠিক করোনি। ওই টাকাগুলো আজ আমার হাতে থাকলে আমিই একটা দল খুলে ফেলতে পারতাম। কাকার পরোয়া করতাম নাকি?

থানাপুলিস কাকে দেখাচ্ছ বীণা? কাকা যদি তোমাকে মারতে চাইত তা হলে কি পারত না? ও সব মানুষ দু-দশটা খুন অনায়াসে করতে পারে। পুলিস কিছু করতে পারত না। তোমার অভিজ্ঞতা নেই বলে বলছ। ও টাকা তোমার ভোগে লাগত না। বেঘোরে মারা পড়তে শুধু। তবে কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ, পগার টাকা কাকার পাওনা হয় না। সে তোমারও হয় না। শুনেছি সেটা লাল সিং-এর টাকা। কিন্তু ওয়ারিশান খুঁজে বের করে তার হাতে টাকা তুলে দেওয়ার দায় তো আমার নয়। তোমার। আমি শুধু তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি।

এটাকে কিরকম বাঁচা বলে বলো তো! আমি কি বেঁচে আছি নাকি? এর চেয়ে মরলে জ্বালা জুড়োত।

তুমি কিভাবে বাঁচবে, কিভাবে বাঁচতে চাও তা তোমাকেই ঠিক করে নিতে হবে। এখন জীবনটা তোমার একার। মরলে জ্বালা থাকে না ঠিকই, কিন্তু মরা তো আছেই। জীবন না চাইলে মরণকে আর ডেকে আনতে হবে না।

অত কাঠ-কাঠ কথা বলছ কেন? আমি তো আমার মতো করেই নিজের পথ করে নিচ্ছিলাম। তুমি এসে বাগড়া দিলে। মেঝে খুঁড়ে কোথায় টাকা আছে দেখিয়ে দিলে। দাওনি?

শোনো বীণা, টাকা যে ওখানেই আছে তা আমার জানার কথা নয়। ও টাকার হদিশ আমি পেয়েছিলাম হঠাৎ করে। তুমি বলোওনি। টাকাটা তোমার হেফাজত থেকে কোথায় গেল তা কাকা ভেবে পাচ্ছিল না। তারপর তার নজর পড়ল আমার দিকে। ভাবল, ও টাকা তুমি আমাকেই দিয়েছ ব্যবসা করতে। ওপরে লোক-দেখানো ছাড়াছাড়ির অভিনয় করতে করতে আসল কাজ হাসিল করছি। আমার বদনাম হচ্ছিল।

বীণা একটু অবাক হয়ে বলে, এত কথা আমি জানতাম না তো!

জানার কথাও নয়। তুমি কাকার চোখে ধুলো দিতে ঘরে একটা ভুয়ো গর্ত খুঁড়ে রেখে বাপের বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিলে। ওটা বড্ড ছেলেমানুষী হয়েছিল। ওভাবে কি পার পেতে? একদিন বনগাঁয়ে ফিরতেই হত। তখন কী হত বীণা?

আচ্ছা, তুমি কি আমাকে ঘেন্না করো?

হঠাৎ এ কথা কেন?

জিজ্ঞেস করছি। আমি তো চোর, পাপী, নটী। আমাকে কি আজকাল তোমার ঘেন্না হয়?

কম্বলের লোম বাছতে গেলে তো কম্বলই কাবার, ঘেন্না করাটা আমার আসে না। সে তুমি ভালই জানো।

জানতাম। কিন্তু আজকাল সন্দেহ হচ্ছে।

ঘেন্না করলে তোমার ভাত খেতাম নাকি? তোমার রোজগারে প্রতিপালন হয়েছি মা-বাপ সমেত। ঘেন্না করলে পারতুম?

তখন করতে না। এখন করো। আমি তো বলেইছি, আমার কাছে পাপপুণ্যের দাম নেই। বাঁচার জন্য আমাদের মতো মানুষকে সব করতে হয়। ভগবান বলে যদি কেউ থাকে তবে তিনি সেটা বুঝবেন। তিনিই জানেন মানুষ কেন কোন কাজ করে।

একটু হেসে নিমাই বলে, ভগবানের ওপর তোমার এত বিশ্বাস থাকলে করো যা খুশি। ওটাও একটা দর্শন হতে পারে। আমি অত জানি না, বুঝি না। আমার একটা বিশ্বাস আছে মাত্র, সেইটে নিয়ে চলি। সেটা ভুলও হতে পারে।

বীণা চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। প্রসঙ্গটা পাল্টানো দরকার। কোন কথা থেকে কোথায় গড়াল! না, সে নিমাইয়ের সঙ্গে তর্ক বা ঝগড়া করতে তো চায় না!

কিছুক্ষণ ভেবে হঠাৎ বীণা বলল, আমার আর বনগাঁয়ে পড়ে থাকার মানে হয় না।

নিমাই ধীর গলায় বলে, তবে পড়ে আছ কেন?

কোথায় যাবো বলল তো! কোন চুলোয়? থেকে থেকে ওখানেই একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু ভাবি একা একা ওখানে পড়ে থেকে কী হচ্ছে আমার!

বিষ্টুপুরে যাবে?

বিষ্টুপুর! সেখানে তো অবস্থা দেখে এলে! ভাইয়ে ভাইয়ে বাড়ির দখল নিয়ে কুরুক্ষেত্র হচ্ছে। দাদা আমাকে বলে গেল, তার বুড়ো বয়সে বিষ্টুপুরে এসে থাকার সাধ ছিল। এদের কাণ্ড দেখে সে ইচ্ছে চলে গেছে। কত বড় বাড়ি, দুখানা দালান, জায়গাও কত, তবু দোতলা একতলা নিয়ে মাথা কুটে মরছে দুজনে। মেজদা চিরকালই স্বার্থপর, বউটা তো আরও। ওখানে কে থাকতে যাবে বাবা।

তা হলে কী চাও?

বীণা ঝামরে উঠে বলল, কী চাই তা জানি না।

রাগ করছ কেন? রাগের কথা বলিনি। তোমার ভালমন্দ দেখার দরকার হলে দেখব। আমার সাহায্য পাবে। আর যদি কারও সঙ্গে ঘর বাঁধো তখন তার ওপর দায়িত্ব বর্তাবে।

মেয়েরা কি নুনের পুঁটুলি? এর ওর কাঁধে ভর দেবো কেন?

নিমাই গম্ভীর মুখে চুপ করে রইল। তারপর শান্ত গলায় বলল, কী করতে চাও বীণা?

বীণা চুপ করে থাকে।

নিমাই ফের তার শান্ত গলায় বলে, ফের দল করতে চাও? সজলবাবু তো আমাকে সেরকমই বলে রেখেছিল। তুমি টাকা দিতে বারণ করেছ, ভাল কথা। কিন্তু যদি মত পাল্টাও, যদি সজলবাবুর সঙ্গে জোট বেঁধে দল করতে চাও তো আমাকে বোলো। আমার অত টাকা নেই বটে, কিন্তু কিছু দিতে পারব।

আমি দল করতে চাই না।

তা হলে কী করবে?

ভাবছি।

তা হলে ভাবো কিছুদিন। আমার সাহায্য দরকার হলে বোলো।

বীণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বাবার শ্রাদ্ধে তুমি পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছ শুনলাম।

হুঁ

কেন দিলে? ওদের তো দরকার ছিল না।

দরকারের কথা তো ভাবিনি।

কাজটা ঠিক করোনি। দাদা তো খরচের কোনও কার্পণ্য করেনি। দেদার খরচ করেছে। সেজদার অবস্থাও এখন ভাল। তুমি খামোখা কেন দিতে গেলে? এই জন্যই তোমাকে লোকে আহাম্মক ভাবে।

নিমাই মৃদু গলায় বলল, আহাম্মকই তো। জন্ম-আহাম্মক। তবে আমার বড় ইচ্ছে হয়েছিল ওই মানুষটার শেষ কাজে আমারও কিছু দেওয়া থাক। আহাম্মকি হয়ে থাকলে হোক, আমার মনটা তাতে ভালই লাগছে।

বীণা পাশ-চোখে নিমাইয়ের দিকে তাকাল। লোকটা কতটা আহাম্মক সে আজ বুঝতে পারছে না। সে আজ বুঝতে পারে না একজন আহাম্মক কি করে আজ এতটা হয়ে উঠতে পারল। বীণা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

শোনো, একটা কথা।

নিমাই ধীরে মুখ ফিরিয়ে বলল, বলো।

আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দাও।

চাকরি আমি কোথায় পাবো?

তোমার তো অনেক চেনা।

তা আছে। তবে তারা কেউ চাকরি দেওয়ার মতো নয়।

তা হলে আমি কী নিয়ে বাঁচব?

কী নিয়ে বাঁচতে চাও? চাকরি তো বেঁচে থাকার কোনও কারণ নয়।

আমাকে তো কিছু একটা করতে হবে, নাকি?

সেটা তুমিই ভাল বুঝবে।

আমি এ রকম হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব নাকি?

নিমাই একটু হাসল। বলল, আচ্ছা, ভেবে দেখব। তেমন কাউকে পেলে বলেও রাখব চাকারির কথা।

তোমারও তো হিসেব রাখার জন্য লোকের দরকার হয়। হয় না?

হয়। তবে আমার লোক আছে। আর যাই হোক, তোমাকে নিজের কর্মচারী বানানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

কেন, আমি তোমার কর্মচারী হলে ক্ষতি কী? সম্পর্কটা নতুন রকমের হবে। মালিক কর্মচারীর।।

বীণা হাসল, কিন্তু নিমাই হাসল না। বলল, সম্পর্কটার আর দরকার কি? তোমার যাতে গ্রাসাচ্ছাদনের কষ্টটা না হয় তা আমি দেখব বীণা।

সম্পর্কটা তুমি চাও না?

নিমাই চুপ করে জানালার বাইরে চেয়ে রইল।

বীণা তেতো গলায় বলল, তুমি ভাবো যে সজলের সঙ্গে আমি…?

নিমাই আস্তে করে মুখ ফেরাল। বলল, আর হয় না বীণা। আর হয় না।

কিছু হওয়াতে বলিনি। একটা চাকরির কথা বলেছি।

আমার চাকরি কেন করবে?

আচ্ছা বাবা, তোমার নয়, আর কারও চাকরি তো হতে পারে!

না, তাও পারে না। তোমার ক্ষমতা ছিল অভিনয়ের, তা ছাড়া আর কোনও কাজে তো তোমার অভিজ্ঞতা নেই। চাকরির বাজার খুব খারাপ বীণা। সহজে হয় না।

আমি যে পাগল হয়ে যাচ্ছি।

নিমাই তার দিকে ধীরে ফিরে তাকাল। তারপর বলল, কেন পাগল হচ্ছ বীণা? তোমার কষ্ট কিসের?

সে তুমি বুঝবে না। কোনওদিন আমার কষ্ট বুঝেছ?

ব্যথিত গলায় নিমাই বলে, বুঝেছি। তোমার কষ্ট নিজের চোখে দেখেছি। না বুঝে উপায় ছিল না।

তা হলে আজ বুঝছ না কেন? আমি যে মনে মনে ভিখিরি হয়ে গেছি, সেটা বুঝতে পারছ?

না, তা পারছি না। তোমার যাত্রার দলের কাজটা নেই, এটাই কি বড় কথা?

সেটাই বড় কথা। সেটা যে কত বড় কথা তা তুমি বুঝবে না।

নিমাই দু’ধারে মাথা নেড়ে বলল, না, আমি তা বুঝব না বীণা। আমার বুঝবার মতো মন নেই। তবে একটা কথা বুঝি। তুমি অভ্যাসের দাস হয়ে যাচ্ছ। যাত্রার দলের যে জীবন তার রকম আলাদা। বড্ড বারমুখী করে দেয় মানুষকে। ও রকম কি ভাল বীণা?

উপদেশ দিতে শুরু করলে নাকি?

না, তা কেন? উপদেশ নয়। ভেবে দেখতে বলি। শান্ত হও, মাথা ঠাণ্ডা করো, তারপর ভাবো।

মাথা ঠাণ্ডা থাকছে না। মাথা ঠাণ্ডা রাখাই কঠিন।

এত বড় একটা শোক পেলে, সেটাও তো একটা ক্রিয়া করবে!

শোক! ওঃ, তুমি বাবার কথা বলছ?

হ্যাঁ।

বীণা যেন একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। তারপর বলল, হঠাৎ বাবার কথা তুললে কেন? বাবার মরার সঙ্গে আমার অবস্থার সম্পর্ক কী?

বলছিলাম, এ সময়টায় অত উত্তেজিত হতে নেই। শোক মানুষকে শান্ত সমাহিত আত্মমুখী করে দেয়। দেয় না?

আমি অতসব জানি না। বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক কী ছিল বলো তো! আমার বাপু অত সেন্টিমেন্ট নেই।

তাই দেখছি।

বীণা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, শোননা, আমার সঙ্গে কিন্তু সজলের কোনও সম্পর্ক নেই। ও তোমাকে যা বলেছে বানিয়ে বলেছে।

নিমাই একটু অবাক হয়ে বলল, সবটা বানিয়ে?

বীণা একটু লজ্জা পেয়ে বলে, সে রকম ভাব নয়। ও হয়তো চেয়েছিল, আমি চাইনি।

সজলবাবু বেকার, আমি জানি। যদি বেকার না হতেন তা হলে কী করতে বীণা?

কী আবার করতাম! কিছুই করতাম না।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, মানুষটি জোচ্চোর নয়, ঠকবাজ নয়, মানুষটি ভালই। তোমার দুর্দিনে তোমার পাশেই থেকেছেন। শুনলাম তোমার জন্য মারধর খেয়ে হাসপাতালেও যেতে হয়েছিল। মানুষটিকে অমন তাচ্ছিল্য করছ কেন? ওটা ভাল নয়।

বীণা থতমত খেয়ে বলল, তাচ্ছিল্যও করছি না। তোমার ভুল ভেঙে দিচ্ছি। তুমি একটা কিছু ধরে নিয়েছ। সেটা যে সত্যি নয় তাই বলতে চাইছি।

চাকদহে বীণার নেমে যাওয়ার কথা। চাকদহ এসে গেল। বীণা হঠাৎ বলল, হ্যাঁ গো, আজ বনগাঁয়ে চলো না!

নিমাই অবাক হয়ে বলে, বনগাঁয়ে? কেন?

অনেকদিন বাদে চলো না আমার ঘরটায়। দুজনে গল্প করব। সেই পুরনো দিনের মত।

নিমাই হাসল। মাথা নেড়ে বলল, পাগল! আমার কত কাজ পড়ে আছে।

এক দিনে আর কীই বা ক্ষতি হবে? হলে হোক। একবারটি পুরনো দিনের মতো চলো না দুজনে একটু একসঙ্গে হই।

নিমাই মৃদু মৃদু হেসে বলল, এ রকম হয় না বীণা। এ রকম হতে নেই।

কেন নেই?

তোমার আর আমার পথ আলাদা হয়ে গেছে।

তুমি আমাকে একসময়ে কী ভীষণ ভালবাসতে! আজ তার কিছু অবশিষ্ট নেই।

সবটাই আছে। আমার মতো মঙ্গলাকাঙক্ষী তোমার কেউ নেই।

তা হলে?

তোমার ভাল চাই বলেই এই প্রস্তাবে রাজি হলাম না বীণা। সম্পর্ক কখনও এত তরল হওয়া ভাল নয়। এত অবিবেচকের মতো হওয়া উচিত নয়।

কেন ও কথা বলছ?

স্বামী আর স্ত্রী এ বড় কঠিন সম্পর্ক বীণা। অনেক পরীক্ষায় পাস করে তবে স্বামী-স্ত্রী। আমরা পাস করিনি যে!

কী যে বলো, বুঝতেই পারি না।

আবার দেখা হবে বীণা। তখন বুঝিয়ে বলব। তবে আমি যেমন বুঝি। তোমার হয়তো ভাল লাগবে না।

বীণা বনগাঁয়ের বাস ধরতে নেমে পড়ল। নেমে পড়েই হঠাৎ তার মনে হল, বিশ্বজোড়া খাঁ-খাঁ করছে একটা একাকিত্ব। কী সাঘাতিক একা সে!

সন্ধের পর কুসুম এল।

বীণাদি, কেমন হল বাবার কাজ?

অন্যমনস্ক বীণা বলে, ভালই।

নিমাইদার সঙ্গে দেখা হল?

হ্যা, একসঙ্গে চাকদা পর্যন্ত এলাম।

সত্যি! ভাব হয়ে গেল বুঝি?

না রে।

বলো কি?

বীণা মাথা নাড়ল, তোর নিমাইদা আর সেই নিমাইদা নেই। পাত্তাই দিল না।

যাঃ।

বীণা চোখের জল চাপতে পারল না। একটু চুপ করে থেকে বলল, আজ সে শোধ নিচ্ছে।

নিমাইদা তেমন লোকই নয়।

সে খুব ভাল লোক কুসুম, আর আমি খুব খারাপ। এই তো! তোর দুনিয়াটা সহজ সাদা-কালোয় ভাগ করা। বেশ তাই-ই মানছি।

রাগ করলে নাকি? কী হয়েছে বলো না!

বীণা কিছু বলল না। চুপ করে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *