১১১. শোকের এমন প্রকাশ

১১১

শোকের এমন প্রকাশ বহুকাল দেখেনি চয়ন। এরকমও হয় নাকি আজকাল মা-বাপ মারা গেলে? শোকের প্রকাশ কত কমে গেছে মানুষের! আত্মীয়তা জিনিসটাই হয়ে গেছে একটা ফিকে ধারণা মাত্র। মা-বাপ বুড়ো হলে সংসারের মস্ত বোঝা। তারা মরলে মানুষ আজকাল কাঁদেও না ভাল করে। কৃষ্ণজীবনের গভীর শোকাহত মুখটা তাকে গভীরে আঘাত করল আজ। এ মুখখানা সে বোধ হয় আমৃত্যু ভুলতে পারবে না।

ঘটনাটা ঘটল তার সামনেই এক বিকেলে। মোহিনীকে পড়াচ্ছিল চয়ন। কৃষ্ণজীবন ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে বাইরের ঘরে বসে জুতো ছাড়ছিলেন। ঠিক সেই সময়ে টেলিফোন বাজল। রিসিভার ধরলেন কৃষ্ণজীবন নিজেই। দুবার বললেন, হ্যালো। তারপর বললেন, অ্যাঁ! তার পরই কর্ডলেস টেলিফোনটা তাঁর স্খলিত হাত থেকে সশব্দে পড়ে গেল মেঝেয়।

কী হল? বলে উঠে দাঁড়াল মোহিনী। সঙ্গে সঙ্গে চয়নও।

পাশের ঘরে দৌড়ে গিয়েই মোহিনী চিৎকার করে উঠল, বাবা! ও বাবা! তোমার কী হয়েছে?

চয়ন একটু নার্ভাস পায়ে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দরজায় দাঁড়াল। টেলিফোনের টেবিলটার পাশে। দাঁড়িয়ে কৃষ্ণজীবন। মুখখানা ছাইবর্ণ, চক্ষু স্থির এবং অস্বাভাবিক বিস্ফারিত, দুটো হাত মুঠো পাকাচ্ছে আর খুলে যাচ্ছে। মোহিনী দু’হাতে বাবাকে আঁকড়ে ধরে প্রাণপণে ঝাঁকুনি দিতে লাগল, বাবা! বাবা গো! ও বাবা! তোমার কী হল বাবা?

কৃষ্ণজীবন ধীরে ধীরে তাঁর বিস্ফারিত চোখ বুজলেন এবং চোখ ভরা জল দরদর করে নেমে আসতে লাগল।

চয়ন ফোনটা কুড়িয়ে নিয়ে ক্র্যাডলে রাখল। তারও হাত-পা কাঁপছিল নার্ভাসনেসে। এমন কীই বা ঘটতে পারে যাতে উনি এত ভেঙে পড়লেন? মোহিনীর মা তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে কোথাও গেছেন। বোধ হয় যোগব্যায়ামের ক্লাবে। সেরকমই আবছা জানা আছে চয়নের। এঁকে সামলানোর জন্য এখন একজন শক্তসমর্থ লোক দরকার। সে বা মোহিনী কেউই সেই সামর্থ্য রাখে না।

সামলে গেলেন অবশ্য কৃষ্ণজীবন নিজেই। দুহাতে নিজের অরণ্যের মতো চুলের গোছা খামচে ধরে ছেলেমানুষের মতো প্রথম ফুঁপিয়ে, তারপর ডুকরে কেঁদে উঠলেন শক্তপোক্ত কৃষ্ণজীবন। এই কান্নাটার দরকার ছিল। কাঁদতে কাঁদতে পিছু ফিরে একটু টলোমলো পায়ে হেঁটে সোফায় বসে পড়লেন। তারপর শ্বাসরোধকারী একটা শব্দ করতে করতে ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলতে লাগলেন, না⋯না⋯না⋯না⋯

মোহিনী পাশে গিয়ে বসল। বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, কাঁদে না বাবা, কাঁদে না, কী হয়েছে বাবা?

কৃষ্ণজীবনের এই শোক চয়নের কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা। শক্তসমর্থ, বিখ্যাত, প্রতিষ্ঠিত এবং বয়স্ক কৃষ্ণজীবন এত ভেঙে পড়তে পারেন তার ধারণা ছিল না। চয়নের ভয় হচ্ছিল যোগব্যায়ামের ক্লাসে গিয়ে দোলনের কিছু হল নাকি? সে জানে কৃষ্ণজীবন দোলনকে প্রাণাধিক ভালবাসেন।

প্রায় মিনিট দশেক কৃষ্ণজীবন ওরকমই বেহেড রইলেন। শুধু মোহিনী বাবাকে ছাড়ল না। ধীরে ধীরে— যেন মায়ের মতো— বাবার মাথাটা নিজের কাঁধে টেনে নিল, অবিকল মায়ের মতোই হাত বুলিয়ে দিতে লাগল মাথায় আর গালে, কাঁদে না বাবা, অত কাঁদে না। কী হয়েছে বলবে তো!

কৃষ্ণজীবন মেয়েকে আঁকড়ে ধরলেন হঠাৎ। মুখ তুলে বললেন, এ কি হতে পারে বল তো! হতে পারে? বাবা নেই! বাবা কোথায় যাবে আমাকে ছেড়ে? কোথায়?

এ প্রশ্নের জবাব মোহিনী কি দিতে পারে? উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেসে গেছে মানুষটির যত জ্ঞান, যত অভিজ্ঞতা, শোক ভাসিয়ে নিয়ে গেছে গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্ব, কৃষ্ণজীবন যেন এখন অসহায় শিশু।

চয়নের মাও মারা গিয়েছিল। সে মৃত্যু যেন শোক বয়ে আনেনি, এনেছিল প্রার্থিত মুক্তি। মায়ের জরাজীর্ণ অস্তিত্বের বন্ধন যেন অষ্টপাশে বেঁধে রেখেছিল চয়নকে। মা মরে যাওয়ায় কি শোক হয়নি তার? হয়তো তাও হয়েছিল। তবে নানা অনিশ্চয়তায় দিশাহারা, এপিলেপসির প্রকোপ, দাদার মুখাপেক্ষিতা সব মিলিয়ে এমন জট পাকিয়ে গিয়েছিল যে, শোকটাকে চিনতেই পারল না সে। এমন কি তার দাদা অয়নকেও কাঁদতে দেখেনি সে। গাম্ভীর্যের পোস্টার মুখে সেঁটে দাঁড়িয়েছিল শুধু।

কৃষ্ণজীবনের প্রতি বড় শ্রদ্ধা হল চয়নের। এ তো ভালবাসার সময় নয়। ভাত-কাপড়ের চেয়েও মানুষের অনেক বেশি অভাব এখন এই মহার্ঘ ভালবাসার। ওই এক জায়গায় মানুষ এখন দেউলিয়া। এখন মানুষের ভালবাসার লগ্নি বড্ড ছোট। বউ আর বাচ্চাকে নিয়ে ছোট ফ্রেমে ভালবাসাকে বাঁধিয়ে নিয়েছে সে।

মোহিনী মুখ তুলে চয়নের দিকে চেয়ে বলল, চয়নদা, মাকে একটু খবর দেবেন? ওই লালরঙা ফোন-বইতে হৃদয়রঞ্জন দাসের নম্বর।

কর্ডলেস টেলিফোনটা পড়ে গিয়েছিল। এখনও ঠিক আছে কি? চয়ন ফোন তুলে কানে দিয়ে দেখল, ডায়ালটোন আছে। নম্বরটা বের করে নার্ভাস আঙুলে ডায়াল করল সে। মোহিনীর মাকে সহজেই পাওয়া গেল। বললেন, কী হয়েছে চয়ন?

আপনার শ্বশুরমশাই মারা গেছেন।

ওঃ! আচ্ছা আসছি। উনি কী করছেন?

উনি খুব ভেঙে পড়েছেন।

ভেঙে পড়েছে?

ভীষণ! সামলোনো যাচ্ছে না।

অত ভেঙে পড়ল কেন? শ্বশুরমশাইয়ের বয়স হয়েছিল তো।

আপনি আসুন।

মোহিনী তার বাবাকে দুটি কিশোরী-হাতে ঘিরে রেখেছে। তাড়িয়ে দিতে চাইছে যতেক শোকতাপ। পারছে না। কৃষ্ণজীবনের হেঁচকি উঠছে। তার মধ্যেই হাহাকার হয়ে বুক থেকে শ্বাসবায়ু বেরিয়ে আসছে, বাবা!

এইভাবেই আরও আধ ঘণ্টা কাটবার পর রিয়া এলেন। মুখে চোখে থমথমে ভাব। কান্না নেই।

কৃষ্ণজীবনকে তেমনি ধরে আছে মোহিনী। তবে কৃষ্ণজীবন এখন সোফার পিছনে মাথাটা সম্পূর্ণ এলিয়ে চোখ বুজে আছেন। চোখ অবিরাম বর্ষণ করছে অশ্রুধারা। কেঁপে কেঁপে উঠছে বুক। কত কালের জমা দীর্ঘশ্বাসসমূহ উপর্যুপরি বেরিয়ে আসছে বুক থেকে।

রিয়া দৃশ্যটা দেখল একটু থমকে দাঁড়িয়ে। তার পর হঠাৎ চয়নের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, এখন আমরা কী করব বলো তো!

চয়ন বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে বলল, আপনাদের একবার ওখানে যাওয়া দরকার। এখনই।

এখনই! কিন্তু এখনই কি করে?

কৃষ্ণজীবন দুটি অসহ্য রাঙা চোখ মেলে তাকায়। তারপর কান্নাভেজা গলায় বলে, তোমাদের যাওয়ার দরকার নেই।

রিয়া কি সামান্য স্বস্তি বোধ করল? বলল, তুমি কি যাবে?

কৃষ্ণজীবন হঠাৎ যেন সচকিত হয়ে সোজা হলেন। তারপর দু’হাতে ফের মুখ ঢেকে ফেললেন। অদ্ভুত চাপা একটা আর্তনাদ করে উঠলেন, মুখাগ্নি বোঝো? মুখাগ্নি? আমি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র, শ্রাদ্ধাধিকারী। বোঝো এসব? আমি না গেলে হবে এসব? হবে? বাবা বারান্দায় শুয়ে আছে আমার জন্য। প্রাণ নেই, তবু অপেক্ষা করছে। জানো এসব? মানো?

রিয়া কাছে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। কোমল কণ্ঠে বলে, ওরকম কোরো না গো! অত ভেঙে পড়তে নেই। আমি কি তোমাকে একা ছাড়ব ভেবেছ? আমরা সবাই যাবো। ওরা একটু তৈরি হয়ে নিক?

কৃষ্ণজীবন কিছুই বললেন না, আর একটা কান্নার ঘূর্ণি ঝড় যেন অন্তস্তল থেকে উঠে এল তাঁর। ভেসে যাচ্ছিলেন।

এইটুকু দেখে বিদায় নিল চয়ন। তার আর কিছু করার নেই। শোকেসন্তাপে চেনা কৃষ্ণজীবনের ভিতর থেকে যে আর একজন কৃষ্ণজীবন বেরিয়ে এলেন তাঁকে এতকাল চিনত না চয়ন। এ এক আশ্চর্য কৃষ্ণজীবন। ইনি গাছপালা, পশুপাখি ভালবাসেন এটা সে জানত। কিন্তু সেই ভালবাসার এই গভীর উন্মোচন আজ বড় লজ্জিত করে চয়নকে। এত ভালবাসা মানুষটার! এত! বৃদ্ধ গ্রাম্য সরল এক বাবার জন্য এই বিশ্বখ্যাত মানুষটার এত ভালবাসা, এত হাহাকার? কৃষ্ণজীবনের মতো মানুষকে দেখলেও বোধ হয় বহু জন্মের পাপ কাটে।

তুমি চালিও না, তুমি চালিও না, অ্যাকসিডেন্ট করবে। আমি ড্রাইভার ডাকছি। চারুশীলাদের একজন চব্বিশ ঘণ্টার ড্রাইভার আছে।

দাঁতে দাঁত চেপে কৃষ্ণজীবন বলল, না, আমি পারব। আমাকে পারতেই হবে।

পিছনে তিন বিস্ময়াবিষ্ট ছেলেমেয়ে, সামনে রিয়া, কৃষ্ণজীবন গাড়ি ছাড়ল। তার চোখ আজ উষ্ণ প্রস্রবণের মতো ভেসে যাচ্ছে জলে। দীর্ঘশ্বাসে পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে যেন।

এই তো সেদিন আম্রপল্লবটা বাংলাদেশ থেকে এনে দিয়েছিল সে। মুখে কী অপার্থিব হাসি ফুটেছিল বাবার! কী হল তোমার বাবা? হঠাৎ কী হল? এইভাবে যেতে হয় বুঝি?

কিছুই কি দেখতে পাচ্ছে না সে? সব যেন আবছা। চোখের জলে পথের আলো নানা বিভ্রম ঘটাচ্ছে। কৃষ্ণজীবন তীব্র হর্ন দিয়ে দিয়ে চালাচ্ছে গাড়ি। বাইপাস ধরে উত্তর দিকে মুখ ঘুরিয়ে সে জোরে ছেড়ে দিল গাড়ি।

অত জোরে নয়, ওগো সাবধান!

কিছু হবে না। আমাকে কনসেনট্রেট করতে দাও। কথা বোলো না।

রিয়া কথা বলল না আর। মাঝে মাঝে রুমালে চোখ মুছে নেয় কৃষ্ণজীবন। গাড়ি চালাতে থাকে।

এরা কেউ জানে না, তাদের সম্পর্ক রচিত হয়েছিল অভাবে খিদেয়, অনেক সর্বনাশকে ঠেকিয়ে। বাবা তাকে পড়াত, চাষ করতে শেখাত। বাবা তাকে শিখিয়েছিল পৃথিবীকে ভালবাসতে। পিতা ধর্ম, পিতা স্বর্গ, পিতাহি পরমং তপঃ•••

উড়ে গেল ভি আই পি, উড়ে গেল যশোর রোড। তার পর গাঁয়ে যাওয়ার ভাঙা রাস্তা। গাড়ি। লাফায়, টাল খায়, যায়। পিছনে ঘুমিয়ে পড়েছে দোলন, আর দুজন চিত্রার্পিত বসে আছে। তারা জানে না কিভাবে শোক করতে হয়। তারা দাদুকে ভাল করে চেনেই না।

গ্রামবাসী অনেক জড়ো হয়েছে উঠোনে। রামজীবন দাদাকে দেখে দৌড়ে এসে কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল পায়ের ওপর, দাদা রে!

নয়নতারার চোখে আর জল নেই। সারা দিন ভুল বকে, কেঁদে হাঁফিয়ে এই এখন বিষ্ণুপদর খাট আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে নিঝুম হয়ে। তাকে কেউ সরাতে পারেনি। মাঝে মাঝে বলে উঠছে, কালঘড়ি দেখেছিল না! কালঘড়ি! তখনই জানতাম। তখনই জানতাম ফাঁকি দেবে।

বাবার শিয়রে এসে দাঁড়াল কৃষ্ণজীবন। অপলক চেয়ে রইল মুখের দিকে। বাবার গালে তিন-চার দিনের দাড়ি। মুখ বড় প্রশান্ত। চোখভরা ঘুম। একজন শান্ত, নিরীহ, নিপাট মানুষ। এই পৃথিবীর কারও সঙ্গে তাঁর কোনও বিবাদ ছিল না। ছিল না ঋণ, অভিযোগ, ক্ষোভ বা হিংসে। বাবার মুখের দিকে চেয়ে থেকে সেই গুণাবলীর উত্তরাধিকার আজ গ্রহণ করার চেষ্টা করছিল কৃষ্ণজীবন। এও জ্ঞান, এও বিদ্যা, এও দীনজনের মতো নতমস্তকে গ্রহণ করতে হয়।

কৃষ্ণজীবন তার বাবাকে প্রণাম করল।

হরিবোল, বিষ্ণুপদ কাঁধে উঠলেন। চললেন। রাত ভোর হওয়ার আগেই ছাই হয়ে গেলেন। পঞ্চভূতের শরীর নিয়ে নিল যে যার ভাগেরটা। যা রয়ে গেল তা স্মৃতি।

খালের নোংরা জলে স্নান করে যখন উঠে এল কৃষ্ণজীবন তখন তার বুক পাথরের মতো নিস্তব্ধ। যেন হৃৎপিণ্ডও থেমে গেছে। ব্রাহ্মমুহূর্তের বৈরাগ্যের রং চারদিকে। জীবন ও মৃত্যুর অর্থহীনতার মাঝখানে কী মহান এই পার্থিব জীবন! ক্ষণস্থায়ী, অথচ কত বর্ণময়।

সকালের আলো ফুটল। শ্মশানযাত্রীরা ফিরে এল নিঃশব্দ পদসঞ্চারে। বিধ্বস্ত, বিহ্বল বাড়িটায় আজ সকালে জাগরণের কোনও কোলাহল শোনা গেল না। খুব নিঝুম।

কৃষ্ণজীবন যখন ধড়া পরে বারান্দার প্রান্তে একটি কুশাসনে নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিল তখন কোমল কচি দুখানা হাত পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল তার গলা, বাবা!

বড় চমকে ওঠে কৃষ্ণজীবন। কে?

খুব কেঁদেছো বাবা?

আয় দোলন।

দোলন পাশটিতে বসে বাবার মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

কৃষ্ণজীবনের দু’চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ে জল।

দোলন আর কিছু বলে না। শুধু চেয়ে থাকে। এ বাড়িটা কাদের সে বুঝতে পারে না। এরা কারা তাও তার কাছে স্পষ্ট নয়।

বাঁ পাশে কুয়োতলা, তারপর বাগান, সামনে উঠোন। কৃষ্ণজীবন তার বাবার পরিধি দেখছিল। গত কয়েক বছর বাবা এই বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে বড় একটা যায়নি। যেখানে কৃষ্ণজীবন বসে আছে সেখানে ছিল একখানা দাওয়া। কৃষ্ণজীবন বাঁধিয়ে মোজেইক করে দিয়েছে। দাওয়ার এই প্রান্তটিতে বসে ঝুম হয়ে চেয়ে থাকত। কী দেখত বাবা? কী দেখত? অভাবক্লিষ্ট জীবনের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসে এই দাওয়ায় বসে আকাশ-পাতাল ভাবত। কূলকিনারা পেত না, থৈ পেত না এই জীবনের, এই পৃথিবীর। কৃষ্ণজীবন বিদেশে গেছে শুনলেই বাবা পটলের ভূগোলের বই আর ম্যাপ খুলে বসত। এই মস্ত পৃথিবীর কোন সুদূর প্রান্তে গেছে তার ছেলে তা অনুধাবন করত। হয়তো-বা ছেলের চোখ দিয়েই দেখার চেষ্টা করত অচেনা বিদেশ। অজানা দেশ, অচিন দেশ কত কি দেখা হল না তার। বোঝা হল না এই জীবনের অর্থ।

বাবার সেই বিস্ময়ের উত্তরাধিকার আজ কোলে নিয়ে বসে আছে কৃষ্ণজীবন। মাথার ওপর ওই যে মহাশূন্য, এই চারদিকে পরিব্যাপ্ত বিশ্বজগৎ তার অর্থ কি কৃষ্ণজীবন জানে? এই যে মৃত্যু এসে নিয়ে গেল মানুষটাকে— এরই বা অর্থ কি? কোথায় যায়? নাকি⋯যায় না কোথাও?

দিনের আলোয় চেনা মুখগুলি ফুটে উঠল চারধারে। শোকসন্তপ্ত একটা বাড়ির উঠোনে, বারান্দায়, ঘরে সরস্বতী, বীণাপাণি, রামজীবন, বামাচরণ, নয়নতারা। বাচ্চা। বউরা। বিষ্ণুপদ বিশ্বাস কি বেঁচে আছে এদের মধ্যে?

আম্রপল্লবটা মা যত্ন করে রেখে দিয়েছে বিছানার পাশে একটা ফুলদানিতে।

ওইটে ধরে বসে থাকত, বুঝলি? কেমন ধারা হয়ে গিয়েছিল।

জানি মা।।

কী থেকে কী হয়ে গেল বাবা, বল তো! শেষ দিনটায় বয়সের হিসেব নিচ্ছিল। কেন নিচ্ছিল কে জানে!

মায়ের দিকে চেয়ে বিহ্বল হয়ে যায় কৃষ্ণজীবন। তার মা আর বাবা বিয়ের পর থেকে বোধ হয় একটি দিনও পরস্পরকে ছেড়ে থাকেনি। নিবিড় গভীর ছিল দুটি মানুষের সম্পর্ক। দুজনে মিলে নিঃশব্দে টানত সংসারের জোয়াল। কখনও মা আর বাবার ঝগড়া বা মতান্তর হয়নি। মা যে কী ভীষণ একা হয়ে গেল তা শুধু গভীরভাবে টের পায় কৃষ্ণজীবন। এই একাকিত্ব কি মা সহ্য করতে পারবে? মা হয়তো পারবে। সংসারের সঙ্গে জড়িয়ে-মড়িয়ে, নাতিপুতি ছেলে-বউ নিয়ে হয়তো বা পারবে। কিন্তু বাবার বদলে মা যদি যেত তাহলে বাবা পারত না। আরও বোবা হয়ে যেত, অসহায় হয়ে যেত। পুরুষরা তো সংসার নিয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে থাকতে পারে না।

কৃষ্ণজীবনের গভীর শোকাহত চেহারা দেখে দোলন আর নয়নতারা ছাড়া কেউই বড় একটা কাছে ঘেঁষছে না।

নয়নতারা শুয়েই আছে ওপরের ঘরে। মাঝে মাঝে নানা কথা ভুরভুরি কাটছে। তারপর দীর্ঘ বিরতি, চোখ বোজা। সেই চোখের কোলে জমে যাচ্ছে পুকুর।

বাড়ির আর সবাই সামলে উঠেছে। বাচ্চারা একটু খেলছে-টেলছে উঠোনে, বাগানে, পাড়ার লোকেরা আসছে যাচ্ছে। জামতলায় গিয়ে বিড়ি টেনে এল বামাচরণ। সবই দেখতে পায় কৃষ্ণজীবন। কিছুই স্পর্শ করে না তাকে।

রিয়া একসময়ে এসে বলল, ছেলেমেয়েদের স্কুল কামাই হচ্ছে। দুটো-তিনটে দিন হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু তার বেশি হলে মুশকিল। জানোই তো মোহিনীর ফাইনাল ইয়ার।

কৃষ্ণজীবন তার উদাস চোখ জোড়া রিয়ার চোখে স্থাপন করে বলে, যাবে? যাও তাহলে।

আজ শনিবার, না গেলেও চলবে। কিন্তু কাল গেলে ভাল হয়।

অস্ফুট গলায় কৃষ্ণজীবন বলে, যেও।

তারও কত গুরুতর কাজ পড়ে আছে কলকাতায়। কত মিটিং সেমিনারে নেমন্তন্ন অপেক্ষা করছে। কিন্তু কিছুই তার ভিতরে কোনও তাগিদ সৃষ্টি করছে না আর। সামনে এক শূন্যতা নিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে গেছে বড়। বারবার বুঝতে চেষ্টা করছে উত্তরাধিকারের কথা। তার ভিতরে বাবা কতটুকু বেঁচে আছে?

কে একজন একটা কাটা ডাব হাতে নিয়ে সামনে এসে বলল, এটা খেয়ে নিন দাদা।

কৃষ্ণজীবন চেয়ে দেখল, নিমাই। ডাবটা হাতে নিয়ে সে বলল, কেমন আছ নিমাই?

ভালই।

নিমাই যে ভাল আছে তা তার পরিচ্ছন্ন ধুতি বা জামাতে নয়, প্রকাশ পাচ্ছে তার মুখেচোখে। উদ্‌ভ্রান্ত, তটস্থ, ভীতু সেই মুখখানায় অনেক আত্মস্থ একটা ভাব। দেখে ভাল লাগে। নিমাই চুপ করে বসে রইল সামনে।

তুমি আর বীণা কি একসঙ্গে এলে নিমাই?

আজ্ঞে হ্যাঁ। গতকাল বীণা বনগাঁ থেকে কাঁচরাপাড়ায় গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে খবরটা দিল বিকেলবেলায়। তখনই চলে এলাম।

তোমরা এখনও একসঙ্গে থাকো না?

আজ্ঞে না। সম্পর্কটা সেরকম নয়।

কৃষ্ণজীবন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কোনও সম্পর্কই আর বেঁধে রাখতে পারছে না মানুষকে পরস্পরের সঙ্গে। এ বড় ভাগের সময় এল। বিষ্ণুপদ আর নয়নতারাদের আর পাওয়া যাবে না দুনিয়াতে। তারা হারিয়েই যাবে বুঝি।

একটু বেলায় শোরগোলটা উঠল। জামতলার দিকে তিনটে গলা উঠল সপ্তমে। বামাচরণ চেঁচাচ্ছিল, বিশ্বাস না হয় মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, দোতলাটা বাবা আমাকে দিয়ে গেছে কি না। দেখ জিজ্ঞেস করে। বাবা নিজের মুখে বলেছে আমি মরলে তুই দোতলাটা নিস।

বামার বউ গলা মিলিয়ে বলল, আমরা তো আর বলতে যাইনি। উনি নিজের মুখেই বলে গেছেন।

রামজীবন তেজের সঙ্গে বলল, দোতলা-ফোতলা ভুলে যাও। থাকতে হয় তো থাকতে পারো, কিন্তু দোতলা কেউ পাবে না। মা থাকবে যেমন আছে। বাবার সব জিনিস সাজিয়ে রাখা হবে ওখানে।

বামাচরণ বলল, কেন? এত বড় জায়গাটা ফাঁকা ফেলে রাখবি, এ কি গায়ের জোর নাকি? দোতলা আমার পাওয়ার কথা।

কৃষ্ণজীবনের কানে আঙুল দিতে ইচ্ছে করছিল। এরা তার শোকভারনম্র দ্রব মনটাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। সে গভীর স্বরে ডাকল, পটল!

পটল দৌড়ে এল, বলল জ্যাঠা।

চল তো, ঘুরে আসি।

পটলের সঙ্গে হাটে-মাঠে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল কৃষ্ণজীবন। মনটা ছিছিক্কারে ভরা। তার বউ ছেলে-মেয়ে ওই কদর্য ঝগড়ার সাক্ষী থাকছে। বিষিয়ে যাচ্ছে তারা। দৃষিত হয়ে যাচ্ছে চারপাশ।

যখন ক্লান্ত কৃষ্ণজীবন ফিরল তখন ঝগড়া থেমেছে। কিন্তু এ হল বারুদের স্তূপের ওপর বসে থাকা। এই বাড়িঘর যতেক নির্মাণ এসব বাইরে থেকেই দেখতে ভাল। এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকে স্বার্থপরতা।

এ বাড়িটা তার বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হল একবার।

সে ফিরে বারান্দার কোণে কুশাসনে চুপ করে বসে ছিল, এমন সময়ে রিয়া এসে সামনে দাঁড়াল, শুনছ?

বলো।

খুব চাপা গলায় রিয়া বলল, এখানে কি থাকা যাবে? ঝগড়া তো শুনলে!

শুনলাম।

কিরকম খারাপ খারাপ সব কথা বলছিল দু’জন। বাড়ি করে দিয়ে তুমি আরও বিপদ করেছ।

কৃষ্ণজীবন চুপ করে থাকে।

চলো, চলে যাই। শ্রাদ্ধের সময় না হয় আসা যাবে। কী বলো?

কৃষ্ণজীবন আরও খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, তাই চলো! তোমরা তৈরি হয়ে নাও।

দুপুরের খাওয়াটা হোক। তারপর।

কৃষ্ণজীবন স্তিমিত গলায় বলল, আচ্ছা।

কলকাতার দিকে গাড়ি চালাতে চালাতে কৃষ্ণজীবন ভাবছিল, বিষ্টুপুরে তার কি আর ফিরে আসা হবে? ওই ভাগের বাড়ি, তলায় তলায় আক্রোশ, রোজ ঝগড়া— এ সবের মধ্যে হারিয়ে যাবে তার ধ্যান, তার প্রজ্ঞার অনুভূতি। না, বিষ্টুপুর নয়। অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে।

বর্ধমানের দিকে একটা খামারবাড়ি দেখে এসেছিল সে। লাগোয়া জমিই অনেকটা, চার বিঘের ওপর। প্রচুর গাছ আছে। বুড়ো মালিক বিক্রি করে দিতে চায়। এখনও কি আছে? থাকলে কিনে নেবে সে। মাঝে মাঝে তার যে পালানো দরকার। সভ্যতা থেকে, আত্মীয়তা থেকে, সম্পর্ক থেকে।

বাড়ি এসে গুম হয়ে রইল কৃষ্ণজীবন। গুটিয়ে গেল নিজের মধ্যে। আর এই গুম হওয়া ভাবটা অব্যাহত রইল বিষ্ণুপদর শ্রাদ্ধ অবধি। ন্যাড়া মাথায় ফিরে এল কলকাতায়।

তারপর একদিন অনুর ফোন, কতকাল দেখা হয় না বলুন তো! এখন কী নিয়ে ব্যস্ত আপনি বলডিং হেডের কাজ তো শেষ?

আমার বাবা চলে গেলেন।

সে তো জানি। স্যাড। আমার বাবারও খুব শরীর খারাপ হয়েছিল একদিন, জানেন! আমাদের এত ভয় হয়েছিল!

উনি এখন ভাল আছেন?

হ্যাঁ। কিন্তু কবে দেখা হবে বলুন তো! আবার তো ফুরুৎ করে চলে যাবেন বিদেশে, না?

কৃষ্ণজীবন হাসে, হয়তো যাবো।

কবে?

সামনের মাসে। বেলজিয়াম।

উঃ, পারেনও বটে আপনি ঘুরতে।

তুমি বেড়াতে ভালবাসো, না?

খুব বাসি।

আমি বেড়াতে যাই না, আমি যাই পৃথিবীটাকে বুঝতে। কত চেষ্টা করি, কিছুতেই আজও বুঝতে পারি না এ পৃথিবীটা কিরকম, এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী?

আপনি আমাকে বুঝিয়ে দেবেন।

নিজে আগে বুঝি তবে তো!

শুনুন, একটা খবর আছে।

কি খবর?

হেমাঙ্গ অ্যান্ড দিদি। বলে হি হি করে হাসে অনু।

1 Comment
Collapse Comments
শুভাশিস রায় November 17, 2024 at 3:16 pm

শোকের প্রকাশ নিয়ে শীর্ষেন্দু’র বিশ্লেষন (বর্ণনা) অনবদ্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *