চন্দননগরের গোন্দলপাড়ায় গঙ্গার ধারে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িটি রাজপ্রাসাদতুল্য। নীলের ব্যবসায়ী মোরান সাহেব এই বাগানবাড়িটি বানিয়েছিলেন খুব শখে ও যত্নে। এখন নীলের কারবারে মন্দা চলছে, প্রায় বন্ধ হবারই মুখে, তাই এই কুঠিবাড়িটি ভাড়া দেওয়া হয়। বর্তমানে এখানে সস্ত্রীক বসবাস করতে এসেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
একেবারে গঙ্গার তীর থেকেই পাথরে বাঁধানো সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে ওপরে, মিশেছে এক সুবিশাল বারান্দায়। তারপর ঘরগুলির আকৃতিও বিচিত্র। তারপর ঘরগুলি সমতলে নয়, কোনটি একটু উঁচুতে, কোনটি কয়েক সিঁড়ি নীচে, কোনও ঘরই পাশাপাশি নয়, দরজাগুলিও বিভিন্ন দিকে। এ বাড়িতে কোনোদিনই অতি পরিচয়ের একঘেয়েমি আসবে না।
নদীর গা ঘেঁষেই রয়েছে একটি প্রশস্ত বৈঠকখানা, তার সব জানালায় রঙিন ছবিওয়ালা কাচ বসানো। প্রতিটি ছবিই এক একটি মধুর দৃশ্য। তার মধ্যে একটি ছবি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে : ঘন পত্রপল্লবময় একটি গাছের ডালে বাঁধা রয়েছে একটি দোলনা, তাতে বিভোর হয়ে দুলছে দুই যুবক-যুবতী। দেখলেই মনে হয় সম্পূর্ণ নির্জনতার স্বাদ উপভোগ করছে ওরা দুজন।
এ বাড়ির দু পাশে এবং পশ্চাৎদিকে অনেকখানি বিস্তৃত বাগান, তাতে যেমন রয়েছে প্রচুর ফলবান বৃক্ষ, তেমনই বহুরকম ফুলের সম্ভার। বিভিন্ন ঋতুর ফুল-ফল অনেকটা এমনিই ঝরে যায়। একটি বড় আম গাছের ডালে টাঙানো আছে সত্যিকারের দোলনা। নদীর ঘাটে বাঁধা আছে একটি সুদৃশ্য নৌকো, এই ঘাটে অন্য কারুর নৌকো ভিড়তে পারে না।
আকাশে এখন রঙের দ্যুতি, অস্ত যাচ্ছেন সূর্যদেব। গঙ্গার বুকে নেমে এসেছে সহস্ৰ রেখা, পাল তোলা চলমান নৌকোগুলি সেই অপরূপ আলোয় মায়াময় রূপ ধরেছে। এখানে কল-কোলাহল নেই, কোনও যান্ত্রিক শব্দ নেই, একটু কান পাতলেই যেন সোনা যায় প্রকৃতির নিজস্ব সংগীত।
ঘাটের সিঁড়িতে নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন, এক সুঠাম পুরুষ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ষষ্ঠ সন্তান। দীর্ঘকায়, মজবুত গড়ন, টানা টানা চোখ, কুঞ্চিত চুল, তাঁর রূপ দেবোপম। দেবেন্দ্রনাথের চতুর্দশ পুত্রকন্যার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিত্বই সবচেয়ে উজ্জ্বল, রূপে-গুণে সমান, তিনি খেলাধুলো অশ্বারোহণ ও শিকারে দক্ষ, পিতার অনুপস্থিতিতে জমিদারির কাজ তিনিই পরিদর্শন করেন, আবার সাহিত্য ও সঙ্গীতে তার যশ অনেকখানি ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বেহালা বাজাতে পারেন, পিয়ানো বাজাতে জানেন, সঙ্গীত রচনা করে সঙ্গে সঙ্গে সুর বসিয়ে দেন, নাট্যকার হিসেবে তিনি রীতিমত সফল, তাঁর রচিত নাটক সাধারণ রঙ্গমঞ্চেও অভিনীত হয় নিয়মিত। বাংলার সকলেরই চোখ ঠাকুর বাড়ির এই প্রতিভাবান তরুণটির দিকে, অনেকেরই ধারণা, তিনি অসাধারণ কীর্তি রেখে যাবেন।
জ্যোতিন্দ্রনাথের হাতে রুপোর হাতল বসানো পাতলা পোরসিলিনের চায়ের পেয়ালা, তাতে চুমুক দিতে দিতে তিনি সূর্যাস্তের শোভা উপভোগ করছেন, একবার মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রবি কোথায়? রবি নামেনি?
বাগানে সাজানো রয়েছে বেতের গোল টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার। একটি চেয়ারে বসে আছেন জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথের স্ত্রী কাদম্বরী, ইনিও সাধারণ নারীদের তুলনায় লম্বা, গাঢ় ভুরু, বড় বড় অক্ষিপক্ষ্ম, কৌতুকময় চক্ষু। এর সঙ্গেও তুলনা দেওয়া যায় কোনও গ্ৰীক দেবীর। বস্তুত অন্তরঙ্গ মহলে তাঁর ডাক নাম হেকেটি। তাঁর আরও একটি ডাক নাম আছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পরে আরও অনেক ভাই বোন জন্মে গেলেও অনেকের কাছে তিনি বা নতুনদা নামে পরিচিত। সেই অনুসারে তাঁর স্ত্রী নতুন বউঠান। দেবেন্দ্রনাথের অন্যান্য পুত্রবধূরাও এসে গেছে, কিন্তু কাদম্বরী নতুন বউঠানই রয়ে গেলেন, তিনি পুরনো হবেন না।
মাথার চুল সামনের দিকে পাতা কাটা, পরনে ঘটিহাতা ব্লাউজ ও সাদা সিল্কের শাড়ি, কাদম্বরীও চা-পান করতে করতে একটি বই পড়ছিলেন, একটি চটি কাব্যগ্রন্থ, মুখ তুলে বললেন, রবি তো চা খায় না।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গলা তুলে ডাকলেন, রবি, রবি!
এ বাড়িতে কতগুলি যে কক্ষ তার হিসেব নেই। অনেক ঘরই কাজে লাগে না। তিনজন মাত্র নারী পুরুষের বসবাস এখানে, ভৃত্যদের মহল বেশ খানিকটা দূরে। প্রয়োজনে না পড়লে তাদের কাছাকাছি এসে ঘোরাফেরা করার নিয়ম নেই। গৃহটির সবচেয়ে উঁচুতলায় একটি গোল ঘর রয়েছে, তার সব দিকই খোলা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রবি এটি দখল করে নিয়েছে, এখানে সে নিভৃতে কবিতা-সাধনা করে।
অনন্ত এ আকাশের কোলে
টলমল মেঘের মাঝার
এইখানে বাধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার।
দাদার ডাক শুনে রবি ছাদের কার্নিশের ধারে দাঁড়িয়ে নীচে উঁকি দিল। কুড়ি বছর পূর্ণ করে সদ্য একুশে পা দিয়েছে সে। সলজ্জ, লাবণ্যমাখা মুখ, মাত্র কিছুদিন আগে সে দাড়ি কামানো শুরু করেছে, মাথার চুল দু পাশে পাট করা, মাঝখানে সিঁথি। একটা রেশমের কাজ করা কুর্তা ও কুচোনো ধুতি পরা, পায়ে লপেটা। রবি দেখতে চাইল, তার দাদার কাছে কোনও দর্শনার্থী এসেছে কি না। কেউ নেই দেখে সে প্রফুল্ল মনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল।
ইদানীং সে বাইরের লোকদের সংসর্গ পারতপক্ষে এড়িয়ে যেতে চায়, এমনকি আত্মীয়-স্বজনদেরও সামনে অস্বস্তি বোধ করে। এই সংসারে আর যা কিছুরই অভাব থাক, অযাচিত মন্তব্য বা উপদেশ দেওয়ার মানুষের অভাব নেই। নিজের কোনও উপকার হয় না তবু অন্যকে মানুষ আঘাত দেয়। অনেকে শুভার্থীর ছদ্মবেশে হাসিমুখে গরলমাখা তীর নিক্ষেপ করে আনন্দ পায়। যেমন, ইদানীং অনেকেই দেখা হলেই তাকে প্রশ্ন করে, কী রবি, এবারেও বিলেত গিয়ে কিছু করতে পারলে না? শুধু শুধু ফিরে এলে!
একবার নয়, দু দুবার রবিকে বিলেত পাঠানো হয়েছিল ব্যারিস্টার কিংবা আই এ এস হয়ে আসার জন্য। দুবারই সে ব্যৰ্থ হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথের এতগুলি সন্তানের মধ্যে একমাত্ৰ সত্যেন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউই নিজস্ব জীবিকা অর্জনে সমর্থ হয়নি। যৌবনে ঋণে জর্জরিত দেবেন্দ্রনাথ একান্ত নিজের উদ্যমে সমস্ত দায়মুক্ত হয়েছেন এবং বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারির বিস্তার ঘটিয়েছেন। কিন্তু তাঁর পুত্ররা সেই ঐশ্বৰ্য বৃদ্ধির বদলে ক্ষয়ের দিকেই বেশি মনোযোগী। বিবাহিতা কন্যাদের স্বামীরাও ঘরজামাই। দেবেন্দ্রনাথ এখন কলকাতায় থাকেন কদাচিৎ। পশ্চিমের বিভিন্ন শৈল শহরে কিংবা নদীবক্ষে বোটে বাস করেন ইচ্ছেমতন, অবশ্য চিঠিপত্র ও দূত মারফত পরিবারের প্রত্যেকের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখেন।
তাঁর চোদ্দটি সন্তানের মধ্যে রবিই এখন কনিষ্ঠ। রবির পরেও বুধ নামে আরো একটি পুত্র ছিল, কিন্তু সে অকালমৃত। রবির দুই দাদা পাগল, অন্যরাও খামখেয়ালি। কৈশোরেই রবির বুদ্ধির প্রাখর্য প্ৰকাশ পেয়েছে, তার সুঠাম সুন্দর শরীর, সকলেরই ধারণা হয়েছিল রবি নিশ্চিত একজন কেউকেটা হবে। সেই জন্যই ষোলো বৎসর বয়েসে তাকে বিলেত পাঠানো হল। তার জন্য দেবেন্দ্রনাথ এস্টেটের তহবিল থেকে মাসে মাসে দেড়শো টাকা বরাদ্দ করেছিলেন, পরে তা বাড়িয়ে দুশো চল্লিশ টাকা করা হয়। সেই টাকায়, অর্থাৎ মাসিক কুড়ি পাউন্ডে বিলেতে তার বেশ সচ্ছলভাবেই চলে যাওয়ার কথা।
প্রথম প্রথম রবির মন বসেনি তা ঠিক। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ মানিয়ে নিতে সময় লাগে। মেজবৌদি জ্ঞানদানন্দিনী সেই সময় দুই ছেলেমেয়ে বিবি আর সুরেনকে নিয়ে ইংল্যান্ডে ছিলেন, মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ দুটি কাটাতে এসে পড়লেন, রবি থাকতে লাগল ওঁদের সঙ্গে। ওঁরা চলে যাওয়ার পর রবি একটু একটু করে মন দিল ভাষা শিক্ষায়, তারপর ভর্তি হল লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে। সেখানে ভালোই করছিল সে, হঠাৎ দেবেন্দ্রনাথের আদেশে তাকে ফিরে আসতে হল। পিতার আদেশের কোনও প্রতিবাদ চলে না।
প্রায় দু বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে, অনেক অর্থ ব্যয় করেও কোনও ডিগ্রি না নিয়ে রবি ফিরে এলো, কিন্তু সবটাই কি তার দোষ? শেষের দিকে রবি পেয়িং গেস্ট ছিল একটি ইংরেজ পরিবারে। সেই পরিবারে এক প্রৌঢ় দম্পতি ও তিনটি কন্যা তাদের মধ্যে দুটি মেয়ে না জানি ভারতীয়দের কীরকম কিম্ভূত দেখতে হয় এই ভয়ে প্রথমে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল পরে তারা ফিরে এসে দেখে এই যুবকটি রীতিমতন সুপুরুষ এবং সুকণ্ঠ, বিলিতি আদবকায়দাও জানে। গৃহকর্ত্রী রবিকে জননীর মতন স্নেহ করতেন। যুবতী তিনটির সঙ্গে রবির বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সবাই মিলে এক সঙ্গে গান গায়, পিকনিকে গিয়ে হাসিঠাট্টায় মাতে, অন্ধকার ঘরে প্ল্যানচেটে বসে। এসব খবর দেবেন্দ্রনাথের কানে পৌঁছেছিল। মেম-যুবতীদের সঙ্গে ছেলের এমন মেলামেশা তিনি পছন্দ করেননি, আর একটি ব্যাপারেও দেবেন্দ্ৰনাথ উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। বিলেত থেকে রবি ভারতী পত্রিকার জন্য ‘য়ুরোপ যাত্রী কোনও বঙ্গীয় যুবকের পত্র’ নামে যে লেখাগুলি পাঠাত, তাতে মাঝে মাঝে রীতিমতন ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ছিল। ‘পারিবারিক দাসত্ব’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রায় পারিবারিক বিদ্রোহের মতন। তাতে রবি লিখেছিল যে, বাঙালি পরিবারের অভিভাবকরা বাড়ির ছোটদের প্রতি দাস-দাসীর মতন ব্যবহার করে, তাদের মতামতের কোনও মূল্য দেয় না। এমনই উগ্ৰ মতামত যে সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ছোটভাইয়ের লেখাটি প্রকাশ করেছিলেন বটে, কিন্তু সম্পাদকীয় মন্তব্যে প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বাবার হুকুমে রবি ফিরে এল তবু সবাই রবিকেই দায়ী করল। আত্মীয়রা বলতে লাগল, কী রে, রবি, এতগুলো দিন বিলেতে থেকে এলি, কিছুই করলি না? সেই সব খোঁচা তার গায়ে বেঁধে, সে কষ্ট পায়, তার সেই কষ্ট মাত্র- দু-একজন ছাড়া আর কেউ বোঝে না। রবি ঠিক করল, সে ব্যারিস্টারি পাশ করবেই, বাবার কাছে সে আর একবার বিলেত যাওয়ার অনুমতি চাইল।
দ্বিতীয়বার আর একা নয়, তার সঙ্গী হবে তার প্রায় সমবয়সী ভাগনে, বড়দিদি সৌদামিনীর ছেলে সত্যপ্ৰসাদ। একই বাড়িতে দুজন বালক বয়েস থেকে বর্ধিত হয়েছে, সত্যপ্ৰসাদ বয়েসে দু-এক বছরের বড়, রবির তুলনায় অনেক বেশি তুখোড়। সত্যপ্ৰসাদ কলকাতার কলেজে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ে করেছে এবং পরপর পরীক্ষায় ফেল করলেও এরই মধ্যে এক কন্যা সন্তানের পিতা হয়ে একটা অন্তত সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। এই সত্যপ্ৰসাদই রবিকে দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়ার প্ররোচনা দেয়।
কলকাতা থেকে ছাড়ল জাহাজ, ডেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সত্যপ্ৰসাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার শেষ নেই, ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে এসে সে আর জোড়াসাঁকোয় থাকবে না। সাহেবপাড়ায় বাড়ি ভাড়া করবে, রবিকে করে নেবে তার জুনিয়ার! রবিকে বেশি পরিশ্রম করতে হবে না, সে কবিতা লেখার অনেক সময় পাবে। কিন্তু মাদ্রাজ পৌঁছবার কিছু আগে পেটে মোচড় দিতেই সে চিৎকার করতে লাগল, ওরে রবি রে, আমার আর বিলেত যাওয়ার কাজ নেই, আমি বাড়ি ফিরে যাব, আমি বাড়ি যাব! রবি যত বোঝায় যে এই সী-সিকনেস দু-একদিন পরেই কেটে যাবে, সত্যপ্ৰসাদ তত আর্তনাদ বাড়িয়ে দেয়। জাহাজের পার্সার এবং অন্যান্যরাও এসে তাকে নানারকম টোটকা দেওয়ার চেষ্টা করল, সে কিছুই শুনবে না। সে বলতে লাগল, তার রক্ত আমাশয় হয়েছে, মৃত্যুর আর দেরি নেই, সে তার প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী নরেন্দ্ৰবালা আর শিশুকন্যার মুখ না দেখে পৃথিবী ছাড়তে চায় না।
জাহাজের ক্যাপ্টেন বিরক্ত হয়ে সত্যপ্ৰসাদকে নামিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু সত্যপ্ৰসাদ একা যাবে না, রবিকেও ফিরতে হবে তার সঙ্গে।
বন্দরে নামার পরেই বোঝা গেল। সত্যপ্ৰসাদের অসুখবিসুখ কিছুই নেই। খাদ্যদ্রব্যের প্রতি বেশ লোভও আছে। আসল কথা, পত্নী-কন্যাকে ছেড়ে সে বিলেতে থাকতে পারবে না। কিন্তু রবির তো ওসব বন্ধন নেই, তবু রবির যাত্রা নষ্ট করা কেন। সত্যপ্ৰসাদ জানে, দেবেন্দ্রনাথ এই সংবাদে মহা বিরক্ত হবেন, তাই রবিকে সে ঢাল হিসেবে নিজের সামনে রাখতে চায়। দেবেন্দ্ৰনাথ তখন রয়েছেন মুসৌরিতে, মাদ্রাজ থেকেই টেলিগ্ৰাম করে তাকে জানানো হল দুঃসংবাদ। এবং কলকাতায় না ফিরে দুজনে সোজা মুসৌরিতে গেল দেবেন্দ্রনাথের কাছে মার্জনা চাইতে।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ক্রোধের কোনও কর্কশ প্রকাশ নেই। দুই অপরাধীকে তিনি বসিয়ে রাখলেন সামনে। তপস্যারত ভঙ্গির মতন কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তিনি আত্মসংযম করলেন। তারপর ধীর স্বরে বললেন, জাহাজ ভাড়া বাবদ অতগুলি টাকা তোমরা জলাঞ্জলি দিলে, সে জন্য তোমাদের কোনও শাস্তি দেব না। তবে, ভবিষ্যতে তোমাদের শিক্ষার জন্য আমার কাছ থেকে আর একটি পয়সাও পাবে না। যথেষ্ট হয়েছে! এবারে তোমরা নিজেরা যা পার করো। ঈশ্বর তোমাদের সহায় হোন!
বাবার কাছে রবি যা বলতে পারেনি, কলকাতায় ফিরে চাপা বিদ্রূপকারীদেরও তা সে মুখ ফুটে বলতে পারল না, এবার সত্যিই ইংল্যন্ড গিয়ে পড়াশুনো করতে চেয়েছিল, সত্যপ্ৰসাদের জন্যই সে ফিরতে বাধ্য হয়েছে। রবির ভদ্রতাবোধ অতি সূক্ষ্ম, সত্যপ্রসাদের নামে দোষ চাপাতে তার রুচিতে বাঁধে। সত্যপ্রসাদ সবার সামনে বেশ বীরত্বের সঙ্গে বলে, আমি আর রবি দুজনেই ঠিক করলুম, ওই স্লেচ্ছদের দেশে স্যান্ডুইচ আর মশলা ছাড়া সেদ্ধ মাংস খেয়ে বছরের পর বছর কাটানো আমাদের সহ্য হবে না। গরম ভাত, মুসুরির ডাল আর মৌরলা মাছ না পেলে কি বাঙালির ছেলে বাঁচে! খুব জোর বেঁচে গেছি বাবা। সত্যপ্ৰসাদ আসল সত্য প্রকাশ করে না, রবি সেখানে উপস্থিত থাকলেও প্রতিবাদ করে না। রবি মিথ্যে কথা বলতে প্রায় অক্ষম, আবার সত্যের বড়াই করে কোনোক্রমেই অন্যকে আঘাত দিতে পারবে না সে। রবি অনেকদিন মাতৃহীন, বড়দিদি সৌদামিনী তার মাতৃসমা, সত্যপ্ৰসাদকে সবাই অভিযুক্ত করলে বড়দিদি দুঃখ পাবেন ভেবেও রবি নীরব থাকে।
এই সময়ে পলায়নই শ্ৰেষ্ঠ পন্থা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর পিতার মতনই এক বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারেন না। শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে কিংবা শহরের বাইরে এক একটি সুরম্য অট্টালিকা ভাড়া নিয়ে কাটিয়ে যান কিছুদিন। কলকাতায় ফিরেই রবি যখন শুনল যে জ্যোতিদাদা ও নতুন বউঠান রয়েছেন চন্দননগরের বাগানবাড়িতে, রবি চলে গেল সেখানে। অবিলম্বেই তার চিত্তশুদ্ধি হল, এই দুজনের সান্নিধ্যেই সে সবসময় পায় প্রকৃত মুক্তির স্বাদ।
দিন কাটছে যেন স্বর্গের এক একটি দিন। প্রতিটি মুহূর্ত এক এক বিন্দু অমৃত। সারাদিন কোনও পরিকল্পনা নেই, কোনও উদ্বেগ নেই। কোনও কর্তব্য নেই, কোনও দায়িত্ব নেই। যখন যা মন চায়, তখনই তা করা যায়। ইচ্ছে করলে বাগানে গিয়ে দোলনায় বসে দোলা যায়, গাছ থেকে ফল পাড়া যায়, নদীতে নৌকা বিহারে যাওয়া যায়, আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিছানায় বুকে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করলেও বাধা দেবে না কেউ।
তিনজনে একসঙ্গে থাকলে গান হয়, গানের পর গান, নতুন নতুন গান। সুরের তরঙ্গই আনন্দের তরঙ্গ। সেই সঙ্গে হাসির উচ্ছলতা। জ্যোতিদাদা জীবনকে উপভোগ করতে জানেন, এক একদিন এক এক রকম পরিবেশ সৃষ্টি করেন। মাঝে মাঝে তাঁকে অবশ্য কাজের জন্য বাইরে যেতে হয়, কলকাতাতেও যেতে হয়, ফিরতে রাত হয়, সেই সব সময়ে নতুন বউঠান আর রবি এই দুজনই দুজনের সঙ্গী, দুজনেরই রয়েছে পরস্পরের জন্য অফুরান গল্প, সময় ওদের হাতের তালু দিয়ে অলক্ষ্যে ঝরে যায় বালির মতন। কাদম্বরী রবির চেয়ে মাত্র বছরের বড়, তিনি এখনও জননী হননি, তিনি অসংসারী নারী, তার শরীর ও মন জুড়ে রয়েছে শিল্পের সুষমা। এই লাজুক দেবরটিকে প্রীতি ও বন্ধুত্ব দিয়ে তিনি সব সময় আপন করে রাখেন আর রবিও তার মন সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিতে পারে শুধু এই নতুন বউঠানেরই কাছে।
বাগানে এসে রবি দেখল জ্যোতিদাদা মাঝিমাল্লাদের কী সব নির্দেশ দিচ্ছেন, রবিকে দেখে বললেন, আয় রবি। ঠিক করেছি আজ রাতটা গঙ্গার বুকে কাটাব। এমন আকাশের রূপ লক্ষ বছরে একদিন হয়।
কাদম্বরী চাপা হাসির সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, কী গো, দুপুর থেকে তুমি ওপরতালায় নিরুদ্দেশ। কটা কবিতা লেখা হল?
রবি বলল, যা লিখেছি, তার থেকে না লিখেছি বেশি। সেই না-লেখা লাইনগুলিই বোধ হয় আসল কবিতা। সেই লাইনগুলি ধরতে পারছি না, কে যেন আড়াল করে দাঁড়াল।
কাদম্বরী বললেন, কে, কে?
ঘাটে বাঁধা বোটটি একটি ছোটখাটো বজরা। মাঝখানে দুটি কক্ষ। ছাদটি চৌকো ধরনের, কেউ যাতে অসাবধানে জলে না পড়ে যায়। সেই জন্য দুদিকে রেলিং দেওয়া। সেই ছাদের ওপর ফরাস পেতে মখমলের তাকিয়া দেওয়া হল। সঙ্গে নেওয়া হল পানীয় জল, কিছু মুখরোচক আহার্য। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কোঁচানো ধুতি ও বেনিয়ান পরে বসলেন ছাদের একদিকে, তার হাতে বেহালা। কাদম্বরী ও রবি তাঁর মুখোমুখি। নৌকো চলতে শুরু করতেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ধরলেন পূরবী রাগিণী। আকাশে এখন সোনার ছড়াছড়ি, যেন মহাকাল মেতেছে স্বর্ণ হোলি খেলায়। সূর্য অদৃশ্য, তবু এত রং, এত বিভা। গঙ্গার দুদিকের গাছপালা ঝাপসা হয়ে এসেছে, শোনা যাচ্ছে দূরের কোনও মন্দিরের টুং-টাং ঘণ্টাধ্বনি, কোনও মসজিদের অস্পষ্ট আজানের সুর।
বাজনা শেষ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, রবি, তুই এবার একটা গান কর।
কাদম্বরী বললেন, ওই গানটা গাও, এ কী সুন্দর শোভা …
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, ওটা তো পূরবী সুর নয়, ইমন ভূপালি-কাওয়ালি
কাদম্বরী বললেন, তা হোক, আমি ওটাই শুনতে চাই
রবি মুখ নিচু করে শুরু করলেন :
এ কী সুন্দর শোভা
কী মুখ হেরি এ…
বোটের তিনজন মাঝিকে একেবারে নীরব থাকার নির্দেশ দেওয়া আছে। শুধু ঝাপ ঝাপ দাঁড়ের শব্দ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পাশে রাখা ফরাসি ব্ৰান্ডির বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে মৃদু মৃদু চুমুক দিচ্ছেন। তারপর তিনিও বেহালায় ধরলেন ইমনের সুর। একসময়ে একটু থেমে তিনি যেই সিগারেট ধরালেন, রবিকে বললেন, তুমি আর একখানি গান ধরো-
এবারে আর কোন গান জিজ্ঞেস করতে হল না, সেই কনে-দেখা আলোয় নতুন বউঠানের দিকে তাকিয়ে সে গেয়ে উঠল, আলাইয়া ঝাঁপতালে, “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা, এ সমুদ্রে আর কভু হবো না পথহারা…।”
জ্যোতিদাদা বললেন, এখন তো সবেমাত্র গোধূলি, এখনও ধ্রুবতারা ওঠেনি।
আকাশে সোনার আভা মিলিয়ে গেল একটু একটু করে, কিন্তু অন্ধকারের পর্দা সব কিছু ঢেকে দেওয়ার আগেই চাঁদ উঠে ছড়িয়ে দিল তরল রুপোর মতন জ্যোৎস্না। ভেসে চলেছে নৌকো, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাজিয়ে চলেছেন একটার পর একটা রাগ-রাগিণী, রবি গান গাইছে সঙ্গে সঙ্গে, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কখনও সেই গানে যোগ দিচ্ছেন কাদম্বরী। স্বর্গে ইন্দ্রের সুরসভা কি এর চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হতে পারে? ভাবে বিভোর তিনজন মানুষ এখন পৃথিবী বিস্মৃতি।
একসময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নীচের এক মাঝিকে বললেন, ওরে, কতদূরে এলি রে? এবার ফের!
কাদম্বরী বললেন, এর মধ্যেই ফেরা হবে? তুমি তো সবে বেহাগ বাজাচ্ছিলে। আমি ভেবেছিলুম, ভৈরবীতে শেষ হবে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হা হা করে হেসে উঠে বললেন, তা হলে ফেরার পথে আর কোনও গান থাকবে না! নৌকোয় আমি ঘুমোতে ভালোবাসি না।
রবি এতক্ষণে জ্যোতিদাদার বেহাগের সুরের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের একটা বেহাগ-খাম্বাজ একতালা গান পেয়েছে। সে গেয়ে উঠলঃ
সখি, ভাবনা কাহারে বলে
সখি যাতনা কাহারে বলে
তোমরা যে বল দিবস-রজনী,
‘ভালোবাসা, ভালোবাসা’…
গানের মাঝখানেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মাথায় নতুন এক খেয়াল চাপিল। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, পলতার কাছাকাছি এসেছি মনে হচ্ছে। আয় রবি, ঝাঁপ দিবি আমার সঙ্গে? তুই-আমি সাঁতরে গিয়ে গুণোদাদার সঙ্গে দেখা করে আসি!
জ্যোতি-রবিদের খুল্লতাত ভাই গুণেন্দ্রনাথ সম্প্রতি পলতায় একটি অতি সুদৃশ্য বাগানবাড়ি কিনে সপরিবারে অবস্থান করছেন। আমোদ ও হৈচৈ পরায়ণ গুণেন্দ্রনাথ সে বাড়িতে প্রায়ই প্রচুর অতিথিদের আমন্ত্রণ করে পার্টি দেন। সেখানে বোট নিয়েই যাওয়া যায়, কিন্তু জোয়ার এসেছে, জ্যোতিরিন্দ্র এই রাত্রিতে জোয়ার-উত্তাল নদী সাঁতরেই পারহতে চান। এর আগেও তিনি কাদম্বরীকে ভীতি-বিহ্বলা করে রবিকে নিয়ে সাতার দিয়ে গঙ্গা পার হয়েছেন।
কাদম্বরী ব্যাকুল হয়ে রবির হাত চেপে ধরে বললেন, না, না, না, তুমি যেতে পারবে না! কিছুতেই যাবে না!
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আবার হাসলেন। তিনি জানতেন, তাঁর স্ত্রী তাঁর বেলায় খুব আপত্তি না করলেও কিছুতেই রবিকে যেতে দেবে না। রবিকে ও এখনও ছেলেমানুষ করে রাখতে চায়!
এক এক রাতে এমন সঙ্গীত ও রঙ্গ-কৌতুকে তৃতীয় প্রহর পার হয়ে যায়, তার পরের দিন অনেক বোলা পর্যন্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী শয্যাত্যাগ করেন না। রাত জাগলেও কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুমোতে পারে না রবি। সে সূর্যোদয়ের একটু পরেই উঠে পড়ে, দাদা-বউদিদের ডাকে না, একলা একলা বাগানে ঘুরে বেড়ায় কিংবা ঘাটে বসে নৌকো চলাচল দেখে। প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি মানুষ এমনকি প্রতিটি বস্তুই তার নতুন মনে হয়। সব কিছুই যেন তাৎপর্যময়। একজন সাধারণ মানুষ খুব মনোযোগ দিয়ে স্নান করার পর গামছা দিয়ে পিঠ রগড়াচ্ছে, অস্ত সূর্যের বিপরীত দিকে উড়ে যাচ্ছে বকের পাঁতি, সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রবির মনে হয়, এই সব দৃশ্যেরও যেন কোনও গূঢ় অর্থ আছে, অথচ সে অর্থটা তার কাছে ধরা পড়ছে না।
কবিতা রচনার সময়েও সে এই সংশয়ে বিমূঢ় বোধ করে।
বিলেতে গিয়ে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জনের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর তাকে প্রায়ই আত্ম অনুসন্ধান করতে হচ্ছে ইদানীং। একটা কিছু তো করতেই হবে, কিন্তু তার কী যোগ্যতা আছে? বাংলা ভাষায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু রচনা করতে তার সবচেয়ে ভালো লাগে, কিন্তু সেটাই কি যথেষ্ট? রমেশ দত্ত, বঙ্কিমবাবু, নবীনসেন এঁরা খ্যাতিমান লেখক বটে, কিন্তু এঁরা কৃতবিদ্য এবং সমাজে অন্যভাবেও প্রতিষ্ঠিত। আর মাইকেল মধুসূদন, নাঃ, ওঁর কথা না তোলাই ভালো, উনি সব দিক দিয়েই ব্যতিক্রম। রবিকে কি তার পিতার পরিচয়েই পরিচিত হতে হবে?
বাল্যকাল থেকেই সে কবিতা লিখছে। আত্বীয়বন্ধুরা তাঁর কবিতার বই ছাপিয়ে দেয়, কুড়ি বছর বয়েসেই সে তিন-চারখানি গ্রন্থের গ্রন্থাকার। দু দশ কপির বেশি বিক্রি হয় না অবশ্য। মহৎ সাহিত্য যে তাৎক্ষনিক জনপ্রিয়তা পায় না তাও রবি জানে। কবিত্বশক্তি নিয়ে তার নিজের বেশ একটা আত্মশ্লাঘা ছিল, কিন্তু অতি সম্প্রতি তার মনে একটা দ্বিধা দেখা দিয়েছে। দাদারা এবং পারিবারিক শুভার্থীরা স্নেহের বশে উচ্ছসিত হয়ে সে যা লেখে তারই প্রশংসা করেন, কিছু কিছু অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েরা শুধু তার কবিতা নয়, তার সাজপোশাকেরও অনুকরণ শুরু করেছে বটে, কিন্তু প্ৰকৃত শিক্ষিত বোদ্ধারা কী বলেন?
রবি সন্দেহাতীত ভাবে একজন ভালো গায়ক। নিজের পারিবারিক গণ্ডী, আদি ব্ৰাহ্মসমাজের ছোট বৃত্ত ছাড়িয়ে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতার বৃহত্তম প্রাঙ্গণে। বিশেষত বিলেত থেকে ফেরার পর তার কণ্ঠে সুরের সঙ্গে মিশেছে দার্ঢ্য। ছেলেবেলায় সে যদু ভট্টের কাছ থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিয়েছিল, ব্ৰাহ্ম সমাজের বাধা গায়ক বিষ্ণু চক্ৰবর্তীর কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছে, জ্যোতিদাদার পিয়ানো বাজনার সঙ্গে গলা মিলিয়েছে, তারপর ইংল্যান্ডে গিয়ে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মৰ্মে প্রবেশ করেছে খানিকটা। সব মিলিয়ে তার সঙ্গীত জ্ঞান সমৃদ্ধ কণ্ঠস্বরেও এসেছে নিজস্বতা। সবাই তাকে এখন গান শোনাবার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু রবি কি পেশাদার গায়ক হতে চায়?
অভিনেতা হিসেবেও সে এর মধ্যেই অনেকটা সার্থক। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যে-কোনও নাট্য-উৎসবে রবির অনিবাৰ্য ভূমিকা, কলকাতার বিদ্বজ্জনেরা সে সব দেখতে আসেন। রেভারেন্ড কেষ্ট বাডুজ্যে বাল্মীকি প্রতিভায় রবির গান ও অভিনয় দেখেশুনে রবিকে অ্যাখ্যা দিয়েছিল, ‘বাল্মীকি কোকিল’! কিন্তু রবি তো নেহাত অভিনেতাও হতে চায় না। তার প্রধান ভালোবাসা যে কবিতা!
বস্তুত, কবি হিসেবে রবি এ পর্যন্ত তেমন কোনও অসাধারণত্বের প্রমাণ দিতে পারেনি। সে অনবরত কবিতা লিখে যেতে পারে, ছন্দ মিল আসে সাবলীলভাবে, কিন্তু কিছুতেই গভীরতা আসে না। তার শব্দগুলো এলিয়ে পড়া, ছাড়া ছাড়া, অস্পষ্ট। বিশুদ্ধ আবেগের বদলে ফুটে ওঠে উচ্ছ্বাস, বিষণ্ণতার বদলে হা-হুতাশ নয়। রবি কবিতা লিখতে গেলেই যেন হয়ে যায় ছন্দোবদ্ধ ব্যক্তিগত ডায়েরি কিংবা চিঠি, তাতে সার্বজনীনতার স্পর্শ লাগে না। রবি এখন তা বুঝতে পারছে, কিন্তু কী করে এর থেকে উত্তরণ ঘটানো যায়?
‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর কেউই বিশেষ ভালো কথা বলেনি। রবি ভাবছে, এই বইটির প্রচার বন্ধ করে দেবে। যাঁর মতামতকে রবি বিশেষ শ্ৰদ্ধা করে, সেই প্রিয়নাথ সেন বইখানি পড়ে রবিকে প্রায় ভৎসনাই করেছেন বলতে গেলে। বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রতিবেশী এই প্রিয়নাথ সেনের সঙ্গে রবির পরিচয় হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। এই মানুষটির জ্ঞানের পরিধি দেখে রবি একেবারে মুগ্ধ। প্রিয়নাথ যেন সাহিত্যের সাত সমুদ্রের নাবিক। তিনি পৃথিবীর সব কটি প্রধান ভাষার সাহিত্যের স্বাদ গ্ৰহণ করেছেন, রবির সঙ্গে তাঁর প্রীতির সম্পর্ক, রবি তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছে। প্রিয়নাথ নিজে কবি হতে চান না। তাই রবির প্রতি তার ঈর্ষা থাকারও কোনও কারণ নেই। ভগ্নহৃদয় পড়ে তিনি ভ্ৰকুঞ্চিত করে বলেছেন, এ সব কী লিখেছি হে, রবীন্দ্র? এ যে নিছক মেয়েলি ছড়ার মতন, এতে কোনও উচ্চাঙ্গের ভাব নেই, রস নেই। ভাষা এত দুর্বল! “এ পারে দাঁড়ায়ে, দেবী, গাহিনু যে শেষ গান/তোমারই মনের ছায় সে গান আশ্রয় চায়- / একটি নয়নজল তাহারে করিও দান…”। যাত্রা দলের ছোঁড়ারা এমন প্যানপ্যানানি গান গায়। ‘একটি নয়নজল’ আবার কী? তারপর এই যে লিখেছে, “বিষণ্ণ অধর দুটি অতি ধীরে ধীরে টুটি/ অতি ধীরে ধীরে ফুটে হাসির কিরণ …”। অধর আবার দুটো হয় কি করে? ওপরেরটি ওষ্ঠ, নীচেরটি অধর। তাও না হয় হল। অধর আবার টুটিবে কী করে? অধরের কথা লিখতে গিয়ে ভাষা কি মাথামুণ্ডও খোয়াবে? পরপর দু লাইনে “অতি ধীরে ধীরে” কোনও ভালো কবি লিখবে না!
পরিবারের সবাই সব সময় প্রশংসা করে রবিকে উৎসাহিত করেন বটে, শুধু একজন ব্যতিক্রম। যাঁর উদ্দেশ্যে রবির অধিকাংশ কবিতা লেখা, তিনিই রবির প্রধান সমালোচক। নতুন বউঠান। রবির সব কবিতা তিনি প্রথম পাঠ করবেনই, রবি দেখাতে না চাইলেও জোর করে খাতা কেড়ে নেবেন। কিন্তু পড়তে পড়তে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কৌতুক হাস্যে বলেন, যাই বল, তুমি এখনও উঁচুদরের কবি হতে পারোনি, বিহারীলালের মতন তুমি লিখতে পার না? তোমার গানগুলি বেশ হয় বটে, কিন্তু কাব্যে বিহারীবাবু সেরা!
কাদম্বরী বেশ ভালোই জানেন, কোন কথা তাঁর এই দেবরটির মনে বেশি জ্বালা ধরাবে। কোনও কবিই অন্যের সঙ্গে তুলনা সহ্য করতে পারে না। এই কথা শুনলে রবি পুরনো কবিতা ছিঁড়ে ফেলে আবার নতুন করে লিখতে বসে। বিহারীলালকে ছাড়িয়ে যেতেই হবে, নতুন বউঠানের কাছে সে-ই হবে একমাত্র কবি। কিন্তু পারা যাচ্ছে না কেন? মাঝখানে রবি বিহারীলাল চক্রবর্তীকে অনুসরণ করারও চেষ্টা করেছিল। ‘বাল্মীকি প্ৰতিভা’ তো বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গল’-এর আদলেই রচিত, তাতে অনেক লাইনও ঢুকে গেছে। নাঃ, ও ভাবে হবে না, ও ভাবে হবে না!
রবি এর মধ্যে সত্যিকারের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে গদ্য রচনায়। সতেরো-আঠেরো বছর বয়েসে সে যেমন পরিচ্ছন্ন, নির্মেঘ, ধারালো গদ্য লিখেছে, তার তুলনা বাংলায় তো দূরের কথা ভূভারতে নেই। এমনকি সারা পৃথিবীতেই বা তার বয়সী এমন অবিশ্রান্ত গদ্য লেখক আর কে আছে? তার গদ্যে রয়েছে যুক্তি, কৌতুক, শ্লেষ ; নেই অকারণ উপমার বাহুল্য, নেই অনর্থক তৎসম শব্দ ঝঙ্কারের প্রতি মোহ। যারা রবিকে শুধু স্কুল-পালানো ছেলে মনে করে, তারা জানে না নিজস্ব পড়াশুনোর বিস্তার কতখানি। তার প্রবন্ধের বিষয়, বিয়াত্ৰিচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য, নর্মান জাতি ও অ্যাঙ্গলোসাহিত্য, নিন্দাতত্ত্ব, নিঃস্বাৰ্থ প্রেম, বস্তুগত ও ভাবগত কবিতা, সঙ্গীত ও ভাব, চীনে মরণের ব্যবসায়, গোলাম চোর, গেটে ও তাঁহার প্রণয়িনীগণ ইত্যাদি। এ ছাড়া ‘য়ুরোপ যাত্রী কোন বঙ্গীয় যুবকের পত্র’ নামে ধারাবাহিকভাবে যেগুলি সে তাতে ভারতীয় ও ইংরেজ সমাজের খুঁটিনাটি তুলনা, অল্প আঁচড়ে এক একটি চরিত্রকে জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তোলা ও অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় আছে। কিন্তু পরিহাস এই যে, গদ্য লেখক হিসেবে রবির কোনও সুনাম হয়নি, ‘ভারতী’তে কোনও রচনাতেই লেখকের নাম থাকে না। রবির কয়েকখানি কবিতার বই প্রকাশিত হয়ে গেছে, অনেকেই ঠাকুরবাড়ির এই ছোট ছেলেটিকে কবি হিসেবে চিনেছে, কিন্তু ভারতীয় ওই তীক্ষ্ণ গদ্য রচনাগুলি কে লিখছে কে জানে!
তা ছাড়া, গদ্য তেমন গুরুত্বও পায় না। অনেকের কাছেই এখনও কবিতাই প্রকৃত সাহিত্য, গদ্য-টদ্য খবরের কাগুজে ব্যাপার। হ্যাঁ, বঙ্কিমবাবু মহাকাব্যের বদলে গদ্য-আখ্যায়িকা লিখছেন বটে, সেগুলি বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে, মেয়েরা খুব পড়ে, তা বলে বঙ্কিম তো ভারতচন্দ্র কিংবা চণ্ডীদাসের চেয়ে বড় নন।
বিলেত ঘুরে এসে, পশ্চিমী সাহিত্যের সাম্প্রতিক ধারার সঙ্গে খানিকটা পরিচিত হয়ে রবি বুঝতে পেরেছে ভবিষ্যতে গদ্যেরই যুগ আসছে। ক্রমশ নাটক-নভেলই কবিতার ওপর আধিপত্য করবে। লম্বা লম্বা পদ্যে লেখা মহাকাব্য আর কেউ পড়তে চাইবে না। বঙ্কিমবাবুও পদ্য ছেড়ে গদ্যে এসেছেন, তিনি ঠিক পথই ধরেছেন। গদ্য লেখার জন্য বঙ্কিমের কী অহংকার, রবি দু একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, বঙ্কিমবাবু পাত্তাই দেননি। প্রকাশ্যে তিনি রবির পিঠ চাপড়ান বটে, সেটা যেন খানিকটা করুণা, বাড়িতে গেলে কথাই বলতে চান না। বঙ্কিমের ওপর টেক্কা দিতে গেলে রবিকেও উপন্যাস লিখতে হবে। চন্দননগরে এসে সে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছে। ঐতিহাসিক উপন্যাসেই বঙ্কিমের প্রধান খ্যাতি, রবিও বেছে নিয়েছে ঐতিহাসিক পটভূমিকা। নাম দিয়েছে ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’। কবিতার মতন, এই গদ্য রচনার সময়ও নতুন বউঠানের ছায়া তার সামনে এসে দাঁড়ায়। এখানে লিখতে লিখতে আর একটা উপন্যাসের প্লটও তার মাথায় এসেছে। এক রহস্যময়ী রমণীকে ঘিরে দুজন পুরুষের প্রণয় দ্বন্দ্ব। তবে এই বিষয়টা নিয়ে এখুনি লেখা ঠিক হবে কি না সে বিষয়ে সে মনঃস্থির করতে পারছে না।
সকালবেলা বাগানে প্রাতরাশ খেতে খেতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, ও রবি, তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। কাল বিকেলে একজন লোক একটি পত্র নিয়ে এসেছিল। ত্রিপুরার রাজ দরবারের দুজন দূত তোর সঙ্গে দেখা করতে চায়।
রবি চমকে উঠে বলল, কেন?
একটু দূরের চেয়ারে বসে কুরুশ কাঠি দিয়ে একটি পশমের আসন বুনছেন কাদম্বরী, তার মাঝখানে দু একটি অক্ষর ফুটে উঠেছে। আসনটি কার জন্য বোনা হচ্ছে তা তিনি বলবেন না কিছুতেই। বোনা থামিয়ে তিনি কৌতূহলী হয়ে তাকালেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, কেন, তা আমি কী করে জানব। শুনেছি, ত্রিপুরার রাজারা কলকাতা থেকে মাস্টার ধরে নিয়ে যায়। তোকেও মাস্টার ঠাউরেছে নাকি? তোর তা হলে একটা হিল্লে হয়ে যাবে।
কাদম্বরী ফিক করে হেসে বললেন, রবি হবে মাস্টার?
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ত্রিপুরায় এখনকার রাজার নাম কী যেন? বীরচাঁদ না ভীরুচাঁদ, না না, ওরা মাণিক্য হয়। বীরুমাণিক্য, ওই রাজার শখ নবরত্ব সভা বসাবার। আমাদের যদু ভট্টকেও তো ওখানে নিয়ে গেছে। তোকেও বোধ করি সভাকবি হিসেবে পাকড়ে নিয়ে যাবে।
রবি বলল, জ্যোতিদাদা, আমি ওদের সঙ্গে দেখা করতে চাই না।
কাদম্বরী বললেন, কেন, যাও না ত্রিপুরায়। তুমি বেশ রাজকবি হবে। কত সম্মান হবে। আমরা ত্রিপুরায় বেড়াতে যাব।
রবির মুখে বেদনার রেখা ফুটিল, সে এক দৃষ্টিতে নতুন বউঠানের দিকে চেয়ে রইল।
জ্যোতিদাদা বললেন, দেখা করবি না। কী রে, আমি যে আসতে বলে দিয়েছি। এখুনি এসে পড়বে। কী বলতে চায় শুনেই দেখ না। এই সব নেটিভ স্টেটের রাজারা এক একটি উৎকট জীব হয়। এদের কতরকম উদ্ভট খেয়ালের কথা যে শুনেছি! কেউ কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করে, কেউ পাঁচ সাতশো বিয়ে করে। মানডুর সুলতান গিয়াসুদ্দিন, তার হারেমে নাকি ছিল পনেরো হাজার নারী। তার দেহরক্ষীরাও নারী, সিংহাসন ঘিরে থাকত নারীরা, সে ব্যাটা সৰ্বক্ষণ স্ত্রীলোক ছাড়া কোনও পুরুষকে দেখতই না! আর একজন রাজার ছখানা পরোটা ভাজার জন্য তিরিশ সেরা ঘি খরচ হতো। এদের তো ডিফেন্স বাজেট নেই, সৈন্য নিয়ে কারুর সঙ্গে লড়তে হয় না, তাই টাকা পয়সা নিয়ে নয়-ছয় করে। দেখ এই ত্রিপুরার বীরুমাণিক্যের কোন বাই চেপেছে!
কাদম্বরী বললেন, বাইরের লোক আসবে, আমি ভেতরে যাই।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, ওঁরা তো রাজার দূত। মেজবৌদি লাটসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তুমি এক রাজার দূতদের সামনে থাকতে পারবে না কেন?
কাদম্বরী তাঁর কণ্ঠস্বরের অপ্ৰসন্নতা অনেকটা ঢেকে বললেন, তোমার মেজবৌদি যা যা পারেন, তার সব কি আমি পারি?
কাদম্বরী থাকলেন না। চলে গেলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রবিকে বললেন, সেবারে কী মজা হয়েছিল জানিস তো? লাটসাহেব কলকাতায় অনেককে ডেকেছেন, মেজদা মেজবৌদিকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর তো কেউ বউদের নিয়ে যায় না। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পাথুরেঘাটার প্রসন্ন ঠাকুর, উনিতো আমাদের জ্ঞাতি, প্রথমে মেজবৌদিকে দেখে ভেবেছিলেন বেগম সেকেন্দার। ভূপালের ওই বেগম পুরুষ সেজে থাকেন, পুরুষের মতন দরবারে বসেন। তারপর প্রসন্ন ঠাকুর যে-ই চিনতে পারলেন যে বেগম নয়, উনি ঠাকুরবাড়ির বউ, অমনি রেগেমেগে উঠে গেলেন সেখানে থেকে।
রবি বলল, বেগম সেকেন্দার তাঁর মেয়ের নাম দিয়েছেন শাহজাহান, তাই না?
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, হ্যাঁ, খুব তেজী মহিলা। মুসলমান হয়েও পর্দা-ফর্দি ছিঁড়ে ফেলেছে।
একটু পরেই এসে পড়লেন রাধারমণ ও শশিভূষণ। সঙ্গে একজন ভৃত্যের হাতে উপহার দ্রব্যের একটি ডালি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ওঁদের বৈঠকখানা ঘরে এনে বসালেন।
রাধারমণ বললেন, আমরা রবীন্দ্ৰবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, এই তো আমার ছোট ভাই রবি।
রাধারমণ ও শশিভূষণ দুজনেই বিস্মিতভাবে চেয়ে রইলেন। এই সদ্য যুবকটির চোখে-মুখে এখনও লেগে রয়েছে কৈশোরের লাবণ্য। তার দৃষ্টি সলজ্জ।
রাধারমণ আবার জিজ্ঞেস করলেন, ইনিই ভগ্নহৃদয়’ কাব্যটি লিখেছেন?
জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ বললেন, বিলক্ষণ। রবির আরও বই বেরিয়েছে।
রাধারমণ এবারে গদগদভাবে বললেন, হে কবি, আপনাকে আমাদের শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। ত্রিপুরার মহামান্য মহারাজ শ্ৰীল শ্ৰীযুক্ত বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য আপনার কাব্যখানি পড়ে মোহিত হয়েছেন। তিনি আপনাকে একটি মানপত্র পাঠিয়েছেন, আর সামান্য কিছু প্রীতির নিদর্শন।
জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ উৎসাহের সঙ্গে বললেন, বাঃ, এতো খুব ভালো কথা। শ্রীমান রবির খ্যাতি অনেক দূর ছড়িয়ে গেছে দেখছি!
মানপত্ৰখানি রাধারমণেরই রচনা। তিনি সেটি পাঠ করে শোনালেন। তারপর সবিস্তারে বলতে লাগলেন, নিদারুণ শোকগ্ৰস্ত অবস্থায় কীভাবে মহারাজ এই কাব্যগ্রন্থটি আবিষ্কার করেন, এর কবিতাগুলি থেকে তিনি কতখানি সান্ত্বনা পেয়েছেন। মহারাজ স্বয়ং একজন কবি, তিনি কবিতার মর্ম বোঝেন।
শুনতে শুনতে রবি সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে খানিকটা গৰ্বও বোধ করছে ঠিকই। ‘ভগ্নহৃদয়’-এর কবিতাগুলি তা হলে একেবারে ব্যর্থ নয়। একজন মানুষকে শোকে সান্ত্বনা দিতে পারে। যে সে মানুষ নয়, একজন মহারাজ এবং কবিতার সমঝদার।
শশিভূষণ অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার বললেন, রবীন্দ্ৰবাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? কিছুকাল আগে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল একটি সন্দর্ভ, জুতা ব্যবস্থা, সেটি কি আপনার রচনা?
রবি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
শশিভূষণ বললেন, আমি ঠিক ধরেছি। আপনি যে ‘য়ুরোপ যাত্রী বঙ্গীয় যুবকের পত্র’ লিখতেন, নাম না থাকলেও আপনার লেখা বলে চেনা যায়। তার সঙ্গে এই রচনাটির ভাষায় খুব মিল আছে। এই লেখাটি পড়েই আমি আপনার বিশেষ অনুরাগী হয়েছি।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘জুতা ব্যবস্থা’ কোন লেখাটা রে?
শশিভূষণ-হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে তুলে বললেন, মশাই, সে লেখাটির মধ্যে বারুদ ঠাসা আছে। ইংরেজরা আমাদের যখন তখন অপমান করে, কেউ তা প্রতিবাদ করে না। ওই যে ট্যাঁস ফিরিঙ্গিদের একটা কাগজ আছে, ইংলিশম্যান সে কাগজে পর্যন্ত।
রবি এবার ধীর স্বরে দাদার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি পড়েছ লেখাটা। ইংলিশম্যান কাগজ একবার লিখেছিল, ভারতীয়দের সঙ্গে কথা বলার আগে একবার লাথি মারতে হয়। Kick them and then speak to them. Age lat pechoo bat. আমি তার উত্তরে
শশিভূষণ বললেন, মুখের মতন জবাব দিয়েছিলেন। হিন্দু পেট্রিয়ট কাগজও প্রতিবাদ করেছিল বটে, কিন্তু তেমন জোরালো নয়। আপনি বাঙালি জাতটাকেও বলেছেন, আর কতকাল জুতো খাবে? Perfect piece of political writing! ওই লেখাটির জন্য বিশেষ করে অভিনন্দন জানাচ্ছি। ওই রকম আরও লিখুন।
রাধারমণ ঈষৎ অসহিষ্ণুভাবে বললেন, শশী, এবার আমাদের উঠতে হবে।
এর মধ্যে জলখাবার এসে গিয়েছিল। আর একটুক্ষণ ভদ্রতা বাক্যের বিনিময়ের পর ওঁরা দুজন বিদায় নিলেন। দুই ভাই ওঁদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসার পর জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ বললেন, কী দিয়েছে দেখি!
পুঁটলিটা খুলে দেখা গেল, তার মধ্যে আছে একটি শাল, এক জোড়া ধুতি, একটি উত্তরীয়, হাতির দাঁতের তৈরি দুটি পুতুল এবং একটি ছোট্ট মখমলের তোড়ায় পাঁচটি মোহর।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, তেমন কিছু রাজকীয় বলা যায় না, তবু মন্দ নয়। কিন্তু রবি, তোর রাজকীয় চাকরিটা হল না। মহারাজের কাছে অ্যাপ্লাই করে দেখলে পারিস।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথকেও এবার বেরুতে হবে। তিনি গাড়ি জুততে বলে পোশাক বদলাতে গেলেন। রবি কাদম্বরীকে খুঁজল, কাছাকাছি কোথাও দেখতে পেল না। জ্যোতিদাদা চলে যাওয়ার পর তাঁর শয়নকক্ষে উঁকি মারল, সেখানেও নেই। দু চারবার ডেকেও সাড়া পাওয়া গেল না। তখন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বাগানে ঘুরতে লাগল।
কাদম্বরী একটি কাঁঠাল গাছে ঠেস দিয়ে গঙ্গার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। শূন্য উদাস দৃষ্টি।
রবি কাছাকাছি গিয়ে ডাকল, নতুন বউঠান!
কাদম্বরী মুখ ফেরালেন, কোনও কথা বললেন না। রবি ভেবেছিল, বাইরের লোকদুটি চলে যাওয়ামাত্রই কাদম্বরী এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কথা জিজ্ঞেস করবেন, মানপত্র ও উপহার দ্রব্যগুলি দেখবেন, রবির সঙ্গে খুনসুটি করবেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে কাদম্বরীর কোনও আগ্রহই নেই।
রবি বলল, ত্রিপুরার মহারাজ আমার ‘ভগ্নহৃদয়’ বইটি খুব পছন্দ করেছেন। ওরা অনেক ভালো ভালো কথা বলে গেলেন। তুমি খুশি হওনি?
কাদম্বরী আবেগহীন শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, কেন খুশি হব না ভাই। তোমার মান বাড়লে আমাদের সকলেই আনন্দ হয়।
রবি বলল, ‘ভগ্নহৃদয়’ বইখানি তো তোমারই। এ সম্মানও তোমার।
কাদম্বরী বললেন, আমার না ছাই!
রবি বলল, ওরা কী সব জিনিসপত্র দিয়ে গেল, তুমি দেখবে না?
কাদম্বরী কয়েক পা এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, দেখবনে পরে।
রবি বলল, তোমার কী হয়েছে বলো তো? মন খারাপ?
কাদম্বরী একটা ঝোপ পেরিয়ে গিয়ে বড় একটি আমগাছের দালে টাঙ্গানো দোলনায় বসলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, নাঃ কিছু হয়নি।
দূরে দাঁড়িয়ে রবি প্রচ্ছন্ন অভিমানের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, তুমি তখন আমাকে ত্রিপুরায় চলে যেতে বললে কেন? তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিতে চাও?
কাদম্বরী বললেন, আমি দূরে ঠেলে দেব কেন? তুমি নিজেই চলে যাবে। দিন দিন তোমার যশ হবে, তোমার কর্মক্ষেত্র বাড়বে, অনেক মানুষ তোমাকে চাইবে, তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। তুমি যত বিখ্যাত হবে, তত তুমি সর্বসাধারণের হয়ে যাবে, আমরা ছোট গণ্ডির মধ্যে তোমাকে ধরে রাখতে যাব কেন?
রবি বলল, তোমাকে ছেড়ে আমি কোনদিন কোথাও যাব না তা তুমি নিশ্চিত জান।
কাদম্বরী বললেন, না রবি তা হয় না। তোমার কবিতা আর আমাকে প্রথম শোনার সময় তুমি পাবে না। আমি তো নগণ্য।
রবি বলল, নতুন বউঠান তুম এমন কথা আমাকে বল না, বল না! তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও থাকতে পারি না। তুমি আমার সব!
কাদম্বরী বললেন, তুমি বিলেতে চলে গিয়েছিলে। তোমার নতুন দাদাও খুব ব্যস্ত, তাঁর কত কাজ, আমার কাছে আসার সময় পান না, আমি দিনের পর দিন একা আর একা, জোড়াসাঁকোর বাড়ির তেতলার ঘরে একা, বন্দিনীর মতন, কেউ নেই, তুমি সৰ্বক্ষণ থাকতে পাশে, তুমিও ছিলে না গত বছর।
রবি বলল, বিলেতে আমিও তো একা, সৰ্বক্ষণ তোমার কথাই ভেবেছি। আমার সব লেখা তোমারই উদ্দেশ্যে তা তুমি জান না? ‘ভারতী’তে যে চিঠিগুলি ছাপা হয়েছে সেগুলো তো আসলে তোমাকেই লেখা চিঠি। ‘ভগ্নহৃদয়ের’ সব কবিতা তো তোমারই জন্য।
কাদম্বরী বাহুতে মুখ গুঁজে একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর হঠাৎ মেজাজ পরিবর্তন করে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তোমাকে বলা হয়নি, তুমি ‘ভগ্নহৃদয়’-এর উপহারে শুধু শ্ৰীমতী হে-কে লিখেছ কেন?
রবি বলল, শুধু তোমার জন্য।
কাদম্বরী বললেন, ওরকম কেউ লেখে?
রবি বলল, আর কেউ বুঝবে না। শুধু তুমি আর আমি বুঝব। তুমিই হেমাঙ্গিনী, তুমিই হেকেটি। এই লেখাগুলি তুমি আর আমি একরকম পড়ব, অন্যরা আর একরকম পড়বে।
কাদম্বরী খানিকটা ভৎসনার সুরে বললেন, আহা, কী বুদ্ধি! অলীকবাবু নাটকে তুমি অলীক আর আমি হেমাঙ্গিনী সেজেছিলুম, তা বুঝি অন্যরা জানে না? তুমি যে আমায় কখনও কখনও হেকেটি বলে ডাক, তাও অন্যেরা জানে!
রবি বলল, জানুক গিয়ে! যে যা খুশি বুঝুক। আমার ইচ্ছে হয়েছে। অমন লিখেছি! কাদম্বরী বললেন ভ্রুভঙ্গি করে বললেন, আ-হা-হা-হা! বাবুর ইচ্ছে হয়েছে বলে।
কাদম্বরীর মেজাজ পরিবর্তনে রবি খুশি হয়ে উঠল। সে বলল, তুমি একটু বসো, নতুন বউঠান, আমি এখুনি আসছি।
সে দৌড়ে চলে গেল বৈঠকখানা ঘরে। উপহারের পুঁটুলিটা নিয়ে ফিরে এল। কাদম্বরী তখন দোলনাটায় একটু একটু দুলছেন আর মৃদু স্বরে গান গাইছেন।
দোলনাটা থামিয়ে দিয়ে রবি কাদম্বরীর পায়ের কাছে বসল। মোহরের তোড়াটি ছোঁয়াল কাদম্বরীর পায়ে। হাতির দাঁতের পুতুল দুটি তাঁর কোলের ওপর ফেলে দিয়ে রবি বলল, এই নাও, দেবী, এ সবই তোমার। আমার যা কিছু আছে, সবই তোমার।
কাদম্বরী কিছু দেখলেনই না। মুখটা ঝুঁকিয়ে এনে বললেন, আমার কিছুই চাই না। ভানু, তুমি শুধু আমাকে একটা গান শোনাও—
এইভাবেই কাটতে লাগল দিন। জ্যোতিদাদাকে প্রায়ই কলকাতায় যাতায়াত করতে হয়। তিনি একটি নতুন ব্যবসায়ের পরিকল্পনায় মেতেছেন। নানাবিধ লোকসানের ব্যবসায়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের খুব উৎসাহী। তিনি সকালবেলা চলে যান, সন্ধের আগে ফিরতে পারেন না। সারা দিনমান নতুন বউঠানের সঙ্গী শুধু রবি, তার কখনও গল্প করে মুখোমুখি বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনও ছুটোছুটি করে বাগানে। কখনও গলা মিলিয়ে গান করে, কখনও গাছ থেকে ফল পাড়ে, কখনও ঘাটের সিঁড়িতে বসে থাকে জলে পা ডুবিয়ে। নতুন বউঠান যখন বনের মধ্যে ঝুলনায় দোলেন, রবি তখন গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল তুলে এনে ফুলডোরে সেটাকে সাজিয়ে দেয়। যখন তারা গান করে না, গল্প করে না, তখন তারা চুপ করে পরস্পরের দিকে চেয়ে শুধু বসে থাকে, সেই নৈঃশব্দ্যও অনেক বাঙ্ময়।
সন্ধেবেলা অন্ধকার নদীতে ছলচ্ছল শব্দ হয়। চলন্ত নৌকোগুলিতে দেখা যায় বিন্দু বিন্দু আলো, যে আলোটি খুব কাছে এগিয়ে আসে সেদিকে উৎসুকভাবে তাকিয়ে থাকে ওরা দুজন। এই বুঝি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ফিরে এলেন। ইদানীং তিনি বোটে যাওয়া-আসা করছেন। কিন্তু প্রত্যাশা পূর্ণ হয় না, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রায়ই দেরি হয়।
চন্দননগরের এই বাড়িতে আসা হয়েছিল শীতের শুরুতে, ক্রমে বসন্ত ও গ্ৰীষ্ম পেরিয়ে গেল। আকাশে জমছে মেঘ, সেই মেয়ের রং গাঢ় হচ্ছে, বর্ষা আসন্ন। নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া ফুলের মতন এক একটি দিন। রবি ও নতুন বউঠান পরম্পরকে এত নিবিড়ভাবে কাছাকাছি আগে কখনও পায়নি। দুজনের জন্য শুধু দুজন। এক একদিন দমকা হাওয়ায় সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়, চতুর্দিকে প্রকৃতির আঁচল ওড়ে, বাড়ির সন্নিহিত জঙ্গলটিতে একটি আবরণ তৈরি হয়ে যায়, মনে হয় এই পৃথিবীতে এই জঙ্গল ছাড়া আর কিছু নেই, তখন তার মধ্যে হাত ধরাধরি করে ছোটে দুটি বিশুদ্ধ যুবক-যুবতী তাদের বুক কাঁপে বস্ত্রপাতের শব্দে, তবু কি মধুৰ সেই ভয়, গাছের পাতাগুলি ঝিলিমিলি শব্দে যোগ দেয় তাদের হাসির উচ্ছলতায়।
একদিন একটা বিপর্যয় হল। সেদিন সকাল থেকে রবি লেখা নিয়ে মগ্ন। উপন্যাসটিতে বেশ মন বসেছে, একটানা সাত পাতা লেখার পর থেমে দুটি কবিতা লিখে ফেলল। এখন তাকে বিদ্যাপতিতে পেয়ে বসেছে, বিদ্যাপতি নতুন বউঠানরও খুব প্রিয়। তিনি নিরালায় রবিকে ভানু নামে ডাকেন, রবি ভানুসিংহ ছদ্মনামে ব্ৰজবুলিতে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলেছে। সেরকম দুটি কবিতা শেষ করে সে আবার উপন্যাসে মনোনিবেশ করল।
একসময় তার মনে হল যে তার বেশ খিদে পেয়েছে। বেলা কত হল কে জানে? কেউ তাকে খেতে ডাকেনি কেন? তারপরেই খেয়াল হল ওঃ, আজ তো সেই পিকনিক হবার কথা। এরকম আগেও হয়েছে কয়েকবার। জ্যোতিদাদার খুব বনভোজনের শখ। আজ জঙ্গলের মধ্যে একটা বকুল গাছের তলায় নতুন বউঠান রান্না করবেন, জ্যোতিদাদা আর রবি তাঁকে গানবাজনা শোনাবে। মশলা না দিয়ে শুধু সঙ্গীত সহযোগে পঞ্চ ব্যঞ্জনের কেমন স্বাদ হয়, তার পরীক্ষা। রবি ভুলেই গিয়েছিল জ্যোতিদাদার নিশ্চয়ই ওখানে বসে আছেন। রবিকে ডেকে পাঠাননি কেন?
কাগজপত্র এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে রবি ছুটে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। জঙ্গলের মধ্যে নির্দিষ্ট জায়গাটিতে গিয়ে সে আরও অবাক হল। উনুন সাজানো আছে কিন্তু আগুন ধরেনি, রান্নার সরঞ্জাম ও দ্রব্য পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা হয়েছে কিন্তু ছোঁওয়া হয়নি কিছুই, একটা মোড়ায় পাথরের মূর্তির মতন বসে আছেন কাদম্বরী, জ্যোতিদাদার কোনও চিহ্ন নেই।
রবি ঝাপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে হাত জোড় করে বলল, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো নতুন বউঠান, আমি ভুলে গিয়েছিলাম, আমাকে তুমি একটিবারটি ডাকলে না? আমি লেখা নিয়ে ডুবে ছিলাম।
কাদম্বরী যেন রবির কথা শুনতেই পেলেন না।
রবি জিজ্ঞেস করল, জ্যোতিদাদা কোথায়?
এবারও কোন উত্তর নেই।
রবি বলল, দাঁড়াও আমি এক্ষুনি জ্যোতিদাদাকে ডেকে আনছি।
সে আবার ছুটে গেল বাড়িতে। ভৃত্যদের কাছ থেকে খবর নিয়ে জানল যে জ্যোতিদাদা বেরিয়ে গেছেন ভোরবেলা, কখন ফিরবেন ঠিক নেই।
রবি এবার ভয় পেয়ে গেল। নতুন বউঠানের অভিমান অতি সাঙ্ঘাতিক। এই অভিমানে তিনি চ্যাঁচামেচি করেন না, কাঁদেন না, তীব্ৰ বিষাদে মগ্ন হয়ে যান, সেই সময় তিনি কথা বলতে চান না কিছুতেই। কিছুদিন আগে এই রকম এক সময় নতুন বউঠান আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। আজ রবি নিজেও দোষ করেছে।
আবার ফিরে গিয়ে রবি নতুন বউঠানের মান ভাঙবার জন্য কাকুতি-মিনতি করতে লাগল। পা দুখানি জড়িয়ে ধরে টেনে নিল নিজের বুকে। কাদম্বরী তাতেও মুখ খুললেন না। পা ছাড়িয়ে নিয়ে তিনি দৌড় দিলেন জঙ্গলের দিকে। রবি গোল পেছন পেছন, কাদম্বরী কিছুতে ধরা দেবেন না।
আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে, গম্ভীর গুরু গুরু শব্দে ডাকছে বাজ, হঠাৎ এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চিরে ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। তার পরেই উঠিল ঝড়, প্রবল ঝড়। মড়মড়িয়ে উঠল গাছপালা, গঙ্গায় জল উত্তাল। রবি নতুন বউঠানের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, ঘরে চলো, ঘরে চলো, এ সময় গাছতলায় দাঁড়ানো বিপজ্জনক।
কাদম্বরী প্রবলভাবে মাথা নাড়ছেন। যেন তাঁর আর ঘর নেই, তার ফেরা-না-ফেরা সমান।
রবি তবু বলল, নতুন বউঠান, আমি আর কোনওদিন তোমাকে দুঃখ দেব না, শুধু আজ আমার কথা শোনো।
কাদম্বরী তবু ছুটোছুটি করতে লাগলেন। এরই মধ্যে নামল বৃষ্টি, বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি, তারপর জলপ্রপাতের মতন বৃষ্টি। এখন আর কোথাও যাওয়া যাবে না। একটা বড় গাছের নীচে দাঁড়াল দুজনে। এবারে কাদম্বরীর সারা শরীর কাঁপতে লাগল, তাঁর দু চোখ থেকেও অঝোরধারা মিশে গেল বৃষ্টির জলে।
এক সময় তিনি বললেন, রবি –
রবি বলল, কী, নতুন বউঠান?
কাদম্বরী আর কিছু বললেন না, গভীর একাগ্রতায় চেয়ে রইলেন রবির দিকে। কী বলতে গিয়ে তিনি থেমে গেলেন তা রবি বুঝল না। সেও চেয়ে রইল, চোখে চোখে সেতু বন্ধন হল। কী অপূর্ব সুন্দর এখন দেখাচ্ছে কাদম্বরীকে, সেই রূপ যেন অপার্থিব। এখন এঁকে মানবী বলা যায় না, রবি অস্ফুটভাবে বলতে লাগল, দেবী, দেবী।
একটু পরে কাদম্বরী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যে পাখির নীড় নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর দৃষ্টি সে রকম পাখির মতন অসহায়। তিনি আস্তে আস্তে বললেন, এ ভরা বাদার মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর। এ ভরা বান্দর
দুতিনবার সেই একই পঙক্তি উচ্চারণ করে তিনি আবার বললেন, রবি, তুমি এর সুর জান? আমাকে গেয়ে শোনাবে?
রবি মনে মনে একটু গুনগুন করে সুর ভেঁজে নিল। তারপর তাতে বসিয়ে দিল মিশ্ৰ মল্লারের সুর। দু’জনেই ভিজে একেবারে শপশপে হয়ে গেছে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, হাতে হাত ধরে রবি নতুন বউঠানকে গেয়ে শোনাতে লাগল, এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর…।