১০৭. মাসে মাসে পাঁচশো করে টাকা

১০৭

মাসে মাসে পাঁচশো করে টাকা পাঠাচ্ছে নিমাই। মাসের প্রথমেই একটা ছেলে এসে দিয়ে যায়। হাত পেতে টাকাটা নিতে ইচ্ছে করে না বীণার। কিন্তু তবু নেয়। না নিলে তার চলবে কি করে? নিমকহারাম নিমাইয়ের জন্য তো সে কম করেনি। যদি সেই ঋণ শোধ করতে চায় তা হলে করুক। একটু বাধো-বাধো লাগলেও পুরনো কথা ভেবে বীণা নেয়।

যে ছেলেটা টাকা দিয়ে যায় সে আজ সকালেই এসেছিল। বীণা কোনওদিন তাকে বসতে বলে না, কোনওরকম আপ্যায়ন করে না। নিমাইয়ের লোককে সে তা করবেই বা কেন? তবে ছেলেটা ভারি ভদ্র আর বিনয়ী। খুব নরম গলায় কথা বলে। আজ যখন এসে ঘর্মাক্ত মুখে একটু হেসে পকেট থেকে টাকা বের করে হাতে দিল তখন বীণার একটু মায়া হল। হঠাৎ বলল, তোমার নামটা কী বল তো!

নির্মল রায়।

কী করো?

নিমাইদার দোকান দেখাশুনো করি, সঙ্গে থাকি।

একটু বসে জিরিয়ে নাও। চা খাবে?

চা আমি খাই না।

তা হলে জল খাও।

ছেলেটা অনাবিল আনন্দের হাসি হেসে বলল, একটু আগেই রাস্তার কল থেকে জল খেয়ে এসেছি। বাসে খুব তেষ্টা পেয়েছিল।

আমার ঘরে খাবারটাবার কিছু তেমন থাকে না। মুড়ি খেতে পারো। খাবে?

না। আমি খেয়েই বেরিয়েছি।

তাহলে তোমার সঙ্গে কি দিয়ে ভদ্রতা করি?

ছেলেটা জিব কেটে বলল, কিছু লাগবে না দিদি।

নির্মলের হাসিটা বড় ভাল লাগল বীণার। সরল সোজা ছেলে। রংটা কালো হলেও মুখখানায় মায়া মাখানো। এখনও দুনিয়ার পাপ একে পায়নি।

তা হলে আসি?

এসো গিয়ে।

নিমাইদাদাকে কিছু বলার নেই তো!

না। কী বলার থাকবে? প্রথমবার তুমি টাকা দিয়ে একটা কাঁচা রসিদ লিখিয়ে নিয়েছিলে। মনে আছে? আর নাও না তো!

ছেলেটা লজ্জা পেয়ে একটু হেসে বলল, আর লাগবে না।

ছেলেটা চলে গেছে। বিছানার ওপর টাকাগুলো পড়ে আছে অবহেলায়। বীণা এক ধারে চুপ করে বসা। এই মাসোহারা ভাঙিয়ে তাকে বেঁচে থাকতে হবে নাকি? এই দয়ার দানে? চোখ থেকে মন থেকে স্বপ্নগুলো সব মুছে যাচ্ছে। আলো, হাততালি, উল্লাস, ভরা আসরে নেমে প্রাণ ঢেলে অভিনয়—সব কি মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেল? এখন গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য চেয়ে থাকতে হবে কাঁচরাপাড়ার দিকে? তার যে বড় অপমান লাগে!

কিছুক্ষণ অঝোরে চোখের জল ফেলল বীণাপাণি। বুকটা এত ভার হয়ে থাকে যে, বলার নয়। মাথা ধরে। শরীর বিবশ হয়ে যায়। মনের কষ্টে তার কি একটা রোগ পাকিয়ে উঠছে? মাথাটাও পাগল-পাগল লাগে আজকাল। কতকাল পালা নেই, রিহার্সাল নেই, প্রশংসা নেই, এখানে ওখানে দল বেঁধে যাওয়া নেই। বনগাঁয়ে থেকে তা হলে আর কী লাভ?

কিন্তু যাবেই বা কোথায় সে? বাপের বাড়িতে ঝকঝকে দালান উঠেছে, একটু জায়গা সেখানে হতে পারে। কিন্তু সেখানেই বা কী আছে? কোন সুখ?

আজ সকালটা বড্ড ভারী। কেমন যেন!

এতদিনে কি কাকার রাগ পড়েনি? এককালে কাকা তো তাকে কতই স্নেহ করত। একবার যাবে নাকি কাকার কাছে? গিয়ে হাতজোড় করে বলবে, আর পারছি না কাকা, এ বারটা যদি ক্ষমা না কর তা হলে যে আমাকে গলায় দড়ি দিতে হয়।

না, কাকার কাছে আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আর গিয়ে দাঁড়ানো যাবে না কখনই। কিন্তু কথাটা নির্লজ্জের মতো মাঝে মাঝে ভাবে সে।

সজল এল একটু বেলায়। একটু উস্কোখুস্কো চেহারা। বেচারা বড়লোক ধরার চেষ্টা করতে করতে হন্যে হয়ে গেল। ভাল একজন স্পনসর পেলেই যাত্রার দল খুলবে। কিন্তু কেউ বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

চা খাওয়াবে নাকি বীণা?

বীণা বিরস গলায় বলল, শরীর ভাল নেই।

কেন, কী হয়েছে?

সে জানি না। আজ আমি কিছু করব না।

গলার স্বর শুনে মনে হয় কান্নাকাটি করেছ!

মেয়েমানুষ অনেক কাঁদে। ছুতো পেলেই।

তুমি তো শক্ত মেয়ে, সহজে কাঁদার পাত্রী নও।

এককালে শক্ত ছিলাম। আজ নেই।

সজল টুলের ওপর বসল। বিছানার দিকে চেয়ে বলল, টাকাগুলো তুলে রাখো। হাওয়া দিচ্ছে, উড়ে যাবে।

বীণা হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো খামচে বালিশের তলায় চাপা দিয়ে রেখে বলল, তোমার কী হল?

কী আর হবে। চেষ্টা করে যাচ্ছি, হার মানছি না। তবে বাজার বড় সাঙ্ঘাতিক। আমার মতো আনাড়িকে কেউ পাত্তা দিতে চায় না। তোমার কথাও বলছি চারদিকে। আমার দলে তুমি থাকবেই। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না।

আমার কথায় কাজ হবে কেন? আমি কোন্ বিনোদিনীটা বল তো?

আমার ধারণা ছিল এই অঞ্চলে তোমার খুব নাম। নাম যে নেই তাও নয়। সকলেই তোমাকে চেনে। কিন্তু উৎসাহ দেখাচ্ছে না।

তুমি বোকা। ভুলে যাচ্ছ কেন যে, আমার বদনামও আছে? কাকা তো আমাকে চুরির দায়ে তাড়িয়েছে।

ধুর! ওটা কোনও কথা নয়। যতদূর জানি কাকা তোমার বদনাম করে বেড়ায় না। তাছাড়া এ সব করার তার সময় কোথায়? সে এখন নতুন নতুন পালা নিয়ে ব্যস্ত। দল বড় হচ্ছে। চিৎপুরে ঘর নিচ্ছে শুনলাম। পুরোপুরি পেশাদার ব্যাপার।

সব জানি। আমার মতো চুনোপুঁটিকে নিয়ে ভাববার তার সময় নেই। তবু আমার বদনাম আমার চারদিকে একটা বেড়া তুলে দিয়েছে। তুমি বরং বনগাঁ ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে দল করো।

সে চেষ্টাও কি করিনি? এখানে দল করতে গেলে কাকা হামলা করতে পারে। সে হামলা না করলেও কম্পিটিশনে তার সঙ্গে পারব না। কিন্তু কোথাও কিছু সুবিধে হচ্ছে না।

তা হলে আর আয়ুক্ষয় করছ কেন?

কী করব তা বলতে পারো? আমার তো মাথায় কিছুই আসছে না।

কাকার মতো স্মাগলিং করো।

কী যে বলো! ও সব পারব না।

বীণা একটু হাসল। বলল, বড় শখের মূল্য দিতে হয়। নীতিকথা মেনে চললে হয় না।

নীতিকথা মানিও না। বাঁচার জন্য সব কিছু করা যায়। কিন্তু সবার তো সব রকম গাটস্ থাকে না। আমার ধাত ওরকম নয়। দেখ, শো বিজনেসের চেয়ে ভাল বিজনেস কিছু নেই। আমি পারলে ওটাই পারব।

বীণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তা হলে চেষ্টা করে যাও।

করছি বীণা। তোমাকে একটা কথা বলব? অভয় যদি দাও।

বলই না। নাটক করার দরকার নেই।

তোমার হাজব্যান্ডের ব্যবসাটা ভালই চলছে শুনি। উনি আরও একটা হোটেল খুলছেন। জানো?

একটু অবাক হয়ে বীণা বলে, না। কিন্তু হঠাৎ তার কথা কেন?

বলছিলাম কি, নিমাইবাবুকে একবার অ্যাপ্রোচ করলে হয় না?

ভ্রূকুটি করে বীণা বলল, তার মানে?

উনি ইচ্ছে করলে আমাদের ফিনান্স করতে পারেন। দলের মালিকানা ওঁরই থাকবে, আমরা লাভের একটা অংশ পারিশ্রমিক নেবো।

বীণা প্রচণ্ড রাগের একটা উত্তাপ টের পেল তার মাথায়। রগের শিরাগুলো দপদপ করতে লাগল। কঠিন চোখে চেয়ে সে বলল, তুমি কি জানো ও লোকটাকে আমি কত ঘেন্না করি?

সেটা তো পারসোনাল লেভেলে। কিন্তু প্রফেশনাল লেভেলে হেল্প নিতে ক্ষতি কী? ওরও লাভ, আমাদেরও লাভ। পিওর পার্টনারশিপ।

তুমি এক নম্বরের আহাম্মক বলেই এ কথা ভাবতে পারলে। যাত্রার দল খোলার কথা ভাবতে ভাবতে তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ। সব জায়গায় পার্টনারশিপ চলে না। আত্মমর্যাদা বলে একটা জিনিস আছে।

সজল উত্তেজিত না হয়ে বলল, আচ্ছা, তুমি অত রেগে যাচ্ছ কেন? বাঁচার জন্য স্মাগলিং করার চেয়ে তো এটা ভাল।

ও কথা আর মুখে এনো না। তা হলে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না।

ঘাট হয়েছে বাবা। কিন্তু নিমাইবাবুর মাসোহারা তো নিচ্ছ বীণা। সেইজন্যই সাহস করে কথাটা পাড়লাম।

মাসোহারা নিই কে বলল?

তা হলে?

আমার কাছে তার অনেক দেনা আছে। কষ্টের দিনে নিজে না খেয়েও তার সংসার টেনেছি। এখন সে সেই দেনা শোধ করছে। সে কথা তোমাকে বলেওছি।

সরি বীণা। তোমার অতীতের কথাটা আমার খেয়াল ছিল না।

বীণা কিছুক্ষণ মুখটা জড়ো করা হাঁটুর মধ্যে গুঁজে রাখল। তারপর মুখ তুলে বলল, তাও নিতাম না, যদি কাকার চাকরিটা থাকত।

সজল কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে বলল, তোমার রেফারেন্স না দিয়ে যদি নিমাইবাবুকে অ্যাপোচ করি?।

বীণা কঠোর গলায় বলে, কখনই নয়। ওকে ছেড়ে তুমি অন্য কথা ভাবো।

সজল করুণ মুখ করে বলে, আর যে কাউকে রাজি করাতে পারছি না। শুনেছি উনি বেশ দয়ালু লোক।

দয়ালু নয়, দুর্বল লোক। কিন্তু ওকে ভুলে যাও সজল।

তা হলে একটা পরামর্শ দাও। এ ভাবে বসে থাকার মানে হয় না।

আমিও তো বসে আছি।

তোমাকেও বসে থাকতে হবে না। দল করতে পারলে তাতে তো তুমিও থাকবে।

থাকব কি না কে জানে! আমার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। গলার জন্য একগাছা দড়ি ঠিক জুটবে।

উঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না।

বীণা হঠাৎ বলল, আজ যাও সজল। আমার আজ আর বকবক করতে ভাল লাগছে না। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। একটু চোখ বুজে শুয়ে থাকব।

সজল বিদায় নিল। সজল বোকা এবং আহাম্মক। নইলে নিমাইয়ের টাকায় দল খোলার কথা ভাবতে পারত না। কিন্তু নিমাই যে মালদার হয়েছে সেটা জানা ছিল না বীণার। ওর কি এতই টাকা? এমন বুদ্ধিই যদি ওর ছিল তা হলে এতকাল বউয়ের পয়সায় বসে বসে খেল কেন?

বীণা এই ধন্ধটা নিয়ে সারা দিন উপোসী পেটে বসে রইল। শুলো বটে, কিন্তু ঘুম এল না। সারা রাত কাটল এ-পাশ ও-পাশ করে।

খুব ভোরে উঠে সে মুখ হাত ধুয়ে বেরনোর জন্য তৈরি হল। মাথাটা আরও ভার হয়ে ছিঁড়ে পড়ছে। সারা গা জ্বরো রুগীর মতো তপ্ত। ঠাণ্ডা জল ছুঁলে ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে। চোখে জ্বালা-জ্বালা ভাব। এক কাপ চা আর একটা ব্যথার বড়ি খেয়ে একটু সামাল দিল সে। খালি পেটে ব্যথার বড়ি খেলে অম্বল উথলে ওঠে। কিন্তু কিছু মুখে দিতে ইচ্ছেই হল না তার।

যখন বাস ধরল তখন চারদিকে রোদ ঝলমল করছে। সেই রোদ চোখে লাগছিল খুব।

কাঁচরাপাড়ায় বড় রাস্তার কাছেই নিমাইয়ের দোকান। এই সাতসকালেও সেখানে রাজ্যের ভিড়। দোকানটা বাইরে থেকেই দাঁড়িয়ে একটু দেখল বীণা। চা, ঘুঘনি, পাঁউরুটি, চাপাটি আর জিলিপি খুব বিক্রি হচ্ছে। ভিতরে নিমাইকে দেখা গেল না।

একটা ছোকরা দরজার কাছেই একটা টেবিলে চা দিচ্ছিল। ভিতরে ঢুকে বীণা তাকেই জিজ্ঞেস করল, নিমাইবাবু কোথায় বলতে পারো?

ও বাড়িতে।

ও বাড়ি! সেটা কোথায়?

নতুন দোকানে। সামনে এগিয়ে গেলে বাঁ হাতে পাবেন।

বীণা ইতস্তত করছিল। হঠাৎ ভিতরের কোনও ঘর থেকে নির্মলকে বেরিয়ে এসে ক্যাশ কাউন্টারে বসতে দেখল সে।

বীণা এগিয়ে গিয়ে বলল, তুমি তো নির্মল?

নির্মল দু-এক সেকেন্ড চেয়ে থেকেই টপ করে উঠে দাঁড়িয়ে সেই সরল হাসিটা হেসে বলল, দিদি! কখন এলেন?

এইমাত্র।

বসুন বসুন। চা খান এক কাপ। আর কী খাবেন বলুন?

কিছু নয়। তোমার নিমাইদা কি নতুন দোকান দিলেন?

হ্যাঁ। বড় দোকান। কাছেই তো। যাবেন?

একবার দেখা করব।

চলুন তা হলে, আপনাকে নিয়ে যাই।

তুমি ব্যস্ত হয়ো না। আমি খুঁজে নিতে পারব।

আরিব্বাস, তাই হয়? আপনি এসে পড়েছেন যখন, তখন আমার ওপর সব ছেড়ে দিন। তার আগে একটু কিছু মুখে দিন।

আমার একটুও খাওয়ার ইচ্ছে নেই। মাথা ভীষণ ধরেছে।

অন্তত এককাপ চা! স্পেশাল করে দেবে।

আগে ওর সঙ্গে দেখা করি, তারপর।

তা হলে চলুন।

বাইরে এসে একটা রিক্‌শা নিল নির্মল। বীণা বলল, দূর নাকি? রিক্‌শা নিচ্ছ কেন?

দূর নয়। কাছেই। হেঁটে যাওয়ার দরকার কী?

হেঁটেই যাই চল। হাঁটতে ভালই লাগবে।

তবে তাই চলুন। রিক্‌শার অবশ্য ভাড়া লাগত না। আমাদেরই রিকশা। নিমাইদা তো অটোরিকশাও কিনছেন।

খুব ফলাও কারবার তো!

লোকে বলে নিমাইদা যা ধরেন তাই সোনা হয়ে যায়। বাজারে এক পয়সা ধার নেই। সবাই মানে।

শুনে বীণার বমি-বমি করছিল। এত পয়সা করল ওই লোকটা? কি করে হয়?

মিনিট কয়েক হাঁটার পর যে দোকানটার সামনে তারা পৌঁছলো সেটা আসলে একটা ধাবা। মস্ত জায়গা নিয়ে ছড়ানো ব্যবস্থা। সামনে মস্ত করুগেটেড শেডের তলায় সারি দিয়ে খাটিয়া পাতা। ভিতরে মস্ত রেস্টুরেন্ট। মেলা টেবিল-চেয়ার। সবটা ঝকঝক তকতক করছে। তন্দুরি রুটি সেঁকার গন্ধ, কষা মাংস হচ্ছে, কোল্ড ড্রিঙ্কস সাজানো, মস্ত ফ্রিজ। বেশ কিছু খদ্দের বসে আছে। উঠোনের এক দিকে বাথরুম-পায়খানা, চৌবাচ্চা ভর্তি জল, মগ, সব আছে। দোকানের সামনের দিকে এক কোণে পান সিগারেটের দোকান রয়েছে।

এইটেই। ভিতরে আসুন দিদি।

এটা কি ধাবা?

হ্যাঁ। রাতে খুব ভিড় হয়। দুপুর থেকে শুরু হয় ভিড়টা।

কবে হল?

মাস দুয়েক।

নিমাইকে পাওয়া গেল না। বাজারে গেছে। সুতরাং বসতে হল বীণাকে। কাউন্টারের গদিআঁটা চেয়ারেই তাকে বসিয়ে নির্মল হাঁকডাক শুরু করে দিল। সবাইকে বুঝিয়ে দিল দোকানের মালকিন এসেছেন।

খাঁটি দুধে লিকার করা চা আর মচমচে টোস্ট চলে এল সঙ্গে সঙ্গে।

খান দিদি। টোস্টে স্পেশাল মাখন লাগানো আছে। আমরাই মাখন বানাই।

বীণা খুব অনিচ্ছের সঙ্গে চাটা মুখে তুলল। শুচিবায়ু করে লাভ নেই। নির্মল হয়ত দুঃখ পাবে।

কিন্তু সুস্বাদু টোস্ট আর চমৎকার চা খাওয়ার পর শরীরটা অনেক ভাল লাগল তার। গতকাল সারা দিন উপোস গেছে। আজ ভীষণ দুর্বল লাগছিল শরীর।

দিদি, আপনাকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে। একটু বিশ্রাম করবেন? ভিতরে ভাল ব্যবস্থা আছে।

এই তো বেশ আছি।

নিমাইদার আসতে হয়তো দেরি হবে। আজ একটু মোটা বাজার আছে। ততক্ষণ আপনি একটু গড়িয়ে নিতে পারেন। শরীর ভাল নয় বলছিলেন। আসুন আমার সঙ্গে।

কি জানি কেন বীণা উঠল। ধাবার ভিতরে পিছন দিকে বেশ কয়েকটা ঘর রয়েছে। বেশ সাজান-গোছান।

এ সব ঘর কার জন্য নির্মল?

তিনটে ঘর। দুটো নিমাইদা ব্যবহার করেন। আর একটা আছে কোনও গেস্ট এলে থাকেন। এখনও কেউ থাকেনি এখানে। নতুন চাদর পাতা হয়েছে আপনার জন্য। একটু শুয়ে থাকন।

আশ্চর্যের বিষয়, এই প্রস্তাবটিও বাক্যব্যয় না করে মেনে নিল সে। শরীরটা সত্যিই আর দিচ্ছিল না। বীণা শুয়ে পড়ল। বেশ নরম বিছানা। নির্মল জানালার পর্দা টেনে দিল। তারপর বেরিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে গেল সাবধানে।

বীণা শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, সে তো ভাব করতে আসেনি। সে শুধু একটা কথাই বলতে এসেছে। লোভী সজল যদি বীণার বারণ না শুনে যাত্রার দল খোলার প্রস্তাব নিয়ে আসে তা হলে যেন নিমাই রাজি না হয়। সে যতদূর সজলকে চেনে, তাতে তার দৃঢ় বিশ্বাস, সজল তা করবে। ওর চরিত্র বলে কিছু নেই, বুদ্ধিও অবাস্তব। ও আরও একবার নিমাইয়ের কাছে এসেছিল বীণার ওপর অধিকার ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতে। সেটা বড় লজ্জার ব্যাপার হয়েছিল বীণার কাছে। নির্বোধ সজল যাত্রার দল খোলার জন্য পাগল হয়ে গেছে। এখন তার পক্ষে সবই সম্ভব।

কিন্তু নিমাইয়ের অবস্থা দেখে বীণাও একটু হকচকিয়ে গেছে। এ কি ময়দানবের কাণ্ড? মাত্র দু-তিন বছরে এত কাণ্ড কি করে নিমাই ঘটিয়ে তুলল? আগে তো এখানেই একটা ফলের দোকান চালাত। তাতে পেটও চলত না ভাল করে।

ভাবছিল, খুব ভাবছিল বীণা। ভাবতে ভাবতে কখন ঘোরের মতো ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল কে জানে! অতল গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে সে ভাবছিল, কাজটা ঠিক হচ্ছে না।

যখন ঘুম ভাঙল তখন সকাল না বিকেল বুঝতে পারল না সে। জানালার পর্দা টানা, ঘরের দরজা ভেজানো। শুধু একটা জলের পরিচ্ছন্ন জগ আর ঢাকা দেওয়া চকচকে কাচের গেলাস কে রেখে গেছে যেন। আকণ্ঠ তেষ্টা টের পেল বীণা। ঢকঢক করে অনেকটা জল খেল। বাইরে এখনও দিনের আলো আছে।

মাথা ধরাটা ছেড়ে গেছে। শরীর দুর্বল হলেও তেমন জড়তা নেই। সামনে একটা ড্রেসিং টেবিল দেখে বীণা নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল। লোকটা কি ফিরেছে?

বীণা উঠতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে দরজায় টোকা দিয়ে বাইরে থেকে নির্মল জিজ্ঞেস করল, দিদি কি উঠেছেন?

হ্যাঁ।

দাদা ফিরেছেন। ডাকব কি?

ডাকো।

ডাকতে বলার পর থেকেই বুকটা হঠাৎ দুরুদুরু করতে থাকে বীণার। কেন করে কে জানে! নিমাইকে সে কোনওকালে পূর্ণাঙ্গ পুরুষ বলে তো মনেও করেনি। তার কি তবে ভয় করছে? নার্ভাস লাগছে? লাগলে সেটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার।

দরজায় টোকা দিয়ে নিমাই বলল, আসব নাকি?

জবাব দিতে গিয়ে গলাটা দেবে গেল বীণার। ফেঁসে যাওয়া স্তিমিত গলায় বলল, এস।

দরজা ঠেলে যখন নিমাই ঘরে ঢুকল তখন বীণা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়েছিল।

নিমাই বেশ দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলল না।

খুব আস্তে চোখ ফেরাল বীণা। মানুষটা নিমাই বটে, আবার নয়ও। সেই ছোটখাটো চেহারা, তবে শরীরটা পোড় খেয়েছে। রংটা আরও তামাটে। পরনে একটা ফসা ধুতি আর সাদা শার্ট। হাতে ঘড়ি। কিন্তু এ তো বাইরের খোলস। যেটা অবাক হওয়ার সেটা হল, নিমাইয়ের মুখচোখ। সেই ভীতু, আত্মবিশ্বাসহীন, জুলজুলে চাউনি আর নেই। বদলে ভরপুর, শান্ত, আত্মবিশ্বাসী একজোড়া চোখ!

বীণা বলল, বসবে না? কথা আছে।

নিমাই চেয়ারে বসল। কিন্তু কিছু বলল না। বড় চুপচাপ।

বীণা এই নিমাইকে ঠিক চিনতে পারছে না। কে জানে কেন, তার একটু ভয়-ভয় করছে। সে স্তিমিত ধরা গলায় বলল, একটা জরুরি কথা বলতে এসেছি।

ও। সংক্ষিপ্ত জবাব দিল নিমাই।

সজল বলে একটা ছেলে আছে বনগাঁয়ে। ছেলেটা যাত্রার দল খুলবে বলে পাগল। সে হয়ত তোমার কাছে এসে টাকা চাইবে। ওকে টাকাপয়সা দিও না।

সে ইতিমধ্যে বারকয়েক এসে ঘুরে গেছে।

বীণা সচকিত হয়ে সবিস্ময়ে বলল, এসে গেছে?

কয়েকবার। তোমার নাম করেই বলেছে যে, তুমি নাকি দল খুলতে চাও, টাকার দরকার।

সর্বনাশ! কী মিথ্যুক! তুমি দাওনি তো?

না। অতটা আহাম্মক হলে আমার চলে না। তবে তাকে বলেছি, বীণা যদি নিজে প্রস্তাব দেয় তবে ভেবে দেখব।

আমি কিন্তু ওকে পাঠাইনি। মিথ্যে কথা বলেছে।

ওর চোখের দিকে তাকিয়ে তাই মনে হচ্ছিল।

একটু শঙ্কিত হয়ে বীণা বলল, ও তোমাকে আর কী বলেছে?

নিমাই মাথা নেড়ে বলে, আর কিছু নয়।

আমার সম্পর্কে কিছু বলেনি তো!

নিমাই একটু চুপ করে থেকে বলল, তোমাদের সম্পর্কের কথা বলে।

কী সম্পর্ক?

ভাব-ভালবাসার কথা। তোমরা বিয়ে করবে। ঘর বাঁধবে। এই সব।

বীণার মাথায় বজ্রাঘাত হল। সে শুধু বলল, কী সর্বনাশ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *