১০৬. মধ্যপ্রদেশের বান্ধবগড় অরণ্যে

১০৬

শুরুটা হল এইভাবে: মধ্যপ্রদেশের বান্ধবগড় অরণ্যে এক শীতের বিকেলে আমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। সেই রাজকীয় বিশাল সুন্দর শরীর ধীর গতিতে উঠে এসেছিল একটা পাথরের চাতালে। আমি মুগ্ধ, সম্মোহিত। ভয় নয়, শ্রদ্ধা ও আবেগে আমার মাথা নত হয়ে এসেছিল তার সামনে। কী নিরাসক্ত, নির্ভীক আর উদাস তার চোখ। পৃথিবীতে তার ভয় পাওয়ার মতো কিছুই নেই। হায়, এমন এক অসামান্য জীবকে চিড়িয়াখানার করুণ খাঁচার মধ্যে পুরে কী অপমানটাই না করে মানুষ! এমন দিনের কি আর দেরি নেই যখন রাজ্যহারা এই রাজা আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন, বীতশ্রদ্ধ এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেবে? ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হচ্ছে পাখি, পশু, পতঙ্গের প্রজাতি।

প্রথম পরিচ্ছেদের নাম দিল কৃষ্ণজীবন, দি কিং ইজ ডায়িং।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের নাম, দি ফানি ব্যালান্স শিট। তাতে মানুষের সংখ্যা ও পৃথিবীতে উৎপন্ন ফসল ও খাদ্যের অনুপাত আর পশু ও তার খাদ্যের অনুপাতের বিস্তারিত পরিসংখ্যান, কতটা দূষণ ঘটছে পৃথিবীতে আর কতটাই বা শোষিত হচ্ছে সেই দূষণ, গাছপালা অরণ্যের হিসেবনিকেশ।

এইভাবে এগিয়ে গেল তার দ্বিতীয় গ্রন্থ, দি বলডিং হেড। কখনও পরিসংখ্যান, কখনও অঙ্ক, কখনও নীরস বিজ্ঞানের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে পুরাণ, ওল্ড টেস্টামেন্ট, কোরান, রিলকে, লোরকা, বোদলেয়ার, টলস্টয়, রবীন্দ্রনাথ, মিশে যাচ্ছে স্মৃতি, লোকগাথা, রূপকথা। বল্গাহীন এক প্রবহমানতা। রূপসী বাংলার কত কবিতার যে অনুবাদ ঘটাল সে! লিখতে লিখতে সংশয় আসে, এ কি তরল ছেলেমানুষী হয়ে যাচ্ছে? এ কি হয়ে যাচ্ছে একান্ত ব্যক্তিগত রচনা? মাঝে মাঝে তার কাউকে শোনাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাকে শোনাবে? কার সময় আছে? কে শুনবে মন ও কান দুই-ই নিবিষ্ট রেখে?

সংসার ছেড়ে হয়ত একদিন তাকে পরিব্রাজক হয়ে যেতে হবে। এ সংসার তাকে কিছুই দেয়নি, দিতে পারবেও না আর। রিয়া তাকে শাসন করতে করতে এমন একটা সীমারেখায় পৌঁছে দিয়েছে সেটা যেন ঘর ও বাইরের মধ্যবর্তী চৌকাঠ। পেরোলেই মুক্তি। সে সহ্য করতে পারে না চটুল হিন্দি গান বা ভি সি আর-এ যখন তখন সিনেমা চালানো, জোরে কথা বলা, অকারণে রাগারাগি চেঁচামেচি, ঝি-এর সঙ্গে বিতর্ক তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। সে কখনও কাউকে শাসন করতে পারে না, তর্ক বা ঝগড়া সে কখনও করেই না। তবে কি তার রাগ হয় না? হয়। কিন্তু সেই রাগ যেন এক অন্ধ হাতির মত দাপাদাপি করে তারই ভিতরে। তার হৃদযন্ত্রে, পাকস্থলীতে, ফুসফুসে, মস্তিকে সর্বত্র সেই অন্ধ রাগের ধাক্কা গিয়ে লাগে। তাকে ক্লান্ত করে দেয়, বিধ্বস্ত করে ফেলে, নিঃঝুম করে দেয়।

রিয়ার রাগ আজকাল এতই বেড়েছে যে সে আর ভদ্রতার মুখোশটাও রাখছে না মুখে। বারবার সে পনের লক্ষ টাকার হিসেব চাইছে। বিষ্টুপুরের বাড়ি নিয়ে তার দাপাদাপিও সাঙ্ঘাতিক। তার ধারণা হয়েছে সব টাকা ঢেলে ফেলেছে সে গাঁয়ের বাড়ির পিছনে। তাকে শোষণ করে নিচ্ছে তার আত্মীয়রা।

কোনও কথাই সে রিয়াকে বোঝাতে পারে না। একদিন চেষ্টা করতে গিয়েছিল, রিয়া হঠাৎ উন্মত্তের মতো প্রথমে একটা স্টিলের গেলাস ছুঁড়ে মারল তাকে। সেটা কৃষ্ণজীবনের কাঁধে সামান্য আঘাত করে ছিটকে গেল। পরের ঘটনা মারাত্মক। একটা রুটি বেলার বেলন দিয়ে ঘাড়ে, কপালে, গালে, হাতে এলোপাথাড়ি মারল তাকে। কৃষ্ণজীবন চুপ করে দাঁড়িয়ে শুধু ক্ষীণ আটকানোর চেষ্টা করে গেল। কোনও শোধ নিল না। সে অবাক দুটি চোখে ক্রোধ ও আক্রোশের বিকৃত চেহারাটা দেখছিল। এ সবই তার অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। এই পৃথিবী থেকে সে কত কিছু শেখে রোজ!

ঘটনার সময়ে ছেলেমেয়েরা বাড়িতে ছিল না। কিশোরী একটি ঝি ছিল। সেই পরে এসে তুলো ভিজিয়ে তার ক্ষতস্থানের রক্ত মুছিয়ে দিয়েছিল।

না, কৃষ্ণজীবনের এতে কিছু যায় আসে না। শুধু মনঃসংযোগ কেটে যায়। হারিয়ে যায় চিন্তার সূত্র। তাকে অপমান করবে কে! ধুলোমাটি থেকে সে উঠে এসেছে। তার অস্তিত্বের সঙ্গেই তো অবমাননার ধুলোমাটি লেগে আছে। তার কোনও জ্বালা-যন্ত্রণা নেই।

সংসারে তার একটা মাত্র বন্ধু। দোলন। কিন্তু দোলনও কত বড় হয়ে গেল! আগে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমোত। আজকাল একটু তফাত। আর আগের মত আবোল-তাবোল কথা হয় না তাদের মধ্যে।

সংসারের বাঁধন কি শিথিল হয়ে এল তার? কাজের মধ্যে, লেখার মধ্যে যখন ডুবে যায় তখন তার তথাকথিত আপনজনেরা হারিয়ে যায় কোথায়। এই যে বলডিং হেড লিখছে সে, লিখতে লিখতে যেন কোন অতলে তলিয়ে যাচ্ছে সে। বারবার চলে আসছে কত তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা, কত স্মৃতির টুকরো, কত বৃষ্টির বিকেল, শীতের রাত, দেশ ও বিদেশের কত ল্যান্ডস্কেপ, ট্রামে বাসে ট্রেনে শোনা কথা, সংলাপের অংশ। লিখতে লিখতে নাওয়া-খাওয়া ভুল হয়ে যায়।

আমেরিকা থেকে পাবর্লিশার তার দ্বিতীয় গ্রন্থের জন্য অগ্রিম দশ হাজার ডলারের একটা চেক পাঠিয়ে দিয়েছে। এ টাকার কথা গোপন করতে হল তাকে রিয়ার কাছে। কাজ কি অশান্তি বাড়িয়ে। সে মরে গেলে এ সব টাকা তো ওরাই পাবে। আপাতত টাকার কথাটা চাপা থাক।

কিন্তু টাকার এই আকর্ষণ, এই গুরুত্বকে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না সে। গরিব ঘরের ছেলে, প্রাণান্তকর কষ্টের মধ্যে বড় হয়েও কেন সে টাকার মূল্য বুঝছে না, এ প্রশ্নের জবাব সে তার বাবাকেও দিতে পারেনি সেদিন।

কৃষ্ণজীবন টের পায় দিন দিন সে এক গভীর নিঃসঙ্গতার মধ্যে চলে যাচ্ছে। তার বন্ধু নেই, আত্মীয় নেই, ভালবাসার লোক নেই কেউ। শুধু সে আর কাজ।

উত্তেজিত একটা টেলিফোন এল এক সকালে।

হ্যালো, আপনি কি মর্নিং নিউজটা শুনেছেন টিভি-তে?

না তো!

আমি হেমাঙ্গ বলছি। আপনি যে বিরাট একটা প্রাইজ পেয়েছেন!

কৃষ্ণজীবন উদাস গলায় বলল, আপনি কেমন আছেন? অনেকদিন আপনার দেখা নেই।

আরে মশাই, আমি ভালই আছি। আপনি যে প্রাইজ পেলেন সে বিষয়ে একটু রি-অ্যাকশন দেখান!

ওরা যে কেন আমাকে প্রাইজ দেয় কে জানে! পৃথিবী গোল্লায় যাচ্ছে, প্রাইজ দিয়ে কী হবে বলুন তো!

আচ্ছা মানুষ আপনি। একটু খুশি হবেন তো!

খুশি! তা খুশিই না হয় হলাম, ফর ইওর সেক। কিন্তু আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রাইজ আসলে ঘুষ। আমার প্ল্যান বা পরামর্শ কিছুই ওরা নেবে না, ফাইল বন্দি করে ফেলে রাখবে। আর প্রাইজ দিয়ে বন্ধ রাখবে আমার মুখ।

আপনি একজন ইমপসিবল মানুষ। কিন্তু এরকমই থাকুন। খাঁটি লোক পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমে।

কৃষ্ণজীবন একটু হাসল, হারিয়ে যাচ্ছে না। তেমন মানুষ জন্মাচ্ছেই না আর। জন্মও একটা বিজ্ঞান। মানুষ তা মানছে কই। অপমানুষে পৃথিবী ভরে যাচ্ছে।

আপনি ডারলিং আর্থ-এ এ কথা লিখেছেন।

লিখছি। বলছি। আর কী করতে পারি বলুন! কিছুতেই কাউকে বুঝিয়ে উঠতে পারছি না, এখন পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য আমাদের একসঙ্গে বসা উচিত। জড়ো করা উচিত অল আওয়ার রিসোর্সেস। সবচেয়ে গুরুতর কাজ এখন এটাই। নইলে পৃথিবী চলে যাবে শয়তানের থাবায়। শুধু পরিবেশ তো নয়, মানুষকে ধরেছে আরও হরেক রকম ক্ষয়। আপনি কি জানেন হোমোসেকসুয়ালিটি একটা রোগ? মনোবিকার?

তাই তো মনে হয়।

এর থেকে পরিত্রাণ চাইছে না মানুষ। চাইছে তার এই রোগকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক।

হোমোসেকসুয়াল আর লেসবিয়ান মানুষ ও মহিলারা জোটবদ্ধ হচ্ছে, মিছিল করছে, আলাদা অলিম্পিক করছে, যেন সেটাই স্বাভাবিকতা।

জানি।

আরও কি জানেন যে, বাপ-মায়ের সঙ্গে সন্তানের যৌন সংসর্গকে পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় তকমা এঁটে পাশ মার্কা দেওয়ার আয়োজন চলছে?

তাও জানি।

আপনি কি মানেন পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন?

মানছি।

এই অসুখ আমাকে দিনরাত কুরে কুরে খাচ্ছে। প্রাইজ দিয়ে আমি কি করব বলুন তো! কয়েক সেকেন্ড টিভি কভারেজ, মালা, রাষ্ট্রপতির হাত থেকে দেঁতো হাসি হেসে পুরস্কার নেওয়া—গোটা ব্যাপারটাই এত কৃত্রিম! জীবনে বহুবার আমাকে এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

হেমাঙ্গ হেসে প্রসঙ্গান্তরে গেল, এবার বলুন বলডিং হেড কতদূর এগোল।

শেষের দিকে। প্রকাশকরা তাগাদা দিচ্ছে। আমি একটু সময় নিচ্ছি। লেখা শেষ হতে আরও মাসখানেক। তারপর রিভিশন।

সামনের বছর বেরোবে?

মনে হয়।

আমি অপেক্ষা করছি।

আপনি একজন অত্যন্ত ভাল লোক। আপনি সত্যিই পৃথিবীকে ভালবাসেন।

ধন্যবাদ।

আরও দু-চারটে কথার পর ফোন রাখল কৃষ্ণজীবন। মন তিক্ততায় ভরা।

রিয়া কাছেপিঠেই ছিল। ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গে সামনে এসে দাঁড়াল।

কে ফোন করেছিল?

হেমাঙ্গবাবু।

কী বলছিলেন উনি?

এমনি। কেমন আছি জিজ্ঞেস করলেন।

একটা প্রাইজের কথা শুনলাম যেন!

ও কিছু নয়।

কে প্রাইজ পেল? তুমি নাকি?

কৃষ্ণজীবন একটু লজিত হয়ে বলল, হ্যাঁ, সেরকমই বলছিলেন।

কী প্রাইজ?

তা জিজ্ঞেস করিনি। বোধহয় সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের কিছু একটা হবে!

অত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কী আছে? প্রাইজ তো একটা সম্মান।

হ্যাঁ। তা ঠিক।

তা হলে বলছ না কেন?

কৃষ্ণজীবন তার ক্লান্ত বিষণ্ণ দুটি চোখে তার সুন্দরী স্ত্রীর মুখের দিকে একটু চেয়ে থেকে বলে, আমি জানি না রিয়া। রেডিও বা টিভি-তে হয়ত আবার বলবে। শুনে নিও।

তুমি ইন্টারেস্টেড নও?

না। প্রাইজ নিয়ে লাফালাফি করার কিছু নেই। যখন দেবে, হাত পেতে নেব। আর কি?

এতক্ষণ গলায় একটু ধমক ছিল রিয়ার। এবার হঠাৎ কোমল হল। বলল, তুমি কেন এরকম গো? তুমি কেন আর পাঁচজনের মত নও? তোমার জন্য যে আমার ভয় করে।

কৃষ্ণজীবন তটস্থ হল। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। কিছু বলল না।

রিয়া বলল, এইজন্যই তো তোমার সঙ্গে আমার লেগে যায়। তোমার কোনও রি-অ্যাকশনই হয় না কোনও কিছুতে। এইজন্যই তো আমি মাঝে মাঝে পাগল হয়ে যাই।

কৃষ্ণজীবন মৃদু একটু হেসে বলল, আমি পাঁচজনের মতোই। তবে আমার তো অনেক চিন্তা, তাই বোধ হয় রি-অ্যাকশন কম হয়।

না, তা নয়। তুমি বোধ হয় একজন মস্ত মানুষ। আমি বোধ হয় তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি না। না গো?

ঘন ঘন মাথা নেড়ে কৃষ্ণজীবন বলল, তা নয়, তা নয়। ওরকম ভাবতে নেই রিয়া। আমি কত সামান্য তা তুমি জানো না।

রিয়া তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। তার দু’ চোখ বেয়ে টস টস করে জল গড়িয়ে নামে। একটু ফুঁপিয়ে উঠে বলে, আমি মাঝে মাঝে তোমার সঙ্গে রাক্ষুসির মত ব্যবহার করি। কিন্তু তুমি যে….

কথা শেষ করতে পারল না রিয়া। ভেঙে পড়ল।

দ্বিতীয় ফোনটা এল গভীর রাতে, যখন কৃষ্ণজীবন তার রচনার মধ্যে ডুবে আছে। সে যে পরিচ্ছেদটা লিখছিল তার শিরোনাম কপালকুণ্ডলার সেই বিখ্যাত লাইন, পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?

কী করছেন আপনি এখন? লিখছেন তো!

হ্যাঁ। তুমি কেমন আছ?

আচ্ছা, আমি যে বড় হয়েছি তা আপনি লক্ষ করছেন?

কৃষ্ণজীবন হাসল, করছি।

কেমন লাগছে আপনার আমাকে এখন?

তুমি তো সুন্দর মেয়ে।

আহা, ওভাবে বান্ধবীকে কমপ্লিমেন্ট দিতে হয়? একদম গাঁইয়া হয়ে যাচ্ছেন কিন্তু।

গাঁইয়াই তো ছিলাম!

সে ছিলেন তো ছিলেন, এখন ইউ আর এ ফেমাস ম্যান, এ সেলিব্রাইটি। আপনি যে একটা প্রাইজ পেলেন আমি জানি।

ওটা কিছু নয়।

তাও জানি। আপনি একটা খুব অহঙ্কারী লোক।

আমি তো উল্টো জানতাম।

মোটেই না মশাই। আচ্ছা বলডিং হেড কি আমি একটু অ্যাডভান্স পড়তে পারি না?

পারো। ইন ফ্যাক্ট আমি একজন কাউকে শোনাতে চাইছিলামও।

সত্যি? তা হলে কবে?

তোমার কখন সময় হবে?

আমার তো এক্ষুনি আপনার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।

পাগল। বলে হাসল কৃষ্ণজীবন। তারপর বলল, কাল আমার ক্লাস নেই।

আমিও স্কুল পালাব। কোথায় আর কখন?

একটু ভাবল কৃষ্ণজীবন। তারপর বলল, বেলা বারোটায় গোল পার্কের রেলিং-এর সামনে থেকো। তুলে নেব।

খিক খিক করে হাসল অনু। বলল, উইল ইট বি সিক্রেট অ্যান্ড রোমান্টিক মিটিং?

নো, নটি গার্ল। ইট উইল বি অ্যান অ্যাকাডেমিক মিটিং।

আচ্ছা বাবা, তাই হোক। তবু তো কিছুক্ষণ কম্পানি পাওয়া যাবে।

তোমার এখনও একটা বয়ফ্রেন্ড জুটল না?

কে বলল জোটেনি?

কে সে?

আপনিই তো আমার বয়ফ্রেন্ড।

কৃষ্ণজীবন হাসল। বলল, বড্ড পাকা হয়েছে।

কত বয়স হল জানেন? এখন আমি আর গার্ল নই, এ উওম্যান।

পরদিন দুপুর বারোটায় জিনস, সাদা শার্ট আর বড় রোদ চশমা পরা অনুকে যখন গাড়িতে তুলে নিল সে তখন কৃষ্ণজীবনের ভিতরে একটা কিছু হচ্ছিল। একটা সিরসিরে গোপন কাঁপন। মানুষ এসব প্রবণতাকে বুদ্ধি ও বিবেচনা দিয়ে চাপা দেয়।

কোথায় যাব আমরা এখন?

কৃষ্ণজীবন হাসল, চল কোনও ভাল রেস্টুরেন্টে বসি!

আমার কিন্তু খিদে নেই।

এঃ হে, তোমাকে আজ লাঞ্চে ডাকলেই হত!

কেন ডাকেননি?

বড্ড ভুলে যাই যে!

এরকম আনমাইন্ডফুল বয়ফ্রেন্ড নিয়ে যে আমার কী মুশকিল!

আইসক্রিম তো খেতে পারবে!

পারব।

তা হলেই হবে। চল।

খুব দামী একটা হোটেলের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁয় তারা বসল। কৃষ্ণজীবন তার হাতে টাইপ করা কয়েকটি শিট দিয়ে বলল, পড় তো।

অনু যখন পড়ছিল তখন তাকে লক্ষ করছিল কৃষ্ণজীবন। মেয়েটা এমনিতে একটু ফাজিল, কিন্তু যে-ই পড়তে শুরু করল অমনি গম্ভীর, স্থির, একাগ্র হয়ে গেল। একবারও চোখ তুলল না। খুব খুশি হল কৃষ্ণজীবন। মেয়েটা হয়ত কেবল ফাজিলই নয়, ভিতরে ভিতরে সিরিয়াস।

কয়েকটা পাতা ধীরে ধীরে পড়ে শেষ করল অনু। তারপর মুখখানা যখন তুলে তার দিকে তাকাল, তখন মেয়েটার মুখখানা লাবণ্যে ভরে গেছে।

বুঝতে পারছ অনু?

পারছি না? কী যে বলেন! কী অদ্ভুত লেখা!

শুধু প্রশংসা করলেই তো হবে না। ক্রিটিক্যালি পড়লে তবে আমি নিশ্চিন্ত হব।

ক্রিটিক্যালি! যা খুব সত্যি তাকে কি ক্রিটিসাইজ করা যায়?

ভোলাচ্ছ না তো!

না। আমি সে রকম গার্ল ফ্রেন্ড নই। আমি সিরিয়াস। আপনি একজন অদ্ভুত মানুষ। আমার কান্না আসছিল পড়তে পড়তে।

দ্যাটস গুড। দ্যাট ইজ ভেরি গুড। তোমার কি মনে হয় মানুষ এই লেখা পড়ে নড়েচড়ে বসবে? বই পড়লে মানুষের কিছু প্রতিক্রিয়া হয়। সেটা তাৎক্ষণিক। আমি চাই এমন লেখা লিখতে যা পড়ে মানুষ সত্যি করে কিছু করতে চাইবে এবং করবে।

অনু তার একখানা হাত বাড়িয়ে কৃষ্ণজীবনের হাতের ওপর রেখে একটু চাপ দিয়ে বলল, আপনিই হয়ত পারবেন। আমি তো অত বুঝি না।

তাও ঠিক। তোমার অভিজ্ঞতা কতটুকুই বা!

আমার আইসক্রিম কই?

আসবে। আমি বেয়ারাকে পরে আসতে বলেছি।

এবার ডাকুন।

কৃষ্ণজীবন অনুর জন্য আইসক্রিম আর নিজের জন্য কফির অর্ডার দিয়ে তৃপ্ত মুখে বসল।

তিন মাস বাদে বলডিং হেড বেরল আমেরিকা থেকে। নিউ ইয়র্কে রিলিজের দিন উপস্থিত ছিল কৃষ্ণজীবন। টিভি থেকে ছোট্ট সাক্ষাৎকার নিল তার।

রাতে হোটেলের ঘরে অন্ধকারে একা বসে কাচের শার্সি দিয়ে বাইরে চেয়ে সেন্ট্রাল পার্কের দৃশ্য দেখছিল সে। দেখতে দেখতে সে চলে গেল বিষ্টুপুর গাঁয়ে, তার ছেলেবেলায়। কাদাজল ভেঙে ইস্কুলে যাচ্ছে। মাথায় কচুপাতা এক হাতে ধরা, জামার নিচে বইখাতা অন্য হাতে ধরা। খালি পা। চলেছে চলেছে। পথ ফুরোয় না আর। পিছল পথ। উঁচু নিচু পথ। কত দূরে ইস্কুল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *