১০৫. চারদিকে সুখ

১০৫

চারদিকে সুখ একেবারে উছলে পড়ছে। পাকা দোতলা বাড়ি, চার দিকে বুক-সমান ঘের-দেয়াল উঠেছে। যে বাড়িটা রামজীবন তুলতে গিয়ে পেরে ওঠেনি সেটার ছাদ-ঢালাই করে দিয়েছে কৃষ্ণজীবন। পলেস্তারা পড়ে গেছে, জানালা-দরজাও বসে গেছে। রং হলেই সে বাড়িও হেসে উঠবে। পুরনো ঘরগুলো ভেঙে জায়গা চৌরস করে বাগান হচ্ছে। ময়দানবের কাণ্ড যেন, রামজীবনের আধখ্যাঁচড়া ঘর আর মুখ ভ্যাংচায় না বিষ্ণুপদকে। বিষ্ণুপদ এখন দোতলার চওড়া বারান্দায় বসে দুনিয়াটা দেখে। কিন্তু নতুন রকম লাগে কি? তা তো লাগে না!

সুখের যে একটা বান ডেকেছে সেটা বুঝতে পারে বিষ্ণুপদ। কিন্তু এত সুখে যখন নয়নতারা উথলে ওঠে তখনও বিষ্ণুপদ কেন ঠাণ্ডা মেরে থাকে! কোনও সুখই কেন ভিতর অবধি গিয়ে সেঁধোয় না তার!

সুখের চিহ্নগুলো সারাদিন ধরে ঘরে বাইরে খুঁজে বেড়ায় সে। বাড়ি হল, সাহেবি সব আসবাব হল, আজকাল পাতে রোজ মাছ তো বটেই, তার সঙ্গে আরও দুই-তিন পদ। রামজীবনকে দোকান করে দিয়েছে কৃষ্ণজীবন। সে দোকানও চলছে। রামজীবন আজকাল মদটদ খাচ্ছে না কিছুদিন! সবই সুখের বৃত্তান্ত।

কুয়োর ধারে বড় জমিটা মস্ত ভরসা ছিল সংসারের। আনাজপাতি না জুটলে ওই বাগান থেকে যা-হোক কিছু খুঁটে তুলে আনত নয়নতারা। শাকপাতা, কচু-ঘেঁচু, নিদেন একটা লেবু। আজকাল আর তার দরকার হচ্ছে না। অনটন নেই।

তবু বুকে একটু টনটনানি থেকে যায় কেন! কী নেই? আরও কী চায় বিষ্ণুপদ!

আগাছায় ভরা বাগানটায় বিষ্ণুপদ একদিন সকাল থেকে গিয়ে বসে রইল। আজ বাদলা মেঘ নেই। বৃষ্টি একটু থিতু রয়েছে। আতা গাছের ছায়ায় বসে বিষ্ণুপদ ভাবনাচিন্তার ঝাঁপি খুলে বসল। নিরিবিলি এরকম নিজের মোকাবিলা করা মাঝে মাঝে ভাল।

কিন্তু তার ভিতরটা চিরকালই বড় নিস্তব্ধ। সেখানে কথার ভুড়ভুড়ি কম, ভাবনা-চিন্তাও যেন খেই-হারা। সুখের কথাই ভাবছে বিষ্ণুপদ। এই যে বাড়ি হল, কতকালের কত অভাবের সঙ্গে লড়াই শেষ হয়ে গেল, এসব হওয়ার পরও সে কেন যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে? একটা এই হতে পারে যে, তার পুরনো চেনা বাড়িটা লোপাট হয়ে যাওয়ায় কেন যেন নতুন বাড়িতে সে খাপে খাপে বসছে না। খুঁতখুঁতুনি হচ্ছে, নতুন জুতো পরলে যেমনধারা হয়! তাই কি! আর এক অস্বস্তি বামাচরণ। শোনা যাচ্ছে, তার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। মাথার ব্যামো। লোভে, অশান্তিতে, আক্রোশেই কি পাগল হয়ে গেল ছেলেটা?

সব মিলিয়ে বিষ্ণুপদর তেমন সুখ হচ্ছে না। কেমন যেন মনে হচ্ছে, পরের বাড়িতে বাস করছে সে। কেন এরকম হয়!

একখানা দা হাতে বোধ হয় গুলতির কাঠ কাটতে বাগানে ঢুকেছিল পটল। দাদুকে দেখে থমকে দাঁড়াল।

দাদু, কী করছো?

বসে আছি দাদা।

এ সময়টায় সাপ বেরোয় তো।

বিষ্ণুপদ মৃদু হাসল, হেলে ঢোঁড়া সব।

না দাদু, চক্করওলাও আছে।

বিষ্ণুপদ মাথা নাড়ল, নেই। ভিত খোঁড়ার সময় দু-দুটো বাস্তুসাপ মেরে ফেলল মিস্তিরিরা, দেখিসনি?

আর নেই?

বিষ্ণুপদ বলল, সাপও আজকাল কই? আগে কত দেখা যেত। বসত বাড়ছে, সব নিকেশ হয়ে যাচ্ছে।

পটল বলল, সাপের বিশ্বাস কি! তুমি বারান্দায় গিয়ে বোসো।

বিষ্ণুপদ উদাস গলায় বলে, গাঁয়ের ছেলে হয়ে সাপকে ভয় পাস?

খুব পাই দাদু।

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আগে লোকে বাঘ-সিংহী ভয় পেত, আজকাল দেখ তাদের কী দুর্দশা! ফৌত হয়ে হয়ে মাত্র কয়েকটিতে দাঁড়িয়েছে। এখন ভয় দেখা দিয়েছে, একদিন না এসব জন্তু লোপাট হয়ে যায়। সাপেরও সেই অবস্থা হয়ে এল। আগে বর্ষাকালে হেলে-ঢোঁড়া কত কিলবিল করত চার ধারে। উঠোনে, পুকুরে। আজকাল কোথায়?

পটল একটু হাসল, তুমি বুঝি সাপখোপ বাঘ-সিংহ চাও?

বিষ্ণুপদ নাতির দীঘল চেহারা আর কোমল মুখখানার দিকে চেয়ে বলল, তুই চাস না?

না তো!

তোর বড় জ্যাঠা চায়। দুনিয়াটা এক অদ্ভুত জায়গা। প্রকৃতি এমন করে সৃষ্টি করেছিল সব যে পান থেকে চুন খসলেই গণ্ডগোল। প্রকৃতির ভারসাম্য না কী যেন বলে! তোর জ্যাঠা জানে। সে অনেক জানে, বুঝিয়ে বলতে পারবে। আমি তত জানি না। কিন্তু আমারও কেন যেন মনে হয়, সাপখোপ বাঘ-ভাল্লুক না হয় থাকত কিছু কী ক্ষতি হত তাতে!

সাপের কামড়ে যে কত মানুষ মারা যায় দাদু!

বিষ্ণুপদ একটু হেসে বলে, সাপের কামড়ে যত না মানুষ মরেছে তার চেয়ে লক্ষ গুণ সাপ মরেছে মানুষের লাঠিতে। বাঘ যত না মানুষ মেরেছে তার বহুগুণ বেশি বাঘ মরেছে মানুষের হাতে। সবসময়ে যে না মারলেই চলত না, এমন নয়। তবু মেরেছে। মানুষের দাঁতে নখে জোর না থাক, তবু মানুষের চেয়ে হিংস্র আর কে আছে বল তো!

পটল একটু ভাবল। তারপর দাদুর সামনে উবু হয়ে বসে মুখের দিকে চেয়ে বলল, দাদু, বড়জ্যাঠা এইসব নিয়ে লেখে, না?

ও বাবা! সে পণ্ডিত মানুষ, কী নিয়ে লেখে তার আমি কী বুঝি? তবে এসব কথাও নাকি আছে তার বইতে।

বইটা আমি জ্যাঠার কাছে চেয়েছি। বলেছে দেবে।

সে বই কি তুই বুঝবি?

বুঝব দাদু। জ্যাঠার কথা আমি বুঝতে পারি।

বিষ্ণুপদ একটু আনমনা হয়ে গেল। আপনমনে শুধু বলল, সে বড় ভালবাসে দুনিয়াটাকে।

পটল এখন অনেকটাই বড় হয়েছে। সামনের বছর তার মাধ্যমিক পরীক্ষা। সে আজকাল ক্লাসে ফার্স্ট হয়। গোপালকে কলকাতার ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে কৃষ্ণজীবন। হোস্টেলেরও ব্যবস্থা হয়েছে। পটলের একটু ফাঁকা লাগে তাই।

পটল বিষ্ণুপদর দিকে চেয়ে বলল, জ্যাঠা এখন কোথায় আছে দাদু? আমেরিকা না ইউরোপ?

বিষ্ণুপদ এক-গাল হাসল, না রে, কলকাতাতেই আছে এখন। গিয়েছিল কাছেপিঠে কোথায় যেন! ম্যানিলা হবে বোধ হয়। ফিরে এসেছে। যদি ভাল করে লেখাপড়া করিস তাহলে তুইও তার মতো কত দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবি।

কী যে বলো! জ্যাঠার মতো পারব? উরিব্বাস! আগে মাধ্যমিকটা তো ডিঙোই।

পটল চলে গেলে বিষ্ণুপদ ফের ভাবতে বসল। ভাবনাগুলো বড্ড ছাড়া-ছাড়া, মোয়া বাঁধছে না। সুখের কথাই ভাবছে বিষ্ণুপদ। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। একটা খোঁড়া লোকের যদি পা গজায়, একজন অন্ধ যদি চোখ ফিরে পায়, একটা হাভাতের যদি ভাতের ব্যবস্থা হয় তো খুব সুখ হয়। কিন্তু সুখটা বড় গড়ানে জিনিস। চূড়ায় বাস করতে পারে না। নেমে আসে। যার নতুন ঠ্যাঙ হল সে ক’দিন খুব খটর মটর করে হাঁটবে তারপর একদিন ঠ্যাং-এর কথা ভুলে যাবে। যার চোখ হল তার আনন্দও বেশিদিন নয়। হাভাতের ভাতের সুখও বড় ক্ষণস্থায়ী।

তুমি এইখানে বসে! সারা বাড়ি খুঁজছি।

নয়নতারাকে দেখলেই বিষ্ণুপদর একটা মায়া হয় আজকাল। এই এক মানুষ যার সুখটা বেশ স্থায়ী হচ্ছে। ডগোমগো ভাবটা আর নেই, তবু মুখখানা সবসময়ে আহ্লাদে মাখা। সারাদিন ঘুরে ঘুরে বাড়ি ঝাড়পোঁছ করছে, যারা বহুবার দেখেছে সেইসব পাড়াপ্রতিবেশীদের ফের ডেকে এনে তার আশ্চর্য বাড়ির অন্ধিসন্ধি দেখাচ্ছে। মজে আছে সব নিয়ে।

বিষ্ণুপদ বলল, এ বাগানটা একটু পরিষ্কার করলে হয়।

তা হয়। রেমোকে বললেই নোক লাগিয়ে দেবে। কিন্তু তুমি এখানে বসে কেন? ওপরের বারান্দায় চেয়ার পেতে রেখেছি, সেখানে বসলেই তো হয়!

বারান্দায় তো রোজই বসি। আজ বাগানে বসতে ইচ্ছে হল। ইচ্ছে তো নানা রকমের।

পুরোনো বাড়িটার কথা ভুলতে পারছে না, না?

তা নয়। আসলে কি জানো, আমরা তো ভোগ করতে কোনওদিন শিখিনি। ভাল বাড়ি, ভাল জামাকাপড়, ভাল খাবার-দাবার এসব ভোগ করার জন্যও একটা ট্রেনিং লাগে, অভ্যাস লাগে। হঠাৎ বুড়ো বয়সে এইসব রাতারাতি হয়ে যাওয়ায় কেমন হাঁফ ধরে যাচ্ছে! সেই হাঁফ ছাড়তেই বাগানে এসে বসা।

তোমার মুখ থেকে যা বেয়োয় বেদবাক্য। কথাটা বলেছো বড্ড ভাল। ভোগ করতে শিখতে হয়। তবে চেষ্টা করতে করতে শেখাটা হয়েও যায়। না গো?

তোমার হচ্ছে, দেখছি। বলে বিষ্ণুপদ হাসল।

লজ্জা পেয়ে নয়নতারা বলে, মেয়েমানুষের মন তো বিষয়মুখী, তাই আমরা এগুলো তাড়াতাড়ি শিখি। তোমার মুখখানা আজ রসস্থ দেখছি যে! শরীর খারাপ নয় তো!

আরে না। তোফা আছি।

ভাঁড়িও না বাপু।

না গো, তোমার কাছে লুকোবো সাধ্যি কি! শরীর ভালই আছে। মনটা ভাল নেই।

কেন, হলটা কী?

ছেলেটা দুহাতে কেন যে এত খরচ করল! বউমার সঙ্গে হয়তো অশান্তি হচ্ছে।

সে আর বলতে! খুব হচ্ছে।

জানো ঠিক?

আন্দাজ করছি। ছেলে মুখ-ফস্কা দু-একটা কথা বলেও ফেলে। আর বউমা তো স্পষ্ট কথা শুনিয়েই গেছে। ওসব গায়ে মাখলে তো চলবে না। ছেলে তার বাপ-মায়ের প্রতি কর্তব্য করেছে। বাপ-মাও তো ফ্যালনা নয়।

একটু কম করে করলেও হত। বউমা তো খুব অন্যায্য কথা বলেনি।

সে বিদেশ থেকে মেলা টাকা পেয়েছে তাই করেছে। তার পরিশ্রমের রোজগার।

বিষ্ণুপদ কথাটা ঠিক স্বীকার করতে পারল না। একটু চুপ থেকে বলল, সবই বুঝি নয়নতারা। তবু বলি, এতটা না করলেও চলত। তাদেরও তো হক আছে, দাবি আছে। আমার কেবল মনে হচ্ছে এ যেন অন্যের মুখের গ্রাস।

নয়নতারা বলে, ওগো, তারও তো আমাদের জন্য প্রাণটা পোড়ে। সে তো এতকাল কিছু করেনি। বউ ছেলেমেয়ের সেবাই করেছে। এখন একটু মায়া হয়েছে বলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হল!

কৃষ্ণটা হয়তো মনের কষ্টে আছে। বউমা হয়তো কথা শোনায়। আমাদের তিনকাল তো কেটেই গিয়েছিল। আর কয়েকটা দিন কি চলতো না?

আমাদের চলত, কিন্তু কৃষ্ণ যে প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিল তা তো হত না।

বিষ্ণুপদ একটু ভেবে বলল, তা বটে!

নয়নতারা একটু বিষণ্ণ গলায় বলল, কৃষ্ণ এত করেও তোমাকে কিন্তু খুশি করতে পারল না। হ্যাঁ গো, তুমি কেন খুশি হলে না, বলো তো!

বিষ্ণুপদ একটু হেসে বলল, সুখটা যে কোথায় থাকে তাই তো বুঝতে পারি না নয়নতারা। রোজ ভাবি, এই যে সাতসকালে বাগানে এসে বসে আছি সে এমনি নয় গো, বসে বসে ভাবছি আর ভাবছি। তা আমার ভাবনা কেমন জানো? যেমন লম্বা দড়ি জট পাকিয়ে যায় তেমনি। মেলা গিঁট, মেলা ফাঁস। কিছুতেই সরল হতে চায় না।

তোমার সুখ না হলে আমার মনটা খারাপ হয়, জানো তো!

তা জানি। তবে ভেবো না, ধীরে ধীরে সব অভ্যাস হয়ে যাবে।

তোমার পুরনো বাড়ির জন্য মন কেমন করে বোধহয়।

তাও করে। সে বাড়ি নিজের রক্ত জল করে করা। অনেক পুরনো দিনের নানা কথা জড়িয়ে ছিল তার মধ্যে, তা বলে ভেবো না আমি স্মৃতি নিয়ে পড়ে আছি। আমি ভাবছি সুখ জিনিসটার কথা। মনটা কেমন ছাড়া হয়ে আছে।

চলো তো, ওপরের বারান্দায় গিয়ে আমার সামনে বসবে। আমি কুটনো কুটবো এখন। তুমি সামনে থাকলে আমার বুকটা ঠাণ্ডা থাকে।

চলো তাহলে। বলে উঠে পড়ল বিষ্ণুপদ।

কৃষ্ণজীবন এল দু’দিন বাদে। রবিবার। দোতলা থেকে তাকে প্রথম দেখল বিষ্ণুপদ। সে নয়নতারাকে ডাকাডাকি করল না। ছানি পড়া চোখে কৃষ্ণজীবনের লম্বা শরীরটাকে সটান হেঁটে আসতে দেখল সামনের মাঠের পাশ দিয়ে। দোতলা থেকে অনেক দূর অবধি দেখা যায়। ছাদে উঠলে তো কথাই নেই।

কৃষ্ণ এল, বাড়িতে একটু তটস্থ ভাব হল। এলেমদার মানুষের কদরই আলাদা!

ওপরে এসে বাপের মুখোমুখি যখন বসল কৃষ্ণজীবন, তখন বিষ্ণুপদ ভাল করে ছেলের মুখখানা লক্ষ করল। কেমন আছে তার এই আলাভোলা ছেলেটা? ভাবের জগতে থাকে, দুনিয়ার নানা উল্টোপাল্টা ব্যাপার ভাল বুঝতে পারে না। বউমার সঙ্গে পট খাচ্ছে তো! অপমান হতে হচ্ছে না তো!

মুখখানা খুব একটা হাসিখুশি নয়। কেমন যেন থম ধরা।

বাবা, কেমন আছেন?

দিব্যি আছি বাবা। এর চেয়ে ভাল কখনও থাকিনি।

বলেই বিষ্ণুপদর মনে হল, মিথ্যে কথা বলা হল নাকি? দুনিয়ায় যত সাধুবাদ আছে তার মধ্যে একটু করে মিথ্যে ঢুকে থাকেই। যত প্রশংসাবাক্য আছে তার অধিকাংশই একটু বাড়তি কথা। কী আর করা যাবে!

কৃষ্ণ একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, যখন যা দরকার হবে বলবেন বাবা। নিঃসঙ্কোচে বলবেন।

বিষ্ণুপদ খুব হাসল। একেবারে ছেলেমানুষের মতো। সারা জীবনে এরকম কথা কেউ তাকে বলেনি। এ যেন হঠাৎ স্বর্গ থেকে দেবতা নেমে এসে বললেন— কী বর চাও বলো, দেবো। কিন্তু বিষ্ণুপদ ভাবে, সারা জীবন খিদে নিয়ে, অপূরণ ইচ্ছে নিয়ে, নিদারুণ অভাব কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকার একটা যে সময় গেছে তখনও তার চাহিদা তো খুব বেশী ছিল না। রাঙা চালের মোটা ভাত আর একটু ডাল হলেই হত। দুখানা মোটা ধুতি, দুখানা জামা হলেই হত। পায়ে এক জোড়া জুতো হলেই হত। তার বেশি আকাঙক্ষাই তো তৈরি হত না মনে।

বিষ্ণুপদ হাসি থামিয়ে স্মিত মুখে বলল, কী আর লাগবে বাবা? কিছুই তো লাগে না এখন। যথেষ্ট আছে।

কৃষ্ণজীবনও একটু হাসল। তারপর বলল, আপনার যে কিছুই লাগে না তা আমি জানি।

বিষ্ণুপদ একটা সরল শ্বাস ফেলে বলল, বড় কষ্ট করে বড় হয়েছে বাবা, তুমি জানবে না তো কে জানবে? কত অল্পে কত সামান্য নিয়েও মানুষের চলে যায়, তা তুমি ভালই জানো।

কৃষ্ণজীবন মেদুর চোখে চেয়ে বসে রইল। জবাব দিল না। জীবনের গভীর গভীরতর মর্মস্থল থেকে মাঝে মাঝে উঠে আসে হলাহল, মাঝে মাঝে উঠে আসে অমৃত। মন্থন করো, জীবনের গভীরে দাও ডুব। নইলে ওপরসা ওপরসা ভেসে বেড়ানো হবে, লাগবে হাজার উপকরণ, বোঝাই যাবে না কেন জন্ম, কেন এই জীবনযাপন।

কৃষ্ণজীবন মৃদু স্বরে বলল, বামার বউ আমার কাছে গিয়েছিল। সে কিছু টাকা চায় আর ওই রামজীবনের বাড়িটা চায়।

তুই কি বলেছিস?

আমি কিছু বলিনি। বলেছি, ভেবে, পরামর্শ করে বলব।

কত টাকা চায়?

এক লাখ।

কেন?

বলছে তাদের বড় অভাব, বামার চিকিৎসার জন্য মেলা খরচ হচ্ছে, এইসব আর কি!

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, টাকার জন্য আমার ওপরেও হামলা করেছিল। লোভে পাগল হয়ে গেছে।

আমার মনে হয় টাকাটা দিয়ে ওদের ঠাণ্ডা করে দেওয়াই ভাল। নইলে আবার এসে আপনাদের জ্বালাতন করবে।

তুমি অনেক শিখেছো বাবা, তবু লোকচরিত্র বোঝে না। ওদের লাখ লাখ টাকা দিয়েও কিছু হবে না। ওটা তো খিদে নয়, হাঁকাই। টাকা দাও, ফের কিছুদিন পরে এসে হাত পেতে দাঁড়াবে।

দেবো না তাহলে?

না বাবা। তুমি গরিবের ছেলে হলে কি হবে, এখনও টাকার ওপর তোমার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ভাবো বুঝি টাকা দিয়েই সব সমস্যা মেটানো যায়! ওরকম ভেবো না।

কৃষ্ণজীবন একটু হাসল, সবাই যে টাকা-টাকাই করে।

তোমার টাকার ওপর মায়া হল না কেন বলো তো?

মায়া? কিসের মায়া বাবা?

তুমি গরিবের ছেলে, নুন জুটতো তো পান্তা জুটত না তোমার, জুতো জামা বই খাতা পেনসিলের জোগাড় ছিল না, সেই তুমি এখন টাকার মুখ দেখলে, তবু টাকাকে তোমার খোলামকুচি মনে হয় কেন বাবা?

কৃষ্ণজীবন একটু হেসে বলে, টাকা নিয়ে ভাবতে বলেন নাকি বাবা?

না, তবে টাকা বড্ড উড়ছে তোমার চারদিকে। ঠক জোচ্চোরেরা ঘিরে ধরবে। শ্যামলীকে বেশি প্রশ্রয় দিও না। ওদের টাকার অভাব নেই। দুটি মোটে মানুষ, বামা চাকরিও করে। ওদের অভাব কি? তবে রামজীবনের ওই বাড়িটায় এসে যদি থাকতে চায় তো থাকবে। রেমোর কাছে কথাটা পাড়ব’খন।

সেই বুদ্ধিই ভাল।

এ বাড়ির পিছনেও তুমি অনেক টাকা ঢেলেছে। এতটা না করলেও হত। বউমা আর ছেলেপুলেদের দিকটাও তো দেখতে হয়!

তাদের জন্যও অনেক আছে বাবা। বেশি টাকাও ভাল নয়। হঠাৎ হাতে বেশি টাকা পড়লে সৎকাজে ব্যয় করা ভাল। নইলে ছেলেপুলে ওই টাকার পাল্লায় পড়ে নষ্ট হয়।

বিষ্ণুপদ একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ অনাবিল হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করে বলল, একটা বড় ভাল কথা শুনলাম আজ। বেশ বলেছে বাবা।

কৃষ্ণজীবন চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে। আজ যে ছেলের মেজাজ ভাল নেই তা বুঝতে পারে বিষ্ণুপদ। সেও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

কৃষ্ণজীবন হঠাৎ বলে, আপনার বাঁ চোখের ছানিটা বোধহয় ম্যাচিওর করে গেছে। কিছু দেখতে পান বাঁ চোখে?

বিষ্ণুপদ ডান চোখে হাত চাপা দিয়ে বাঁ চোখে চারদিকটা দেখে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে, না। বড্ড ধোঁয়া ধোঁয়া। এই যে তোকে দেখছি, একটা কেউ বসে আছে বোঝা যায়। তার বেশী নয়। তবে ডান চোখে দেখি।

বাঁ চোখটা কাটিয়ে নিতে হবে।

দরকার কি? দেখার আছেই বা কি? চলে তো যাচ্ছে!

না বাবা। বেশি ম্যাচিওর করে গেলে চোখটা যাবে। এসব পুষে রাখা ভাল নয়। আমি কলকাতায় ফিরেই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলব। আজকাল ঝামেলা কম। মাইক্রো সার্জারি করালে এক দিনের বেশি আটকেও থাকতে হয় না।

আবার খরচের পাল্লায় পড়বে?

কৃষ্ণজীবন হেসে বলে, মানুষ খরচ করলে তার বদলে কিছু পায়ও তো! শুধু খরচ দেখলেই কি হবে বাবা?

সে তো খাঁটি কথা। কিন্তু লোকে ওই খরচটাই যে দেখে।

আপনি আর ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না —চোখটা না কাটালেই নয়।

এখানে হয় না?

না বাবা। মাইক্রো সার্জারি করাতে হলে কলকাতায় যেতে হবে। তাতেই বা কি? কলকাতা তো একটুখানি রাস্তা। আমি আপনাকে গাড়ি করে নিয়ে যাবো।

ও বাবা! গাড়িতে কি কম তেল পুড়বে? তার দরকার নেই। ট্রেনেই যেতে পারব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *