১০২
কাকা তাকে ডাকল না, খোঁজও করল না। প্রথম দিন কয়েক আশায় আশায় ছিল বীণাপাণি। কাকা তাকে বড় আর্টিস্ট করার স্বপ্ন দেখত। হয়তো দোষঘাট ভুলে গিয়ে ক্ষমা করে দেবে, ডেকেও পাঠাবে। কিন্তু একদম সাড়াশব্দ নেই।
দিন সাতেক বাদে বীণাপাণি বুঝতে পারল, কাকা তাকে আর ডাকবে না। হয়তো প্রতিশোধ নেবে না, কিন্তু তা বলে সব ভুলেও যাবে না। নিজের সম্মান বিসর্জন দিয়ে বীণা গিয়ে দাঁড়াতেও পারবে না কাকার সামনে।
কিন্তু দিন কি করে চলবে সেইটেই সমস্যা। পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল কাকা। তখন সুনজরে দেখত, বোনাস না কি যেন বাবদে টাকাটা দিয়েছিল তাকে। ব্যাঙ্কে একটা ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছিল সে। টাকাটা তুলতে হল।
সজল এসে প্রায়ই বলে, চলো, বিয়েটা সেরে ফেলি।
আজকাল বিরক্ত হয় বীণাপাণি। বলে, বিয়ে-বিয়ে করছে কেন বলল তো! ওটা একটা ব্যাপার নাকি? আমার জীবনে কত বড় সর্বনাশটা হয়ে গেল বলল তো! কোনও দল যদি না ডাকে তবে না খেয়ে মরতে হবে। ভাগ্যিস কিছু টাকা বোনাস দিয়েছিল কাকা, তাই চলছে।
সেই পাঁচ হাজার টাকা?
হ্যাঁ।
সজল একটু হেসে ম্লান মুখে বলল, বোনাস কে বলল?
কাকাই তো বলেছিল এরকম একটা কথা।
সজল মাথা নেড়ে বলল, বোনাস নয়। কাকাও দেয়নি নিজের ট্যাঁক থেকে।
তাহলে?
ওটা দিয়েছিলেন তোমার স্বামী নিমাইবাবু।
স্তম্ভিত হয়ে গেল বীণাপাণি, তার মানে!
কাকাই একদিন বলেছিল, নিমাই বীণার ঋণ শোধ করতে টাকা পাঠিয়েছে। মিথ্যে কথা বলে টাকাটা তাকে গছাতে হয়েছে।
নিমাই দিয়েছে!
হ্যাঁ। আমি জানি বীণা।
বীণা বিছানায় অবশ শরীরে বসে পড়ে বলল, ঋণ শোধ দিয়েছে?
সেরকমই শুনলাম। নিমাইবাবু মানুষটি বড্ড ভাল। আমি যখন গিয়েছিলাম তখনও মনে হয়েছিল, খুব সৎ ধর্মভীরু মানুষ। আমি মাংস-পরোটা খেয়েছিলাম, উনি দাম দিতে দেননি।
সেইজন্যই ভাল?
না বীণা, সেইজন্য নয়। কেমন যেন মনে হয়েছিল, উনি এই আমাদের মতো নুন। অন্যরকম।
ওকে তোমরা কিছুই জান না। ভীষণ পাজি, নিমকহারাম, শয়তান।
সজল মাথা নেড়ে বলে, তা ঠিক। বাইরে থেকে আর কতটা বোঝা যাবে! তবে দোকানটা কিন্তু খুব চলে। আমি গত সপ্তাহে কাঁচরাপাড়া গিয়েছিলাম। দোকানটা দেখলাম আরও বড় হয়েছে। প্রচণ্ড বিক্রি।
বীণা রাগের গলায় বলল, তাই এত টাকার গরম! আমার ঋণ শোধ দিয়েছে!
ভাগ্যিস দিয়েছিল! নইলে তোমার এখন চলত কিসে? তোমারও চাকরি নেই, আর আমাকে তো তাড়িয়েই দিয়েছে অপমান করে।
বীণা চুপ করে রইল। বুকে আগুন জ্বলছে।
বীণা, মিছিমিছি রাগ করে কী করবে? জীবনে এরকম খারাপ সময় সকলেরই মাঝে মাঝে আসে। আমি তোমাকে বিয়ের কথা কেন বলি জানো? দুজনে মিলে আমাদের একটা জোর হবে। একটা কিছু করতে পারব।
কী করবে?
ধরো যদি যাত্রার দল করি!
যাত্রার দল করা কি চাট্টিখানি কথা!
খুব শক্তও নয়। এ অঞ্চলে তোমার বেশ নামডাক আছে! তোমাকে দাঁড় করালে ধীরে ধীরে একটা দল করা যায়।
তোমার অভিজ্ঞতা নেই বলে স্বপ্ন দেখছে। কাকার বিশ্ববিজয় অপেরা নিতান্তই ছোট দল, তবু তারও কত লোকজন, কত জিনিসপত্র লাগে দেখেছো? কাকা পয়সাওলা মানুষ বলে পেরেছে। আমরা পারব না।
চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি!
বীণা সবেগে মাথা নেড়ে বলে, ওসব আমাকে বোলো না। নতুন দল গড়ে তারপর কেঁচে গণ্ডুষ করা আমার পোষাবে না। ওসব তোমার জন্য। আমি অনেক ঠেকে শিখেছি।
কেন যে এত হতাশ হয়ে পড়ছো!
আমার সমস্যা তুমি বুঝবে না। তাই বিয়ের জন্য অমন হামলে পড়ছো।
আমরা তো একসঙ্গে থাকতেও পারি!
না সজল, তাও পারি না। আমাকে যত সস্তা বলে তুমি ভাবো ততটা সস্তা আমি নই। যদি শরীর চাও তাহলে বাজারে মেয়েমানুষের অভাব নেই। তাদের কাছে গেলেই পারো।
সজল লজ্জায় লাল হয়ে বলল, ছি ছি বীণা, আমি মোটেই ওভাবে বলিনি। আমি বলছিলাম নিমাইবাবুর সঙ্গে যখন তোমার ডিভোর্স হয়নি তখন বিয়েটা হয়তো অসামাজিক হবে। তাই বলছিলাম, আজকাল তো লিভিং টুগেদার হয়।
হতে পারে। কিন্তু ওসব প্রস্তাব আমার এখন ভাল লাগে না সজল। এখন তুমি যাও।
কথার মাত্রা রাখতে পারিনি। মাপ করে দিও।
সজল গেল। কিন্তু ছাড়ল না। মাঝে মাঝেই আসতে লাগল। সজলকে কিছু খারাপ লাগে না বীণার। কিন্তু এই অনভিজ্ঞ, কপর্দকহীন সুন্দর ছেলেটার হাতে নিজেকে সমর্পণ করার কথাও কেন যেন আজকাল আর সে ভাবতেই পারে না। বসে বসে গল্প করতে তার অবশ্য খারাপ লাগে না।
গল্প করে করে তিন মাস কেটে গেল। তাদের সম্পর্ক একটুও এগোলো না। বীণা ঘোরাঘুরি করে এল চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায়। কোনও দলেই জায়গা নেই। অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে। হাতের টাকা ফুরিয়ে এল প্রায়। দুশ্চিন্তায় রাতে ভাল ঘুম হয় না।
কুসুম এসে একদিন বলল, বীণাদি, কাজ করবে?
কী কাজ রে?
সেলাই ফোড়াই জানো? তাহলে সমীরবাবুর ওখানে কাজ হতে পারে। উনি সেলাই জানা লোক খুঁজছেন। কাঁথা ফোঁড় না কী যেন বলে, শাড়ির ওপর সেই কাজ করতে হবে।
ধুস! ওসব আমি পারি না।
কুসুম হেসে বলল, তাহলে কী করবে?
হ্যাঁ রে, কাকা আমার কথা কিছু বলে না?
না।
একদম না?
না গো, তোমার কথা আর কেউ বলে না।
নতুন পালা নামছে নাকি, জানিস?
হ্যাঁ। কাকা তো নতুন একটা পালা লিখল। বর্ষাকালটা জোর রিহার্সাল হবে।
আমার বদলে এখন কে করবে মেইন পার্ট?
পুতুল রায় বলে সেই যে মেয়েটা। সে-ই করছে।
এঃ মা! তার তো লেপাপোঁছা নাক-চোখ। জিবের আড় ভাঙেনি।
এখন কাকা তো তাকেই তৈরি করছে।
বীণার মন খারাপ হয়ে গেল। কুসুম তার ঘরের কাজকর্ম আজও করে। তাকে সঙ্গও দেয়। তার কাছে দলের অনেক খবর পায় বীণা। সেইসব খবর তার দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়। এই যে পুতুল নামে মেয়েটা, ফিরে তাকানোর মতো চেহারাও নয়। আর অভিনয়ের কিছুই জানে না এখনও, এর কথা ভেবে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
হ্যাঁ রে কুসুম, আমাকে একটা লক্ষ্মীর পট এনে দিবি?
দেবো না কেন? কী করবে?
কোনওকালে পুজোআচ্চা ধর্মকর্ম করিনি তো! আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয়, এসব একটু করে দেখি।
খুব ভাল হয় বীণাদি। লক্ষ্মীর পাঁচালিও কিনে আনব’খন। মন ভাল হবে। দেখো।
শুধু লক্ষ্মী নয়, কয়েকদিনের মধ্যেই বীণার ঘরে লক্ষ্মী, শিবলিঙ্গ, কালী আর শীতলার পট চলে এল। একটা সস্তা জলচৌকির ওপর তাদের বসানো হল। বীণা ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাদের নিয়ে। ঠিক যেরকম ছেলেবেলায় পুতুল খেলত সেরকমই অবস্থা এখন তার।
সজল এসে সব দেখে হাসে, কী করছো বলো তো! হঠাৎ এত পুজোআচ্চা কেন?
কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে!
কিছু নিয়ে থাকতে চাও তাহলে তো সবচেয়ে ভাল হত একটা দল করলে। নতুনদের নিয়েই করব।
তুমি এখনও দল করার কথা ভাবছো?
ভাবছি। আমার তো আর কোনও যোগ্যতা নেই। অভিনয়টাও ভাল জানি না, তবু বড় নেশা।
একটু ভাবো না বীণা! তোমাকে পাশে পেলে মনে হয়, অনেক কিছু করতে পারি।
আমাকে পাশে পাওয়ার আশা ছাড়ো। আমি আর নতুন করে কিছুই শুরু করতে পারব না। আমার মন ভেঙে গেছে।
ডলার আর পাউন্ডগুলো নিয়েই কি এত কাণ্ড হল?
হ্যাঁ। ও টাকা কাকার নয়। আমার কাছে একজন গচ্ছিত রেখেছিল। ন্যায্য পাওনা আমারই হয়।
আমাকে যদি একবার বলতে তাহলে ঠিক লকাতায় নিয়ে গিয়ে ব্ল্যাকে বেচে একটা ক্যাপিটাল করে ফেলতাম। আজ আর টাকার জন্য কিছু আটকাত না।
আজ আর টাকাটার জন্য শোক নেই! তবে দল ছাড়তে হল বলে কান্না পায়। কেউ আর আমাকে চিনবে না।
চিনবে বীণা। তোমার ভিতরে যা আছে তা কম মেয়ের মধ্যেই পাওয়া যায়। আমি দল করার কথা ভাবছি। তুমি তাতে অভিনয় করতে রাজি তো?
বীণা হাসল, গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল।
পারব বীণা, নিশ্চয়ই পারব।
আচ্ছা আমার আজও জানা হয়নি তোমাকে ওরা মারল কেন?
ও কথা থাক। মেরেছে তো কী হয়েছে! আমি ওদের অন্য ভাবে মারটা ফিরিয়ে দেবো। সেইজন্য তো দল করার কথা ভাবছি।
বরং বাড়ি ফিরে যাও সজল। সংসারে মন দাও।
দূর! আমার আবার সংসার কোথায়?
মা-বাপ তো আছে।
তারা আমার ধার ধারে নাকি? ভাই তো আমাকে দেখতেই পারে না। যাত্রা করে বেড়াই বলে প্রেস্টিজও দেয় না।
এখানেই বা কোন মুখে আছো? কি করে চলে তোমার?
সে কি তুমি জাননা না? চেহারাটা ভদ্রলোকের মতো, গান গাইতে পারি, গল্প জমাতে পারি, লোকের দায়ে দফায় দৌড়ঝাঁপ করতে পারি, এইসব প্লাস পয়েন্ট থাকায় এর ওর তার বাড়িতে মাথা গোঁজা বা দু-মুঠোর জোগাড় হয়ে যায়। দুটি মেয়েকে গান আর একটা ছেলেকে তবলা শেখাই। আবৃত্তি শেখানোর ক্লাসও খুলছি। একে কি বেঁচে থাকা বলে বীণা? কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় কি বলো তো!
বিয়ের ভূত মাথা থেকে নেমেছে?
বিয়ের ভূত? কী যে বলো! বিয়ে করার কথা কখনও মনেই হয়নি। তোমাকে দেখার পর মনে হল, হ্যাঁ, এরকম কাউকে পেলে এ জীবনটার একটা সার্থকতা আসবে। এটা ঠিক শরীরের আকর্ষণ নয় বীণা, এ একটা অন্যরকম ব্যাপার।
শোনো, আমার একটু তীর্থে যাওয়ার শখ হয়েছে। যাবে সঙ্গে?
কোথায় যেতে চাও?
প্রথমে তারকেশ্বরে যাই চলো। সকালে গিয়ে বিকেলে চলে আসব। তারপর একবার তারাপীঠ।।
কেন বলো তো! তোমার হলোটা কী?
কী যে হল তা বুঝতে পারছি না। দেখিই না এসব করে একটু। কোনওদিন তো ভগবানকে ডাকিনি।
ঠিক আছে। কবে যাবে বোলো, সঙ্গে যাবো। তোমার সঙ্গে যাওয়ার তো একটা থ্রিল আছেই।
কথাটা কেন যেন ভাল লাগল না বীণার। কথাটা পবিত্র নয়।
দু’দিন পর বীণা তারকেশ্বর গেল বটে, কিন্তু সঙ্গে সজলকে নিল না, নিল কুসুমকে। সারা দিনটা কেটে গেল যাতায়াতে। ভিড়ে, ঠেলাঠেলিতে। যখন ফিরল তখন শরীর ক্লান্ত, মনও ক্লান্ত।
হ্যাঁ রে কুসুম, তীর্থ করে এলাম তবু মনটা ভাল লাগছে না কেন রে?
ওমা! ও কি কথা! আমার তো খুব ভাল লাগছে। বাবা তারকেশ্বর যেন গা থেকে পাপতাপ সব পুঁছে নিয়েছেন। ঝরঝরে লাগছে।
তোর আবার পাপটা হল কিসে?
আহা, কত পাপ অজান্তেও হয়।
তাহলে তোর জন্যই এইসব তীর্থটীর্থ। তোর মতো যদি সরল হতে পারতাম!
তোমার না মনটাই খুব চঞ্চল। সকলের তীর্থে গেলে আনন্দ হয়, তোমার কেন হয় না?
আমি বোধহয় খুব পাপী।
যাঃ। তুমি খুব ভাল।
সে তোর কাছে। ভগবানের কাছে নয়।
একটা কথা বলব বীণাদি?
বল না।
মেয়েদের কাছে কিন্তু স্বামীও ভগবান। কথাটা বললে তুমি রাগ করবে, নিমাইদাদাও কিন্তু বড্ড ভাল মানুষ। ভগবান যদি তোমার ওপর রেগে থাকেন তাহলে ওইজন্যই।
রেগে যেতে গিয়ে বীণা হেসে ফেলল, তোর অঙ্ক খুব সোজা। সব একেবারে স্পষ্ট দেখতে পাস, না?
তা নয় তো কী?
তুই জীবনে খুব সুখী হবি। খুব আহ্লাদে থাকবি।
তুমি কেন নিমাইদাকে ভালবাসো না বলো তো! ওরকম মানুষকে ভাল না বেসে পারা যায়
তুই বুঝি নিমাইদার প্রেমে পড়েছিস রে মুখপুড়ি?
কী যে সব অসভ্য অসভ্য কথা বলো!
অসভ্য কেন হবে! ঠিকই তো বলছি। এতই যদি পছন্দ তবে বিয়ে করে ফেল। এখন তো আর আমি তার বউ নই।
ইস! তোমার মুখের একেবারে আগল নেই। বীণাদি, ভগবান কিন্তু পাপ দিচ্ছেন।
বীণা খুব হাসল, বলল, দিক না পাপ।
খুব তো বলছো, ওদিকে জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখে তো কাঁদতে বসেছিলে নিমাইদাদা আবার বিয়ে করেছে ভেবে। আমাকে খবর আনতে বলেছিলে, মনে নেই?
তা আছে।
তবে অত বড় বড় কথা বলছো যে! তুমি মনে মনে ঠিকই নিমাইদাদাকে ভালবাসো, মুখে স্বীকার করতে চাও না।
খুব বুঝেছিস।
বুঝিনি?
ছাই বুঝেছিস।
কুসুম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কি জানি বাপু, আমি মুখসুখ মানুষ। যেমন বুঝি বলি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বীণা গম্ভীর হল। বলল, হয়তো তুই-ই ঠিক বুঝিস রে। কে জানে কে ঠিক আর কে ভুল!
বীণা চুপচাপ শুয়ে রইল। সারা দিন গরম আর ঘামে তার শরীর দুর্বল লাগছে। মনটা বিস্বাদে ভরা। এভাবে কি জীবন কাটবে? এই কাজ-না-থাকা, পালা-না-থাকা, ক্ল্যাপহীন জীবন কিভাবে কাটবে তার?
রাতে কিছু খেল না বীণা। রান্না করতেই ইচ্ছে করল না। শুয়ে মড়ার মতো ঘুমোলা।
সকালে উঠে তার মনে হতে লাগল, এভাবে জীবন কাটবে না তার। এভাবে কিছুতেই বেঁচে থাকা যাবে না। তাকে কিছু করতেই হবে। কী করবে সে? কী করবে?
বেলা দশটা নাগাদ যখন দ্বিতীয়বার চা খেতে বসেছে বীণা, তখনই একটা ছেলে এল। সাধারণ চেহারা। বিনয়ী। বলল, আমাকে নিমাইদাদা পাঠিয়েছেন। এই যে চিঠি।
নিমাইয়ের চিঠি! খুব অবাক হল বীণা। মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে খামের ওপর তার নাম লেখা।
চিঠিটাও মুক্তাক্ষরে। তবে সম্বোধন নেই। শুধু লেখা : তোমার অবস্থা আমি জানি। যদি দোষ না ধরো তাহা হইলে সামান্য কিছু টাকা গ্রহণ করিও। এই অর্থে কোনও গ্লানি নাই। আমি পরিশ্রম দ্বারা উপার্জন করিয়াছি। নিমাই।
বীণা চোখ তুলে চাইতেই ছেলেটা তার প্লাস্টিকের ব্যাগ খুলে এক বাণ্ডিল নোট বের করে দিল।
আশ্চর্যের বিষয়, বীণা কিছু না ভেবেচিন্তেই টাকাটা নিল।
পাঁচ হাজার আছে। গুনে নিন।
গুনতে হবে না।
একটু যদি লিখে দেন তো ভাল হয়।
কী লিখবো?
টাকাটা যে পেয়েছেন।
ও।
বীণা ঘরে খুঁজেপেতে একটা পার্ট মুখস্থ করার খাতার কাগজ ছিঁড়ে তাতে লিখল, টাকাটা পেয়েছি। বীণা।
সারাটা দিন বীণা আজ ঝুম হয়ে বসে রইল। রান্না করতে ইচ্ছে হল না। খিদে পেয়েছিল, মুড়ি চিবিয়ে চা খেয়ে খিদেটা মারল।
কুসুম সন্ধেবেলা এল।
কী গো বীণাদি, মুখ শুকননা কেন?
এমনি বসে আছি। মন ভাল নেই।
আবার কী হল?
তোর নিমাইদাদার কাছে হেরে যাচ্ছি।
আহা, কী কথা! হারার কী হল?
তোর নিমাইদাদা আমাকে খারপোষ পাঠাচ্ছে।
সে আবার কী?
বউকে ত্যাগ দিলে খোরপোষ দিতে হয় না, তাই!
কুসুম হাসল, টাকা পাঠিয়েছে বুঝি?
হ্যাঁ, আর আমিও নির্লজ্জের মত নিলাম।
নেবে না কেন? ও টাকা তো আশীবাদ!
তোর মতো করে ভাবতে পারলে বোধহয় ভাল হত। আমি যে পারি না।
না পারো, টাকাটা মাথায় ঠেকিয়ে খরচ কোরো। ওতেই হবে।
কী হবে রে?
ভাল হবে।
বীণা কিছু বলল না। আজ মনটা অন্যরকম লাগছে। অদ্ভুত লাগছে।
বীণাদিদি, একটা কথা বলব?
বল না!
যাও না একবার নিমাইদাদার কাছে!
গিয়ে?
পায়ে পড়ো গিয়ে।
ওমা, কেন?
ক্ষমা চাও।
তাই বা কেন?
স্বামীর পায়ে ধরতে হয়।
তোর মাথা!