১০০
এই যে এত আনন্দ হল বাড়িতে, গৃহপ্রবেশে এত লোক খেল, এত হইচই, এর মধ্যেও বীণাপাণি রইল আড় হয়ে। তার মনে একটুও সুখ নেই। সে শুনেছে ভিড়ের মধ্যে এক ফাঁকে এসে নিমাই নাকি শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম করে চলে গেছে। চোখাচোখিটুকুও হয়নি তার সঙ্গে। না হয়ে ভালই হয়েছে। বীণাপাণির যত অশান্তির মূলে তো ওই একটা লোক।
ভয়ে বীণাপাণির বুক সবসময়ে দুরদুর করে। বনগাঁয়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবলেই বুক হিম হয়ে যায়। নিমাই নাকি ছোড়দাকে বলেছে, বীণাপাণি বনগাঁয়ে ফিরে যেতে পারে। কথাটার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝেনি বীণা। সে বনগাঁয়ে ফিরবে কি না তা নিয়ে নিমাইয়ের মাথাব্যথা কেন?
বীণার সবচেয়ে দুঃখ, নাটকটাই জীবন থেকে বাদ হয়ে যাচ্ছে। সজল বলেছিল, কাকা টের পেয়ে গেছে। কাকা এমনিতে ভাল, কিন্তু চটলে সাড়ে সর্বনাশ। বীণা কি করবে তাই ভেবে পাচ্ছে না। ডলার আর পাউন্ড বাঁচাতে সে চট করে যা মাথায় এসেছিল তেমনই একটা কৌশল করে রেখে এসেছে বটে, কিন্তু তাতে বিপদটা রয়েই গেল। কাকা তাকে খুঁজবে, দরকার হলে খুনও করাবে। তবে বিষ্ণুপুর শীতলাতলার পাল্লাটা একটু দূরের, এইটুকুই যা ভরসা। উদ্বেগ টাকাগুলোর জন্যও রয়েছে। মেঝের নিচে গর্তের মধ্যে চাপা আছে ঠিকই, তবু নাগালের মধ্যে যে নেই সেটাই দুশ্চিন্তার কারণ। কী হচ্ছে কে জানে!
বাড়িটা যে দেখনসই হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। মা বাবার মুখে হাসি ধরছে না। দাদা মেলা জিনিসপত্র কিনে ঘর সাজিয়ে দিয়েছে। সোফাসেট, লোহার আলমারি, নতুন খাট। এরকম রাজার হালে থাকার কথা মা-বাবা তো কখও ভাবেনি।
তবে বিষ্ণুপদ তাকে বলেছে, বড় অস্বস্তি হচ্ছে, বুঝলি! প্রথম প্রথম তো! মনে হচ্ছে যেন পরের বাড়িতে ঢুকে পড়েছি।
নতুন বলে হচ্ছে বাবা, দুদিনেই সয়ে যাবে।
তা বটে। আজ ঝাঁঝরির জলে চান করলুম, ঠাণ্ডা না লেগে যায়।
বুঝেসুঝে কোরো।
কাল থেকে ভাবছি ওই কুয়োপাড়েই চানটা করব। এ ঠিক জুত হচ্ছে না।
না বাবা, পুরনো অভ্যাস বজায় রাখলে নতুনটা আর অভ্যাস হবে না। দাদা এত আদর করে সব করে দিল।
তা বটে।
সবচেয়ে খুশি নয়নতারা। চোখে-মুখে সবসময়ে ডগমগ ভাব। মুখে উপচে পড়ছে হাসি।
ও মা, তোমার যে দেমাকে মাটিতে পা পড়ছে না গো!
নয়নতারা হেসে বলে, তা বাপু, একটু দেমাক আমার হয়েছে। সব ঘুরে ঘুরে দেখলি তো! মেঝেটা বাপু যেন তেলতেল করছে। সিঁড়িটিড়ি সব দেখলি? আর রান্নাঘর? কত তাক, কত কাবার্ড।
কাবার্ড কথাটা দাদা শিখিয়েছে মাকে। শুনে সবাই হাসে।
বীণাপাণিও হাসল, আমাকে কোন ঘরখানা দেবে মা?
কেন, দোতলায় তিনখানা শোওয়ার ঘর। আমাদের পাশের ঘরেই তুই থাকবি।
দাদাকে বড় ভয় বীণার। অপরাধবোধও কম নয়। এই দাদাকে তারা এ বাড়ি থেকে অনেক অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তবু এতদিন বাদে দাদা কিছু মনে করে রাখেনি নিশ্চয়। তা না হলে এখানে এত বড় বাড়ি করে দিত না। খুব ভয়ে ভয়ে আর লজ্জার সঙ্গে গৃহপ্রবেশের পর দিন সকালে দাদার ঘরে গেল বীণা। প্রণাম করে বলল, কেমন আছ দাদা?
কৃষ্ণজীবনের মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। বলল, ভালই! তুই কেমন?
ওই একরকম। আমাদের আর ভাল থাকা!
কৃষ্ণজীবন গম্ভীর গলায় বলে, তুই নাকি যাত্রায় নামিস?
নামি দাদা। না নেমে উপায় ছিল না তখন।
কৃষ্ণজীবন চিন্তিতভাবে তার মুখের দিকে চেয়ে বলে, আমার যাত্রা সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই কিন্তু লোকে বলে, যাত্রার দলে ভদ্রবাড়ির মেয়েরা যায় না। তুই যে কেন গেলি!
সামান্য ক্ষোভের সঙ্গে বীণাপাণি বলল, আমি কি ভদ্রবাড়ির মেয়ে দাদা? তুমি কি জানোনা আমরা কত কষ্টে মানুষ হয়েছি? আর কীভাবে আমাকে একজন হাড়হাভাতের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হল! ওরকম শ্বশুরবাড়ি যেন শত্রুরও না হয়। কী গরীব ভাবতে পারবে না। তার ওপর হল অসুখ, চিকিৎসার টাকা নেই, পথ্যি জোটে না। কী করতাম বলো তো!
কৃষ্ণজীবন তার মুখের দিকে গভীর নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইল। বলল, বল শুনি।
কেঁদে ফেলল বীণাপাণি। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলল, নিজেকে ভদ্রবাড়ির মেয়ে বলে ভাবতে কবেই তো ভুলে গেছি। এ গরিব বাড়ি থেকে আরও গরিব আর-এক বাড়িতে গিয়ে উঠেছি। ভদ্র পরিবেশ কোথায় পেয়েছি বলল তো! জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল আমার। তখন তো তুমি আমাদের পাশে ছিলে না। তুমি ছাড়া আর এ বাড়ির কেই-বা ভদ্রলোকের মতো বলো তো! মেজদা সেজদা এদের তো জানো। আজ মস্ত বাড়ি হয়েছে তোমার দয়ায়, কিন্তু এতদিন কিভাবে কেটেছে আমাদের?
কৃষ্ণজীবন মাথা নেড়ে বলল, ঠিক কথাই তো। কিন্তু তবু যাত্রাদলে কেন গেলি সেটা বোঝা গেল না।
ওই জন্যই তো। কাকা নামে একটা নাটক-পাগল লোক আছে, সে-ই বাঁচিয়ে দিল চাকরি দিয়ে।
কিন্তু সেই লোকটা নাকি স্মাগলার?
হ্যাঁ, তাও ঠিক। তবে সে লোক ভাল।
নিমাই কি খুব খারাপ লোক রে বীণা?
মেরুদণ্ডহীন।
কৃষ্ণজীবন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, অনেকদিন আগে তাকে একবার দেখেছিলাম। ফের দেখা হল গতকাল। আশ্চর্যের বিষয় হল, তাকে আমার ভীষণ ভাল লোক বলে মনে হয়েছে। কেন রে?
কেন তা কি করে বলব? বাবাও বলে, তুমিও বলছ, আমি তো ভালর কিছু দেখি না। অকমার ধাড়ি।
আমরা ছাড়া আর কেউ বলে না?
বলে। ভাল লোক ভাল লোক শুনে শুনে কান পচে গেল। কিন্তু ভাল ধুয়ে কি জল খাবো?
শুনি এখন সে কাঁচরাপাড়ায় হোটেল চালাচ্ছে। ভাল আয়।
কে জানে কি!
তোর সঙ্গে কি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?
ওইরকমই।
কেন হল?
বনল না।
কৃষ্ণজীবন মাথাটা একটু দু’ধারে নেড়ে বলল, খুব অল্প সময়ের মধ্যে যে একটা ব্যবসাকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে সে খুব অকর্মণ্য বলে আমার মনে হয় না।
এতদিন তো পারেনি।
কৃষ্ণজীবন তার চোখের দিকে চেয়ে বলল, সেইটেই তো তোর কাছে জানতে চাইছি, এতদিন পারেনি কেন?
ও মা! তা আমি বলব কি করে?
তোর সঙ্গে ছিল, অথচ তখন পারল না, তোকে ছেড়ে এসেই পেরে গেল তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে?
কী বলো তো?
তার মানে দাঁড়াচ্ছে কোনও কারণে ও তোর কাছে বাধা পেত, সাহস করে উঠতে পারত না, তোর মুখাপেক্ষী হয়ে ছিল। হা রে, নিমাই কি খুব স্ত্রৈণ?
মোটেই নয়।
ব্যাপারটা খুবই রহস্যময়। এনিওয়ে, তোকে ছেড়ে গিয়ে লোকটার তো উন্নতিই হয়েছে দেখছি।
হোক, আরও হোক। আমি তো আর ভাগ বসাতে যাচ্ছি না।
কৃষ্ণজীবন হাসল, কী কথার কী জবাব। বোস, ঠাণ্ডা হ। ওর ওপর তোর এত রাগের কারণটা আমাকে বলবি? নিরীহ, সৎ একজন লোক, হয়তো-বা মুখচোরা, তার বেশি আর কি খারাপ হবে নিমাই বল তো!
তোমরা বুঝবে না। তোমরা সবাই ওর পক্ষে।
আমরাই বা কেন নিমাইয়ের পক্ষে সেটাও কি ভেবেছিস?
তোমরা ওর সততাকে খুব দাম দাও।
সততাকে তুই দাম দিস না?
দেবো না কেন, কিন্তু বেশি-বেশি করলে রাগ হয়। এটা কলিযুগ, সততা দিয়ে কি বাঁচা যায়? কাকা ওকে একটা চাকরি দিয়েছিল, কেন নিল না জানো? ওটা নাকি পাপের টাকার তহবিল। সেই চাকরি পরে আমি নিই।
সেটা কি নিমাই অন্যায় করেছে?
করেছেই তো। তোমার নিমাই হল নিমকহারাম। এতদিন আমারটা খেল-পরল, আমার টাকায় মা বাবার প্রতিপালন করল, আর আমাকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে গেল। এই লোকের কী যে গুণ দেখলে তোমরা!
কৃষ্ণজীবন হঠাৎ প্রশ্ন করে, বনগাঁয়ে তুই কি একা থাকিস?
একা আবার কি? সেখানে আমার নিজের বাড়ি, পাড়া-প্রতিবেশী আছে, চেনাজানা কত লোক। ওকে একা বলে না।
নিমাই আসে না?
আসবার মুখ আছে নাকি?
কৃষ্ণজীবন একটু উদাস হয়ে গিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কাল নিমাই এসেছিল। চেহারাটা ভাল হয়েছে একটু। বেশি কথা বলল না। কিন্তু মুখখানায় এমন একখানা ভাব আছে যাতে ওকে ভাল লাগে। এরকম শুদ্ধ চোখ বড় একটা দেখি না।
কী বলল তোমাকে? আমার নামে লাগায়নি?
কৃষ্ণজীবন মাথা নেড়ে বলে, সেরকম লোকই নয়। তোর কথা তার মনে আছে বলেও তো মনে হল না।
কি করে বুঝলে?
আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
কী জিজ্ঞেস করেছিলে?
তোর সঙ্গে দেখা করেছে কিনা। অবাক হয়ে বলল, আমি তো তার কাছে আসিনি। এ বাড়ির কর্তা আমার গুরুজন, তাঁকে প্রণাম করে চলে যাবো।
এত আস্পর্ধা?
কৃষ্ণজীবন হাসল, আমাকেও প্রণাম করেছে। বাবাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে প্রণাম করেছে।
পাঁচ হাজার?
হ্যাঁ। বাবা অবশ্য নেয়নি। ফিরিয়ে দিয়েছে।
কতক্ষণ ছিল?
আধঘণ্টার বেশি নয়। দোকান খোলা আছে বলে তাড়াতাড়ি চলে গেল।
বীণাপাণি চুপ করে বসে রইল। তার কান্না পাচ্ছে, রাগ হচ্ছে, সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে ইচ্ছে করছে। ভগবান এমন একচোখো কেন? আজ দান উল্টে বীণাপাণির রোজগার বন্ধ, আর ওদিকে নিমাইয়ের বরাত ফিরেছে। এরকম কেন হয়?
কৃষ্ণজীবন হঠাৎ একটু নরম গলায় বলল, আমাকে একটা কথা বলে গেছে নিমাই। তোকে বলার জন্য।
কি কথা?
বলেছে তুই বনগাঁয়ে ফিরে গেলে তোর কোনও অসুবিধে হবে না। বলে গেছে কাকা না কে যেন, তোকে আর কিছু বলবে না। মিটমাট হয়ে গেছে।
তড়িৎস্পর্শে উঠে দাঁড়ায় বীণাপাণি, বারবার খবরটা দিচ্ছে কেন বলল তো! আমার বনগাঁয়ে যাওয়া নিয়ে ওর এত মাথাব্যথা কেন?
তা তো জানি না। আমিও ভাবছিলাম মেসেজটার মধ্যে একটা রহস্যের গন্ধ আছে।
না গো দাদা। কোনও রহস্য নেই। কাকার সঙ্গে আমার একটু মন কষাকষি চলছিল, তাই।
কৃষ্ণজীবন মাথা নেড়ে বলল, তা নয় রে বীণা। আমি বাবার কাছেও কিছু শুনেছি।
কী শুনেছ দাদা?
তোর ডলার আর পাউন্ডের কথা। কাজটা ভাল করিসনি।
বাবাকে কে বলল?
নিমাই, এখান থেকে যেদিন চলে গিয়েছিল মাঝরাতে, বাবার সঙ্গে দেখা হয়। তখন বলেছিল।
ওঃ। বলে বীণা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।
ও টাকা তুই কেন যে বিপদ মাথায় করে নিজের কাছে রেখেছিলি!
ও টাকা তো কারও নয় দাদা।
সে তো ঠিকই। কারও নয়। তার মানে তোরও নয়।
কিন্তু গচ্ছিত ছিল যে।
তাহলেও সেটা যে গচ্ছিত রেখেছিল তার বাড়ির লোকের পাওনা। তোর পাওনা হয় কি করে?
তার বাড়ির লোককে পাবো কোথায়?
খুঁজেছিলি?
না।
ও টাকার জন্য তোকে বোধ হয় অনেক গুনাগার দিতে হল। না?
দাদা, আমি কি তবে চোর?
তুই বোকা।
আমি লোভী, না দাদা?
অভাবে পড়ে হয়তো লোভ করেছিলি।
তুমি আমাকে চোর বলবে না?
বললে কি তুই খুশি হোস?
না, বলোই না, চোর বলতে ইচ্ছে করে কি না।
না। চুরি করিসনি ঠিকই, তবে কাজটাও ভাল হয়নি।
এখন আমি কি করব দাদা?
কৃষ্ণজীবন মৃদু একটু ম্লান হাসি হেসে বলে, অনেক দুঃখের কথা শুনিয়েছিস আজ। তোর বিয়ে, সংসার, জীবনসংগ্রাম সব শুনলাম। কিন্তু এবার তোর সুখের কথাও শুনতে ইচ্ছে করছে।
সুখ কোথায় দাদা? আমার মতো পোড়ারমুখি আর আছে?
অনেক আছে। তোর এখনই বা বয়স কী?
কী করতে বলল আমায়?
আমি বলি নিমাই যা বলে তাই কর। বনগাঁয়ে ফিরে যা। যাত্রাদলের চাকরি গেছে ভালই হয়েছে। আর ওপথে যাওয়ার দরকার নেই।
পেট চলবে কি করে?
পেট চালানোর ভার বাবা যাকে দিয়েছে তার ওপর আর একবার নির্ভর করে দেখ না!
কার কথা বলছ? নিমাই? ওর সঙ্গে আর এ-জীবনে আমার মিল হবে না।
তাহলে যা ভাল বুঝবি করিস।
হ্যাঁ দাদা, তোমাদের নিমাই কাকার সঙ্গে মিটমাটের কথা বলে গেল কেন? ঝগড়া তো আমার সঙ্গে কাকার, নিমাই মাঝখানে আসছে কোথা থেকে?
তা জানি না।
বীণাপাণি সারা দিন কথাটা নিয়ে ভাবল। মিটমাট তো হওয়ার কথা নয়। মিটমাট হবে কি করে?
সারা রাতটা ঘুমহীন কাটল তার। সকালে উঠেই সে বনগাঁয়ে রওনা হয়ে গেল। সরেজমিনে ব্যাপারটা দেখতে হবে। বুটা দুরুদুরু করছে।
ঘোমটা টেনে বাস থেকে এক স্টপ আগে নেমে পড়ল বীণা। তারপর অনেকটা হেঁটে দুপুরে নিজের ঘরে পৌঁছলো। দরজার তালা খুলে ভিতরে ঢুকে স্তব্ধ হয়ে গেল সে। মিটমাট কিভাবে হয়েছে তা বুঝতে আর বাকি থাকল না।
তবু উপুড় হয়ে গর্তটা ভাল করে খুঁজে দেখল বীণা। নেই। তার বুক-বুক করে লুকিয়ে রাখা অত ডলার আর পাউন্ড সব হাওয়া।
মেঝের ওপরই বসে পড়ল বীণা। বুকটা হাহাকারে ভরে গেল। দু’ চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। দুঃখের দিনে ওই লুকোনো যখের ধনের কথা ভেবে কত ভরসা পেত সে। ভাবত সব গেলেও ওটা তো আছে।
আজ কিছু রইল না তার।
কাকাও তাকে আর বিশ্বাস করবে না কখনও।
সারা দিন রান্নাবান্না না করে না খেয়ে চুপ করে শুয়ে রইল বীণা।
বিকেলে তার কাছের প্রতিবেশীর মেয়ে সুমনা এসে বলল, ও মা! তুমি এসেছ বীণাদি! এদিকে কত কাণ্ড হয়ে গেল! তোমার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল।
কী কাণ্ড রে? বলে বীণা উঠে বসল।
তুমি কিছু জানো না?
না তো।
তোমাকে মারবে বলে কাকার দল ঘোঁট পাকিয়েছিল তা জানো?
না। তাও জানি না।
সজলদাকে তো খুব মেরেছে।
বীণা চুপ করে রইল।
ওরা নিমাইদাকেও ধরেছিল। নিমাইদা নাকি তোমার টাকা নিয়ে কাঁচরাপাড়ায় দোকান দিয়েছে। নিমাইদাকেও মারত।
মারেনি!
না। কাকা নিমাইদাকে খুব ভালবাসে তো!
তারপর বল।
নিমাইদা তোমাকে বাঁচানোর জন্য অনেক টাকা দিতে চেয়েছিল কাকাকে। এমন কি দোকান অবধি বিক্রি করতে চেয়েছিল। তা অবশ্য করতে হয়নি।
ঘরে গর্ত করল কে রে?
নিমাইদা এসে তোমার লুকোনো টাকা বের করে কাকাকে দিয়ে দিয়েছে। নইলে নাকি তোমার বিপদ ছিল। হ্যাঁ, বীণাদি, এ নাকি সেই পগার টাকা?
বীণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, একটু জল খাওয়াবি সুমনা? গলাটা শুকিয়ে আছে।
সুমনা দৌড়ে গিয়ে জল এনে দিল। তারপর বলল, তুমি নাকি আর যাত্রা করবে না বীণাদি?
কে জানে কী করব।
সজলদার সঙ্গে কি তোমার বিয়ে হবে?
কে বলেছে?
সবাই বলছে।
না রে। ওসব বাজে কথায় কান দিস না। সজল কেমন আছে জানিস?
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। ভালই আছে বোধ হয়।…
সন্ধের পর সজল নিজেই এসে হাজির। বীণা ঘরদোর ঝাঁটপাট দিয়ে হ্যারিকেন জ্বেলে স্টোভ ধরিয়ে চা করছিল।
সজল এসে বলল, বীণা, কেমন আছ?
আমার জন্য মার খেয়েছ শুনলাম।
তোমার জন্য সব পারি।
তোমার বীরত্বের দরকার ছিল না।
বীরত্ব কে বলল? তোমাকে পালানোর পরামর্শ দিয়েছিলাম বলে এই শাস্তি।
এখন কী হবে বলো তো!
তাই ভাবছি, দুজনেই বেকার।