নবম পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ১৪ই ডিসেম্বর
দক্ষিণেশ্বরে মারোয়াড়ী ভক্তগণসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ
বৈকাল হইয়াছে। মাস্টার ও দু-একটি ভক্ত বসিয়া আছেন। কতকগুলি মারোয়াড়ী ভক্ত আসিয়া প্রণাম করিলেন। তাঁহারা কলিকাতায় ব্যাবসা করেন। তাঁহারা ঠাকুরকে বলিতেছেন, আপনি আমাদের কিছু উপদেশ করুন। ঠাকুর হাসিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মারোয়াড়ী ভক্তদের প্রতি) — দেখ, “আমি আর আমার” এ-দুটি অজ্ঞান। হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা আর তোমার এই সব এর নাম জ্ঞান। আর ‘আমার’ কেমন করে বলবে? বাগানের সরকার বলে, আমার বাগান, কিন্তু যদি কোন দোষ করে তখন মনিব তাড়িয়া দেয়, তখন এমন সাহস হয় না যে, নিজের আমের সিন্দুকটা বাগান থেকে বের করে আনে। কাম, ক্রোধ আদি যাবার নয়; ঈশ্বরের দিকে মোড় ফিরিয়ে দাও। কামনা, লোভ করতে হয় তো ঈশ্বরকে পাবার কামনা, লোভ কর। বিচার করে তাদের তাড়িয়ে দাও। হাতি পরের কলাগাছ খেতে গেলে মাহুত অঙ্কুশ মারে।
“তোমরা তো ব্যবসা কর, ক্রমে ক্রমে উন্নতি করতে হয় জানো। কেউ আগে রেড়ির কল করে, আবার বেশি টাকা হলে কাপড়ের দোকান করে। তেমনি ঈশ্বরের পথে এগিয়ে যেতে হয়। হল, মাঝে মাঝে দিন কতক নির্জনে থেকে বেশি করে তাঁকে ডাকলে।
“তবে কি জানো? সময় নাহলে কিছু হয় না। কারু কারু ভোগকর্ম অনেক বাকি থাকে। তাই জন্য দেরিতে হয়। ফোঁড়া কাঁচা অবস্থায় অস্ত্র করলে হিতে বিপরীত হয়। পেকে মুখ হলে তবে ডাক্তার অস্ত্র করে। ছেলে বলেছিল, মা, এখন আমি ঘুমুই আমার বাহ্যে পেলে তখন তুমি তুল। মা বললে, বাবা, বাহ্যেতেই তোমায় তুলবে, আমায় তুলতে হবে না।” (সকলের হাস্য)
[মারোয়াড়ী ভক্ত ও ব্যবসায়ে মিথ্যাকথা — রামনাম কীর্তন]
মারোয়াড়ী ভক্তেরা মাঝে মাঝে ঠাকুরের সেবার জন্য মিষ্টান্নাদি দ্রব্য আনেন, ফলাদি থাল মিছরি ইত্যাদি। থাল মিছরিতে গোলাপ জলের গন্ধ। ঠাকুর কিন্তু সেই সব জিনিস প্রায় সেবা করেন না। বলেন, ওদের আনেক মিথ্যাকথা কয়ে টাকা রোজগার করতে হয়। তাই উপস্থিত মারোয়াড়ীদের কথাচ্ছলে উপদেশ দিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ, ব্যবসা করতে গেলে সত্যকথার আঁট থাকে না। ব্যবসায় তেজী মন্দি আছে। নানকের গল্পে আছে যে তিনি বললেন, অসাধুর দ্রব্য ভোজন করতে গিয়ে দেখলুম যে, সে-সব রক্ত মাখা হয়ে গেছে। সাধুদের শুদ্ধ জিনিস দিতে হয়। মিথ্যা উপায়ে রোজগার করা জিনিস দিতে নাই। সত্যপথে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়।১
সর্বদা তাঁর নাম করতে হয়। কাজের সময় মনটা তাঁর কাছে ফেলে রাখতে হয়। যেমন আমার পিঠে ফোঁড়া হয়েছে, সব কাজ করছি, কিন্তু মন ফোঁড়ার দিকে রয়েছে। রামনাম করা বেশ। যে রাম দশরথের ছেলে; আবার জগৎ সৃষ্টি করেছেন; আর সর্বভূতে আছেন। আর অতি নিকটে আছেন। অন্তরে বাহিরে।
“ওহি রাম দশরথকী বেটা,
ওহি রাম ঘট ঘটমে লেটা,
ওহি রাম জগৎ পশেরা,
ওহি রাম সব সে নিয়ারা।”
১ সত্যেন লভ্যস্তপসা হ্যেষ আত্মা, সম্যগ্জ্ঞানেন ব্রহ্মর্য্যেণ নিত্যম্। [মুণ্ডকোপনিষদ্ — ৩/১/৫]
সত্যমেব জয়তে নানৃতম্। [মুণ্ডকোপনিষদ্ — ৩/১/৬]