সপ্তম পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ১৪ই ডিসেম্বর
ক্লেশোঽধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্ ৷
অব্যক্তা হি গর্তিদুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে ৷৷
[গীতা — ১২।৫]
ভক্তিযোগ যুগধর্ম — জ্ঞানযোগ বড় কঠিন — “দাস আমি” — “ভক্তের আমি” — “বালকের আমি”
বিজয় (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — মহাশয়! আপনি “বজ্জাৎ আমি” ত্যাগ করতে বলছেন। “দাস আমি”তে দোষ নাই?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, “দাস আমি” অর্থাৎ আমি ঈশ্বরের দাস, আমি তাঁর ভক্ত — এই অভিমান। এতে দোষ নাই বরং এতে ঈশ্বরলাভ হয়।
বিজয় — আচ্ছা, যার “দাস আমি” তার কাম-ক্রোধাদি কিরূপ?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঠিক ভাব যদি হয়, তাহলে কাম-ক্রোধের কেবল আকার মাত্র থাকে। যদি ঈশ্বরলাভের পর “দাস আমি” বা “ভক্তের আমি” থাকে, সে ব্যক্তি কারু অনিষ্ট করতে পারে না। পরশমণি ছোঁয়ার পর তরবার সোনা হয়ে যায়, তরবারের আকার থাকে, কিন্তু কারু হিংসা করে না।
“নারিকেল গাছের বেল্লো শুকিয়ে ঝরে পড়ে গেলে কেবল দাগমাত্র থাকে। সেই দাগে এইটি টের পাওয়া যায় যে, এককালে ওইখানে নারিকেলের বেল্লো ছিল। সেইরকম যার ঈশ্বরলাভ হয়েছে, তার অহংকারের দাগমাত্র থাকে, কাম-ক্রোধের আকারমাত্র থাকে; বালকের অবস্থা হয়। বালকের যেমন সত্ত্ব, রজঃ, তমো গুণের মধ্যে কোন গুণের আঁট নাই। বালকের কোন জিনিসের উপর টান করতেও যতক্ষণ — তাকে ছাড়তেও ততক্ষণ। একখানা পাঁচ টাকার কাপড় তুমি আধ পয়সার পুতুল দিয়ে ভুলিয়ে নিতে পার। কিন্তু প্রথমে খুব আঁট করে বলবে এখন — ‘না আমি দেব না। আমার বাবা কিনে দিয়েছে।’ বালকের আবার সব্বাই সমান — ইনি বড়, উনি ছোট, এরূপ বোধ নাই। তাই জাতি বিচার নাই। মা বলে দিয়েছে, ‘ও তোর দাদা হয়’, সে ছুতোর হলেও একপাতে বসে ভাত খাবে। বালকের ঘৃণা নাই, শুচি-অশুচি বোধ নাই। পায়খানায় গিয়ে হাতে মাটি দেয় না।
“কেউ কেউ সমাধির পরও ‘ভক্তের আমি’, ‘দাস আমি’ নিয়ে থাকে। ‘আমি দাস, তুমি প্রভু’, ‘আমি ভক্ত, তুমি ভগবান’ — এই অভিমান ভক্তের থাকে। ঈশ্বরলাভের পরও থাকে, সব ‘আমি’ যায় না। আবার এই অভিমান অভ্যাস করতে করতে ঈশ্বরলাভ হয়। এরই নাম ভক্তিযোগ।
“ভক্তির পথ ধরে গেলে ব্রহ্মজ্ঞান হয়। ভগবান সর্বশক্তিমান, মনে করলে ব্রহ্মজ্ঞানও দিতে পারেন। ভক্তেরা প্রায় ব্রহ্মজ্ঞান চায় না। ‘আমি দাস, তুমি প্রভু’, ‘আমি ছেলে, তুমি মা’ — এই অভিমান রাখতে চায়।”
বিজয় — যাঁরা বেদান্ত বিচার করেন, তাঁরাও তো তাঁকে পান?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, বিচারপথেও তাঁকে পাওয়া যায়। একেই জ্ঞানযোগ বলে। বিচারপথ বড় কঠিন। তোমায় তো সপ্তভূমির কথা বলেছি। সপ্তভূমিতে মন পৌঁছিলে সমাধি হয়। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা — এই বোধ ঠিক হলে মনের লয় হয়, সমাধি হয়। কিন্তু কলিতে জীব অন্নগত প্রাণ, “ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা” কেমন করে বোধ হবে? সে-বোধ দেহবুদ্ধি না গেলে হয় না। “আমি দেহ নই, আমি মন নই, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নই, আমি সুখ-দুঃখের অতীত, আমার রোগ, শোক, জরা, মৃত্যু কই?” — এ-সব বোধ কলিতে হওয়া কঠিন। যতই বিচার কর, কোন্খান থেকে দেহাত্মবুদ্ধি এসে দেখা দেয়। অশ্বত্থগাছ এই কেটে দাও, মনে করলে মূলসুদ্ধ উঠে গেল। কিন্তু তার পরদিন সকালে দেখ, গাছের একটি ফেঁকড়ি দেখা দিয়েছে! দেহাভিমান যায় না। তাই ভক্তিযোগ কলির পক্ষে ভাল, সহজ।
“ ‘আর চিনি হতে চাই না, চিনি খেতে ভালবাসি।’ আমার এক কখন ইচ্ছা হয় না, যে বলি ‘আমি ব্রহ্ম’। আমি বলি ‘তুমি ভগবান, আমি তোমার দাস’। পঞ্চমভূমি আর ষষ্ঠভুমির মাঝখানে বাচ খোলানো ভাল। ষষ্ঠভূমি পের হয়ে সপ্তমভূমিতে অনেকক্ষণ থাকতে আমার সাধ হয় না। আমি তাঁর নামগুণগান করব — এই আমার সাধ। সেব্য-সেবক ভাব খুব ভাল। আর দেখ গঙ্গারই ঢেউ, ঢেউয়ের গঙ্গা কেউ বলে না। ‘আমিই সেই’ এ অভিমান ভাল নয়। দেহাত্মবুদ্ধি থাকতে যে এ অভিমান করে, তার বিশেষ হানি হয়; এগুতে পারে না, ক্রমে অধঃপতন হয়। পরকে ঠকায় আবার নিজেকে ঠকায়, নিজের অবস্থা বুঝতে পারে না।”
[দ্বিবিধা ভক্তি — উত্তম অধিকারী — ঈশ্বরদর্শনের উপায়
কিন্তু ভক্তি অমনি করলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। প্রেমাভক্তি না হলে ইশ্বরলাভ হয় না। প্রেমাভক্তির আর একটি নাম রাগভক্তি। প্রেম, অনুরাগ না হলে ভগবানলাভ হয় না ঈশ্বরের উপর ভালবাসা না এলে তাঁকে লাভ করা যায় না।
“আর-একরকম ভক্তি আছে। তার নাম বৈধী ভক্তি। এত জপ করতে হবে, উপোস করতে হবে, তীর্থে যেতে হবে, এত উপচারে পূজা করতে হবে, এতগুলি বলিদান দিতে হবে — এ-সব বৈধী ভক্তি। এ-সব অনেক করতে করতে ক্রমে রাগভক্তি আসে। কিন্তু রাগভক্তি যতক্ষণ না হবে, ততক্ষণ ঈশ্বরলাভ হবে না। তাঁর উপর ভালবাসা চাই। সংসারবুদ্ধি একেবারে চলে যাবে, আর তাঁর উপর ষোল আনা মন হবে, তবে তাঁকে পাবে।
“কিন্তু কারু কারু রাগভক্তি আপনা-আপনি হয়। স্বতঃসিদ্ধ। ছেলেবেলা থেকেই আছে। ছেলেবেলা থেকেই ঈশ্বরের জন্য কাঁদে। যেমন প্রহ্লাদ। ‘বিধিবাদীয়’ ভক্তি — যেমন, হাওয়া পাবে বলে পাখা করা। হাওয়ার জন্য পাখার দরকার হয়। ঈশ্বরের উপর ভালবাসা আসবে বলে জপ, তপ, উপবাস। কিন্তু যদি দক্ষিণে হাওয়া আপনি বয়, পাখাখানা লোকে ফেলে দেয়। ঈশ্বরের উপর অনুরাগ, প্রেম, আপনি এলে, জপাদি কর্ম ত্যাগ হয়ে যায়। হরিপ্রেমে মাতোয়ারা হলে বৈধী কর্ম কে করবে?
“যতক্ষণ না তাঁর উপর ভালবাসা জন্মায় ততক্ষণ ভক্তি কাঁচা ভক্তি। তাঁর উপর ভালবাসা এলে, তখন সেই ভক্তির নাম পাকা ভক্তি।
“যাঁর কাঁচা ভক্তি, সে ঈশ্বরের কথা, উপদেশ, ধারণা করতে পারে না। পাকা ভক্তি হলে ধারণা করতে পারে। ফটোগ্রাফের কাচে যদি কালি (Silver Nitrate) মাখানো থাকে, তাহলে যা ছবি পড়ে তা রয়ে যায়। কিন্তু শুধু কাচের উপর হাজার ছবি পড়ুক একটাও থাকেনা — একটু সরে গেলেই, যেমন কাচ তেমনি কাচ। ঈশ্বরের উপর ভালবাসা না থাকলে উপদেশ ধারণা হয় না।”
বিজয় — মহাশয়, ঈশ্বরকে লাভ করতে গেলে, তাঁকে দর্শন করতে গেলে ভক্তি হলেই হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, ভক্তি দ্বারাই তাঁকে দর্শন হয়, কিন্তু পাকা ভক্তি, প্রেমাভক্তি, রাগভক্তি চাই। সেই ভক্তি এলেই তাঁর উপর ভালবাসা আসে। যেমন ছেলের মার উপর ভালবাসা, মার ছেলের উপর ভালবাসা, স্ত্রীর স্বামীর উপর ভালবাসা।
“এ-ভালবাসা, এ-রাগভক্তি এলে স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-কুটুম্বের উপর সে মায়ার টান থাকে না। দয়া থাকে। সংসার বিদেশ বোধ হয়, একটি কর্মভূমি মাত্র বোধ হয়। যেমন পাড়াগাঁয়ে বাড়ি কিন্তু কলকাতা কর্মভূমি; কলকাতায় বাসা করে থাকতে হয়, কর্ম করবার জন্য। ঈশ্বরে ভালবাসা এলে সংসারাসক্তি — বিষয়বুদ্ধি — একেবারে যাবে।
“বিষয়বুদ্ধির লেশমাত্র থাকলে তাঁকে দর্শন হয় না। দেশলাইয়ের কাঠি যদি ভিজে থাকে হাজার ঘষো, কোনরকমেই জ্বলবে না — কেবল একরাশ কাঠি লোকসান হয়। বিষয়াসক্ত মন ভিজে দেশলাই।
“শ্রীমতী (রাধিকা) যখন বললেন, আমি কৃষ্ণময় দেখছি, সখীরা বললে, কই আমরা তো তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না। তুমি কি প্রলাপ বোকচো? শ্রীমতী বললেন, সখি! অনুরাগ-অঞ্জন চক্ষে মাখো, তাঁকে দেখতে পাবে। (বিজয়ের প্রতি) তোমাদের ব্রাহ্মসমাজেরই গানে আছে:
“প্রভু বিনে অনুরাগ, করে যজ্ঞযাগ, তোমারে কি যায় জানা।
“এই অনুরাগ, এই প্রেম, এই পাকা ভক্তি, এই ভালবাসা যদি একবার হয়, তাহলে সাকার-নিরাকার দুই সাক্ষাৎকার হয়।”
[ঈশ্বরদর্শন — তাঁর কৃপা না হলে হয় না]
বিজয় — ঈশ্বরদর্শন কেমন করে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — চিত্তশুদ্ধি না হলে হয় না। কামিনী-কাঞ্চনে মন মলিন হয়ে আছে, মনে ময়লা পড়ে আছে। ছুঁচ কাদা দিয়ে ঢাকলে আর চুম্বক টানে না। মাটি কাদা ধুয়ে ফেললে তখন চুম্বক টানে। মনের ময়লা তেমনি চোখের জলে ধুয়ে ফেলা যায়। “হে ঈশ্বর, আর অমন কাজ করব না” বলে যদি কেউ অনুতাপে কাঁদে, তাহলে ময়লাটা ধুয়ে যায়। তখন ঈশ্বররূপ চুম্বক পাথর মনরূপ ছুঁচকে টেনে লন। তখন সমাধি হয়, ঈশ্বরদর্শন হয়।
“কিন্তু হাজার চেষ্টা কর, তাঁর কৃপা না হলে কিছু হয় না। তাঁর কৃপা না হলে তাঁর দর্শন হয় না। কৃপা কি সহজে হয়? অহংকার একেবারে ত্যাগ করতে হবে। ‘আমি কর্তা’ এ-বোধ থাকলে ঈশ্বরদর্শন হয় না। ভাঁড়ারে একজন আছে, তখন বাড়ির কর্তাকে যদি কেউ বলে, মহাশয় আপনি এসে জিনিস বার করে দিন। তখন কর্তাটি বলে, ভাঁড়ারে একজন রয়েছে, আমি আর গিয়ে কি করব! যে নিজে কর্তা হয়ে বসেছে তার হৃদয়মধ্যে ঈশ্বর সহজে আসেন না।
“কৃপা হলেই দর্শন হয়। তিনি জ্ঞানসূর্য। তাঁর একটি কিরণে এই জগতে জ্ঞানের আলো পড়েছে, তবেই আমরা পরস্পরকে জানতে পারছি, আর জগতে কতরকম বিদ্যা উপার্জন করছি। তাঁর আলো যদি একবার তিনি নিজে তাঁর মুখের উপর ধরেন, তাহলে দর্শনলাভ হয়। সার্জন সাহেব রাত্রে আঁধারে লণ্ঠন হাতে করে বেড়ায়; তার মুখ কেউ দেখতে পায় না। কিন্তু ওই আলোতে সে সকলের মুখ দেখতে পায়; আর সকলে পরস্পরের মুখ দেখতে পায়।
“যদি কেউ সার্জনকে দেখতে চায়, তাহলে তাকে প্রার্থনা করতে হয়। বলতে হয়, সাহেব, কৃপা করে একবার আলোটি নিজের মুখের উপর ফিরাও, তোমাকে একবার দেখি।
“ঈশ্বরকে প্রার্থনা করতে হয়, ঠাকুর কৃপা করে জ্ঞানের আলো তোমার নিজের উপর একবার ধর, আমি তোমায় দর্শন করি।
“ঘরে যদি আলো না জ্বলে, সেটি দারিদ্রের চিহ্ন। হৃদয় মধ্যে জ্ঞানের আলো জ্বালতে হয়। জ্ঞানদীপ জ্বেলে ঘরে, ব্রহ্মময়ীর মুখ দেখ না।”
বিজয় সঙ্গে ঔষধ আনিয়াছেন। ঠাকুরের সম্মুখে সেবন করিবেন। ঔষধ জল দিয়া খাইতে হয়। ঠাকুর জল আনাইয়া দিলেন। ঠাকুর অহেতুক কৃপাসিন্ধু, বিজয় গাড়িভাড়া, নৌকাভাড়া দিয়ে আসিতে পারেন না। ঠাকুর মাঝে মাঝে লোক পাঠাইয়া দেন, আসতে বলেন। এবার বলরামকে পাঠাইয়াছিলেন। বলরাম ভাড়া দিবেন। বলরামের সঙ্গে বিজয় আসিয়াছেন। সন্ধ্যার সময় বিজয়, নবকুমার ও বিজয়ের অন্যান্য সঙ্গিগণ বলরামের নৌকাতে আবার উঠিলেন। বলরাম তাঁহাদিগকে বাগবাজারের ঘাটে পৌঁছাইয়া দিবেন। মাস্টারও ওই নৌকায় উঠিলেন।
নৌকা বাগবাজারের অন্নপূর্ণা ঘাটে আসিয়া পৌঁছিল। যখন বলরামের বাগবাজারের বাড়ির কাছে তাঁহারা পৌঁছিলেন, তখন জ্যোৎস্না একটু উঠিয়াছে। আজ শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথি, শীতকাল, অল্প শীত করিতেছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অমৃতোপম উপদেশ সমরণ করিতে করিতে ও তাঁহার আনন্দমূর্তি হৃদয়ে ধারণ করিয়া বিজয়, বলরাম, মাস্টার প্রভৃতি গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন।