কুলসুমের গলার তেজে বরং ঘুমের রেশটুকু কেটে যায় তমিজের বাপের। ঘুমিয়ে আর দিনমান শুয়ে ক্লান্ত শরীরে বৌকে ধমক দেওয়ার বলও সে পায় না। মেঝেতে বসে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকালে তারার টিমটিমে আলোয় জবুথবু বাইরের উঠানটা একটু করে বাড়ে, কিন্তু তার নিজের জবুথবু ভাব আর কাটে না। সামনের ডোবাটাও মাথা গুঁজে দিয়েছে এই উঠানের ভেতর। ডডাবায় কি ডাঙা জেগে উঠলো? তমিজ কি ডোবা-ফুড়ে-ওঠা এই ডাঙাতেও একদিন লাঙল দেওয়ার নিয়ত করে নাকি? তখন তো এটা চলে যাবে মণ্ডলের দখলে। তমিজ কি তখনো মণ্ডলের বর্গাচাষী হয়েই জীবন কাটাবে? ওদিকে কালাহার বিলে এই যে রোজ রোজ জমি জেগে উঠছে, বিল হয়তো একদিন এই ডোবার মতোই আরেকটি ছোট্টো ডোবার মধ্যে গুটিসুটি হয়ে ধুকতে থাকবে।–তমিজের বাপ জানে, এসব আসলে শালা মণ্ডলের কারসাজি। মণ্ডল মনে হয় উত্তর সিথানের পাকুড়গাছ দখলের তালে আছে। তমিজের বাপের চোখ হঠাৎ করে খচখচ করে, সেখানে কি পড়লো বোঝা যায় না। খচখচ-করা চোখের বন্ধ দুই মণির। মাঝখানে ঠাঁই নেয় কালাহার বিল। ভাদ্রের ভরা বিলে মাঝে মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে,তাতে তার মাথার ভেতরটা চুলকায়। হতে পারে চোখ সাফ করে চোখের কাঁটা তার পৌঁছে গেছে মাথার ভেতরে। সেখানে টনটন করে : ভাদ্রের মেঘের উল্টা টানে কা ৎলাহারের সব পানি বুঝি মেঘ হয়ে হয়ে ওপরে উড়ে যাচ্ছে। উড়তে উড়তে, রাতভর উড়তে উড়তে বেলা উঠবে, সূর্যের তাপে মেঘ আগুন হয়ে জ্বলে ঝুলতে ঝুলতে শুষে নেবে বিলের শেষ জলবিন্দুটি। তারপর আসমান থেকে আগুনের গোলাগুলো দেখবে যে, পানিহারা বিলে শরাফত মণ্ডলের বর্গাচাষীরা হাল বাইছে।–মণ্ডল যদি পাকুড়গাছ পর্যন্ত লাঙল চালায় তো কী হবে? সবটাই মণ্ডলের দখলে গেলে মুনসির পোষা গজার মাছগুলো হয়তো নতুন-ওঠা মাটির তলায় কেঁচো হয়ে কিলবিল করবে। না-কি সেগুলোকে ভেড়ার আকার দিতে না পেরে মুনসি তাদের লোহার আংটা করে গড়িয়ে নিয়ে গেঁথে রাখবে। নিজের গলার শেকলে? অতো সোজা লয়!–চেরাগ আলি বলে গেছে, চেরাগ আলির রুহে ভর করে মুনসিই জানিয়ে গেছে, গজারগুলোকে কেউ উৎপাত করলে এই দুনিয়ার ভাত তার চিরকালের জন্যে উঠে যাবে। গজার মাছের ওপর জুলুম করা অতো সোজা নয়।-তমিজের বাপের সারা শরীরে রক্ত চলাচলের গতি বাড়ে, এই চলাচলের আওয়াজ সে শোনে এইভাবে:
মুনসির হুকুম দরিয়াতে গরজিলে।
কোম্পানি সিপাহি চোক্ষে দ্যাখে আজরাইলে–
কিন্তু ফকির নাই, মুনসির হুকুম আসবে কার মুখ দিয়ে? কতোদূরে কোন কোন গাঁও, কতো চর, কলোকায়েমি চর, কতো নতুন জেগে-ওঠা বিরান চর পেরিয়ে যমুনার সাত স্রোতের টানে টানে, ঊনপঞ্চাশ ঢেউয়ের তালে তালে চেরাগ আলির গান উছলে পড়ে বাঙালি নদীর পানিতে, সেখানে কয়েকটা ড়ুব দিয়ে উঠে মানুষের জোতজমি, জোতদারদের সাথে লাঠালাঠি করা বর্গাচাষাদের রক্তে পিছলা জমির আল পেরোতে পেরোতে মুনসির গান কমজোর হয়ে গড়িয়ে পড়ে কালাহার বিলে। বিলের পানিতে হাবুড়ুবু খেয়ে উঠে এই গিরিরডাঙায় আসতে আসতে গান ঝাপসা হয়ে পড়ে। বৃষ্টিভেজা তারার আলোয় তমিজের বাপের বাড়ির খুলিতে তার ছায়া পড়ে। এই ছায়া ছায়া আলোয় ঐ গান এসেছে কার গলায় সওয়ারি হয়ে ভালো করে খেয়াল করলে ছায়াটিকে পাকুড়তলার সাদা ঘোড়া বলে ঠাহর করা যায়। সারা অঙ্গে তার দুষমনের তীর বেঁধা, সওয়ারি নেওয়ার জন্যে অস্থির সাদা ঘোড়ার গায়ের তীরের ডগাগুলো তিরতির করে কাঁপে। অতো অতো তীরের মধ্যে মুনসি বসবে কোথায় তা ভালো করে বুঝতে না বুঝতে ঘোড়া ছুটতে শুরু করে। ঘোড়ার খুরের আওয়াজ বাজিয়ে তোলে চেরাগ আলি ফকিরের গান :
চান্দ কোলে জাগে গগন পাশে বিবি নিন্দে মগন
খোয়াবে কান্দিলো বেটা না রাখে হদিস।
(ফকির) না রাখে হদিস।
(হায়রে) সিথানে পড়িয়া থাকে কার্পাসের বালিস।
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ঘোড়া করিলো কুর্নিশ।
(ফকির) ঘোড়ায় চড়ি বাহিরিলো নাহিকো উদ্দিশ।।
এখানে কে গান করে গো? ফকির চেরাগ আলি কি ফিরে এলো নাকি? বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলে তমিজের বাপ হয়তো বুঝতে পারতো, কিন্তু হাঁটু ভেঙে বসে দাড়িওয়ালা মুখটা হাঁটুর ওপর রেখে চোখ বন্ধ করে কান বন্ধ করে সে এক মনে গান শোনে :
চান্দ জাগে বাঁশঝাড়ে একটা একটা ডিম পাড়ে
ভাঙা ডিমে হলুদবরণ হইলো সকল ঠাঁই।
উঁকি দিয়া চায়া দেখি ফকির ঘরত নাই।।
না গো, এ তো চেরাগ আলির গলা নয়। তার গলার স্বর তমিজের বাপের মতো এতো ভালো করে চেনে আর কে? গিরিরডাঙায় আসার পর চেরাগ আলির গান প্রায় সব সময় শুনতে সেই মানুষটা কে?-তমিজের বাপ ছাড়া আবার কে? আর থাকতো চেরাগ আলির নাতনি কুলসুম। তা কুলসুমের বয়স তখন কম। দাদার গান শুনে সে নিজেও গাইতো, কিন্তু এইসব গানের কথা বোঝার বয়স কি তখন তার হয়েছে? এখনি কি গানের ভেতরের কথা কিছু ধরতে পারে নাকি? কালাম মাঝির বাশঝাড়ের ছাপরা ঘরের ভেতর বসে গুনগুন করতে করতে মাটিতে দাগ কেটে কেটে লোকটা কতো মানুষের খোয়াবের তাবির বলতো তার আর লেখাজোকা নাই। খোয়াবের মানে খোঁজার ফাঁকে ফাকে কিংবা খোঁজার জন্যেই ফকির একটার পর একটা শোলোক গাইতো। আবার। গোলাবাড়ি হাটে দোতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গেয়ে সে মানুষ জমাতো, মানুষজন জমা হলে শুরু হয়েছে তার স্বপ্নের বয়ান। তার রঙবেরঙের কাপড়ের তালি দেওয়া ঝোলা থেকে বার হতো হেঁড়াখোড় বই, সেই বইয়ের লেখা কি ফকির পড়তো, না-কি তার পাতায় পাতায় আঁকা চৌকো চৌকো সব রেখাগুলো শুনতো তা অবশ্য তমিজের বাপ জানে না। তবে ঐ দাগগুলো সে আঁকতো ঘরের জমিনে। দাগ কেটে কেটে সে মানুষের স্বপ্ন বুঝে ফেলতো। কতো মানুষের কতো কিসিমের খোয়াব!-গোয়াবে কেউ একটা গোরু দেখলো, গোরুটা মোটাতাজা হলে তার মানে এক রকম, আবার রোগা হলে মানে.. অন্য রকম। গোরু জবাই হতে দেখলে তাবির পাল্টে যাবে। স্বপ্নে কাউকে কুকুর তাড়া করেছিলো শুনে চেরাগ আলি হাসতো, লোকটার শত্রু জব্দ হবে। আবার শুধু কুকুর দেখা মানে কঠিন বিপদের আলামত। বাঙালি নদীর ওপারে কোনো এক গাঁয়ের এক জয়িফ বুড়া এক দিনের রাস্তা হেঁটে এসে উপুড় হয়ে পড়েছিলো চেরাগ আলির পায়ে। কী ব্যাপার?—না, সে নিজের বেটার বৌয়ের সঙ্গে জেনা করার স্বপ্ন দ্যাখে সপ্তাহে অন্তত একবার। হাজার তওবা করেও কুলকিনারা করতে না পেরে চেরাগ আলির কাছে ধন্না দেয়। তারপর ধরো কালাম মাঝির নামাজের জামাতে ইমামতি করার স্বপ্ন খুব জোরেসোরে রাষ্ট্র করা হয়েছিলো। কিন্তু কালামের অন্য অনেক খোয়াবের বৃত্তান্ত জানে। এক কালাম আর চেরাগ আলি। শরাফত মণ্ডলও গোলাবাড়ি হাটে একদিন চেরাগ। আলিকে আড়ালে ডেকে খুব গোপনে তার এক স্বপ্নের কথা বলেছিলো। তবে ফকির কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন কারো কাছে ফাঁস করে দেয়নি। বৈকুণ্ঠ তো প্রায় নিত্যি নতুন নতুন স্বপ্নের কথা শোনাতো। নিজের স্বপ্নের কথা শুধু বলেনি তমিজের বাপ। তবে তার আর দোষ কী?—আবোর মানুষ, রাতভর ঘুমের ভেতর যা দেখে আকাশ ফর্সা হলে তার কিছুই মনে থাকে না। গোলাবাড়ি হাটে বৈকুণ্ঠ ছোঁড়াটা প্রায়ই বলতো, তমিজের বাপ, তুমি কথা কও না কিসক? তুমি কী দেখিছো, কও তো? এমনিতে কথা বলতে গেলে তমিজের বাপের সব তালগোল পাকায়, স্বপ্নের কথা সে বলে কী করে? এই বৈকুণ্ঠই ফকিরের ঘরে একদিন চেপে ধরলো, তোমার আজ কওয়াই লাগবি তমিজের বাপ। তুমি বলে দরজার হুড়কা খুল্যা কোটে কোটে যাও? তোমাক ডাক দেয় কেটা, কও তো? কী স্বপন দেখ্যা তুমি বারাও? আজ তোমাক কওয়াই লাগবি।
তখন মাটিতে চৌকো চৌকো দাগ কেটে চেরাগ আলি খুঁজছিলো বৈকুণ্ঠের স্বপ্নের মানে, গুনগুন করে শোলোক বলা স্থগিত রেখে একেকবার বৈকুণ্ঠকে সে কী জিগ্যেস করে আর তাকে জবাব দেওয়ার ফাকে ফাকে বৈকুণ্ঠ খালি খোঁচায়, ক্যা গো, তমিজের বাপ, কল্যা না?
ভোতা চোখে তমিজের বাপ এদিক ওদিক দ্যাখে। অনেকক্ষণ স্থির তাকিয়ে থাকে ঘরের বাইরে। বাঁশঝাড়ের ওপারে বেগুনখেতের বেড়া ডিঙাবার চেষ্টা করে না পেরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালাম মাঝির মাদি ছাগলটা। তমিজের বাপ ওর চোখে কী দ্যাখে? দেখতে দেখতে তার চোখ বুজে খুঁজে আসে। আগের রাতে দ্যাখা স্বপ্নটা মনে করতে সে কি কয়েক পলক ঘুমিয়ে নেবে নাকি? বৈকুণ্ঠের তাগাদায় শেষ পর্যন্ত তাকে মুখ খুলতেই হয়, কাল। বলে সে চুপ করে। কিছুক্ষণ পর স্বপ্নের ভেতর কথা বলার মতো বিড়বিড় করে, না, গো কাল লয়। ঊদিনকা! কিন্তু ঠিক কোন দিন সেটা উল্লেখ না করেই সে ফের বলে, বেনবেলা পান্তা খানু মরিচপোড়া দিয়া, না আঁইটা কলাও বুঝি আছিলো। না, কলা খাছি তার আগের দিন। কলা খাবার দিনটাও ঠিক মনে করার জন্যে সে ফের চুপ করে। কুলকিনারা না পেয়ে বৈকুণ্ঠের দিকে বোবা চোখে তাকালে বৈকুণ্ঠ হেসে ফেলে, কী হলো কও। তমিজের বাপ চমকে উঠে গড়গড় করে বলে, উদিনকা বেনবেলা খাপি জালখান লিয়া বিল গেনু। কয়টা ট্যাংরা পাওয়া গেলো, সাথে দুটা ছাতান আর একটা বেল্যা আছিলো। তমিজের বাপ থামলে তার এই সংক্ষিপ্ত স্বপ্লবয়ানে বৈকুণ্ঠ হতাশ হয়, দুর, ইটা তোমার স্বপন হবি কিসক? তুমি তো লিত্যি কালাহার বিলত যাচ্ছে। বিলত মাছ ধরো না তুমি?
শরাফত মণ্ডল তখনো বিল ইজারা নেয়নি। সুতরাং তমিজের বাপের এটা স্বপ্ন হতে যাবে কেন?
তা হলে ঐদিন রাতে সে দেখলো কী?—মাথা নিচু করে তমিজের বাপ মেঝেতে বসেই থাকে, তার তখন-পর্যন্ত-কালো দাড়ি আরো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্বপ্নের কথা ভাবতে ভাবতে তার ঘুম পায়, ঘুম ঘুম চোখে তার স্বপ্নের লেশমাত্র নাই। তার কানে ঝাপসা হয়ে বাজে, চেরাগ আলির শোলোকের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে বৈকুণ্ঠ গিরি। বৈকুণ্ঠের মুখ ভরা মুড়ি, গানের তোড়ে তার সামনে মুড়ির গুড়ার কুয়াশা। চেরাগ আলির ঘরে আসার সময় কেঁচড় ভরে সে মুড়ি দিয়ে এসেছে। তার মুড়ি খাচ্ছে সবাই,—চেরাগ আলি, কুলসুম, এমন কি তমিজের বাপও। মুড়ি খেতে খেতে আর কথা বলতে বলতে গলা কাঠ হয়ে এলে বৈকুণ্ঠ কুলসুমকে ডাকে, এ কুলসুম, তোর হাতের আমটা দে।
খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে খাল পেরিয়ে গিয়ে বুলু মাঝির বাড়ির পালান থেকে আমটা কুড়িয়ে এনেছে কুলসুম। বৈকুণ্ঠের আবদেরে হুকুমে মুখটা কালো করে সে তার হাতে আম তুলে দেয়। আমের নিচের দিকটা দাঁতে কেটে বৈকুণ্ঠ চুষে চুষে খায় আর বলে, টক আম রে। টকের টক।
কুলসুম মুখ ঝামটা দেয়, হামি তোমাক সাধিছিনু? টক আম তোমাক খাবার কছে। কেটা?
তিয়াস লাগিছে রে ছুঁড়ি। এতোগুলা মুড়ি খালাম, জলতেষ্টা হবি না?
মুশকিল কি, চেরাগ আলির ঘরে বৈকুণ্ঠ জল খেতে পারে না। তার জাত তো আলাদা, পিপাসা পেলেও জাত বাঁচাতে তাকে জলতেষ্টা মেটাতে হয় আম খেয়ে।। এদের ঘরে বৈকুণ্ঠ বসতে পারে, মুড়ি খেতে পারে,-গুড় দিয়ে তো পারেই, এমন কি নুনতেল দিয়ে মাখালেও দোষ নাই। কিন্তু পারে না কেবল জল স্পর্শ করতে। জাতের দোষ হয়ে যাবে। কুলসুম আর একবার মুখ ঝামটা দিলে বৈকুণ্ঠ বলে, ভগবান জাত সিষ্টি করিছে, আমরা সিটা লষ্ট করবার পারি?
তোমার ভগবান মানষের ঘরত আম খাবার হুকুম দিছে, না? ভগবানের লালচ বেশি, পানি খাবার দিবি না, আমেত আপত্তি নাই।
উগলান কথা কওয়া হয় না, কওয়া হয় না। তোর আল্লা যা, হামার ভগবানও তাই। ফারাক খালি নামের। লয় গো ফকিরের বেটা?
আল্লা ও ভগবানের অভিন্ন সত্তা সম্বন্ধে বৈকুণ্ঠের এই সিদ্ধান্তকে ঘাড় নেড়ে অনুমোদন জানাতে জানাতে চেরাগ আলি মেঝেতে আরো কয়েকটি দাগ কাটে এবং নতুন দাগের দিকে কয়েক মিনিট চুপ করে তাকিয়ে থেকে বৈকুণ্ঠকে জিগ্যেস করে, তুই খৈ খাওয়ার স্বপন দেখলু বেনবেলা বেলা ওঠার আগে?
হুঁ। তোমাক আর কী কই, বাবু বাড়ির দিকে ঘাটা ধরিছে আত তখন লওটা বাজে। না-কি দশটাই হবি? না গো, এগারোটার কম লয়। দোকান থেকে তার মনিবের বাড়ি যাবার সময় নির্ণয় করতেই সে অনেকটা সময় নেয়। তারপর তার খলসে মাছ দিয়ে এবং পরে তালের রস আর দুধ দিয়ে ভাত খাবার বিবরণ চলে অনেকক্ষণ ধরে। তারপর হরির নাম দিয়ে শোয়া এবং নিঝুম হাটে মুকুন্দ সাহার দোকানে তার দুই চোখের পাতা কিছুতেই এক করতে না পারার কষ্ট সম্বন্ধে বলতেও তার উৎসাহের কোনো সীমা নাই। এসব খান্ত করে তারপর আসে তার স্বপ্নের প্রসঙ্গ। সকালে মুড়ি খেতে খেতে গত রাতে দেখা স্বপ্নের যে বিবরণ সে দিয়েছিলো এখন তার সঙ্গে যোগ করে মেলা খুচরা ঘটনা। এতে চেরাগ আলির কোনো বিকার নাই, বৈকুষ্ঠের নতুন নতুন সংযোজন শোনে আর মাটিতে তার দাগের সংখ্যা বাড়ে। এর মধ্যে বৈকুণ্ঠ জানায়, স্বপ্নে বৈকুণ্ঠ খৈ খেয়েছিলো মশারির ভেতরে বসে। চেরাগ আলি জানতে চায়, মনে করা কোস। মশারির মদ্যে খৈ খালৈ একরকম, ধারেত বস্যা খাস তো তার মাজেজা আলাদা। খোয়াব ঠিক মতো কবার না পারলে ফুল, খারাপ কলাম। যা দেখিছু ঠিক ঠিক বুঝা শুন্যা কবু।
চেরাগ আলির এরকম প্রশ্ন, মন্তব্য, হুঁশিয়ারি ও ধমকে উৎসাহিত হয়ে বৈকুণ্ঠ একটিমাত্র রাত্রের স্বপ্নের যে দীর্ঘ ও জটিল বিবরণ দেয় তাতে তমিজের বাপ একেবারে মুগ্ধ। কিন্তু চোখের কোণে ও ঠোঁটের বিচিত্র বাঁকাচোরায় চেরাগ আলি ওর স্বপ্নের যে মাজেজা শোনায় তাতে সবাই বোঝে, খৈ খাবার স্বপ্নে বৈকুণ্ঠের ধনদৌলত রোজগারের যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিলো, একই স্বপ্নে মশারির ভেতর ঢুকে বৈকুণ্ঠ তার বিনাশ তো ঘটিয়েছেই, এমন কি বেশ সংকটেই পড়েছে। সর্বনাশের ইংগিত পেয়ে বৈকুণ্ঠ জোরে শব্দ করে টক আমের রস একেবারে শেষ বিন্দুটুকু চুষে খায়। তার নির্বিকার চেহারায় চেরাগ আলির লম্বা দাড়িওয়ালা মুখে মেঘ নামে। মশারির স্বপ্ন আসলে কবরের ইশারা,–কথাটা বলতে বাধোবাধে ঠেকছিলো চেরাগ আলির। এটা সে সরাসরি জানায় কেবল তমিজের বাপকে, তাও তিন দিন পর গোলাবাড়ি হাটে। ওখানেই বৈকুণ্ঠকে ডেকে ফকির শুধু বললো, বৈকুণ্ঠ তোর খোয়বের মাজেজা ভালো লয় রে! পাঁচ আনা পয়সা মুনসির নামে মানত দেওয়া লাগবি। শুনে বৈকুণ্ঠ হাসলে ফকির ধমক দেয়, হাসিস কিসক রে ছোঁড়া? পয়সা কয়টা দে। বড়ো ফাড়া আছে রে তোর!
পাঁচ আনা পয়সা কম নয়। বৈকুণ্ঠ বলে, পয়সা পাই কুটি? কলকাতাত বোমা। পড়িচ্ছে, সেই খবর রাখো? হামার বাবুর বলে ব্যবসা বাণিজ্য লাটে উঠিচ্ছে, তার চোখোত নাই ঘুম। এখন হামাক পয়সা দিবি?
কলকাতায় বোমা পড়ার খবর এবং জাপানিদের অবধারিত বিজয়ের সম্ভাবনায় হাট জুড়ে সেদিন মহা উত্তেজনা, চেরাগ আলির রোজগারপাতি একেবারেই কম। বৈকুণ্ঠের কাছ থেকে একটা সিকি পেলেও সের খানেক চাল, বেগুন আর তেল নুন কেনা যায়। দরগায় গিয়ে মানত পরে দিলেও চলবে। চেরাগ আলি বলে, ছোঁড়া তুই হাসিস? মশারির স্বপন দেখা এখনো তুই হাসিস? দোতারায় টুংটাং তুলতে তুলতে সে খোয়াবে মশারি দেখার শোলোক গায়,
খোয়াবে দেখিল মুসা শয্যাতে মশারি।
শুনিয়া মজনু কান্দে আছাড়ি পিছাড়ি।।
হায় হায় নাহি মোর পুত্রের হায়াৎ।
কেমনে সহিব পুত্রবিয়োগ আঘাত।।
আজরাইলে তিন বোজ তিন রাত দিবে।
তওবা করা আসো বেটা দরগাশরিফে।।
এতোকাল পর ঘরের মেঝেতে বসে বাইরে তারার আলো-ফেলা আবছা আলোর দিকে দেখতে দেখতে তমিজের মাথামোটা মাথার ভেতরে একটানা ঢেউ ওঠে। ঢেউ ওঠে, ঢেউ পড়ে এবং অবিরাম এমনি হতে থাকলে তার চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমে। মেঝেতে সানকিতে বেড়ে-রাখা ভাত ও খেসারির ডালের টান এড়িয়ে সে সটান শুয়ে পড়ে মাচার ওপরে, কুলসুমের গা ঘেঁষে শুতে না শুতে ঘুম নামলো তমিজের বাপের দুই চোখ ঝোঁপে।
তমিজের বাপের ঘুমের মধ্যে চেরাগ আলির গান কিছুমাত্র মিইয়ে যায় না, বরং ফুটতে থাকে আরো কলকল করে। ঐ শোলোক গাওয়া হয়েছিলো বৈকুণ্ঠকে লক্ষ করেই। দ্বিতীয়বার যখন গাওয়া হয় তখন বৈকুণ্ঠও গলা মেলালো তমিজের বাপের সঙ্গে। তার মনিবের ব্যবসার সম্ভাব্য লোকসান কিংবা জাপানিদের বোমা পড়ার ভয় ভুলে সে বেশ জাঁকিয়ে বসেছিলো আসন পেতে। তিন দিন আগে দেখা নিজের স্বপ্ন সে ভুলে গেছে কিংবা ঐ স্বপ্ন চলে গেছে তার নতুন কোনো স্বপ্নের আড়ালে। তমিজের বাপকে নতুন শোলোকটা বারবার গাইতে বললে তমিজের বাপ হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে যায়, বেশ জোর দিয়ে বলে, বৈকুণ্ঠ, পয়সা কয়টা দিয়া দে। স্বপন তোর ভালো লয় রে।
সে কথায় কান না দিয়ে বৈকুণ্ঠ জিগ্যেস করে ফকিরকে, গানটা লতুন শুনলাম। লতুন বান্দিছো? আগে তো শুনি নাই।
গান তো হামি বান্দি না বাবা, কতোবার না তোক কছি। ইগলান হামাগোরে মাদারির গান। ইগলান পাওনা গান। হামরা পাই নাই, হামরা কি আর পাওয়ার মানুষ ইগলান পাছে আগিলা জামানার মুরুব্বিরা। চেরাগ আলির কথার মাঝখানে বৈকুণ্ঠের দিকে তাকিয়ে প্যানপ্যান করে কুলসুম, পয়সাটা দ্যাও না? তোমার জানের মায়া নাই? চার আনাই তো পয়সা। দ্যাও না কিসক?
পয়সা দিলে তোক দিমু। উদিনকা তুই যা টক আম খিলালু, তার দাম শোধ করা লাগবি না? সুদে আসলে ধরলে তোক আধুলি একটা পুরাই দেওয়া লাগে রে।
বৈকুণ্ঠের এইসব ইয়ার্কি মারা কথায় কুলসুমের রাগ হয় না, তার ভয় করে। —মানুষটার কি জানের ভয়ডর কিছু নাই? কাছেই বসে সেদিন কুলসুমের চোখের সেই ভয় দেখছিলো তমিজের বাপ। সে কি আজকের কথা গো? অথচ দেখো, শালা গিরির বেটার জন্যে কুলসুমের সেই সেদিনকার উদ্বেগ এতোকাল পর তমিজের বাপের মাথায় কুটকুট করে কামড়ায়। এই পোকাটিকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতেই সে কাত হয়ে, শোয়, তার মাথা লাগে কুলসুমের বুকে। ঐ বুকে বৈকুণ্ঠের মশারির স্বপ্ন দেখায় তার জন্যে কতোকাল আগেকার উদ্বেগের ছিটেফোঁটা রেশ আছে কি-না, থাকলেও তমিজের বাপের কানে সেটা লাগে কি-না বোঝা মুশকিল। তবে তমিজের বাপের মাথায় ও ঘাড়ে, পাতলা চুলে ও ঘন দাড়িতে কাদার গন্ধে কুলসুমের স্তনজোড়া কেবলি ফুলতে থাকে। কিন্তু তমিজের বাপের মাথায় চেরাগ আলির শোলোক বাজে শিরশির করে, শোলোকের সঙ্গে বৈকুণ্ঠ গিরি গলা মেলাচ্ছে বলেই হয়তো তার মাথার ভেতরটা ভারি হয়ে গড়িয়ে পড়ে কুলসুমের বুক থেকে। সেখানে খট খট করে বাজে শরাফত মণ্ডলের কাঠের খড়মের আওয়াজ। এই আওয়াজে মুনসির মস্ত কালো জাল কি গুটিয়ে পড়ছে নাকি? মুনসি কি কিছুই খেয়াল করে না? পাকুড়গাছে বসে মুনসি এখন করেটা কী?—একবার দেখা দরকার। মুনসিকে এক নজর দেখতে বিলের দিকে যাবার জন্যে তমিজের বাপ মাচা থেকে নামে টলতে টলতে।