নয়
অর্ক দরজা ঠেলতেই মাধবীলতা মুখ তুলল। প্রথমে বিস্ময় ফুটে উঠল চোখে তারপর মুখখানা শক্ত হয়ে গেল। মায়ের এই পরিবর্তন দেখা মাত্র অর্কর ঘাড় টান হল। বুকের ভেতর যে তিরতিরে ভয় ডালপালা মেলছিল প্রাণপণে সেটাকে রুখতে চাইছিল সে।
মাধবীলতার দুটো চোখ এখন জ্বলছে, হিসহিসে গলায় ছিটকে এল প্রশ্ন, ‘কোথায় গিয়েছিলি?’
ভয়টা চট করে বড় হচ্ছে টের পেতেই অর্কর গলা চড়া হল, ‘কেন, বাবা বলেনি তোমাকে?’
‘আমি তোকে প্রশ্ন করছি, তুই জবাব দে।’ মেঝেতে বসা মাধবীলতা সশব্দে সামনে নামিয়ে রাখা ভাতের সসপ্যানটা সরিয়ে দিল এক পাশে।
‘অ্যাকসিডেণ্টের খবর দিতে গিয়েছিলাম। কাল রাত্রে অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছিল, অল্পের জন্যে বেঁচে গিয়েছি।’ শেষের দিকে গলাটা নেমে এসেছিল অর্কর, যতটা নামালে যে শুনছে তার মন নরম হয়।
‘কাল সারাদিন, সারাদিন কোথায় ছিলি?’
‘অনুর মাকে পোড়াতে গিয়েছিলাম। তুমি মাইরি এমন বাতেলা করছ যেন কিছুই জানো না।’ অর্ক খানিকটা বিস্ময়েই হাত নাড়ল।
‘কি বললি?’ একটা বিকট চিৎকার ছিটকে এল মাধবীলতার মুখ থেকে। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল সে। মায়ের এই মূর্তি দেখে আচমকা কুঁকড়ে গেল অর্ক। জিভ জড়িয়ে গেল, কোনরকমে বলল, ‘কি আবার বললাম!’
সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের দিকে ঘুরে দাঁড়াল মাধবীলতা, ‘তুমি শুনতে পেয়েছ? এই তোমার ছেলে যাকে আমি—!’ দাঁতে ঠোঁট চাপল সে! তারপর গোঙানির গলায় বলল, ‘তুই বেরিয়ে যা, আমি তোর মুখ দেখতে চাই না।’
এরকম একটা বাক্যের জন্যে প্রস্তুতি চলছিল অর্কর মনে। কানে ঢোকা মাত্র চ্যালেঞ্জের ভঙ্গীতে বলল, ‘কেন?’
মাধবীলতা প্রশ্নটা শুনে প্রথমে স্তম্ভিত তারপরেই প্রাণ ফিরে পেয়ে ছুটে গেল দরজার কাছে। হাত বাড়িয়ে হিড়হিড় করে ছেলেকে টেনে নিয়ে এল ঘরের মধ্যে। অর্ক কিছু বোঝার আগেই দুহাতে চড় মারতে লাগল ওর গালে মাথায় বুকে। বিস্ময়ের ধকলটা কাটিয়ে ওঠা মাত্র অর্ক হাত তুলে আঘাত বাঁচাবার চেষ্টা করতেই মাধবীলতা আর্তনাদ করে উঠল। জোরে মারতে গিয়ে বেকায়দায় অর্কর কনুইএর হাড়ে তার লোহার নোয়া বেঁকে চামড়ায় মুখ বসিয়েছে। অন্য হাত তখনও অর্ককে খামচে ধরে ছিল।
নিজেকে বাঁচাতেই সেই হাতটাকে টেনে সরিয়ে দিতে মাধবীলতা পিছু হঠে খাটের ওপর গিয়ে পড়ল। অর্ক দেখল মায়ের কবজির ওপর এক বিন্দু রক্ত টলটল করছে।
অনিমেষ এতক্ষণ চুপচাপ কথাবার্তা শুনে যাচ্ছিল। খাটের ঠিক মাঝখানে খালি গায়ে বসে সে রক্তের ফোঁটাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘তুই মায়ের গায়ে হাত তুললি?’
‘আমি মাকে মেরেছি?’ অর্ক ঘাবড়ে গেল যেন।
‘চোখের সামনে ঠেলে ফেলে দিলি আবার মিথ্যে কথা!’
হঠাৎ মাধবীলতা অনিমেষের দিকে মুখ ফেরালো, ‘দোহাই, চুপ করো!’
‘ও তোমাকে, ও তোমাকে—।’ অনিমেষ যেন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।
‘তুমি চুপ করো। আমি যদি একা থাকতাম তাহলে ও কখনই এরকম হতো না।’
‘তার মানে? আমি আসার পর থেকে ও পাল্টেছে?’
‘হ্যাঁ, সেটাই ঘটনা। তুমি তো এখন শালগ্রামশিলা, তোমাকে আর কি বোঝাব।’ মাধবীলতা তর্জনী দিয়ে রক্তের ফোঁটা মুছে নিল।
‘আচ্ছা!’ অনিমেষের কণ্ঠস্বর এখন খ্যানখেনে, ‘আমি যে তোমার বোঝা সে কথাটা এতদিনে মুখ ফুটে বললে!’
‘বোঝা ছিলে না, ক্রমশ বোঝা বানিয়ে নিচ্ছ নিজেকে!’
‘হ্যাঁ, এখন তো আমার অনেক দোষ হবে। আমি হাঁটতে পারি না, কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা রোজগার করি না, তোমার ঘাড়ে বসে খাচ্ছি কথা তো শোনাবেই।’ অনিমেষের বুক বাতাস শূন্য হল।
‘এসব কথা আমি বলিনি। তুমি নিজে ভাবছ।’
‘আর বলতে কি বাকি রাখলে! আমি তো তোমার কাছে আসতে চাইনি, তুমিই ছুটে গিয়েছিলে আমাকে আনতে। আঃ!’
মাধবীলতার চিবুক বুকে গিয়ে ঠেকেছিল। সেই অবস্থায় সে মাথা নাড়ল, ‘এমনভাবে বলোনা, আমি তো তোমাকে কিছুই বলতে চাইনি। সব জেনে শুনেও তুমি একথা বলতে পারলে!’ মাধবীলতা দেখল কবজির চামড়া আবার ভিজে ভিজে দেখাচ্ছে। এখন আর রক্ত ফোঁটা হয়ে ফুটছে না। তিরতিরে হয়ে চামড়ায় ছড়িয়ে পড়ছে।
সে উঠল। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্নান করে নাও। খেয়েদেয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলব।’
গলার স্বর এবং বলার ভঙ্গী যে এখন একদম পাল্টে গেছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না অর্ক কিংবা অনিমেষের। খানিক আগের সেই আক্ষেপে জর্জরিত উত্তেজনা এখন শামুকের মত মুখ লুকিয়েছে। হঠাৎ অত্যন্ত শান্ত কিন্তু কঠিন পাথরের মত হয়ে গেছে মুখের চেহারা। গলার স্বরে যে শীতলতা ফিরে এসেছে তাকে একটুও পছন্দ করে না অর্ক। এত উত্তেজনা কিংবা রাগারাগি যা কিনা এই বস্তির আর পাঁচটা ঘরের মত স্বাভাবিক সেটা কিছুতেই মেলে না মায়ের এই পরিবর্তনের সঙ্গে। কিন্তু অর্ক বুঝতে পারে যে ঝড় আসছে এবং সেই ঝড়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানো অসম্ভব।
মাধবীলতা জামাকাপড় গামছা এবং বালতি নিয়ে ঘর থেকে বের হবার সময় সামান্য দাঁড়িয়ে আবার পা বাড়াল। ওর হাতে নিজের এবং অনিমেষের ময়লা কাপড়। অর্ককে খুলে দিতে বলতে গিয়ে সামলে নিল সে। এতদিন ওর যাবতীয় জামা প্যান্ট গেঞ্জি মায় আণ্ডারওয়ার পর্যন্ত সে কেচে দিত। আজ থেকে আর নয়। দরজার বাইরে পা দিয়ে সে চারপাশে একবার তাকাল। না, কোন ভিড় জমেনি। অর্থাৎ তাদের ঘরের কথা কাউকে আকর্ষণ করেনি। একটু চিৎকারে যদি খেয়োখেয়ির গন্ধ থাকে তাহলে বস্তির মানুষ মাছির মত ভনভন করে। আজ হয়নি এটুকুই শান্তি।
এত বছরে একটা অভ্যেস হল না মাধবীলতার। এই বস্তির আর পাঁচটা মেয়ের মত খোলামেলা হয়ে স্নান করতে আটকে যায় তার। প্রথম দিকে সি এম ডি এ যখন মেয়েদের স্নানের জায়গা আলাদা করে দেয়নি তখন কয়েক মগ মাথায় ঢেলে বুকে গামছা জড়িয়ে ঘরে ফিরে কাপড় ছাড়তো। তারপর অভ্যেস করেছিল অন্ধকার থাকতে ওঠার। কেউ জাগবার আগেই শরীরের প্রয়োজনগুলো চুকিয়ে ঘরে স্থির হয়ে বসা। খুব কষ্ট হত, কোন কোন দিন বেলায় ঘুম ভাঙ্গলে আর গায়ে জল ঢালা হত না। সে সময় মাধবীলতার প্রায়ই শ্রীশ্রীমায়ের কথা মনে পড়ত। বছরের পর বছর ওই মুরগির খাঁচার মত ঘরে দিন রাত বন্দী হয়ে থাকতেন তিনি। দিনের বেলায় প্রাকৃতিক কাজ করার কোন উপায় ছিল না। অন্ধকার থাকতে তাঁকে যেতে হত গঙ্গায়। প্রাতঃকৃত্য করে স্নান সেরে আবার সারাদিনের মত ঢুকতেন খাঁচায়। কষ্ট হয়নি তাঁর? নিয়মটা ভাঙ্গতে ইচ্ছে হয়নি? কোন বই-এ সে খবর পায়নি মাধবীলতা। তবে শ্রীশ্রীমায়ের কথা ভাবলে তখন মনে জোর আসতো। সে একরকম আনন্দ যার খবর আগে জানা ছিল না।
অনুদের দরজার সামনে দিয়ে নীরবে চলে এল মাধবীলতা। ওই দরজার দিকে তাকাতেই শরীর কুঁকড়ে উঠল। গতকালও সেই মহিলা ওখানে ছিলেন। মৃত্যু স্থির। শুধু জীবন তার কাছ থেকে পিছলে পিছলে সাময়িক সরে যেতে চায়। ওই ঘরে সেটা হল না। হয় না।
কল খুলে বালতিটা পেতে দিতেই জলের শব্দ ধক্ করে উঠল! তারপর নিঃসাড়ে শব্দের বয়ে বয়ে যাওয়া। মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না মরতে ইচ্ছে করে না একটুও। তাছাড়া এখন মরলে ওই ধারগুলো শুধবে কে? কিন্তু কেন বেঁচে থাকা? আমি কেন বাঁচবো? মাধবীলতা মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। মেঘ নেই, নীল নেই, একটুও চোখের আরাম নেই। শুধুই ক্যাটকেটে শূন্য। যতই ওপরে যাও কোন স্পর্শ নেই কিংবা গন্ধ। ঠিক জীবনের মত। আগামীকালটার জন্য কেন অপেক্ষা করব তা জানি না। ঘুম ভেঙ্গে আজ যা করেছি তা কাল কেন পুনরাবৃত্তি করব? কোন উত্তর নেই। তবু মরে যেতে ইচ্ছে করে না। কেন যে করে না।
রবিবার ছাড়া এই সময়টা কলতলা খালি থাকে। জামাকাপড় কেচে স্নানের ঘরে ঢুকল সে। সি এম ডি এ মাথায় একটা ছাদ আর চারপাশে পাঁচ ফুট দেওয়াল তুলে দিয়েছে! অল্প বয়সী মেয়েরাই এটাকে ব্যবহার করে। মাধবীলতার বয়সী যারা তারা বাইরেই স্নান সারে। পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে গেলে ওদের লজ্জাবোধ কমে আসে। আসা যাওয়ার পথের পাশে ওই কলের সামনে বসে উদোম পিঠে সাবান ঘষতে কারো কোন সঙ্কোচ হয় না। দরজা বন্ধ করে মগে জল নিতেই মাধবীলতার শরীর আচমকা থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। বুকে চিনচিনে ব্যথা, নিঃশ্বাসে চাপ আর তারপরেই হাউ হাউ কান্নাটাকে দাঁতে দাঁত চেপে সামলালো সে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে, কাঁধ পিঠ, দুই চোখ ঝাপসা। মগের জল পড়ে গেল বালতিতে এবং মাটিতে। বন্ধ স্নানের ঘরের মেঝেতে বসে পড়ল মাধবীলতা। নিজের শরীরটা এখন স্পর্শে এক, কাঁপুনিটা ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। আর তখনই দরজায় কেউ ধাক্কা দিল। এত দ্রুত কান্নাকে লুকোন যায় না। কিন্তু ত্রস্ত হল মাধবীলতা। শরীর উজাড় করে আসা কান্নাকে প্রাণপণে শরীরেই ফেরত পাঠাল।
জামাটাকে একটানে খুলে অর্ক বাবার দিকে তাকাল। অনিমেষ এখন পাথরের মূর্তির মত বসে আছে। অর্ক খাটের সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি মা-কে বলনি কিছু?’
অনিমেষ উত্তর দিল না। বোধহয় প্রশ্নটা তার কানে ঢোকেনি। অর্ক এবার সামান্য গলা তুলল, ‘বাবা!’
এবার অনিমেষ চেতনায় ফিরল। চকিতে ছেলের দিকে তাকাতেই তার কপালে ভাঁজ পড়ল। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে অর্ক তৃতীয়বার প্রশ্ন করতে সাহস পেল না। ময়লা জামা প্যান্ট নিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
এখন অনিমেষ এই ঘরে একা, দরজা হাট করে খোলা। আমি শালগ্রামশিলা! কি আশ্চর্য। আমি সেই অনিমেষ মিত্র যে উত্তাল আন্দোলনে একসময় শামিল হয়েছিল সে নেহাতই জড়ভরত। কে কবে কি করেছিল তা নিয়ে বিচার করে কি হবে, সত্যি যা তা সব সময়েই সত্যি। এখন সে প্রকৃত অর্থেই দায় ছাড়া কিছু নয়। যেটা স্বাভাবিক সেটাকেই মেনে নেওয়া উচিত।
কথাটা গতকাল ছেলের মুখে শুনেও তার চৈতন্য হয়নি। এখন পৃথিবীর অনেক হাত-পা কাটা মানুষ রোজগার করে। সে কেন পারবে না? একটা সিগারেটের দোকান বা ওইরকম কিছু করলে নিশ্চয়ই চালাতে পারবে। অনিমেষ চোখ বন্ধ করে নিজের দোকান করা দেখল। সঙ্গে সঙ্গে একধরনের হীনতাভাব তাকে আচ্ছন্ন করল। একটা সিগারেটের দোকানের মালিক হওয়ার জন্যে কি সে স্কটিশে ভরতি হয়েছিল? অতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল? বিরাট একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল বুক থেকে। অথচ গতকাল ছেলের মুখে সেই পঙ্গু লোকটার দোকান করার গল্প শোনার পর থেকে নিজের রোজগারের কথা মনে হলেই সিগারেটওয়ালা ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না। আচ্ছা, দুটো হাত এবং মস্তিষ্ক দিয়ে আর কি করা যায়?
এই ঘরে অনেক দিন কেটে গেল। কত বছর? হিসেবের দরকার নেই, অর্ককে দেখলেই তো বোঝা যায়। চুপচাপ নিঃসঙ্গ কাটিয়ে যাওয়া! নিঃসঙ্গ? অনিমেষ নিজের ঠোঁট নিজেই কামড়ালো। কেন মাধবীলতা ছিল না? অর্ক ছিল না? ছিল, তবু এই মুহূর্তে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে কেন? এই বস্তির ঘরে আসার পর থেকে মাধবীলতা বারংবার তাকে অনুরোধ করেছে জলপাইগুড়ির চা-বাগানে চিঠি দিতে। যে কোন মেয়েই বোধহয় প্রথমে শ্বশুর শাশুড়ির সংস্পর্শ কামনা করে। কিন্তু প্রবলভাবে আপত্তি করেছিল অনিমেষ। না, শরীরের এই অবস্থায় কাউকেই নিজের অস্তিত্ব জানাতে চায় না সে। বাবার সঙ্গে তার আবাল্য যে ফাঁক ছিল সেটা তখন আরও বড় হয়ে গিয়েছে। ছোটমায়ের কথা মনে পড়ত কিন্তু নিজের শরীর নিয়ে কারো দ্বারস্থ হওয়া মানে তাকে বিব্রত করা, মাধবীলতা যেচে যা কাঁধে নিয়েছে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোন যুক্তি ছিল না। তাই এই বস্তির ঘরে এক ধরনের স্বেচ্ছা নির্বাসনে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ল সে। তখন মনে হত, যদি কখনও শরীর আগের সুস্থতা ফিরে পায় তাহলে সবাইকে নিয়ে জলপাইগুড়িতে বেড়াতে যাবে। এ নিয়ে মাধবীলতার সঙ্গে নানান গল্প হত, সেই গল্প শোনার জন্যে অর্ক কান খাড়া করে থাকতো। একটু একটু করে সে জেনে গিয়েছিল তার ঠাকুরদা-ঠাকুমা যে জায়গায় থাকেন তার নাম স্বৰ্গছেঁড়া। তার একজন বড়দিদা আছেন যিনি চমৎকার পায়েস রাঁধতে পারেন। সেখানে চারধারে যতদূর তাকানো যায় শুধু সবুজের ভিড়, চায়ের বাগান এবং খেলার মাঠ। এক সময় অর্ক বায়না ধরতো সেখানে যাওয়ার জন্যে, অনেক কষ্টে ভোলাতে হত তাকে। একটু বড় হওয়ার পর আর ওসব কথা বলতো না সে, এ নিয়ে আলোচনাও হত না এই ঘরে। সেই সময় অর্ক তো সারাক্ষণই তার কাছে থাকতো। সেই শিশু অবিরাম প্রশ্ন করতো কেন সে হাঁটতে পারে না? প্রথম প্রথম এড়িয়ে যেত। কিন্তু একা থাকতে থাকতে মানুষের মন নিশ্চয়ই দুর্বল হয়ে পড়ে নইলে শুধু কথা বলতে পারার নেশায় কেন সে একে একে সব কথা ওই ছোট্ট ছেলেটাকে বলত? কি করে এই দেশ স্বাধীন হল, কংগ্রেসের রাজত্ব, তার কলকাতায় আসার রাতের ঘটনা, আহত হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা, সি পি এমে যোগ দেওয়া এবং শেষ পর্যন্ত নকশাল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার গল্প শোনাতে সে ছেলেকে। কথাগুলোর অর্থ ধরতে পারতো না অর্ক কিন্তু বারংবার শুনতে চাইতো। আর একই কথা দিনের পর দিন বলতে একটুও ক্লান্তিবোধ করত না অনিমেষ। প্রথম দিকে মনে হত এই সব ঘটনা আর তার সমালোচনা ওই শিশুর মনে নিশ্চয়ই ছাপ রাখছে। এগুলো থেকে ভবিষ্যতে সে পথ চিনে নিতে পারবে। কিন্তু ক্রমশ অর্কর আকর্ষণ বাড়লো সেইসব অংশের ওপর যেখানে অ্যাকশন আছে। সেই ঘটনাগুলোই বারংবার শুনতে চাইতো।
আর একটু বড় হয়ে একদিন স্কুল থেকে ফিরে অর্ক তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বাবা, তুমি মানুষ মারতে?’
‘মানুষ মারতাম?’ অনিমেষ অবাক, ‘কে বলল?’
‘শুনেছি। বল না, কটা মানুষকে মেরেছ তুমি?’
‘কে বলেছে তোকে এসব কথা?’
‘আমার ক্লাসের একটা ছেলে। নকশালরা নাকি দুমদাম মানুষ মারতো। তাই নকশালদের পুলিশ মেরেছে। তাই?’
অনিমেষের খুব রাগ হয়ে যেত। এইসব অপপ্রচার থেকে শিশুদের মুক্ত করা দরকার। ও তখন অর্ককে নিয়ে পড়তো, খুব বিশদভাবে ওকে নকশাল আন্দোলনের লক্ষ্য বোঝাতো। কিন্তু সেটা শুরু করলেই ছটফটানি আরম্ভ হত অর্কর। কিছুতেই কোন গভীর কথাবার্তা পছন্দ হত না তার।
কিন্তু মাধবীলতা বলল সে একা থাকলে অর্ক নাকি এমন হত না। কথাটা কি সত্যি? অনিমেষ ভাবছিল। সে তো অর্ককে বুকে আঁকড়ে রেখেছিল। কখন কোন ফাঁকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জলের মতন মুঠো থেকে বেরিয়ে গেল তা টের পায়নি। কিন্তু তার চেষ্টায় তো কোন ফাঁকি ছিল না। মাধবীলতা এর থেকে বেশি কি পারতো? কিন্তু না, আর নয়, এবার বেরোতেই হবে। পা-দুটো যখন আর কখনই সারবার নয় তখন বাইরের পৃথিবীটাকে একটু দেখা দরকার। অনিমেষের মনে জেদ এল, সে এবার থেকে রোজগার করবে, যেভাবেই হোক।
স্নান সেরে বাইরে বেরিয়ে এল মাধবীলতা। এখন ওর মুখ বেশ শান্ত। সৌন্দর্য চলে যেতে যেতে যেটুকু রয়ে গেছে তাতেই তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। সে দেখল বারোয়ারি কলতলায় অর্ক খাটো প্যান্ট পরে গায়ে জল ঢালছে। অর্ক কল দখলে রাখায় কয়েকজন অপেক্ষা করে আছে। সেই কালো লম্বা মেয়েটা হাঁ করে অর্কর শরীর দেখছে। মেয়েটা মোটেই ভাল নয়। হাব ভাব ভঙ্গীতেই সেই ভাল না হওয়াটা স্পষ্ট। মাধবীলতা মুখ ফিরিয়ে নিল। এই বস্তিতে কেউ নিজে ঠিক না থাকলে ঠিক রাখা মুশকিল। খামোকা চেষ্টা করে কি লাভ।
ঘরের সামনের প্যাসেজটায় একটা তার টাঙানো রয়েছে। কাচা কাপড় মেলতে এসে মাধবীলতা বিব্রত হল। একটুও জায়গা খালি নেই। অথচ কলঘরে যাওয়ার আগে এত কাপড় এখানে ছিল না। এটা অদ্ভুত একরকম জেদাজেদি। সে কলঘরে গিয়েছে মানেই ফিরে এসে কাচা কাপড় মেলবে। এটা জেনেই কেউ না কেউ তাড়াতাড়ি তার দখল করে রেখেছে। মাধবীলতার নজরে পড়ল অর্কর শার্ট এবং প্যান্ট তারের একপাশে ঝুলছে। টপটপ করে জল ঝরছে সেগুলো থেকে। ধোয়ার পর যে জলটা নিংড়োতে হয় সে বোধ পর্যন্ত নেই। কিন্তু আজ যে হঠাৎ নিজেই নিজের জামা কাপড় নিজে কাচল। যদিও মাধবীলতা মুখ ফুটে তখন বলেনি তবু এখন খারাপ লাগছিল। জীবনে বোধহয় আজই প্রথম ছেলেটা এই পরিশ্রম করল।
কাপড়গুলো সরিয়ে সরিয়ে খানিকটা জায়গা বের করে মাধবীলতা নিজের কাচা কাপড়গুলো মেলে দিল। ছড়াতে না পারলেও শুকিয়ে যাবে। ব্রেসিয়ারটা চট করে তারে ঝুলিয়ে ব্লাউজ দিয়ে চাপা দিল সে। নিজের অন্তর্বাস প্রকাশ্যে মেলে ধরতে রুচিতে বাধে তার। অথচ এই বস্তিতে এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কদিন আগে অর্কর প্যান্টের গায়ে অনুর ময়লা ব্রেসিয়ার নেতিয়ে ছিল, দেখে মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল তার।
ঘরে ঢুকে কয়েকটা ক্লিপ নিয়ে সে আবার বেরিয়ে এল। অনিমেষ যে তখনও খাটে বসে আছে টের পেয়েও তাকায়নি। ক্লিপ গুলোয় জামাকাপড় আটকে ঘরে ফিরতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল মাধবীলতা। তারপর অর্কর জামাটা নামিয়ে জল নিংড়ে আবার মেলে দিল। প্যান্টটা নামাতে নামাতে দেখল অর্ক স্নান সেরে দ্রুত পায়ে ফিরছে। ওর হাতে প্যান্ট দেখে যেন আঁতকে উঠল ছেলেটা। প্রায় দৌড়ে এসে বলল, ‘আমার প্যান্ট তুমি ধরো না, ছেড়ে দাও বলছি।’
‘কেন?’ খুব অবাক হল মাধবীলতা।
একটু তোতলালো অর্ক, ‘তুমি তো কাচোনি, আমি কেচেছি।’
‘কেমন কেচেছিস তা তো দেখতেই পাচ্ছি। জলটা যে নিংড়োতে হয় তা জানিস না।’ মাধবীলতা ঈষৎ মুচড়ে জল ঝরাচ্ছিল।
অর্কর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। মায়ের হাত থেকে প্যান্টটা কেড়ে নিতে পারলেই যেন সে বেঁচে যায়। প্রথমে প্যান্টটাকে মাধবীলতার হাতে দেখে সে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। এখন অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখছিল সে। মাধবীলতার বিস্ময় বাড়ছে। ছেলে ওইরকম চোখে প্যান্টের দিকে তাকাচ্ছে কেন? শুধু নিজে কেচেছে এই অহঙ্কারে তাকে স্পর্শ করতে দিতে চায় না, তাই? সে প্যান্টটাকে ঝাড়তেই অর্ক ছোঁ মেরে প্যান্টটা নিয়ে বলল, ‘আমার প্যান্ট আমি মেলব। এখন থেকে কাউকে আমার কাজ করতে হবে না।’
মাধবীলতা হাসল, ‘ভাল। চৈতন্য উদয় হলেই ভাল।’
মা ঘরে ঢুকে গেলে অর্ক দ্রুত হাত ঢোকাল ভেজা প্যান্টের পকেটে। আঙ্গুলের ডগা যে ভেজা কাগজটাকে তুলে নিয়ে এল সেটা যে দশ টাকার নোট তা বুঝতে অসুবিধে হল না। অন্য পকেটে হাত চালালো সে। কিছুই নেই। আবার তন্নতন্ন করে পকেট দুটো দেখে সে পাথর হয়ে গেল। হারখানা নেই।
অবশ ভাবটা কাটতেই সে চকিতে মাটিতে চোখ রাখল। পুরো প্যাসেজটা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে অনুর গলা শুনল সে, ‘কি হারিয়েছে?
সে চোখ তুলে সন্দেহের গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’
‘হারিয়েছে মনে হচ্ছে তাই।’ অনু যে অবাক হয়েছে বোঝা গেল।
অর্ক জবাব দিল না। ওর মাথা ঘুরছিল। ভারী দামী সোনার হার। একটা লকেটও ছিল। সেটা কি হীরের? রাগের মাথায় নিজের জামাপ্যান্ট নিয়ে কলতলায় গিয়ে জলে ডুবিয়েছিল সে। এমন বেহুঁশ যে খেয়ালেই ছিল না হারখানার কথা। নিজের পাছায় নিজেরই লাথি মারতে ইচ্ছে করছিল তার। এই একটু আগে স্নান শেষ করার পর খেয়াল হতেই ছুটে আসছে সে। মায়ের হাতে প্যান্ট দেখে বুক কেঁপে উঠেছিল। আচ্ছা, মা কি হারখানা দেখে সরিয়ে ফেলেছে?
প্যান্টটাকে তারের ওপর ছুঁড়ে ফেলে সে ঘরে ঢুকল। মাধবীলতা তখন চুল আঁচড়াচ্ছে। অর্ক শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি আমার প্যান্টের পকেট থেকে কিছু নিয়েছ?’
‘আমি?’
‘হ্যাঁ!’
‘না তো! কি ছিল?’
‘নাওনি?’
‘কি বলছিস তুই? তোর প্যান্টে এমন কি থাকতে পারে যে আমি নিতে যাব?’ মাধবীলতা ছেলের মুখ দেখে অবাক হয়ে গেল।
অর্ক এবার বিব্রত হল। মা যদি না নিয়ে থাকে তবে কোথায় গেল? শেষ কখন সে হারখানা দেখেছিল মনে করার চেষ্টা করল!
‘কি ছিল তোর পকেটে?’ এবারের প্রশ্ন অনিমেষের।
অর্ক প্রথমে বাবা তারপর মাকে দেখল। সত্যি কথাটা বলবে নাকি? ওরা বিশ্বাস করবে? উঁহু করবে না। বলবে লেকটাউনে খবর দিতে যখন গিয়েছিল তখন হারখানা দিয়ে আসেনি কেন? অথচ এমনভাবে দুজনে তাকিয়ে আছে যে একটা জবাব দেওয়া দরকার। সে মাথা নেড়ে বলল, ‘টাকা ছিল।’
মাধবীলতা চাপা গলায় বলল, ‘টাকা! টাকা কোত্থেকে পেলি তুই? তোর বাঁ হাতে ওটা কি?’
অর্ক মুঠোটা তুলতেই ভেজা কোঁচকানো দশ টাকা স্পষ্ট হল। অনিমেষ বলল, ‘ওই তো। ভিজে গেল কি করে?’
মাধবীলতা বলল, ‘তুই টাকা পেলি কোথায়?’
তোমার কি দরকার বলতে গিয়ে সামলে নিল অর্ক, ‘কাল শ্মশান থেকে ফিরে ওরা রাখতে দিয়েছিল।’
‘কারা?’
‘বিলুরা। অনুর মাকে পোড়াবার জন্যে চাঁদা তুলেছিল।’
কথাটা শুনে মাধবীলতা বিরক্ত হল আরও, ‘যার টাকা তাকে ফেরত দিসনি কেন? খেয়ে উঠেই দিয়ে আসবি।’
অনিমেষ বলল, ‘টাকাটা কার তাই তো সমস্যা, না অর্ক?’
মাধবীলতা বলল, ‘ওসব আমার জানার দরকার নেই, টাকাটা তোর কাছে রাখবি না। কিন্তু হাতে টাকা নিয়ে তুই খুঁজে বেড়াচ্ছিস?’
অর্ক আর কথা বাড়াল না। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। নিশ্চয়ই রাস্তায় পড়ে যায়নি। জামাপ্যান্ট পাল্টাতে পাল্টাতে ওর মনে হল বিলাস সোম যদি সেরে উঠে তার কাছে হারখানা ফেরত চায় সে কি জবাব দেবে? কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। কেউ না। হারখানা খুঁজে বের করতেই হবে, জান কসম!