2 of 3

০৯৫. ইহা কী হইতে চলিয়াছে

“ইহা কী হইতে চলিয়াছে? কী ঘটিবে? জীবনের গতি বিচিত্র সন্দেহ নাই। ইহার বাঁকে বাঁকে অঘটন, বিপর্যয়, রঙ্গ, তামাশা। তবু বলি, আজ আমার জীবনে যাহা ঘটিতে চলিয়াছে তাহা অদৃষ্টপূর্ব বা অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু আমি হইলাম ভাবনকাজি। ভাবিয়া ভাবিয়া মেঘের উপর প্রাসাদ তুলিয়া ফেলি, কিন্তু বাস্তবে কুটাগাছটিও নাড়িতে উদ্যোগী হই না। ঘটনা ঘটাইতে আমার কুণ্ঠা সীমাহীন। বাতায়নে বসিয়া পৃথিবীর রঙ্গতামাশা দেখিব, নিজে তাহাতে যোগ দিব না, ইহাই আমার চিরকালের মনোভাব।

“তবু কপালদোষে আমার মতো কর্মহীন অবসরপ্রিয় নিরুপদ্রব মানুষকে লইয়া পৃথিবীর ঘটনাবলীর তরঙ্গরাশি ছিনিমিনি খেলিতেছে। একটি প্রাচীন বাটির অভ্যন্তরে বহু বৎসরের পুরাতন কালদুষ্ট আবহাওয়ায় আমার আত্মা প্রতিপালিত হইয়াছে। ইহাই আমার পৃথিবী। কাছারিঘরের পিছনে অযত্নলালিত উদ্যানটির মধ্যে আমি প্রকৃতির লীলা প্রত্যক্ষ করিতাম। চাহিদা আমার বিশেষ নাই। পুত্রকন্যারা কেহ প্রতিষ্ঠিত, কেহ বিবাহিত। তাহাদের প্রতি দায়দায়িত্ব তেমন কিছু ছিল না, সম্পর্কও নিতান্তই আলগা। একমাত্র কৃষ্ণকান্ত আমাকে কিছু মায়ায় বাঁধিয়াছিল। এখনও সেই মায়াই আমাকে বিহুল করিতেছে। ইহা ছাড়া আর একটি বন্ধনের কথা স্বীকার করিব। পুরোহিত-কন্যার বালিকাহৃদয় যে-খাতে বহিতে শুরু করিয়াছিল আজও যৌবনপ্রান্তে আসিয়া সে খাতেই বহিতেছে। এই নারীকে সাধ্বী বলিব না তো কাহাকে বলিব? তাহার সেই সাধ্বী অনুরাগকে অবহেলা করার অনেক চেষ্টা করিয়াছি। পারি নাই। আজ বুঝিতেছি একটি ক্ষীণ বন্ধনে সেও আমাকে বাঁধিয়াছে। কুল ভাসায় নাই, সৌজন্য ভাঙে নাই, দেহস্পর্শে আবিল করে নাই। কিন্তু একমুখী লক্ষে বহিয়াছে ঠিকই। আমি তাহার সংযম, তাহার নিষ্ঠা ও সেবাপরায়ণতার প্রশংসা করি। আমি রূপমুগ্ধ নহি, হইলে বলিতাম আমি তাহার রূপানলেও ঝাঁপ দিয়াছি। কিন্তু তবু এই বয়সে পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবার মতো উদ্যম এবং উৎসাহ আমার ছিল না।

“কৃষ্ণকান্তের জন্য উদ্বেগে আমার অভ্যন্তর শুকাইতেছে। জীবনীশক্তি হ্রাস পাইতেছে। বীর পুত্রের জন্য গৌরবের চেয়ে তাহার বিরহ আমাকে কাতর করিয়াছে অনেক বেশি। অপাপবিদ্ধ তাহার কিশোর মুখের শ্রী আমার ভিতরে এক কোমল অভিভূতির সৃষ্টি করিত। কতকাল যেন তাহাকে দেখি না। কৃষ্ণকান্তের ভিতর দিয়াই প্রথম বুঝিলাম, পুত্র কেমন হয়। পুত্রস্নেহ কাহাকে বলে। আমার সেই পরম প্রিয় পুত্র পুলিশের তাড়া খাইয়া, প্রতি মুহূর্তে লাঠি গুলির বিপদের মধ্যে অভুক্ত, অক্ষত, নিরাশ্রয় হাটে মাঠে ঘাটে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আর আমি? আমি মহাসুখে অট্টালিকার নিরাপদ আশ্রয়ে চর্বচোষ্য ভোগ করিয়া গদির বিছানায় দেহ এলাইয়া দিবাস্বপ্ন দেখিতেছি। তাহাও একরূপ সহনীয় ছিল, কিন্তু এই অবস্থায় বিবাহের টোপরটি পরিব কোন মুখে?

“সত্য বটে বিবাহের অনুকুলেও যুক্তি আছে। পুরোহিত-কন্যার জীবন লইয়া আর ছিনিমিনি খেলিবার সময় নাই। এও সত্য দুর্জনের মুখ বন্ধ করিবার নিমিত্ত বিশাখা ও শচীনের বিবাহের আগেই এই কর্মটি চুকাইয়া ফেলা অভিপ্রেত। তবু মন সায় দেয় না। মনে হয়, কী যেন একটি কুকর্ম, পাপকাজ করিতে চলিয়াছি। ইহার ফল বহুকাল ধরিয়া ভোগ করিতে হইবে।

“বিবাহ আজই। বিশ্বাস হয় না। সুনয়নী কবে মরিয়াছে, সেই শূন্য স্থান পূরণ করিতে যাইতেছি, সুনয়নীর আত্মা ব্যথিত হইবে না তো! পুত্রকন্যারা সকলেই কি এই বিবাহ স্বীকার করিবে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, আজ এই পরিণত বয়সে বিবাহ করিয়া আমরা পরস্পরকে কীই বা দিতে পারিব? কেমন যেন ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগিতেছে। মনে কাটার মতো কী যেন বিধিতেছে।

“অবশ্য বিবাহের কোনও আয়োজন নাই, উপকরণ নাই, নিমন্ত্রিত কেহই আসিবেন না। ঠাকুরদালানে পুরোহিত একান্তে শুধু দুই হাত এক করিয়া দিবেন। সাক্ষী থাকিবেন শালগ্রাম শিলা, অগ্নি, গৃহদেবতা। তবু বড় চঞ্চল বোধ করিতেছি।

“একটু আগে বিশাখা আসিয়া আমার মুখের দিকে ক্ষণমাত্র দৃষ্টিক্ষেপ করিয়াছিল। তাহার চোখে বিস্ময়। আমি সভয়ে চোখ নামাইয়া লইলাম। আমাকে চমকিত করিয়া বিশাখা কহিল, বাবা, আপনার গরদের পাঞ্জাবি বের করে রেখেছি।

“আমি কহিলাম, গরদের পাঞ্জাবি কী হবে?

আজ পরতে হবে না?

আজ! আজ কী ব্যাপার?

“বিশাখা নতমুখে কহিল, আমি জানি না। পিসি বলল তাই। কিন্তু বিস্ময়ের কথা তাহার মুখ দেখিয়া মনে হইল না যে সে আমাকে ঘৃণা করিতেছে রাগ করিয়া আছে। অথচ সেটাই তো স্বাভাবিক!

“যাহার এত বড় বিবাহযোগ্য কন্যা আছে তাহার বিবাহ কীরূপ হইবে?

“অনেক ভাবিলাম। ভাবিতে ভাবিতে বেলা কাটিতে লাগিল। একবার মনে হইল নিরুদ্দেশ হইয়া যাই না কেন? গিয়া স্বদেশিদের দলে ভিড়িয়া পড়ি বা সন্ন্যাস গ্রহণ করি। আমাদের বংশে তো ইহা নূতন নহে।

“আবার ভাবিলাম এই সময়ে চপলতা মানায় না। স্থির থাকিতে হইবে। সংযত থাকিতে হইবে।

“পড়ন্ত বেলায় সদাশয়-হাস্য মুখে মাখিয়া ধুতি পাঞ্জাবিতে সাজিয়া রাজেনবাবু আসিয়া হাজির।

কহিলেন, এ কী, এখনও যে প্রস্তুত হননি।

কীসের প্রস্তুত?

“রাজেনবাবু আমার মুখের দিকে চাহিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। কহিলেন, দেখুন, আপনার মতো ভাগ্যবান খুব কম লোকই আছে। লোকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে গেলে তার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউ বড় একটা খুশি হয় না। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে ঘটেছে উলটো।

কীরকম?

স্বয়ং আপনার মেয়েই চায় আপনি বিয়েটা করুন। আমি আপনার হবু বেয়াই, আমিও চাই করুন। কারণ বিশাখার বিয়ের পর আপনি একদম একা হয়ে যাবেন। আমরা আপনাকে এক অসহায় অবস্থায় ফেলতে পারি না। অনেক আলোচনা, গবেষণার পরই আমরা সর্বান্তঃকরণে এই বিয়ে অনুমোদন করেছি। এবার আপনি অনুমোদন করলেই হয়।

“বুঝিলাম মনু সব দিক দিয়া আঁট বাঁধিয়া লইয়াছে। সে কিছুতেই আমার মুখে চুনকালি লেপন হইতে দিবে না। তবু বিশাখা কেন অনুমোদন করিল তাহা ভাবিয়া পাইলাম না। কিন্তু কৃতজ্ঞ বোধ করিলাম।

“রাজেনবাবু তাড়া দিলেন, উঠুন, উঠুন, লগ্নের বেশি দেরি নেই। আমার গিন্নিও আসছেন।”

আমি ব্যথিত হইয়া কহিলাম, এই তামাশায় আবার তাকে কেন?

রাজেনবাবু সহাস্যে কহিলেন, তামাশা হবে কেন? তিনি এয়োর কাজ করতে আসবেন। ব্যাপারটা আমাদের কাছে তামাশা নয়। আমরা আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।

“বিশ্বাস হইল না। মনে হইল ইহারা রঙ্গ দেখিতেই আসিয়াছেন। আমাকে লইয়া পরে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা বিদ্রুপ করিবেন। শেষ অবধি জল কোথায় গড়াইবে?

“এক এক সময়ে মানুষের স্বীয় বুদ্ধি লোপ পায়। ভাবিয়া কূল করা যায় না। আমারও আজ সেই অবস্থা। মস্তিষ্ক অসাড়, মন জড়বৎ, দেহ শক্তিহীন। আমার যেন এক কঠিন অসুখে বিকারের মতো অবস্থা। চারদিকে যাহা সব দেখিতেছি তাহা যেন স্বপ্নবৎ এবং অপ্রাকৃত।

“উঠিলাম। কিছু বেশবাস করিতে হইল। রাজেনবাবুর স্ত্রী আসিলেন। অবশ্য তাঁহার অবগুণ্ঠিত মুখের ভাবটি দেখিতে পাইলাম না। বিশাখার সহিত নিচু স্বরে কথা কহিতে কহিতে ঠাকুরদালানের দিকে চলিয়া গেলেন।

“রাজেনবাবু বলিলেন, শচীনেরও আসার কথা।

“যোলোকলায় পূর্ণ হয় তাহা হইলে। ভাবী জামাতা বাবাজীবন শ্বশুরের বিবাহ দেখিতে আসিতেছে, ইহা অপেক্ষা কি মৃত্যু শ্রেয় ছিল না!

“রাজেনবাবু আমার মুখের ভাব দেখিয়া মনের কথা অনুমান করিয়া কহিলেন, আপনি বড় বিমর্ষ হয়ে আছেন। রঙ্গময়ির দিকটাও তো ভাববেন! বহুকাল ধরে সে আপনার পরিচর্যা করে আসছে। বিয়ে অবধি হল না। তার একটা সামাজিক পরিচয়ের কি দরকার নেই।

“জবাব দিলাম না।

“রাজেনবাবু নিজেই কহিলেন, বলতে পারেন শচীনই একরকম এই বিয়ের হোত। আমরা সেকেলে লোক, সে শিক্ষিত এবং আধুনিক স্বভাবের। কাজেই সে আমাদের কাছে সব কিছু বুঝিয়ে বলেছে। রঙ্গময়িকেও সে রাজি করিয়েছে। শুধু আনাকে রাজি করানোর সাহস দেখায়নি। সে ভার রঙ্গময়ি নিয়েছিল। অযথা শচীনের জন্য সংকোচ বোধ করবেন না।

“একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলাম। বাড়ির চাকর বাকর দাসদাসী এবং কর্মচারীরাও আছে। তাহারাও জানিবে। লজ্জায় যে কী করিয়া তাহাদের কাছে মুখ দেখাইব তাহা বুঝিতেছি না।

“ঠাকুরদালানে যখন পৌছিলাম তখন চারিদিক অন্ধকারে ঢাকিয়াছে। মস্ত বারান্দায় স্নিগ্ধ দীপ জ্বলিতেছে। যজ্ঞকাষ্ঠ ও অন্যান্য উপকরণ প্রস্তুত। একধারে বিশাখা ও রাজেনবাবুর স্ত্রী বসিয়া আছে। বিনদচন্দ্র কিছু উদ্বিগ্ন, তটস্থ। একখানা পুঁথিহাতে বসিয়া ছিলেন, আমাদের দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

“যখন আসন গ্রহণ করিলাম তখন মনে হইতেছিল যূপকাষ্ঠে আমাকে ফেলিয়া বলির আয়োজন চলিয়াছে। বিনোদচন্দ্ৰ কহিলেন, বিবাহ শাস্ত্রমতেই হবে। স্ত্রী-আচারগুলো বাহুল্য বলে বাদ দিচ্ছি।

“আমি মাথা নাড়িয়া সম্মতি দিলাম।

“যখন বিনোদচন্দ্রের রুণা স্ত্রী তাহার কন্যাকে বিবাহস্থলে লইয়া আসিলেন তখন আমি সেদিকে দৃকপাত করিতে পারি নাই। অধোবদমে বসিয়া নিজের শ্রাদ্ধ করিতেছিলাম।

“কিন্তু দৃকপাত করিতে হইল। একটি রক্তাভ রেশমি বন্ত্রে অঙ্গ আচ্ছাদন করিয়া, ঘোমটা দিয়া মনু যখন আমার হস্তে সমর্পিতা হইতেছিল তখন একবার চারচোখে মিলন ঘটিল।

“চন্দনচর্চিত মুখ, একটু রূপটানের প্রলেপ, কাজল সবই ছিল। কিন্তু তাহার চেয়েও অনেক বেশি যে জিনিসটি প্রকটিত হইতেছিল তাহা অভ্যন্তরীণ এক দীপ্তি! নারীর নিজস্ব দীপ্তি থাকিতে পারে। থাকেও। কিন্তু পুরুষের দ্বারাই বুঝি সে প্রকৃত দীপ্তি পায়। আজ রঙ্গময়ির মুখে যে দীপ্তি দেখিলাম তাহা আর কখনও দেখি নাই। সে আনন্দিত মুখশ্রী একটু ফুৎকারে আমার সব দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব উড়াইয়া দিল, বুকে বল আসিল। মনে হইল, আমার এই অপ্রতিভ পরিস্থিতিতে আর কেহ না থাকে, পাশটিতে তো মনু থাকিবে। তাহার উপর আমি কি সর্বাধিক নির্ভরশীল নহি?

“বিবাহ হইয়া গেল।

“এই বিবাহে বাসর জাগিবার দায় নাই। সকলে বিদায় লইল। শচীন ঠাকুরদালানে ওঠে নাই। একটু দূরে সাইকেলে ভর রাখিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। উঠানে স্বল্প আলোয় দাসদাসী ও কর্মচারীরাও উপস্থিত ছিল। কিন্তু আমার আর ততটা সংকোচ বোধ হইতেছিল না। মনুর স্পর্শে আমার ভিতরে তাহার তেজ ও সাহস সংক্রামিত হইয়াছে।

“বিবাহের পর যখন দুইজনে জোড়ে হাঁটিয়া ঘরে আসিলাম তখন এক আশ্চর্য অনুভূতি হইতেছিল। ভাঁটানো বয়সে বেশ আবার জোয়ার লাগিয়াছে। মনে হইতেছে পৃথিবীর দুঃখ, সন্তাপ, দুর্দৈবের সহিত আরও বহুকাল সংগ্রাম করিতে পারিব।

“সামান্য কিছু আহার করিয়া একটু অধিক রাত্রে আমরা এক শয্যায় রাত্রিবাস করিতে ঘরে ঢুকিলাম। মনু দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া ঘোমটা সরাইয়া আমার দিকে তীব্র চোখে চাহিয়া কহিল, অমন করছিলে কেন?

তটস্থ হইয়া কহিলাম, কেমন?

চোরের মতো বসে থেকে এমন একখানা ভাব করছিলে যেন কেউ তোমাকে ধরেবেঁধে বিয়ে করতে বসিয়েছে।

একরকম তাহাই। তবু মুখে হাসি টানিয়া কহিলাম, হঠাৎ ঘটে গেল তো, তাই।

মোটেই হঠাৎ নয়। আমাদের এই বিয়ে বহুকাল আগে থেকেই ঘটে ছিল। শুধু অনুষ্ঠানটুকু হল আজ। বলো তাই কি না!

কী আর কহিব! বলিলাম, তাই হবে, মনু। আমি কেমন তা তো জানোই।

জানি বলেই তো এই কাণ্ড করলাম। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এ ছাড়া পথ ছিল না।

“গভীর রাত্রি পর্যন্ত দুজনে নানা কথা কহিলাম। সেসব কোনও প্রেমালাপ নহে। ঘরসংসারের কথা, কৃষ্ণর কথা, ছেলেমেয়েদের কথা, সুনয়নীর কথাও। আমাদের নূতন কথা তো কিছুই নাই। তবু পুরাতন সব কথার মধ্যেই একটু নূতনের সুর লাগিতেছিল।

“আমরা একই শয্যায় পাশাপাশি শয়ন করিলাম। কিন্তু কেহই দেহের সীমানা লঙঘন করিলাম। এমনকী একটি চুম্বনও নহে। বড় লজ্জা ও সংকোচ হইতেছিল।

“পরদিন সকাল হইতে না হইতেই মনু সংসারের চারদিক সামাল দিতে ঝাপাইয়া পড়িল। এখন সে আর নিতান্ত পুরোহিকন্যা নহে, সে এ বাড়ির গৃহিণী। তাহার গৃহিণীপনা দেখিবার মতোই। এমন সুচারুভাবে সে সবকিছু গোছগাছ করিতে লাগিল যে আমি ভরসা পাইলাম।

“দ্বিপ্রহরে একান্তে সে আমাকে বলিল, শোনো, আমরা কিন্তু এখানে থাকব না।

কোথায় থাকবে?

কাশীতে লোক পাঠাও।

কাশী!

হ্যাঁ। আমাদের বাড়িটা সেখানে ফাঁকা পড়ে আছে। লোক গিয়ে সেটা মেরামত করতে থাকুক। বিশাখার বিয়ের পরই আমরা চলে যাব।

সেটাই কি ঠিক হবে?

হবে। এস্টেট শচীন দেখবে। তোমাকে ভাবতে হবে না।

“চুপ করিয়া গেলাম। মনু যাহা বলে তাহা ঠিকই বলে। তাহার পরামর্শ শুনিয়া আমার কখনও ক্ষতি হয় নাই।

“কালরাত্রি কাটিয়া ফুলশয্যা আসিল। কীরূপে সেই রাত্রির বর্ণনা করিব? আমার ভিতরে যে পুরুষ এতকাল নিদ্রিত ছিল, সুনয়নীর সংস্পর্শেও যাহার ঘুম পুরাপুরি ভাঙে নাই, সেই পুরুষটিকেই যেন মনু আজ জাগাইয়া তুলিল। কাম ও প্রেমের মধ্যে পার্থক্য যোজনবিস্তার। কাম তত যে কোনও নারী-পুরুষেই সংঘটিত হইতে পারে। কিন্তু দুটি নরনারী যখন যুগক্ষয়ি প্রতীক্ষার ভিতর দিয়া পরস্পরকে প্রার্থনা করে এবং কালের সকল নিয়মকে উপেক্ষা করিয়া অনুরাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তখন তাহাদের মিলনে অবশ্যই দেবলোকের স্পর্শ, গন্ধ, শব্দ নামিয়া আসে।

“আমি দুঃখী, ক্লিষ্ট, বিগতপ্রায়-যৌবন পুরুষ। মনুও বালিকা নহে। তাহারও জীবন প্রাপ্তিশূন্য। দুই ক্ষতবিক্ষত হৃদয় এবং বয়স্ক শরীরের সেই মিলন ভাষায় বর্ণনার অতীত। আমরা কেবল পরস্পরের মধ্যে পরস্পর বিলীন হইয়া যাইতে লাগিলাম। কদিলাম, হাসিলাম, কত স্মৃতি রোমন্থন করিলাম। অবশেষে পরস্পরকে সুদৃঢ় বাহুপাশে কাঙালের মতো আঁকড়াইয়া ধরিয়া কখন যেন ঘুমাইয়া পড়িলাম।

“মাত্র একটি মাস পরেই বিশাখার বিবাহ। সুতরাং আর সময় নাই। পরদিন হইতেই বাড়িতে মনু রাজমিস্ত্রি লাগাইল। বিবাহের খরচের জন্য শচীন এস্টেটে ঘুরিতে বাহির হইল। আমাকেও নানা মহালে যাইতে হইল।

“কাশীতে লোক পাঠানো হইয়াছে। বাড়ি মেরামতের কাজ সেখানে চলিতেছে। সুতরাং নানা বিষয়কর্মে আমাকে বিশেষরকম ব্যস্ত হইয়া পড়িতে হইল। মোটামুটি দাম পাইয়া একটি মহাল বিক্রি করিয়া দেওয়া গেল। বড় এস্টেটের ঝামেলা অনেক।

“সুখেই কয়েকটা দিন কাটিল। তাহার পরই সংসারের একটা কুৎসিত দিক অকস্মাৎ ভদ্রতা ও সৌজন্যের মুখোশ খুলিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল।

“বিশাখার বিবাহ উপলক্ষে আমার ছেলেমেয়েরা আসিয়া উপস্থিত হইতে শুরু করিয়াছে। বউমা, ছেলেমেয়ে সকলেই আসিতেছে। সকলেরই মুখ গম্ভীর। ভ্রুকুটি, বাক্যহীনতা।

“ঘরে মনু গৃহিণীর আসনে আসীনা, এই দৃশ্য কেহই সহ্য করিতে পারিতেছে না। প্রত্যেকের মুখেই মূক প্রশ্ন, এ কে? এ এখানে কেন? কে ইহাকে অন্দরমহলে স্থান দিয়াছে?

“জানি প্রশ্নগুলি সঙ্গত। কারণ মনুর ভূমিকার এই পরিবর্তন তাহাদের কাছে অপ্রত্যাশিত, অভিনব। মনে মনে এই সকল সম্ভাব্য প্রশ্নের কী জবাব দিব তাহা অনেক মহড়া দিয়াছি। কিন্তু কার্যকালে নীরবতা ছাড়া আর কিছুই অবলম্বন করার ছিল না। কারণ আমাকে কেহ কোনও প্রশ্ন করে নাই।

“বিশাখার বিবাহের তিন দিন আগে অকস্মাৎ বোমাটি ফাটিল। তাহার বিস্ফোরণ আমাকে আমৃত্যু তাড়া করিবে। সংসার যে কীরূপ কঠিন ঠাই তাহা আর-একবার আমার কাছে উদঘাটিত হইল।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *