তৃতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ১৯ই নভেম্বর
শ্রীযুক্ত মনোমোহন ও শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রের বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ
পরের রবিবারে (১৯শে মভেম্বর ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ) ৺জগদ্ধাত্রীপূজা, সুরেন্দ্র নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। তিনি ঘর বাহির করিতেছেন — কখন ঠাকুর আসেন। মাস্টারকে দেখিয়া তিনি বলিতেছেন, “তুমি এসেছ, আর তিনি কোথায়?” এমন সকয় ঠাকুরের গাড়ি আসিয়া উপস্থিত। কাছে শ্রীযুক্ত মনোমোহনের বাড়ি, ঠাকুর প্রথমে সেখানে নামিলেন, সেখানে একটু বিশ্রাম করিয়া সুরেন্দ্রের বাড়িতে আসিবেন।
মনোমোহনের বৈঠকখানায় ঠাকুর বলিতেছিলেন, “যে অকিঞ্চন, যে দীন, তার ভক্তি ঈশ্বরের প্রিয় জিনিস। খোল মাখানো জাব যেমন গরুর প্রিয়! দুর্যোধন অত টাকা অত ঐশ্বর্য দেখাতে লাগল; কিন্তু তার বাটীতে ঠাকুর গেলেন না। তিনি বিদুরের বাটী গেলেন। তিনি ভক্তবৎসল, বৎসের পাছে যেমন গাভী ধায় সেইরূপ তিনি ভক্তের পাছে পাছে যান।”
ঠাকুর গান গাহিতেছেন:
যে ভাব লাগি পরম যোগী, যোগ করে যুগ-যুগান্তরে।
হলে ভাবের উদয় লয় সে যেমন লোহাকে চুম্বক ধরে।
“চৈতন্যদেবের কৃষ্ণনামে অশ্রু পড়ত। ঈশ্বরই বস্তু, আর সব অবস্তু। মানুষ মনে করলে ঈশ্বরলাভ করতে পারে। কিন্তু কামিনী-কাঞ্চন ভোগ করতেও মত্ত। মাথায় মাণিক রয়েছে তবু সাপ ব্যাঙ খেয়ে মরে!
“ভক্তিই সার। ঈশ্বরকে বিচার করে কে জানতে পারবে। আমার দরকার ভক্তি। তাঁর অনন্ত ঐশ্বর্য অত জানবার কি দরকার? এক বোতল মদে যতি মাতাল হই শুঁড়ির দোকানে কত মন মদ আছে, সে খবরে আমার কি দরকার? একঘটি জলে আমার তৃষ্ণার শান্তি হতে পারে; পৃথিবীতে কত জল আছে, সে খবরে আমার প্রয়োজন নাই।”
[সুরেন্দ্রের দাদা ও সদরওয়ালার পদ — জাতিভেদ — caste system and problem of the Untouchables solved — Theosophy]
শ্রীরামকৃষ্ণ এইবার সুরেন্দ্রের বাড়িতে আসিয়াছেন। আসিয়া দোতলার বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। সুরেন্দ্রের মোজোভাই সদরওয়ালা, তিনিও উপস্থিত ছিলেন। অনেক ভক্ত ঘরে সমবেত হইয়াছেন। ঠাকুর সুরেন্দ্রের দাদাকে বলিতেছেন, “আপনি জজ, তা বেশ; এটি জানবেন সবই ঈশ্বরের শক্তি। বড় পদ তিনিই দিয়েছেন, তাই হয়েছে। লোকে মনে করে আমরা বড়লোক; ছাদের জল সিংহের মুখওয়ালা নল দিয়ে পড়ে, মনে হয় সিংহটা মুখ দিয়ে জল বার কচ্ছে। কিন্তু দেখ কোথাকার জল। কোথা আকাশে মেঘ হয়, সেই জল ছাদে পড়েছে, তারপর গড়িয়ে নলে যাচ্ছ; তারপর সিংহের মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে।”
সুরেন্দ্রের ভ্রাতা — মহাশয়, ব্রাহ্মসমাজে বলে স্ত্রী-স্বাধীনতা; জাতিভেদ উঠিয়ে দাও; এ-সব আপনার কি বোধ হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বরের উপর নূতন অনুরাগ হলে ওইরকম হয়। ঝড় এলে ধুলো ওড়ে, কোন্টা আমড়া, আর কোন্টা তেঁতুলগাছ, কোন্টা আমগাছ বোঝা যায় না। ঝড় থেমে গেলে, তখন বোঝা যায়। নবানুরাগের ঝড় থেকে গেলে ক্রমে বোঝা যায় যে, ঈশ্বরই শ্রেয়ঃ নিত্যপদার্থ আর সব অনিত্য। সাধুসঙ্গ তপস্যা না করলে এ-সব ধারণা হয় না! পাখোয়াজের বোল মুখে বললে কি হবে; হাতে আনা বড় কঠিন। শুধু লেকচার দিলে কি হবে; তপস্যা চাই, তবে ধারণা হবে।
“জাতিভেদ? কেবল এক উপায় জাতিভেদ উঠিতে পারে। সেটি ভক্তি। ভক্তের জাতি নাই। অস্পৃশ্য জাত শুদ্ধ হয় — চণ্ডাল ভক্ত হলে আর চণ্ডাল থাকে না! চৈতন্যদেব আচণ্ডালে কোল দিয়েছিলেন।
“ব্রহ্মজ্ঞানীরা হরিনাম করে, খুব ভাল। ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তাঁর কৃপা হবে, ঈশ্বরলাভ হবে।
“সব পথ দিয়েই তাঁকে পাওয়া যায়। এক ঈশ্বরকে নানা নামে ডাকে। যেমন একঘাটের জল হিন্দুরা খায়; বলে জল; আর-একঘাটে খ্রীষ্টানরা খায়, বলে ওয়াটার; আর-একঘাটে মুসলমানেরা খায়, বলে পানি।”
সুরেন্দ্রের ভ্রাতা — মহাশয়, থিওজফি কিরূপ বোধ হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — শুনেছি নাকি ওতে অলৌকিক শক্তি (Miracles) হয়। দেব মোড়লের বাড়িতে দেখেছিলাম একজন পিশাচসিদ্ধ। পিশাচ কত কি জিনিস এনে দিত। অলৌকিক শক্তি নিয়ে কি করব? ওর দ্বারা কি ঈশ্বরলাভ হয়? ঈশ্বর যদি না লাভ হল তাহলে সকলই মিথ্যা!