1 of 2

০৮. রানী রাসমণির জেদ

রানী রাসমণির জেদ শেষ পর্যন্ত রক্ষিত হয়েছে। এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন মহা সমারোহে।

সমারোহ মানে কী, তেমনটি আর কেউ কখনো দেখেনি। বাংলায় ধনী ব্যবসায়ী ও জমিদার তো কম নেই, কিন্তু আর কেউ এত বৃহৎ দেবালয়ের প্রতিষ্ঠাও করেননি, এ রকম বিপুল উৎসবের আয়োজনও কেউ করতে পারেননি শুধু অর্থ থাকলেই হয় না, সেই অর্থব্যয় করার মতন অন্তঃকরণও থাকা দরকার।

সময়ে, যখন হিন্দুধর্ম নানাদিক থেকে বহু রকম আক্রমণে পর্যুদস্ত। অনেক হিন্দু শাস্ত্র এবং সংস্কৃত গ্ৰন্থ অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল প্রায়, ইংরেজ পণ্ডিতগণই তা উদ্ধার করেন। আবার এক শ্রেণীর ইংরেজ সেই সব শাস্ত্র ঘেঁটেই প্রমাণ করতে চান যে, হিন্দু ধর্মের মধ্যে কত রকম বর্বর প্রথা ও বিশ্বাস রয়েছে। খৃষ্টান মিশনারিরা হিন্দু ধর্মের অকাট্য সব দোষ তুলে ধরেছেন ভারতবাসীর সামনে এবং সেই সুবাদে তাদের আকৃষ্ট করছেন খৃষ্টধর্ম গ্ৰহণ করতে। অন্যদিকে ব্ৰাহ্মরাও হিন্দু ধর্মের নানান ত্রুটির কথা প্রচার করছেন, দেব-দেবীরা তাঁদের চক্ষে পুতুল মাত্র, এবং এই পুতুল পূজা তাঁদের কাছে দু-চক্ষের বিষ। শুধু কি তাই, সম্প্রতি তাঁরা এমনও ঘোষণা করেছেন যে, বেদ অপৌরুষেয় নয় এবং বেদ বাক্য মাত্রই অভ্রান্ত নয়। হিন্দু ধর্মের পরম পবিত্র গ্রন্থের প্রতি এই আঘাত হেনে ব্ৰাহ্মরা আরও দূরে সরে গেলেন।

শিক্ষিত ব্যক্তিরা প্রায় সকলেই হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার এবং অনৈতিক প্রথাগুলি সম্পর্কে ঘৃণা বোধ করেন। এই কি সেই মহান ধর্ম যা স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার বিপ্নান দেয়। এই ধর্মে পুরুষের বহুবিবাহ প্রশস্ত। কিন্তু নারী যদি ছ-সাত বছরেও বিধবা হয়, তাহলেও তাকে সারা জীবন বঞ্চিত, অসহ দিনাতিপাত করতে হবে। এই সেই ধর্ম যেখানে একজন মানুষ বিদ্যায় বুদ্ধিতে অন্যের চেয়ে উচ্চ হলেও শুধু সে জন্ম কারণে শূদ্র বলেই ব্ৰাহ্মণ ইত্যাদি জাতির সঙ্গে একাসনে বসতে পারবে না! এই সেই ধর্ম, যে ধর্মের মানুষ মুসলমান চাষীর শ্রমে ফলানো ধান অন্নান বদনে আহার করবে: কিন্তু মুসলমানের হাতে ছোঁয়া জল পান করবে না।

অনেক মুক্তমনা হিন্দু, যাঁদের মনের মধ্যে ধর্মের জন্য আকৃতি আছে, কিন্তু বিজাতীয় খৃষ্ট ধর্মও গ্রহণ করতে চান না, ব্ৰাহ্মদের সম্পর্কেও পুরোপুরি আস্থা নেই, তাঁরাও নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিতে লজ্জা  বোধ করেন এই ধর্মের নানা দোষের কারণে।

এই রকম সময়ই কালীপদ অভিলাষী রাসমণি দাসী পৌত্তলিক হিন্দু ধর্মেই নতুন প্ৰাণ সঞ্চারের জন্য দক্ষিণেশ্বরে শুরু করলেন এই মহাযজ্ঞ। জ্যৈষ্ঠ পৌর্ণমাসী তিথিযোগে জগন্নাথের স্নানযাত্রার দিনটি শুভযোগ, সেইদিন হলো প্রতিষ্ঠা-উৎসব। বরাহনগর থেকে নাটমন্দির পর্যন্ত পথের দু-পাশে টানানো হলো ঝাড়ি লণ্ঠন। মধ্যে মধ্যে এক একটি বাঁধা মঞ্চে বাজনাদাররা বাজনা বাজাচ্ছে। সামনের তোরণটি যেন আকাশচুম্বী এবং বহু বৰ্ণ সব কুসুমে সজ্জিত।

শুধু নিমন্ত্রিতের সংখ্যাই প্ৰায় এক লক্ষ, এছাড়া অনাহুত, রবাহুত যে কত, তার ইয়ত্তা নেই। রানী রাসমণির নির্দেশ যে কেউই অভুক্ত অবস্থায় কিংবা দান না নিয়ে ফিরে যাবে না। বারাণসী, পুরী, পুণা, মান্দ্ৰাজ থেকেও তিনি বিশিষ্ট ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতদের আনিয়েছেন; নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, কোটালিপাড়ার কোনো ব্ৰাহ্মণই বাকি নেই। দেশের সম্ভ্রান্ত নাগরিকদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সকলকে। গঙ্গার বুকে পিনিস, বজরা বোট, ভাউলিয়া প্রভৃতি জলযান গিসগিস করছে, আবার রাজপথে গাড়িও অসংখ্য।

মন্দির প্রাঙ্গণের এক পাশে অনেকগুলি হৃষ্টপুষ্ট গোরু বাঁধা, এক পাশে স্তৃপাকার পট্টবস্ত্র। এছাড়াও কয়েকটি পাহাড় সাজিয়েছেন, রৌপ্য মুদ্রার পাহাড়, সন্দেশের পাহাড়, পাকা কলার পাহাড়, অন্নের পাহাড়। কলকাতার বাজার তো বটেই, পানিহাটি, বৈদ্যবাটি, ত্ৰিবেণী ইত্যাদি সন্নিহিত সব এলাকার বাজার সাফ করে আনা হয়েছে সন্দেশ, সব মিলিয়ে পাঁচশত মণি। আর অন্নের পাহাড়টি তো অন্নমেরু পর্বত। রানী রাসমণি সম্মান অনুসারে ব্ৰাহ্মণদের গোধন, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা এবং বস্ত্ৰ দান করবেন। এবং অন্ন ও মিষ্টদ্রব্য ইত্যাদি উৎসগ করবেন দেবতাকে।

উৎসবের কয়েকদিন আগে একটি বাধা দেখা দিয়েছিল। মাহিষ্য সম্প্রদায়কে গোঁড়া ব্ৰাহ্মণের দল শূদ্র বলে মনে করে, সেই শূদ্র প্রতিষ্ঠিত মন্দিরকে ব্ৰাহ্মণরা অশাস্ত্রীয় বলে ঘোষণা করেছিল। তারপর ঝামাপুকুর টোলের রামকুমার পণ্ডিতের বিধান মতন দেবালয়টি রানী রাসমণি তাঁর গুরুদেবের নামে আগে উৎসর্গ করায় সে সংকট থেকে উত্তীর্ণ হওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ঐ মন্দিরের প্রতিদিনের পূজারী হবেন কে? কোনো শাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিতই শূদ্রের বেতনভুক পূজারী হতে সম্মত হলেন না, সামাজিক অপবাদের ভয়ে। শেষ পর্যন্ত রানী রাসমণির নির্দেশে তাঁর জামাতা মথুর ঐ রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কেই সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন মন্দিরের পূজার ভার গ্রহণ করার জন্য।

সব ব্ৰাহ্মণই পূজারী নয়। বঙ্গে ভট্টাচাৰ্যরাই বংশানুক্রমিক পূজারী। চট্টোপাধ্যায় বংশীয় রামকুমার রানীর প্রস্তাবে কিছু দ্বিধা করেছিলেন প্রথমে। জীবিকার জন্য তিনি কামারপুকুর থেকে এসে কলকাতার ঝামাপুকুরে টোল খুলেছিলেন। পিতৃবিয়োগের পর রামকুমারের ওপরেই সংসারের ভার বর্তেছে। অধ্যাপনা ছেড়ে তিনি বেতনভুক পূজারী হবেন? এদিকে রানী রাসমণি মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন পর্যন্ত ঘোষণা করে ফেলেছেন, পুরোহিতের অভাবে যে সব পণ্ড হয়ে যায়! রামকুমার শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন।

নিয়তি নির্বন্ধে রামকুমারই হলেন মন্দির প্রতিষ্ঠার দিনের হোতা। সঙ্গে তাঁর ছোট ভাই গদাধর, তাঁর বয়েস এখন উনিশ। গদাধর বড় লাজুক প্রকৃতির। গ্রাম থেকে এসে এখনো সে এখানকার লোকজনদের সঙ্গে ঠিক মতন মিশতে পারে না।

রানী রাসমণি, তাঁর মুখখানি ভক্তি ও তৃপ্তির ভাবে বিভোর। অন্যদিকে বসে আছে যুবক গদাধর, মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাবার ভয়ে সে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পাশ ছাড়েনি একবারও। তার দুই চোখ বিস্ময়াবিষ্ট, এত মানুষ, এত দ্রব্য, আর নবরত্বের মন্দিরটি যেন একটি পর্বত। গদাধরের এক ভাগিনেয় হৃদয়ও এসেছে সঙ্গে। সে বয়ঃকনিষ্ঠ হলেও গদাধরের চেয়ে অনেক চটপটে, সে ঘোরাঘুরি করছে চতুর্দিকে।

 

জানবাজারের মাঢ় পরিবারের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবারের সম্পর্ক অনেক দিনের। তাই সিংহ পরিবারকে রাসমণি বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দক্ষিণেশ্বরের উৎসবে যোগদান করার জন্য। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে নবীনকুমারকেই। তবে সে একা আসেনি, জননী বিম্ববতীকেও সঙ্গে এনেচে।

বিম্ববতী গৃহ থেকে নিৰ্গত হতেই চান না। পূর্ণিমা অমাবস্যায় শুধু একবার করে যান। গঙ্গামানে। তাও ঘেরাটোপ পাল্কিতে, এবং সেই পালকি সমেতই তাঁকে জল ড়ুবিয়ে আনা হয়। নবীনকুমার অনেকবার বলেছে তাঁকে কোনো তীর্থ দৰ্শন করে আসতে কিন্তু বিম্ববতী তাতে সম্মত নন, পুত্রমুখ দর্শন না করে তিনি একদিনও থাকতে পারবেন না।

নবীনকুমার বলে, মা, আমি যখুন মহাল পরিদর্শন করতে যাবো, তখুন তুমি কী করবে? তুমিও কি আমার সঙ্গে সঙ্গে বজরায় ঘুরবে?

বিম্ববতী উত্তর দেন, তোর বাবা মহাল দেকতে গিয়ে কাজ নেই; সেজন্যে অনেক লোক আচে।

নবীনকুমার বলে, আমার ঠিক বয়েসটা হোক না, তখন দেকো চর্কির মতন ঘুরবো। বিষয় সম্পত্তি নিজে না দোকলে চলে?

মহাল পরিদর্শনে গিয়েই গঙ্গানারায়ণ নিরুদ্দিষ্ট হয়েছে, সে কথা ভেবে বিম্ববতীর এখনো বুক কাঁপে। তিনি ঐ সব কথা শুনে নবীনকুমারের হাত চেপে ধরে ব্যাকুলভাবে বলেন, না, না, তুই কক্ষুনো মহালে যাবি না! বিষয় যা আচে, ঢের আচে, দূর থেকে চালালেই যথেষ্ট চলবে।

নবীনকুমার মায়ের কথা শুনে হাসে।

নিমতলা ঘাট থেকে বজরায় চেপে অনুকুল জোয়ারে এক ঘণ্টার মধ্যেই নবীনকুমারেরা পৌঁছে গোল দক্ষিণেশ্বরে। সদ্য দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত হয়েছে, উৎসব তখন তুঙ্গে। জননীকে নিজের হাতে ধরে নবীনকুমার তীরে নামালো বিম্ববতীর মুখ ঘোমটায় ঢাকা, কোনোদিন তিনি সূযালোকে অচেনা মানুষের সামনে বেরোননি, এই মধ্যবয়েসেও তিনি নববধূর মতন ব্রীড়াকুণ্ঠিতা।

লোকের ভিড়ে পথ চলা দায়! দুলাল এবং আরও কয়েকজন কর্মচারী মিলে সামনে থেকে পথ সাফ করে দিতে লাগলো। নবীনকুমার তার মাকে ধরে ধরে নিয়ে এলো পূজামণ্ডপে।

গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জন্য আলাদা ঘেরা জায়গায় বসবার স্থান নির্দিষ্ট আছে। একদিকে পুরুষ, অন্যদিকে রমণী। নবীনকুমার বিম্ববতীকে একটি গালিচা-মোড়া কেদারায় বসিয়ে দিল। সে নিজে বসলো না, এক জায়গায় বেশীক্ষণ বসে থাকার মানুষ সে নয়। সে পরে আছে কোঁচানো ধুতি এবং লম্বাহাতার জামা, এবং পরিবার-প্রধানের চিহ্ন হিসেবে সে হাতে নিয়েছে একটি ছড়ি। আর কোনো পঞ্চদশ বৎসর বয়স্ক যুবককে ছড়ি-লাঠি হাতে দেখা যাবে না।

নবীনকুমার ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো সব ব্যবস্থা। রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে দেশের নাম করা ব্যক্তিরা প্ৰায় সবাই এসেছেন। নবীনকুমার খুঁজতে লাগলো। একজনকে। তিনি আসেননি। তিনি নবনীকুমারের গুরু ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিতরা প্রায় সকলেই উপস্থিত, তাঁরা রানী রাসমণির অর্থ বস্ত্ৰ দান গ্ৰহণ করেছেন, শুধু অনুপস্থিত তাঁদের অধ্যক্ষ।

নবীনকুমার ভাবলো, তিনি আসেননি কেন? তিনি কোনো জায়গা থেকে দান গ্ৰহণ করেন না বলে? কিংবা ঈশ্বরচন্দ্ৰকে বোধ হয় অনেকে আজকাল ব্ৰাহ্মণ বলেই মনে করে না। তিনি নাকি সন্ধ্যা-আহ্নিক করেন না, কোনো ঠাকুর-দেবতার পূজা করতেও কেউ কখনো দেখেনি তাঁকে। এ কী ধরনের ব্ৰাহ্মণ? তা ছাড়া তিনি এখন বিধবা বিবাহের ব্যাপারে মহা ব্যস্ত।

এত বড় নবরত্ন মন্দির, নাটমহল ও সার সার শিবমন্দির এবং এত জাঁকজমক দেখে নবীনকুমার প্রথমটায় বেশ অভিভূত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র আসেননিদেখে নবীনকুমারেরও খানিকটা ভক্তি কমে গেল।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও দেখতে পেল না। নবীনকুমার। ব্ৰাহ্মরা সদলবলে এই অনুষ্ঠান বর্জন করেছে। ইয়ংবেঙ্গলের দলও যে আসবে না, তা যেন জানাই ছিল, তবু তাদের দু-একজনকে সেখানে দেখে নবীনকুমার চমৎকৃত হলো। সাহেবীভাবাপন্ন ইয়ংবেঙ্গল দলেরও কয়েকজনের মধ্যে ভক্তিভাব দেখা দিচ্ছে তা হলে!

সন্ধ্যা হতে না হতেই জ্বলে উঠলো রোশনাই। উৎসব এখনো অনেক রাত পর্যন্ত চলবে। নবীনকুমারের আরও কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে ছিল। গঙ্গাতীরের এই স্থানটি বড় মনোরম। লোকের ভিড় থেকে সরে গিয়ে যেখানে গাছপালার ঝোঁপজঙ্গল, সেখানে বসে থাকতে বেশ ভালো লাগছিল তার। কিন্তু বিম্ববতী উতলা হয়ে পড়েছেন, তিনি বারবার দাসী মারফৎ খবর পাঠাচ্ছেন নবনীকুমারের কাছে।

বিম্ববতীর হাত ধরে নবীনকুমার নিয়ে এলো ঘাটের কাছে। বজরায় উঠতে গিয়ে হঠাৎ তার একটা কথা মনে পড়লো। এতগুলি মন্দিরের কোনো বিগ্ৰহকেই সে প্ৰণাম জানায়নি। একবার তার ইচ্ছে হলো, ছুটে গিয়ে প্ৰণাম করে আসে। তারপর আবার ভাবলো, থাক। দূর থেকে প্ৰণাম জানালেও তো হয়।

সে তখনও তার জননীর হাত ধরে থমকে আছে। বিম্ববতী জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো?

নবীনকুমার বললো, কিছু না।

তারপর সে বজরায় উঠে পড়লো। এবং দূর থেকেও প্ৰণাম জানালো না।

দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে রানী রাসমণির দাক্ষিণ্য, মহানুভবতা এবং হিন্দু ধর্মের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাকে ধন্য ধন্য করা হলো দেশীয় সংবাদপত্রগুলিতে। শুধু ব্ৰাহ্মরা নীরব রইলো। পৌত্তলিকতা নিয়ে নতুন ভাবে এই আড়ম্বর তারা সুনজরে দেখলো না।

 

ব্ৰাহ্মদের নিজেদের মধ্যেও খানিকটা অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এই ধর্ম প্রতিষ্ঠার পর দ্বাদশ বৎসরের একটি যুগ পার হয়েছে। এবার দেখা দিয়েছে একটি সংকট! দেবেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন নিষ্কলুষ ধর্ম সাধনা এবং পরম ব্ৰহ্মের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে। এবং পৌত্তলিকতা ও নানারকম কুসংস্কার বর্জন করে হিন্দু ধর্মেরই একটি পরিশুদ্ধ রূপ দিতে। কিন্তু ইদানীং তাঁর সন্দেহ হচ্ছে যে কতকগুলান নাস্তিক তাঁর এই সভার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। দেবেন্দ্রনাথ পৌত্তলিকদের অশ্রদ্ধা করেন, খৃষ্টানদের অপছন্দ করেন এবং নাস্তিকদের মনে করেন অমানুষ।

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার ব্যয়ভার বহন করেন দেবেন্দ্রনাথ, কিন্তু সেই পত্রিকায় বর্তমানে অধ্যাত্মতত্ত্বের বদলে শুষ্ক জ্ঞানচৰ্চারই বেশী পরিচয় দেখা যাচ্ছে। সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তের ঝোঁক যেন ঐ দিকেই। আর একজন রচনা-পরীক্ষক ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর, তিনি তো কোনো ধর্ম-আলোচনার মধ্যেই থাকেন না। অক্ষয়কুমার আবার একটা রচনা লিখেছেন, বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার। রচনাটি দেখে বিরক্ত হয়েছেন দেবেন্দ্রনাথ। তিনি খুঁজছেন ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ, আর এরা মাথা ঘামাচ্ছে বাহ্যিবস্তু নিয়ে? এরা কি মানুষের মনের মধ্যে ঢুকতে জানে না? ঐ অক্ষয়কুমারের শুধু বিচারের দিকে ঝোঁক। ওঁরই প্ররোচনায় দেবেন্দ্ৰনাথ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে বেদের সব কিছুই অভ্রান্ত নয়।

অক্ষয়কুমার আরও একটি কাণ্ড করে দেবেন্দ্রনাথকে আরও চটিয়ে দিলেন। রামমোহনের অনুসরণে অক্ষয়কুমারও একটি আত্মীয় সভা স্থাপন করেছেন। ব্ৰাহ্মসমাজে শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা আসেন, সেই সুযোগ নিয়ে অক্ষয়কুমার তাঁদের মধ্যে নিজের মতাদর্শ প্রবিষ্ট করিয়ে দিতে চান। ঐ আত্মীয় সভায় অক্ষয়কুমার একদিন বললেন, আচ্ছা, ঈশ্বর যে অনন্ত তার কী প্রমাণ আছে? আপনারা সকলেই বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর সর্বজ্ঞ? আচ্ছা, ঈশ্বর সর্বজ্ঞ কি না তার বিচার করা যাক। কে কে বিশ্বাস করেন ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, হাত তুলুন তো?

এ সংবাদ শুনে দেবেন্দ্রনাথের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। হাত-তোলা ভোটাভুটিতে ঈশ্বরের স্বরূপ বিচার? এতদূর স্পর্ধা! তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা একেবারে বন্ধ করে দেবার অভিপ্ৰায় জানালেন, শুধু তাই নয়, গোটা ব্ৰাহ্মসমাজের ওপরেই অভিমান করে ভাবলেন এর সঙ্গে একেবারে সম্পর্ক ছেদ করবেন। এমনকি সংসারও পরিত্যাগ করে চিরকালের জন্য চলে যাবেন হিমালয়ে। সেখানে গিয়ে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ঈশ্বরচিন্তা করবেন। এবং সত্যিই সেরকম উদ্যোগ আয়োজন করতে লাগলেন।

নবীনকুমার ষোড়শ বর্ষে পা দিয়ে দু-একদিন ব্ৰাহ্মসভার অধিবেশনে যোগ দিতে এলো। তার গৃহে বিদ্যোৎসাহী সভা এখন জমজমাট। প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন সদস্য আসছে এবং নানাপ্রকার চিত্তাকর্ষক বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু নবীনকুমারের জ্ঞানস্পৃহা তাতেও মেটে না। শহরের যেখানে যেখানে বিদ্বজন সমাগম হয়, সেখানেই সে যেতে চায়।

কিন্তু ব্ৰাহ্মসমাজে নবীনকুমার নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারলো না। প্রথম বাধা বয়সের। ব্ৰাহ্মসমাজের সকল সভ্যেরই বয়েস নবীনকুমারের দ্বিগুণেরও বেশী। সে প্রায় বালক বয়েসী বলে সভাচলাকালীন অবস্থায়ও সকলে তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চায়। তাছাড়া, ব্ৰাহ্মদের মুখের ভাষা অতি সুগভীর, এক একজন বক্তৃতা শুরু করে আর থামতেই চান না। পরম ব্ৰহ্মের প্রসঙ্গে অনেকের চক্ষু থেকে অশ্রুগড়ায়। এই সব দেখে শুনে তার হাসি পেয়ে যায়। স্বভাব-চঞ্চল নবীনকুমার এ রকম সভায় আর কতক্ষণ ধৈর্য ধরে বসে থাকবে।

তাছাড়া একজন দলত্যাগী ব্ৰাহ্মও খানিকটা প্রভাবিত করলো তাকে। লোকটির নাম যদুপতি গাঙ্গুলী। নবীনকুমারের চেয়ে সে বয়সে কিছু বড়, সে রীতিমতন দীক্ষা নিয়ে ব্ৰাহ্ম হয়েছিল, তারপর আবার ব্ৰাহ্মদের সংস্পর্শ ত্যাগ করে এক পাদ্রীর কাছে গিয়ে ইউনিটারিয়ান মতবাদে বিশ্বাসী হয়েছে। সে মাঝে মাঝে বিদ্যোৎসাহী সমিতিতেও আসে। নবীনকুমারের সঙ্গে তার বেশ সৌহাদ্য হয়েছে।

সেই যদুপতি গাঙ্গুলী একদিন বললোম ভাই নবীন, তুমি আজকাল ব্রাহ্মদের সভায় যাতায়াত করচো, শুনচি!

নবীনকুমার বললো, ওঁদের ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা কোচ্চি।

যদুপতি বললো, আমার ভাই বড়ই আশাভঙ্গ হয়েচে। বড় আশা নিয়ে আমি ওঁদের কাচে গোসলুম। কিন্তু দেকলুম, ওঁদের কতায় আর কাজে মেলে না।

—কী রকম!

ব্ৰাহ্মরা বলেন, ওঁরা পুতুল পুজোয় বিশ্বাস করেন না। অথচ দ্যাকো, সব ব্ৰাহ্মদের বাড়িতেই এখনো পাথরের নুড়ি কিংবা মাটি কিংবা কাঠের দেবতা রয়েচে। ওঁরা নিজেরা হয়তো পুজো করেন না, কিন্তু তাঁরা নিজের বাড়িতেই এখনো ঐসব পুজো বন্ধ করতে পারেননি, তাহলে সারা দেশে বন্ধ হবে কী করে! এমনকি, ঐসব পুজোর খরচও ওঁরা দিচ্চেন। দেবেন্দ্ৰবাবুর বাড়িতে যে দোল-দুর্গাৎসব হয়, তার খরচা তো ওঁর এস্টেট থেকেই জোগাতে হয়।

নবীনকুমার চুপ করে রইলো।

—তারপর দ্যাকো, ব্ৰাহ্মদের মধ্যে তো জাতিভেদ নেই। সবাই এক ঈশ্বরের পূজারী। এঁদের মধ্যে আবার ভেদাভেদ কী? কিন্তু বলো, বামুন-কায়েতরা ব্ৰাহ্ম হতে পারে। কিন্তু কোনো শূদ্রও কি ব্ৰাহ্ম হবে? কোনো বামুন-ব্রাহ্মের ছেলেমেয়ের সঙ্গে কোনো কায়েত-ব্রাহ্মের ছেলেমেয়ের বিবাহ হয়েছে এ পর্যন্ত? আমি কিন্তু দিকিনি।

নবীনকুমার তর্কে যেতে চায় না। সে ফস করে বললো, যাই বলো, দুর্গাপুজো কিংবা দোল বা রথযাত্রার উৎসব আমার বেশ ভালো লাগে।

—তাহলে তুমি ব্ৰাহ্মদের কাচে যাও কেন?

—দুটো জ্ঞানের কতা শুনতে। হরেক রকম মানুষজন দেকতে!

নবীনকুমার একদিন শুনতে পেল শহরের আর একটি বাড়িতে যুবকরা বিদ্যাচচার জন্য মিলিত হয়। প্ৰখ্যাত দেওয়ান রামকমল সেনের পৌত্র কেশবকে ঘিরে বসে এই আসর।

 

হিন্দু কলেজে পড়বার সময়ে কেশবকে কয়েকবার দেখেছে নবীনকু,আর। তার চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। গম্ভীর, স্বল্পভাষী যুবক, সহজে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। এমন কি কেউ কোনো প্রশ্ন করলেও উত্তর দেয় না সহসা। নবীনকুমারের খুব একটা পছন্দ হয়নি কেশবকে। এত কিসের অহংকার!

কিছুদিন আগে কেশব সম্পর্কে একটা গুজব শুনে নবীনকুমার একটু খুশীই হয়েছিল মনে মনে। কেশব নাকি কলেজের পরীক্ষায় টোকাটুকি করতে গিয়ে ধরা পড়ে ভৎসিত হয়েছে। এই ছেলের আবার অহংকার, হেঃ!–

যদুপতিই নবীনকুমারকে বোঝালো একদিন যে, না, কেশব ছেলেটিও মোটেই সাধারণ নয়। সে ভাবুক প্রকৃতির মানুষ, বাল্যকাল থেকেই তার মধ্যে একটা শুদ্ধতার প্রকাশ পেয়েছে। সে পড়াশুনোও করে অগাধ। বন্ধু ও পরিচিত মণ্ডলীতে সে যখন কোনো বিষয়ে কথা বলে তখন সকলে নিঃশব্দে চিত্রাপিত হয়ে শোনে। সম্প্রতি কেশব তার বন্ধুদের নিয়ে একটি থিয়েটার করারও ব্যাপার নিয়ে মেতেছে।

নবীনকুমার একদিন যদুপতির সঙ্গে গেল। কলুটোলায় কেশবদের বাড়ির আসরে। এখানকার যুবকরা সকলেই প্ৰায় তার কাছাকাছি বয়েসী, এদের সঙ্গে সখ্য স্থাপনে তার কোনো অসুবিধে হবার নয়।

তবু এখানেও কারুর সঙ্গে মনের মিল হলো না নবীনকুমারের।

কেশব বক্তৃতা দেয় ইংরেজি ভাষায়, এমন কি বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলে ইংরেজিতে। যে নাটকের তারা মহলা দিচ্ছে, তার নাম হ্যামলেট।

ইংরেজ গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠ নিয়ে নবীনকুমারও ইংরেজি ভাষায় যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে। কিন্তু এমন নির্লজ্জ পরানুকরণ তার পছন্দ হয় না। বাঙালীরা ধর্ম-বিষয়ক আলোচনাও করচে ইংরেজিতে, হায়!

নবীনকুমার সেখানেও যাওয়া বন্ধ করে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *