ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ২৮শে অক্টোবর
যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ ৷
আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টস্তস্য কার্যং ন বিদ্যতে ৷৷
[গীতা — ৩।১৭]
ঈশ্বরলাভের লক্ষণ — সপ্তভূমি ও ব্রহ্মজ্ঞান
শ্রীরামকৃষ্ণ — বেদে ব্রহ্মজ্ঞানীর নানারকম অবস্থা বর্ণনা আছে। জ্ঞানপথ — বড় কঠিন পথ। বিষয়বুদ্ধির — কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তির লেশমাত্র থাকলে জ্ঞান হয় না। এ-পথ কলিযুগের পক্ষে নয়।
“এই সম্বন্ধে বেদে সপ্তভুমির (Seven Planes) কথা আছে। এই সাতভূমি মনের স্থান। যখন সংসারে মন থাকে, তখন লিঙ্গ, গুহ্য, নাভি মনের বাসস্থান। মনের তখন ঊর্ধ্বদৃষ্টি থাকে না — কেবল কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকে। মনের চতুর্থভূমি — হৃদয়। তখন প্রথম চৈতন্য হয়েছে। আর চারিদিকে জ্যোতিঃ দর্শন হয়। তখন সে ব্যক্তি ঐশ্বরিক জ্যোতিঃ দেখে অবাক্ হয়ে বকে, ‘একি’! ‘একি!’ তখন আর নিচের দিকে (সংসারের দিকে) মন যায় না।
“মনের পঞ্চভূমি — কন্ঠ। মন যার কন্ঠে উঠেছে, তার অবিদ্যা অজ্ঞান সব গিয়ে, ঈশ্বরীয় কথা বই অন্য কোন কথা শুনতে বা বলতে ভাল লাগে না। যদি কেউ অন্য কথা বলে, সেখান থেকে উঠে যায়।
“মনের ষষ্ঠভূমি — কপাল। মন সেখানে গেলে অহর্নিশ ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন হয়। তখনও একটু ‘আমি’ থাকে। সে ব্যক্তি সেই নিরুপম রূপদর্শন করে, উন্মত্ত হয়ে সেই রূপকে স্পর্শ আর আলিঙ্গন করতে যায়, কিন্তু পারে না। যেমন লন্ঠনের ভিতর আলো আছে, মনে হয়, এই আলো ছুঁলাম ছুঁলাম; কিন্তু কাচ ব্যবধান আছে বলে ছুঁতে পারা যায় না।
“শিরোদেশ — সপ্তভূমি — সেখানে মন গেলে সমাধি হয় ও ব্রহ্মজ্ঞানীর ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ দর্শন হয়। কিন্তু সে-অবস্থায় শরীর অধিক দিন থাকে না। সর্বদা বেহুঁশ, কিছু খেতে পারে না, মুখে দুধ দিলে গড়িয়ে যায়। এই ভূমিতে একুশ দিনে মৃত্যু। এই ব্রহ্মজ্ঞানীর অবস্থা। তোমাদের ভক্তিপথ। ভক্তিপথ খুব ভাল আর সহজ।”
[সমাধি হলে কর্মত্যাগ — পূর্বকথা — ঠাকুরের তর্পণাদি কর্মত্যাগ ]
“আমায় একজন বলেছিল, ‘মহাশয়! আমাকে সমাধিটা শিখিয়ে দিতে পারেন?’ (সকলের হাস্য)
“সমাধি হলে সব কর্ম ত্যাগ হয়ে যায়। পূজা-জপাদি কর্ম, বিষয়কর্ম সব ত্যাগ হয়। প্রথমে কর্মের বড় হৈ-চৈ থাকে। যত ঈশ্বরের দিকে এগুবে ততই কর্মের আড়ম্বর কমে। এমন কি তাঁর নামগুণগান পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। (শিবনাথের প্রতি) যতক্ষণ তুমি সভায় আসনি তোমার নাম, গুণকথা অনেক হয়েছে। যাই তুমি এসে পড়েছ, অমনি সে-সব কথা বন্ধ হয়ে গেল। তখন তোমার দর্শনেতেই আনন্দ। তখন লোকে বলে, ‘এই যে শিবনাথ বাবু এসেছেন।’ তোমার বিষয়ে অন্য সব কথা বন্ধ হয়ে যায়।
“আমার এই অবস্থার পর গঙ্গাজলে তর্পণ করতে গিয়ে দেখি যে, হাতের আঙুলের ভিতর দিয়ে জল গলে পড়ে যাচ্ছে। তখন হলধারীকে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করলাম, দাদা, একি হল! হলধারী বললে একে গলিতহস্ত বলে। ঈশ্বরদর্শনের পর তর্পণাদি কর্ম থাকে না।
“সংকীর্তনে প্রথমে বলে ‘নিতাই আমার মাতা হাতি!’ ‘নিতাই আমার মাতা হাতি!’ ভাব গাঢ় হলে শুধু বলে ‘হাতি! হাতি!’ তারপর কেবল ‘হাতি’ এই কথাটি মুখে থাকে। শেষে ‘হা’ বলতে বলতে ভাবসমাধি হয়। তখন সে ব্যক্তি, এতক্ষণ কীর্তন করছিল, চুপ হয়ে যায়।
“যেমন ব্রাহ্মণভোজনে — প্রথমে খুব হৈ-চৈ। যখন সকলে পাতা সম্মুখে করে বসলে, তখন অনেক হৈ-চৈ কমে গেল, কেবল ‘লুচি আন’ ‘লুচি আন’ শব্দ হতে থাকে। তারপর যখন লুচি তরকারি খেতে আরম্ভ করে, তখন বার আনা শব্দ কমে গেছে। যখন দই এল তখন সুপসুপ (সকলের হাস্য) — শব্দ নাই বললেও হয়। খাবার পর নিদ্রা। তখন সব চুপ।
“তাই বলছি, প্রথম প্রথম কর্মের খুব হৈ-চৈ থাকে। ঈশ্বরের পথে যত এগুবে ততই কর্ম কমবে। শেষে কর্মত্যাগ আর সমাধি।
“গৃহস্থের বউ অন্তঃসত্ত্বা হলে শাশুড়ী কর্ম কমিয়ে দেয়, দশমাসে কর্ম প্রায় করতে হয় না। ছেলে হলে একেবারে কর্মত্যাগ। মা ছেলেটি নিয়ে কেবল নাড়াচাড়া করে। ঘরকন্নার কাজ শাশুড়ী, ননদ, জা — এরা সব করে।”
[অবতারাদির শরীর সমাধির পর — লোকশিক্ষার জন্য ]
“সমাধিস্থ হবার পর প্রায় শরীর থাকে না। কারু কারু লোকশিক্ষার জন্য শরীর থাকে — যেমন নারদাদির। আর চৈতন্যদেবের মতো অবতারদের। কূপ খোঁড়া হয়ে গেলে, কেহ কেহ ঝুড়ি-কোদাল বিদায় করে দেয়। কেউ কেউ রেখে দেয় — ভাবে, যদি পাড়ার কারুর দরকার হয়। এরূপ মহাপুরুষ জীবের দুঃখে কাতর। এরা স্বার্থপর নয় যে, আপনাদের জ্ঞান হলেই হল। স্বার্থপর লোকের কথা তো জানো। এখানে মোত্ বললে মুত্বে না, পাছে তোমার উপকার হয়। (সকলের হাস্য) এক পয়সার সন্দেশ দোকান থেকে আনতে দিলে চুষে চুষে এনে দেয়। (সকলের হাস্য)
“কিন্তু শক্তিবিশেষ। সামান্য আধার লোকশিক্ষা দিতে ভয় করে। হাবাতে কাঠ নিজে একরকম করে ভেসে যায়, কিন্তু একটা পাখি এসে বসলে ডুবে যায়। কিন্তু নারদাদি বাহাদুরী কাঠ। এ-কাঠ নিজেও ভেসে যায়, আবার উপরে কত মানুষ, গরু, হাতি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে।”