পঞ্চম পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ২৮শে অক্টোবর
ভক্ত্যা ত্বনন্যয়া শক্য অহমেবংবিধোঽর্জুন ৷
জ্ঞাতুং দ্রষ্টুং চ তত্ত্বেন প্রবেষ্টুং চ পরন্তপ ৷৷
[গীতা — ১১।৫৪]
ঈশ্বরদর্শন — সাকার না নিরাকার?
একজন ব্রাহ্মভক্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয় ঈশ্বরকে কি দেখা যায়? যদি দেখা যায়, দেখতে পাই না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, অবশ্য দেখা যায় — সাকাররূপ দেখা যায়, আবার অরূপও দেখা যায়। তা তোমায় বুঝাব কেমন করে?
ব্রাহ্মভক্ত — কি উপায়ে দেখা যেতে পারে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ব্যাকুল হয়ে তাঁর জন্য কাঁদতে পার?
“লোকে ছেলের জন্য, স্ত্রীর জন্য, টাকার জন্য, একঘটি কাঁদে। কিন্তু ঈশ্বরের জন্য কে কাঁদছে? যতক্ষণ ছেলে চুষি নিয়ে ভুলে থাকে, মা রান্নাবান্না বাড়ির কাজ সব করে। ছেলের যখন চুষি আর ভাল লাগে না — চুষি ফেলে চিৎকার করে কাঁদে, তখন মা ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে দুড়দুড় করে এসে ছেলেকে কোলে লয়।”
“ব্রাহ্মভক্ত — মহাশয়! ইশ্বরের স্বরূপ নিয়ে এত মত কেন? কেউ বলে সাকার — কেউ বলে নিরাকার — আবার সাকারবাদীদের নিকট নানারূপের কথা শুনতে পাই। এত গণ্ডগোল কেন?
“শ্রীরামকৃষ্ণ — যে ভক্ত যেরূপ দেখে, সে সেইরূপ মনে করে। বাস্তবিক কোনও গণ্ডগোল নাই। তাঁকে কোনরকমে যদি একবার লাভ করতে পারা যায়, তাহলে তিনি সব বুঝিয়ে দেন। সে পাড়াতেই গেলে না — সব খবর পাবে কেমন করে?
“একটা গল্প শোন:
“একজন বাহ্যে গিছিল। সে দেখলে যে গাছের উপর একটি জানোয়ার রয়েছে। সে এসে আর একজনকে বললে, ‘দেখ, অমুক গাছে একটি সুন্দর লাল রঙের জানোয়ার দেখে এলাম।’ লোকটি উত্তর করলে, ‘আমি যখন বাহ্যে গিছিলাম আমিও দেখেছি — তা সে লাল রঙ হতে যাবে কেন? সে যে সবুজ রঙ!’ আর-একজন বললে, ‘না না — আমি দেখেছি, হলদে!’ এইরূপে আরও কেউ কেউ বললে, ‘না জরদা, বেগুনী, নীল’ ইত্যাদি। শেষে ঝগড়া। তখন তারা গাছতলায় গিয়ে দেখে, একজন লোক বসে আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বললে, ‘আমি এই গাছতলায় থাকি, আমি সে জানোয়ারটিকে বেশ জানি — তোমরা যা যা বলছ, সব সত্য — সে কখন লাল, কখন সবুজ, কখন হলদে, কখন নীল আরও সব কত কি হয়! বহুরূপী। আবার কখন দেখি, কোন রঙই নাই। কখন সগুণ, কখন নির্গুণ।’
“অর্থাৎ যে ব্যক্তি সদা-সর্বদা ঈশ্বরচিন্তা করে সেই জানতে পারে তাঁর স্বরূপ কি? সে ব্যক্তিই জানে যে, তিনি নানারূপে দেখা দেন, নানাভাবে দেখা দেন — তিনি সগুণ, আবার তিনি নির্গুণ। যে গাছতলায় থাকে, সেই জানে যে, বহুরূপীর নানা রঙ — আবার কখন কখন কোন রঙই থাকে না। অন্য লোক কেবল তর্ক ঝগড়া করে কষ্ট পায়।
“কবীর বলত, ‘নিরাকার আমার বাপ, সাকার আমার মা।’
“ভক্ত যে রূপটি ভালবাসে, সেইরূপে তিনি দেখা দেন — তিনি যে ভক্তবৎসল।
“পুরাণে আছে, বীরভক্ত হনুমানের জন্য তিনি রামরূপ ধরেছিলেন।”
[কালীরূপ ও শ্যামরূপের ব্যাখ্যা — ‘অনন্ত’কে জানা যায় না ]
“বেদান্ত-বিচারের কাছে রূপ-টুপ উড়ে যায়। সে-বিচারের শেষ সিদ্ধান্ত এই — ব্রহ্ম সত্য, আর নামরূপযুক্ত জগৎ মিথ্যা। যতক্ষণ ‘আমি ভক্ত’ এই অভিমান থাকে, ততক্ষণই ঈশ্বরের রূপদর্শন আর ঈশ্বরকে ব্যক্তি (Person) বলে বোধ সম্ভব হয়। বিচারের চক্ষে দেখলে, ভক্তের ‘আমি’ অভিমান, ভক্তকে একটু দূরে রেখেছে।
“কালীরূপ কি শ্যামরূপ চৌদ্দ পোয়া কেন? দূরে বলে। দূরে বলে সূর্য ছোট দেখায়। কাছে যাও তখন এত বৃহৎ দেখাবে যে, ধারণা করতে পারবে না। আবার কালীরূপ কি শ্যামরূপ শ্যামবর্ণ কেন? সেও দূর বলে। যেমন দীঘির জল দূরে থেকে সবুজ, নীল বা কালোবর্ণ দেখায়, কাছে গিয়ে হাতে করে জল তুলে দেখ, কোন রঙই নাই। আকাশ দূরে দেখলে নীলবর্ণ, কাছে দেখ, কোন রঙ নাই।
“তাই বলছি, বেদান্ত-দর্শনের বিচারে ব্রহ্ম নির্গুণ। তাঁর কি স্বরূপ, তা মুখে বলা যায় না। কিন্তু যতক্ষণ তুমি নিজে সত্য, ততক্ষণ জগৎও সত্য। ঈশ্বরের নানারূপও সত্য, ঈশ্বরকে ব্যক্তিবোধও সত্য।
“ভক্তিপথ তোমাদের পথ। এ খুব ভাল — এ সহজ পথ। অনন্ত ঈশ্বরকে কি জানা যায়? আর তাঁকে জানবারই বা কি দরকার? এই দুর্লভ মানুষ জনম পেয়ে আমার দরকার তাঁর পাদপদ্মে যেন ভক্তি হয়।
“যদি আমার একঘটি জলে তৃষ্ণা যায়, পুকুরে কত জল আছে, এ মাপবার আমার কি দরকার? আমি আধ বোতল মদে মাতাল হয়ে যাই — শুঁড়ির দোকানে কত মন মদ আছে, এ হিসাবে আমার কি দরকার? অনন্তকে জানার দরকারই বা কি?”