2 of 3

০৭৩. শ্যামলীকে শাসিয়ে গেল

যেদিন ছেলেগুলো এসে বামাচরণের বউ শ্যামলীকে শাসিয়ে গেল, সেদিনকার ঘটনা গড়িয়েছিল অনেক দূর। রাতে দুই ভাইয়ে প্রথমে তুমুল ঝগড়া। তারপর বেদম মারপিট। বামাচরণ একটা দা নিয়ে এসেছিল অবশেষে। মাতাল রামজীবন হয়তো সেদিনই মারা পড়ত। শ্যামলী প্ৰায় উড়ে এসে কোমর জড়িয়ে ধরে বামাকে আটকায়। তবু দায়ের ডগাটা লেগেছিল রামজীবনের কপালে। ধারের দা, কপালের চামড়া আড়াআড়ি ইঞ্জি তিনেক ফঁক হয়ে গলগল করে রক্ত গড়াতে লাগল। অনেকদিন ঠাণ্ডা মেরে ছিল বিষ্ণুপদ, মিইয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিন নতুন আনা বিজলি বাতিতে ছানিওলা চোখেও এই রক্তপাত দেখতে পেল। দেখে শরীরে একটা এমন কাঁপুনি উঠেছিল যে, তখনই দম বন্ধ হয়ে মরার দাখিল। নয়নতারা দৌড়ে গিয়ে রামজীবনকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে সেঁচাতে লাগল। সঙ্গে রাঙাও। সেই চিকারে পাড়াপড়শীরা দৌড়ে এল। বাড়ির মধ্যে তুমুল হই হট্টগোল। এদিকে বারান্দায় বিষ্ণুপদ ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছিল। কেউ লক্ষ করেনি তাকে। মূৰ্ছা কাকে বলে তা জানেই না বিষ্ণুপদ। সেদিন বোধ হয় কয়েক মিনিট তার মূৰ্ছাই হয়েছিল। আবার সেটা আপনা থেকেই কেটেও গেল। যখন চোখ চাইল তখন রামজীবন উঠে দাঁড়িয়েছে। কপালে একটা ন্যাড়া বাঁধা, পুলিন ডাক্তার এসেছে, নিতাই এসেছে। আরও মেলা ভিড়। বামাচরণকে ঘরে টেনে নিয়ে দোর দিয়েছে শ্যামলী।

উঠতে গিয়ে বিষ্ণুপদ দেখল, শরীরটা থরথর করে কাঁপছে, মাথাটা চক্কর দিচ্ছে। কিন্তু এতো সুখের শরীর নয়। ইদানীং জরব হয়েছে বটে, কিন্তু একটা জীবন তো রোদে জলে, মাইল-মাইল হাঁটাপথে, মজুরের অধিক পরিশ্রমে শরীর পোক্ত হয়েছে। বিষ্ণুপদ তাই পারি না-পারি করেও সিঁড়ি ভেঙে উঠোনে নামল।

পুলিন ডাক্তার তার দিকে চেয়ে ঘেঁকিয়ে উঠল, এইসব দেখার জন্য বেঁচে আছো? মরতে পারে না। না পারো তো কাশী, গয়া কোথাও গিয়ে ভিক্ষে করে খাও গে, তবু পাপচক্ষে এসব দেখতে হবে না।

বিষ্ণুপদর গলাটা বড্ড ধরা ছিল। মাথাটা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, মরার আগে এ সব হল প্ৰায়শ্চিত্ত। বুঝলে? প্ৰায়শ্চিত্ত।

পুলিন কঠিন মুখ করে বলল, পরিষ্কার পুলিশ-কেস। সংসার আঁকড়ে আর পড়ে থেকো না হে বিষ্ণুপদ। বয়স হলে মানুষের যে কী জ্বালা, আজ হাড়ে হাড়ে টের পাই।

মাঝখানে দাঁড়ানো রামজীবন, তাকে ধরে তখনও কাঁধছে নয়নতারা। রাঙা নিজেদের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে বামাচরণের বাপান্ত করছে চেঁচিয়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় রামজীবন একেবারে চুপ। একবার শুধু বিষ্ণুপদর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কিছু হয়নি বাবা। সামান্য একটু রক্ত গেছে। ও কিছু নয়। আপনি গিয়ে শুয়ে থাকুন।

শোবো? হঠাৎ শোবো কেন? কতটা কেটেছে?

সামান্যই।

নিতাই মাতব্বর লোক। এ গায়ের গান্ধীবাবা। লোকের উপকার করে বেড়ায়। এম এল এ হওয়ার ইচ্ছেও আছে। ইদানীং কী সব রাজনীতির কারণে কিছুদিন গ্রামছাড়া হয়ে ছিল। আবার ফিরেছে।

নিতাই বলল, জ্যাঠা, আপনার অনুমতি থাকলে পুলিশ ডাকবো। আজ যা হল এরপর তার চেয়ে অনেক গুরুতর ব্যাপার ঘটতে পারে।

রামজীবন ঠাণ্ডা গলায় বলল, না, পুলিশ ডাকার দরকার নেই। বাড়ির কেচ্ছা বাড়ির মধ্যেই থাকা ভাল। ৩০৬

যেটা তোদের ইচ্ছে। তবে পুলিশ ডাকলে ঘটনার একটা লিগ্যাল রেকর্ড থাকত।

বোঝা যাচ্ছিল, রামজীবনের নেশাটা কেটে গেছে। দার্শনিকের মতো একটু হেসে সে বলল, আমার বাপ-মা এখনও বেঁচে আছে রে নিতাই। তাদের সামনে তাদের ছেলেকে ধরে নিয়ে যাবে—এটা কি হয়? ছেড়ে দে। যা হওয়ার হয়ে গেছে।

নিতাই মাথাটা নেড়ে বলল, ঠিক আছে। কিন্তু শ্যামলী বলছিল, কারা সেদিন এসে ওকে শাসিয়ে গেছে। কারা জানিস?

রামজীবন একটা শ্বাস ছেড়ে বলে, জানি। বটতলার কাশী আর বিশে।

কেন শাসিয়েছিল?

সে অনেক কথা। আজ থাক। পরে একসময় শুনিস।

এরপর রামজীবন পাড়াপড়শীদের উদ্দেশ্যে হাতজোড় করে বলল, আজ আপনারা ফিরে যান। রাত হয়েছে। ঝগড়াকাজিয়া সব সংসারেই হয়ে থাকে।

মিনিট দেশেকের মধ্যেই বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল।

বিষ্ণুপদ বারান্দায় এসে বসল। শরীর জুতের নেই। রামজীবনকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে নয়নতারাও এল। পানের বাটাখানা নিয়ে বসল কাছেই। নিঃশব্দে একখানা পান বানিয়ে মুখে দিয়ে বসে রইল।

বিষ্ণুপদ আড়চোখে দেখল নয়নতারাকে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, সংসারে যখন এসব হয় তখন মৃত্যুভয় কেটে যায়, না? তখন মনে হয়, মরণ রে, তুহু মম শ্যামসমান।

নয়নতারার কান্নার একটা রেশ এখনও রয়েছে। হেঁচকি তুলতে গিয়ে সেটা প্রকাশ হল।

আর কেঁদো না। আজ অনেক কেঁদেছো।

মেয়ে হয়ে জন্মেছি, আর কাদবো না, তাই কি হয়? কাঁদতেই তো জন্মায় মেয়েরা।

সে তোমরা। আজকালকার মেয়েদের তা নয়।

আমি তো আর আজকালকার নই।

দেখে শেখো।

আর শেখা! কত শিখছি গো।

কথা আর এগোয় না। দুজনে বসে থাকে। রাত বাড়ে। মশা কামড়ায়।

অনেকক্ষণ বাদে বিষ্ণুপদ বলল, রেমোটা কিরকম ধারা হয়ে গেল, দেখেছে? কেমন ঠাণ্ডা মেরে গেল।

নয়নতারা বলল, দেখেছি। রেমা তো ছেলে খারাপ নয়। মদ খেলেই যা একটু তড়পায়।

বন্ধুগুলো খারাপ। মেজো বউকে ওরকম অপমান করে গেল সেদিন, কাজটা উচিত হয়নি।

তা বলে ভাইকে কাটতে যাবে?

একটু আস্তে বলো। রাত হয়েছে, শুনতে পাবে।

পাক গে। বলে নয়নতারা আবার পান খায়।

বিষ্ণুপদ চুপ করে থাকে। একটা হাই তুলে বলে, আজ শরীরটা বড় খারাপ লাগছে। শুয়ে পড়ি?

শোও গে।

তুমি?

আমি! আমার কি আজ ঘুম হবে?

তবু শুয়ে থাকবে চলো। চলো।

দুজনে পাশাপাশি শুয়ে রইল। কিন্তু ঘুম হল না কারোই। বুকের মধ্যে নানা অশান্তি আর ভয় আজ নাড়াঘাটা খেয়ে ঘুলিয়ে উঠেছে।

ঘটনার তিন দিন বাদে এক সন্ধেবেলা বামাচরণকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে এল কয়েকজন। মাথা ফাটা, ঠোঁট দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, কপালে একটা ঢিবি ফুলে আছে, সর্বাঙ্গে আরও নানা ক্ষত। বামাচরণ কথা কইতে পারছে না। গোঙাচ্ছে।

সারা বাড়িতে তুমুল কান্নাকাটি আর চেঁচামেচি উঠল। শ্যামলী চেঁচাচ্ছিল, চেঁচিয়ে কাঁদছিল নয়নতারা।

আবার নিজের শরীরের কাঁপুনি আর মাথার অন্ধকার টের পেয়ে বিষ্ণুপদ কিছুক্ষণ স্থবিরের মতো বসে রইল। যারা ধরাধরি করে এনে দাওয়ায় শুইয়ে দিয়েছে বামাচরণকে, তাদের একজন বলল, মাঠের ধারে পড়েছিল।

আবার পুলিন এল। পাড়াপড়শীরা এল। শুধু রামজীবনের কোনও পাত্তা নেই।

বিষ্ণুপদ কোনওক্রমে শুধু পুলিনকে জিজ্ঞেস করতে পারল, বাঁচবে?

পুলিন মাথা নেড়ে বলল, বাঁচবে। হাসপাতালে নিলে ভাল হত। অনেক রক্ত গেছে। কলির শেষ হে, বিষ্ণুপদ। এ হচ্ছে সুন্দ-উপসুলের লড়াই। দেখে যাও, পাপস্খালন হোক।

শ্যামলী চিৎকার করে রামজীবনকে গালাগাল দিচ্ছিল। সেইসব গালাগালের মধ্যে শুয়োরের বাচ্চা, কুকুরের বাচ্চা, বেশ্যার ছেলে, বেজ ইত্যাদির সঙ্গে, মুখে রক্ত উঠে মরার অভিশাপও ছিল। পুলিন একটু বিরক্ত হয়ে বলল, চেঁচামেচি করে কী লাভ হচ্ছে বলে তো! একে বরং ঘরে নিয়ে শোওয়াও গে। আর কাউকে পাঠিয়ে কয়েকটা ওষুধ আনিয়ে নাও। তুলো আর ব্যান্ডেজও লাগবে। তাড়াতাড়ি করো, আমি বেশিক্ষণ বসতে পারব না।

তাই হল। শ্যামলীর চেঁচানি একটু কম হল। বামাচরণকে ঘরে নিয়ে শশাওয়ানোর পর সেটা আরও কমে গেল।

কাণ্ডটা যে রামজীবনের পরম বান্ধবরাই করেছে, এটা বুঝতে কারও বাকি নেই। পুলিন ডাক্তার বিষ্ণুপদর পাশেই একখানা টিনের চেয়ারে বসে বলল, মরতে কি তোমাকে সাধে বলি? এর জন্যই বলি। আগের দিনে যে পঞ্চাশোর্ধ্বে বনং ব্ৰজেৎ নিয়ম ছিল, তারও কারণ হল এইসব।

বিষ্ণুপদ নীরবে শুধু মাথা নাড়ল। কথা কওয়ার মতো অবস্থা নয়।

পুলিন কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে, শুনেছো তো, আমার ছোটো পুত্রটির কাণ্ড। কথা নেই, বার্তা নেই, কোথা থেকে একটা গোদা মেয়েছেলে ধরে এনে বুক ফুলিয়ে বলল, এ আমার বউ। বরণ করো। বোঝ কাণ্ড! আমরা তো হা হয়ে গেছি। তখন সে একখানা লেকচার ঝাড়ল। পুরনো বিয়ের নিয়ম-কানুন সে মানে না, এর সঙ্গে তার আশনাই হয়েছে, তাই একেবারে বিয়ে করে, শাখা সিঁদুর পরিয়ে এনে হাজির করেছে। জুতাপেটা করে তাড়াতে যাচ্ছিলাম, তা গিন্নি আড় হয়ে পড়লেন। মায়েরা তো সব ক্ষমার অবতার। আর মায়ের প্রয়েই যত কুলাঙ্গার তৈরি হয়। কী বলে?

বিষ্ণুপদ সামনের দিকে চেয়েছিল। বুকটা বড় হু-হু করছে। তার বড় ভরসা ছিল, রামজীবন উল্টে কিছু করবে না। সেদিন দায়ের কোপ খেয়েও যেমন ঠাণ্ডা হয়ে রইল, রাগ দেখাল না, তাতেই মনে হয়েছিল, রেমোর বোধহয় একটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সে যে ঠাণ্ডা মাথায় অন্য হিসেব কষেছিল, তা কি বিষ্ণুপদ জানত।

কী ভাবছো হে বিষ্ণুপদ? সংসারের কথা হলে, ও আর ভেবো না। ঘটিবাটি বেচে হলেও অন্য কোথাও গিয়ে থাকে। আমিও তাই ঠিক করেছি। হুগলিতে আমার মেজো ভাই আছে, সেখানে জমির একটু বন্দোবস্ত হয়েছে।

বিষ্ণুপদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, আমি বড় নিষ্কর্মা।

বলেই বুঝল, কথাটার কোনও মানে হল না। তাই ফের বলল, তুমি হলে করিষ্কর্মা লোক। আমার মতে হাবাগোবা নও।

দেখ বিষ্ণুপদ, বহু বছর তোমাকে দেখছি। এই গায়ে উদ্বাস্তু পত্তনের সময় থেকে সুখে দুঃখে একসঙ্গেই আছি। তোমাকে কি কিছু কম চিনি? সাতে-পাঁচে থাকো না, সে ঠিক কথা। কিন্তু তা বলে বসে বসে এইসব দেখবে নাকি?

কোথায় পালাবো বলো? আমার যে যাওয়ার জায়গা নেই। ওইটেই তো ভুল করেছে। একটা যাওয়ার জায়গা করে রাখতে হয়।

বিষ্ণুপদ চোখ বুজে খুব বুক ভরে গভীর শ্বস টানল। মাথার চক্করটা টের পাচ্ছে সে। পুলিন আরও কিছুক্ষণ বকবক করল বসে। সে সব কথা তার কানেই ঢুকল না। তারপর পুলিন উঠে গেল বামাচরণের ঘরে। ব্যাভেজ বাঁধবে, টেডড্যাক ইনজেকশন দেবে।

কিছুক্ষণ বাদে শ্যামলী হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে এসে নাটকীয় ভাবে চেঁচিয়ে বলল, আপনারা পুলিশে খবর দিন, পুলিশে খবর দিন। তারাই এসে দেখুক, এ বাড়িতে রোজ কী হচ্ছে।

পুলিন ডাক্তার ভিতর থেকেই বলে উঠল, চেঁচিও না বউমা, এ রুগীর ঘর। মাথা ঠাণ্ডা রাখো।

বিষ্ণুপদর কাছে সামনের সব দৃশ্যই কেমন যেন কাচের ওপারের দৃশ্যের মতো হয়ে গেছে। যেন এসব অন্য এক জগতের ছবি। সব মিথ্যে, সব মায়া।

বাড়িটা নিস্তব্ধ হল প্রায় রাত বারোটা নাগাদ। সকলেই শুতে গেল। বিষ্ণুপদও। শুয়ে নয়নতারা বলল, হ্যাঁ গো, কৃষ্ণর কত বড় বাড়ি?

বড়ই। তবে জায়গা-বাসা বিশেষ নেই। কেন বলো তো!

আমরা গিয়ে যদি থাকি তো জায়গা হবে?

বলো কি, সেখানে গিয়ে থাকবে!

কেন, ফেলে দেবে নাকি?

বিষ্ণুপদ একটু হাসল, তা হয়তো ফেলবে না। কৃষ্ণ তো রাখতেই চায়। কিন্তু আবার কিন্তুও তো আছে! বউমা।

তা একটু গালমন্দ করবে, অচ্ছেদ্দা অবহেলা করবে। তা করুক না। খুনোখুনি তো দেখতে হবে না।

শেষ বয়সটায় এই যে কষ্ট পাচ্ছে, এও হয়তো ভালই। পাপ কাটছে।

অত পাপ কি করেছি? তুমি কী বলো?

আমার চোখে তো পড়েনি।

তাহলে!

এই তাহলের জবাব কি আর আমি জানি!

আমরা তো আর কাশী-বৃন্দাবন যেতে পারব না। ট্র্যাকের জোর নেই। হ্যাঁ গো, মেজো বউমা নালিশ করলে কি আমাদের পুলিশে ধরবে?

বিষ্ণুপদ একটু ভেবে বলে, তা ধরতে পারে।

এও কি কপালে লেখা আছে, শেষ অবধি?

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মাত্র।

নয়নতারা বলল, আমাকে ধরে ধরুক, সে সইবে। কিন্তু তোমাকে ধরলে যে আমাকে গলায় দড়ি দিতে হবে।

বিষ্ণুপদ মৃদু স্বরে বলল, একটু পান খেয়ে ঘুমোও। কাল কি হবে তা নিয়ে ভাবতে নেই। যা হওয়ার হবে।

ঘুম কি হবে?

একটু পান মুখে দাও। হবে।

বাস্তবিকই পান মুখে নিয়ে নয়নতারা ঘুমোলা। তখন বিষ্ণুপদ টৰ্চটা হাতে নিয়ে এসে বাইরে বসল। বুকের মধ্যে বড় উচাটন। বড় উথাল-পাথাল। একটা আশার আলো যেন বিদ্যুচ্চমকের মতো ঝলসে উঠে মিলিয়ে গেছে।

বামাচরণের ঘর থেকে নানাবিধ শব্দ হচ্ছে। কখনও শ্যামলীর গলা, কখনও বামাচরণের উঃ আঃ।

অপমান করবে? তা করুক। বিষ্ণুপদ উঠোন পেরিয়ে বামাচরণের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।

বউমা, আমি বিষ্ণুপদ।

শ্যামলীর কঠিন জবাব এল, কী চান? শেষ তো করে ফেলেছেন মানুষটাকে।

বউমা, বামার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?

কষ্ট হলে কী করবেন?

আমি বাইরেই বসা আছি। দরকার হলে ডেকো।

আপনাকে বসে থাকতে হবে না। নাকে তেল দিয়ে ঘুমোন গিয়ে। উঃ, কত দরদ!

বিপদের সময়ে বিচলিত হতে নেই। হিতে বিপরীত হয়।

আপনি ঘরে যান। আমার উপদেশের দরকার নেই।

বিষ্ণুপদ একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি বড় অপদার্থ, মা। আমাকে মাপ করে দাও।

একথাটার কোনও জবাব এল না। বামাচরণ শুধু একবার বলে উঠল, কে গো? বাবা নাকি?

তুমি ঘুমোও তো।

বাইরে কী বাবা? ঘরে আসতে বলো।

শ্যামলী কঠিন গলায় বলল, না। তুমি ঘুমোও।

বামাচরণ একবার উঃ বলে কাতর আর্তনাদ করল। তারপর বলল, বাবা গায়ে হাত বোলালে ব্যথা সেরে যায় জানো? ছেলেবেলায়…

আর বলতে পারল না বামা। বোধহয় ঝিমুনি এল।

শ্যামলী চাপা গলায় বলল, আমি বসে সেবা করছি আর উনি বাবা-বাবা করছেন।

বিষ্ণুপদ মাথাটা দুধারে নাড়ল। তারপর বড় ধীর পায়ে ফিরে এল দাওয়ায়।

ধীরে ধীরে বামাচরণের ঘরের শব্দটব্দ সব বন্ধ হয়ে গেল। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়ল দুজনেই।

বিষ্ণুপদর আজ দুচোখ বড় জ্বালা করছে। দু-এক ফোঁটা জলও পড়ল বোধহয়। আজ তার বড় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। যদি এই মুহূর্তেই বুকের শব্দ থেমে যায়, তাহলে বেশ হয়।

একটা ছায়ামূর্তি চোর পায়ে উঠোনে ঢুকল। চারদিকটা আন্দাজ করছে।

বিষ্ণুপদ টৰ্চটা একবার পট করে জ্বালিয়েই নিবিয়ে দিয়ে খুব চপা গলায় বলল, আয়।

ছায়ামূর্তি কাছে এসে দাওয়ায় বসল।

তোর জন্যই বসে আছি।

রামজীবন একটা শ্বাস ফেলল। বিষ্ণুপদ বাতাসটা খুঁকে বুঝল, রামজীবন আজ মদ খায়নি।

কোথায় ছিলি এতক্ষণ?

মনটা ভাল নেই বলে একটু কলকাতায় ঘুরে এলাম। ফিরেছি অনেকক্ষণ, বটতলায় বসেছিলাম।

কী হয়েছে তা জানিস?

জানি। শুনেছি।

এ কাজ করলি কেন? সেদিন মার খেয়েও কেমন ঠাণ্ডা ছিলি, বুকটা আমার ভরে গিয়েছিল। আজ বড় অস্থির লাগছে। কেন করলি বাপ।

নিজের জন্য করিনি বাবা।

কার জন্য করলি?

ও যে আপনাকে আর মাকে উচ্ছেদ করতে চায়!

তা আর বেশী কথা কী? চাইতেই পারে।

রোজ বুঝামেলা ভাল লাগে না বাবা। একদিন একটু শিক্ষা হওয়া ভাল।

বিষ্ণুপদ মাথা নাড়ল, ও ভাবে কি হয় বাপগুণ্ডা লাগিয়ে কি শিক্ষা হয়। বামা যা চায়, তাতে তার হক আছে। লোভী বলে ওর তর সয় না।

বাবা, বামাচরণ কখনও এ সংসারের জন্য কিছু করেছে? আপনাদের সেবা দূরে থাক, কোনওদিন শরীর খারাপ হলে এসে জিজ্ঞেস করেছে, কেমন আছেন? কোনওদিন একটা ফল হাতে করে এনেছে আপনার জন্য। কিছুই করেনি, তবু ভাগ চায় কেন? ভাগে ওর কী অধিকার?

অন্য কেমন তা দেখে তোর দরকার কী? তুই কেমন সেটা নিয়ে ভাবিস না কেন?

আমি কেমন, বাবা?

তোর অনেক গুণ বাপ। অনেক গুণ। কিন্তু বাপকে মাকে ভালটা মন্দটা খাওয়ালে আর ভক্তি শ্রদ্ধা করলেই কি হয়? বুকটা যে ভেঙে দিলি! দায়ের কোপ খেয়েও রেগে গেলি না, সেইটে দেখে যে বড় ভরসা হয়েছিল।

রামজীবন মাথাটা নিচু করে রইল। তারপর বলল, আমি তো খারাপই বাবা। আপনি আমার মধ্যে ভাল দেখেন কেন?

মার খেয়ে যদি উল্টে মারলি, তবে শোধবোধ হয়ে গেল। যদি মার খেয়েও না-মারলি, তবে তোর তবিলে কিছু জমা হল। আমি আহাম্মক, এরকমই বুঝি।

বামা যখন আপনাকে ঘরছাড়া করতে চায়, তখন আমার মাথার ঠিক থাকে না।

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, কাল হয়তো পুলিশ আসবে। আজ অবধি এ জীবনে কখনও পুলিশের সঙ্গে বোঝাঁপড়া হয়নি আমার। এবার হবে।

পুলিশে খবর দিয়েছে, আমি জানি বাবা। তবে এফ আই আর করেছে আমার নামে। থানা থেকেই জেনে এসেছি।

থানায় গিয়েছিলি?

প্রায়ই যাই। কিছু হবে না। সাক্ষী নেই।

ঘরে যা।

যাই। মাঝরাত অবধি বসে আছেন, আপনার শরীর খারাপ হবে না?

শরীর আর কিসের খারাপ হবে? এখনও আছে, এই যথেষ্ট।

ওরকম বলবেন না বাবা।

আমার কখনও মরার ইচ্ছে হয় না। প্রাণটা যতদিন থাকে ততই যেন ভাল। কিন্তু আজ আমার বড় মরার ইচ্ছে হচ্ছিল।

কেন বাবা?

দুনিয়ার সঙ্গে আর লটকে থাকতে পারছি না। আলগা হয়ে গেছি যেন!

রামজীবন হাত বাড়িয়ে বিষ্ণুপদর পা দুটো ছুঁয়ে বলল, এই পা ছুঁয়ে যা প্রতিজ্ঞা করতে বলবেন আজ, তাই করব। বলেন বাবা।

বিষ্ণুপদ নড়ল না। চপ করে বসে রইল।

বলেন বাবা, যা খুশি। আজ যা প্রতিজ্ঞা করাবেন, তাই করব।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, না।

না কেন বাবা? যা বলবেন।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, আমি বিচক্ষণ মানুষ হলে তোক দিয়ে শপথ করিয়ে নিতাম। কিন্তু আমার ভরসা হয় না বাপ। কী করতে কী করে ফেলি! আমাকে মাপ কর।

বলছি তো, আপনি যেমন চান আমাকে তেমন হতে বলুন। প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিন।

তাই কি হয় বাপ? আমি যেমন চাই, তুই তেমনটাই বা হবি কেন? আমি চাইবার কে? দুনিয়ার সব ভালমন্দ কি আমি বুঝি? তুই নিজে বুঝে দেখ বাপ।

আমি যে বুঝতে পারি না বাবা।

আমিও পারি না। এই তো দেখি, বামা মদ-বিড়ি খায় না, অন্য দোষও কিছু নেই বোধহয়, তবু তাকে কি ভাল দেখি। আর এই যে তুই নেশাভাঙ করিস, গুণ্ডার দল নিয়ে বেড়াস, তুই কি ততটা খারাপ? মানুষের ভাল-মন্দর বিচারটাও তো গোলমেলে। আমার কাছে ভাল হলেই কি ভাল, খারাপ হলেই খারাপ। গান্ধীবাবার মধ্যেও তো লোকে খারাপ দেখেছে, নইলে মারে?

রামজীবন আর একটু কাছ ঘেঁষে বসল। বিষ্ণুপদর পা দুখানা কোলে তুলে নিয়ে বলল, আপনি ক্ষমা করলেই আমার সব পাপ মুছে যাবে বাবা।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, ওরকম বলিস না। আমি কি তোর মালিক, না সৃষ্টিকর্তা? ওরকম বলিনি, বাপ-মা তো ক্ষমা করার জন্য মুখিয়েই থাকে। তাদের ক্ষমায় কি ক্ষমা হয়? আরও বড় জজ আছে।

আমার কাছে আপনারা দুজনেই ভগবান।

বিষ্ণুপদ একটু হাসল। বলল, বামা যা চায় দিয়ে দিতে পারবি?

তা কেন পারব না। আপনি বললেই পারব।

দিতে বলিনি। দিতে পারবি কিনা জিজ্ঞেস করলাম।

পারব বাবা।

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, ওতেই হবে।

আপনি আমাকে কখনও মদ ছাড়তে বলেননি বাবা। কেন বলেননি?

বলে কি লাভ?

পা দুখানা বুকের কাছে চেপে ধরে ঝুম হয়ে বসে থাকে রামজীবন। তারপর বিষ্ণুপদ টের পায়, রামজীবন কাঁদছে। ফুলে ফুলে কাঁদছে। সেই কান্না বিষ্ণুপদ নিঃশব্দে বসে শুনতে লাগল। নড়ল না। একটা কথাও বলল না। রামজীবনের কান্নাই যেন আকাশ থেকে অন্ধকার মুছে দিচ্ছে। বিষ্ণুপদর বুক থেকেও। বিষ্ণুপদ বহুকাল এত বুকভরা আনন্দকে টের পায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *