2 of 3

০৬১. বাবা, আমি কাল যাব না

বাবা, আমি কাল যাব না।

হেমকান্ত গন্ডূষের পর ভাতের গ্রাস সদ্য মুখে তুলতে গিয়ে পুত্রবধূর এই কথা শুনলেন এবং একটু বিরক্ত হলেন। যাদের মতের স্থির নেই তারা মানুষ হিসেবেও খুব বিশ্বাসযোগ্য এবং আস্থাভাজন নয়। তবে চপলা সম্পর্কে তাঁর এতকালের ধারণাটা ছিল অন্যরকম এবং বিপরীত।

কেন? আমি যে তোমার চলনদার ঠিক করে ফেলেছি।

কৃষ্ণের নাকি পইতে দিচ্ছেন! কৃষ্ণের খুব ইচ্ছে ওর পইতে পর্যন্ত এখানে থেকে যাই।

হেমকান্ত বললেন, তার এখনও দেবি আছে। ততদিনে কলকাতায় গিয়ে আবার ঘুরে আসতে পারবে।

একথার কী জবাব দেবে চপলা! থাকার কথা বলতে তার খুব লজ্জা করছিল একটু আগেও। কেউ চাইছে না সে আর এখানে থাকুক। শুধু কৃষ্ণ ছাড়া। সে বলল, তা হলে যাব?

হেমকান্ত বললেন, কৃষ্ণ যখন ধরেছে আর তাকে যখন তুমি কথা দিয়েছ তখন তার মতটা নেওয়া ভাল। কিন্তু কৃষ্ণ কোথায় বলল তো! আজকাল তো তাকে রাত্রিবেলা খাওয়ার সময় দেখতে পাই না! সে কি আগে খেয়ে গেছে?

রান্নার ঠাকুর সুদর্শন দু’পা এগিয়ে এসে বলে, ছোটবাবু তো আজকাল রাত্রে ভাত খায় না।

হেমকান্ত অবাক হয়ে বললেন, ভাত খায় না? সে কী? ভাত খায় না তো কী খায়?

চিঁড়ে মুড়ি খই কিছু একটা খান। একটু দুধ আর কলা।

কই, আমাকে তো আগে এসব বলিসনি!

সুদর্শনের মুখে কথা জোগাল না। ছোটবাবু কেন ভাত খায় না তা জিজ্ঞেস করার সাহস তার নেই। বাস রে, ছোটবাবুর চোখ আজকাল ভাঁটার মতো জ্বলজ্বল করে। বড়বাবুর সঙ্গেও কথা বলার অভ্যাস তার নেই। কম কথার গভীর মানুষ, কথা বলতে ভয় করে। সে তো রান্নার ঠাকুর বই নয়। এ বাড়ির ইঁদুর আরশোলার মতোই তুচ্ছ জীব।

লজ্জা পেল চপলা। বাস্তবিক সেও জানত না যে, কৃষ্ণকান্ত আজকাল রাত্রে ভাত খায় না। অথচ বাড়ির বড়বউয়ের তো এটা জানা উচিত ছিল। তবু সে কখনও জানার চেষ্টা করেনি। এ সংসারে কী যে সব ঘটে যাচ্ছে তা এতকাল ভাল করে তাকিয়ে দেখার আগ্রহই সে বোধ করেনি। সে বলল, আচ্ছা, আমি কৃষ্ণর কাছে যাচ্ছি।

হেমকান্ত শান্ত মুখখানা তুলে বললেন, তার দরকার নেই, বউমা। আমি শিশুদের মতামতকেও মূল্য দিই। কাল সকালে বরং আমার সঙ্গে দেখা হলে জেনে নেব।

চপলা মৃদু স্বরে বলে, ও বোধ হয় ব্রহ্মচর্য করছে, বাবা।

হেমকান্ত উজ্জ্বল মুখে বললেন, ওর মধ্যে একটা কিছু আছে বলে কি তোমার মনে হয় না, বউমা?

খুব হয়।

কী আছে বলো তো!

ও খুব তেজি হবে।

হেমকান্ত একটু চুপ করে থেকে বললেন, আমার আর কোনও সন্তান এত উজ্জ্বল নয়। ওর ওই উজ্জ্বলতা তাই আমার কাছে আনন্দেরই বিষয়। কিন্তু ভয় কী জানো?

কী ভয়, বাবা?

এ তো স্বদেশিদের যুগ। তেজি ছেলে দেখে তারা আবার নিয়ে না দলে ভেড়ায়!

এ ভয় যে খুব আছে সে বিষয়ে চপলা নিশ্চিত। তবু মুখে বলল, তা নয়। ও হয়তো সাধু-সন্ন্যাসী হবে।

এ বাড়িতে সেই বীজাণুও আছে। তুমি তো সবই জানো। সাধু হলেও চিন্তার কথা, স্বদেশি হলেও চিন্তার কথা। আমার সঙ্গে তো ওর কোনও ঘনিষ্ঠতা নেই। তুমি একটু জানবার চেষ্টা করো তো, ও আসলে কী হতে চায়।

করব। কিন্তু আপনি ওকে নিয়ে অত ভাববেন না।

মা-মরা ছেলে বলে ভাবি। এই যে রাতে ভাত খায় না তা জানতে আমার কয়েকদিন সময় লেগে গেল, তাও কথাটা উঠল বলে, ওর মা বেঁচে থাকলে কি হত এরকম?

কেউ একথার জবাব দিল না। কারণ কথাটা অত্যন্ত কঠোর সত্য।

হেমকান্ত জিজ্ঞেস করলেন, বিশাখাকেও আজকাল দেখতে পাই না বড় একটা। সেও কি ভাইটার একটু দেখাশোনা করতে পারে না?

চপলা অবাক হয়ে বলে, কিন্তু কৃষ্ণ যে আজকাল এ বাড়িতে থাকেই না। বার বাড়িতে থাকে।

বার-বাড়ি? সে কী?–হেমকান্তর খাওয়া একদম থেমে গেল।

হ্যাঁ বাবা, আমি মনে করেছিলাম, আপনি জানেন।

জানব কী করে? এত বড় বাড়ি, কে কোথায় যাচ্ছে আসছে তা কি নজরে পড়ার কথা? বার বাড়িতে থাকে কেন?

ও-ঘরে ও ধ্যান করে। পড়ে।

কোন ঘরটায় বলো তো!

যে ঘরে শশিভূষণ ছিল।

তার মানে নলিনীর ঘর! —হেমকান্ত খুবই অবাক হয়ে বলেন, ও-ঘরে ও একাই থাকে নাকি? একদম একা।

হেমকান্তর এর পরেও অনেক প্রশ্ন থাকার কথা, কিন্তু সেসব করলেন না। একটা কথা মনে মনে স্থির করে নিলেন। তারপর অনেকক্ষণ বাদে বললেন, ছেলেটা অদ্ভুত।

একথার জবাব কী দেবে চপলা ভেবে পেল না। হেমকান্ত কোনও প্রশ্ন করেননি। কিন্তু তবু বোধ হয় কিছু শুনতে চান। তেমনভাবেই চপলার দিকে তাকালেন।

চপলা মৃদু স্বরে বলল, খুবই অদ্ভুত, বাবা। তবে এটা পাগলামি নয়। অন্য কিছু।

ধ্যান করে বলছ? কীসের ধ্যান? ও তো কোথাও দীক্ষা নেয়নি।

ওর ঘরে ঠাকুরের ফটো আছে।

ওঃ, নলিনীর সেই পাবনার ঠাকুর!–বলে আবার চুপ করে থাকেন হেমকান্ত। একটু যেন চিন্তিত। তারপর বললেন, তোমরা কিছু বলতে যেযো না। ওজন মেপে কথা না বললে একটা গোলমাল হয়ে যেতে পারে। যা বলার আমিই বলব।

বাকি সময়টা হেমকান্ত খুব আনমনে খেয়ে উঠে গেলেন।

গভীর রাতে কেরোসিনের উজ্জ্বল বাতির সামনে বসে হেমকান্ত তার ছেলের কথা ভাবলেন কিছুক্ষণ। তার ছেলে! ভাবতে শরীর কণ্টকিত হয়ে ওঠে পুলকে, গৌরবে, আনন্দে। কিন্তু বস্তুত নিজের কোনও সন্তানকেই তো তিনি সৃষ্টি করেননি। তারা তার মাধ্যমে সৃষ্ট হয়েছে মাত্র। কী করে তারা শরীর ধারণ করল, কোথা থেকে পেল প্রাণ, সে রহস্য তো তার অধিগম্য নয়। তবে এ ছেলে তার একথা তিনি ভাবেন কেন? এই যে “আমার ছেলে’ বা ‘আমার’ বলে বোধ এ এক বিষম অজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা। আসলে তার সন্তান বলে তিনি যাদের জানেন তারা কোনও বৃহতের জটিল সৃষ্টিলীলার ফসল। তিনি নিজেও তাই। হেমকান্ত শুধু এদের অভিভাবক, নিরাপত্তারক্ষী ও জোগানদার। এইসব মহৎ চিন্তা আজ তাঁর হৃদয়কে দ্রব করে ফেলল। মনটা প্রসারিত হয়ে গেল বহু দুর পর্যন্ত।

এই রাত্রির নির্জন নিরাশ্রয়ে হেমকান্ত তার বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভাবলেন। একথা সত্য যে তার জীবনে এখন দুই স্তরের দুটি গ্লানির সংক্রমণ ঘটেছে। তার নিজের জীবনে মনু! তার পুত্রবধূর ক্ষেত্রে শচীন। এই দুই গ্লানি আজকাল অহরহ তাঁকে নিষ্পেষিত করে। চপলার ব্যভিচারহেতু তার নিজের সঙ্গে মনুর সম্পর্কটাকে পর্যন্ত অশুচি মনে হয়। অথচ এরকম মনে হওয়ার কোনও কারণ নেই। সেদিনকার সেই কিশোরীর বয়ঃসন্ধির বাঁধনছেড়া ভালবাসা আজ বয়স ও অভিজ্ঞতার শাসনে সংযত ও সেবামুখী। তিনি নিজেও মৃত্যুচিন্তায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে আরও স্তিমিত, আরও শ্লথ। তবু একটা ঘনায়মান ব্যভিচারের নৈকট্য নতুন করে তাঁর আর মনুর সম্পর্কটাকে বিচার করতে চাইছে অন্য একরকম মাপকাঠিতে। আসছে সংশয়, সন্দেহ, যা আগে কখনও ছিল না।

এই ক্লিষ্ট সময়টায় কৃষ্ণকান্তের মধ্যে কয়েকটি উজ্জ্বল লক্ষণ দেখে তার গ্লানি অনেক কেটে গেল। বুকটা হালকা লাগতে লাগল।

বাইরে তুমুল বৃষ্টিপাত ঘটে যাচ্ছে। জানালার পাল্লা সামান্য ফাঁক করতে গিয়ে তিনি বায়ুবেগের প্রবলতা টের পেলেন। যতদূর চোখ যায় অন্ধকারে সাদা আবছা একটা পতনশীল জলের ঝরোখা।

জানালা আবার বন্ধ করে দিয়ে তিনি ডায়েরি লেখার খাতাটি খুলে বসলেন।

আজ মনে হইতেছে, বয়স হইয়াছে, এ জীবনের অনেক ছেলেখেলা এবার গুটাইতে হইবে। কিন্তু মন কি বয়সের শাসন মানে?

আশ্চর্য এই, যখন যৌবন ছিল তখন আমি প্রকৃত বৃদ্ধের ন্যায় নিস্পৃহ ও উদাস আচরণ করিয়াছি। স্ত্রী ছাড়া অন্য নারীর যৌবনের দিকে আগ্রহী হই নাই। নিজের স্ত্রীর প্রতিও যথোচিত মনোযোগী ছিলাম? মনে হয় না।

আজ যখন যৌবনের ভাণ্ডটি ফুরাইয়াছে, বয়সে লাগিয়াছে অস্তায়মান জীবনসূর্যের রং তখন একটা হাহাকার হৃদয় জুড়িয়া বাজিতেছে। কেবল মৃত্যুভয় নহে, ইহার মধ্যে সুপ্ত ভোগস্পৃহা, আকাঙক্ষা ও যৌবনোচিত আরও অনেক অতৃপ্ত বাসনা লুক্কায়িত আছে। মানুষ তো কেবল কতকগুলি আকাঙক্ষারই সমষ্টি নহে। বিধাতা তাহার মধ্যে অন্য সম্ভাবনার বীজও উপ্ত করিয়াছেন। তবু মানুষ বুঝি আকাঙক্ষা ছাড়া কিছুই জানে না।

আমার জীবনটার শেষভাগ এই আত্মধিক্কারেই পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। আজ এই পরিণত বয়সে যখন সব সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ স্বপ্নের দুয়ার রুদ্ধ হইয়াছে, যখন আর কিছুই হওয়ার নাই বলিয়া ধ্রুব জানিয়াছি তখন মাঝেমধ্যে যৌবনের পাছদুয়ারটি খুলিয়া দিয়া স্মৃতি রোমন্থন করিতে বড় মধুর লাগে।

সেই কিশোরীটির সব কথা এখনও ফুরায় নাই। তাহার সাংঘাতিক ভালবাসা ক্রমে আমাকে তাহার প্রতি মনোযোগী করিয়া তুলিল। তাহার পিতা এস্টেটের সামান্য কর্মচারী মাত্র। তাহার সহিত সুতরাং প্রকাশ্যে সহজভাবে আলাপাদি করা অসঙ্গত ও দৃষ্টিকটু হইত। কিন্তু কোনওপ্রকারে ইহার নৈকট্যও আমার কাম্য বিষয় হইয়া উঠিল।

অনেক ভাবিয়া স্থির করিলাম, ইহাকে যদি আমার স্ত্রীর সর্বসময়ের সঙ্গিনী ও সাহায্যকারিণী নিয়োগ করি তাহা হইলে বোধ করি তেমন খারাপ দেখাইবে না।

কিশোরীটি রোজ প্রাতঃকালে কুঞ্জবনে ফুল তুলিতে যাইত। এই খবরটি আমার জানা ছিল। প্রাতঃকালে শয্যাত্যাগ ও কখনও প্রাতঃভ্রমণ আমারও অভ্যাস ছিল।

একদিন ভোরবেলা যখন আকাশের তারা মুছিয়া যায় নাই, ব্রহ্মপুত্রের বুক হইতে দেবতাদের শরীর-গন্ধ বহন করিয়া এক অলৌকিক বাতাস বহিয়া আসিতেছে, আমাদের সাংসারিকতার স্তর যখন এক স্বপ্নলোকে নিমজ্জিত হইয়া আছে, তখন দুরু দুরু বক্ষে আমি কুঞ্জবনে গিয়া ঢুকিলাম।

কিশোরীটি বড়ই চপলা, দুষ্টমতি। আবছায়া ভোরের আলোয় আমি একটি করবী বৃক্ষের নীচে তাহার ছায়ামূর্তিটি দেখিতে পাইয়া অনুচ্চস্বরে নাম ধরিয়া ডাকিলাম। ছায়ামূর্তি চমকাইয়া উঠিয়া কিছুক্ষণ স্থাণুবৎ দাঁড়াইয়া রহিল। পরমুহূর্তেই আর তাহাকে দেখা গেল না। আমি বেশি ডাকাডাকি করিয়া নিঃশব্দচরণে তাহার অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হইয়া পড়িলাম। বেশি ডাকাডাকি করিলে লোকে জানিয়া যাইবে।

কিন্তু কিশোরীটি দুষ্টবুদ্ধিতে অদ্বিতীয়া। কখনও খুব নিকটেই তাহার পদশব্দ শুনি। অদূরে তাহার দেহের স্পর্শে পত্রপুষ্প শিহরিত হইতেছে। অথচ সে ধরা দিতেছে না।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমি ক্লান্ত হইয়া অনুচ্চ স্বরে বলিলাম, তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল যে! শুনতে চাও না?

আমার পশ্চাতে কয়েক হাত দূর হইতে সে বলিল, কী কথা?

সুনয়নীর শরীরটা ভাল নেই। তুমি ওর কাছে থাকবে?

ঝি হয়ে নাকি?

না, না, ছিঃ! ও কী কথা!

তবে কী হিসেবে থাকব?

এমনি থাকবে। সখী হয়ে।

সই! বুদ্ধিটা কার?

ধরো না কেন, আমারই।

কিশোরী খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল, তোমার তো খুব বুদ্ধি!

আমি মাথা চুলকাইয়া বলিলাম, থাকবে কি না বলো।

কী দেবে?

যা লাগে সবই পাবে। শাড়ি গয়না টাকা। সুনয়নী মানুষও ভাল।

হঠাৎ কিশোরী চাপা গর্জনে বলিল, থাক, আর বউয়ের প্রশংসা করতে হবে না।

আমি অপ্রতিভ হইয়া বলিলাম, তা বলিনি। বলছিলাম সুনয়নী তোমাকে কোনও কষ্ট দেবে না।

আমি শাড়ি গয়না টাকা কিছু চাই না।

তবে কী চাও?

আমি সতীনের সেবা করতে পারব না।

সতীন! আমি নির্লজ্জ মেয়েটার এই সাংঘাতিক বেহায়াপনায় একেবারে হতবাক হইয়া গেলাম, বুকের ভিতরটা দমাস দমাস করিতে লাগিল। পাগলিনী বলে কী!

আমি গলা খাঁকারি দিয়া কহিলাম, ওসব আবার কী কথা!

কেন? তোমার কি লজ্জা হল নাকি?

আমি কিশোরীকে মুখোমুখি দেখিবার জন্য পিছন ফিরিলাম। একটি ঝুমকা ফুলের গাছের আড়ালে সে দাঁড়াইয়া আছে।

বলিলাম, তোমারও এসব বলতে লজ্জা হওয়া উচিত।

কেন, সেদিন তো নদীর পাড়ে অন্য কথা বলেছিলে।

আমি সংকুচিত হইয়া বলি, তোমার কি ভয়ডর নেই? এসব আর কাউকে বোলো না। বললে কলঙ্ক রটবে। তোমার বিয়ে হবে না।

বিয়ে আবার নতুন করে কী হবে? দু’বার হয় নাকি?

আমি প্রমাদ গণিলাম। গলা খাঁকারি দিয়া কহিলাম, আচ্ছা, ওসব কথা থাক। কাজটা করবে তো!

আমাকে ওর সেবা করতে নিচ্ছ কেন?

ভাবলাম আলস্যে সময় কাটিয়ে কী করবে? তোমারও কাজ হবে, সুনয়নীরও ভাল হবে।

আমাকে তুমি দেখতে পারো না কেন?

কে বলল দেখতে পারি না?

আমি সব টের পাই।

আচ্ছা, আর ছেলেমানুষি করতে হবে না। তোমার বাবাকে আজই বলব যাতে সুনয়নীর কাছে তোমাকে পাঠায়।

কিশোরী ধৈর্যহীন স্বরে কহিল, না, বাবাকে বলবে না।

তা হলে? তুমি কি কাজ করতে চাও না?

কাজ আবার কী? আমি চাকরি করতে পারব না।

এটা চাকরি হবে কেন?

আমি সব বুঝি। শোনো, আমি সুনয়নীর কাছে এমনি থাকব। সেবা-টেবার ত্রুটি হবে না। কিন্তু তার বদলে টাকা পয়সা গয়নাগাঁটি কিছু দিতে পারবে না। আমি ওসব নেব না।

কেন? নিলে ক্ষতি কী?

তোমরা বড়লোক, ইচ্ছে করলেই দিতে পারে। কিন্তু ওসব আমার চাই না।

এই কিশোরী যে সহজে প্রলুব্ধ হইবে না এইরকম ধারণা আমার ছিল। ইহার মধ্যে কিছু অসাধারণত্ব আছে, যাহা সহজলভ্য নহে। আমাকে ইহার চরিত্রের সেই রহস্যময় দিকটিই মুগ্ধ করিল। কিশোরীর চেহারাটি ধারালো রকম এবং আকর্ষণীয় বটে, কিন্তু আমার রূপতৃষ্ণা বিশেষ প্রবল নহে। সুতরাং একমাত্র নারীদেহ বা রূপ দেখিয়া মোহিত হওয়া আমার চরিত্রে নাই। কিন্তু এই কিশোরীর ওই অতিরিক্ত, ব্যাখ্যার অতীত একটা চারিত্রিক গুণ আমাকে একেবারে পাড়িয়া ফেলিল। ব্যাখ্যার অতীত এই কারণে যে, মেয়েটি নিতান্তই দরিদ্র এক কর্মচারীর কন্যা। ইহাদের সংসারে নিত্য অভাবের গীত কীর্তন হইতেছে। সেই বিকট দারিদ্র্যের দূষিত আবহাওয়া ইহাদের নৈতিক বোধ ও সততারও হানি ঘটাইতেছে। ব্রাহ্মণের ব্রহ্মতেজ অস্তমিত, এখন বুঝি তাহার মনুষ্যত্বও যায়। সেই পরিবেশে জন্মিয়া ও লালিত-পালিত হইয়া এই মেয়েটি কী করিয়া নিজের অভ্যন্তরে দীপশিখাটিকে নিষ্কম্প রাখিয়াছে তাহা কে জানে! কিংবা মেয়েটি আমার প্রতি মোহমুগ্ধ বলিয়াই কি বিষয়গত ক্ষুদ্রতা হইতে ঊর্ধ্বে উঠিবার চেষ্টা করিতেছে? এবং আমিও ইহার প্রণয়পাশে আবদ্ধ হইয়া একান্তই ভাবাবিষ্ট নয়নে ইহার গুণ আবিষ্কারে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছি!

আমি মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি তবে কী চাও?

তোমাকে খুশি করার জন্য কাজটা করব। আর কিছু চাই না।

বেশ। তাই করো।

তুমি খুশি হবে তো?

হ্যাঁ, হব।

কাজ না দেখেই?

আমি ব্যথিত হইয়া কহিলাম, কাজ তো বেশি কিছু নয়। আসলে কাজ নেইও। শুধু একটু সঙ্গে থাকা। কাজ করার জন্য তো ঝি চাকরের অভাব নেই।

আমি তো ইহাকে কিছুতেই বলিতে পারিলাম না যে, সঙ্গে থাকার জন্যও সুনয়নীর অনেক লোক আছে। আমি শুধু ইহার নৈকট্য কামনা করিয়া সঙ্গে থাকার ব্যাপারটি মস্তিষ্ক হইতে বাহির করিয়াছি।

কিশোবী হঠাৎ কহিল, তোমার বউ আমাকে পছন্দ করবে তো!

করবে না কেন!

একটু জিজ্ঞেস করে দেখো।

কেন বলো তো!

তোমার বউকে খুব বোকা ভেবো না। সেই চিঠি দেওয়ার পর একদিন বুড়ো খাজাঞ্চিমশাই হঠাৎ আমাকে দিয়ে একটা পরচা লেখালেন। কেন লেখালেন তখন বুঝতে পারিনি। পরে টের পেয়েছি। আমার হাতের লেখা তোমার বউ পরীক্ষা করেছে।

আমি বিস্মিত ও ভীত কণ্ঠে কহিলাম, তারপর?

কিশোরী হাসিয়া কহিল, আমি তিন রকম হাতের লেখা জানি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *