বিছানায় গা এলিয়ে প্রথমে মনে হয়েছিল ঘুম আসবে না, কিন্তু কখন যে রাতটা কেটে গেছে টের পায়নি জয়িতা। দরজা জানলা বন্ধ থাকায় ঘরটায় এখনও আবছা অন্ধকার। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে উঠল সে। নটা বাজতে দশ। আজ সকাল দশটায় কফি হাউসে প্রত্যেকের মিট করার কথা। এত বেলা পর্যন্ত কখনও বিছানায় থাকে না জয়িতা। আজ কেউ তাকে ডেকেও দেয়নি।
আর এই সময়েই তার মনে পড়ল আগের রাত্রের কথা। এ ঘরে চলে আসার পর সে সীতারামের কোন সাড়াশব্দ পায়নি। এখনও এই বাড়িতে কেউ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। লাগোয়া বাথরুম থেকে তাজা হয়ে ফিরে এল জয়িতা। কিন্তু তখনই বুঝতে পারল মাথাটা সামান্য টিপটিপ করছে। এতটা ঘুমিয়েও স্থিরতা আসেনি।
জিনসের প্যান্ট আর নীল সার্টটা পরে নিল জয়িতা। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি বোলাল। তার মুখে একটা মিষ্টি ছাপ আছে। চোখে এবং চিবুকে সেটা মাখামাখি। কিন্তু আর কোথাও মেয়েলিপনা নেই। এই যে সে সার্ট প্যান্ট পরে আছে, কোথাও কোন ঢেউ নেই। আজ হঠাৎ ঠোঁট কামড়াল জয়িতা। তারপর মাথা ঝাকিয়ে হেসে ফেলল।
বাইরে বেরিয়ে সে শ্রীহরির মুখোমুখি হল। জয়িতা গম্ভীর মুখে বলল, আমি বেরুচ্ছি।
শ্রীহরি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, জলখাবার খাবে না?
না। সময় নেই। চলতে চলতে উত্তর দিয়ে চারপাশে তাকাল সে। না, কোথাও সীতারামকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। জয়িতা নিজেও চাইছিল না এইসময় মুখোমুখি হতে। দরজাটা টেনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল নিঃশব্দে।
নিচে নেমেও মনে হল এই পাড়ায় দিন শুরু হয়নি। বড় লোকদের পাড়ার অদ্ভুত একটা আলস্যের ছায়া মাখামাখি হয়ে থাকে। ফুটপাতেও লোজন নেই। দোকানপাট বলতে এই পথে একটা কেক-প্যাটিসের দোকান, সেটা এখনও খোলেনি।
আরও কিছুটা এগোতেই সে অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। একটি চোদ্দপনেরো বছরের স্বাস্থ্যবতী মেয়ে হনহন করে এগিয়ে আসছে কাঁদতে কাঁদতে আর তার খানিকটা পিছনে ছুটে আসছেন একজন প্রৌঢ়। প্রৌঢ় ডাকছেন, খুকি আয়, খুকি শোন, জাস্ট এ মিনিট। হঠাৎ মেয়েটা ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, ডোন্ট চেজ মি, ডোন্ট কল মি খুকি!
ভদ্রলোক ততক্ষণে কাছে এসে পড়লেন, আরে তুই বুঝতে পারছিস না।
আমার কিস্যু বোঝার দরকার নেই। তুমি আমার সঙ্গে এসো না।
না মানু, রাগ করিস না–।
রাগ? নো, রাগ কেন করব! হু আর ইউ? তুমি তো আমার বাবা নও। আমাকে একাই যেতে দাও। মেয়েটা চোখের জল মুছে নিয়ে আবার ফিরে দাঁড়াল। জয়িতা ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না। এতক্ষণে তার মনে হল ভদ্রলোককে সে দু-একবার দেখেছে তাদের ব্লকে ঢুকতে। তবে এদিকে থাকে না নিশ্চয়ই, নইলে চিনতে পারত। মেয়েটি যেরকম ভঙ্গি করছে তাতে অন্য জায়গায় ভিড় জমে যেত। জয়িতা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এক্সকিউজ মি! মে আই হেল্প য়ু?
মেয়েটা ওর দিকে তাকাল। তারপর ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ল, না।
জয়িতা এবার ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার বলুন তো? আপনি ওর কে হন?
ভদ্রলোক জয়িতাকে যেন আমল দিলেন না। মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, খুকি, বাড়িতে চল্।
আমাকে তুমি খুকি বলে ডাকবে না। মেয়েটি এবার ফুঁপিয়ে উঠল।
এবার ভদ্রলোক জয়িতার দিকে খানিকটা অসহায় চোখে তাকালেন। বোধহয় এইসময় তিনি বুঝতে পারলেন সামনে আর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন নিজের কাছেই সাফাই দেবার ভঙ্গিতে তিনি বললেন, এই পাড়াটাকে ভদ্রপাড়া বলেই জানতাম। এখানে তো আগেও কয়েকবার এসেছি, এরকমটা দেখিনি।
কি হয়েছে? জয়িতা বুঝল ভদ্রলোক খুব নার্ভাস।
ওই তো, ট্রাম থেকে নেমে মেয়েকে নিয়ে আসছিলাম।–
ভদ্রলোককে বাধা দিয়ে মেয়েটি কান্না জড়ানো গলায় ফুঁসে উঠল, মেয়ে বলবে না।
ঠিক আছে, আছে। ভদ্রলোক চাপা দিতে চাইলেন, হ্যাঁ, ওই যে ওখানে একটা পার্ক আছে, ওর পাশ দিয়ে আসার সময় তিনটে ছেলে রিমার্ক পাশ করতে লাগল।
কোন তিনটে ছেলে?
পার্কের রেলিঙে বসে ছিল। তা আমি বললাম প্রতিবাদ করার দরকার নেই, নির্জন রাস্তা, তাড়াতাড়ি চলে এস। ওসব ছেলেরা যে কি মারাত্মক হয় তা তো জানি। ভদ্রলোক জয়িতাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে হালকা করতে চাইলেন পরিবেশটাকে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি প্রতিবাদ করল, না, তুমি সব কথা বললে না। আমি আর বাবা আসছিলাম। তিনটে রোগা রোগা ছেলে রেলিঙে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। একজন চিৎকার করে বলল–। মেয়েটি কান্না থামাতে ঠোঁট কামড়ে ধরল।
কি বলল? নির্বিকার মুখে জয়িতা প্রশ্ন করল।
আমি বলতে পারব না। খুব খারাপ কথা। ওইসব বলে ওরা আমাকে ডাকছিল। আমি বললাম ছেলেগুলোকে কিছু বলল। তুমি শুনতেই চাইলে না। বরং জোরে জোরে পা ফেলে জায়গাটাকে পেরিয়ে আসতে চাইলে। আমি বললাম, ওরা আমাদের পিছনে আসছে। তুমি বললে, তাকিও না। ওরা ডেঞ্জারাস। ওরা অবশ্য এল না কিন্তু হায়নার মতো হাসতে লাগল। নিজের মেয়ের সম্মান বাঁচাতে পার না তুমি, কি করে নিজেকে বাবা বলছ? শেষ প্রশ্নটায় স্বর উঁচুতে উঠল। কি বলি বলুন তো, ওখানে প্রতিবাদ করতে যাওয়াটা—।
ভদ্রলোক জয়িতার সহানুভূতি পাওয়ার জন্যে তাকাতেই সে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ছেলেগুলো যদি ওকে জড়িয়ে ধরে অত্যাচার করত তাহলে কি করতেন?
না না, সে সাহস পাবে না। নির্জন রাস্তা বটে তবে অতটা—।
যদি করত?
ভদ্রলোক জয়িতার মুখের দিকে তাকালেন। কি বলবেন তিনি বুঝতে পারছিলেন না। জয়িতা বলল, আপনি যদি তখনই প্রতিবাদ করতেন, একটি ছেলেকে মেরে অন্য দুজনের কাছে যদি মার খেয়ে মরেও যেতেন তাহলে সারা জীবন আপনার মেয়ে বলত বাবা আমাকে রক্ষা করতে প্রাণ দিয়েছিলেন। আপনি নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাইলেন আজ কিন্তু চিরকালের জন্যে মেয়ের কাছে মরে থাকবেন।
ভদ্রলোক মাথা নিচু করে বললেন, আমি বুঝতে পারছি, এখন বুঝতে পারছি। আসলে ওরকম কিছু হলে সরে আসাই অভ্যেস হয়ে গেছে তো!
ছেলেগুলো কি এখনও আছে ওখানে?
জানি না।
চলুন তো।
অ্যাঁ! মানে—
আমার মনে হয় আপনার যাওয়া উচিত।
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, ওরা এখন নাও থাকতে পারে। তাছাড়া আমাদের এমনিতে খুব দেরি হয়ে গেছে। আমার এক পরিচিত ভদ্রলোকের মামা পুলিশে বড় কাজ করে। তাকে রিপোর্ট করব আমি। ভদ্রলোকের কথা শেষ করার আগেই মেয়েটি গন্তব্য পথে হাঁটতে শুরু করল। ভদ্রলোক যেন তাতে বেঁচে গেলেন। আর কথা না বাড়িয়ে মেয়েকে অনুসরণ করলেন।
জয়িতা ওদের চলে যাওয়াটা দেখল। ভদ্রলোককে সে বুঝতে পারছে কিন্তু মেয়েটি? তার প্রস্তাবে সে তো সাড়া দিল না। বাবাকে সে অভিযুক্ত করছিল কিন্তু এই সময় তো বাধ্য করতে পারত বাবাকে ছেলেগুলোর সামনে যেতে। ও কেন ফিরতে চাইল না?
জয়িতা সতর্ক হয়ে হাঁটছিল। দুপাশে বাগানওয়ালা চমৎকার বাড়ি। এবং তারপরেই পার্কটাকে দেখতে পেল। পার্কের রেলিঙে একটি ছেলে একা বসে আছে। তিনজনের দলটাকে ধারে কাছে দেখতে পেল না জয়িতা। সে সন্ধিগ্ধ চোখে ছেলেটির দিকে তাকাল। ছেলেটি উদাসীন মুখে বসে আছে। যেন কোন গভীর চিন্তায় মগ্ন। এইসময় পার্কের ধারে ট্রাম স্টপে ট্রাম এসে দাঁড়াতেই একটি অল্পবয়সী মেয়ে নামল। মেয়েটিকে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে ছেলেটি হাত নাড়তে আরম্ভ করল। জয়িতা আর দাঁড়াল না। এবং তখনই তার নজর গেল হাত-ঘড়িতে। সর্বনাশ, আনন্দ আজ খচে ফায়ার হয়ে যাবে! একটা উত্তরের দিকে যাওয়ার বাসের জন্যে উদভ্রান্তের মতো তাকাতে লাগল সে। দেরি হলে আনন্দ শুধু গম্ভীর চোখে তাকাবে কিন্তু চিমটি কাটার সুযোগ পেয়ে যাবে সুদীপটা।
কফি হাউসের সিঁড়ি ভেঙে দোতলার কোণের দিকে তাকাতেই ওদের দেখতে পেল জয়িতা। আনন্দর চোয়াল শক্ত, অর্থাৎ খচছে। সুদীপটা ওকে দেখাবার জন্যেই ইচ্ছে করে ঘড়ির দিকে তাকাল। কল্যাণ বসে আছে চুপচাপ। ওর পাঞ্জাবির ওপরের বোতামটাও বন্ধ। অন্যরকম দেখাচ্ছে ওকে। চতুর্থ খালি চেয়ারটায় গিয়ে বসল জয়িতা। সুদীপ বলল, আধ ঘণ্টা, এমন কিছু বেশি নয়!
আনন্দ বোধহয় শেষপর্যন্ত সামলাল নিজেকে, আমাদের প্রত্যেকের চেষ্টা করা উচিত সময়টা ঠিক রাখা। বাঙালির টাইম ব্যাপারটাকে আমি ঘেন্না করি।
সুদীপ বলল, ঠিক হ্যায়, ওর নিশ্চয়ই কিছু অসুবিধে হয়েছিল। ব্যাপারটা শোনা যাক।
আনন্দ বলল, অসুবিধে তো নিশ্চয়ই হয়েছিল, নইলে দেরি করবে কেন? তবে সেটা আমাদের শোনার কোন প্রয়োজন নেই। কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমরা ইন্টারেস্টেড নই।
জয়িতা হেসে বলল, ফাইন।
আনন্দ মুখ ফেরাল, ফাইন মানে?
জয়িতা বলল, আমি যে টেবিলে বসে সরি বলব তার সুযোগ পর্যন্ত তোরা দিলি না। আর এমন ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছিস যেন আমি কঁসির আসামী। আমি স্বীকার করছি আমার দেরি করা অন্যায় হয়ে গেছে। আর এই দেরিটা হত না যদি রাস্তায় একটা ঘটনা না ঘটত। ঠিক আছে, আমি আবার বলছি, দুঃখিত।
সুদীপ চোখ কুঁচকে তাকাল, রাস্তায় আবার কি হল?
জয়িতা তার দিকে তাকিয়ে বলল, কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমরা ইন্টারেস্টেড নই।
আনন্দ বলল, স্টপ ইট! তোরা কেউ কফি খাবি?
জয়িতা বলল, আমি সকাল থেকে কিছুই খাইনি। আমি একটা লেট-ব্রেকফাস্ট চাই।
কল্যাণ এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। সুদীপ জয়িতাকে জিজ্ঞাসা করল, পকেটে মাল আছে তো?
জয়িতা মাথা নাড়ল, দ্যাটস নট ইওর হেডেক।
এবার কল্যাণ জয়িতার দিকে তাকাল। সেটা দেখতে পেয়ে জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তোর কি হয়েছে? গলা বন্ধ করে বসে আছিস কেন?
জ্বর, গা হাত পা ব্যথা এবং খিদে। কল্যাণ হাসল।
খিদে?
হ্যাঁ। কাল থেকে অনশনে আছি। সারাদিন জ্বরের ঘোরে উঠতে পারিনি। সকালে একটু বেটার মনে হওয়ায় চলে এলাম। বাড়িতে কেউ জিজ্ঞাসা করেনি কিছু খাব কিনা।
সেকি!
এরকমই হয়। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর মানে যদিও হয় না তবু শালা আমি মাঝে মাঝে সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাই। তোদের ফ্রিজ ভর্তি খাবার, তুই খাসনি আর আমার বাড়িতে খাবার নেই বলে খেতে পারিনি। তুই যা বলবি তাই আমার জন্যে বলে দে কিন্তু পয়সা আমি দিতে পারব না। কল্যাণ জয়িতার দিকে তাকাল, তাকিয়ে আবার হাসল।
জয়িতা ঠোঁট কামড়াল। তারপর বলল, দ্যাখ কল্যাণ, তোকে কথাটা আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি। আমাদের জন্মের ওপর কোনও হাত ছিল না। তুই বিত্তহীন পরিবারে জন্মেছিস, আমি বড়লোকমীতে। ফলে আমি যা দরকার তার চেয়ে বেশি পেয়েছি, তুই তার তুলনায় কিছুই পাসনি। কিন্তু তার জন্যে আমরা কেউ দায়ী নই। তাছাড়া আমি সবসময় চেষ্টা করি বাড়ি থেকে দেওয়া ফেসিলিটিগুলো অ্যাভয়েড় করতে। আমার মানসিকতার সঙ্গে তাদের কোন মিল নেই। তুই জেনেশুনে আমাকে খোঁটা দিস কেন?
কথাগুলো কল্যাণ শুনছিল অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল, আমি চাই না বলতে, কেন যে মুখ থেকে বেরিয়ে যায়!
আনন্দ বলল, আসলে তুই এখনও কমপ্লেক্সটা কাটাতে পারিনি।
কিসের কমপ্লেক্স?
জয়িতা বা সুদীপ বড়লোক।
একমিনিট, আমি বড়লোক নই, শ্রীযুক্ত বাবু অবনী তালুকদারের সঙ্গে আমার কোন আর্থিক দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক নেই ভাই। সুদীপ হাত নাড়ল।
কল্যাণ বলল, তুই আমাকে এখনও বুঝতে পারিসনি আনন্দ। ওদের সম্পর্কে আমার জ্ঞানত কোন কমপ্লেক্স নেই। আসলে আমাকে কি লড়াই করে বাড়িতে একা একা বেঁচে থাকতে হয় তা তোরা কেউ জানলি না।
সুদীপ বলল, তোকে লড়াই করতে হয় অভাবের সঙ্গে। আর আমাদের লড়াই নিজের বিরুদ্ধে। একা একা বেঁচে থাকাটা কিন্তু এক। আমরা তো সবাই আমাদের কথা জানি তাহলে আর এই আলোচনা কেন?
জয়িতা বলল, সুদীপ, রামুকে ডাক তো, কল্যাণ আর আমার জন্যে খাবার বল্। আমি যা খাব তাই তোকে খেতে হবে কিন্তু।
সুদীপ বলল, বাঃ, আমি আর আনন্দ?
চারজনের জন্যেই খাবার বলল জয়িতা। তারপর সকালে দেখা মেয়েটার ঘটনা বলল। আনন্দ মাথা নাড়ল, এইটেই মুশকিল। পাবলিকের মেরুদণ্ডটা আটত্রিশ বছরে প্লাস্টিকের হয়ে গেছে। কেউ প্রতিবাদ করবে না। কাল আমি আর সুদীপ যখন দমদমে যাচ্ছিলাম তখন টালা ব্রিজের ওপর সব বাস মিনিবাস লরি একঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়েছিল। পাকপাড়ার কাছে ব্রিজের মুখে চারটে ছেলে টেম্পোয় সন্তোষী ঠাকুর নিয়ে যাচ্ছিল নাচতে নাচতে, কেউ তাদের সরতে বলছিল না, তারাও নেচে যাচ্ছিল।
কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, তারপর? তোরা কি করলি?
সুদীপ উত্তর দিল, আমরা আছি খালের এপাশে বাগবাজারে।
জয়িতা হাসল, সবাই ওইরকম ভাবে, আমি দূরে আছি, সামনাসামনি যারা আছে তারাই প্রতিবাদটা করুক।
আনন্দ মাথা নাড়ল, কথাটা ঠিক বলেছিস তুই কিন্তু কিছু করতে গেলে আমাদের এক মাইল দৌড়ে যেতে হত। ততক্ষণে জ্যামটা বাধিয়ে দিয়ে ছেলেগুলো হাওয়া হয়ে গেছে।
ওরা প্রায় নিঃশব্দে খেয়ে নিচ্ছিল। সুদীপ মাঝে মাজে জয়িতার দিকে তাকাচ্ছিল। গতরাত্রে ওরকম একটা ফোন করার পর সেই প্রসঙ্গ একবারও এল না। কথাটা তোলা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছিল না। খাওয়া শেষ হলে সে খুব স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করল, এভরিথিং নর্মাল?
জয়িতা তখন কল্যাণের প্লেটের দিকে তাকিয়ে। ওর যে খিদে পেয়েছিল খুব তা বোঝা যাচ্ছে। কারণ কল্যাণ খাচ্ছে খুব ধীরে ধীরে। বাকি তিনজনের শেষ হয়ে গেছে, কল্যাণ এখনও মাঝপথেই আছে। বেশ কিছুদিন আগে ও এই থিয়োরিটা জানিয়েছিল। যদি খিদে খুব বেশি থাকে এবং সেই তুলনায় খাবার কম থাকে তখন পেট ভরাবার আমেজ পাওয়ার উপায় হল ধীরে, খুব ধীরে খাওয়া। মনে হবে অনেক খেয়ে ফেলেছি। কিন্তু ওর জন্যে আবার খাবার বলাও যাবে না, সবাই যা খেয়েছে তার বেশি ওকে দিতে চাইলে স্বাভাবিক ভাবে নেবে না। সে সুদীপের প্রশ্নটা এই সময় শুনতে পেয়ে মুখ ফেরাল, কোটে নর্মাল?
সুদীপ একটু বিস্মিত, বলল, কাল রাত্রে যেটা বললি?
জয়িতা কাঁধ নাচাল, ওই বাড়িতে থাকতে হলে ওই সব প্রব্লেম নিয়েই থাকতে হবে। সরি, কাল রাত্রে তোকে ডিস্টার্ব–!
ওকে থামিয়ে দিল সুদীপ, হোয়াটস দিস?
মানে?
হঠাৎ এরকম ফর্মাল হতে আরম্ভ করলি কেন? সুদীপের গলা চড়ল।
আনন্দ এতক্ষণে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?
জয়িতা হেসে ফেলল, এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই না সুদীপ?
আনন্দ বলল, কাজের কথায় আসা যাক। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম কল্যাণকে নিয়ে আজ গ্রামের বাড়িতে যাব। কিন্তু তোর শরীর তো ফিট নয়, রেস্ট নিয়ে সারিয়ে তোল নিজেকে। যদি মনে হয় আমার হোস্টেলে আসতে পারিস।
কল্যাণের খাওয়া তখন শেষ পর্যায়ে। বলল, আমি আজ যেতে পারব।
পারবি তবু বিশ্রাম নে। সুদীপ চলুক। ওর কে এক আত্মীয়া থাকেন ঠাকুরপুকুর। আজই ফিরে আসার চেষ্টা করব। প্রত্যেকে কিপ ইন টাচ। আনন্দ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানাল।
কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, কাল দমদমে কি হল? পার্টি রাজি হয়েছে?
আনন্দ মাথা নাড়ল, না, পার্টি এখনই কোন অ্যাকশনে নামবে না।
জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কি করবে? শহিদ মিনারের তলায় দাঁড়িয়ে গরম গরম কথা বলে পার্টির অস্তিত্বের প্রমাণ দেবে? কি চায় পার্টি?
আনন্দ বলল, পার্টি এখনই এমন কাজ করতে চায় না যেটাকে হঠকারিতা বলা হয়ে থাকে। একটু একটু করে দেশের মানুষের মন দখল করার পরেই পার্টি আন্দোলনের ডাক দেবে। একাত্তর সালে একদল যে ভুল করেছিল পার্টি তা আর করতে চায় না।
কল্যাণ একটু উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল, পার্টি ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছে কবে?
সবাই হেসে ফেলল। আনন্দ বলল, একটা কথা ঠিক পার্টি এখনও অর্গানাইজড নয়। এদেশে এই পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বিপ্লব সম্ভব নয়। একজন নেতা নেই যার ওপর দেশের মানুষ নির্ভর করবে, বিশ্বাস করতে পারবে।
জয়িতা বলল, পিপ্ল? আই ক্যান্ট বিলিভ দেম!
আনন্দ বলল, ভুলে যাস না ইউ আর ওয়ান অফ দেম।
জয়িতা হাসল, সিওর। আই বিলিভ, ঠিক আছে; ক্যারি অন।
আনন্দ মুখ নামাল, ব্যাপারটা হল, এখন শুধু বিপ্লব বিপ্লব খেলা করা যেতে পারে। উইদাউট অর্গানাইজিঙ পিল্ল ঝাঁপিয়ে পড়া বোকামি। তার জন্যে সময় লাগবে। অনেকরকম প্রস্তুতির প্রয়োজন। তাছাড়া জনসাধারণ এখন দিনকে দিন আরও ক্যালাস হয়ে পড়েছে। তাদের ইনভলভড় করা দরকার। একাত্তরের ভুল পার্টি করতে চায় না। ওই অভিজ্ঞতাই পার্টি কাজে লাগাতে চায়। যুক্তি খুঁজতে চাইলে এই বক্তব্যে আমি কোনও ফাঁক পাইনি।
জয়িতা চোখ ছোট করল, তাহলে?
কল্যাণের খাওয়া শেষ। সে জিজ্ঞাসা করল, দ্যাখ আনন্দ, পার্টির সঙ্গে তোর সম্পর্কেই আমরা সম্পর্কিত। সুদীপ বোধহয় কিছুটা। কিন্তু আমি কিংবা জয়িতা এসব মানব কেন?
আনন্দ মাথা নাড়ল, কেউ মানতে বলেনি।
কল্যাণ এমন উত্তর আশা করেনি। ও ভেবেছিল আনন্দ পার্টির পক্ষ নিয়ে তাকে বোঝাতে চাইবে। একাত্তরের আন্দোলন এখন শুধুই স্মৃতি। সেই স্মৃতি কোন কোন পরিবারের পক্ষে তীব্র বেদনাদায়ক। কিন্তু ওরা জেনেছে সেই সময় একটা বিরাট ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা চলেছিল। তখন ওদের বয়স খুবই অল্প। জয়িতা কিংবা সুদীপের কিছুই মনে নেই। আনন্দর আবছা কিন্তু কল্যাণের স্পষ্ট। তখন উত্তর কলকাতায় তাদের পাড়ায় প্রায়ই বোমা ফাটত। মা ওদের ভাইদের জড়িয়ে ধরে বসে থাকতেন। আর বাবার আসার সময় চলে যাওয়ার উপক্রম হলেই তার কান্না শুরু হত। আর মাঝে মাঝেই পুলিশের হামলা হত পাড়ায়। দুদিন তাদের বাড়ি তছনছ করেছিল পুলিশ। সেই ছবিটা এখনও কল্যাণের স্পষ্ট মনে আছে।
কিন্তু পরে একাত্তরের আন্দোলন নিয়ে ওরা অনেক আলোচনা করেছে। নকলপন্থী বলে যাদের চিহ্নিত করা হয় তারা কেন ওই কাজ করেছিল তাই নিয়ে নানান বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। সেসবও ওদের পড়া। যত জানতে চেয়েছে তত ধোঁয়াশা বেড়েছে। পরবর্তীকালে সেই-সময়ের বিখ্যাত ব্যক্তিদের কার্যকলাপ দেখে সেটা আরও ঘনীভূত হয়েছে। সেই সময়ের এক ভারতবিখ্যাত বিপ্লবী নেতা এখন দিনরাত দিশী মদ খেয়ে বেড়ান। কোন দলের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। বিপ্লব করার কল্যাণে তিনি সরকারি আনুকূল্য পেয়েছিলেন ব্যবসা করার জন্যে। সেসব উড়িয়ে দিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় মানুষের করুণা ভিক্ষে করেন মদ খাওয়ার জন্যে। সম্প্রতি ওঁরই এলাকার একদা কমরেডদের সম্মেলন হয়ে গেল কিন্তু তাকে সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, তার নিজেরও বোধহয় সে আকাঙ্ক্ষা ছিল না। এই মানুষটি বুদ্ধিমান নন। নিজের অর্জিত নামকে তিনি কাজে লাগাতে পারেননি। কিন্তু আন্দোলন খতম হয়ে গেলে যেসব মাঝারি নেতা জীবিত রইলেন তারা কিছুদিন অপেক্ষার পর চেহারা পালটাতে লাগলেন দ্রুত। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গিয়ে একে অপরের নিন্দে করা শুরু করলেন। যে আন্দোলন একটা মহৎ প্রচেষ্টার সম্মান পেতে পারত তাকে ছিন্নভিন্ন করার প্রবণতা দেখা দিল এইসব যদুনায়কদের। তারপর এঁদের অনেকেই ফিরে গেলেন সেইসব মানুষ, প্রতিষ্ঠান কিংবা ধারাব কাছে যাঁদের এতকাল এঁরা গালাগাল দিয়ে এসেছিলেন বুর্জোয়া এস্টাব্লিশমেন্ট বলে। যাঁরা এককালে নির্বাচন পদ্ধতিকে গালিগালাজ করেছেন তারাই অতঃপর নির্বাচনের দিকে ঝুঁকেছেন। মজার কথা, দু-একজন ছাড়া কাউকেই জনসাধারণ নির্বাচিত করেনি। তাও প্রথমবার, পরের নির্বাচনে তাদের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
তবে বেশিরভাগই গুছিয়ে নিয়ে শান্ত হয়ে বসেছেন। এঁরা অবশ্য সেইসময় সম্মুখ সমরে নামেননি, বুদ্ধি চালান করে পুলিশের বিরাগভাজন এবং জনসাধারণের কাছে পরিচিত হয়েছিলেন। যদিও খুব অন্তরঙ্গ মহলে একটা গোপন রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের বাতাবরণ সৃষ্টি করে রাখেন এঁদের কেউ কেউ কিন্তু আসল সত্যিটা এতদিনে প্রকট হয়ে পড়েছে। আর যারা সম্মুখ সমরে নেমেও জীবিত আছেন তারা ক্রমশ বুঝে যাচ্ছেন কিছু করার নেই। জীবনের সবচেয়ে দামী সময় আন্দোলনে কাটিয়ে দেওয়ায় এঁদের পক্ষে এখন পায়ের তলায় মাটি পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর ফলেই বিভিন্ন উপদলের উৎপত্তি হয়েছিল, পরস্পরকে সন্দেহ এবং গালিগালাজ করার প্রবণতা বেড়েছিল। এখন সেসবও থিতিয়ে গেছে। অতবড় একটা আন্দোলন, যৌবনের বাঁধভাঙা উচ্ছাস যেন কোন কাজেই লাগল না। জনসাধারণের জীবনযাত্রায় কোন প্রতিক্রিয়া ঘটল না। দেশের ষাট থেকে সত্তর কখনও আশিভাগ নাগরিক ভোটর বাক্সে কাগজ ফেলে নিশ্চিন্তে ঘরের কোণায় জায়গা খুঁজেছে। দেশটার দায়দায়িত্ব দুটো রাজনৈতিক দলের ওপরে দিয়ে তারা জেনে গিয়েছে কিছু করার নেই। যে তাদের পাইয়ে দেবে সেই দলই ব্যালটটা পাবে। মাঝে মাঝে আবেগের হাওয়ায় অবশ্য ভাসাভাসি চলে কিন্তু স্বার্থ শব্দটার বাইরে আর কিছুর কথা জনসাধারণ ভাবতে রাজী নয়। ক্রমশ এই স্বার্থ শব্দটার ক্ষেত্রও ছোট হয়ে আসছে। এখনও পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে নিজেরটা বাঁচাও-এর মধ্যে সীমিত আছে। কদিন পরে পাশের ঘরে মা বাবা পুড়ে মরলে সে নিজের শরীরটাকে বাঁচাতে আগে ছুটবে।
এই পরিস্থিতিতে নবগঠিত পার্টি ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বেশ কিছু অচলায়তনকে ধাক্কা দেওয়া রক্তগরম করা শব্দাবলী একত্রিত করে ছাপা একটি লিফলেট ওদের হাতে পড়েছিল। ওরা বিস্মিত হয়েছিল কিছু মানুষ এ ব্যাপারটা নিয়ে সক্রিয় ভাবনা ভাবছেন এবং খুব গোপনে সংগঠন গড়ে তুলছেন। এরপরেই আনন্দর সঙ্গে পার্টির যোগাযোগ হয়। আনন্দ প্রায় নিয়মিত যাওয়া আসা করত। বাকি তিনজন ছিল অনিয়মিত। এর পিছনে কোন নির্দিষ্ট কারণ ছিল না। শুধু একটি জনসভায় উপস্থিত থেকে ওরা কিছু জ্বালাময়ী বক্তৃতা শোনার পর ওদের মনে কিছু প্রশ্ন জাগে। সেইসঙ্গে দ্বিধা। ওরা স্থির করে নেয়, আনন্দই যোগাযোগ রাখবে। ওদের ধারণা হচ্ছিল এখন কোন অবস্থাতেই পার্টির পক্ষে সাহসী হওয়া সম্ভব নয়। এমন একজন নেতা পার্টিতে নেই যাকে জনসাধারণ বিশ্বাস করবে। অতএব আরও বিশদভাবে পরবর্তী কার্যাবলী লক্ষ্য করা দরকার বলে ওদের মনে হয়েছিল।
কল্যাণ এবার সুদীপকে জিজ্ঞাসা করল, ঠাকুরপুকুরে তোর কে থাকে?
কাফি দূরের রিলেটিভ। বুড়ি আমাকে পছন্দ করে বলে মনে হয়।
তা করুক। কিন্তু এর সঙ্গে তোর গ্রামের কি সম্পর্ক? প্রশ্নটা আনন্দর উদ্দেশ্যে।
আনন্দ হাসল, এই নিয়ে আলোচনা করার জন্যে আমরা এখানে এসেছি। তার আগে আমি প্রত্যেককে একটি প্রশ্ন করছি। যে কাজ করব বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাতে কারও কোন দ্বিধা বা ভয় নেই তো?
কল্যাণ মাথা নাড়ল, প্রশ্নই ওঠে না।
সুদীপ বলল, এই প্রশ্নটাই নিরর্থক।
জয়িতা আনন্দর দিকে তাকাল, এই প্ল্যানটার কথা এখন পর্যন্ত কজন মানুষ জেনেছে?
আনন্দ বলল, দমদমে কাল তিনজন ছিল আর ধর, আমরা ছাড়া আর চারজন জানে। কিন্তু নট ইন ডিটেলস। আমি স্পটটাও বলিনি তবে ওরা জানে আমরা চারজন একসঙ্গে আছি, দ্যাটস অল।
কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, এই চারজনের কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে?
আনন্দ মাথা নাড়ল, না, সেরকম হওয়ার চান্স খুব কম। তাছাড়া তোদের সঙ্গে কথা বলেই আমি গিয়েছিলাম। কখনও কখনও তো বিশ্বাস করতে হয়।
জয়িতা বলল, এই বিশ্বাসটা যেন আমাদের খুব বড় দাম দিতে বাধ্য না করে।
আনন্দ চট করে প্রশ্ন করল, তুই কি ভয় পাচ্ছিস সঙ্গে আসতে?
মোটই না। হেসে উঠল জয়িতা, আবার সেইসব বস্তাপচা শব্দগুলো যেন তোরা বলতে শুরু করিস না। তোরা যা করতে পারবি আমিও তাই পারব। এইভাবে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে মরতে আর মরা দেখতে ভাল লাগে না। ভবিষ্যতের কথা যদি ভেবে ভয় পেতাম তাহলে তো নিজের ক্যারিয়ার গোছাতাম রে। তবে এখন থেকে আমাদের চারজনের বাইরে কোন কথা আর কাউকে বলার দরকার নেই। কারও কাছে কিছু যখন পাওয়া যাবে না–।
সুদীপ গুনগুন করল, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে–।
আনন্দ চাপা গলায় বলল, বি সিরিয়াস সুদীপ!
গান থামিয়ে গম্ভীর মুখ করে সুদীপ বলল, আই অ্যাম অলওয়েজ সিরিয়াস। তারপরেই দূরের এক টেবিলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করল, কিরে, তোদের পত্রিকা বেরিয়েছে? ওপাশ থেকে একটি ছেলে হাত নেড়ে না বলল।
জয়িতা বলল, চমৎকার নমুনা।
সুদীপ হাসল, যদি কেউ আমাদের লক্ষ্য করে তাহলে এখন ভাববে আমরা স্রেফ আড্ডা মারছি। এতক্ষণ যা গম্ভীর মুখে তোরা কথা বলছিলি যে দেখলেই সন্দেহ হত।
আনন্দ বলল, ঠিক আছে। আর ফালতু কথা নয়। শোন, আমরা বিকেলের বাস ধরে ডায়মন্ডহারবারের উদ্দেশ্যে রওনা হব। ওখানে পৌঁছতে হবে এমন সময় যাতে সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে আসে। তোরা সবাই আমার বাড়িতে চলে আসবি। আমার এক বন্ধু ড্রাইভারি করে, মানে একসঙ্গে আমরা স্কুলে পড়তাম, তাকে বলব গাড়ি আনতে। সেই গাড়ি নিয়ে জয়িতা আর সুদীপ প্যারাডাইসে পোঁছে যাবি।
সুদীপ মাথা নাড়ল, আর একজন উইটনেস থাকছে না?
আনন্দ বলল, ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভেবেছি। কিন্তু আমাদের একটা গাড়ি দরকার।
সুদীপ বলল, আমি গাড়ি চালাতে পারি। কাউকে কিছু বলার কোন দরকার নেই।
জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, গাড়ি পাবি কোথায়?
সুদীপ হাসল, পেয়ে যাব। রাস্তায় এত গাড়ি আর একটা গাড়ি পাব না? আমি তো আজ আনন্দর সঙ্গে যাচ্ছি, হালচাল দেখে ওটা ঠিক করে আসব।
আনন্দ বলল, ধর, তোর কিছু হল?
হঠাৎ সবাই চুপ করে গেল। আনন্দর প্রশ্নটা নিয়ে সুদীপ অবশ্য বিব্রত হচ্ছিল না। কারণ তার ঠোঁটে হাসি লেগেই ছিল। জয়িতা বলল, আমি চালাব তাহলে।
আনন্দ খুশী হল, বেশ তাহলে একটা ঝামেলা চুকল। গাড়িটা কিভাবে পাওয়া যায় তা আজ আমরা দেখে আসব। এবার কেন সুদীপের আত্মীয়ের বাড়ির কথা বলছি সে প্রসঙ্গে আসছি। সুদীপের কাছ থেকে শুনেছি যে ওই বাড়িতে ভদ্রমহিলা একা থাকেন। বেশ বড় বাড়ি। জায়গাটা কলকাতার কাছেই আবার আমাদের গ্রাম থেকে সোজা চলে আসা যায়। যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে আমরা ওই বাড়িতে শেল্টার নিতে পারি। কিন্তু এসবই নির্ভর করছে সুদীপ কিভাবে ওর আত্মীয়াকে ম্যানেজ করবে তার ওপর। যদি তিনি রাজী হন তাহলে যতদিন না সবকিছু ঠাণ্ডা হচ্ছে ততদিন আমরা নিশ্চিন্ত।
সুদীপ বলল, বুড়িকে আমি ম্যানেজ করে নেব, তুই চিন্তা করিস না।
আনন্দ বলল, হলে ভাল নইলে আমাদের চিন্তা করতে হবে। আমি বলছি না যে ওই রাত্রে শেল্টারের প্রয়োজন হবেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমরা যে যার বাড়িতে ফিরে যাব হয়তো, কিন্তু সামান্য ঝুঁকি হয়ে গেলে বিকল্প ব্যবস্থা হাতে রাখতে হবে। অন্যান্য যা দরকার আমি আর সুদীপ ম্যানেজ করে নেব। শুধু জয়িতা, পাঁচ হাজার টাকা দরকার। এইটের ব্যাপারে তুই কোন হেল্প করতে পারিস?
পাঁচ হাজার? ও সিওর!
কিভাবে?
দুটো বালা আছে, হার আছে, মানে আমার কাছে যা আছে তাতেই ওই টাকা হয়ে যাবে। শুধু আমি জানি না কোথায় বিক্রি করলে ঠিকঠাক টাকা পাওয়া যায়!
ওগুলো বিক্রি না করে টাকাটা পাওয়া যাবে না?
কিভাবে? আমার মুখ দেখে পাঁচ হাজার কেউ দেবে? টু মাচ এক্সপেকটেশন!
ইয়ার্কি মারিস না। বাড়ি থেকে টাকাটা ম্যানেজ করতে পারবি?
নো! আমি কারও কাছে ভিক্ষে চাইতে পারব না।
কল্যাণ চুপচাপ শুনছিল, বলল, পাঁচ হাজার টাকা আমার কাছে আকাশের চাঁদের মত। এখন আমি কোন কাজেই লাগতে পারছি না, না?
আনন্দ বলল, তোর কাজ পরে। তারপর জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের কিছু টাকা হাতে রাখা উচিত। বেশ কিছু টাকা, যাতে প্রয়োজন হলে কিছুদিন চুপচাপ কাটিয়ে দিতে পারি। সুদীপের সঙ্গে ওর বাবার রিলেশন অনেকদিন থেকেই খারাপ। তার ওপর ওদের বাড়িতে ইনকামট্যাক্স-রেইড হয়ে গেছে। এছাড়া আর একটা জিনিসের দায়িত্ব নিয়েছে সুদীপ। আমি জানতাম যতই তুই অপছন্দ করিস না কেন, তোদের সম্পর্ক সুদীপদের মত নয়। তুই চেষ্টা করলে
গতরাত্রে সেটা শেষ হয়ে গিয়েছে। ভুল বললাম, শেষ হয়েছিল অনেক আগেই, কাল তার শ্রাদ্ধ হল। এখন আর আমি কিছু চাইতে পারব না।
সুদীপ বলল, ঠিক হ্যায়। এখনও কিছুদিন সময় আছে হাতে। সবাই মিলে ভাবলে একটা পথ বের হয়ে যাবে। জয়িতা, আমরা যেটা করতে চাইছি সেটা এদেশের আইনের চোখে অপরাধ। কিন্তু আমরা মনে করি ওই অপরাধগুলো মানুষের বিবেকবোধ জাগ্রত করবে। আমরা মনে করি ওই অপরাধগুলো করা মানুষ হিসেবে আমাদের পবিত্র কর্তব্য। ব্যাপারটা যদি তাই হয় তাহলে ঘরের দুর্গ আক্রমণ করতে দোষ কি?
একটাই প্রশ্ন থেকে যায়। আমরা যে সব অপরাধ, মানে ওই আইনের চোখে, করতে যাচ্ছি তা আরও অনেক বড় অপরাধকে নষ্ট করার জন্যেই। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের জীবন তারা তাদের মত চালাচ্ছেন, আমি তা মানতে পারছি না, কিন্তু তারা অপরাধ করছেন কিনা সেটা প্রমাণিত হচ্ছে কোথায়?
জয়িতা খুব সরল প্রশ্ন করল।
সুদীপ ভাবছিল জবাবটা। আনন্দ বলল, ঠিক আছে, আপাতত এই প্রসঙ্গ থাক। তোরা একটু এগিয়ে আয়। পাশের টেবিলে লোক এসেছে। আমার প্ল্যানটা হল–।
চারটে মাথা প্রায় একহাতের বৃত্তে পৌঁছে গেল চারকোণা থেকে।