পাঁচ
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অর্ক দেখল শরীর নড়বড়ে, দুটো হাঁটু যেন অকেজো হয়ে গিয়েছে। চোখের দৃষ্টি বারংবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আর পেটের ভেতরে জমে থাকা যাবতীয় তরল এবং গলিত পদার্থ পাক খেয়ে ঢেউ-এর মত গলা অবধি উঠে আবার নেমে যাচ্ছে। যতক্ষণ বসেছিল ততক্ষণ এসব এমন করে টের পায়নি। দু’তিন গ্লাস খাওয়ার পর বেশ মজা লাগছিল। একমাত্র খুরকি আর কিলা ছাড়া বাকিরা বেশ আলতু ফালতু বকছিল। সেই স্ত্রীলোকটি অন্ধকার থেকে বোতল আনছিল আর শুড্যাটা টাকা নিয়ে যাচ্ছিল। প্রথম প্রথম হিসেব ছিল ঠিকঠাক, কত টাকা খরচ হচ্ছে মনে রাখতে পারছিল কিন্তু তারপরেই সব গুলিয়ে গেল। এখন পকেটে টাকা আছে কিন্তু কত আছে তা সে জানে না। শরীরের সমস্ত শক্তি যখন আচমকা মরে গেল তখনও তার ভাবতে কোন কষ্ট হচ্ছিল না। অন্যদের থেকে যে তার বুদ্ধি সাফ এটুকু জেনে সে খুশি হচ্ছিল। কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই লোডশেডিং-এর মত সেটুকু হারিয়ে গেল। এখন মাথার ভেতরে কিছু নেই, একটা ঢেউ-এ ভাসছে যেন সে। কেউ যেন তাকে টানছে, অর্ক মুখ ফিরিয়ে দেখবার চেষ্টা করল, ‘কে বে?’
গলার স্বর নিজের কাছেই অচেনা মনে হল। কেমন মোটা এবং জড়ানো।
খুরকি বলল, ‘এদিকে আয়।’
‘কেন বে?’
খুরকিও টলছিল। মুখের সামনে হাত নেড়ে বলল, ‘ভেগে পড়ি চল। এ শালারা আউট হয়ে গিয়েছে।’ কথাটা শেষ করেই খুরকি ওর বাজু ধরে টানতেই অর্ক হাঁটতে লাগল। গঙ্গার দিকে নয়, বিপরীত দিকের গলিতে ওরা ঢুকে পড়েছে। চারধার ঘুটঘুটে অন্ধকার। কয়েক পা যাওয়া মাত্র পেছন থেকে ডাক ভেসে এল, ‘আবে অক্ক, ফুটছিস কেন?’
খুরকি দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘অ্যাই কিলা, তোকে ডাকব ভেবেছিলাম কিন্তু একদম ভুলে গিয়েছি। এসো দোস্ত, আমরা তিনজনে যাই।’
কিলা ততক্ষণে ওদের পাশে এসে পৌঁছেছে, ‘একদম বাতেলা করবি না, আমি ওয়াচ করছিলাম। তুই মুরগিকে নিয়ে হাওয়া হবি আমি জানতাম; ছোড় ইয়ার, আমার নাম কিলা।’
খুরকি অর্ককে ছেড়ে কিলাকে জড়িয়ে ধরল, ‘না দোস্ত, তোকে ব্যাণ্ডেজ করতে পারি আমি? হাত মেলাও গুরু, দোস্তি হয়ে যাক।’
অর্ক দেখল ওরা অনেকক্ষণ ধরে করমর্দন করল। কিলা কাকে মুরগি বলল? তাকে? অর্ক ঠিক ভেবে পাচ্ছিল না। তাকেই কি? কিন্তু সে কোন ঝামেলায় গেল না। পকেটে এখনও কিছু টাকা আছে। এগুলোকে সামলাতে হবে। দুটো হাত পকেটে ঢুকিয়ে দিল অর্ক।
গলিটা এঁকেবেঁকে একসময় ট্রাম রাস্তায় উঠে এল। এখন চারপাশের দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। তার মানে, অর্ক বুঝল, বেশ রাত হয়ে গেছে। তার নিজের হাতে ঘড়ি নেই। সে কিলাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘টাইম কত বে?’
‘কি হবে টাইম জেনে?’
‘বাড়ি যাব।’
‘তোর নেশা হয়েছে অক্ক! তুই শালা মাতাল।’
‘কোন খানকির ছেলে আমাকে মাতাল বলে?’ চিৎকার করে উঠল অর্ক, ‘জানিস আমি ভদ্রলোকের ছেলে। আমি বাড়ি যাব।’
কিলা বলল, ‘বাড়িতে ঢুকলে তোর মা কি বলবে তোকে? আদর করে চুমু খাবে? বাবা মাল খেয়েছ, এসো হামি খাও। চুক চুক!’ জিভ দিয়ে শব্দ করল সে।
আর তখনই ভয়টা মনে ঢুকে পড়ল অর্কর। সেকি সত্যি মাতাল হয়ে গেছে? সত্যি মা কি ওকে দেখেই বুঝতে পারবে? হঠাৎ কেমন ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করল ওর। মা শালা তাকে ঠিক প্যাঁদাবে, হয়তো বাড়ি থেকে বের করে দেবে। বাপ শালা নুলো কিন্তু রাগলে চোখ জ্বলে। পুলিসকে প্যাঁদাতো তো এককালে! না, এখনই বাড়ি যাওয়া উচিত হবে না। কিন্তু সত্যি সে মাতাল? ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করল সে খুরকিকে।
খুরকি বলল, ‘ঠিক হ্যায়, পরীক্ষা হয়ে যাক তুই মাতাল কিনা? মাতাল হলে আমরা বাড়ি যাব না এখন, না হলে ফিরে যাব। ঠিক আছে?’
অর্ক ঘাড় নাড়ল।
খুরকি এগিয়ে গেল ট্রাম রাস্তার উপর। এখন দুপাশে ফাঁকা। গাড়ি কিংবা বাস চলছে না। তবে রিকশাঅলারা খুব ছোটাছুটি করছে। খুরকি চেঁচাল, ‘এই কিলা, তুই ওদিকে দাঁড়া। লাইনটার ওপরে।’
একটা ট্রাম লাইনের এপাশে খুরকি ওপাশে কিলা দাঁড়াল। ঠিক হল ট্রাম লাইনের ওপর পা ফেলে অর্ক হেঁটে আসবে। যদি ওর পা লাইনের বাইরে পড়ে তাহলে প্রমাণ হবে সে মাতাল। কিলা আর খুরকি দুপাশে বসে এর বিচার করবে।
‘আমি মাতাল হইনি। এই লাইনের ওপর হেঁটে যাওয়া জলের মত সোজা।’ অর্ক কিলার সামনে লাইনে পা দিল। তাকে হাঁটতে হবে দশ হাত, যেখানে খুরকি দাঁড়িয়ে টলছে। কিলা চেঁচাল, ‘রেডি! স্টার্ট!’
অর্ক পা ফেলল। এই পা কি তার নিজের? অনেক চেষ্টার পর লাইনেই পা পড়ল তার। পেছনের পা টেনে আনতে সাহস পাচ্ছিল না সে কিন্তু এগোতে হলে ওটাকে আনতেই হবে। স্থির হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চোখের দৃষ্টিকে স্বচ্ছ করার চেষ্টা করল অর্ক। আর সেই সময় কানের কাছে আচমকা ঢং ঢং শব্দ বেজে উঠল তারস্বরে। অর্ক কোনক্রমে পেছন ফিরে তাকাল। দৈত্যের মত দুই জ্বলন্ত চোখে একটা ট্রাম ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কখন। ড্রাইভার ঘণ্টা বাজাচ্ছিল, এবার চিৎকার করে সরে যেতে বলল। এটা বোধহয় শেষ ট্রাম।
খুরকি চেঁচাল, ‘আয় বে, হেঁটে আয়। হাঁটি হাঁটি পা পা!’
ট্রামের ড্রাইভার যেমন চেঁচাচ্ছে, যাত্রীরাও মুখ বের করে গালাগাল দিচ্ছে। অর্ক পা ফেলল, ঠিক আছে কিন্তু তারপরই সে লাইনের বাইরে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ওরা দুজন চিৎকার করে হাততালি দিয়ে উঠল। অর্ক কিছু বোঝার আগেই গায়ে হাওয়ার ঝটকা লাগল। বিদ্যুৎচমকের মত ট্রামটা তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
‘তুই শালা মাতাল, ঠিক আছে।’ খুরকি কাছে এল।
‘মাতালের কাছে টাকা রাখতে নেই, ছিনতাই হয়ে যায়।’ কিলা হাত পাতল, ‘টাকাগুলো দে।’
পা ফেলতে না পারার জন্যে নয়, ট্রামটার ছুটে যাওয়া শরীর অর্ককে খুব নার্ভাস করে দিয়েছিল। হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছিল তার। সে কথাটা শোনামাত্রই সতর্ক হবার চেষ্টা করল, ‘কিসের টাকা?’
‘আরে চাঁদু, এখন বলে কিসের টাকা! বিলা হচ্ছে? ছাড়!’
দু’ পকেটে হাত ঢুকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল অর্ক, ‘কি বলছিস?’
কিলা ওর কাঁধে একটা থাবড়া মারল আস্তে করে, ‘বিকেলবেলা অতগুলো মুরগি কাটলাম ন্যাড়ার মাকে দেখিয়ে, সেই মালগুলো দে বে?’
‘কি করবি? ওটা তো ন্যাড়ার মায়ের টাকা!’
‘একি মাইরি, মাতাল না হরিদাস পাল?’ হেসে গড়িয়ে পড়ল কিলা, ‘যার নামের টাকা সে তো কখন ফোট হয়ে গেছে, এতক্ষণে ছাই পর্যন্ত নেই। দে বে, আর কথা বলতে ভাল লাগছে না।’
অর্ক বুঝতে পারছিল কিলার দাবি না মিটিয়ে সে পারবে না। তবু সে খুরকির দিকে তাকাল। খুরকি এক দৃষ্টিতে ওদের দেখছিল। এবার নীরবে মাথা নাড়ল, ‘কার বাপের টাকা বে?’
সঙ্গে সঙ্গে কিলা ঘুরে দাঁড়াল, ‘মানে?’
‘কার বাপের টাকা যে তুই নিবি?’
‘খবরদার খুরকি, বাপ তুলে কথা বলবি না। এ টাকা আমার, সতীশদা আমাকে তুলতে বলেচে।’ কিলা এগিয়ে যাচ্ছিল খুরকির দিকে। কিন্তু কাছে যাওয়ার আগেই থমকে দাঁড়াল সে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টলতে লাগল। খুরকির হাতে তখন একটা চ্যাপ্টা খুর, খুরটাকে তুলে সে পরম স্নেহে চুমু খাচ্ছে। কিন্তু দৃষ্টি কিলার ওপর নিবদ্ধ।
কিলা চেঁচিয়ে উঠল, ‘খুরকি! মাল সরা!’
খুরকি উত্তর দিল না কথাটার। একটু হেসে বলল, ‘অক্ক, টাকাটা আমাকে দে!’
কিলা দুটো হাত দুপাশে বাড়িয়ে বুক চিতিয়ে বলল, ‘না বে, ও টাকা আমার। সতীশদা না বললে ওই টাকা আমরা তুলতাম না। সতীশদা আমার পার্টির লোক তাই টাকা আমার।’
খুরকি হাসল, ‘তোর সতীশের মুখে আমি—ফোট্। অক্ক, টাকাটা দে।’
অর্ক বুঝতে পারছিল একটা কিছু গোলমাল হতে যাচ্ছে। রাস্তাটা এখন একদম ফাঁকা। সে এদের থামাতে চাইল, ‘মাইরি খুরকি, তুই এত চালাক আর এটুকু বুঝিস না কেন বে?’
‘কি বুঝি না?’
‘নিজেদের মধ্যে গোলমাল করলে মুশকিল হয়।’
‘নিজেদের মধ্যে মানে? ও শালা সতীশের জাঙ্গিয়া।’
কিলা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘তুই বে নুকু ঘোষের গেঞ্জি।’
ঠিক সেইসময় দূরে একটা গাড়ির শব্দ ভেসে এল। শব্দটা শুনে খুরকি, চকিতে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করল, ‘ভাগ, গিরধর আসছে।’
কথাগুলো মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সে ঢুকে গেল পাশের গলিতে। কিলা এগিয়ে আসা গাড়িটাকে ভাল করে দেখে সুড়ুৎ করে সরে গেল।
অর্ক প্রথমে বোঝেনি এরা কেন পালাচ্ছে। কত গাড়ি তো রাস্তা দিয়ে গিয়েছে, এটার কি বিশেষত্ব! তবু ওর মনে হল এই গাড়ি থেকে কোন বিপদ আসতে পারে। কিন্তু সে দৌড়াতে গিয়ে বিফল হল। শরীরের ওপর কোন অধিকার নেই যেন তার। এক পলকে চোখে পড়ল সামনেই একটা রক, রকের একটা দিকে উঁচু দেওয়াল। হুড়মুড় করে সে ওই দেওয়ালের গায়ে শুয়ে পড়তেই একটা লোক চিঁ চিঁ করে উঠল, ‘কে রে, মরে গেলাম, চেপে দিল রে, উঁহু হু।’ জড়ানো গলায় অর্ক ধমক দিল, ‘চুপ, পেট ফাঁসিয়ে দেব।’ শোনামাত্রই লোকটা চুপ করে গেল।
অর্ক দেখল সারা শরীরে ছেঁড়া বস্তা চাপিয়ে একটা ভিখিরী টাইপের বুড়ো ওর পাশে শুয়ে জুলজুল করে দেখছে। হঠাৎ ওর বমি পেল। কয়েক গ্লাস বাংলা মদ খেয়ে যা হয়নি এই লোকটির পাশে শুয়ে তাই হল। দাঁতে দাঁত চেপে বমিটাকে সামলাচ্ছিল অর্ক। আর তখনই গাড়িটা এসে দাঁড়াল পাশের রাস্তায়।
ভ্যান থেকে দু’তিনজন পুলিস নামল লাফিয়ে। একজন বলল, ‘মনে হচ্ছে শালারা গলিতে ঢুকেছে। ঢুকে দেখব?’
‘মাতাল ফাতাল হবে, ছেড়ে দে।’
‘মাতাল হলে পালাবে কেন?’
টর্চের ভারী আলো পড়তে লাগল গলিতে। দেওয়ালের গায়ে। আর তারপরেই দ্রুত ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। পুলিসগুলো গলির মধ্যে ঢুকে গেছে। অর্ক দেওয়ালের আড়ালে উপুড় হয়ে শুয়ে অনেক কষ্টে বমি সামলাচ্ছিল। এইসময় আলো এসে পড়ল রকের ওপর আর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার, ‘কে ওখানে?’
অর্ক ভিখিরীটার পেটে খোঁচা মারল। ভিখিরীটা বলল, ‘আমি।’ সরু নাকি গলা। চিঁ চিঁ করছে। সার্জেন্ট চিৎকার করল, ‘নেমে আয়।’
ভিখিরীটা উঠবে কিনা ঠাওর করতে পারছিল না কিন্তু অর্ক আবার খোঁচা মারতেই উঠে বসল। তারপর ঘষটে ঘষটে পাঁচিলের আড়াল ছেড়ে নেমে এল ফুটে। সার্জেন্ট তার মুখে টর্চ ফেলে হতাশ হল, ‘যা শালা! আর শোওয়ার জায়গা পাস না?’
চিঁ চিঁ করে ভিখিরাটা বলল, ‘এখানেই তো শুই।’
তখনই গলি থেকে পুলিসগুলো বেরিয়ে এল, ‘সার, মাল পেয়েছি। এ শালার কাছে খুর ছিল।’
সার্জেন্ট এগিয়ে গেল ভিখিরীকে ছেড়ে, ‘এসো চাঁদু, নাম কি?’
খুরকির গলা শোনা গেল, ‘মাইরি, আমরা কিছু জানি না, কিছু করিনি আমরা।’
‘করিস নি তো ভাগছিলি কেন? হেভি টেনেছে মনে হচ্ছে। এখানে কি করছিলি?’ সার্জেন্ট জিজ্ঞাসা করল।
‘আমরা শ্মশান থেকে আসছি। ভ্যান দেখে ভয় লাগল।’
‘তোর কাছে খুর কেন?’
‘কুড়িয়ে পেয়েছি স্যার।’
সার্জেন্ট জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর নাম কি?’
‘কিলা। শ্মশান থেকে বাড়ি যাচ্ছিলাম।’
‘তোল শালাদের ভ্যানে। সার্জেন্ট ফিরে যাচ্ছিল। কিলা চিৎকার করল, ‘খুরকিকে তুলুন আমাকে না।’
‘খুরকি? ওর নাম খুরকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘আরে এ তো সেই বেলগাছিয়ার মাল। চমৎকার! তুমি কে হে নবাব? তোমাকে তুলব না কেন?’
‘আমি পার্টি করি।’
‘আচ্ছা! বেকায়দায় পড়লে সবাই ওই কথা বলে। ও কি করে? কংগ্রেস?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোল ওদের।’
একটু বাদেই ভ্যানটা চলে যেতেই ওয়াক ওয়াক করে বমি তুলল অর্ক। এবং যতক্ষণ না শেষ জলটুকু পেট থেকে বের হল ততক্ষণ স্বস্তি পেল না। সে শব্দ শুনে ছুটে এসেছিল ভিখিরীটা, চিঁ চিঁ করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হায় বাপ! আমার বিছানার বারোটা বাজাল। তোমাকে আমি বাঁচালাম আর তুমি আমার সব্বনাশ করলে!’
অর্ক উঠে বসেছিল। খুব অবসন্ন লাগলেও শরীর শান্ত হয়েছে এতক্ষণে। সে দেখল রকটা ভেসে গেছে। কোনরকমে নিচে নেমে পকেট থেকে একটা আধুলি বের করে ভিখিরীটার সামনে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ চোখ পাল্টে গেল লোকটার, বলল, ‘একটা টাকা দাও, তোমাকে বাঁচালাম।’
আবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে নোট বের করল অর্ক। না, একটাকা তার কাছে নেই। শেষপর্যন্ত দুটো টাকার নোটই এগিয়ে দিয়ে সে ট্রাম রাস্তার ওপর এসে দাঁড়াল। কেউ কোথাও নেই। পুলিস ভ্যানটা কিলাদের নিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। সে পিছু ফিরে গলির দিকে তাকাল। ওটা নিশ্চয়ই ব্লাইণ্ড লেন, না হলে ওদের ধরল কি করে!
হঠাৎ সমস্ত শরীরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল অর্কর। ভাগ্যিস সে গলির মধ্যে যেতে পারেনি তাহলে এতক্ষণ তাকেও ভ্যানে বসতে হত। মা কি থানায় আসতো? না। বাবা? না। শালা মুখ দেখানো যেত না মায়ের কাছে। কিন্তু এত রাত্রে একা একা বেলগাছিয়ায় ফিরবে কি করে সে? বমি হয়ে যাওয়ার পর শরীরটাও আর ঠিক নেই। তাছাড়া এত রাত্রে এই অবস্থায় বাড়ি যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার।
অর্কর খেয়াল ছিল না সে উল্টো দিকে হাঁটছে। হঠাৎ তার মনে পড়েছে যে পকেটে এখন অনেক টাকা আছে, অনেক। ওই ভ্যানটা না এলে টাকাগুলো আর তার পকেটে থাকতো না। কিন্তু এখন সে-ই এর মালিক। ওরা যদি পরে জিজ্ঞাসা করে তাহলে বলে দেবে ছিনতাই হয়ে গিয়েছে। কিংবা নেশার ঝোঁকে পড়ে গেছে। ওদের কতদিন আটকে রাখবে? যত বেশী দিন রাখে ততই মঙ্গল।
বিডন স্ট্রীটের মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল অর্ক। মোড়ের মাথায় একটা সাদা অ্যাম্বাসাডার দাঁড়িয়ে আছে। আর ড্রাইভিং সিটে বসে একটা লোক হাত বের করে তাকে ডাকছে। তাকেই কি? অর্ক আশে পাশে তাকাল। কেউ নেই। সে আবার সামনে তাকাল। লোকটার মতলব কি? পুলিস নয়তো? পুলিসরা কি সাদা অ্যাম্বাসাডারে থাকে? সে ফুটপাথের ওপর উঠে দাঁড়াল। তখন লোকটা দরজা খুলে রাস্তায় পা দিল। অর্ক দেখল লোকটার পা টলছে, ওপরের শরীরটা নড়বড়ে, কোনরকমে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে। যাঃ শালা! লোকটা মাতাল! তাহলে ওর কাছে যাওয়া যায়। অন্তত এই রাত্রে একা একা কোলকাতায় ঘোরার চেয়ে ভদ্রমাতালের সঙ্গ ঢের ভাল। অর্ক পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। এতক্ষণে তার নেশাটা আর নেই বললেই চলে, চোখের দৃষ্টি বেশ সহজ। লোকটার কাছে গিয়ে অর্ক দেখল এ যে সে মাতাল নয়। ঝকঝকে সাদা শার্ট আর টাই, প্যান্টটাও বেশ দামী। কাছাকাছি হতেই ওকে খুঁটিয়ে দেখল লোকটা। দুটো ঠোঁট শক্ত করে চেপা, মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনবার দেখে লোকটা বলল, ‘হু আর য়ু? কে তুমি?’
‘আমি অর্ক।’
‘অর্ক। অর্ক মানে কি? রাতদুপুরে অর্ক? ইয়ার্কি পেয়েছ? তুমি শুকতারা, না হল না, সপ্তর্ষি, নো নট কারেক্ট, তুমি কালপুরুষ।’ কথাটা খুঁজে পেয়ে যেন খুশি হল লোকটা।
‘ডাকছিলেন কেন?’
‘ডেকেছি, আমি? ও হ্যাঁ। তুমি কি গুণ্ডা না ছিনতাইবাজ?’
‘কেন?’
‘লজ্জা পেও না, বলে ফেল। আমার কাছে কিছু নেই, সব মিস তৃষ্ণা নিয়ে নিয়েছে। তৃষ্ণাকে চেন? চেন না? ওই যে পার্কটা ওর ওপাশে থাকে। তা ডেকেছিলাম কেন? হ্যাঁ, তুমি আমার গাড়িটাকে একটু ঠেলে দেবে? এই গাড়িটা বাস্টার্ড।’
অর্ক বুঝতে পারল। কিন্তু লোকটা কোন দিকে যাচ্ছে? সে বলল, ‘উঠে পড়ুন, আমি ঠেলে দিচ্ছি।’
‘গুড ভেরি গুড।’ দরজা খোলা রেখেই লোকটা আবার স্টিয়ারিং-এ গিয়ে বসল। গাড়ির পেছনে চলে এল অর্ক। তারপর প্রাণপণে ঠেলতে লাগল গাড়িটাকে। একটু একটু করে নড়তে নড়তে গড়ালো চাকাগুলো। তিন চারবার চেষ্টা করে ইঞ্জিনটা চালু হল। অর্ক ভেবেছিল লোকটা স্পীড তুলে বেরিয়ে যাবে কিন্তু একটু এগিয়ে ব্রেক কষল, ‘এই যে মাই বয়, কাম হিয়ার।’
অর্ক এগিয়ে গেল। লোকটা বলল, ‘তোমার নাম কি যেন?’
‘অর্ক।’
‘আবার অর্ক! কালপুরুষ। ইয়েস কালপুরুষ, আমি ভাল করে চোখে দেখতে পাচ্ছি না। তুমি জানো আমি কে?’
‘না।’
‘বিলিতি ডিগ্রি আছে আমার, য়ুনিভার্সিটির ফার্স্ট বয়, ইয়ার্কি মের না। আই অ্যাম নট এ পাতি মাতাল। বিলাস সোম।’
‘আপনি কোনদিকে যাবেন?’
‘লেকটাউন। হোয়াই ?’ লেকটাউন! তাহলে তো বেলগাছিয়া দিয়ে যেতে পারে। সে ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি বেলগাছিয়ায় যাব, নিয়ে যাবেন?’
‘নো, এতরাত্রে অচেনা অজানা একটা কালপুরুষকে লিফট দিয়ে যদি খুন হয়ে যাই, নো নেভার।’ লোকটা গাড়িটা ছেড়ে দেবার উপক্রম করল। অর্ক মরিয়া হয়ে চেঁচাল, ‘শুনুন, যাবেন না। আমি আপনাকে খুন করতে যাব কেন? তাছাড়া আমার কাছে কোন অস্ত্র নেই।’
‘পেটে গোঁজা আছে।’
‘নেই, দেখুন।’ জামা তুলে দেখাল অর্ক।
‘তুমি ড্রিঙ্ক করেছ?’
‘করেছিলাম।’
‘হুইস্কি?’
‘না, বাংলু।’
‘যা বাব্বা! তুমি তো ছুপা রুস্তম। ছোলা উইদ বাংলু। তাহলে উঠে এসো বাবা, তুমি আমাকে গাইড করবে।’ মাথা নাড়ল লোকটা।
সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটাকে আধ পাক ঘুরে অর্ক সামনের সিটে উঠে বসল। লোকটা বেশ জোরে গাড়ি চালাতে লাগল। ট্রাম রাস্তার ওপর ভীষণ বেঁকেচুরে যাচ্ছিল, ওপাশ থেকে কিছু এলেই ধাক্কা লাগবে। অর্ক চেঁচিয়ে উঠল, ‘এত জোরে চালাবেন না, আস্তে আস্তে।’
লোকটা কোন উত্তর দিল না। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করছিল আবার যেন কোনক্রমে শক্তি জড়ো করে উঠে বসছিল। দুটো পুলিশ কনস্টেবল ব্যাপারটা দেখে চিৎকার করে উঠল। লোকটা তাদের সামনে দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেল গাড়ি। অর্ক ওর হাত ধরতে গিয়ে সামলে নিল। যে কোন মুহূর্তে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটবে কিন্তু হাত ধরলে এখনই। সে অনুনয় করতে লাগল গাড়িটাকে থামাবার জন্যে। লোকটা হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল, ‘স্পীড মোর স্পীড। আরো জোরে ছুটে যাও। ফাক্ দি টাইম, সময় ডিঙ্গিয়ে যাও।’
লোকটা হাসছিল আর পাগলের মত মাঝে মাঝে স্টিয়ারিং থেকে হাত তুলে লাফিয়ে উঠছিল। অর্ক একবার বাইরের দিকে তাকাল। বাড়িগুলো কাছে আসছে আর সরে যাচ্ছে। এই অবস্থায় দরজা খুলে লাফিয়ে পড়লে বাঁচতে হবে না। অথচ আজ বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই। এত দ্রুতগতি যে ওর সমস্ত শরীর সিরসির করছিল। বাগবাজার দিয়ে গাড়িটা সোজা আর জি করের মুখে আসতেই আচমকা লাফিয়ে উঠল গাড়িটা। অর্কর মনে হল যে শূন্যে উড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে সিটে আছড়ে পড়তেই সে ব্রেকে হাত দিল। তিন নম্বরের সামনে দাঁড়ানো গাড়িগুলোর চেহারা দেখে ওর এটুকু জানা ছিল। কিন্তু গাড়ির গতি এত বেশী যে সঙ্গে সঙ্গে দুপাক ঘুরে গেল গাড়িটা। ঘুরে দড়াম করে ধাক্কা মারল পাশের দেওয়ালে। অনেকটা ঘষটে গিয়ে গাড়িটা যখন স্থির হল তখন চারপাশে হই চই পড়ে গিয়েছে। ফুটপাথের ঘুমন্ত মানুষগুলো জেগে উঠে চিৎকার শুরু করে দয়েছে। অর্ক আচমকা আঘাতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল লোকটার ওপরে। লোকটার একটা হাত সামনের কাঁচ ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছে। মুখটা ড্যাসবোর্ডের ওপরে, শরীর ঝুলছে। কোনক্রমে নিজেকে তুলতে গিয়ে অর্ক দেখল লোকটার বুক পকেট থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে একটা কিছু তার মুখের ওপর ঝুলছে। হাত দিয়ে টেনে নিতে সে দেখল একটা চকচকে হার।
ততক্ষণে মানুষজন ছুটে এসেছে। দরজা খুলে ওরা প্রথমে লোকটাকে নামাল। তারপর অর্ককে। অর্কর কনুই এবং কপালে খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল কিন্তু রক্ত পড়ছিল না। লোকটা এখন একদম অজ্ঞান। সাদা শার্ট দ্রুত রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে। লোকগুলো বলল, মরেনি মরেনি। ওরা ওকে কাঁধে তুলে নিল, অর্ককেও ছাড়ল না। অর্ক যত বলে তার কিছু হয়নি তবু শুনল না। এই সময় অর্কর খেয়াল হল ওর হাতের মুঠোয় হারটা ঝুলছে। কোনরকমে সে ওটাকে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল।
পাশেই আর জি কর হসপিটাল, পৌঁছাতে দেরি হল না। এমার্জেন্সিতে পৌঁছাতেই লোকটাকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে গেল ওরা। অর্ককে ফাস্ট এইড দিয়ে নাম ধাম জিজ্ঞাসা শুরু করল। লোকটার নাম সে জানে না বলতে গিয়েই আচমকা খেয়াল হল। সে বলল, ‘বিলাস সোম, ইঞ্জিনিয়র, লেকটাউনে থাকেন।’ তারপর ভেবে নিয়ে জানাল, ‘ব্রেক ফেল করায় অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছে।’ নিজের নামধাম ঠিকঠাক বলার পর ওর খেয়াল হল এখনই না হসপিটাল থেকে বাড়িতে খবর দেয়। কিন্তু সেরকম কোন চেষ্টাই দেখা গেল না। যারা পৌঁছাতে এসেছিল তারা ফিরে গেলে সে একা বসে রইল কিছুক্ষণ হাতে মাথায় প্লাস্টার লাগিয়ে। হসপিটালের একজন এসে বলল, ‘পুলিসকে খবর দিয়েছি, তুমি ওর বাড়িতে খবর দিয়ে দাও। কণ্ডিশন সিরিয়াস। ভদ্রলোক ড্রাঙ্ক ছিলেন।’
অর্ক মাথা নাড়ল। তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল বাইরে। কনুইটা কনকন করছে। খোলা আকাশের তলায় আসতেই ঠাণ্ডা বাতাস লাগল। এখন শেষ রাত। কেউ তাকে বাধা দিচ্ছে না। কেউ জিজ্ঞাসা করেনি তার সঙ্গে লোকটার কি সম্পর্ক! হঠাৎ ওর মনে হল, এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত। যত তাড়াতাড়ি। লোকটা যদি মরে যায় তাহলে পুলিস নিশ্চয়ই তাকে ধরবে। অথচ সে কিছুই জানে না। নিজের নাম ধাম ঠিকঠাক বলার জন্যে খুব আফসোস হচ্ছিল তার।
এইসময় দুটো লোক তার দিকে এগিয়ে এল। একজন একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ আর চাবির রিং এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘গাড়িটা গ্যাছে তবু লক করে দিলাম। এই নিন।’
অর্ক নিঃসাড়ে হাত বাড়াল। তারপর মাথা নাড়ল। লোকগুলো যেন পবিত্র কর্ম করেছে এমন ভঙ্গীতে চলে গেল। অর্ক দেখল রিং-এ দুটো চাবি। ব্যাগটার মধ্যে কয়েকটা কাগজপত্র এবং বিলাস সোমের ড্রাইভিং লাইসেন্স। লেকটাউনের ঠিকানাটা রয়েছে সেখানে। পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে গিয়ে ও হারটার স্পর্শ পেল। নিশ্চয়ই দামী হার অথচ লোকটা বলেছিল তার কাছে কিছু নেই। লোকটা কি তাকে ভয় পেয়েই জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল!
ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছিল অর্ক। ভোর হচ্ছে। নিচে মালগাড়ির ইঞ্জিন চলতে শুরু করেছে। হারটাকে ঝেড়ে দেওয়া যায়। কেউ টের পাবে না। হঠাৎ খুব আনন্দ হতেই সে চুপসে গেল। ভদ্রলোক তাকে বলেছিল, ছুপা রুস্তম। কেন? এইজন্যেই কি?
পাড়ার মোড়ে সকাল হওয়া আবধি বসে রইল সে। ক্রমশ পৃথিবীটা আলোকিত হলে মাধবীলতা বেরিয়ে এল গলি থেকে। এই ভোরের আলোয় মাকে দেখল অর্ক। মাথা ঝুঁকে পড়েছে, খুব ক্লান্ত পায়ে হাঁটছে। পরনের শাড়িটা আধময়লা, ব্যাগটা বুকের কাছে ধরা। কোনদিকে না তাকিয়ে মাধবীলতা ট্রাম স্টপে গিয়ে দাঁড়াতেই অর্ক গলিতে ঢুকে পড়ল।
নিমুর দোকানের সামনে বেশ ভিড়, সে চুপচাপ তিন নম্বরে পা বাড়াল, অনুদের ঘর বন্ধ। মোক্ষ বুড়ি জিজ্ঞাসা করল, ‘কে যায়?’ সাড়া দিল না অর্ক। নিজেদের ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিঃশ্বাস ফেলল। খুব ভয় করছিল তার। কাল সকাল থেকেই সে ঘরের বাইরে। এরকম কখনো হয় নি। বাবা নিশ্চয়ই খুব রেগে আছে।
সে দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখল অনিমেষ বিছানায় বসে, ‘কোথায় ছিলি’?
‘মড়া পোড়াতে গিয়েছিলাম।’
‘সেখানেই থেকে গেলি না কেন?’
অর্ক কোন জবাব দিল না। হাত বাড়িয়ে গামছা নিয়ে ফের যখন বের হতে যাচ্ছে তখন অনিমেষ চিৎকার করল, ‘কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?’
চাপা দাঁতে অর্ক বলল, ‘যাকে দেবার তাকে দেব। তুমি আমাকে খাওয়াও না পরাও যে জিজ্ঞাসা করছ!’