1 of 3

০৩৬. ভূতুরে ভয়

আমার খুব ভূতুরে ভয় হয়েছে আজকাল, জানো?

ভূতের ভয়? সে কি! গায়ে গঞ্জে কতদিন কাটালে, এ ভয় তো ছিল না তোমার!

তাই তো ভাবি। দেশের গায়ে রাত-বিরেতে একটা পুকুরঘাটে গেছি, কত, ভয় বলে কিছু টের পাইনি। এখন হচ্ছে কেন বলো তো?

বিষ্ণুপদ একটু হাসে। বলে, আমি পাশে থাকলেও ভয় করে?

কি হয় জানো? হঠাৎ মাঝ রাত্তিরে ঝাম করে ঘুমটা ভেঙে যায়। ভাঙা মসজিদে তক্ষক ডাকে। আর বাঁশবনে কেমন মড়মড় শব্দ হয়। একটা হাওয়া বয়ে যায় হঠাৎ করে। শেয়াল ডাকে। তখন বুকটা কেমন উথাল-পাথাল করে। মনে হয়, কারা সব যেন আনাগোনা করছে চারপাশে। ফিসফিস করে কথা কইছে। কী একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে যেন। শুনছো, না ঘুমিয়ে পড়লে?

শুনছি। ঘুম কি আর মাইনে-করা চাকর যে ডাকলেই এসে হাজির হবে! ভাটির বয়স, এখন সবই কমতে থাকে। তা তোমার ভূতের বৃত্তান্তটা বলো, শুনি।

তাই তো বলছি। হ্যাঁ গো, এরকম কি ভাল?

নিশুত রাতে কতরকম মনে হয়। মানুষ তখন একা। একা হওয়াটা মানুষ পছন্দ করতে পারে না। তার জন চাই।

নয়নতারা গালের পানটা একটু চিবিয়ে নিয়ে একটা হেঁচকির মতো শব্দ করে বলে, এই যে তুমি আমার কাছটিতে আছো, কাছেই আছো তো! তবু ভয়-ভয় ভাবটা বড্ড চেপে ধরে। মনে হয়, আমার বুঝি কেউ নেই। বড্ড অন্ধকার লাগে চারদিকটা। গাটা কেমনু ছমছম করে। মনে হয়, কোন অজান দেশে চলে এলাম। চারদিকে অজান সব জিনিস।

এও বয়সেরই দোষ।

বেঁচে থাকলে বয়স তো বাড়েই। তাতে দোষের কি? কত বুড়ো মানুষ হোসে-খেলে বেড়াচ্ছে।

বিষ্ণুপদর দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা নিশুত রাতে বেশ বড় হয়ে শোনা গেল। শ্বাসটা ফেলে বলল, আমরা যে কেমন একা হয়ে যাচ্ছি তা টের পাও? আপনজন, রক্তের সম্পর্কের মানুষের অভাব নেই। তবু কেমন যেন সব ছেড়ে যাচ্ছে। দূরের মানুষ হয়ে যাচ্ছে। টের পাও না?

তা যদি বলো। তবে বলতে হয়, ছেলেপুলে কি চিরকাল আগলে রাখা যায়? তাদের পাঁচটা কাজ আছে, রুজিরোজগার, আছে।

ওইটেই তো পরিস্থিতি কঠিন করে দেয়। যত বুড়ো হবে তত একা!

আমন করে বোলো না তো। তোমার কথা শুনলে মাঝে মাঝে বুক কেঁপে ওঠে আমার।

বলি কি আর সাধে! কৃষ্ণ তফাত হল, বামা তফাত হল, একটা কোথায় নিরুদেশ হল, মেয়ে দুটো কালেভদ্রেও আসে না। মাঝে মাঝে ভাবি, দুনিয় কেড়ে নিল সবাইকে। কেমন জানো? ছেলেবেলায় যখন গুলি খেলতাম, মাঝে মাঝে কেঁচড় বা পকেট থেকে পড়ে যেত। সব কটা কুড়িয়ে পেতাম না, কিছু হারিয়ে যেত।

এবার নয়নতারার দীর্ঘশ্বাসটা বেশ শব্দ করে হল। বলল, তা নয় গো। হারাবে কেন? সবাই-ই তো আছে। আমাদেরই আছে। শিবুটার কথা খুব মনে হয়। তুমি কি ভাবো বলো তো! বেঁচে আছে?

বিষ্ণুপদ একটা হাই তুলে বলে, না থাকার কি? আছে ঠিক। হয়তো জীবনে উন্নতিও করে ফেলেছে।

একদিন আসবে?

না এসে যাবে কোথায়?

আমি মরার আগে আসবে তো!

তুমি এখনই মরছে না। আগে আমার পালা।

তোমার একটা মরার বাই হয়েছে আজকাল।

কথাটা ভুল বললে। ইচ্ছে করে কেউ মরতে চায় না। এই যে আমাদের কথাই ধরো, কোন ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে পড়ে আছি, কেউ পৌঁছেও না। আমাদের, বেঁচে থাকার কষ্টও কত, তবু কিন্তু মরতে ঠিক ইচ্ছে যায় না। মরার কথা ভাবলেই কেমন যেন হাঁফ-ধরার মতো লাগে। সেই যে কালঘড়ি দেখেছিলাম, তার পর থেকেই একটা মরণের ভয় মাঝে মাঝে এসে ভালুকের মতো চেপে ধরে।

নয়নতারা অন্ধকারেই তার মানুষটার দিকে তাকায়, বলে, মরার মতো কিছুই তো হয়নি তোমার। বয়সও এমন কিছু নয়, ভগবানের দয়ায় তেমন কোনও অসুখ-বিসুখও নেই। তবে ভাবো কেন?

ভাবনার সঙ্গেই তো সারাদিন যুদ্ধ করি। হাতে কাজকর্ম নেই, মাথাটা বোঁদা হয়ে গেছে।

কাজকর্ম একটু একটু করলেই তো পারো!

সেটাও ইচ্ছে যায় না। কেবল মনে হয়, পণ্ডশ্রম করে হবেটা কি? যে কাজই করি, মনে হয়, ছাইভস্ম। জীবনে আমার আর যেন কিছুই করার নেই।

ওটাই তো তোমার দোষ। শরীরটা বড্ড বসিয়ে ফেলেছে। দাঁড়াও, কাল থেকে তোমাকে হাটেবাজারে পাঠাবো।

রক্ষে করো! বিকিকিনির মধ্যে আমি আর যেতে পারব না। পয়সার হিসেব গুলিয়ে ফেলব। ওসব কথা থাক, তোমার ভূতের বৃত্তান্ত বলো।

বললাম তো। নিশুত রাতে ওরকম সব হয়।

বিষ্ণুপদ উঠে একটু জল খেয়ে বলল, তোমার যেমনটি হয়, অনেকটা তেমনতর আমারও হয়। আমার যেন মনে হতে থাকে, দেহ ছাড়বার সময় যত কাছে এগিয়ে আসতে থাকে তত প্রেতলোকের ছায়া এসে পড়ে চারধারে।

মা গো! তুমি কি বলছে আমার মরার সময় হয়েছে?

তা কি জানি! এটা বুঝি যে, বয়স ভাটির দিকে। এখন ওসব হলে বুঝতে হবে ঘাঁটি ছাড়ার সময় হয়েছে।

তুমি বাপু, একটু কেমন যেন আছো। বড্ড ঠোঁট-কাটা।

তোমাকে ছাড়া আর কাকে এসব বলব বলো তো!

আমি যে ভয় পাই। সংসার-টংসার নিয়ে জড়িয়ে মড়িয়ে আছি, এই বেশ আছি। ওসব কথা তুললে কেমন ঘাবড়ে যাই। হ্যাঁ গো, একটু তীৰ্থ করতে যাবে? মনটা ভাল করে আসি চলো।

ও বাবা, সে তো মস্ত খরচের ব্যাপার!

দূরে নয় গো। কাছেপিঠেই কোথাও যাই চলো। রামজীবনকে বললে খরচ দিয়ে দেবে।

বিষ্ণুপদ বলল, ওর এখন অনেক খরচ। ঘর শেষ করতে পারছে না বলে মাথাটাও গরম। বলতে যেও না।

গেলে ভাল হত। কিন্তু। তারকেশ্বর বা ওরকম কাছেপিঠে গেলেও কি অনেক খরচ? কাশী-বৃন্দাবন তো যেতে চাইছি না। এক জায়গায় থেকে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে।

তীর্থেই বা কোন শ্বাস ফেলার জায়গা আছে বলো তো! সব জায়গাতেই ভিড়।

আচ্ছা, তোমার কি ভগবানে ভক্তি নেই? সত্যি করে বলো তো! এতকাল ধরে তোমাকে দেখছি, কোনওদিন মুখ ফুটে ভুবন্ধু কথাটা বললে না। কত ব্রত করেছি, পুজাে করেছি, তোমার তাতে কখনও যেন গা ছিল না। ইয়া গো, তুমি কি নাস্তিক?

বিষ্ণুপদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে করুণ গলায় বলে, তাও ঠিক বুঝতে পারি না।

সত্যি কথাটা বলেই ফেল না।

বিষ্ণুপদ দুর্বল গলায় বলে, যা ভাবছো তা নয়। কিন্তু তোমাদের মতো করে নয়।

তা হলে কার মতো করে?

আমার নিজের একটা রকম আছে। তোমরা যে পুজো-আচ্চা করো তার মধ্যে একটু ব্যবসা-বুদ্ধি আছে। ফুল বাতাসা দিয়ে ভগবানের কাছ থেকে কিছু আদায় করে নেওয়া। দমাদম বাজনা, ট্যাঙস ট্যাঙস। কাঁসি বাজিয়ে দুর্গাপুজো হয়, ও আমার কেন যেন ভাল লাগে না। আমার মনে হয়, ভগবান ঠাণ্ডা সুস্থির একজন মানুষ। তাকে বুঝতে হলে নিজেকেও একটু ঠাণ্ডা বা সুস্থির হতে হয়।

তুমি কত জানো। আমার হল মেয়েলি বুদ্ধি।

আমি যে একটা জান বুফওলা মানুষ এ কেবল তোমার মতো বোকার কাছে। আমি কীই বা জানি? কতটুকুই বা বুঝি!

বিদ্যের জাহাজ না হলেও তুমি বাপু অনেক জিনিস স্পষ্ট টের পাও। অনেক বিদ্বানেরও সেই ক্ষমতা নেই।

এই না হলে নয়নতারা। তা ভাল, এরকমই বোকাসোকা থেকো। সংসারে বোকা আর ভালদের দাম না থাক, তাদের ওপর ভগবান সন্তুষ্ট থাকেন।

বাকি রাতটুকু আর দুজনের কারোই ঘুম হল না। কথা কয়ে, জল খেয়ে আর এপোশ ওপাশ করে কেটে গেল।

রোদ উঠবার অনেক আগেই তারা উঠে পড়ে। তখন অন্ধকার থাকে, চারদিকটা থাকে ঘুমন্ত। একটা দুটো পাখি সবে ডাকতে শুরু করে। একটা সময় আছে, ইরফানের মোরগাটা যখন জানান দেয়।

সকালে নয়নতারার মেলা কাজ থাকে। ঘরদের সারা, লেপাপোছা, আরও অনেক কিছু। বিষ্ণুপদর কোনও কাজ থাকে না। জলচৌকিতে বসে আজ সে শরতের একটু হিম মাখানো ভোরবেলাটিকে বড় ভালবাসল।

ডেকে বলল, কয়েকটা শিউলি তুলিব নাকি গো? তোমার ঠাকুর পুজোয় লাগবে।

তা তোলো। বাসি কাপড় ছেড়ে হাত পা একটু ধুয়ে নাও।

বাঁশের সাজিটা নিয়ে বারান্দা থেকে নেমে পড়ল বিষ্ণুপদ। এই ফুল তোলাটা তার একটা দৈনন্দিন কাজ করে নিলে কেমন হয়?

গাছ দুটো ঝোপে কী ফুল! কী ফুল! মাটিতে ঘাসে কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। ফুলে ফুলে ছয়লাপ হয়ে আছে।

বিষ্ণুপদ হাঁক দিল, হ্যাঁ গো, মাটিতে পড়া ফুল কি পুজোয় লাগে?

নয়নতারা উঠোনের এক প্রান্ত ঝাঁট দিতে দিতে বলল, শিউলিতে দোষ হয় না, যেটা পায়ে লাগবে সেটা কুড়িও না।

গাছেও মেলা আছে।

তবে গাছেরগুলোও তোলো।

গাছের পাতায় পাতায় বেঁটা আলগা হয়ে কত শিউলি ঢলে পড়ে আছে। একটু নাড়া খেলেই টুপ করে খসে পড়ে। শিউলির বেঁটা কেন এরকম তা বুঝতে পারে না বিষ্ণুপদ। দুনিয়ায় একঢালা নিয়ম কিছু নেই। শিউলির ধর্ম শিউলির, বেল ফুলের ধর্ম কেবল বেল ফুলেরই। একই মাটির একই রস টেনে কত নানারকম হচ্ছে। আশ্চর্য লাগে বিষ্ণুপদর।

সাজি ভরে উঠতে সময় লাগল না মোটেই। বিষ্ণুপদ ওপচানো সাজি নয়নতারার ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে রেখে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল, আরও কিছু কাজ দেবে নাকি?

ওমা! এ যে ভূতের মুখে রাম নাম!

কেন, কাল রাতেই তো বললে আজ থেকে আমাকে দিয়ে মেলা কাজ করাবে।

তাই লক্ষ্মী মানুষটির মতো কাজ চাইছো? মরে যাই!

দোষটা কি আমার? তুমিই তো কিছু করতে দাও না। আমাকে।

একটা জীবন কম খেটেছো নাকি? কম কষ্ট করেছো? তখন এ জায়গার কী অবস্থা! হাট নেই, বাজার নেই, পথঘাট নেই! হেঁটে হেঁটে পায়ে কড়া পড়েছে। সাইকেলে কত মাইল যেতে হত যেন! উরেব্বাস, যখন ফিরে আসতে তখন মুখখানা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে যেত।

আহা, তখন যৌবন-বয়স। ও বয়সে কষ্ট করাই ভাল। গায়ে লাগে না। বরং ভালই হয় তাতে।

সেই জন্যই বুড়ো বয়সে কষ্ট করতে দিই না। তা একটু-আধটু করতে চাও তো করো। এই তো বলছিলে, কাজ করতে গিয়ে মনে হয়। ছাইভস্ম করছি। হঠাৎ মন পাল্টালে কেন?

এই দেখ, ওকালতি পাশ করে এলে নাকি? তখন বলেছিলাম, তখন একরকম মনে হয়েছিল বলে। এখন মনে হচ্ছে, তুমি কথাটা খারাপ বলনি।

তা হলে যাও, বাগানে বসে একটু গাছপালার সেবা দাও।

কাজটা বিষ্ণুপদর খুব পছন্দের। এবার ভারী বর্ষায় গাছ বেড়েছে খুব। বাগান দেখার কেউ নেই বলে আগাছায় একেবারে বনবিবির থান হয়ে আছে। দা আর কোদাল নিয়ে লেগে গেল বিষ্ণুপদ। লেগে গিয়ে বুঝল, শরীরের সেই ক্ষমতা আর নেই। হাত পায়ে যেন জরা একেবারে বাটখারার মতো চেপে বসে আছে। দামেও বেশ ঘাটতি হচ্ছে।

নয়নতারা বারান্দার কোণে কখন এসে দাঁড়িয়ে তার কাণ্ড দেখছিল। এবার চেঁচিয়ে বলল, ওগো, অতি হুড়মাড় কোরো না। বয়স বসে নেই। ধীরে সুস্থে সইয়ে সইয়ে করো। কোদাল চালাতে হবে না, গাছের গোড়াগুলো একটু সাফ করে দাও, তাতেই হবে।

রোদ উঠল। বউরা উঠল। ছেলেরাও উঠে পড়ল। রামজীবন সকালে উঠে বাপ-মাকে প্ৰণাম করে রোজ। আজ বাপকে খুঁজে না পেয়ে বলল, ও মা, বাবা কোথায় গেল?

বাগানে কাজ করছে।

অ্যাঁ! বলো কি? বাবার কি আর সেই ক্ষমতা আছে? ছিঃ ছিঃ!

ওরে, কিছু হবে না। কাজে থাকলেই ভাল থাকবে।

খুঁজতে খুঁজতে যখন আতা গাছের তলায় বিষ্ণুপদকে খুঁজে পেল রামজীবন, তখন বিষ্ণুপদ মস্ত একখানা আতা ভেঙে মগ্ন হয়ে খাচ্ছে। আতার মাখন লেগে আছে ঠোঁটের পাশে।

বাবা!

আয় রে, বোস। আতা খাবি?

বসবার মতো জায়গা এটা নয়। বর্ষা গেছে এবার খুব। মাটির পোরে পোরে এখনও জল ঢুকে আছে। ঠেসে বসলে পাছার কাপড় ভিজে যাবে।

এঃ হেঃ, এ যে ঠাণ্ডা লাগিয়ে ফেলবেন বাবা! বাগানের কাজ করতে গিয়ে হার্টের গড়বড় হয়ে গেলে? আপনি উঠন, ঘরে যান। আতা পেড়ে ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বিষ্ণুপদ একটু হেসে বলে, অমন হুড়ো দিচ্ছিস কেন? বেশ লাগছে। এখানটায়। বোস না ঘাসের ওপর!

রামজীবন বসল। বলল, মায়ের আক্কেল দেখে অবাক হই। সকালেই লাগাল বাগানের কাজে! কেন, গায়ে কি কামলার অভাব!

তোর মা লাগায়নি। আজ এমনিতেই একটু ইচ্ছে হল। শরীর নাড়লে খিদেটাও পায়।

তা বটে। কিন্তু বেশি নাড়োনাড়ি কি ভাল এই বয়সে!

তোরা সবাই মিলে আমাকে এমন বুড়োই বানালি যে, নিজেকে বুড়ো ভাবতে ভাবতে অথর্ব হয়ে যাচ্ছি।

তা একটু হাঁটাহাঁটি করলেই তো পারেন। বসা শরীরকে হঠাৎ দুনো খাটালে হিতে বিপরীত হবে যে?

আচ্ছা, একটা কথা বলবি?

কি কথা বাবা?

তোর এত পিতৃভক্তি, মাতৃভক্তি, তবু খারাপ অভ্যাসগুলো এল কোথা থেকে রে?

রামজীবন যেন একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নামাল। কিন্তু কথাটা পাশ কাটাল না। একসময়ে রামজীবনই ছিল বিষ্ণুপদর ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে সুপুরুষ। কৃষ্ণজীবনও খুব সুপুরুষ আর জোয়ান সমর্থ বটে, কিন্তু তত লম্বা-চওড়া না হলেও রামজীবনের রং আর মুখের গড়ন চমৎকার, ছেলেবেলায় যাত্রাপালায় বালক কৃষ্ণ সাজত। কিছু গুণ ছিল, কিন্তু অগুণগুলোই কেন যে বেড়ে উঠল কে জানে! আজকাল আর রামজীবনের চেহারায় কোনও জলুস নেই। চোয়াড়ে একখানা মুখ, গায়ের রঙ তামাটে, মাথার চুলে এই বয়সেই পাক ধরেছে। পোশাক-আশাকের তেমন কোনও চাকচিক্য নেই। মুখখানা যখন তুলাল রামজীবন, তখন বড্ড বিমর্ষ একটা ভাব এসেছে মুখে। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, কুসঙ্গে পড়েই তো ওসব হয়। বাবা!

আর একখানা মস্ত আতা ভেঙে বিষ্ণুপদ তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, নে, খা।

হাত বাড়িয়ে নিল রামজীবন। কিন্তু খেল না। চুপ করে বসে রইল।

বিষ্ণুপদ বলল, এ গাছে যে এত আতা হয় জানতামই না। এইটুকু ছিল গাছটা।

গত বছর থেকে ফলন দিচ্ছে। বাগানটা জঙ্গল হয়ে থাকে বলে কেউ আসেও না, লক্ষও করে না। গত বছর অবশ্য বিশেষ ফলন হয়নি। দু-চারটে মাত্র। এ বছর ঢেলে দিয়েছে।

বিষ্ণুপদ আতার মধ্যে মুখ ড়ুবিয়ে খেতে খেতে বলে, গাছ কত সয় বয়, ফল দেয়। গাছের কাছে শিখতে হয়। কত কী শেখার আছে!

রামজীবন মাথাটা নত করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, সংসারটা আমার জন্যই ছারেখারে যাচ্ছে বাবা।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, তুমিও কেউ নও, আমিও কেউ নই, নিজেকে নিমিত্ত ভাবিস কেন?

আমি মোদ্দা মাতাল লোক, পয়সা ওড়াই, ঝগড়া বিবাদ করি।

আতার একখানা বিচি ফুড়ুক করে ফেলে বিষ্ণুপদ বলে, সবাই একরকম হয় না। কৃষ্ণজীবন তো অনেক ফারাকে। তুই আর বামা নিজেদের আর ছাড়িয়ে উঠতে পারলি না।

সেই কথাই তো বলছি।

বটতলার ওরা কারা বল তো! চিনতে পারছি না। মাঝে মাঝে আসে।

বন্ধুবান্ধবের মতোই। তবে চক্করটা ভাল নয়!

খুনখারাপি করে নাকি?

তা করে।

তোর সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন ধারা?

বিকেলের দিকে বসা হয় মাঝে মাঝে।

তোর কি ওদের কাছে কোনও দেনা আছে?

হয়ে যায় মাঝে মাঝে।

দেনা করিস কেন? আমরা যখন খুব গরিব ছিলাম তখনও বাবা শেখাত, দেনা করতে নেই। আমরা তো অল্পেীস্বল্পে চালিয়ে নিতে শিখেছি। তুই পারিস না?

মদ আর জুয়াই আমাকে খেল।

আর কিছু নেই?

আছে বাবা। সেসব আপনার শুনে কাজ নেই।

চুরি-ডাকাতি?

ফের অধোবদন রামজীবন মুখখানা অনেকক্ষণ বাদে তুলে বলল, দুটো ডাকাতিতে ছিলাম।

ওইটেই খারাপ করেছিস। গোরস্তরা কত কষ্টে রোজগার করে, তা কেড়ে নিস কেন?

আতা খেতে খেতে এত সরলভাবে কথাটা বলল বিষ্ণুপদ যে, রামজীবনের বুকে কথাটা যেন দুটো টোকা মেরে উড়ে গেল। রামজীবন উদাস গলায় বলল, দিনকাল যা পড়েছে। বাবা, এসব ছাড়া আর উপায় কি বলুন! গাঁ-গঞ্জের অবস্থা তো আরও খারাপ।

বিষ্ণুপদ ছেলের দিকে চেয়ে বলে, এই যে আতা দেখছিস, বিচিতে ভরা। গিজ গিজ করছে বিচি। বিচি ফেলে তবে আতার মাখন।টুকু খেতে হয়। তাই না? মানুষের জীবনটাও তেমনই মেলা বিচি। ওসব বাদছাদ দিয়ে তবে খেতে হয়। বাঁকা পথ নিবি কেন? এ বংশের যা ধারা, তাতে ওসব কি তোর সইবে? কঠিন হয়ে পড়বে যে!

বাবাকে নিয়ে একটা বিস্ময় আছে রামজীবনের। বাবা তাকে কখনও বকেনি, মারা তো দূরের কথা! যখন বখে যাচ্ছিল সে, তখনও কিছু বলত না কখনও। সেই নিরীহ মানুষটি আজ যে সব বলছে তাও শাসন করার জন্য নয়। ভালবাসার জন্যই।

রামজীবন হাতের আধখানা আতার দিকে চেয়ে রইল। থাকতে থাকতে বুঝতে পারল তার চোখে জল আসছে। একটু স্থলিত গলায় বলল, আপনাদের কষ্ট আমি তো দেখতে পারি না।

কষ্ট কি? কষ্টের বোধ না থাকলে কষ্টও নেই। চিরটা কাল আমরা এই ভাবেই তো দিব্যি কাটিয়ে এসেছি। আরও কত লোক আছে! আমাদের বাড়িতে যারা ভিক্ষে চাইতে আসে তারা তো আমাদের চেয়েও কত খারাপ আছে।

রামজীবন মাথা নেড়ে বলে, ওসব আমার সহ্য হবে না। বাবা। আমার কিছু একটা করাই চাই।

বিষ্ণুপদ হঠাৎ বললু, তুই কি কৃষ্ণকে হিংসে করিস?

হিংসে! বলে রামজীবন একটু থমকে গেল। একটু সময় নিয়ে গলাটা এক পর্দা নামিয়ে বলে, বড়দাদা বড় হয়েছে, আমরা তো হলাম না। বড্ড জ্বালাপোড়া হয়। বাবা।

যখন জ্বালা হয় তখন খুন চাপে তোর মাথায়?

তা চাপে বাবা।

তা হলেই বোঝা মনের মধ্যে কেমন যম বসে আছে আসন পেতে! ঠাকুর বলেন, বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়।

বাবা, জ্বালাপোড়ারও একটু দরকার হয়। নইলে যে টগবগ করে না ভিতরটা। ওই হিংসেটাই তো আগুন!

রান্নার আগুন আর ঘরপোড়া আগুন কি এক?

তা নয় বটে।

বিষ্ণুপদ খুব হাসল, আতা, খেয়ে আমার খুব কথা আসছে রে আজ।

আপনি আরও বলুন বাবা। আমার শুনতে ইচ্ছে যাচ্ছে।

দুর পাগল, আমি কি একটা পণ্ডিত লোক নাকি!

আমার কাছে আপনার চেয়ে বড় আর কে আছে?

ওই তো মায়ায় বাধিস!

মায়া ছাড়া সংসারে আর আছেটাই বা কি!

বিষ্ণুপদ বলল, মায়া আছে। আবার বৈরাগ্যও আছে।

বড়দাদা যদি আমাদের পিছনে থাকত বাবা, তা হলে কিন্তু এরকমটা হতে পারত না। আজ যে আমরা পতিত হলাম তার জন্য আপনার বড় খোকাই কিন্তু দায়ী।

ওরকম ভাবতে পারিস। আবার অন্যরকমও ভাবা যায়।

সে কি রকম?

কৃষ্ণও কিছু কম কষ্ট করেনি। জামা নেই, জুতো নেই, বই খাতা নেই, পেটে ভাত নেই, সে একটা দিনই গেছে! সেখান থেকে এত উপরে উঠেছে—সে তার নিজের জোরে।

তা না হয় হল। কিন্তু সে ডাঙায় উঠল বলে যারা ড়ুবছে তাদের টেনে তুলবে না? বউয়ের আঁচল ধরে বসে রইল গিয়ে, এরকম কি কথা ছিল? আমরা যে তাকে মাথায় করে রেখেছিলাম। বাবা!

যেমনটি চাস তেমনটিই যদি সব পাওয়া যেত, তা হলে আর সংসারের মহিমা কি? ভগবানের তো ক্ষমতার অভাব নেই! লহমায় মানুষের সব দুঃখ ঘুচিয়ে দিতে পারেন। দেন না বলেই মানুষের কিছু মান-মর্যাদা এখনও আছে।

পয়সার দুঃখটাই দুঃখ নয়। বাবা, সে যে আমাদের ছেড়ে চলে গেল।

পয়সার দুঃখকে দুঃখ বলে ভাবিস না, সে খুব ভাল। কিন্তু সংসারে আরও সব দুঃখ আছে। আমরা হচ্ছি। শতচ্ছিন্ন কাপড়, রিপু দিয়ে, সেলাই দিয়ে চালাতে হয়। রেগে যাস কেন?

মাথাটা গোলমাল লাগে।

হিংসের চোটেই মদ খাস?

রামজীবন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে হঠাৎ বলল, আপনি কি অন্তর্যামী বাবা?

দুর বোকা! আমাকে ঠাওরালি কী তোরা?

আমি যে বড়দার ওপর রাগের চোটেই মদ খাওয়া ধরেছিলাম, এত জ্বালাপোড়া নেবাই কিসে?

মদে কি জ্বালা জুড়োয়?

না বাবা। একটু অন্যরকম লাগে।

তাই তো। বড্ড অন্যরকম হয়ে যাস তখন! রামজীবন বলে চিনতে পারি না।

রামজীবন হাসল, বড়দার ওপর আমার বড় রাগ বাবা। কিছুতেই রাগটাকে কমাতে পারি না।

আমার একটা কথা মনে হয়।

কী বাবা?

যখন ছোটো ছিলি, তখন তুই ছিলি কৃষ্ণজীবনের সবচেয়ে ন্যাওটা। ছায়ার মতো পিছু পিছু ঘুরতি। যেখানে কৃষ্ণ সেখানেই রাম। মনে আছে?

থাকবে না? খুব মনে আছে।

আমার মনে হয় আজও তুই বড়দাদাকে মনে মনে সবচেয়ে বেশি ভালবাসিস। কিন্তু হিংসের চোটে, রাগের চোটে তা বুঝতে পারিস না। রাগ আর হিংসের চাপানে ভালবাসাটা ঢাকা পড়ে আছে। ঠিক যেমন পানীয় ভর্তি পুকুর। ওপর থেকে মনে হয় ডাঙা, কিন্তু নিচে টলটল করছে জল।

কেমন সুন্দর কথা বলেন। আপনি বাবা! রোজ এমন করে বলেন না কেন?

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, ওরে, আমার তো মনে হচ্ছে আতা খেয়ে আমার একটু নেশা হয়েছে। নইলে এত বলি কি করে?

রামজীবন খুব হাসতে লাগল। শরতের সকালটা যেন সোনা ঝরিয়ে দিতে লাগল চারদিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *