সকাল নটায় জলখাবার খেয়ে ধুতি আর পুরো-হাতা শার্ট পরে নিলেন অমরনাথ। এইসময় তাঁর খুব আরাম লাগে। একজোড়া বিদ্যেসাগরী চটি আছে। তিন বছর অন্তর কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে কলেজ স্ট্রীট থেকে কিনে আনেন। সপ্তাহে ছদিন তো কেডস আর হাফপ্যান্ট পরে কাটাতে হয় চায়ের বাগানে। সন্ধের পরে তাসের আড্ডায় যাওয়ার সময় ফুলপ্যান্ট পরেন। রবিবার একটু বাঙালি সেজে বের হলে মনটাও অন্যরকম লাগে।
চিরকালই ব্যাকব্রাস করেন অমরনাথ। আয়নাটা বেলজিয়ামে তৈরী। কুড়ি বছর আগে রবার্ট সাহেবের বউ তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন দেশে ফিরে যাওয়ার সময়। নিজেকে দেখলেন অমরনাথ। চুয়াল্লিশ বছর বয়সেই শরীর ভারী হয়েছে, জুলপি পেকেছে, দ্বিতীয় চিবুক স্পষ্ট। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে মামার এক বন্ধুর কাঠের ব্যবসায় চাকরি নিয়ে গেদে থেকে তিনি এসেছিলেন উত্তর বাংলায়। মাতুলালয়ে যারা মানুষ হয় তাদের স্বাবলম্বী হতে হয় তাড়াতাড়ি। সেই কাঠের ব্যবসায় এসে রবার্টসাহেবের সঙ্গে আলাপ। তিনিই নিয়ে এলেন চা-বাগানের চাকরিতে। চব্বিশ বছর হয়ে গেল সময়টা।
তিনখানা পেল্লাই সাইজের ঘর, উঠোনের গায়ে আর একটি ঘর, ওপাশে রান্নাঘর, দু পাশে আমকাঁঠালের গাছ, শাকসবজি নিয়ে অমরনাথের এই কোয়াটার্স। উঠোনে নেমে অমরনাথ মনোরমার দর্শন পেলেন। উঠোনে মোড়া পেতে বসে আছেন চুপচাপ। রান্নাঘরে বাচ্চাদের কলরব। সম্ভবত জলখাবার খাওয়া হচ্ছে। অমরনাথ মায়ের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, বল কি আনতে হবে?
মনোরমা বললেন, কি আর আনবি? সেই তো থোড়বাড়ি। তা ছাড়া আজ যে রকম হয়ে আছে আকাশ তাতে ভাল করে বাজার বসবে বলে তো মনে হয় না।
একদম সাদা থান পরেন মনোরমা। একবার অঞ্জলির বাপের বাড়ি থেকে নরুন পাড় ধুতি দিয়েছিল, উনি পারেননি। অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, কাঁকরোল আনবো? গত হাটে খুব ছোট দেখেছিলাম, আজ মনে হয় বড় পাওয়া যাবে।
কাঁকরোল তো বাড়িতেই হয়েছে। তবে ওই বিচিওয়ালা বেগুন আনিস না। নতুন আলু উঠেছে কি না দেখিস। একবেলা তো রান্না করি, বেশী বাজারের কি দরকার! আর হ্যাঁ, সেরখানেক কালানোনিয়া চাল আনিস তো আজ। মনোরমা বললেন।
মাথা নেড়ে রান্নাঘরেব সামনে গেলেন অমরনাথ, হাটে যাচ্ছি, কি কি আনতে হবে?
রান্নাঘর থেকে অঞ্জলির গলা ভেসে এল, বুধুয়াকে বলে দিয়েছি।
সে কোথায়? অমরনাথ গলা তুললেন, বুধুয়া! এই বুধুয়া?
গোয়ালঘরের দিক থেকে কালো মদেশিয়া ছেলেটা দৌড়ে এল। অমরনাথ বললেন, নে। ব্যাগট্যাগ নিয়ে চল। পকেট থেকে নস্যি বেবি করতে গিয়ে সামলে নিলেন তিনি। কোনদিন মায়ের সামনে নস্যি নেননি। পা বাড়াতে গিয়ে ডাক শুনলেন, অমর, অমরনাথ পেছন ফিরলেন। মনোরমা বললেন, একটু কিসমিস আনিস আজ।
কিসমিস?
পায়েস হবে। মেয়ের জন্মদিনের কথা বাপের মনে থাকে না। ছেলে হলে মনে রাখতিস। মনোরমা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। হেসে ফেললেন অমরনাথ। কাল রাতে অঞ্জলি বলেছিল কিসমিসের কথা। মনোরমা মনে না করিয়ে দিলে নিঘাৎ একটা অনর্থ ঘটত আজ।
বাড়ির সামনের মাঠে পা রাখলেন অমরনাথ। আজ রোদ উঠবে না। গাছপালাগুলো পর্যন্ত ভিজে-ভিজে দেখাচ্ছে। ছাতি নেওয়ার দরকার হবে না। বর্ষাকাল নয় তো, মেঘ যতই ঘোরাফেরা করুক চট করে বৃষ্টি নামবে না। আর নামলেও সেটা সন্ধের পর। গত রাতে বাড়িতে ফেরার সময় ছাতা থাকতেও ভিজে গিয়েছিলেন খুব। গরমজলে পা ড়ুবিয়ে তবে সর্দিটা বাঁচানো গেল। মাঠের ওপারে আসাম রোড ধরে এই মেঘলা দিনেও লোক যাচ্ছে হাটে। মাঝে একটা হাটবাস বেরিয়ে গেল বোঝাই লোক নিয়ে। আকাশ ভেঙে না পড়লে সপ্তাহের একটিমাত্র হাটবারে বেচাকেনা জমে উঠবেই। শীত পড়ার মুখে, লক্ষ্মীপুজো চলে গিয়েছে। বড়বাবুর বাড়ির সামনে গেটের ভেতরে চালা বেঁধে অনন্ত কালীঠাকুরে কাঠামোয় খড় বেঁধেছে। আগে লোকটা ওই একটি ঠাকুর গড়তো। এখন পাঁচ পাঁচটা বাগানের কালীর অর্ডার নিয়ে কর্মচারি দিয়ে করায়। তবে অন্য যেখানে যাই করুক, এই বাগানের ঠাকুরের রঙ আর চোখ অনন্ত করবেই নিজের হাতে। অমরনাথ দেখলেন বড়বাবুর কোয়াটার্সের তারের বেড়া ধরে শনিচর ধোপা খড়ের কাঠামোর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। চা বাগানের একমাত্ৰ ধোপা। এই বাগানে চাকরি নেবার সময় থেকেই ওকে দেখছেন। বাগান থেকেই ওকে থাকার জায়গা দেওয়া হয়েছে। ও অশক্ত হলে ওর ছেলে কাজ করবে। এটাই নিয়ম। কিন্তু সেই ছেলে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে হঠাৎ সংসার ত্যাগ করেছে। ছেলেটাকে দেখেছেন তিনি। রবিবারের বিকেলে ইস্ত্রি করা কাপড় নিয়ে বাড়িতে আসত। সাদামাটা গোবেচারি বিহারী যুবকটির মাথায় এমন মতলব ছিল তা তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। শনিচর এখন ভয় পাচ্ছে অশক্ত হয়ে পড়লে তাকে এই বাগান থেকে বিতাড়িত হতে হবে। চিন্তাটা মাঝে মাঝে তাঁর নিজেরও হয়। দেশের বাড়িতে এখন কেউ নেই। কাকাদের সঙ্গে তো কোনদিন সম্পর্ক নেই। মামারবাড়িতে যে মানুষ তার সঙ্গে থাকবেই বা কেন? বিষয়সম্পত্তি যা ছিল বাবার নামে তা একসময় কাকারা নিজেদের নামে আইনসম্মত করে নিয়েছে। দাদু মারা যাওয়ার পর মামারা খারাপ ব্যবহার করেনি। তবে তারা যে বাইরের লোক এটা ক্রমশ ব্যবহারে ফুটে উঠছিল। এখন এই চা-বাগানের চাকরিটা ছাড়া তার কোন সম্বল নেই। তবে সময় আছে হাতে। গঞ্জের ওপাশে শস্তায় একটা জমি কিনে রেখেছেন। ষোল বছর চাকরি আছে। একটু একটু করে গুছিয়ে নিতে হবে এখন থেকেই।
চাঁপা ফুলের গাছটার কাছে পৌঁছে উলটোদিক থেকে শ্যামলকে আসতে দেখলেন তিনি। পাতিবাবু, হরিদাস চ্যাটার্জির বড় ছেলে। ম্যাট্রিক পাস করে বসে রয়েছে। ভাল ফুটবল খেলে। পাতিবাবু বড়বাবুকে ধরেছেন যাতে তিনি সাহেবকে বলে শ্যামলের চাকরির ব্যবস্থা করেন। ভদ্রলোক বোকামি করছেন। অমরনাথ জানেন বড়বাবু তাঁর শালার জন্যে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
সাইকেল থামিয়ে শ্যামল দাঁড়িয়ে গেল। অমরকাকা, বাবা বলছিলেন আপনি যদি একবার আমাদের বাড়িতে আসেন তা হলে খুব ভাল হয়। বাবা নিজেই যেতেন, কিন্তু তালুইমশাই আছেন বলে যেতে পারছেন না।
কি ব্যাপার তুমি জানো?
ও আপনি বাবার কাছেই শুনবেন। আমি আপনার বাড়িতেই যাচ্ছিলাম।
চল। অমরনাথ আর কথা বাড়ালেন না। সাইকেল নিয়ে শ্যামল পাশাপাশি হাঁটছিল। কোয়াটার্সগুলো বাঁদিকে, ডানদিকে আসাম রোড। ধুতিতে চোরকটা লেগে যাচ্ছে। শ্যামল বলল, কাল লঙ্কাপাড়া বাগানের সঙ্গে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছিলেন বড়সাহেব।
হ্যাঁ, তোমার দেওয়া গোলে আমাদের বাগান সেমিফাইনালে উঠেছে বলে শুনলাম।
সাহেব কিছু বলেছেন?
কি ব্যাপারে?
এই আমার গোল দেওয়ার ব্যাপারে?
জানি না। আমার সঙ্গে তো কথা খুব কম হয়। অমরনাথ মনে মনে হাসলেন। একটা গোল দিয়েই ছোকরা ভাবছে চাকরি পেয়ে যাবে। বড়সাহেব গভীর জলের মাছ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বাজার যাবে না?
আমাদের বাজার খাওয়াদাওয়ার পর হয়।
কেন? অমরনাথ অবাক হন।
তখন দাম কমে যায়।
অমরনাথ চুপ করে গেলেন। মালবাবুর পাশেই পাতিবাবুর কোয়াটার্স। বাগানের সরু গলিতে গলিতে টহল মেরে পাতি তোলান হরিদাসদা। এই চা-বাগানের সবচেয়ে প্রবীণ কর্মী। সামনের মাসে অবসর নেবার কথা ছিল, সাহেবকে অনেক ধরেটরে এক বছরের এক্সটেনশন পেয়েছেন। অমরনাথ দেখলেন বাইরের বারান্দায় চেয়ার পেতে হরিদাসদা বসে গল্প করছেন তাঁর বেয়াই-এর সঙ্গে। জলপাইগুঁড়িতে গিয়ে বাড়ি ভাড়া করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এখানকার নিমন্ত্ৰিতরা লরিতে চেপে জলপাইগুঁড়িতে গিয়ে সেই বিয়ের নেমস্তন্ন খেয়ে এসেছে। অমরনাথের শরীর ভাল না থাকায় যাননি। খরচ কমানোর জন্যে এখানকার অনেকেই একটা বাহানা দেখিয়ে জলপাইগুঁড়িতে গিয়ে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেয়। হরিদাসদার যা অবস্থা তাতে ওটা না করে উপায় ছিল না। এখানে বিয়ে দিতে আটগুণ মানুষকে খাওয়াতে হত। তবে হ্যাঁ, এই চা-বাগানের প্রথম দিকের সন্ধেগুলো তাঁর কাটতো এই হরিদাসদার কোয়াটার্সেই। পুরনো দিনের কলের গান আছে হরিদাসদার। কানা কেষ্ট, সায়গল, কাননীবালার রেকর্ড বাজাতো সন্ধের পরে। হরিদাসদা একসময় কলকাতায় ছিলেন। আলাউদ্দিন খায়ের বাজনা শুনেছেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্পর্কে ভাল ধারণা ছিল। ওঁর সঞ্চয়ের রেকর্ড আজকাল কেউ শোনে না।
হরিদাস চ্যাটার্জীকে বয়সের চেয়ে বেশী বয়স্ক দেখায়। রোগা ক্ষয়া লম্বা চেহারা। গরমকালেও গেঞ্জির ওপর সুতির চাদর জড়িয়ে রাখেন। কালীঠাকুরের মূর্তিতে অনন্ত হাত দিতেই গায়ে আলোয়ান আসে। অমরনাথকে দেখে হরিদাসবাবু উঠে দাঁড়ান চেয়ার ছেড়ে, এসো অমরনাথ। চা খাবে তো? শ্যামল, যাও তো মাকে বল চা দিতে।
না দাদা। এইমাত্র জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছি। কি ব্যাপার বলুন!
আরে বসো বসে। বাজারে যাচ্ছ কিন্তু বাজার তো বসেইনি। এই বারান্দায় বসে কটা হাটবাস এল দেখে বুঝতে পারি বাজারের কি অবস্থা। এই বাদলায় বাজার বসতে সময় লাগবে। বসো।
শ্যামল জিজ্ঞাসা করল, তা হলে সত্যি আপনি চা খাবেন না অমরকাকা?
অমরনাথ মাথা নেড়ে না বলে তৃতীয় চেয়ারটিতে বসলেন।
হরিদাসবাবু বললেন, সবার আমার বেয়াই-এর সঙ্গে তো তোমার আলাপ হয়েছিল।
অমরনাথ নমস্কার করলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। ভাল আছেন তো?
আছি। বয়স হলে যেমন সবাই থাকে। ভদ্রলোক জবাব দিলেন।
হরিদাসবাবু বললেন, বেয়াইমশাই ব্যস্ত মানুষ, দু দুটো দোকানের ঝামেলা, মিউনিসিপালিটির কাজ, কংগ্রেসী করেন তা তো জানোই, তবু গত রাতে এদিকে এসেছিলেন বলে আমার কাছে একটু থেকে গেলেন। এমনিতে জলপাইগুঁড়ির বাড়িতেই ওঁকে ধরা যায় না।
ওসব ছেড়ে দিন। ভদ্রলোক হাসলেন, জলপাইগুঁড়ি শহরে পুরনো কংগ্রেসী বলতে তো আমরা কজন। লোকে জিজ্ঞাসা করে আমি কেন এম. এল. এ হলাম না। বিধানবাবু অতুল্যবাবুরা তো আমাকে পছন্দ করেন। আমি বলি ওসব করার জন্যে তো খগেন দাশগুপ্ত মশাই আছেন। ওঁকে জেতাতে পারলেই আমাদের জিত। হরিদাসবাবুর বেয়াই চুরুট ধরালেন।
হরিদাসবাবু বললেন, বেয়াইমশাই বোধ হয় একটু বেশী চুরুট খান।
তা খাই। আমি তো বলে রেখেছি চিতায় যখন তুলবে। তখনও মুখে একটা চুরুট গুঁজে দিও।
যেন বিরাট রসিকতা করেছেন এমনভাবে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক।
অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার হরিদাসদা, কিছু বললেন না তো!
হরিদাসবাবু বললেন, বেয়াইমশাই-এর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ওঁর ভাই-এর একটি সুপুত্ৰ আছে। এবার ম্যাট্রিক দেবে। ভ্ৰাতৃবধুর ইচ্ছে ছেলেটির বিয়ে দিয়ে ঘরে বালিকাবধু আনবেন। ওকে আমি একবার দেখেছি। প্রকৃত সুদর্শন। বয়স কত হবে বেয়াইমশাই?
ভদ্রলোক বললেন, কত হবে। সেদিন তো জন্মালো। ধরুন, সতের।
হরিদাসবাবু আবার শুরু করলেন, যা বলছিলাম, ওঁদের কোন দাবিদাওয়া নেই। শুধু মেয়েটিকে সুন্দরী হতে হবে, দশ বারো বছর হলেই চলবে। শুনেই আমার মনে পড়ল তোমার দীপার কথা। এই বাগানে ওর চেয়ে সুন্দরী মেয়ে তো আর কেউ নেই।
অমরনাথ চমকে উঠলেন, সে কি! দীপা তো আজ দশে পড়ল। এই বয়েসে বিয়ে দেবার কথা ভাবছিই না।
হরিদাসবাবুর বেয়াই বললেন, গরমদেশের মেয়েরা বারোতেই যুবতী হয়ে যায়। আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল সাতে, আমি হয়েছিলাম তেরোতে। ওহো, আমার ভাইটিকে আবার কংগ্রেসী বলে ভাববেন না। সে কনট্রাক্টরি করে প্রচুর পয়সা জমিয়েছে। পুত্র বলতে ওই একটি, ছটি কন্যার একটি বিবাহিতা। আপনাকে শাঁখা সিঁদুর ছাড়া কিছুই দিতে হবে না।
অমরনাথের বুকের পাঁজর যেন টনটন করে উঠল। ওইটুকুনি মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। তা ছাড়া কথাটা মুখ ফুটে বাড়িতে বলবেনই বা কি কবে? অঞ্জলি শুনলে প্ৰচণ্ড রেগে যাবে। অমরনাথ দেখলেন দু দুটো মুখ তাঁর দিকে জবাবের আশায় তাকিয়ে আছে। অমরনাথ বললেন, শুনলাম। কিন্তু হরিদাসদা, ইনি তো আমার মেয়েকে দ্যাখেননি। দেখলে যে পছন্দ হবেই তারও তো কোন মানে নেই।
বেয়াইমশাই বললেন, দেখেছি। একটু আগে ওই মাঠ দিয়ে একটি ছেলের সঙ্গে বাজারের দিকে গেল। দূর থেকে যা দেখলাম তাতেই চোখ জুড়িয়ে গিয়েছে।
অমরনাথ হতভম্ব। দীপা আবার কোন ছেলের সঙ্গে বাজারেব দিকে গেল। তিনি ভেবেছিলেন রান্নাঘরে বসে জলখাবার খাচ্ছে। একটি ছেলে মানে কোন ছেলে? অঞ্জলি যে রাগারাগি করে তা খুব ভুল করে না।
হরিদাসবাবু বললেন, বেয়াইমশাই সামনে রয়েছেন, তবু বলি। সুযোগ যখন পাচ্ছি তখন আর হাতছাড়া করো না। মেয়ে বড় হলে সুপাত্র পাওয়া মুশকিল।। তা ছাড়া আমরা যা চাকরি করি তাতে ভাল পাত্র পেতে গেলে যে বরপণ দিতে হয় তা যোগাড় করতে পারব না। অতি বড় সুন্দরীও সেই কারণে বর পায় না হে।
অমরনাথ বললেন, আপনি নিশ্চয়ই সুপরামর্শই দিচ্ছেন। দেখি, ভেবে দেখি; বাড়িতে একটু আলোচনা করি। তারপর হরিদাসবাবুর বেযাই-এর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এখানে কিছুদিন আছেন নাকি?
ভদ্রলোক দ্রুত মাথা নাড়লেন, না না। আজই চলে যাব। তা আপনি ভেবে দেখুন। আজই যে জবাব দিতে হবে তা তো নয়।
একটা কথা। উনি এত অবস্থাপন্ন আমি আমি চা-বাগানের সামান্য কেরানি। বিয়ে-থা সমান ঘরে হওয়া উচিত। আমার মত লোকের মেয়েকে কেন বউ করে নেবেন ওরা?
না মশাই, আপনাকে নিয়ে পারা গেল না। আমাদের সমান ঘর হলে এবিকম প্ৰস্তাব নিয়ে যেতে পারতাম। বড়লোক বাপ কি দশ বছরের মেয়ের বিয়ে দেবে? আমার ভাই চাইছে আপনাদের মত পরিবার থেকে মেয়ে আনতে। কচি আছে, শিক্ষা আছে শুধু পয়সাটাই যা নেই। ভদ্রলোক চুরুটে টান দিতে থাকলেন।
অমরনাথ উঠে দাঁড়ালেন, অর্থবান মানুষের পরিবারে দরিদ্র সংসারের মেয়েরা মানিয়ে নিতে পারে না তো সবসময়। তাই বলছিলাম আর কি?
ভদ্রলোক বললেন, অর্থের সঙ্গে শিক্ষার যোগাযোগ যাদের নেই। সেই পরিবারগুলোতে হয়তো তেমন হয়। এই যে এখানে হরিদাসবাবু রয়েছেন, ওঁর অবস্থা ভাল নয, মেয়েটিও আহামরি সুন্দরী নয় জেনেও আমি আমার ঘরে নিয়েছি। কেন নিয়েছি জানেন? বড়লোকের মেয়ের কাছে আমরা শান্তি পাবো না তাই। তাই বলে কি সে খুব কষ্টে আছে? কি হরিদাসবাবু, বলুন না?
না না। এরা সেই প্রকৃতির মানুষই নয় অমরনাথ। হরিদাসবাবু জানিয়ে দিলেন।
ঠিক আছে, ভেবে দেখি বলে অমরনাথ মাঠে নামলেন। বুধুয়া দূরে দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। তাঁকে চলতে দেখে সে এগিয়ে গেল। দীপার বিয়ে এই বয়সে তিনি কি সত্যি দিতে পারবেন? বুকের মধ্যে চাপটা রয়েই গেল। মেয়েটির মুখ মনে হতেই তিনি মাথা নাড়লেন, না। পাত্র যতই লোভনীয় হোক সম্ভব নয়।
গাছের গুঁড়ি কেটে সিঁড়ি বানানো হয়েছে মাঠ থেকে তারের গেট পেরিয়ে আসাম রোডে নামতে। অমরনাথ ধুতি সামলে সেখানে পৌঁছে দেখলেন বুধুয়া একটা ডিমওয়ালাকে ধরেছে। কুলি লাইন থেকে সারা সপ্তাহের জমানো ডিম নিয়ে যাচ্ছে হাটে বেচতে। এখানে কিনলে কয়েক আনা শস্তা হয়। দাম দিয়ে তিনি ডিমওযালকেই বললেন কোয়াটার্সে পৌঁছে দিতে।
পিচের রাস্তার দু পাশে পাইকাররা বসে গেছে পাট বিক্রি করতে আসা রাজবংশী কৃষকদের ধরতে। দরাদরি করে কেনা পাট চলে যাচ্ছে সদরে। ড়ুড়ুয়া নদী থেকে মাছ ধরে মদেশিয়ারা আসছে হাটে ঝুড়ি ঝুলিয়ে। বেশীর ভাগই ছোট মাছ। তাদের একজনকে দাঁড় করালেন অমরনাথ, কি আছে, দেখাও। লোকটা দেখাল, বান আর পাথরঠোকরা। কবে বান মাছ খেয়েছেন মনে করতে পারলেন না অমরনাথ। ভাল করে রাঁধলে শুনেছেন মাংসের চেয়েও উপাদেয় হয়। চার টাকা সের শুনে জ্যান্ত কি না দেখতে চাইলেন। পেছন থেকে বুধুয়া জানাল ওই মাছ নিয়ে গেলে মাইজি খুব রেগে যাবে। অন্যদিন সাড়ে তিন টাকায় বিক্রি হয় তবু মাইজি নেয় না। বলে, দেখলে সাপের কথা মনে হয়। অন্যদিন মাছ কেনে অঞ্জলি। দুপুরের খাওয়ার পাট চুকলে ওরা বারান্দায় এসে বসে। দূরে আসাম রোড দিয়ে মাছমারারা গেলে ডাকিয়ে এনে মাছ কেনে।
অমরনাথ মত পরিবর্তন করলেন। হাটে এসে চালানি মাছ কেনাই ভাল। অমরনাথ এগোলেন। আগে হাট বসত এই হাটতলাতেই। এখন চৌমাথা ছাডিয়ে গিয়েছে। আসাম রোড দিয়ে গাড়ি যায় শামুকেব মত। পাঁচ ছটা বাগান থেকে মানুষ ঝেঁটিয়ে আসছে বাজার করতে। ভিড়ে ভিড়ে একাকার। সপ্তাহেব বাকি ছদিন তো মাছিও বসে না। দোকান বলতে হাজারির মুদি খানা, মুখার্জীদের মনিহারী দোকান, একটা হাজামখানা, কয়েকটা সিগারেট বিড়ির দোকান, সাইকেল সারাই-এর দোকান আর যাদবদের ভাটিখানা। এদের ওপর ভরসা করে থাকতে হয় তাঁদের। হঠাৎ কানে তীব্র আর্তনাদ ভেসে এল। একটানা ককিয়ে যাচ্ছে শুয়োরটা। ডানদিকের মাঠের বুকে শুয়োর কাটা হচ্ছে। মদেশিয়াদের প্ৰিয মাংস, শস্তাও। কিন্তু চিৎকারটা সহ্য করা যায় না। এই নিয়ে এককালে অনেক ঝামেলা হয়েছে কিন্তু বিক্রি বন্ধ করা যায়নি।
প্ৰথমে মাছ কিনলেন অমরনাথ। বরফচাপা বড় রুইমাছ। যেটাকে একটু সতেজ মনে হল তার ওজন তিন সের। কয়েকদিন চলবে। একবেলা মাছ খাওয়া হয়। বুধুয়াকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন বাড়িতে। অঞ্জলির সুবিধে হয়, তাড়াতাড়ি রান্না বসাতে পারবে। বুধুয়া জানে ফিরে এসে কোথায় তাঁকে খুঁজতে হবে। হয় হাজারির মুদিখানা নয় পেট্রল পাম্পে তাঁকে পাওয়া যাবে। হাজারির দোকানের সামনে ভিড় বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালেন তিনি। নস্যি নেন। কিন্তু মাঝে মধ্যে সিগারেটও চলে। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভিড় দেখতে দেখতে তাঁর মনে হল, তা হলে দীপারও সম্বন্ধ এল। এইসময় একটা স্টেশনওয়াগন এসে থামল সামনে। তেলিপাড়া চা-বাগানের মালবাবু সুনীল সেন ওয়াগন থেকে নেমে তাঁকে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন, যাক, একেই বলে বরাত, আপনাকে পেয়ে গেলাম, নইলে বাড়ি পর্যন্ত ছুটতে হত।
কি ব্যাপার? অমরনাথের ভাল লাগল দীপার বিয়ে-ভাবনা থেকে মুক্তি পেতে।
পরশুদিন আপনাদের যে খেলাটা ছিল বানারহাট বাগানের সঙ্গে সেটা ওরা আজ খেলতে চাইছে। একজন পার্টনারকে মঙ্গলবার পাওয়া যাবে না। নিজেদের মধ্যে ব্যাপার, প্লিজ না বলবেন না। সুনীল সেন হাত ধরলেন।
কিন্তু আমার পার্টনারকে তো বলতে হবে। ছুটির দিন বেরুতে ইচ্ছে করছিল না অমরনাথের। তেলিপাড়া ক্লাব অকসন ব্রিজ কম্পিটিশন করছে। এই বাগান থেকে দুটো টিম গিয়েছে। তাঁর পার্টনার মেজগুদামবাবু। ছোকরার একটা দোষ ভুল হলেই বলে আমি ভেবেছিলাম আপনার হাতে অমুক তাসটা আছে। যতবার বলেন তোমার এই ভাবাভাবি ব্যাপারটা ছাড়ো তবু শুধরোয় না। সুনীল সেন বললেন, ম্যানেজ করে নিন। নইলে কম্পিটিশন শেষ করতে পারব না।
আসাম রোডটা নদীর ওপর ছোট্ট সাঁকো ডিঙিয়ে চৌমাথার দিকে চলে গিয়েছে। এখানে বাঁদিকে কাটা কাপড়ের দোকান বসে। উলটোদিকে বেতের ঝুড়ি থেকে আরম্ভ করে তামাকপাতা, সাবান, রঙিন ফিতে থেকে মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে পসারীরা বসে। ডাক্তারবাবুর ছেলে বিশু। উবু হয়ে বসে কাপড়ের ওপর ছড়ানো নানা রকমের বঁড়শি দেখছিল। ঠিক তার পাশে দাঁড়িয়ে অসহিষ্ণু গলায় দীপা বলল, এত দেখার কি আছে? পুঁটি পাথরঠোকরার জন্যেও ছটা নিয়ে নে? বিশু বলল, তুই কেন মেয়ে হলি রে? মেয়েদের এত অধৈর্য হতে নেই!
দীপা ঝাঁঝিয়ে উঠল, মা যদি ডেকে না পায় তা হলে দুপুরে মাছ ধরতে যাওয়া বন্ধ হযে যাবে।
বিশু দোকানদারকে বলল, বান মাছ ধরার সুতো আর বঁড়শি দাও।
দীপা বিরক্ত হল, বান মাছ মা রাঁধবে না।
আমার মা রাঁধবে। তোরা ঘটি তাই ভাল জিনিস খাস না। বিশু বলল।
বিশুর ওপর খুব রাগ হয়ে গেল দীপার। তখন থেকে বঁড়শি দেখছে তো দেখছেই। আবার ঘটি বলে ঠোকা হল। ঠাকুমা বলে বাঙালদের কোন বাছবিচার নেই। ঠিক বলে কি না বোঝা যাচ্ছে না বিশুর বঁড়িশি কেনার ধরন দেখে। সে আগ বাড়িয়ে বলল, ওই আটটা বঁড়শির কত দাম হবে? দোকানদার দেখে বলল, এক টাকা দিদি!
এমা! এ কি বলে রে? এখান থেকে নিস না বিশু। দীপা এমন গলায় চিৎকার করে উঠল যে আশেপাশের অনেকেই এদিকে তাকাল। বিশু শেষপর্যন্ত অনেক ঘ্যানর ঘ্যানর করে দামটা বারো আনায় নামিয়ে আনল। দুজনের সঞ্চয়ে ছিল একটাকা, তার বারো আনাই বেরিয়ে গেল। গত চার রবিবারে বাবার কাছ থেকে দুজনে দুআনা করে সংগ্রহ করেছে।
কাগজে মুড়ে বঁড়শিগুলো পকেটে পুরে বিশু উঠে দাঁড়াল, এই, শোনপাঁপড়ি খাবি?
দীপা মাথা নাড়ল, শোনপাঁপড়িওয়ালা এবারের হাটে আসেনি। বৃষ্টি নামবে, তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। আর খাওয়াদাওয়ার পর বৃষ্টি নামলে আমি কিন্তু মাছ ধরতে যাব না।
বেশ। তা হলে কদমা খাওয়া। ওই ওখানে বসে আছে। বিশু আঙুল তুলে দেখাল।
তুই কি পেটুক রে! কদমা খেলে পেটে কেঁচো হয় জানিস না?
বিশু বলল, বাবা ঠিক বলে, মেয়েরা এক নম্বরের কিপটে হয়।
অতএর কদমাওয়ালার কাছে যেতেই হল। দুজনের চার আনা পয়সা বেঁচে আছে। বিশুর জন্যে তার পুরোটাই খরচা হয়ে গেল। কদমাটাকে কামড় দিতেই গিয়েই সে থমকে গেল। সেই ছেলেটা। মালবাবুর বাড়িতে এসেছে। সে চাপা গলায় বিশুকে বলল, অ্যাই বিশু, সেই ছেলেটা!
বিশু বিরক্ত গলায় জানতে চাইল, কোন ছেলেটা?
যে আমাকে আজ সকালে সুচিত্রা সেন বলেছিল।
বিশু সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ ঘুরে দেখতে চাইল ছেলেটাকে। যার কথা হচ্ছিল সে হাটে এসেছে ফুলবাবু সেজে। মাথায় টেরি বানিয়েছে। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে এ দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। দীপার খুব রাগ হয়ে গেল। আজ সকালে ছেলেটার মুখে কথাটা শোনামাত্র সে উঠে দাঁড়িয়েছিল। ফ্রকের প্রান্ত উঁচু করে তুলে ফুল রেখেছিল। হাঁটু দেখা যাচ্ছে বুঝতে পেরে ফুলগুলো ফেলে দিয়ে ফ্রক নামিয়ে গম্ভীরভাবে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছিল। সদর দরজা বন্ধ। তারের বেড়া পেরিয়ে বাইরে থেকে আসা ওই ছেলেটির সামনে অশোভন বলে পাশের গলির পথ ধরেছিল। ফুলগুলো আনা হল না বলে খুব কষ্ট হয়েছিল তার। এখন রাগ হল। সে হাত বাড়িয়ে ডাকল ছেলেটাকে। ছেলেটা বেশ খুশিমুখে এগিয়ে এল, কি ব্যাপার?
কি দেখছেন এদিকে? চেচিয়ে বলল দীপা।
সঙ্গে সঙ্গে বিশু জুড়ে দিল, আপনি ওকে সুচিত্রা সেন বলেছেন কেন?
ছেলেটি ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে গেল। দীপা বলল, আবার যদি দেখি আপনি কাছে এসেছেন তা হলে রতনকাকুকে বলে দেব। কথাগুলো শেষ করে সে হাঁটা শুরু করল। বিশু তার সঙ্গ ধরে কয়েক পা হেঁটে বলল, উরি ব্বাস, তুই কি রাগীলোকের মত কথা বললি রে!
দীপা অহঙ্কারী মুখে আকাশ দেখল। এই ভঙ্গীতে কথা বলতে পারবে কোনদিন কেন আজ সকালেই ভাবতে পারেনি। এখন খুব ভাল লাগছে। খোকন বিশুও তো ছেলে কিন্তু ওই ছেলেটার মত বদ চাহনি নেই। আচ্ছা বদ মনে হল কেন? একটা খটকা লাগল তার। কথাটা কাকে জিজ্ঞাসা করা যায়? সে বিশুকেই প্রশ্ন করল, ছেলেটার তাকানো দেখেছিস?
বিশু মাথা নাড়ল, হুঁ। উত্তমকুমারের মত।
উত্তমকুমার? তুই উত্তমকুমারকে দেখেছিস?
পত্রিকায়। মা পড়ে। তাতে উত্তমকুমারের ছবি আছে।
যাই বলিস, ছেলেটা বদ। আমার একটুও ভাল লাগেনি। দীপা এমন গলায় কথা বলল যে বিশু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল হাঁটার সময়। দীপা সেটা লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করল, অ্যাই, তুই আমার দিকে অমন করে কি দেখছিস?
তুই কেমন বড়দের মত কথা বললি।
মানে?
আমার সোনামাসীকে দেখেছিস তো, জলপাইগুঁড়িতে কলেজে পড়ে, একদিন আমার সামনে এক বন্ধুকে বলছিল ঠিক ওইভাবে।
দীপার শরীরটা কেমন করে উঠল কথাগুলো শুনে। সে কি বড় হয়ে যাচ্ছে! সে গম্ভীর গলায় বলল, আমি তো বড় হচ্ছি।
বিশু বলল, ছাই। শাড়ি না পরলে মেয়েরা বড় হয় না।
এই সময় সত্যসাধনবাবুর সঙ্গে দেখা হল তাদের। সত্যসাধনবাবু তাদের ক্লাসটিচার। ময়লা একটা চটের থলি নিয়ে বাজারে এসেছেন। দেখতে পেয়েই ডাকলেন, ও দীপা, তোমাগো বাড়িতে জাম্বুড়ার গাছ আছে না?
দীপা মাথা নাডল, আছে।
সত্যসাধনবাবু খুশি হলেন, চল, একবার তোমাদের অখানে যাব।
মাস্টারমশাই-এর সঙ্গে হাঁটতে একদম ইচ্ছে করছিল না দীপার। বিশুটা তাল বুঝে পিছিয়ে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে মাস্টারমশাই বললেন, অঙ্ক করতেছ তো রোজ? অন্য সব সাবজেক্টে চিন্তা নাই, অঙ্কটাই তোমার গুলমাল। হাফ ইয়ালিতে কত পাইছিলা?
চল্লিশ।
ভেরি ব্যাড। মিনিমাম নাইনটি পাওয়া উচিত। তোমার বাবাব লাগে কথা বলা দরকার। আপনমনে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলেন সত্যসাধনবাবু। দীপা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বিশু আরও পিছিয়ে পড়েছে। অঙ্কে বিশু পঁয়ত্ৰিশ পেয়েছে।
হাজারির দোকানের সামনে এসে দীপা মুশকিলে পড়ে গেল। বাড়িতে যেতে হলে অমরনাথকে দেখা দিতেই হবে। হাটে আসার জন্যে কৈফিয়ত চাইতে পাবেন এখানেই। কিন্তু কিছু করার আগেই সত্যসাধনবাবু বলে উঠলেন, নমস্কার অমরনাথবাবু, আছেন কেমন?
অমরনাথ বুধুয়ার জনো অপেক্ষা করছিলেন, বললেন, এই একরকম। সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের দিকে নজর গেল তাঁর। সত্যসাধন বললেন, দীপাকে কইলাম আপনার বাড়ি যাব। এ মেয়ে সব বিষয়ে ব্রিলিয়ান্ট, অনলি অঙ্কে একটু কম পায়। যদি ওই সাবজেক্টটা ইমপ্রুভ করণ যায় তা হলে আ্র দেখতে হইব না। ম্যাট্রিকে ফাস্ট ভিভিশন পাইতে হলে এখন থিকাই তৈরী করন দরকার। কিছু একটা করেন।
অমরনাথ বললেন, ভাল প্ৰাইভেট টিউটর পাচ্ছি না। মায়ের কাছেই পড়ে তো।
অন্যান্য বিষযে, দীপা ভাল একথা সত্যসাধনবাবু বলায় খুব খুশি হলেন তিনি। সত্যসাধনবাবুকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। সেটা লক্ষ্য করেই অমরনাথ বললেন, আপনি তো অনেক টিউশনি করেন, সময় পাবেন কি?
দ্যাখেন, ভাল স্টুডেন্ট পাইলে টাইম করা অসুবিধা না।
তা হলে কবে কথা বলব?
বিকালে বাড়ি থাকরেন?
না। তেলিপাড়ায় যেতে হবে। আগামীকাল যদি আসেন তা হলে ভাল হয়।
ঠিক আছে। সেই কথাই থাকল। চল দীপা।
শান্ত মেয়ের মত দাঁড়িয়ে ছিল দীপা। এবাব জিজ্ঞাসা করল, বাবা, তোমার মাছ কেনা হয়ে গিয়েছে? তপসে মাছ উঠেছে আজ?
অমরনাথ বললেন, দেখিনি। যাও, বাড়িতে যাও।
রান্নাঘরের বারান্দায় বাজারের স্তুপ। অঞ্জলি তাই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। বুধুয়া মনোরমার বাজার আলাদা ব্যাগে এনে দিয়ে গেছে। অঞ্জলি শাশুড়িকে বলল, দেখুন মা, আপনার ছেলের কাণ্ড, কাল রাত্রে আমি বললাম, বেরুবার সময় আপনি মনে করিয়ে দিলেন তবু এখনও কিসমিস কিনে পাঠায়নি। আর এই হাঁদাগঙ্গারামকে প্ৰতিবার বলে দিই বিচিওয়ালা বেগুন আনবি না। তবু কাঁড়ি কাঁড়ি আনবেই।
বুধুয়া একটা বেগুন তুলে বলল, বাহারসে দেখনে তো অচ্ছাই লাগতা হ্যায়। আউর, বাবু তো মেরা বায় শুনতাই নেহি। আজ বান মাছ কিনতে মাংতা থা।
ওটা আনলে তুমি তোমার বাবুকে রেঁধে খাওয়াতে। অঞ্জলি বলল, এখানে বসে না থেকে বাজারে যাও। বাবুকে বলো কিসমিস আনতে।
বুধুয়া ছুটল। মনোরমা বললেন, দুপুরের খাওয়ার পরে মরা আঁচে পায়েস বসিয়ে দিও বউমা।
অঞ্জলি বলল, আপনি পায়েস বাঁধলে আপনার ছেলের বেশী পছন্দ হয়।
না। ছেলেমেয়ের জন্মদিনে মাকেই পায়েস রাঁধতে হয়। সে কোথায়?
কোনরকমে কয়েকটা লুচি মুখে গুঁজে গোথায় গেল কে জানে। রবিবারে তো বই নিয়েও বসে না।
এবার থেকে মেয়ের রাশ ধরো। রান্নাবান্না শেখাও।
অঞ্জলি কিছু বলল না। বড় কাঁঠালগাছে একটা ঘুঘু গলা ফাটিয়ে ডেকে যাচ্ছে। মনোরমা আঁচারের বয়ামগুলো রোদে দিয়েছিলেন। কাকের ভয়ে মুখ খোলেননি একটারও। অঞ্জলি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ও কি করেছেন মা। আচার রোদ পাবে কি করে? আকাশ জুড়ে তো মেঘ।
বলা যায় না, উঠতেও তো পারে। মনোরমা ভুলটা স্বীকার করলেন না। তারপর বললেন, এবার দীপাকে একটু ঘরে আটকে রাখ। ছেলেদের সঙ্গে মেশে এটা ঠিক নয়।
অঞ্জলি তরকারির ঝুড়িটা রান্নাঘরে নিয়ে যাওয়ার মুখে বলল, কটা দিন তো মা। সারাজীবন তো ঘরে বন্দী হয়েই কাটাবে।
মনোরমা অবাক হয়ে বললেন, সে কি! তুমি তো কাল সন্ধেবেলায় এই নিয়ে রাগারাগি করছিলে। তোমাদের আমি বুঝতে পারি না বাবা। কথা শেষ করামাত্রই তিনি দীপাকে দেখতে পেলেন। পাশের দরজা দিয়ে ঢুকছে। মনোরমা বললেন, এই যে এলেন তিনি রাজ্য জয় করে। চেহারা দ্যাখো, একদম শাকচুন্নী হয়ে এসেছে।
দীপা দ্রুত ঠোঁটে আঙুল চাপা দিল। শাশুড়ির গলা শুনতে পেয়েছিল অঞ্জলি। তাই রান্নাঘর থেকেই চেঁচিয়ে বলল, অ্যাই, কোথায় গিয়েছিলি? দাঁড়া আজ তোর মজা দেখাচ্ছি।
দীপা অঞ্জলির কথা কানে তুলল। না। এক দৌড়ে মনোরমার কাছে পৌঁছে নিচু গলায় কিছু বলতে তিনি ঘোমটা টানলেন, ওমাম তাই নাকি? অ বউমা, তাড়াতাড়ি এসো। মাস্টারমশাই এসে বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
অঞ্জলি হলুদ হাতে বেরিয়ে এল, মাস্টারমশাই? কোন মাস্টারমশাই?
সত্যসাধনবাবু। আমি তো এতক্ষণ তাঁব কাছে ছিলাম। গম্ভীর গলায় বলল দীপা।
ও। তা বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন? বাইরেব ঘরে বাসা। অঞ্জলি ব্যস্ত হল।
উনি বসবেন না। ভেতরে আসবেন। বলে মেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। এবং কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে সত্যসাধনবাবুকে নিয়ে ফিরে এল। সত্যসাধন মহিলাদের নমস্কার করলেন, পরিবারের হুকুম তাই আইলাম আপনাগো বাড়িতে। জাম্বুড়া দরকার একখান।
অঞ্জলি বলল, জাম্বুড়া? ওহে! কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো বাতাবি লেবু নেই।
সে কি? দীপা, তুমি কইলা না তোমাগো বাড়িতে জাম্বডা গাছ আছে?
হ্যাঁ। ওই তো। দীপা হাত তুলে একটি যৌবনে পড়া বাতবি লেবুব গাছ দেখিয়ে দিল। নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেন সত্যসাধন, তাই কও। আমারই ভুল হইছে। আপনাগো মাইয়ার রসিকতাবোধ প্ৰবল। আমি ফল কই নাই গাছ কইছিলাম। সে ঠিকই কইছে। রিয়েল ইনটেলিজেন্ট গার্ল। আদর করে দীপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি।
অঞ্জলি লজ্জিত হলেন, না না। আপনার মত মানুষের সঙ্গে রসিকতা করা অন্যায়।
হাত তুলে নিষেধ করলেন সত্যসাধন, আরে না না। আমি কিছু মনে করি নাই।
হঠাৎ দীপা বলল, আপনি বসুন আমি এখনই বাতাবি লেবু এনে দিচ্ছি। খোকনদের বাড়িতে এত্তো বাতাবিলেবু আছে। বলে ছুটে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল। অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল, কি হল?
দীপা বলল, দিনের বেলায় খোকনের ঠাকুমা আসেন না, না?
অঞ্জলি স্থানকালপাত্র ভুলে হেসে ফেললেন। মনোরমা পর্যন্ত লজ্জিত। সত্যসাধন কৌতূহলী হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন।
খোকনদের গাছে উঠতে হল না। ওর মা রান্নাঘরে রাখা দুটো বাতাবি লেবু দীপাকে দিয়ে দিলেন। সে দুটো নিয়ে বাড়ি ফিরে সে সত্যসাধনবাবুকে দিল। সত্যসাধনবাবু বললেন, শোন খুকি। ভূত পেত্নী দৈত্যদানব বইল্যা কিছু নাই। এ সবই মানুষের কল্পনা। আসল কথা হইল আমাদের সামনে যেসব মানুষ ঘুইরা বেড়ায় তারাই কেউ কেউ ভূত পেত্নী হইয়া যায় সময়সময়। এখন বোঝবা না। এসব কিন্তু কক্ষনো কল্পনার ভয় পাইবা না। মহিলাদের নমস্কার করে সত্যসাধনবাবু বিদায় নিলেন।
অঞ্জলি বলল, যাও ভূতের মত দাঁড়িয়ে থেকে না। স্নান করে আমাকে উদ্ধার করো। দীপা ফিক করে হেসে ফেলল, মা, আমি ভূত হব কি করে? মেয়েরা কি ভূত হয়? অঞ্জলি নিজের হেসে ফেলার কারণে লজ্জিত ছিল, মেয়ের এই কথা শুনে মুহূর্তেই রান্নাঘরে ঢুকে গেল।