একা এবং কয়েকজন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ভূমিকা
এই উপন্যাসের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যক্তিত্ব ছাড়া সমস্ত চরিত্র ও কাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জীবিত কারুর সঙ্গে কোথাও কোনও মিল খুঁজে পাওয়া গেলে তা নিতান্ত কাল্পনিক হিসেবে গণ্য করতে হবে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কয়েক বছর আগে থেকে শুরু করে এ দেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত কয়েক বছর পর পর্যন্ত যে অদ্ভুত মিশ্র সময় আমরা পার হয়ে এসেছি, তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই কাহিনী। দেশ ও সামাজিক বিবর্তনের পটভূমিকায় আমার এই উপন্যাসে শেষ পর্যন্ত কয়েকজন আলাদা মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও পরিণতিই প্রাধান্য পেয়েছে।
উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল দেশ পত্রিকায়। গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় অনেক কাটাকুটি করেছি এবং বাড়িয়েছি। রচনাকালে অনেক গ্রন্থকার এবং আমার শ্রদ্ধেয় কয়েকজন ব্যক্তি ও বন্ধুদের কাছ থেকে নানারকম সাহায্য পেয়েছি, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
–গ্রন্থকার
.
উৎসর্গ
কমলকুমার মজুমদার
শ্রদ্ধাস্পদেষু
.
০১.
মাঝে মাঝে মনে হয়, এই যে মানুষ হয়ে জন্মেছি, এর চেয়ে বিস্ময়কর আর কিছু নেই। না জন্মাতেও পারতাম এবং তাতে আর কারওর কোনও ক্ষতি হত না। না জন্মালে দেখতে পেতাম না এই ষড়ৈশ্বর্যময়ী পৃথিবী, আমার নিশ্বাসের জন্য বরাদ্দ বাতাসটুকু নেওয়া হত না, মধ্যরাত্রির আকাশের দিকে যারা তাকিয়ে দেখে তাদের মধ্যে একজন মানুষ কম পড়ত। জলের আঙুল দিয়ে একটি শিশু ছবি আঁকত না। ছুটতে ছুটতে পাহাড়ের ওপর উঠে একটি বালকের উল্লাসে ফেটে পড়া–কখনও উপস্থাপিত হত না সেই দৃশ্য। একটি নারীর অনাবৃত ঝকঝকে বুকে মাথা রেখে যে চাঞ্চল্যকর শান্তি পাওয়া যায়–কখনও পেতাম না তার সন্ধান।
আমি না জন্মালে আমার মা, বাবা, কয়েকজন কাকা ও জ্যাঠা, ভাই, বোন, আত্মীয়, কয়েকটি অনাত্মীয়া নারী, চার-পাঁচটি নদী ও দুটি দেশ নিয়ে আমার যে সম্পূর্ণ নিজস্ব জগৎ, এত ব্যাকুলতা ও মমতা–থাকত না এর কোনও অস্তিত্ব। বিশ্বাসই করা যায় না! বিশ্বাস করা যায় না বলেই পুনর্জন্ম, নিয়তি, কর্মফল–এইসব ভালো ভালো মায়াময় বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল একসময়। এখন আবার আকস্মিকতায় ফিরে এসেছি, তাই ভাবতে গেলেও বুক কাঁপে। আমি না জন্মালে এই ক্ষুদ্র জগৎটিতে আমার অনুপস্থিতি কেউ অনুভব করত না, কেউ অপেক্ষা করত না আমার জন্য। যা নেই, তার জন্য আবার অপেক্ষা কী! আর সবাই থাকত, ‘আমি’ থাকতাম না, এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি আর হয় না মানুষের মৃত্যু চিন্তার চেয়েও মর্মান্তিক। কৈশোরে ও প্রথম যৌবনে আমি তিন-চার বার আত্মহত্যার কথা ভেবেছি। অনেকেই ভাবে। আত্মহত্যারও একটা মর্ম আছে। কখনও কখনও গৌরবও থাকে কিন্তু না-জন্মানো? মানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই বুঝতে পারি, না-জন্মানো মানে কী অসীম শূন্যতা। আমি মনুষ্যজন্ম পেয়েছি, আমি ধন্য।
মাঝে মাঝে একথাও মনে হয়, এই জীবনের সার্থকতা কী? এই যে দুর্লভ সৌভাগ্য আমাকে দেওয়া হল, কী এর শ্রেষ্ঠ ব্যবহার? অবহেলায় ঔদাসীন্যে ধুলো কাদায় ফেলে রাখার জিনিস তো এ নয়! এই দেহ নিয়ে জন্মাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, মোমবাতির ওপরে শিখাটুকুর মতন, মানুষের জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকে আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষার অলৌকিক চোখ নিয়ে দুর্দান্ত অবাধ্য বালকের মতন সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে চারদিক, সে আরও কিছু চায়। জীবন যেখানে থেমে আছে, তা ছাড়াও আরও কিছু। কী সেটা? যশ, অর্থ, ভোগ বা ভালোবাসাও শেষ কথা নয়।
যৌবন পেরিয়ে গেলে কোনও এক বাদামি সন্ধ্যাবেলা মানুষের মনে হয়, এই জীবন অন্য রকম হবার কথা ছিল। কৈশোরের যে মহিমা-উজ্জ্বল জীবনের ছবি ভেসে উঠত চোখে, কোথায় গেল সেই মহিমা? মেঘলা আকাশের জ্যোৎস্নার মতন চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকে স্বপ্নের শব। মনে হয়, যদি আর একবার নতুন করে জীবনটাকে শুরু করা যেত– শৈশব থেকে আবার ফিরে আসা! রাষ্ট্রপতিকেও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। কোটিপতিও শ্বেতশুভ্র বাথটবের ঠান্ডা-গরম জলে শরীর ডুবিয়ে আরাম করতে করতে হঠাৎ ক্ষুর দিয়ে হাতের শিরা কেটে ফেলে। কেন না আমরা তো প্রায়ই ভুলে যাই, যে আমরা কুকুর অথবা পিঁপড়ে হয়ে জন্মাইনি! আমরা মানুষ, এই উত্তরাধিকারের দায়িত্ব কী বিরাট! একটি সিংহ আর একটি সিংহকে কখনও হত্যা করে না, পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করার সময় নখ গুটিয়ে রাখে। মানুষই শুধু তার ভাই, বন্ধু, পরিজন ও প্রতিবেশীকে খুন করার জন্য আবিষ্কার করেছে কত রকম অস্ত্র। জন্মসূত্রে যে সে একা, এই কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে সে বার বার গোষ্ঠীবদ্ধ হতে গিয়ে গোষ্ঠীকে ভাঙে।
কখনও কখনও যেন একটা বিশাল কঠিন, বন্ধ দরজার গায়ে দুম দুম করে আঘাত করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, বলো, বলল, কার নাম সার্থকতা! বলে দাও! ইতিহাসের কোনও কোনও শতাব্দীতে এক-আধ জন ধর্মগুরু সেই দরজা একটু ফাঁক করে বলতে চেয়েছেন, শোনো, আমি বলছি। এই পথ অনুসরণ করলে মনুষ্যজন্ম তার সম্পূর্ণতা পাবে। আমার কাছে এসো, আমি পথ দেখাচ্ছি…। কিন্তু সব কথা শোনা যায়নি, সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি, তার আগেই ধূপধুনোর ধোঁয়া আর চাটুকারিতার হট্টগোলে। সব ঢেকে গেছে। দু’এক শতাব্দীতেই কেটে যায় ঘোর। তারপরও হাজার হাজার অতৃপ্ত মানুষ ধাক্কা মেরে সেই দরজা ভেঙে ফেলতে চায়।
হয়তো এই সার্থকতার সন্ধানও সবার মধ্যে জাগে না সারা জীবনে। কেন না, এই পৃথিবীতে অনেক নেশা আছে। বাদুড়ের ডানায় একবার হাত দিলে সেই তেলতেলে কালো রং সহজে উঠতে চায় না, গন্ধও জড়িয়ে থাকে। অনেকের হাত একবার রুপোর টাকা ছুঁলে রুপোর দাগ লেগে যায়–তারপর সারা জীবন দু’হাতে রুপো ছানাছানি করতে ভালোবাসে। সেই রকমই, নারী। কেউ চায় অন্যের ওপর প্রভুত্ব করতে কিংবা অন্যদের নিজের মতে চালাতে। এই নেশাটাই সবচেয়ে তীব্র। একটা দেশ বা একটা শহর বা একটা দল বা একটা অফিস বা নিছক নিজের পাড়ার পাণ্ডা হবার জন্য কী আকুলিবিকুলি চেষ্টা। যে-পৃথিবীতে সে সত্তর বা আশি, বড়জোর একশো বছরের বেশি থাকবে না–সেই পৃথিবীকেও সে বদলাবার জন্য প্রাণপাত করে। এই শরীর বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু শেষ–এই কঠোর সত্যটা জেনেও কত মানুষ অতীন্দ্রিয় তত্ত্বের কথা ছড়িয়ে যায়।
অনেকেই অবশ্য মায়ার ঘোরে জগৎটা খুব ছোট করে আনে, নিজের স্ত্রী-পুত্রকন্যা আত্মীয়দের নিয়ে ছোট্ট সংসারের বাইরে আর কিছু দেখতে চায় না–এদের খুশি বা সুখী করার জন্য সারা জীবন ভূতের ব্যাগার দিয়ে যায়। একই মানুষ দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ করে ছেলেকে আদর করে সম্পূর্ণ স্নেহে, বাড়ি থেকে বেরোবার আগে ভক্তিভরে প্রণাম করে শ্রীরামকৃষ্ণের ছবির সামনে এবং অফিসে গিয়ে ঘুষ নেয়–এও তো নেশার ঘোর। এমন নেশাগ্রস্ত মানুষ অনেক দেখেছি।
যাই হোক, আমি আমার ছেলেবেলা থেকেই একজন মানুষকে জানি যিনি জীবন সম্পর্কে নানা ধরনের প্রশ্ন ও সংশয়ে কষ্ট পেতেন। তিনি আমার পিসেমশাই। তখন অবশ্য সব বুঝিনি। সেই লম্বা-চওড়া, সুপুরুষ, সদাহাস্যময় মানুষটি মাঝে মাঝে দারুণ বিষণ্ণ হয়ে যেতেন। তিন-চার দিন ধরে কারওর সঙ্গে কথা বলতেন না, তিনতলার ঘরে একা শুয়ে থাকতেন। বাড়ির কেউ বিরক্ত করতে সাহস করত না ওঁকে। শুধু আমার জ্যাঠামশাই খড়ম ঠকঠকিয়ে ওপরে উঠে জিজ্ঞেস করতেন, কী হে অমরনাথ, কী হল আবার তোমার? চলো, শিশিরবাবু আবার ষোড়শী বই নামিয়েছেন, দেখে আসি।
জ্যাঠামশাইকে দেখে পিসেমশাই উঠে বসতেন। ফ্যাকাশে ভাবে হেসে বলতেন, জানো পি আর, ইচ্ছে করে আবার সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে বেরিয়ে পড়ি!
জ্যাঠামশাই উত্তর দিতেন, এখন বয়স হয়েছে, এখন আর ওসব পাগলামি কোরো না। শরীরে সইবে না।
ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে আমরা এইসব কথা টুকরো টুকরো ভাবে শুনতাম। তখন পিসেমশাইয়ের বয়স ষাটের কাছাকাছি। আমার জ্যাঠামশাইও ওঁর থেকে পাঁচ-ছ’ বছরের ছোট।
আমার পিসেমশাইকে আমরা সবাই ডাকতাম বড়বাবু। আমার বাবা-কাকারাও তাই বলতেন। ছেলেবেলায় এ-ডাকটা আমরা স্বাভাবিক হিসেবেই গ্রহণ করেছিলাম, কারণ জানতাম না। পরে জেনেছি। পিসেমশাইয়ের আসল নাম অমরনাথ ভাদুড়ী, কিন্তু ওঁর চেহারার সঙ্গে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর খুব মিল ছিল। যদিও শিশির ভাদুড়ীর পরিবারের সঙ্গে পিসেমশাইদের কোনও রকম আত্মীয়তা ছিল না। তখন রঙ্গমঞ্চে শিশির ভাদুড়ীর দেশজোড়া নাম। তার ডাকনাম অনুসারেই পিসেমশাইকে বাড়ির সবাই বড়বাবু বলত। অবশ্য ওঁর আসল নাম অমরনাথেরও একটা ইতিহাস আছে।
আমার যখন ছ’-সাত বছর বয়স, তখন একদিন বিকেলবেলা পিসেমশাই আমাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন এক জায়গায়। সেদিন আমার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
আমরা কলকাতায় পিসেমশাইয়ের বাড়িতেই থাকতাম। পিসেমশাই সেই সময় গোয়ালিয়ার থেকে ব্যবসা গুটিয়ে কলকাতার বিবেকানন্দ রোডে একটা বাড়ি কিনেছেন। বিবেকানন্দ রোড তখন প্রায় নতুন রাস্তা, পাড়াটার ইজ্জত ছিল। তিনতলা বাড়ি, অনেকগুলি ঘর। তখন বসতবাড়ি ভাড়া দেবার বিশেষ রেওয়াজ ছিল না–আমরা গ্রাম থেকে এসে পিসেমশাইয়ের বাড়িতেই উঠতাম, বিসদৃশ কিছু দেখাত না তাতে। আমার জ্যাঠামশাই বয়সে ছোট হলেও তার ভগ্নীপতির সঙ্গে কথা বলতেন ভারিক্কি চালে। পারিবারিক সম্পর্কের মূল্য তখন ছিল সামাজিক প্রতিষ্ঠার চেয়েও একটু বেশি।
আমার পিসেমশাই বিধবা বিবাহ করেছিলেন। অর্থাৎ, আমার পূর্ণিমা পিসিমা বিধবা হয়েছিলেন এগারো বছর বয়সে। সতেরো বছর বয়সে অমরনাথ ভাদুড়ীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তখন আমার পিসিমা গর্ভবতী। এর এক বছর আগেই অমরনাথ ভাদুড়ী আমার ঠাকুরদার কাছে পূর্ণিমা পিসিমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব জানান। আমার ঠাকুরদা ওই অমরনাথ ভাদুড়ী নামক উদ্ধত ছোকরাকে রুপো বাঁধানো লাঠি দিয়ে মেরেছিলেন। কেন না বিদ্যাসাগর মশাইয়ের বিধবা বিবাহের তত্ত্বটি অনেকেই কাগজ-কলমে সমর্থন করলেও নিজ পরিবারে চালাতে দেননি। তারপর পূর্ণিমা পিসিমার ওই অবস্থাটা জানার পর আমার ঠাকুরদা দেওয়ালে কপাল ঠুকে ঠুকে রক্ত বার করে ফেলেছিলেন। হায় হায় করেছিলেন অন্তত এক হাজার বার। কারণ, তখনকার দিনে ভদ্রঘরের বিধবারা যাতে দুশ্চরিত্রা না হয়ে যায় সেজন্য নিরাপদ ব্যবস্থা ছিল তাদের কাশী পাঠিয়ে দিয়ে দশ-পনেরো টাকা করে মাসোহারা পাঠানো। তারপর সেখানে তারা বাঁচুক, মরুক বা চরিত্র নষ্ট করুক সে-খবর এত দূরে এসে পৌঁছোবে না। আমার ঠাকুরদা নেহাত কন্যার প্রতি মায়াবশত এ-ব্যবস্থা না নিয়ে ওই ভুলটি করেছিলেন।
পূর্ব বাংলার ছোট শহরে ওই ঘটনায় কী রকম হইহল্লা হয়েছিল তা বোঝাই যায়। তা ছাড়া অমরনাথ ভাদুড়ী ছিলেন অজ্ঞাতকুলশীল। তখনকার দিনে একটা চমৎকার ব্যবস্থা ছিল। জমিদার বাড়িতে বা অনেক অবস্থাপন্ন বাড়িতেই পাঁচ-দশটি দুঃস্থ ছেলেকে থাকতে খেতে দিয়ে পড়াশুনোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হত। আমাদের পাড়াতেই রায়চৌধুরী বাড়িতে ওই রকম দুটি ছেলে থাকত, অমরনাথ ভাদুড়ী তাদের মধ্যে একজন, তিনি তখন কলেজের ছাত্র। গ্রীষ্মের ছুটিতে বিরাট বিরাট শূন্য দুপুর, রায়চৌধুরীদের বাড়িতে কত ফঁকা জায়গা, কত বড় বাগান! পূর্ণিমা পিসিমা ওই বাগানে জামরুল কিংবা কামরাঙা ফল পাড়তে যেতেন।
যাই হোক, অমরনাথ ভাদুড়ীর সঙ্গে পূর্ণিমা পিসিমার নমো নমো করে বিয়ে দিয়ে রাতারাতি তাঁদের দেশছাড়া করে দেওয়া হল। কলকাতাতেও না, কারণ সেখানেও অনেক চেনাশুনা লোক আছে, ওঁরা গিয়ে ঘর বাঁধলেন পাটনায়। তারপর ওঁদের ভুলে গেল সবাই। পূর্ণিমা পিসিমা মাঝে মাঝে চিঠি লিখতেন, কেউ কোনও দিন তাকে বাপেরবাড়ি আনার কথা বলেনি। এমনকী, পূর্ণিমা পিসিমার দু’বছরের মেয়েটি যখন স্মল পক্সে মারা গেল, তখনও কেউ দেখতে যায়নি আমাদের বাড়ি থেকে।
আমার ঠাকুরদা মারা যাবার পর, আমার বাবা-জ্যাঠামশাইরা হঠাৎ যেন উদার হয়ে উঠলেন। ততদিন পিসেমশাইরা পাটনা থেকে এলাহাবাদে চলে গিয়ে ব্যবসা করে বেশ বড়লোক হয়েছেন। আমার বাবা দিল্লিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে ফেরার সময়। এলাহাবাদে পূর্ণিমা পিসিমাদের বাড়িতে থেকে এলেন। কয়েকদিন পর ফিরে এসে গল্পের আর শেষ হয় না। পিসেমশাইদের এলাহাবাদের বাড়িতে তিনজন ঝি-চাকর, একজন দারোয়ান, বাগানের জন্য একজন মালি–এবং সবচেয়ে বড় কথা, একজন। জমাদার রোজ সকালে এসে বাথরুম পরিষ্কার করে যায়। দোতলার বাথরুমে জমাদারের আসা-যাওয়ার জন্য বাড়ির পেছনে আলাদা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। পাড়াগাঁর মানুষের চোখে এসব অত্যাশ্চর্য ঘটনা।
তার পরের বছর পুজোর সময় পূর্ণিমা পিসিমারা বেড়াতে এলেন আমাদের দেশের বাড়িতে। গাঁঠরি বাঁধা বাঁধা সব ধুতি-শাড়ি কম্বল এনেছিলেন গাঁয়ের মানুষের মধ্যে বেলাবার জন্য। বাড়ির প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা উপহার। পূর্ণিমা পিসিমা আমার মাকে দিয়েছিলেন জারমান সিলভারে বাঁধানো বড় আয়না। পিসেমশাইয়ের সুন্দর চেহারা। অঙ্গে পুরোপুরি সাহেবি পোশাক–তবু তিনি তার ছেলেবেলার পরিচিত মানুষজনের বাড়িতে গিয়ে দাওয়ায় বসে হুঁকোয় তামাক খেতেন–এইজন্য তার খাতিরের সীমা ছিল না। একদিন এই জায়গা থেকে তিনি অপমানিত হয়ে বিতাড়িত হয়েছিলেন–আজ সেখানেই ফিরে এসেছেন প্রবল প্রতাপে। সব মানুষই বোধহয় এ রকম ভাবে ফিরে আসতে চায়। কাউন্ট অফ মন্টোক্রিস্টো গল্পের মতন। পূর্ণিমা পিসিমার বয়সি বিধবা কিংবা স্বামী না-নেওয়া অবজ্ঞাত বউ আমাদের সেই ছোট শহরে তখন অনেক ছিল।
এক বারও শ্বশুরবাড়িতে যায়নি কিংবা সারা জীবনে তিন-চার বারের বেশি স্বামীকে চোখে দেখেনি–ব্রাহ্মণ পরিবারের এমন মেয়েমানুষের সংখ্যা তখন অজস্র। তিন-চার বছরের মেয়েকে থালার ওপর বসিয়ে বৃদ্ধ জরাবের সঙ্গে সাতপাক ফেরানো কিংবা রক্তমাংসের স্বামীর অভাবে কলাগাছের সঙ্গে সোমখ মেয়েদের বিয়ে দেওয়াও বেশি দিনের ঘটনা নয়। সেই রকম কোনও বিয়ের অনুষ্ঠান আমি চোখে দেখিনি বটে, তবে সেই সব বৃদ্ধাদের আমি দেখেছি। কচি বয়সের বিধবাকে সেই সময় চলতি কথায় বলা। হত, কড়ে রাঢ়ী। তারা পূর্ণিমা পিসিমার সৌভাগ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলত। পূর্ণিমা পিসিমারও তো ওই রকম অবস্থাই হওয়ার কথা ছিল। এখনও সবাই গল্প করে যে পূর্ণিমা পিসিমার স্বভাব খুব নরম, কারওর সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলতেন না। কিন্তু প্রতিবেশিনী কড়ে রাঢ়ীরা পূর্ণিমা পিসিমা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ওই জাত-খোয়ানো মাগির দেমাকে যেন মাটিতে পা পড়ে না! অত সুখ কপালে সইলে হয়!
সত্যিই সহ্য হয়নি। সেবার এলাহাবাদে ফিরে যাবার পর কিছুদিন বাদেই পূর্ণিমা পিসিমার চিঠিতে অন্য সুর দেখা দিতে লাগল। প্রায়ই পিসেমশাই সম্পর্কে নানা রকম অভিযোগ। পিসেমশাইয়ের ব্যবসায়ে মন নেই, হঠাৎ হঠাৎ কোথায় চলে যান তিন চার দিনের জন্য, বাড়িতে কিছু বলা কওয়া নেই। সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে খুব মেশেন, মানুষটা বুঝি এবার সন্ন্যাসীই হয়ে যাবেন! এক বছর বাদে আবার অন্য রকম অভিযোগ, এবার আরও গুরুতর। পিসেমশাই একটি মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে পাগল হয়েছেন। জ্যাঠামশাই এলাহাবাদ ছুটে গেলেন তার বোনকে বাঁচাতে। ফিরে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, পূর্ণিমার কপালে দুঃখু আছে। অমরনাথকে ফেরানো যাবে না সে বড় আত্মম্ভরী মানুষ, অন্য কারওর কথা শোনে না। তা ছাড়া, সেই মুসলমান মেয়েটির মতন সুন্দর নারী এ-দুনিয়ায় দুর্লভ, তাকে দেখলে মাথা ঠিক রাখা অনেক পুরুষের পক্ষেই শক্ত। পাঁচখানা মোহর দিয়ে তার নাচ দেখতে হয় নিরালায়। অমরনাথ এবার সর্বস্বান্ত হবে।
আমার ঠাকুমা তখনও বেঁচে, তিনি ঝঝের সঙ্গে বলেছিলেন, পূর্ণিমাকে তুই নিয়ে চলে এলি না কেন? ও-জামাইয়ের সঙ্গে আমরা আর কোনও সম্পর্ক রাখতে চাই না। আগেই জানতাম
জ্যাঠামশাই বলেছিলেন, পূর্ণিমা আসতে চেয়েছিল। আমি ইচ্ছে করে আনিনি। পূর্ণিমা একবার চলে এলে বিষয়সম্পত্তির আর কিছুই কি ও পাবে? সব জলাঞ্জলি যাবে। তবু ও যেটুকু সামলে রাখতে পারে–
এরপর দু’-চার বছরের ইতিহাস একটু অস্পষ্ট। পিসেমশাই এলাহাবাদের বাড়ি বিক্রি করে চলে গেলেন গোয়ালিয়ার–পূর্ণিমা পিসিমাও সঙ্গে গিয়েছিলেন এবং নর্তকীটিও। পূর্ণিমা পিসিমার একটি মেয়ে হয়ে মারা গিয়েছিল, আর কোনও ছেলেপুলে হয়নি। সেই নর্তকীর একটি ছেলে হয়, তার নাম সূর্য। এই ছেলেটি তার তিন বছর বয়স থেকে পূর্ণিমা পিসিমার কাছেই বেশি থাকত। পূর্ণিমা পিসিমা তখন তার আইন বহির্ভূত সতীনের সঙ্গে মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছিলেন। সতীন থাকা তো তখনকার দিনে খুব অস্বাভাবিক ছিল না। আমার ঠাকুরদাই তিনটি বিয়ে করেছিলেন।
এলাহাবাদের সেই নর্তকীর নাম ছিল বুলবুল। পোশাকি নাম নাসিম-আরা বানু। এলাহাবাদ থেকে গোয়ালিয়ারে আসবার পর তার ভক্তসংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এই নিয়ে পিসেমশাইয়ের সঙ্গে মন কষাকষি দেখা দেয়। তার ছেলে সূর্যর বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন বুলবুল হঠাৎ আত্মহত্যা করেন বিষ খেয়ে। বুলবুল সেই সময় গোয়ালিয়ার রাজবাড়িতে মুজরো পেতে শুরু করেছিলেন–অনায়াসেই অমরনাথ ভাদুড়ীর মতন একজন মানুষকে পরিত্যাগ করতে পারতেন, তার বদলে আত্মহত্যা করার কোনও মানেই হয় না। সূর্য সেই থেকে পুরোপুরি পূর্ণিমা পিসিমারই ছেলে হয়ে গেল।
পূর্ণিমা পিসিমার শেষ জীবনটা মোটামুটি সুখেই কেটেছিল। স্বামীকে আবার সম্পূর্ণ ভাবে ফিরে পেয়েছিলেন এবং শেষ বার অসুখের সময় পেয়েছিলেন স্বামীর হাতের সেবা। বাবা আর মা গিয়েছিলেন সেবার, ফিরে এসে বললেন, পুরুষমানুষ যে ও ভাবে সেবা করতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। অমরনাথের মনটা ভীষণ নরম—
পূর্ণিমা পিসিমার মৃত্যুর পর সূর্যকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে পিসেমশাই দু’বছরের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কেউ আর তার কোনও পাত্তা পায়নি। ওঁর গোয়ালিয়ারের বিষয়সম্পত্তি এবং ব্যবসা অরক্ষিত অবস্থায় নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। তারপর হঠাৎ একদিন একমুখ চুলদাড়ি নিয়ে এসে উদয় হলেন। সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে কলকাতায় এই বাড়ি কিনলেন।
এসবই আমার জন্মের আগেকার কথা। পূর্ণিমা পিসিমাকে আমি চোখেও দেখিনি কখনও।
একেবারে বাল্যকালের স্মৃতি মাঝে মাঝে দু-এক ঝলক মনে পড়ে, কিন্তু তার সত্যতা যাচাই করা যায় না। যে-পুকুরপাড়ে তিন বছর বয়সে খেলা করেছি মনে হয়, আসলে সে। পুকুরটা ঠিক সেই রকম দেখতে নয়। একটা শিউলি গাছের তলায় ফুল কুড়োতে যেতাম, প্রত্যেকটি শিউলি ফুলই কি শিশির-মাখা থাকত? স্মৃতি কেন সেই ছবি দেখায়? দুর্গাপুজোর এক মাস আগে কালো রঙের নিখুঁত পাঁঠা কিনে রাখা হত বলিদানের জন্য। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা ঘাসপাতা খাইয়ে মোটা করত সেই পাঁঠাগুলোকে। পাঁঠাকে খাওয়াবার জন্য ধানখেত থেকে ধানের ডগা ছিঁড়তে গেছি, ধারালো ধানপাতায় আমার। আঙুল কেটে গেল, ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগল। শৈশবের শুধু এই দৃশ্যটাই বা আমার মনে গেঁথে আছে কেন? আঙুলে দাগ পর্যন্ত নেই।
এমন অনেক জায়গার স্মৃতির ছবি হুবহু দেখতে পাই, আসলে যে-সব জায়গায় আমি কখনও যাইনি। যেমন, মানুষের জন্মদিনটির কথা তো মনে রাখা অসম্ভব, তবু যেন মনে হয়, আমার মনে আছে। ভীষণ বৃষ্টির দিনে জন্মেছিলাম বলে আমার নাম রাখা হয় বাদল। নার্সিং হোমে জন্মাইনি, মামাবাড়িতে, পাড়াগাঁর আঁতুড়ঘরে। উঠোনের মধ্যে সাময়িক ভাবে বানানো। তিন দিন ধরে অশ্রান্ত বৃষ্টি–সেই সময় জন্মগ্রহণ করে আমি বাড়ির সবাইকে খুব বিপদে ফেলেছিলাম। একজন প্রৌঢ়া ধাইয়ের কৃতিত্বেই বেঁচে গেছি কোনওক্রমে। মা-মাসিদের কাছে পরে এতবার শুনেছি সেই গল্প যে, স্মৃতিতে যেন হুবহু দেখতে পাই সেই দৃশ্য–অঝোর বর্ষার মধ্যে একটি সদ্যোজাত শিশুর পায়ের পাতায় টোকা মারা হচ্ছে আর সে ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদছে।
পাঁচ কি ছ’বছর বয়স থেকে পিসেমশাইয়ের কথা আমার মোটামুটি স্পষ্ট মনে আছে। একদিন ওঁর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
যে-সময়কার কথা বলছি তখনও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ লাগেনি। তার দু-এক বছর আগের কথা। তখন চাল কিনতে হত মুদির দোকানে, অনেক রকমের চাল সাজানো থাকত, তিন টাকা মণের খুব সরু চালের অর্ডার দিলে মুদির দোকানের লোকই বাড়ি পৌঁছে দিত। সেলুনে চুল কাটতে গেলে চুলকাটার ডিজাইন পছন্দ করার জন্য বাঁধানো ছবি থাকত সাহেবদের। অনেক সাহেবও তখন সিঁথি কেটে পাশে চুল আঁচড়াত। শিয়ালদা ও হাওড়া স্টেশনের কাছে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত ঘোড়ারগাড়ি। যে চটের থলিকে এখন র্যাশন ব্যাগ বলে–সে-জিনিসের প্রচলন ছিল না। পরিবার পরিকল্পনা বা জন্ম নিয়ন্ত্রণের কথা কেউ শোনেনি। মিষ্টির দোকানে এক টাকার মিষ্টি কেনা হলে এক আনা পয়সা ফেরত দিত। এক পয়সা ও আধলার প্রচলন ছিল। ধুতির সঙ্গে শুমোজা পরা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। কলকাতায় অনেক রাস্তাতেই গ্যাসের আলো জ্বলত। গান্ধীজি, সুভাষ বোস, ফজলুল হকেরও প্রচুর নিন্দুক ছিল। গলিতে গলিতে ক্রিকেটের বদলে ড্যাংগুলি বা চু-কিতকিতের খেলা চলত। ইস্কুলে ভরতি হবার আগে যেতে হত পাঠশালায়। নাপিতকে বলা হত পরামানিক।
কলকাতায় তখন বাঙালরা ছিল প্রকৃতপক্ষেই সংখ্যালঘু। নাটক নভেলে হাস্যকর চরিত্র উপস্থাপিত করার জন্য অবধারিত ভাবে ব্যবহার করা হত বাঙাল ভাষা, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে যার শুরু। বাঙালরা কলকাতায় এসে অতি দ্রুত কলকাত্তাই ভাষা শিখে নেবার চেষ্টা করে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলত। বাঙালদের মুখে অতি মিহি গলায় কলকাতার ভাষা বলতে শুনলেই হাসি পেত।
বাঙালদের সম্পর্কে তখন চিত্তাকর্ষক কয়েকটি ছড়াও প্রচলিত ছিল, সেগুলির রচয়িতার নাম জানা যায় না। পথে-ঘাটে প্রায়ই ছোটদের মুখে শোনা যেত :
বাঙাল মনুষ্য নয়
অদ্ভুত জন্তু
লম্ফ দিয়ে
গাছে ওঠে
ল্যাজ নাই কিন্তু!
আসলে ‘অদ্ভুত’ কথাটার বদলে অন্য কিছু ছিল, সেটা এক ঢিলে দু’পাখি মারার ব্যাপার। সে-শব্দটা এখন ব্যবহার না করাই ভালো। ছড়াটির মধ্যে কিন্তু বেশ কল্পনাশক্তির পরিচয় আছে। আরও শোনা যেত :
বাঙাল
চিংড়িমাছের কাঙাল!
এটার ঠিক মানে বোঝা যায় না। কেন না বাঙালদের সঙ্গে ইলিশ মাছই বেশি জড়িত। চিংড়িমাছও বাংলাদেশে কম পাওয়া যায় না। সুতরাং তারা বেছে বেছে চিংড়িমাছের কাঙাল হবে কেন কে জানে।
বাঙালদের বোধহয় ছড়া বানাবার ক্ষমতা কম কিংবা সংখ্যালঘু বলে ভয় পেত। কারণ বাঙালরা কোনও ছড়া বানিয়ে কলকাতার লোকদের যোগ্য উত্তর দিতে পারেনি। কলকাতার লোকদের কোনও দুর্বোধ্য কারণে তারা ঘটি আখ্যা দিয়েছিল, এবং বড়জোর কখনও চেঁচিয়ে বলত, ঘটি, ফুটো ঘটি!
বাঙালদের সম্পর্কে আর একটি ছড়া নিশ্চয়ই কোনও ঘটনা উপলক্ষে রচিত। কিন্তু এটিও বেশ জনপ্রিয় ছিল :
বাঙালো
রস খাইলো
ভাড় ভাঙিলো
পয়সা দি—লো–না!
শেষের দিলো না’টা খুব টেনে টেনে বলেই ছুটে ছুটে যাওয়া নিয়ম ছিল। কারণ, এটাতেই বেশি রেগে যেত বাঙালরা। বাঙালরা সাধারণত গোঁয়ার এবং তাদের হাতের টিপ অব্যর্থ, তারা ইট ছুঁড়ে মারতে যায়।
সব পাড়ার মধ্যেই একটি বাড়ি ‘বাঙালদের বাড়ি’ বলে পরিচিত হত তখন সে বাড়ির ছেলে বাঙালদের ছেলে, সে বাড়ির বউ বাঙালবাড়ির বউ। বাঙাল ও ঘটিদের মধ্যে পারস্পরিক বিয়ে প্রায় নিষিদ্ধই ছিল বলা যায়। কলকাতায় আমি এই রকমই একটা বাঙাল বাড়িতে থাকতাম।
একদিন বিকেলবেলা পিসেমশাই আমাকে বললেন, বাদলা, তোর মা-কে গিয়ে বল, তোকে ভালো জামা-প্যান্ট পরিয়ে দিতে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, বড়বাবু, আমি কোথায় যাব?
পিসেমশাই বললেন, চল, তোকে এক জায়গা থেকে বেড়িয়ে নিয়ে আসি।
তাই শুনে বাড়ির অন্যান্য বাচ্চারা আমিও যাব, আমিও যাব বলে চাঁচামেচি শুরু করে দিল। বড়বাবু বললেন, না, আর কেউ না! শুধু ও একলা যাবে।
বড়বাবু সাধারণত বাড়ির ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়াতে যেতেন না। আমাদের বাড়িতে বাচ্চাও তখন ছ’সাত জন। বড়বাবু হঠাৎ সেদিন আমাকে কেন বেছে নিয়েছিলেন জানি না। ভাগ্যিস নিয়েছিলেন।
অপূর্ব ভাষা! নমস্য সুনীল।