আজকের দিনটি বড় মনোরম। শুভ্র রোদ্দুরে একটুও জ্বালা নেই, স্নিগ্ধ বাতাস বইছে মৃদু মন্দ, পটভূমিকার পাহাড়শ্রেণী স্পষ্ট দৃশ্যমান। গত কয়েকদিন ছিল একটানা বৃষ্টি, কাল সন্ধ্যায় যেন সমস্ত মেঘ নিঃশেষ হয়েছে, তাই আকাশ স্বোদহীন নীলাভ। অরণ্যের প্রতিটি বৃক্ষ ও লতাপাতাই স্নানসিক্ত, ফুটে উঠেছে যার যার নিজস্ব বর্ণ, প্রকৃতির মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছে আনন্দের কলস্বর। আজ এক সার্থক উৎসবের দিন।
পাহাড় থেকে নেমে অরণ্য ভেদ করে দলে দলে মানুষ চলেছে রাজধানীর দিকে। যেন অনেক নদীর ধারা কিন্তু একটির সঙ্গে আর একটি মিশে যাচ্ছে না। কোনও দলেই শিশু কিংবা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা প্রায় নেই, চলেছে সমর্থ শরীরের নারী ও পুরুষেরা, পায়ে হেঁটে যেতে হবে অনেক দূর। বিশেষ পোশাক পরে এসেছে সকলেই, এমনকি যারা অন্য দিন তেমন পোশাকের ধার ধারে না তারাও কিছু-না-কিছু পরিধান করেছে। নারী ও পুরুষদের আবরণের প্রভেদ বিশেষ নেই, কটিবস্ত্ৰ মাত্র সম্বল, নারীদের রয়েছে নানারকম আভরণ, কেশদাম কুসুম সজ্জিত, গলায় গুঞ্জাফুলের মালা, নানারকম হাড়ের টুকরো ও কুঁচ ফলের হার, বিশেষ বিশেষ পুরুষদের মাথায় পালকের মুকুট।
যেন পাহাড় থেকে ঢল নেমেছে। অরণ্য থেকে বেরিয়ে আরণ্যকরা। অমরপুর, বিলোনিয়ার দিক থেকে আসছে রিয়াংদের দল। প্রায় দুশো জনের এই দলটি বেশ সুশৃঙ্খল, প্রায় সকলেই চলেছে পায়ে হেঁটে, মাঝখানে রয়েছেন এক অশ্বারোহী। অনুচ্চ এক টাট্টু ঘোড়া, তাতে উপবিষ্ট প্রৌঢ় মানুষটিও ছোটোখাটো, বোঝা যায় ইনিই দলপতি, ইনি রিয়াংদের রাই। রাইকে বিশেষ সম্মান জানাবার জন্য একজন এঁর মাথায় ছাতা ধরে আছে, সামনে পেছনে চলেছে দু’জন বাদ্যকর, একজন বাজাচ্ছে ঢোল, অন্য জন বাঁশি। অন্যদের ঊর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন হলেও রাই-এর কাঁধে রয়েছে একটি চাদর। এর চক্ষু দুটি ঢুলু ঢুলু, গত রাত্রির মাদকতা এখনও কাটেনি, তবু মাঝে মাঝে সচেতন হয়ে পেছন ফিরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছেন দলটিকে। শুধু তীক্ষ্ণতা নয়, রাই-এর দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে ক্রূরতা, কারুর সামান্য অবাধ্যতাও ইনি সহ্য করতে পারেন না। রাই-এর পরেই পদমর্যাদায় যার স্থান তাঁর নাম রাইকাচক, বয়েসে প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় পৌঁছালেও তাঁর বেশ বলিষ্ঠ শরীরের গড়ন, কালো পাথরের মতন বুক, হাতে একটি বর্শা। রাইকাচক পায়ে হেঁটে আসছেন, তবে কোথাও একটু থামলেই তাঁর দুটি অনুচর সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর দু’পায়ের গুলফ মার্জনা করে দিচ্ছে মিছিলের একেবারে শেষ দিকে অল্প বয়সীরা লাফিয়ে লাফিয়ে গাইছে একটা কৌতুকের গান, যুবতীরা গলা মেলাচ্ছে তাদের সঙ্গে, হঠাৎ হঠাৎ হাসিতে নুয়ে যাচ্ছে তাদের শরীর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পদযাত্রাতেও তাদের চোখে মুখে কোনও ক্লান্তির চিহ্ন নেই।
কৈলাশহর, সাবারুম, উদয়পুরের দিক থেকে আসছে বিভিন্ন চাকমাদের দল। এদের দলে কলকোলাহাল কম, এরা নীরবে পথ চলা পছন্দ করে। তবে কোথাও ফুলের ঝাড় দেখলেই এদের মেয়েরা ছুটে যায়, আবার হাঁটতে হাঁটতেই তারা ফুলের মালা গাঁথে। এরা বৌদ্ধ।
ধর্মনগর, কমলপুরের দিক থেকে আসছে লুসাই আর কুকি সম্প্রদায়। লুসাই আর কুকিদের মধ্যে সম্প্রদায়গত তেমন তফাত নেই। কিন্তু আচার-ব্যবহারে লুসাইরা খানিকটা স্বতন্ত্র হয়ে গেছে। লুসাইদের মধ্যে কিছু লোক খ্রিস্টান হয়েছে সম্প্রতি, কেউ কেউ লেখাপড়া শিখছে। কোপন স্বভাব ও নির্মম লুসাইরা খ্রিস্টানধর্মের প্রেমের বাণী গ্ৰহণ করে এখনও বৈপরীত্যের বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। লুসাই অর্থাৎ লু-চাই অর্থাৎ নৃমুণ্ডশিকারী। এই তো কিছুকাল আগেও মৃত দলপতির পারলৌকিক কাজের জন্য তারা মহা উৎসাহে বাঙালি ও মনিপুরীদের মুণ্ডু কেটে আনত। এখন পাদ্রিরা তাদের দেখাচ্ছেন, প্রতিবেশীদের ভালোবাসো। অন্য কুকিদের সঙ্গে এদের ব্যবধান বোঝা যায় পরিধেয় বস্ত্রে। কুকিরা ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢাকার ধার ধারে না, লুসাই রমণীরা নিজের হাতে বোনা এক খণ্ড বস্ত্রে বক্ষ বেঁধে রেখেছে। সেই বস্ত্রখণ্ড বন মোরগের কুটির মতন তীব্র লাল। দু-একটি ছোকরা আবার পাদ্রিদের দেওয়া পাতলুনও পরেছে।
আসছে জামাতিয়া, হালাম, নোয়াতিয়া, মগ, মুণ্ডা, ভিল, গারো, খাসিয়া, ওরাং এবং আরও অনেক উপজাতির মানুষ। পাহাড়-জঙ্গলের নিজস্ব ডেরা ছেড়ে বেরিয়ে এসে তারা সকলেই চলেছে এক দিকে। এদের মধ্যে হালাম ও জামাতিয়াদের দলে নারীর সংখ্যা কম, পুরুষরা সবাই সশস্ত্র, গান গাওয়ার বদলে এরা মাঝে মাঝে দেয় রণহুংকার। তবে অন্য সম্প্রদায়ের পাশাপাশি চলে এসেও আজ কেউ বিবাদ করবে না। আজ উৎসবের দিন।
এবং আসছে ত্রিপুরিরা, সব দিক থেকে। এদের সংখ্যাই বেশি। ত্রিপুরিদের অনেকেরই ঘোড়া আছে, নারীদের শরীর দু-টুকরো কাপড়ে, এরাও গান ভালোবাসে। ত্রিপুরিদের দলে রয়েছে কয়েকটা হাতি, মাহুত ছাড়া সেই হাতিগুলির পিঠে কেউ আরোহণ করেনি। এইসব হাতি রাজার জন্য উপহার। অন্য উপজাতীয়রাও কিছু কিছু উপহার নিয়ে চলেছে, কোনও দলে রয়েছে উৎকৃষ্ট তুলো ভর্তি পুঁটুলি, ঝোরা ভর্তি জমপুই পাহাড়ের কমলালেবু, গুচ্ছ গুচ্ছ আনারস, সদ্য আহরিত জুম চাষের ফসল, একটি-দুটি হরিণশিশু। আজ বিজয়া দশমী, আজ রাজবাড়িতে মহাভোজ।
বিভিন্ন এলাকা থেকে এইসব মানুষ চলেছে। রাজধানীর দিকে, কোনও কোনও দল যাত্রা শুরু করেছে দুদিন-তিনদিন আগে, বিজয়া দশমীর সন্ধের মধ্যে পৌঁছে যাবে। রাজার নিমন্ত্রণ, আজ সবাই রাজবাড়ির অতিথি।
ত্রিপুরার রাজ-প্ৰাসাদের অলিন্দে পারিষদ পরিবৃত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন চন্দ্ৰ বংশীয় মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য। ইংরেজশাসিত ভারতের মধ্যেও তিনি এক স্বাধীন নরপতি। কিংবদন্তী অনুসারে তিনি মহাভারতের যযাতির বংশধর। ভোগ বাসনায় অতৃপ্ত মহারাজ যযাতি তাঁর পুত্রদের কাছ থেকে যৌবন ধার চেয়েছিলেন। যে-কজন পুত্র তাঁদের পিতার এই উৎকট খেয়াল চরিতার্থ করতে অস্বীকার করে, তাঁদের নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন ক্রুদ্ধ যযাতি। সেই নির্বাসিত পুত্রদের একজন ছিলেন দ্রুহ্য, তিনি আর্যাবর্ত ত্যাগ করে বহু দূর চলে এসে উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমানায় কিরাত রাজ্যের স্থানীয় রাজাকে পরাজিত করে স্থাপন করেন নতুন রাজ্য ত্রিপুরা। সেই কাহিনী অনুসারে অবিচ্ছিন্ন চন্দ্ৰ বংশীয় শাসনের একশো পঁচাত্তরতম উত্তরাধিকারী এই মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য।
হয়তো এ সবই গল্পকথা। উত্তর ভারতীয় আর্যাদের সঙ্গে বর্তমান কয়েক পুরুষের রাজাদের আকৃতির মিল নেই। বরং স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে সাদৃশ্য স্পষ্ট। ইদানীং এই বংশের রাজারা মণিপুর থেকে রূপসী রমণীদের রাজপরিবারের বধূ করে আনছেন, সেই সংমিশ্রণে পরবর্তী বংশধরদের অবয়বে মঙ্গোলীয় ছাপা পড়েছে।
মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য মাঝারি উচ্চতার একজন বলিষ্ঠকায় পুরুষ। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মুখমণ্ডলে প্রথমেই চোখে পড়ে নাকের নীচের অতি পুরুষ্টু গোঁফ। এই গোঁফের বৈশিষ্ট্য এই যে, ওষ্ঠের দুদিকে দৃঢ়ভাবে ফুলে থাকলেও নাকের ঠিক নীচের অংশটি মুণ্ডিত। মহারাজ বয়েসের বিচারে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছালেও তাঁর অঙ্গ সঞ্চালন যুবকোচিত। কিছুক্ষণ আগেই তিনি দীর্ঘপথ অশ্বচালনা করে রাজধানীতে ফিরেছেন। বংশের প্রথা অনুযায়ী তিনি নবমীর রাত্রিতে উদয়পুরে ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিলেন। মহাভোজের সময় উপস্থিত থাকতেই হবে বলে তিনি ব্যস্তসমস্ত হয়ে ফিরেছেন।
এখন অপরাহ্ণ কিন্তু সূর্যদেব পশ্চিম গগনে পুরোপুরি ঢলে যাননি। বিকেলের পরিপূর্ণ আলোয় চতুর্দিক উজ্জ্বল। রাজপ্রাসাদের সামনে বিসর্জনের বাজনা শুরু হয়ে গেছে। দুর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রায় অবশ্য মহারাজ স্বয়ং যাবেন না, মঙ্গলঘট বহন করে নিয়ে যাবেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র, ভবিষ্যৎ যুবরাজ রাধাকিশোর।
এ রাজ্যের প্রজারা সবাই আদিবাসী, বহু উপজাতিতে বিভক্ত, তাদের ভাষাও বিভিন্ন। দূরত্ব ও দুর্গমতার কারণে আর্য সভ্যতা এখানে তেমন আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম, ইসলাম, খ্রিস্ট ধর্মও উপজাতিগুলির মধ্যে প্রভাব ছড়িয়েছে বটে, অনেকে দীক্ষিতও হয়েছে, তবু এরা এদের নিজস্ব ভাষা ও আচার-আচরণ পরিত্যাগ করেনি। রাজবংশ অবশ্য নিজেদের আর্য হিন্দুত্বের উত্তরাধিকার প্রমাণ করার জন্য সদা ব্যস্ত। রাজা বীরচন্দ্ৰ মাণিক্যের প্রিয় ভাষা বাংলা, অনেক দিন ধরেই এ রাজ্যের সরকারি ভাষাও বাংলা। হালে কিছু কিছু রাজকর্মচারী দু’পাতা ইংরেজি শিখে দরবারের কাজে ইংরেজি প্রচলনের চেষ্টা করেছিল, মহারাজ ধমক দিয়ে তাদের নিবৃত্ত করেছেন। সিপাহি বিদ্রোহের পর ইংল্যান্ডে মহারানীর শাসন প্রবর্তিত হয়েছে প্রায় সম্পূর্ণ ভারতে, কিন্তু ত্রিপুরা রাজ্য যেমন কখনও মোগল শাসনাধীনে যায়নি, তেমনি পুরোপুরি ব্রিটিশ রাজত্বেরও অঙ্গীভূত হয়নি। মহারাজ ইংরেজের সংস্পর্শ থেকে যতদূর সম্ভব মুক্ত থাকতে চান।
অবশ্য একটি বিলিতি দ্রব্যের প্রতি মহারাজের খুব আসক্তি। ক্যামেরা! তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে কেউ এই বস্তুটির নামও শোনেনি, ছবি তোলার ব্যাপারটা এখনও অবিশ্বাস্য মনে হয়। শৌখিন মহারাজ ইংল্যান্ড ও ফরাসি দেশ থেকে বহু মূল্য ক্যামেরা আনিয়েছেন, অন্ধকার কক্ষে ছবি পরিস্ফুটনের কাজে নিজের হাতে করতেও শিখেছেন।
রাজপুত্র ও মহারানীদের ছবি তুলে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি, কিন্তু প্রজাদের ছবি তোলার অনেক ঝঞাট আছে। কয়েক বছর আগে মহারাজ শিকার করতে গিয়েছিলেন সোনামুড়ায়, সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্যামেরার লটবহর। সেখানে একটি কুকি যুবককে দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, মনুষ্য জাতির মধ্যেই এমন শরীরের গড়ন বিরল। যেন এক ভ্রমরকৃষ্ণবর্ণ দেবতা। তার আকৃতিই শুধু নিখুঁত নয়, বিস্ময়কর তার মুখের সারল্য। মহারাজের সামনেও তার দৃষ্টিতে কোনও শঙ্কা, কুণ্ঠা বা দীনতা নেই, যেন এই পৃথিবীটাকেই সে সদ্য দেখছে। মহারাজের ইচ্ছা হয়েছিল এই ছেলেটির ছবি তুলে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেখাবেন।
ছবি তুলতে সময় লাগে। তিন পায়া স্ট্যান্ডের ওপর বসাতে হয় মস্ত বড় প্লেট ক্যামেরা, ভিউ ফাইন্ডারে যাতে আলো না পড়ে সেই জন্য একটি বড় কালো রঙের সিন্ধের চাদরের তলায় ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যান ঢাকা পড়ে যায়। তারপর লেন্সের ফোকাস করতে হয় ঠিকমতন। কুকি যুবকটিকে দাঁড় করানো হল একটি কাঁঠাল গাছের তলায়, পেছন দিকে লালসাই পাহাড়। মহারাজ কালো চাদরের তলায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন, তাঁর সঙ্গী মহিম ঠাকুর, হায়দার খাঁ, নিসার হোসেন ও আরও কয়েকজন যুবকটিকে বলতে লাগলেন, এই একটুও নড়বি না। নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাক, চোখের পলক ফেলবি না, তোর ছবি সাহেবরা দেখবে!
মহারাজ ফোকাস ঠিক করতে পারছেন না, মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে, পারিষদরা অনবরত সাবধানবাণী উচ্চারণ করে যাচ্ছেন ছেলেটিকে, সে কী বুঝল কে জানে, হঠাৎ চোখ উল্টে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। অমন একটা জোয়ান ছেলে, সদ্য বলি দেওয়া ছাগের মতন দাপাতে লাগল হাত-পা ছড়িয়ে, গ্যাঁজলা বেরুতে থাকল তার মুখ থেকে। একটু দূরে ভিড় করে দাড়িয়ে ছিল অনেকে, তারা এবার আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল তক্ষুনি। রটে গেল যে মহারাজ একটা অদ্ভুত কালো বাক্সে ওই কুকি যুবকের আত্মা বন্দী করে ফেলেছেন!
এই রটনা অনেকটা বিশ্বাসযোগ্যতাও পেয়ে গেল একটা বিশেষ কারণে। অন্যান্য উপজাতীয়দের তুলনায় কুকিদের তেজ বেশি, তারা রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে কয়েকবার। ওই যুবকটি আবার লাল চোকলার কনিষ্ঠ পুত্র। সেই লাল চোকলা, কুকিদের দুর্ধর্ষ দলপতি, অনেক বছর আগে যিনি মণিপুরিদের গ্রাম কোচাবাড়ি আক্রমণ করেছিলেন। তাঁর পিতা লারু’র সমাধিতে কয়েকটি টাটকা নরমুণ্ড নিবেদন করার জন্যই ছিল লাল চোকলার এই অভিযান। গভীর অরণ্যে এরকম কোনও ঘটনা ঘটলে তার তরঙ্গ রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত পৌঁছয় না, কিন্তু মণিপুরিদের ওপর এই আক্রমণে রাজপরিবারেও দারুণ বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। মনিপুরের কন্যারা এই বংশের রানী হয়ে আসে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের প্রতি সকলেরই পক্ষপাতিত্ব থাকে, তাই বেশ কিছু মণিপুরি ত্রিপুরায় এসে বসতি স্থাপন করেছে এবং রাজদরবারে উচ্চপদ পেয়েছে। দলপতি লাল চোকলাকে শায়েস্তা করার জন্য মণিপুরিরা ক্ষেপে উঠল, শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সৈন্যদের সাহায্য নিয়ে বন্দী করা হল লাল চোকলাকে, তাঁর দণ্ড হল যাবজ্জীবন নির্বাসন।
মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য ওই কুকি যুবকটির পরিচয় জানতেন না। লাল চোকলা রাজপরিবারের শত্ৰু, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্ৰ বীরুর আত্মা মহারাজ একটা কালো বাক্সের মধ্যে টেনে নিয়েছেন, এই প্রচার ছড়িয়ে গেল আগুনের মতন। আর একটি কুকি-বিদ্রোহের উপক্রম। মহারাজ হতভম্ব হয়ে গেলেন, অনেক চেষ্টা করেও তাঁর আসল উদ্দেশ্য বোঝাতে পারলেন না। সোনামুড়ায় চিকিৎসারও কোনও ব্যবস্থা নেই। রোগ-ব্যাধি হলে এখানকার মানুষ দুধ-পুষ্করিণীর জল খায়। খুব কাছেই মাত্র পাঁচ-ছ’ মাইল দূরে কুমিল্লা শহর। মহারাজ জানতেন যে সেখানে একজন ধন্বন্তরির মতন কবিরাজ আছেন। নিজের হাতির হাওদায় বীরু চোকলাকে তুলে নিয়ে তিনি দ্রুত চলে গেলেন কুমিল্লা। সৌভাগ্যের বিষয় একদিনের মধ্যেই ছেলেটি সুস্থ হয়ে উঠল।
এরপর থেকে মহারাজ তার প্রজাদের ছবি তোলার আর কোনও চেষ্টাই করেননি।
ছবি কাকে বলে তা এখানকার মানুষ জানবে কী করে, অনেকে যে নিজের মুখখানাই স্পষ্ট করে কখনও দেখেনি। এই পৃথিবীতে মানুষ হয়ে জন্মাল, একটা গোটন জীবন কাটিয়ে আবার মাটিতে মিশে গেল, নিজের মুখখানা ঠিকমতন চিনলই না। প্রতিদিনের আহার্য যেখানে অনিশ্চিত, শরীর ঢাকার জন্য এক টুকরো বস্ত্ৰ মাত্র সম্বল, সেইসব অরণ্য-কুটিরে দর্পণের বিলাসিতার প্রশ্নই নেই। মেয়েরা মুখ দেখে স্থির জলে। জলাশয়ের জল তেমন পরিচ্ছন্ন হয় না, নদীর জল চঞ্চল, তাই মাটির পাত্রে জল ধরে রাখা হয়, দু-তিন দিন থিতিয়ে ওপরের জল পরিষ্কার হলে দুপুরের রোদে মেয়েরা সেই জলের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। নারী জাতি রূপ-সচেতন। পুরুষদের মধ্যে এরকম রীতি নেই। কিছু কিছু ব্যবহার মেয়েদের মানায়, পুরুষদের পক্ষে তা অনুকরণ করতে যাওয়া মানহানিকর। কোনও কৌতূহলী কিশোর কখনও বাড়িতে এরকম মাটির পাত্রে ধরা জলের সামনে মুখ নিয়ে এলে তার পিতা তাকে প্রচণ্ড শাসন করেন। মাটিতে তার মুখ ঘষে দেন। সেইসব কিশোর-যুবকেরা কখনও কোনও ঝর্ণায় কিংবা দিঘিতে উবু হয়ে চুমুক দিয়ে জল খেতে গিয়ে দেখতে পায় একটি মুখের ছায়া। সবিস্ময়ে ভাবে, এই কি আমি?
প্ৰজারা জানতে পারবে না, মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য প্রাসাদের অলিন্দ থেকে আজ ছবি তুলবেন। আজ তাঁর রাজ্যের সমস্ত অঞ্চল থেকে সমস্ত উপজাতীয় প্রজারা আসবে, আজই সুবর্ণ সুযোগ। ব্যাভেরিয়া থেকে সদ্য নতুন একটি ক্যামেরা আনিয়েছেন, তাতে নাকি দূর থেকে স্পষ্ট ছবি তোলা যায়, আজ সেই ক্যামেরারও পরীক্ষা হবে।
কয়েকটি দল এসে গেছে এরই মধ্যে। সামনের বিশাল চত্বরে প্রত্যেকটি উপজাতীয়দের জন্য নির্দিষ্ট করা আছে স্থান। এক একটি মিছিল এসে অলিন্দের নীচে দাঁড়িয়ে মহারাজের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে চলে যাচ্ছে নিজেদের জায়গায়। এ সময় স্বয়ং মহারাজের দর্শন দেবার প্রথা নেই, প্রজারা আনুগত্য জানাচ্ছে রাজপ্রাসাদকে। সূর্যাস্তের পর যখন দশমীর চাঁদ উঠবে, তখন চন্দ্ৰবংশীয় এই রাজা গিয়ে দাঁড়াবেন সব প্রজাদের মাঝখানে একটি অনুচ্চ বেদীতে, বিভিন্ন দলপতি এসে উপহার দ্রব্য এনে রাখবে তাঁর সামনে। আজকের দিনে নজরানা দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। রাজকোষ থেকেই এত বিশাল ভোজের ব্যবস্থা, কিন্তু এই সরল আদিবাসীরা যতই দরিদ্র হাকে, রাজদর্শনে আসার সময় কিছু-না-কিছু ভেট আনবেই। এই পর্ব শেষ হবার পর মহারাজ প্রজাদের সঙ্গে অন্ন গ্ৰহণ করবেন মাটিতে এক পঙক্তিতে বসে।
এই প্রথা চলে আসছে অনেক দিন ধরে। বিজয়া দশমীর দিনে হাসাম ভোজন। কেউ কেউ একটু শুদ্ধ করে বলে অসম ভোজন। এতগুলি উপজাতির মধ্যে রয়েছে অনেক রকম ভেদাভেদ। প্রায় সকলেই অতি দরিদ্র ও অর্ধ নগ্ন, তবু এর মধ্যে কেউ কেউ অন্যদের তুলনায় নিজেদের মনে করে উঁচু জাত। এক উপজাতির সঙ্গে অন্য উপজাতির বিবাহ সম্পর্ক হয় না। মাত্র কিছুদিন আগেই চাকমাদের এক তরুণী একটি হালাম তরুণকে পছন্দ করে তার গলায় মালা দিয়েছিল বলে চাকমারা ক্রুদ্ধ হয়ে দল বেঁধে তাড়া করে দু’জনকেই ধরে ফেলে এবং হত্যা করে তদ্দণ্ডেই। হালাম সম্প্রদায় অনেকের চোখে ঘৃণ্য, কারণ তারা দাসশ্রেণীর, তাদের স্বাধীন জীবিকা নেই। আবার হালামরা গর্ব করে বলে বিজয়া দশমীর এই হাসাম ভোজ আসলে হালাম ভোজ। এক সময় ত্রিপুরারাজের সৈন্যবাহিনীতে হালামরাই ছিল প্রধান, তারা দাস নয়, তারা যোদ্ধা হিসেবে মহারাজার সেবা করত, সেই জন্যই আগের কালের মহারাজারা বছরে একদিন সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে একাসনে ভোজন করতেন। সে যাই হোক, আগেকার দিনে যে-নিয়মই থাকুক, মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য এই একটি দিন সকল উপজাতীয়দের এক জায়গায় মেলাতে চান এবং সকলের মাঝখানে আহার করতে বসে বুঝিয়ে দিতে চান যে তার চক্ষে প্রজাদের মধ্যে কোনও জাতিবৈষম্য নেই।
সামনের চত্বরের এক পাশে হোগলার ছাউনি দিয়ে বাঁধা হয়েছে আটচালা। সেখানে দশটি উনুনে প্ৰকাণ্ড প্ৰকাণ্ড হাঁড়িতে রান্না চড়েছে। খিচুড়ি আর পায়সান্ন, এই দুটি মাত্র পদ, সবাই পেট চুক্তি খাবে, সকলের খাওয়া শেষ হতে হতে রাত ভোর হয়ে যাবে। একেক জন সন্ধেবেলা খেতে বসে ভোর হবার আগে ওঠেই না। রাজার আদেশ আছে। যে যতবার যতখানি চাইবে তাকে তত দিতেই হবে। কেউ কেউ যেন সারা বছরের ক্ষুধা এই একদিনে মিটিয়ে নিতে চায়। সকালবেলা দেখা যায় উচ্ছিষ্ট পাতের সামনেই অনেকে ঘুমে ঢলে পড়ে আছে।
কালো চাদরে শরীর ঢেকে ছবি তুলছেন মহারাজ। কাছাকাছি যে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন, তাদের একজনের নাম শশিভূষণ সিংহ। ত্রিপুরার রাজকার্যে এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিকতা প্রবর্তনের জন্য মহারাজ কলকাতা থেকে কয়েকজন বিশিষ্ট শিক্ষিত ব্যক্তিদের আনিয়েছেন, তাদের মধ্যে শশিভূষণ সবচেয়ে উচ্চ শিক্ষিত। ইনি বি এ পাস ও ব্ৰাহ্ম, কিছুদিন দেবেন ঠাকুরের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইনি রাজকুমারদের গৃহশিক্ষক। শশিভূষণ মাঝে মাঝে মহারাজের সামনেও এমন কথা উচ্চারণ করেন যা শুনে অন্যদের প্লীহা পর্যন্ত চমকিত হয়, কিন্তু এঁর সম্পর্কে মহারাজের একটা প্রশ্ৰয়ের ভাব আছে।
শশিভূষণ গৌরবর্ণ, সুপুরুষ, তীক্ষ্ণ নাশা। পোশাকের ব্যাপারে অত্যন্ত শৌখিন, চুনটি করা ধুতি ও বেনিয়ান সব সময় শুভ্রবর্ণ, মাথায় বাবরি চুল, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। হাতে একটা দূরবীন নিয়ে শশিভূষণ চত্বরের জনসমাগম দেখতে দেখতে পাশের এক ব্যক্তির কাঁধে হাত রাখলেন। এর নাম যদুনাথ ভট্টাচাৰ্য, বিষ্ণুপুর ঘরানার একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ, মহারাজের দরবারের নবরত্ন সভার অন্যতম। শশিভূষণ এঁকে বললেন, ভট্ট মশাই, অনেকদিন তো এ দেশে রইলেন, ট্রাইবগুলিকে পৃথক পৃথক ভাবে চিনতে পারেন? বলুন দেখি, নোয়াতিয়া আর ওরাংদের মধ্যে পার্থক্য কী?
যদুনাথ নিরীহ ধরনের মানুষ, গানবাজনা ছাড়া অন্য কিছু বিশেষ বোঝেন না। তিনি বললেন, আমার চোখে তো সকলে একই রকম লাগে!
শশিভূষণ বললেন, ভালো করে দেখুন, মনোযোগ দিয়ে দেখুন।
যদুনাথ বললেন, শুধু যে দেখি পিল পিল করে মানুষের মাথা। ব্যাটাছেলে মেয়েছেলেরও তফাত করা যায় না।
শশিভূষণ নিজের দূরবীনটি যদুনাথের চোখের সামনে ধরে বললেন, এই বার ভালো করে দেখুন।
কিন্তু দূরবীন ব্যবহার করা যাদের অভ্যেস নেই তাদের পক্ষে দৃষ্টি-সংযোগ সহজ নয়। যদুনাথ বিকৃতভাবে বললেন, এ যে দেখি আকাশ! এবার? এখনও আকাশ! না, না, দেখতে পাচ্ছি, অনেকগুলি গাছ। বাঃ, গাছগুলি কত নিকটে এসে গেছে।
যদুনাথের কাছ থেকে দূরবীন সরিয়ে শশিভূষণ আবার নিজে দেখতে দেখতে বললেন, কেউ তেল চকচকে কালো, কেউ খসখসে কালো। কারুর গায়ের রং মাটির মতন। ওরাং রমণীদের রিয়া (বক্ষবন্ধনী) আর লুসাইদের রিয়া এক নয়। কুকিদের চলার মধ্যে একটা তেজের ভাব, প্রত্যেকের হাতে অস্ত্ৰ…
বলতে বলতে অকস্মাৎ থেমে গেলেন শশিভূষণ। কিছুটা ঝুঁকে একদিকে ভালো করে নিরীক্ষণ করে অস্ফুট স্বরে বললেন, আশ্চৰ্য, আশ্চর্য!
বিকেলের আলো মরে আসছে, এর পর আর ভালো ছবি আসবে না, মহারাজ মাথার ওপর থেকে কালো কাপড় সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। গোঁফে বা হাতের তর্জনী বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সিংহমশাই, আশ্চর্যের কী দেখলে?
শশিভূষণ বললেন, মহারাজ, একপাল মেঘের মধ্যে একটি বাস্ত্ৰ শৰক দেখলে আপনি অবাক হবেন না। আমি যে তাই দেখছি!
মহারাজ ভুরু তুলে বললেন, সত্যি নাকি? ব্যাঘ্র শাবক?
শশিভূষণ বললেন, আপনি নিজে দেখুন, ওই যে লুসাইরা এসে সমবেত হচ্ছে, তাদের পশ্চাৎ দিকে। শশিভূষণ নিজের দূরবীনটি মহারাজের দিকে এগিয়ে দিতেই পাশ থেকে দু’তিনজন শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, করেন কী, করেন কী! মহারাজ স্মিত হাস্যে শুধু একটা হাত তুললেন। অপরের ব্যবহৃত কোনও জিনিস যে মহারাজ স্পর্শ করেন না, তা এই বাঙালীবাবুটি জানেন না।
একজন ভৃত্য দৌড়ে গিয়ে মহারাজের নিজস্ব দূরবীন নিয়ে এল।
মহারাজ সেটি চক্ষে সংস্থাপন করে লুসাইদের দলটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বললেন, হুঁ একটি গৌরবর্ণ ছোকরাকে দেখা যাচ্ছে বটে। ওকে আপনার ব্যাঘ্র শাবক মনে হল কেন?
শশিভূষণ বললেন, শুধু গাত্ৰবৰ্ণ গৌর নয়, চুলের রং দেখুন। খাটি ইংরেজের সন্তান মনে হয়। ও কেন এসেছে?
মহারাজ দূরবীন থেকে চোখে না। সরিয়েই বললেন, কোনও পাদ্রির বাচ্চা হতে পারে। সিংহমশাই, আমি আমার প্রজাদের মেষের পাল মনে করি না। একটা ফ্যাকাসে রঙের ছোড়াকে দেখে তুমি এত বিচলিত হচ্ছে কেন?
শশিভূষণ বললেন, ওটা একটা উপমা মাত্র। অন্যভাবেও বলা যেতে পারে। ফুলের বাগানে একটি বিষাক্ত সাপ। মহারাজ, আপনার রাজ্যে পাদ্রিরা ধর্মপ্রচার শুরু করেছে জানি। কিন্তু আপনি কি তাদের এই ভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন? মহারাজ, আমি পাদ্রিদের ভালো চিনি, আমার বাড়ি কৃষ্ণনগর, সেখানে দেখেছি, তারা গির্জার এলাকায় নিরীহ মানুষদের ডেকে নিয়ে যায়। এমনভাবে রাজার আলয়ে দূত পাঠায় না।
মহারাজ সেই গৌরাঙ্গ ছেলেটিকে আবার ভালো করে দেখলেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। শশিভূষণের কথায় গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তিনি হরিহর নামে এক পার্শ্বচরকে বললেন, খবর নাও!
মহারাজ সেখানে আর বেশিক্ষণ রইলেন না। এক ভৃত্য এসে জানাল যে মহারানী তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন।
আজকের দিনে মহারাজকে অঙ্গবন্ত্র পরিয়ে দেবার ভার নেন স্বয়ং মহাদেবী ভানুমতী। সারাদিন ধরে তিনি নিজের হাতে ফুলের মালা গেঁথেছেন, শ্বেত ও রক্তচন্দন প্রস্তুত করেছেন। মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য মনেপ্ৰাণে বৈষ্ণব, প্রজাদের সঙ্গে এই পঙক্তি ভোজনের দিনে তিনি রাজবেশ ধারণ করেন না, মাথায় মুকুটও পরেন না। মহাদেবী ভানুমতী মহারাজকে পট্টবস্ত্ৰে সাজাতে লাগলেন, আর মহারাজ গুনগুন করে গান ধরলেন, “যদি গোকুলচন্দ ব্ৰজে না এল—”। মহারাজ সঙ্গীতপ্রিয়, তাঁর গলাটিও সাধা।
মহারাজের পত্নী ও উপপত্নীর সংখ্যা মোট কতজন, তা তিনি নিজেও সঠিক জানেন না। রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন প্রতিবেশী রাজাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়, আসাম ও মণিপুরের অনেকগুলি অঙ্গ রাজ্যের কন্যারাই তাঁর মহিষী। এ ছাড়াও বিভিন্ন উপজাতীয় দলপতিরা তাঁকে মাঝে মাঝে এক একটি কন্যারত্ন উপঢৌকন দেয়, তারা রাজবাড়িতে স্থান পায়, তাদের বলা হয় কাছুয়া, তাদের কেউ কেউ কদাচিৎ মহারাজের নেকনজরে পড়ে। রীতিমতন বিবাহ অনুষ্ঠান না হলে এইসব কাছুয়া পত্নীরা ঈশ্বরী বা মহাদেবী হতে পারে না।
মহাদেবী ভানুমতী এ রাজ্যের পাটরানী। ভানুমতী মহারাজের প্রায় সমবয়েসী, তাদের বিবাহের সময় দু’জনেই ছিলেন বালক-বালিকা। অর্ধাঙ্গিনী হবার আগে ভানুমতী ছিলেন বীরচন্দ্রের খেলার সঙ্গিনী। সেই সম্পর্কটা এখনও রয়ে গেছে। ভানুমতীর তুলনায় অন্য কয়েকটি তরুণী ও রূপসী রানী রয়েছে, মহারাজ প্রায়ই তাদের কোনও একজনের মহলে রাত্রিবাস করতে যান বটে, কিন্তু ভানুমতীর কাছে এমনকি দিনের বেলাতেও যখন তখন আসেন রঙ্গকৌতুক করার জন্য। নিরালা প্রকোষ্ঠে ভানুমতী বীরচন্দ্রকে সব সময় মহারাজ হিসেবে শ্রদ্ধা প্ৰদৰ্শন করেন না, বরং কখনও কখনও শাণিত বিদ্রূপ ঝলসে ওঠে তাঁর কণ্ঠে। একদিন ভানুমতী অভিমানের অশ্রুবর্ষণ করতে করতে পালঙ্কের চার পাশে ছুটছিলেন আর মহারাজ বীরচন্দ্ৰ হাত জোড় করে, গান গাইতে গাইতে তার মান ভাঙাতে চেষ্টা করছিলেন, আড়াল থেকে কয়েকজন দাসী এই দৃশ্য দেখে ফেলে বিস্ময়ে অজ্ঞান হয়ে যাবার উপক্রম। মহাপ্ৰতাপশালী এবং প্রয়োজনে অতি নির্মম এই রাজা বীরচন্দ্ৰ এক এক সময় এমন ছেলেমানুষও হয়ে যেতে পারেন!
মহারানী ভানুমতী সুস্বাস্থ্যবতী, বয়েসের বলিরেখা পড়েনি শরীরে, মুখে রয়েছে তেজের আভা, মণিপুরিদের তুলনায় চক্ষু দুটি টানা টানা। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে গেলেও তাঁর কণ্ঠস্বরে বালিকার চাপল্য।
বীরচন্দ্রের কপালে চন্দনের ফোঁটা দিতে দিতে ভানুমতী মৃদু স্বরে বললেন, আজ আমিও আপনার সঙ্গে যাব!
গান না থামিয়ে বীরচন্দ্ৰ চোখের ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়?
ভানুমতী বললেন, হাসাম ভোজে আমি আপনার পাশে গিয়ে বসব।
বীরচন্দ্র চমকিত হয়ে মুখটা একটু সরিয়ে নিলেন, ভানুমতীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, আজ আবার পাগলামি চেপেছে!
ভানুমতী বললেন, এতে পাগলামির কী আছে? মহারাজের পাশে মহারানী থাকতে পারে না?
ভানুমতীর থুতনি ধরে আদর করে বীরচন্দ্র বললেন, তোর আর বয়েস বাড়ল না, ভানু! এ বংশের কোনও মহারানী কি কখনও লোক সমক্ষে যায়? তোর সাজানো শেষ হল? আর দেরি করা যাবে না, বেলা পড়ে এসেছে।
ভানুমতী ধারালোভাবে হেসে বললেন, হ্যাঁ, একদিন অন্তত রাজার পাশে পাশে মহারানী সবার চোখের সামনে দিয়ে যায়। যায় না? রাজা অবশ্য দেখতে পান না। কিন্তু হাজার হাজার প্রজা দেখে। সেই একটা দিন ছাড়া… কেন, কেন, আজকের আনন্দের দিনে আমি তোমার সঙ্গে বেরুতে পারব না?
কথা ঘোরাবার জন্য বীরচন্দ্র বললেন, কই রে, নিমচাটা দে রে পাগলী! এবার যাই!
ভানুমতী বললেন, এখনও সাজানো শেষ হয়নি। চুপটি করে বসুন।
বীরচন্দ্রের মুখমণ্ডল আবার চন্দনচর্চিত করতে করতে ভানুমতী ফিসফিস করে বললেন, আজ যদি আমায় না নিয়ে যাও, আমি সেদিনও তোমার পাশে পাশে গিয়ে চিতায় চড়ব না!
বীরচন্দ্র একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। যেন তিনি তাকালেন নিজের শরীরের অভ্যন্তরে, অনুভব করলেন প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ভানু, তুই আজকের দিনে আমার মৃত্যুর কথা বললি?
ভানুমতী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, না, মোটেই তা বলিনি। তোমার সঙ্গে আমি চিতায় চড়ব না, তার আগে আমিই মরে যাব। মরবাই!
মহারাজ মৃদু হেসে ভঙ্গি করে বললেন, সে কী? সতী হলে কত পুণ্য অর্জন করবি, তা জানিস না? ধন্যমাণিক্যের পাটরানী কমলার নামে ঘরে ঘরে পুজো হয়। তুই আমার পাটরানী, আমার সঙ্গে সহমরণে যাবার সৌভাগ্য একমাত্র তোরই আছে, আর কোনও রানী পাবে না!
ভানুমতী বললেন, চাই না আমার ওই সৌভাগ্য। আমি আগে মরবাই মরবো। ওই হারামজাদি, প্যাচামুখী, খেদি, ছোট জাতের মেয়ে রাজেশ্বরীটা, ওই শাকচুন্নী, ওই বেজন্মা, ভাতারখাগী, ওই রাজেশ্বরী তোমার চিতায় জুলে পুড়ে মরুক, মরুক, আমি স্বর্গ থেকে দেখবা!
বীরচন্দ্ৰ এবার হা-হা শব্দে ঘর ফাটিয়ে হাসলেন।
সপত্নীদের মধ্যে রেষারেষি, ঈৰ্ষা ও ক্রোধের সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক, বীরচন্দ্র তা জানেন। এক রানী অন্য এক রানীকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে, এমন ঘটনাও এই প্রাসাদে ঘটেছে। কিন্তু কোনও রানীই অন্য কোনও রানীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ কথা মহারাজের সামনে উচ্চারণ করার সাহস পায় না। বীরচন্দ্রের পিতা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য একবার এক কটুভাষী রানীকে নির্বাসনদণ্ড দিয়েছিলেন। মহারাজ বীরচন্দ্রও রানীদের বিবাদের মধ্যে একেবারেই মাথা গলান না, তাঁর সামনে ওই প্রসঙ্গ উত্থাপন করাও নিষিদ্ধ। কিন্তু ভানুমতীর কথা স্বতন্ত্র, ভানুমতী যে তাঁর বাল্যসখী। তাঁকে শাসন করা যায় না।
বীরচন্দ্ৰ হাসতে হাসতে বললেন, ভাতারখাগী! হারামজাদি! কী সব ভাষা! লোকে কি ভাবে জানিস, রাজবাড়ির মধ্যে সবাই খুব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে! খারাপ কথা মুখেই আনে না। তোকে নিয়ে আর পারি না ভানু! তুই জানিস, আর কোনও রানী যদি আমার সামনে এই রকম কথা বলত, তা হলে আমি এই মুহূর্তে কাচাত করে তার মুণ্ডুটা কেটে ফেলতাম!
ভানুমতী ঘরের কোণ থেকে দ্রুত একটা তলোয়ার নিয়ে এলেন। মণিমাণিক্য এই তলোয়ারটির নাম নিমচা। বীরচন্দ্রের পূর্বপুরুষ মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যকে দিল্লীশ্বর শাহজানের পুত্র সুলতান সুজা এটা উপহার দিয়েছিলেন বলে কথিত। উৎসবের দিনে শুধু পট্টবস্ত্র ও উত্তরীয় ধারণ করলেও মহারাজদের এই তরবারিটি সঙ্গে নিতে হয়।
ভানুমতী তলোয়ার কোষমুক্ত করে বললেন, মারুন, আমাকে এখনই বধ করুন। তা হলে সকল জ্বালা জুড়োয়। আজই আপনি রাধুকে যুবরাজ বলে ঘোষণা করবেন, তাই না?
বীরচব্দ্রের মুখমণ্ডল থেকে কৌতুক মুছে গিয়ে বিরক্তির ছায়া পড়ল। কোনও কিছুই কি গোপন রাখার উপায় নেই? তাঁর দ্বিতীয় পত্নী রাজেশ্বরীর জ্যেষ্ঠপুত্র রাধাকিশোরকে যে যৌবরাজ্য পদে বসাবার ঘোষণা করা হবে। আজ, তা মাত্র দু’জন জানে। রাজেশ্বরীও এখনও জানেন না। ভানুমতীর কানে এলো কী করে?
বীরচন্দ্ৰ গম্ভীরভাবে বললেন, তোমার ছেলেটিও বড় ঠাকুর হবে। তোমাকে খুশী করার জন্য আমি যে নিয়ম ভেঙেছি।
ভানুমতী বললেন, চাই না, চাই না! সমরকে আমি কলকাতায় পাঠিয়ে দেব!
খুট করে একটি শব্দ হতেই দু’জনে দরজার দিকে ফিরে তাকালেন।
কক্ষের মধ্যে ঢুকে এসেছে একটি কিশোরী। তার সারা শরীরে যেন ঝনঝন করে ঘণ্টা বাজিয়ে যৌবন তার আগমন বার্তা জানাচ্ছে। তার দৃষ্টিতে এখনও বালিকাসুলভ সরল লাবণ্য। নিম্নাঙ্গে একটা হলুদ রঙের পাছাড়া, কচি কলাপাতা রঙের রিয়া দিয়ে বক্ষ বন্ধন করা।
মেয়েটিকে দেখে মহারাজ আবার বিস্ময়ের সঙ্গে ভানুমতীর দিকে তাকালেন। কোনও দাসী তো এসময় হঠাৎ এসে পড়তে সাহস পাবে না। এ মেয়েটি কে?
ভানুমতীও রেগে উঠলেন না। তাঁর দু’চোখে উদ্গত অশ্রু। তবু কোনও রকমে সামলে নিয়ে তিনি প্রশ্রয়ের সুরে বললেন, কী রে খুমন?
মেয়েটি মহারাজকে কয়েক পলক দেখল। ভয় পায়নি সে, কোনও পাহাড়ের পদপ্রান্তে এসে শিখরের দিকে তাকালে ঠিক ভয় করে না, একটা কিছু গভীর অনুভূতি হয়, সেই রকমভাবে একটুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল মেয়েটি। তারপর মহারানীকে জিজ্ঞেস করল, বিলোনি আর ফুলকু বলছে ছাদে যেতে। আর মেজোরানীমা বললেন, না যাবি না। তা হলে কী করব?
ভানুমতী ধরা গলায় বললেন, আয় ভেতরে আয়। মহারাজকে প্ৰণাম কর।
মেয়েটি এসে প্রথমে মহারাজের কাছে হাঁটু গেড়ে বসল। দু’হাত যুক্ত করে, কপাল ঠেকাল মাটিতে। তারপর সম্পূর্ণ শুয়ে পড়ে মাথা ও হাত রাখল মহারাজের দুই পায়ে। মহারাজ আশীর্বাদের ভঙ্গিতে এক হাত তুলে খানিকটা অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন, এই ছেমরিটা কে?
মেয়েটি নিজেই মাথা তুলে বলল, আমি খুমন থরোলৈমা!
ভানুমতী বললেন, ও তো আমার বোনের মেয়ে। তুমি ওকে চেন না? বাচ্চা বয়েসে কিছুদিন আমার কাছে এসে ছিল, তুমি তখন ওকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করতে। এখন আবার এক বছর হল ওকে প্রাসাদে এনে রেখেছি।
মেয়েটিকে আগে দেখেছেন কি না তা মনে করতে পারলেন না বীরচন্দ্র। কিন্তু তাঁর বিস্ময় ক্রমেই বাড়ছে। ভানুমতী আজ খুবই মান-অভিমানের মধ্যে রয়েছেন, রাজার কাছে অনেক অভিযোগ জানাচ্ছিলেন, এর মধ্যে একটি মেয়ে এসে পড়ল, তাকে বাইরে চলে যেতে বলাই তো স্বাভাবিক ছিল, বোনের মেয়ে হোক আর নিজের সন্তানই হোক! অথচ ভানুমতী সামান্য বিরক্তিও প্রকাশ করেননি।
বীরচন্দ্রের অবশ্য তাতে সুবিধেই হল। ভানুমতীর অনুযোগে তিনি অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞ চোখে কিশোরীটির আপাদমস্তক যাচাই করলেন। এর শরীরের গড়নে ছন্দ আছে, চোখে আছে দুৰ্গতি। এর নীরব ভঙ্গিও যেন কিছু কথা বলে। দু’এক বছরের মধ্যেই এই কিশোরী একটি রমণীরত্ন হয়ে উঠবে। পুরুষদের জয় করার জন্য এরকম রমণীদের কোনও চেষ্টা করতে হয় না, পুরুষরাই সহজে আকৃষ্ট হয়।
ভানুমতী বললেন, আমি ওর বাংলা নাম রেখেছি মনোমোহিনী। মনো, এখন থেকে তুই ওই নাম বলবি।
বীরচন্দ্র বললেন, বাংলা নাম রেখেছ, শাড়ি পরাওনি কেন?
ভানুমতী বললেন, হ্যাঁ, শাড়ি পরা শেখাতে হবে। এখনও দুরন্ত আছে তো, গায়ে আঁচল রাখতে পারে না।
বীরচন্দ্ৰ এবার থরোলৈমা ওরফে মনোমোহিনীকে বললেন, ছাদে যাবি না কেন? যে-ই নিষেধ করুক, বলবি আমি অনুমতি দিয়েছি।
ভানুমতী বললেন, যা, তুই ফুলকুদের সঙ্গে ছাদে গিয়ে দেখ। বাছা, মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, বাইরে তো বেরুতে পারবি না। ছাদ থেকেই দেখতে হবে। বিয়ে হয়ে গেলে তাও পারবি না।
মনোমোহিনী এবার হাত জোড় করে মহারাজকে অভিবাদন জানিয়েই হরিণীর মতন ছুটে বেরিয়ে গেল।
বীরচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, ওকে তোর কাছে রেখেছিস, ওর মা কোথায়?
ভানুমতী বললেন, আ-হা, আপনার কিছুই মনে থাকে না। আমার বোন দু’বছর আগে আগুনে পুড়ে মরল না?
— সতী হয়েছে?
— ওই একই হল। পুড়ে মরা মানে পুড়ে মরা।
— মেয়েটা সোমথ হয়েছে তোর কাছে আছে যখন, ওর বিয়ের ব্যবস্থা তো তোর করতে হবে। সতী মায়ের কন্যা, ওর জন্য ভালো পাত্ৰ দেখ।
—ওর বিয়ের ব্যবস্থা আমি করে ফেলেছি। এ রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পাত্রের সঙ্গেই ওর বিয়ে হবে।
—তাই নাকি? শুনি, শুনি সর্বশ্রেষ্ঠ পাত্রটি কে?
—মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য!
বীরচন্দ্ৰ এবার ভানুমতীর নাকটি টিপে দিয়ে বললেন, কত উদ্ভট চিন্তাই না আসে তোর মাথায়! আমার আবার বিয়ে করার সময় আছে নাকি?
ভানুমতী বললেন, সত্যি করে বলুন তো, ওকে আপনার পছন্দ হয়নি? সেই জন্যই তো ওকে আমি পাছাড়া পরে আসতে বলেছিলাম। দিব্যি মেয়ে। লক্ষ্মী মেয়ে। আমি ওকে আপনার হাতে তুলে দেব, আপনি ওকে নিয়ে আনন্দ করুন। ওই গতরখাগী, আবাগীর বেটী রাজেশ্বরীর কাছে আপনাকে আর যেতে হবে না!
বীরচন্দ্ৰ এবার সস্নেহে ভানুমতীকে আলিঙ্গন করে নরম স্বরে বললেন, ওসব কথা আজ আর বলিসনি, ভানু। তুই তো জানিস, আমি তোকেই সবচেয়ে ভালোবাসি।
স্বামীর বুকে মাথা রাখার দুর্লভ সুযোগ পেয়েও ভানুমতী কাতর কণ্ঠে বললেন, ভালোবাসা না ছাই। আমি বুড়ি হয়ে গেছি, আমাকে আর নজরে ধরবে না তা জানি, তবু আপনার পায়ে পড়ি, আজ আমাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন। এই বন্ধ ঘরে থাকতে আমার ভালো লাগে না। আজ প্রজাদের মাঝখানে আপনার পাশে গিয়ে বসতে চাই।
বীরচন্দ্র বললেন, বারবার কেন এই কথা বলছিস, জানিস তো এটা সম্ভব নয়। এই বংশের রীতি নেই।
ভানুমতী বললেন, আমি যে পাটরানী, প্রজারা তা কেউ জানে না। রাধুকে তুমি যুবরাজ করবে, রাজেশ্বরী হবে রাজার মা, আমাকে তখন সবাই দাসী-বাদীর মতন হেলা-তুচ্ছ করবে। আমাকে রাজপ্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দেবে।
বীরচন্দ্র অস্থিরভাবে বললেন, আবার ওই সব পাগলামির কথা! তোকে হেলা-তুচ্ছ করবে। এমন সাহস কার আছে? সবাই জানে, এই প্রাসাদের গণ্ডা গণ্ডা রানী থাকলেও মহাদেবী একজনই। তার নাম ভানুমতী। স্বয়ং মহারাজকেও প্রায়ই তার কাছে হাত পাততে হয়। ভালো কথা। রাজকোষ প্রায় শূন্য, শিগগিরই তোর কাছে আমাকে আবার লাখ খানেক টাকা ধার চাইতে হবে।
ভানুমতী আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে বাধা দিয়ে বীরচন্দ্র বললেন, আর সময় নেই রে । সময় নেই । সবাই অপেক্ষা করছে । শোন, আজ ভোজ পর্ব সেরে আমি তোর কাছেই ফিরে আসব । সারা রাত থাকব ভোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। নতুন যে পান বেঁধেছি, তাও তোকেই প্রথম শোনাব ।
ভানুমতী এবার খানিকটা সরে গিয়ে গাঢ় চোখে তাকিয়ে বললেন, ঠিক ফিরে আসবেন আমার কাছে?
বীরচন্দ্র বললেন, ঘরে ধুনো-গুগগুল দিয়ে রাখিস। আজ তোর শয্যায় এক সঙ্গে ঘুমোব। কথা দিলাম।
ভানুমতী বললেন, তিন সত্যি করুন!
বীরচন্দ্র বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ!
মহারানীর মহল থেকে বেরিয়ে এসে, কালো ও সাদা পাথরের চৌখুপ্পি করা লম্বা বারান্দা পেরিয়ে এসে বীরচন্দ্র আর একটি কক্ষে এলেন। এখন দু’জন ভৃত্য তাঁকে জুতো পরাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। তারা বিভিন্ন ধরনের জুতো পরাতে লাগল, মহারাজা অপছন্দ করে মাথা নাড়তে লাগলেন।
তিনি ভেতরে ভেতরে বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছেন। আজকের দিনটি যেমন আনন্দের, তেমন সংকটেরও বটে। প্রজাবৃন্দের সামনে তিনি যুবরাজের নাম ঘোষণা করবেন। ভানুমতী এতে আঘাত পাবেন অবশ্যই, তা ছাড়া বীরচন্দ্র জানেন, এই প্রাসাদের কিছু কিছু আত্মীয় পরিজন ও মন্ত্রণাদাতাদেরও এতে সমর্থন নেই। ভানুমতীর পক্ষে আছেন অনেকে। ভানুমতীর নিজস্ব ধনসম্পদ যথেষ্ট, বিশাল গড় ও আগরতলা পরগনা ভানুমতীর খাসতালুক, সেখানকার অনেক কর্মচারী তার বাধ্য। এরা সবাই মিলে যুবরাজের বিরুদ্ধে এখনই কোন ষড়যন্ত্র শুরু করবে না তো! তবে একটা ব্যাপারে বীরচন্দ্রের বিশ্বাস আছে, তিনি যতদিন জীবিত আছেন, ভানুমতী কোনক্রমেই তার বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। এই বয়েসে আর প্রেম না থাকলেও দু’জনের মধ্যে স্নেহ মমতা বন্ধুত্বের সম্পর্ক খুবই সুদৃঢ় ।
অতি অল্প বয়সে এই প্রাসাদে রানী হয়ে এসেছেন ভানুমতী, তিনি যে যোগ্যতম মহাদেবী তাতেও কোনও সন্দেহ নেই, অন্দরমহলের সকলেই তাকে সমীহ করে। কিন্তু একটা ব্যাপারে ভানুমতী তাঁর সপত্নী রাজেশ্বরীর কাছে হেরে গেছেন। বহুদিন পর্যন্ত ভানুমতীর কোনও পুত্রসন্তান হয়নি। এমনকি ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে ভানুমতী বাঁজা। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। যে স্ত্রী স্বামীর বংশে কোনও পুত্রসন্তান উপহার দিতে পারে না, সে তো অচল পয়সায় মতন পরিত্যাজ্য। সাধারণ ঘরে ঘরেই এই নিয়ম, আর রাজ পরিবারে পুত্রহীন রানী তো রক্ষিতার সমতুল্য। মহারাজ বীরচন্দ্র নিতান্ত স্নেহবশতই ভানুমতীকে বাতিল করে দেননি।
শেষ পর্যন্ত ভানুমতী একটি পুত্রের জন্ম দিয়ে নারীত্বের চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন বটে, কিন্তু ততদিনে রাজেশ্বরীর তিনটি পুত্র জন্মে গেছে। তার ফলে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন নিয়ে দেখা দিল ৰিপত্তি। যুবরাজ হবেন কে, পাটরানীর সন্তান, না রাজার জ্যেষ্ঠ সন্তান? বড় কূট এই প্রশ্ন! এই বংশে প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র লেগেই আছে, সিংহাসনের অধিকার নিয়ে মারামারি-কাটকাটি ও আদালতের মামলা হয়েছে অনেকবার। স্বয়ং বীরচন্দ্রকেও অনেক দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে। বীরচন্দ্র সিংহাসনে বলেছিলেন তার বড় ভাই ঈশানচদ্রের সহসা মৃত্যুর পর। তার ফলে ঈশানচন্দ্রের পুত্ররা এবং বীরচন্দ্রের অন্য ভাইরা নিজেদের দাবি উত্থাপন করে চক্রান্তে মেতে ওঠে। সুযোগ সন্ধানীরা বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে উস্কানি দেয়। চট্টগ্রামের কমিশনার, বাংলা লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে পর্বত মধ্যস্থতা করতে হয়েছিল। সিংহাসন আঁকড়ে থেকে বীরচন্দ্র অন্য দাবিদারদের প্রতি নির্মম হতে বাধ্য হয়েছিলেন, পথের কাঁটা নির্মূল করতে তিনি দ্বিধা করেননি।
আবার যাতে সেই রকম পারিবারিক বিদ্রোহ না ঘটে সেই জন্য বীরচন্দ্র আগেই মনঃস্থির করে রাজেশ্বরীর গর্ভজাত তাঁর প্রথম সন্তান রাধাকিশোরকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। বীরচন্দ্র জানেন, ভানুমতীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে তিনি ভানুমতীর সন্তান সমরেন্দ্রচন্দ্রকে যৌবরাজ্য দিলে শত্রু সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে তো বটেই, আদালতের বিচারে ও চতুর্থ রাজকুমার সমরেন্দ্রচন্দ্রের দাবি টিকবে না। ইংরেজের আদালত জ্যেষ্ঠ সন্তানকেই মর্যাদা দেয়। তবু তো খানিকটা রীতিবিরোধী হয়ে তিনি সমরেন্দ্রচন্দ্রকে বড় ঠাকুরের পদ দিতে চাইছেন, এ রাজ্যে যুবরাজের পরেই বড় ঠাকুরের প্রাধান্য! ভানুমতী তাতেও খুশি নন, অথচ দ্বিতীয় পুত্র দেবেন্দ্রকেও বঞ্চিত করা হল!
অন্যান্য জুতাগুলি বাতিল করে বীরচন্দ্র সাদাসিধে এক জোড়া খড়ম পায়ে দিলেন। তারপর সেই কক্ষ থেকে নিস্ক্রান্ত হয়ে একবার চিন্তা করলেন, রাজেশ্বরীর সঙ্গে দেখা করে যাবেন কিনা। ভানুমতীর চর আছে সর্বত্র, ভানুমতী ঠিক জেনে যাবেন সে কথা। থাক তা হলে।
বীরচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে এটাও ঠিক করলেন, আজ রাতে আর ভানুমতীর কাছে ফিরে আসা হবে না। ও কথা তিনি বলে ফেলেছেন ঝোঁকের মাথায়। ভোজ পর্বের পর আজ গান বাজনার ব্যবস্থা আছে। বীণা বাদক নিসার হোসেন, রবাব বাদক কাসেম আলি খাঁ, পাখোয়াজ বাদক পঞ্চানন মিত্রকে খবর দেওয়া আছে, তারা আসর সাজিয়ে বসবেন, গায়ক যদু ভট্ট মশাই তো রয়েছেনই। কত রাত হবে তার ঠিক নেই। ভানুমতীর কাছে গেলে শুধু অভিযোগের ঘ্যানঘ্যানানি আর প্যানপ্যানানি শুনতে হবে। তাতে মেজাজ নষ্ট হয়ে শুধু। না, ফেরা হবে না! ভানুমতীর কাছে তিন সত্যি করা হয়ে গেল? তাতেও কিছু আসে না। স্ত্রীলোকের কাছে প্রতিশ্রুতির কোনও দাম আছে নাকি? ওরা তো মিথ্যে প্রতিশ্রুতি শুনতেই ভালৰাসে। রণে ও রমণে মিথ্যেই বেশি শক্তিশালী। দুটো তিনটে দিন কেটে যাক, এর মধ্যে আর ভানুমতীর কাছ ঘেঁষা হবে না, তারপর ভানুমতীর নিভৃত সংসর্গে আরও কিছু মিথ্যে সোহাগ দিয়ে তাকে ভোলালেই চলবে।
পারিষদরা অপেক্ষা করছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মহারাজ বীরচন্দ্র আবার গুনগুন করে গান ধরলেন, কী হেরিলাম রাই কিশোরী মরি, মরি। চন্দ্রকলায় কী বা শোভা…