৫৮
‘মানুষ যখন আলোকে ভয় পায়,
তার চেয়ে ট্রাজেডি আর কিছু হতে পারে না।’
—সক্রেটিস
***
আকাশের পুব-কোণটা একটু লালচে হয়েছে মাত্র।
এখনও ভোরের আলো ফোটেনি। জেলগেট মোটামুটি লোকারণ্য। বেশিরভাগই তরুণ। জেলখানার দরজায় অনেকেই ছুটে এসেছে কাক-ডাকার আগেই। শনশন বাতাস বইছে। একটু ঠাণ্ডাও আছে। একটি কাক ডাকছে। চারদিকে থমথমে একটি ভাব। সবার মুখ বিষণ্ন। আজ সক্রেটিসের জীবনের শেষ দিন।[১৩৯]
এখনও জেলখানার দরজা খোলেনি। তরুণরা অপেক্ষা করছে। জেলের দরজা খুললেই সক্রেটিসের একেবারে মুখের সামনে গিয়ে বসবে। শেষ দিনে কোনো কথা মিস করা যাবে না।
দারোয়ান দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে সবাই ঢুকে পড়ল। ঢুকেই থতমত খেলো। ভেতরে যে জেনথিপি আছেন, তারা জানত না। সক্রেটিসের স্ত্রীকে তারা চেনে না। শুধু নাম শুনেছে। কোনোদিন চোখে দেখেনি। কী করতে হবে বুঝতে পারছে না।
সক্রেটিস আর জেনথিপি বিছানায় বসে আছেন। এখনও বিছানায় পাশাপাশি দুটি বালিশ। দাম্পত্যের শেষ চিহ্ন। সক্রেটিসের মুখে হাসি। জেনথিপির মুখ শুকনো। ছোট ছেলেটি মেঝেতে ঘুমাচ্ছে। সে জানে না আজ তার বাবার জীবনের শেষ দিন। জেলখানায় ঢুকে তরুণদের মনে হচ্ছে তারা সক্রেটিসের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে।
সক্রেটিস হাসিমুখে বললেন, এসো, বন্ধুরা। শেষ দিনের প্রথম সূর্যকে বরণ করি।
সবাই সূর্য খোঁজ করতে শুরু করল। এই ঘর থেকে সূর্য দেখা যায় না। কোনো জাগলা নেই। তবু সবাই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সূর্যকে বরণ করতে হবে। সক্রেটিস নিজের মুখে বলেছেন। মরণের দিন তার কথা রাখতেই হবে। সবাই প্রাণপণে সূর্যকে দেখতে চেষ্টা করছে। কেউই দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু এমন ভাব করছে, যেন সবাই দেখতে পাচ্ছে। যেন আজকে আকাশে কয়েকটা সূর্য উঠেছে।
সক্রেটিস বললেন, জেলের ঘর থেকে তো সূর্য দেখা যাবে না। আমি মনের সূর্যকে বরণ করতে বলেছি।
সকলে বুঝল সক্রেটিস বদলায়নি। মরণের দিনটিও তিনি হাসি-ঠাট্টা দিয়ে দিন শুরু করবেন। তিনি দুঃখকে প্রশ্রয় দেন না। জীবনের শেষ দিনেও না। তার ঠাট্টায় তরুণদের ভ্যাবাচ্যাকা ভাব কেটে গেল।
কিন্তু জেনথিপি হাসিঠাট্টায় যোগ দিতে পারছেন না। মন খুব খারাপ। সকাল থেকেই তিনি এই ঘরে কেমন একটি গন্ধ পাচ্ছেন। এটিই মনে হয় মৃত্যু গন্ধ। মরণের আগে এরকম গন্ধ পাওয়া যায়। তিনি ভেবেছিলেন, সময় হলে সক্রেটিসকে জিজ্ঞেস করবেন, তিনি কোনো গন্ধ পাচ্ছেন কিনা। সেই সময় আর হলো না। আলো না ফুটতেই রাজ্যের ছেলেপেলে ঘরে ঢুকে গেছে। তারা এখন জ্ঞানের কথা বলবে। এটি এখন দর্শনের স্কুল। শেষ দিনের স্কুল তারা কামাই করবে না। সক্রেটিস তাদের নিয়ে মেতে উঠেছেন।
হঠাৎ বুক ফেটে কান্না পেল জেনথিপির। মৃত্যু গন্ধটা তাকে উতলা করে তুলেছে। জেনথিপি কোনোকিছুই ধীরে-সুস্থে করতে পারেন না। তিনি চিৎকার করে কান্না শুরু করলেন।
জেনথিপির কান্না সবাইকে ছুঁতে শুরু করেছে। সবাই মনে হয় মৃত্যু গন্ধটা পাচ্ছে। সবার মুখে গম্ভীর হয়ে গেল। সক্রেটিস দেখলেন, সর্বনাশ, কখন যেন জেনথিপির সাথে সবাই কান্না শুরু করে! কান্নার কোরাস হয়ে যাবে। সেটি হতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু কী বলা যায়? সক্রেটিস অনেক যুক্তি জানেন। কিন্তু যে মেয়ের স্বামী একটু পরে মারা যাবে, তাকে কান্না থামাতে বলার মতো যুক্তি সক্রেটিসের জানা নেই।
জেনথিপির দিকে এগিয়ে গেল ক্রিতোর ছেলে ক্রিতোবুলাস। ক্রিতো এখনও আসেননি। ছেলে ক্রিতোবুলাস সকালের খাবার নিয়ে এসেছে। এই ছেলেটি জেনথিপিকে মায়ের মতো দেখে। জেনথিপিরও তার কাছে লজ্জা নেই। ক্রিতোবুলাস জেনথিপিকে একটি রুমাল দিল
জেনথিপি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলছেন, ও সক্রেটিস, বন্ধুদের সাথে এই আপনার শেষ কথা। এই শেষ দেখা। আর কোনোদিন তর্ক করতে পারবেন না। আর কোনোদিন একসাথে আগোরায় বসবেন না। আড্ডা দেবেন না। এথেন্স যেমন আছে, তেমনই থাকবে। ঐ আগোরা থাকবে, আড্ডা থাকবে। শুধু সক্রেটিস থাকবেন না।
তরুণরা হায় হায় করছে। এক্ষুনি কান্নার কোরাস শুরু হবে।
সক্রেটিস তাড়াতাড়ি বললেন, তুমি এখন বাড়ি যাও। বিকেলে আবার এসো। এখানে অনেক মানুষ, আরও ছেলেরা আসবে। সবাই কান্নাকাটি করলে জেলখানার দারোয়ান ঝামেলা করবে। তুমি যাও।
ক্রিতোবুলাস জেনথিপিকে বলল, চলেন, আমি আর সক্রোনিকাস আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি।
জেনথিপি বেরিয়ে গেলেন। তার মনে হচ্ছে— মরণ গন্ধটা তার সাথে সাথেই যাচ্ছে। গন্ধটা নাকে যেতেই তিনি কেঁপে উঠছেন। কেঁপে কেঁপে কাঁদছেন। তার সাথে কোলের ছেলেটাও কাঁদছে।
.
সক্রেটিস সবাইকে নিয়ে বসলেন। তাকে ঘিরে চারদিকে অনেক তরুণ। তার ডান দিকে একটি নিচু টুলের উপর বসে আছে ফিদো। তাকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছিলেন সক্রেটিস। খুবই সুন্দর চেহারা ছেলেটির। নাক, চোখ সব টানাটানা। তার চুলের বড় বাহার। লম্বা রেশমি চুল কাঁধের দুদিকে ঝুলে থাকে। ছেলেটিকে সক্রেটিস খুব পছন্দ করেন। এই ফিদোকে তিনি দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছেন। তিনি ফিদোর লম্বা চুল টেনে সব সময় রসিকতা করেন। আজও হাত বাড়িয়েই ফিদোর সুন্দর পশমি চুল ধরলেন সক্রেটিস। বললেন, চুলের এই কাটিং-এর নাম কী?
ফিদো বলল, এই কাটিং-এর নাম স্পার্টান জিউস।
‘আরে বাবা! তুমি এথেন্সের শত্রু স্পার্টানদের কাটিং করেছ? তবু ওরা তোমার নামে মামলা দিল না। মামলা দিল আমার নামে? দেখো আমার চুল একেবারে সোজা। পুরাপুরি এথেন্স-কাটিং। এক গাছা চুলেও স্পার্টা-কাটিং নেই। তাও আমার নামেই মামলা দিল। তোমাকে কিছুই বলল না। তোমার চেহারা ভালো তো!’
ফিদো বলল, ঘটনা হলো— আমার চুল শুধু স্পার্টান কাটিং নয়, স্পার্টান জিউস কাটিং। চুলের আগায় দেবতা জিউস আছেন। জিউসের নামে মামলা করতে কেউ সাহস পাবে না।
সবাই হেসে উঠল।
সক্রেটিস বললেন, জিউস বুড়ো হয়ে গেছে। বুড়ো জিউসের কাটিং-এর এখন আর চল নাই। তোমার বাবরি চুল কেটে ফেলো।
‘আমি সত্যিই কাল চুল কেটে ফেলব। সক্রেটিস মারা যাবে। আমি তো কিচ্ছু করতে পারব না। তাই শোকের চিহ্ন বোঝাতে চুল কেটে ফেলব।
সক্রেটিস বললেন, না না, ফিদো। আমি ঠাট্টা করছিলাম। পাগলামি কোরো না। চুল-টুল কেটে কোনো লাভ নেই। সক্রেটিসের প্রতি শোক জানাতে চাইলে তার মতো করে চলতে হবে। সত্য ও ন্যায় পথে থাকতে হবে। আচ্ছা, আমাদের আরেক চুলওয়ালা প্লেটো কেমন আছে? তারও তো স্পার্টান কাটিং।
ফিদো বলল, প্লেটো খুবই অসুস্থ। একেবারে শয্যাশায়ী। বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। সে খুব কাঁদছিল।
‘কাঁদছিল? আহা, এত বড় ছেলে কাঁদছে! অসুখ খুব শক্ত মনে হয়। খুব ব্যথা-বেদনা আছে।
‘না না, প্লেটো নিজের ব্যথায় কাঁদেনি। আপনার শেষ দিনে আসতে পারছে না। সেজন্য প্লেটো কাঁদছিল।’
‘আহা বেচারা।’
‘আমি তাকে ভালো করে বলে এসেছি। কীভাবে সক্রেটিস মারা যাবে— সেটি আমি তাকে বলব। একেবারে অক্ষরে অক্ষরে বলব।’
‘ও, তুমি তাহলে ধারাভাষ্যকার। সক্রেটিসের মৃত্যুদৃশ্যের ধারাভাষ্যকার কী সৌভাগ্য আমার! কীভাবে মারা যাচ্ছি, সব রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। ফিদো, তুমি তো ছবি আঁকতে পার। এর চেয়ে কয়েকটা ছবি এঁকে দেখিয়ে দিও প্লেটোকে। ধরো, একটি ছবি আঁকলে— আমি হেমলক মুখে দিয়েছি, আর জিহ্বাটা পুরো এক হাত বের হয়ে গেছে। পারবে না আঁকতে?’
ফিদো বলল, এরকম রসিকতা করলে, আমি কিন্তু কেঁদে ফেলব।
‘না না, তুমি আর কেঁদো না বাপু। ঐ দেখো একজন কেঁদে পুরো জেলখানা ভাসিয়ে দিচ্ছে।’
ফিদো দেখল, এক কোনায় একটি ছেলে কাঁদছে। ফিদো ছেলেটিকে চেনে। তার নাম এপোলোদোরাস।
সক্রেটিস বললেন, ওকে থামতে বলো। ওর চোখের পানিতে তো বন্যা হয়ে যাবে। এথেন্স এখন গরিব হয়ে গেছে। বন্যার পানি নিষ্কাসনের টাকা নেই। শেষে নিজের চোখের জলের বন্যায় নিজেই ভেসে যাবে।
সক্রেটিসের রসিকতায় এপোলোদোরাস আর জোরে কাঁদতে লাগল। মনে হচ্ছে চোখের পানিতে বন্যা করেই ছাড়বে। সক্রেটিসের মামলার যেদিন রায় হলো, সেদিন আদালতেও এপোলোদোরাস কেঁদে ভাসিয়েছিল।
ক্রিতোর সাথে ঘরে ঢুকল সিমিয়াস আরও সিবিজ। তাদের বাড়ি থিবস নগরে। তারা সক্রেটিসের বিরাট ভক্ত। শুধু সক্রেটিসকে দেখার জন্যই এতদূর থেকে এসেছে।
সক্রেটিস বললেন, এসো, তোমরা দেখো, দুইজন ধনী লোক এসেছে। এরা টাকার জোরে এথেন্সের আসামিদের ছাড়িয়ে নিতে চায়।
সিবিজ বলল, আসামি যদি সক্রেটিস হয়, তাহলে শুধু টাকা নয়, জীবন দিয়ে হলেও ছাড়িয়ে নিতে চাই।
ক্রিতো বললেন, ধন আর জ্ঞান একসাথে আছে, এমন লোক পৃথিবীতে খুব কম। এই দুজন একসাথে ধনী আর জ্ঞানী। এরা থিবস নগরের অহংকার।
সক্রেটিস বললেন, থিবসের নাম উঠলেই ‘রাজা ইদিপাস’ নাটকটার কথা মনে পড়ে। সফোক্লিস লিখেছিলেন। বড় সুন্দর করে লিখেছেন। তার চেয়েও সুন্দর অভিনয় করেছিলেন। সেই নাটক দেখে সবাই কেঁদেছে।
সিমিয়াস বলল, হ্যাঁ, আমাদের ওখানেও ‘রাজা ইদিপাস’ অভিনীত হয়েছে। সেখানেও অনেক জনপ্রিয় হয়েছে। ওখানে এখনও সফোক্লিসের অনেক সম্মান। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল, সফোক্লিস মারা গেছেন, তাও লোকে মুখে মুখে তার নাম বলে।
সিবিজ বলল, কত বছর হলো সফোক্লিস মারা গেছেন?
ক্রিতো বললেন, এই গ্রীষ্মে সাত বছরে পড়ল।
ফিদো বলল, সবাই মারা যাচ্ছে। সব মহান মানুষ চলে যাচ্ছেন। আজ চলে যাবেন পৃথিবীর সবচেয়ে মহান মানুষ।
আবার পরিবেশ দুঃখ দুঃখ হয়ে গেল। সক্রেটিস বললেন, এত চিন্তা করছো কেন? আমি তো আবার ফিরে আসব।
‘ফিরে আসব মানে?’
‘মানে, আমার আত্মা ফিরে আসবে। মরার পর আসবে।’
সিবিজ বলল, এরকম কথা আপনার মুখে আগে শুনিনি।
সক্রেটিস বললেন, এসো তাহলে মৃত্যুর পরে কী হবে— সেটি নিয়ে আলাপ করি।
শুরু হলো আলাপ। অনেকক্ষণ ধরে চলল যুক্তি, পাল্টা যুক্তি।
সক্রেটিস বলছেন, তিনি ফিরে আসবেন। দেহ আর আত্মা দুটো ভিন্ন জিনিস। মৃত্যুর সাথে সাথে দেহ নষ্ট হয়ে যায়। আত্মা নষ্ট হয় না, আত্মা অমর। আত্মা অন্য দেহ হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। দেহ মরণশীল, আত্মা মরণশীল নয়। মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার মরণশীল অংশ মারা যায়, মানে দেহ শেষ হয়। কিন্তু অমরণশীল অংশ মানে আত্মার কিছু হয় না। আত্মা আবার ফিরে আসে। অন্য রূপে আসে। সেজন্য আমি আবার ফিরে আসব।[১৪০]
আলাপ চলছে, মাঝখানে একটু লাঞ্চ বিরতি। বিরতির পর আবার চলছে। সিমিয়াস আর সিবিসই আজ সক্রেটিসের সাথে কথা বলছে। অন্যদের সুযোগই দিচ্ছে না। বিষয় একটিই— মৃত্যুর পর কী ঘটনা ঘটে। আত্মা কি ফিরে আসে?
সক্রেটিস এই ব্যাপারে আজ একেবারে নিঃসন্দেহ। আত্মা ফিরে আসে। নতুন করে নতুন দেহে এই পৃথিবীতে ফিরে আসে। অন্য সময় আলোচনায় সক্রেটিস শেষ কথা বলেন না। তিনি শুধু প্রশ্ন করেন। প্রশ্ন থেকেই সমাধান বের হয়। আজ তিনি নিজেই শেষ কথা বলে দিচ্ছেন।
চলছে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। হঠাৎ সিবিস বলল, আপনি তো সারা জীবন প্রশ্ন করলেন, এত প্রশ্ন করে লাভ কী হলো?
সক্রেটিস মিষ্টি স্বরে বললেন, এই প্রশ্নের পর প্রশ্নকে ওরা বলে ‘সক্রেটিক মেথড’। এই মেথডে প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সত্য বের হয়ে আসে, তাতে আমাদের সবার লাভ। তবে আমার অন্য একটি লাভ আছে। প্রশ্ন করে করে যখন সত্যটা বুঝতে পারি, তখন আমি শুদ্ধ হই, আমার ভেতরের অশুভ বস্তু বের হয়ে যায়, আমি নতুন করে জেগে উঠি, পরিশুদ্ধ হই।
কে বলবে— এই মানুষটা একটু পরে বিষ পান করবে। বিষের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নীল হয়ে যাবে। তার কোনো রকম চিন্তা হচ্ছে বলে মনে হয় না।
কাল রাতে তিনি ভয় পেয়েছিলেন। জেনিথিপিকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করছিলেন, বিষে কি সারা শরীর নীল হয়ে যায়? জেনথিপি বলেছিলেন, এই বিষে বেশি নীল হয় না। তবে ভয়ে নাকি অনেকেই খেতে পারে না। খাওয়ার সময় বমি করে দেয়। হেমলক নাকি খুবই বিস্বাদ।
বিষের স্বাদ কেমন? এর উত্তর কি কেউ জানে? বিষ খেয়ে বেঁচে আছে এমন কেউ ছাড়া এর উত্তর দিতে পারবে না। এটি নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। কাল রাতে ভয় করছিল। আজ আর কোনো ভয় করছে না।
ভয় না করার কারণ সক্রেটিস জানেন। তরুণরা সামনে থাকলে তিনি অন্য রকম। তরুণদের সামনের সক্রেটিসই আসল সক্রেটিস। তখন তার রক্ত টগবগ করে ওঠে। ফুঁ দিয়ে সবকিছু উড়িয়ে দিতে পারেন।
বেলা পড়ে এসেছে। সময় শেষ হয়ে এলো।
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে সক্রেটিস বললেন, ট্র্যাজেডি নাটকের শেষ দৃশ্যে নায়করা বলে, ‘ভাইয়েরা, নিয়তির ডাক এসে গেছে’। আমি কি সে রকম কিছু বলব?
সবাই চুপ।
সক্রেটিস বললেন, আমি গোসল করব। দেহ-মন পবিত্র হবে। পবিত্র শরীরে বিষ খাব। মৃত্যুর পর আর গোসল করানো লাগবে না। মহিলাদেরকে একটি মৃতদেহ গোসল করানোর কষ্ট দিতে চাই না।
ক্রিতো বললেন, আমাদের জন্য আর কোনো আদেশ আছে?
সক্রেটিস বললেন, নতুন কিছু নয়। যা সব সময় বলি, নিজেকে জানো। নিজেকে জানতে পারলেই সুন্দর জীবন হবে।
ক্রিতো বললেন, কথা দিলাম— আমরা সবাই চেষ্টা করব। এখন বলো— তোমার দেহ কীভাবে সৎকার হবে?
‘তোমাদের যা খুশি। কবর দিতে পার। দাহও করতে পার। তখন তো আমি আর সক্রেটিস থাকব না। হয়ে যাব লাশ। তুমি আগুনে জ্বালো আর কবরে শোয়াও, লাশ লাফ দিয়ে বলবে না যে— ঐ ক্রিতো, তুমি সক্রেটিসকে এটি করেছ কেন? তাই যা ভালো মনে কর নিশ্চিন্তে করো।’
জেনথিপিকে নিয়ে আসার জন্য ক্রিতোকে বললেন সক্রেটিস। তারপর গোসলখানায় ঢুকে গেলেন।
.
কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনথিপি চলে এলেন। সাথে তাদের তিন ছেলে এবং পাড়ার মেয়েরা। সক্রেটিস ছেলেদের জড়িয়ে ধরলেন। তাদের মাথায় হাত রাখলেন।
জেনথিপিকে কী বলবেন বুঝতে পারছেন না সক্রেটিস।
সময় বেশি নেই। ঠিক সূর্যাস্তের পরেই বিষ খেতে হবে। কিছুক্ষণ নীরবে কেটে গেল। কিছু না বলেই অনেক কিছু বলছেন দুজনে।
জেনিথিপি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কোনো গন্ধ পাচ্ছেন?
সক্রেটিস বললেন, গন্ধ? জেলের কুঠুরি অপরিষ্কার। গন্ধ তো হবেই।
‘না না, অন্য রকম গন্ধ। একটি মরণ মরণ গন্ধ।’
‘মরণ মরণ গন্ধ? তুমি ভুল-ভাল দেখছ। ভুল গন্ধ পাচ্ছ। বেশি চিন্তা কোরো না। শোনো, হেমলকের গন্ধ হলো ইঁদুরের মতো গন্ধ। মরণ গন্ধ বলতে কোনো জিনিস নেই।’
এই কথাটা বলার কিছুক্ষণ পরেই সক্রেটিস কেমন একটা গন্ধ পেতে শুরু করলেন। রাগ হলো জেনথিপির উপর। কী সব গন্ধের কথা বলে তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে! এসব মন থেকে দূরে রাখতে তিনি ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। ক্রিতোকে ডেকে ছেলেদের নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা আরম্ভ করলেন।
জেনথিপি কাঁদছেন। কখনো আস্তে, কখনো জোরে।
সক্রেটিস ভাবছেন তিনি মারা যাওয়ার পর জেনথিপি যে চিৎকার করে কাঁদবে, তাতে মানুষের কাছে সম্মান যাবে। তার চেয়ে জেনথিপি মেয়েদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যাক।
কথাটা ভয়ে ভয়ে বলতেই জেনথিপি রাজি হয়ে গেলেন। তিনি নিঃশব্দে বের হয়ে গেলেন। তার চোখে কোনো পানি নেই। নেই কোনো অভিমান আর কিছুক্ষণ পরে তার স্বামী চিরতরে চলে যাবেন। স্বামীর মৃত্যুর সময় তিনি সামনে থাকবেন না। তার তেত্রিশ বছরের সংসার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনটি নাবালক সন্তান নিয়ে কীভাবে চলবে, তাও জানেন না। তবু জেনথিপি নীরবে বের হয়ে যাচ্ছেন। কারাগারের ছোট্ট কুঠুরিরে রয়ে যাচ্ছে তার সংসারের শেষ চিহ্ন। সেই চিহ্ন পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছেন জেনথিপি। জেলখানার বাইরে এখন অনেক লোক। সবাই সক্রেটিসের মৃত্যুর খবর নিতে এসেছে। তাদের সামনে দিয়ে নীরবে হেঁটে যাচ্ছেন জেনথিপি।
সক্রেটিসের মৃত্যুর সময় জেনথিপির না থাকলেও চলবে। সক্রেটিস সারা জীবন মানুষের জন্য ভেবেছেন। মানুষের জীবন সুন্দর করতে চেয়েছেন। তাই তার জীবনের শেষ মুহূর্তের সাক্ষী থাকুক হাজারো মানুষ। সেখানে জেনথিপির কোনো প্রয়োজন নেই। জেনথিপি একবার পেছন ফিরে তাকালেন। যদি একবার সক্রেটিসকে দেখা যায়! না, এখান থেকে জেলখানার ছোট্ট কুঠুরির ভেতরে সক্রেটিসকে দেখা যায় না। এবার বুক ফেটে কান্না এলো জেনথিপির এই জীবনে স্বামীকে আর জীবিত দেখতে পাবেন না। স্বামীর সাথে তার হিসাব-নিকাশ শেষ হয়ে গেছে। তিনি চারদিকে তাকালেন। জেলখানার বাইরে শত শত মানুষ। তাদের সবার মুখে একটিই শব্দ— সক্রেটিস। অনেকেই কান্না শুরু করে দিয়েছে। তাদের অশ্রুভরা মুখের দিকে তাকিয়ে জেনথিপির মনে হলো— যে মানুষটির জন্য এত লোক কাঁদছে, তিনি নিশ্চয়ই এই মানুষদের কিছু না কিছু দিয়েছেন। তাহলে সক্রেটিসের সুন্দর জীবনের সাধনা সার্থক হয়েছে। তার জন্য সবাই কাঁদছে। এখানে সবাইকে দেখিয়ে জেনথিপির কান্নার দরকার নেই। জেনথিপি ভেতরে ভেতরে কাঁদছেন। সেই কান্না তার একান্ত কান্না। সেই কান্না কেউ দেখবে না। জেনথিপি আকাশের দিকে তাকালেন। দিন প্ৰায় শেষ।
হেমলক পানের সময় হয়ে এসেছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। জেলখানার বিষ- জল্লাদ হেমলক নিয়ে হাজির। তার হাত কাঁপছে। তার থেকে হেমলকের পেয়ালাটি নিলেন সক্রেটিস। তার হাত একটুও কাঁপছে না।
এক্ষুনি গিলে ফেলতে হবে।
সারা ঘর স্তব্ধ। একেবারে নীরব। মনে হচ্ছে জেলের ছোট্ট কুঠুরির বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ নিশ্বাসও নিচ্ছে না। মনে হচ্ছে এথেন্সের দেবতারাও চুপ হয়ে গেছেন। দেবতাদের নাম করে সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। ধর্মের নামে প্রাণ নেওয়া হচ্ছে এমন এক মানুষের যিনি সারা জীবন মানুষকে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ন্যায় পথে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
সক্রেটিস হেমলক ভরা পেয়ালার দিকে তাকালেন। তরল হেমলকের উপর তার মুখের ছবি ভেসে উঠেছে। সেই মুখে তাকাতেই মনে হলো হেমলকের উপর ভেসে উঠেছে তার সারা জীবন। তিনি দেখছেন— একলা পাহাড়ের ঢালে বসে মানুষের জন্য চিন্তা করছেন সক্রেটিস, এথেন্সের পথে পথে খালি পায়ে তরুণদের বোঝাচ্ছেন, সুন্দর জীবনের উপায় বলছেন। হেমলক পাত্রে একের পর এক দৃশ্য ভেসে উঠছে। মামলার ছবি, ক্রিতো, জেনথিপি, তার সন্তানদের মুখ সব ভেসে উঠছে। বিষ আয়না হয়ে উঠেছে। বিষ যেন কথা বলছে।
না না, এই দৃশ্য কিছুতেই দেখা যাবে না। কিছুতেই দুর্বল হওয়া যাবে না। সত্য ও ন্যায়ের জন্য সারা জীবন কাজ করেছি। হাসি মুখেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেব। তিনি হেমলক বিষ থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। তারপর পাত্রটি মুখে কাছের নিতেই একটি তীব্র গন্ধ পেলেন। বিষের গন্ধ? নাকি এটিই মৃত্যুর গন্ধ? তিনি আর কিছু ভাববেন না। বিষের বাটি ঠোঁটে ছোঁয়ালেন। তারপর দম বন্ধ করে এক চুমুকে শেষ করে দিলেন। তার মুখ একটু বাঁকাল না। কোনো শব্দ করলেন না। বিষের বাটি খালি করে দিলেন।
সবাই হায় হায় করে উঠল। সবাই কেঁদে ফেলল। এপোলোদোরাস চিৎকার করে কাঁদছে। তার সাথে সবাই যোগ দিয়েছে। ক্রিতোও শব্দ করে কাঁদছেন। ফিদো চোখ ঢেকে ফোঁপাচ্ছে। এতক্ষণে কান্নার কোরাস শুরু হয়েছে। এই কান্না কি মধুর? সবাই তার জন্য কাঁদছে। প্রিয়জনের কান্না দেখতে দেখতে মরতে পারা অবশ্যই ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু কান্না তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। হয়তো তিনিও কেঁদে ফেলবেন। সেটি হতে দেওয়া যাবে না।
তিনি ধমক দিয়ে বললেন, কী করছ তোমরা? এমন কিছু করবে বলেই আমি জেনথিপিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমরাও অমন শুরু করলে? শান্ত হও, শক্ত হও।
কান্নার রোল একটু কমলো।
সক্রেটিস বিষ-জল্লাদকে বললেন, এবার আমায় কী করতে হবে?
জল্লাদ বলল, জোরে জোরে হাঁটতে হবে। যখন পা ভারী হয়ে আসবে তখন বিছানায় শুয়ে পড়তে হবে।
জল্লাদের কথা মতো সক্রেটিস হাঁটতে শুরু করলেন। এক পেট বিষ নিয়ে কারাগারের ছোট্ট ঘরে হাঁটছেন সক্রেটিস। প্রতি পদক্ষেপের সাথে পেটের বিষ ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। রক্তের শিরা-উপশিরা দিয়ে বিষ যাচ্ছে। বিষের যাওয়া তিনি টের পাচ্ছেন। তার বুক জ্বলছে। হাত-পা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাউকে কিচ্ছু বলছেন না। শান্তভাবে হাঁটছেন। অনেক কষ্টে মুখ চেপে রেখেছেন। এই বুঝি আর্তনাদ করে উঠবেন। মনে হচ্ছে, আর চলতে পারছেন না। পা দুটো ভারী হয়ে আসছে। শরীর অবশ অবশ লাগছে।
সক্রেটিস বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
জল্লাদ তার পায়ের পাতায় চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করল, টের পাচ্ছেন?
সক্রেটিস বললেন, না।
জল্লাদ চাপ দিতে দিতে পায়ের উপরের দিকে উঠতে লাগল। সক্রেটিস টের পাচ্ছেন না। তার পা অবশ হয়ে গেছে। শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
জল্লাদ বলল, বিষ হৃদপিণ্ডে পৌঁছে গেছে। আর দেরি নেই। সময় শেষ হয়ে এলো।
সক্রেটিসের বুক এখন তীব্রভাবে জ্বলছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর কে যেন আগুন জ্বেলে দিয়েছে। তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না। জোরে জোরে বাতাস টানছেন। এখন শুধু বুক ওঠানামা করছে। কোমর পর্যন্ত অবশ হয়ে গেছে। তিনি দাঁত চেপে আছেন। হঠাৎ মনে হচ্ছে আর পারছেন না, আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন।
সবাই সজোরে কেঁদে উঠল। এই বুঝি শেষ। সকলের দৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ কাপড় সরিয়ে মুখ বের করলেন সক্রেটিস। স্পষ্ট স্বরে বললেন, ক্রিতো, সুস্থতার দেবতা এসক্লিপিয়াস আমাদের কাছে একটি মুরগি পাবে। তাকে দিয়ে দিও, ভুলো না কিন্তু।
এথেন্সের ধর্মভীরু মানুষেরা মৃত্যুর পরে আত্মার মুক্তির জন্য সুস্থতার দেবতাকে মুরগি উপহার দেয়। দেবতা খুশি হয়ে আত্মাকে মুক্ত করে দেন।
ক্রিতো ভাবছেন— সক্রেটিস দেবতাকে মুরগি উপহার দিতে বলছেন? এথেন্সের মানুষ বিচার করে প্রমাণ করেছে যে, সক্রেটিস দেবতা মানেন না, তিনি নাস্তিক। অথচ মৃত্যুর পূর্বে সক্রেটিস পুরোপুরি ধার্মিকের মতো বলছেন, আমি মরলে মনে করে দেবতাকে একটি মুরগি দিও। এর মানে কী? সক্রেটিস কী বোঝাতে চাইছেন যে, তিনি দেবতাদের অপমান করেন নি? তিনি নাস্তিক নন? নাকি তিনি সারা জীবন যেমন সবকিছু নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন, তেমনই এটিও তার ব্যঙ্গ? মরার আগেও কি তিনি এথেন্সের বিচার আর ধর্মের নামে অধর্মকে ব্যঙ্গ করে গেলেন?
এর উত্তর ক্রিতো জানেন না। সক্রেটিস ছাড়া আর কেউ জানেন না। অন্য সময় হলে ক্রিতো অবশ্যই সক্রেটিসকে জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু যে মানুষটি হেমলক পান করে বিষের জ্বালায় মুখ ঢেকে ছটফট করছেন, তাকে এসব প্রশ্ন করা যায় না।
ক্রিতো বললেন, অবশ্যই দেবতাকে মুরগি দেওয়া হবে, ভুল হবে না। আর কিছু বলবে, সক্রেটিস?
সক্রেটিসের কোনো সাড়া নেই। মুখটা কাপড়ে ঢাকা। সময়ের জলঘড়ি বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় চুইয়ে পড়ছে সময়। সবাই তাকিয়ে আছে পলকহীন।
হঠাৎ তীব্রভাবে নড়ে উঠল সক্রেটিসের বিছানা। হাত,পা উপরের দিকে উঠে আসছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি তিনি বিছানা থেকে পড়ে যাবেন। মুখ তখনও ঢাকা। তারপর হঠাৎই সব নীরব। সব স্তব্ধ।
বিষ-জল্লাদ কাঁপা কাঁপা হাতে সক্রেটিসের মুখ থেকে কাপড় সরালেন। সক্রেটিসের চক্ষু পাথরের মতো স্থির। মুখ হা করে আছেন।
ক্রিতো সক্রেটিসের চোখ আর মুখ বন্ধ করে দিলেন। বিদায় নিলেন পৃথিবীর মহত্তম মানুষ। বিদায় নিলেন পৃথিবীর প্রথম শহিদ; যিনি পৃথিবীতে সত্য, ন্যায় আর বাকস্বাধীনতাকে প্রথম স্পর্শ করেছিলেন।
সারা ঘরে কান্নার রোল। সক্রেটিসের সব বন্ধু একসাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। আকাশ স্তব্ধ হয়ে গেছে। জেলখানার ভেতর প্রতিটি মানুষ কাঁদছে। বিষ-জল্লাদ বিলাপ করছে। জেলার সাহেব মাথা নিচু করে আছেন। তার চোখ দিয়ে নিঃশব্দে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা পানি। জেলখানার বাইরে শত শত মানুষ— সবার চোখে পানি। এথেন্সের গণতন্ত্রের অশ্রু ঝরছে, সংসদের প্রতিটি পাথর কাঁদছে। বিচারকক্ষ, জলঘড়ি সব নিশ্চুপ হয়ে আছে। যেসব বিচারক সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, আজ তারাই সবচেয়ে বেশি কাঁদছেন।
ক্রিতো তাকিয়ে আছেন সক্রেটিসের মুখখানার দিকে। এই মুখ সারা জীবন সত্য আর সুন্দরের কথা বলে গেছেন, ভালোবাসার কথা বলে গেছেন। কিন্তু একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেননি। মরার পর সক্রেটিসের দেহ মাটি দেওয়া হবে, নাকি পোড়ানো হবে— সেই সিদ্ধান্ত সক্রেটিস ক্রিতোকে বলেননি। এটি ক্রিতোর উপর দিয়ে গেছেন। কিন্তু এই বিশাল সিদ্ধান্ত ক্ৰিতো কীভাবে নেবেন? এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ একজনই আছেন, তিনি হলেন জেনথিপি।
কিন্তু কোথায় জেনথিপি? মৃত্যুর আগে সক্রেটিস তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সবাই ভেবেছিল জেনথিপি চিৎকার করে কাঁদবেন। কিন্তু জেনথিপি কাঁদেননি। বাড়ি ফিরে তিনি শুভ্র কাপড় পরে কিছুক্ষণ বসে ছিলেন উঠানের জলপাই গাছের নিচে। এখন চলছেন কেরামিকাসের পথে। কেরামিকাসে এথেন্সের সমাধি। সেখানেই নিয়ে যাওয়া হবে সক্রেটিসের দেহ। পোড়ানো নাকি কবর? সেই সিদ্ধান্ত শুধুই জেনথিপির। সক্রেটিসের জীবনের কোনো সিদ্ধান্তই জেনথিপি নেননি। এই শেষ সিদ্ধান্তটি তিনিই নিবেন।
সক্রেটিসের দেহ চলেছে সমাধির পথে। আঁধারের ঘোমটা মাথায় দিয়ে জেনথিপিও হাঁটছেন সমাধির দিকে। তিনি কাঁদছেন না। শুধু তার পায়ে পায়ে কাঁদছে কতগুলো শুকনো জলপাই পাতা। সন্ধ্যার আঁধার ছাপিয়ে একটি পাখি নিদারুণ করুণ সুরে ডাকছে। পাখির কণ্ঠে দুনিয়ার সমস্ত বিরহ ঝরে ঝরে পড়ছে। এজিয়ান সাগরের উষ্ণ বাতাস ভিজে উঠেছে। মহাকালের গহ্বর থেকে ভেসে আসছে অচেনা একটি মরণ-মরণ গন্ধ।
একটি অবিনশ্বর মৃত্যুর জ্যোতি নিয়ে অদ্ভুত আঁধার নামছে পৃথিবীতে। সেই আঁধারের গা বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় চুইয়ে পড়ছে মৃত্যু। মহাবিশ্বের মহত্ত্বম কান্নায় ভিজে যাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত আলো। মরণ সাগরের উপর দিয়ে অনাগত কালের পথ-সন্ধানী মানুষের জন্য নিমন্ত্রণ নিয়ে আসছে একটি পাখি— পাখিটির ঠোঁটে এক পেয়ালা হেমলক।
***
১৩৯. সক্রেটিসের মৃত্যুদৃশ্য নিয়ে প্লেটোর বিখ্যাত বই ফিদো (Phaedo).
১৪০. আত্মা সম্পর্কে সক্রেটিসের এই মত প্লেটো তার Phaedo (ফিদো) গ্রন্থে বিস্তারিত দিয়েছেন।
***
সমাপ্ত