৫৬
‘যে অকপটে নির্মম সত্য বলে দেয়,
সে সকলের ঘৃণার পাত্ৰ হয়।’
—প্লেটো
***
সূর্য উঠি উঠি করছে।
বাইরে একটু একটু দিনের আলো ফুটেছে। কিন্তু কারাগারের ছোট্ট ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
সক্রেটিস ভোরের ঘুম ঘুমাচ্ছেন। আজ তার কারাবাসের এক মাস পূর্ণ হলো। সারা জীবন তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছেন। কিন্তু গত এক মাসে সেই অভ্যাস বদলে গেছে। এখানে ভোরের আলো আসে না। তাই ঘুমও ভাঙে না। প্রায়ই অন্য কেউ এসে ঘুম ভাঙায়।
সক্রেটিস ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু ঘুম গাঢ় নয়। তার চোখের পাতা কাঁপছে দ্রুত কাঁপছে।
সক্রেটিস স্বপ্ন দেখছেন— অপূর্ব এক নারী। শুভ্র একটি ওড়না জড়ানো। নারীটি ফিসফিস করে বলছে, সক্রেটিস, তুমি এসো। আমি অপেক্ষা করছি। এসো সক্রেটিস, আজ থেকে তিন দিনের দিন তুমি এই সুন্দর জায়গাটায় চলে এসো। এসো, এসো …
আর কিছু শুনতে পাচ্ছেন না সক্রেটিস। তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। তিনি বুঝতে চাইছেন কণ্ঠটা কার। অমন করে কে ডাকছে! তিনি জোর করে চোখ বন্ধ করে রাখছেন, মেয়েটির কণ্ঠ আবার শুনতে ইচ্ছে করছে। সে কণ্ঠে ভয় আছে, আহ্বান আছে, মনে হয় একটু প্রেমও আছে।
স্বপ্নের শব্দগুলো পরিচিত। এরকম শব্দ তিনি শুনেছেন। মনে পড়ল— হোমারের ইলিয়াডের কাহিনিতে বীর একিলিসকে তার মা থেটিস বলেছিলেন, ‘আজ থেকে তিন দিনের দিন তুমি চলে এসো’। সেটি ছিল একিলিসের জন্য মৃত্যুবার্তা। তার তিন দিন পরে ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিসের তীর তার পায়ে আঘাত করে। একিলিসের মৃত্যু হয়।
তাহলে এই কণ্ঠ কি থেটিস এর? তিনি কি ডাক শুনলেন? তার কি দিন ঘনিয়ে এসেছে? আজ থেকে তিন দিনের মাথায় চলে যেতে বলছে?
ধরফর করে উঠলেন সক্রেটিস। চোখ মেলে দেখলেন, তার সামনে শুভ্রবসনা নারী থেটিস না, বসে আছেন এক বুড়ো লোক। বুড়োটা হলেন তার আশৈশব বন্ধু ক্রিতো।
চোখ ঘষতে ঘষতে বললেন, দেখো, কারাগারে কতই শান্তি। গভীর ঘুম দিচ্ছি। সকালে উঠতেও পারি না। কখন এসেছ?
ক্রিতো বললেন, অনেকক্ষণ।
‘বেলা অনেক হয়ে গেছে?’
‘না, না, বেলা হয়নি। বাইরে মাত্র আলো ফুটতে শুরু করেছে।’
‘তাহলে তুমি কীভাবে ঢুকলে? এত সকালে তোমাকে ঢুকতে দিল?’
‘ঢুকতে মাত্র কয়েক ড্রাকমা খরচ হয়েছে।’
‘ঘুষ দিয়ে আমাকে দেখতে এসেছ ক্রিতো? গত এক মাস এরকমই করছো নাকি?’
‘ওসব নিয়ে তুমি ভাবছ কেন? আমাদের দরকারে আমরা আসি। যেভাবে পারি, সেভাবেই আসি।’
আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসলেন সক্রেটিস। বললেন, এত আগে এসেছ, আমাকে জাগালে না কেন?
‘নিদ্রামগ্ন মানুষকে জাগানো ঠিক নয়। দেবতারা বেজার হন।’
‘না জাগিয়ে ভালোই করেছ। আমি একটি স্বপ্ন দেখছিলাম। ‘ ‘হ্যাঁ, তোমার চোখের পাতা কাঁপছিল।’
‘স্বপ্নে দেখলাম— বীর একিলিসের মা থেটিস আমাকে ডাকছেন। যেভাবে হোমারের ইলিয়াদে একিলিসকে ডাক দিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবে ডাকছেন। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। আমার মনে হয় যাওয়ার দিন চলে এসেছে। এবার আমার কারাবাস শেষ হবে।’
হঠাৎ সক্রেটিসের মনে হলো আজ এত সকালে ক্ৰিতো কেন এসেছে? একেবারে সূর্য ওঠার আগে! নিশ্চয়ই কারণ আছে। সেই সাথে অমন স্বপ্ন! একেবারে স্পষ্ট। তাকে ডাকছে। মনে হচ্ছে এখনও ডাক শুনতে পাচ্ছেন। নিশ্চয়ই ঘটনা আছে।
তিনি বললেন, ক্রিতো, জাহাজ কি ফিরে এসেছে?
‘এখনও না। তবে আজই ভিড়বে। গতকাল সন্ধ্যায় সোনিওতে এসেছে। যেভাবে বাতাস বইছে, তাতে আজ বিকেল নাগাদ সোনিও থেকে এথেন্সে চলে আসবে।’
‘বাহ, খুব ভালো খবর। অপেক্ষার দিন তাহলে ফুরাচ্ছে। তবে আমার মনে হয় আজ আসবে না। কাল আসবে।’
‘আমার আগে কেউ তোমাকে খবর দিয়েছে?’
‘হ্যাঁ, স্বপ্নে খবর পেলাম। বললেন, তিন দিনের মাথায় আমার সাথে দেখা হবে। সেই হিসেবে, জাহাজ আসবে কালকে। আর আমার মৃত্যু হবে পরশু। তার আগে হবে নয়।’
ক্রিতো একটু থেমে চারদিকে তাকালেন। সক্রেটিস খাটে বসেছিল। ক্ৰিতো চুপ করে মেঝেতে তার পায়ের কাছে বসলেন। খুব নিচু গলায় সক্রেটিসের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, শোন, আমি যা বলি মন দিয়ে শোন।
‘বলো।’
‘আমার কাছে যে খবর আছে, তাতে জাহাজ আজই আসবে।’
‘না, জাহাজ কাল আসবে। পরশুর আগে আমার মরণ নেই।’
‘ঠিক আছে, মানলাম। জাহাজ যেদিনই আসুক, আমাদের হাতে সময় নেই।’
‘কী বলছ? আমার হাতে পাক্কা তিনটা দিন আছে।’
‘সক্রেটিস, যা করার এই সময়েই করতে হবে।’
‘কী করতে হবে?’
‘তোমাকে মরলে চলবে না।’
‘মানে কী?’
‘মানে তুমি এখান থেকে চলে যাবে।’
‘আমাকে পালাতে বলছো?’
‘আস্তে বলো। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আজ রাতেই যা করার করতে হবে।’
‘ক্রিতো, কী বলছ তুমি!’
‘হ্যাঁ, সেজন্যই আমি এত সকালে এসেছি। আর একটু পরেই তোমার কাছে লোক আসতে থাকবে। তোমার কারাগার হয়ে যাবে দর্শনের স্কুল। তখন আর এসব কথা বলা যাবে না। তুমি তৈরি হও।’
‘ক্রিতো, তুমি কি বুঝতে পারছ, তুমি কী বলছ?’
‘আমি সব বুঝতে পারছি। আমরা আলাপ করেই এই ব্যবস্থা করেছি। প্লেটো আর ফিদোর সাথে কথা বলেই করেছি। শুধু ওরাই নয়, সবাই চায় তোমাকে বাঁচাতে। এথেন্সের বাইরে থেকেও লোক এসেছে তোমাকে বাঁচাতে।
‘কে কে এসেছে?’
‘থিবস থেকে এসেছে সিমিয়াস আর সিবিস। তারা টাকা নিয়ে এসেছে। আরও অনেকে খবর দিয়েছে, যা লাগে তারা দেবে। টাকা কোনো সমস্যা নয়।’
‘সমস্যা তাহলে কী?’
‘কোনো সমস্যা নাই। সব পাকা হয়ে গেছে। এখন আমি যেভাবে বলি, তুমি শুধু আজ রাতে সেরকম করবে।’
‘কত টাকায় রফা করেছ?’
‘সেটি দিয়ে তুমি কি করবে? টাকার অংক বেশি নয়।’
‘বলোই না। সক্রেটিসের জীবনে দাম কত শুনতে ইচ্ছে করছে।’
‘ত্যাড়ামি বাদ দাও। সারা জীবন ত্যাড়ামি করেছ। এটি তোমার জীবনের দাম না। এটি কারারক্ষীর সততার দাম। আমি একাই সব দিয়ে দিতে চেয়েছি। কিন্তু প্লেটো আর ফিদো রাজি নয়, তারাও টাকা দেবে। তোমাকে রক্ষার কৃতিত্ব আমাকে একলা দিতে তারা রাজি নয়।’
‘বুঝলাম। তোমরা বিরাট কাজ করেছ। এবার আমি যা বলি, শোন।
‘শুনাশুনি শেষ। সব চূড়ান্ত হয়ে গেছে। তুমি আজ রাতে থেসালি চলে যাবে। সেখানে আমার বাড়ি কেনা আছে। ভাবী আর ছেলেমেয়েরা তোমার আগেই সেখানে পৌঁছে যাবে।’
‘জেনথিপিও রাজি হয়ে গেছে? এত বুদ্ধি সে কোথায় পেল? সারা জীবন তো সে ছিল বোকাস্য বোকা।’
‘স্বামীর জীবন বাঁচাতে যদি বোকাস্য বোকা হতে হয়, তাহলে জেনথিপির মতো বোকা মহিলাই ভালো। শোন, কাজের কথায় আসি। আজ রাতের পরিকল্পনা শোন।’
‘উঠে দাঁড়ালেন সক্রেটিস। বললেন, একটু হাত-মুখ ধুয়ে আসি।’
ক্রিতো বুঝলেন, সক্রেটিস তার পরিকল্পনা শুনবেন না। তিনি কথা ঘুরাতে উঠে গেলেন। ক্রিতোর খুব অসহায় লাগল। তিনি কারাগারের দেয়ালে তাকিয়ে রইলেন।
অনেকক্ষণ পরে মুখ মুছতে মুছতে খাটে এসে বসলেন সক্রেটিস। ক্রিতোর হাত ধরে বললেন, তোমার মতো বন্ধু আছে বলেই, জীবন এত মূল্যবান। কিন্তু বল তো, আমি পালিয়ে কোথায় যাব?
‘থেসালি।’
‘সেখানে আমার পরিচয় কী হবে?’
‘তোমাকে সারা পৃথিবীর মানুষ একজন জ্ঞানী মানুষ হিসেবে জানে।’
‘হুঁম, কিন্তু থেসালিতে পালিয়ে গেলে সেখানে আমি হব একজন জেল-
পালানো আসাটি। একজন ফেরারি।’
‘একদিন সবাই সত্য জানবে। সবাই এথেন্সের মানুষের মতো বেকুব নয়।’
‘তুমি আমাকে পলাতকের মতো বেঁচে থাকতে বলছো? সারাজীবন বলে এসেছি শুধু বেঁচে থাকা কোনো কাজের কথা নয়, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকাটাই আসল কথা।’
‘তোমার ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর কথা ভাবো। তুমি থাকলে ওরা মানুষ হবে। পিতার স্নেহ পাবে।’
সক্রেটিসের মুখ থমথমে হয়ে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল তিনটি মুখ। তিনজনের মধ্যে ছোট দুই সন্তান এখনও খুবই ছোট। ছোটটি তো দুধের বাচ্চা। তার চোখ পানিতে ভরে উঠছে। চেষ্টা করেও পানি থামাতে পারছেন না। কান্না লুকাতে হাঁটতে শুরু করলেন সক্রেটিস। হঠাৎ ক্রিতোর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভাই, ছেলেগুলোকে দেখে রেখো।
‘মানে?’
‘মানে, আমি কোনো দিনই পালাতে পারব না।’
‘কেন?’
‘জীবন অনেক সাধের জিনিস। পরিবারও অনেক দামি। কিন্তু সত্য ও ন্যায়ের চেয়ে বেশি নয়। আমি সারাজীবন সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছি। তোমাদেরকে সব সময় ন্যায় পথে থাকতে বলেছি। তাই না?’
‘হুঁম।’
‘তাহলে আজ বিপদে পড়ে সেই পথ থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত নয়। সেটি অন্যায় হবে। আমি কোনো অবস্থায়ই অন্যায় করব না।’
‘না, তুমি অন্যায় করবে না। শুধু তোমার উপর যে অন্যায় হয়েছে, তুমি সেটির প্রতিকার করবে। এই নগর তোমার সাথে অন্যায় করেছে। সেই অন্যায়কে থামাতে তুমি পালিয়ে যাবে।’
‘না, ক্রিতো। কেউ অন্যায় করলেও, বিনিময়ে তার প্রতি অন্যায় করা যায় না। অন্যায়ের বদলে অন্যায় কোনো সমাধান নয়। খারাপের বদলে খারাপ কাজ করা যায় না।’[১৩৮]
ক্রিতো উত্তর করতে চান না। যুক্তিতে সক্রেটিস সারা জীবনে কারও কাছে হারেননি। তার সাথে তর্ক করে জেতার আশা ক্রিতোর নেই। ক্রিতো যুক্তি দিতে আসেননি। তিনি এসেছেন বন্ধুকে বাঁচাতে। এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষকে বাঁচাতে। তিনি আবেগ দিয়ে সক্রেটিসকে রাজি করাতে এসেছেন।
কিন্তু সক্রেটিসের কাছে আবেগের কোনো দাম নেই। তিনি আবেগ বোঝেন না। বোঝেন শুধু যুক্তি। বোঝেন প্রশ্ন আর পাল্টা প্রশ্ন। মরার আগেও সক্রেটিস তার প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলা ছাড়ছেন না। কিন্তু এই প্রশ্নখেলায় এখন জড়াতে চান না ক্রিতো। তিনি জানেন, তিনি পারবেন না।
তিনি এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, নিজের জীবনের জন্য না হোক, আমাকে লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্য তুমি পালাও।
‘তোমার লজ্জা?’
‘হ্যাঁ। সবাই বলাবলি করছে টাকা দিলেই কারাগার থেকে পালানো যায়। ক্রিতো টাকা দিলেই সক্রেটিস বেঁচে যাবে। কেউ বিশ্বাস করবে না যে তুমি নিজের ইচ্ছায় মৃত্যুকে বেছে নিয়েছ। সবাই বলবে- ক্রিতো টাকা দেয়নি, তাই সক্রেটিস মরেছে। আমাকে শরমে ফেলো না।’
‘মানুষ তো কত কিছুই ভাবে। সাধারণ মানুষ নিয়ে এত ভাবলে হবে না।’
‘সাধারণ মানুষদের বাদ দেওয়া যাবে না। তোমার বিচার করেছে সাধারণ মানুষ। এখন তোমাকে মেরে ফেলছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ ও অসাধারণ কাজ করতে পারে। তারা বিপদেও ফেলতে পারে।’
‘হ্যাঁ, কিছু সাধারণ মানুষ আমার ওপর অন্যায় করেছে। কিন্তু তার প্রতিদানে যদি আমি পালিয়ে যাই, সেটিও অন্যায় হবে। নিজে অন্যায় করার চেয়ে অন্যায় সহ্য করা ভালো।’
ক্রিতো চুপ করে লক্ষ করল সক্রেটিস কী সুন্দর সুন্দর কথা বলছেন! ‘অন্যায়ের বদলে অন্যায় কোনো সমাধান নয়’। ‘নিজে অন্যায় করার চেয়ে অন্যায় সহ্য করা ভালো। কী সুন্দর কথা! অন্য সময় হলে ক্রিতো কথাগুলো উপভোগ করতেন। কিন্তু এখন পারছেন না।
একটু থেমে ক্রিতো শক্ত গলায় বলল, এখন তুমি সেটিই করছ, যা তোমার শত্রুরা চাইছে। যখন নিজেকে রক্ষা করার উপায় আছে, তখন তুমি সেটি করছ না।
সক্রেটিস কিছু বললেন না।
ক্রিতো আবার বললেন, তুমি বলছো, তুমি পালাচ্ছ না। এটি মিথ্যা কথা তুমি আসলে পালাচ্ছ। তুমি জেল থেকে পালাচ্ছ না, কিন্তু জীবন থেকে পালাচ্ছ। তুমি সহজটা বেছে নিয়েছ। কিন্তু জীবন থেকে পালানোও লজ্জার। তুমি লজ্জা পাচ্ছ না, সক্রেটিস?
সক্রেটিস চুপ।
ক্রিতো প্রায় চিৎকার করে বললেন, তুমি সারা জীবন ত্যাড়ামি করেছ প্রথম যেদিন মামলা হলো, আমরা লিসিয়াসকে দিয়ে জবানবন্দি লেখালাম। তুমি আমার কথা শুনলে না। ত্যাড়ামি করে সেটি পড়লে না। আদালতে শুনানির দিনও আমাদের কথা রাখলে না। জিদ ধরে বললে, জরিমানা মাত্র এক মিনা। আজ শেষ সুযোগ। আজ রাতে আমার কথা শোন। এই রাত হোক সুবর্ণ রাত। এই রাত সক্রেটিসের জীবন রক্ষার রাত। চলো, জীবন বাঁচাই।
সক্রেটিস বললেন, ক্রিতো, যেদিন মামলার কথা শুনলাম, যেদিন আদালতে কথা বললাম, আর আজ; এই তিনটি দিনে তিনটি সময় বদলেছে। সত্য বদলায়নি। তাই সক্রেটিসও বদলায়নি। সত্যের জন্য সক্রেটিস সেদিন ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, আজও আছে। ক্রিতো, তুমি কোন সক্রেটিসকে ভালোবাসো? যে সক্রেটিস সত্যের জন্য সবকিছু করে, সেই সক্রেটিসকে। আজ আমাকে বাঁচাতে থিবস থেকে ওরা টাকা নিয়ে ছুটে এসেছে। কোন সক্রেটিসকে বাঁচাতে চায় ওরা? সেই সক্রেটিস, যে সারাজীবন সত্য থেকে নড়েনি। যদি গরমকালের সক্রেটিস আর শীতকালের সক্রেটিস আলাদা হতো, তাহলে ওরা বাঁচাতে আসত না। ক্রিতো, এভাবেই আমায় মরতে দাও। আমাকে পাল্টাতে বোলো না।
ক্রিতো উত্তর করতে পারছেন না।
.
অনেক ক্ষণ দুজনেই চুপ। হঠাৎ ক্রিতো কেঁদে ফেললেন, আমাদের ছেড়ে যেও না, বন্ধু। ছেড়ে যেও না।
সক্রেটিস বললেন, ক্রিতো, আমি যদি পালিয়ে যাই, তাহলে ঐ বিচারক যারা আমায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, তারা সঠিক বলে প্রমাণিত হবে। বলবে সক্রেটিস সত্যিই অপরাধী। তাই পালিয়ে গেছে।
ক্রিতো কোনো কথা বলতে পারছেন না। তার চোখে পানি।
সক্রেটিস দেখলেন ক্রিতো ফাঁপরে পড়ে গেছে। সে একটু হাল্কা করতে হাসতে হাসতে বললেন, আর একটি মজার বিষয় আছে। মজাটা হলো এই শহরের আইনের সাথে আমার একটি গোপন প্রেমচুক্তি আছে। আইন হলো আমার গোপন প্রেমিকা। আমি যেদিন ঠিক করলাম আমি সত্য পথে চলব, সেদিন থেকেই আমি নিজে আইন মানি। সবাইকে আইন মানতে বলি। এখন পালিয়ে গেলে, যদি কোনোদিন রাস্তায় আইন ব্যাটার সাথে দেখা হয়, সে জিজ্ঞেস করবে, কিরে সক্রেটিস, তুই তো কথা রাখিসনি। সেদিন বড় শরমিন্দা হব।
ক্রিতো বুঝলেন, সক্রেটিস মজা করছে। কিন্তু তিনি মজা করতে পারছেন না। তিনি এখনও গম্ভীর।
তাকে হাল্কা করতে সক্রেটিস আবার বললেন, ধরো আমি তোমার কথায় থেসালি পালিয়ে গেলাম। সেখানে পিচ্চি ছেলেরা আমাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘তা সক্রেটিস কাক্কু, আপনি তো জব্বর খেল দেখালেন। এথেন্সের জেল থেকে পালালেন। কেমনে ঘটালেন ঘটনাটা? কাহিনিখান একটু শুনাবেন?’ তখন আমি বিশাল সাসপেন্স নিয়ে বলব, ‘শোন বাবারা, ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। একটি শিয়ালের চামড়া আমাকে দিল ক্রিতো। দারোয়ান তো আগেই পয়সা খেয়েছে। আমি ফাঁকা দরজা দিয়ে শিয়ালের মতো বের হলাম। চার হাত-পায়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। তারপর ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ এক দৌড়ে থেসালি।’ এই কথা শুনে তারা হাততালি দিয়ে বলবে, ‘সক্রেটিস কাক্কু তো বুড়ো হাড্ডিতে জব্বর খেল দেখালেন।’
এবার ক্রিতো হেসে উঠলেন।
সক্রেটিস বললেন, বলো ক্রিতো, বুড়া হাড্ডিতে জব্বর খেল্ দেখানোর জন্য আমার পালানো উচিত?
ক্রিতো চুপ করে আছেন। এই প্রশ্নের উত্তর হয় না।
সক্রেটিস শান্তভাবে বললেন, ক্রিতো, আমার বয়স সত্তর। আমাকে মরতে দাও। আমি মরে গিয়ে জ্ঞানকে স্বাধীনতা দেব। জ্ঞানের জন্য মরতে পারে, এমন ভাগ্য কয়জনের হয় বলো? আমায় ডেকো না। ফেরাতে পারবে না। শুধু কষ্ট বাড়বে।
ক্রিতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। তার চোখে জল।
সক্রেটিস তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ক্রিতো, আমি সারা জীবন ভালো কিছুর জন্য কাজ করেছি। সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছি। নিজের বিচারে যা সত্য বলে জেনেছি, ন্যায় বলে বুঝেছি তাই করেছি। কারও কথায়ই তার নড়চড় হবে না, জীবন বাঁচাতেও নয়। কারণ আমি বিশ্বাস করি, সত্যের জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনো কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না, জীবনের জন্যও নয়।
ক্রিতো বুঝলেন ত্যাড়া সক্রেটিস সারা জীবন কথা রাখেননি। এবারও তিনি কথা রাখবেন না। সক্রেটিস কিছুতেই পালাবেন না।
ক্রিতো জেলখানা থেকে বের হলেন। আকাশের দিকে তাকালেন।
সামনে মানুষ আর মানুষ। আগোরার পথে পিঁপড়ার মতো হাঁটছে মানুষ সবাই ছুটছে। কেন ছুটছে? বাঁচার জন্য ছুটছে। সবাই বাঁচতে চায়। যেভাবেই হোক সবাই বেঁচে থাকতে চায়।
শুধু সক্রেটিসই আলাদা। তিনি যেনতেনভাবে বাঁচতে চান না। অসম্মানের বাঁচা তিনি বাঁচতে চান না। পালিয়ে যাওয়ার সব উপায় আছে, তবুও তিনি পালাচ্ছেন না।
ক্রিতো জীবনে অনেক মানুষের সুন্দর সুন্দর কথা শুনেছেন। মুখে অনেকেই ভালো ভালো কথা বলেন। কিন্তু মুখের কথাকে মেনে চলার জন্য জীবন দিতে পারেন, এরকম মানুষ পৃথিবীতে আছেন?
ক্রিতো ভাবছেন, একটি মানুষ কত বড় হলে, এমন করে মৃত্যুকে ডাকতে পারেন। সক্রেটিস আসলেই তার সময়ের সবচেয়ে মহৎ মানুষ।
সকলেই বদলায়, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বদলায়। কিন্তু সক্রেটিস বদলান না। নীতি ও সত্যের জন্য তিনি কোনোদিনই বদলাবেন না।
সক্রেটিস সারা জীবন একটি জিনিস খুঁজেছেন, সেটি হলো ‘সুন্দর জীবন’। এতদিনে ক্রিতোর মনে হলো এটিই বুঝি সক্রেটিসের সেই সুন্দর জীবন।
সারা দুনিয়া মিথ্যার পিছনে ছোটে। মিথ্যার অট্টালিকায় ভরে উঠে নগরের পর নগর। তবু দু’একজন মানুষ সত্যকে আঁকড়ে ধরে থাকেন। সেটিই তাদের সুন্দর জীবনের রহস্য। কেননা তারা পৃথিবীতে আসেন এক মুঠো আলো ছড়াতে। সেই আলো আকাশ-প্রদীপ হয়ে জ্বলতে থাকে। রয়ে যায় পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত।
কেউ তাদের সাথে খারাপ কিছু করলেও, তারা বিনিময়ে খারাপ করেন না। অন্যায়ের বদলে অন্যায় করেন না। ক্ষমা ও প্রেমমাখা একটি সুন্দর জীবন যাপন করতে করতে একদিন নীরবে পৃথিবী থেকে চলে যান।
***
১৩৮. জেল থেকে সক্রেটিসের পালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ নিয়ে ক্রিতোর সাথে তার আলাপ নিয়ে প্লেটো ক্ৰিতো (Crito) নামে একটি বই লিখেছেন, যে বইটি সক্রেটিসের দর্শনের জন্য একটি অমূল্য দলিল।