৫৪
‘পাতালে প্রেতাত্মাদের রাজা হওয়ার চেয়ে,
পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র মানুষটির দাস হয়ে হলেও
আমি পৃথিবীতেই থাকতে চাই।’
অডিসিয়াসের উদ্দেশ্যে একিলিস // হোমার
***
সক্রেটিস জেলে বন্দি।
তার হাতে পায়ে শিকল দেওয়া হয়েছে। একটি বেঞ্চের উপর বসে আছেন তিনি। সারা দিনের বিচারের পর ভীষণ ক্লান্ত। ভীষণ ক্ষুধার্ত। ক্ষুধা খুব জঘন্য জিনিস। মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও দূরে যায় না। তার শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখনও ঝামেলা শেষ হয়নি। এখন ঝামেলা হলো, সক্রেটিসকেই ঠিক করতে হবে তিনি কীভাবে পৃথিবী ছেড়ে যেতে চান।
জেলার সাহেব বললেন, সক্রেটিস, মৃত্যুর উপায় ঠিক করার অধিকার শুধুই আপনার। আপনিই বলুন কীভাবে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চান?
সক্রেটিস ভাবছেন তার কীভাবে মারা যাওয়া উচিত। বেশি ভাবতে ইচ্ছা করছে না। তিনি বললেন, আপনাদের যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই হোক।
জেলার বললেন, আদালতে বিচারকদের ইচ্ছায় সবকিছু হয়। এটি আদালত নয়, জেলখানা। এখানে আমরা আসামির ইচ্ছাকে মূল্য দিই। আপনি বলুন কীভাবে মৃত্যুবরণ করলে আপনি খুশি হবেন?
এবার সক্রেটিসের হাসি পেল। জেলার আসামির ইচ্ছাকে মূল্য দিচ্ছেন। তিনি বললেন, আমার কী কী উপায়ে মৃত্যুর সুযোগ আছে?
জেলার সাহেব বললেন, শিরশ্ছেদ আছে, ফাঁস দেওয়া আছে, মাথার পেছন থেকে আঘাত করে …
তাকে ধমক দিয়ে ক্রিতো বললেন, আর বলতে হবে না। উনি হেমলক পান করবেন।
হাসি দিলেন জেলার সাহেব। বললেন, আপনি তো অনেক কিছু জানেন। রক্তহীন, অল্প ব্যথার মৃত্যুর জন্য হেমলকের চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না। আগে আসামিদের ভীষণ বীভৎসভাবে মারা হতো। কিন্তু এখন আমরা অনেক সভ্য। রক্তপাতহীনভাবে মরার অধিকারও আছে। তবে হেমলক কিন্তু বেশ দামি বিষ। দামটা কিন্তু সক্রেটিসকেই দিতে হবে।
সক্রেটিস হেমলকের দাম জিজ্ঞেস করার আগেই ক্রিতো জেলারকে বললেন, ঠিক আছে, সক্রেটিসই দাম দেবেন।
জেলার বললেন, বেশ, সম্পূর্ণ নির্ঝঞ্ঝাটভাবে হেমলক পানের উত্তম ব্যবস্থা আমি করব। আমিও চাই আপনি ব্যথামুক্তভাবেই মৃত্যুবরণ করুন। আমি মৃত্যুবরণ বলছি। আমি বিশ্বাস করি আপনি মৃত্যুকে বরণ করেই নিচ্ছেন।
লোকটির কথায় সক্রেটিস অবাক হচ্ছেন। জেলখানার প্রধান তাকে সম্মান করছেন। জেলার আবার বললেন, আমি ত্রিশ বছর ধরে এথেন্সের জেলার। মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পরে আসামিদের প্রথম যে কান্না, সেটি আমি খুব ভালো জানি। এই প্রথম কাউকে দেখলাম, যার চোখে আসলেই মৃত্যুভয় নেই। আপনি সত্যিই অন্যরকম। জেলখানায় দাগি আসামিরা আসে। সেই জেলখানায় আপনি এসেছেন। আমার মনে হচ্ছে, আপনার ছোঁয়ায় এথেন্সের জেলখানাটা পবিত্র হলো। এখানে যাতে আপনি ভালো থাকতে পারেন, আমি সেই ব্যবস্থা করব।
সক্রেটিস বললেন, আমাকে কি এখানে অনেকদিন থাকতে হবে?
‘কিছুদিন তো হবেই। তবে ঠিক কত দিন আপনি জেলে থাকবেন, সেটি জানেন শুধু দেবতা এপোলো। এথেন্সের জাহাজ এপোলোর মন্দিরে গিয়ে আটকা পড়েছে। সেই জাহাজ ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানে কারও মৃত্যুদণ্ড হয় না।’
জেলার বিদায় নিলেন।
সক্রেটিস হাসতে হাসতে বললেন, ক্রিতো, জীবনে কয়েক দিন বোনাস সময় পেলাম। খুবই মজা! আমি বাঁচতে চাইলাম; ওরা বলল, বাঁচা যাবে না। এখন মরতে চাচ্ছি; ওরা বলছে, মরা যাবে না।
ক্রিতোর বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। তিনি বললেন, জেনথিপি অনেকক্ষণ ধরে বসে আছেন। তাকে নিয়ে আসি।
জেনথিপি এসেই কান্না শুরু করলেন। তার দিকে একবার তাকিয়েই সক্রেটিসের বুক ফেটে যাচ্ছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেললেন। কিছুতেই স্ত্রীর দিকে তাকানো যাবে না। তাকালেই তিনিও কেঁদে ফেলবেন। স্ত্রীকে সরিয়ে দিতে হবে। বকা দিয়ে হলেও পাঠিয়ে দিতে হবে। আদালতের কক্ষ থেকেই তার জন্য মানুষ কাঁদছে। বন্ধুরা কাঁদছে, শিষ্যরা কাঁদছে। কিন্তু সেই কান্নায় সক্রেটিস ভেঙে পড়েননি। তাহলে জেনথিপির কান্না সইতে পারছেন না কেন? যে মেয়েটিকে সারা জীবনে এক মুহূর্তও সুখ দিলেন না, সেই মেয়েটির চোখের পানিতে এত দুঃখ থাকতে পারে, তিনি ভাবতেই পারেননি। সক্রেটিস মুখ শক্ত করে আছেন, কিন্তু বড় বড় নিশ্বাস লুকাতে পারছেন না। যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ হবে চোখের জলের।
তিনি ক্রিতোকে বারবার ইশারা করছেন, জেনথিপিকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু ক্রিতো চুপ করে আছেন। নির্দোষ স্বামীর মৃত্যুদণ্ডে বুক ভাসিয়ে কাঁদছেন এক স্ত্রী, তাকে সরিয়ে নিতে যে শক্তি লাগে, সেটি ক্রিতোর নেই। ক্রিতোও কাঁদছেন।
কান্নার বেশি সময় পেলেন না তারা। সব ব্যবস্থা করতে রাত হয়ে গেছে। সক্রেটিসকে একা কারাগারে রেখে সবাইকেই চলে যেতে হবে।
.
সক্রেটিস কিছুদিন সময় পেলেন। সাধারণত রায় দেওয়ার পরের দিন মৃত্যু ঘটানো হয়। কিন্তু এথেন্সে এখন ‘পবিত্ৰ সময়’ চলছে। এই পবিত্র সময়ে কোনো অপবিত্র কাজ করার নিয়ম নেই। এই সময় যুদ্ধ করা যায় না। কাউকে হত্যা করাও হয় না। কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় না। পবিত্র সময় শেষ হলেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। এই কদিন তিনি জেলখানায় থাকবেন।
এই পবিত্র সময়ের কাহিনি খুবই পুরনো আর প্যাচের। এর সাথে গ্রিক মিথোলজির বিখ্যাত গোলকধাঁধা বা ল্যাবিরিন্থ এর গল্প জড়িত। লম্বা সেই কাহিনিটি[১৩৫] মোটামুটি এরকম :
কয়েকশ বছর আগে গ্রিসের ক্রীত দ্বীপে একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। সেখানের রাজা মিনোসের সুন্দরী রানি একটি আরও সুন্দর ষাঁড়কে ভালোবেসে ফেলে। এই অদ্ভুত ভালোবাসার সন্তানও হয় এক অদ্ভুত জীব। আধা-মানুষ, আধা-ষাঁড়। শরীরের নিচের দিক মানুষের আর উপরের দিক ষাঁড়। রাজা মিনোসের বংশের এই উদ্ভট প্রাণীর নাম দেওয়া হয় মিনোটর। এই মিনোটর দুটি কাজ খুব ভালো পারে। সে ধরে ধরে মানুষ খেত, আর ভয়াবহ যুদ্ধ করত। কেউ তাকে হারাতে পারত না। তাকে নিয়ে যুদ্ধে বের হলো ক্রীত দ্বীপের রাজা। একের পর এক নগরকে হারিয়ে দিল। এক সময় এথেন্সকেও জয় করল। তখন ঠিক হয়, তারা এথেন্সকে ধ্বংস করবে না, কিন্তু প্রতি বছর এথেন্স থেকে সাতজন তরুণ, সাতজন তরুণী মিনোটরের খাদ্য হিসেবে পাঠাতে হবে। এই শর্ত অনেক বছর মেনে চলছিল এথেন্স। প্রতি বছর মিনোটরের খাদ্য পাঠাত তারা। অবশেষে এথেন্সের রাজা জনাব এজিয়ানের ছেলে থিসিয়াস ঠিক করে যে, এভাবে মরার জন্য আর মানুষ পাঠাবে না এথেন্স। সে নিজে যাবে মিনোটরের সাথে যুদ্ধ করতে। থিসিয়াস যাওয়ার আগে দেবতার কাছে মানত করল, যদি জিততে পারে, তাহলে প্রতি বছর এথেন্স থেকে ডিলোস দ্বীপে দেবতা এপোলোর কাছে এক জাহাজ উপহার পাঠাবে। থিসিয়াস যাওয়ার সময় বাবাকে বলে গেল, এখন জাহাজে কালো পতাকা উড়ালাম, যদি জিততে পারি, তাহলে ফেরার সময় সাদা পতাকা উড়াব। তুমি দূর থেকে পতাকা দেখেই বুঝতে পারবে, আমি বেঁচে আছি, নাকি মরে গেছি।
মিনোটর থাকত একটি গোলকধাঁধার ভেতর যেটির নাম ল্যাবিরিন্থ। এই ল্যাবিরিন্থ এমন প্যাঁচানো যে, কেউ একবার ঢুকলে আর এর থেকে বের হওয়ার রাস্তা পেত না। আর সেই সুযোগে মিনোটর তাকে মেরে ফেলত। থিসিয়াস গেল সেই ল্যাবিরিন্থে। গিয়েই বুঝল, ঘটনা খারাপ। কারও সাহায্য ছাড়া এই ল্যাবিরিন্থ রহস্য সমাধান অসম্ভব। সে বুদ্ধি করে প্রেমের ফাঁদে জড়াল ক্রীত দ্বীপের রাজকন্যাকে। রাজকন্যার বুদ্ধিতে থিসিয়াস একটি সুতা নিয়ে একপ্রান্ত বাঁধল নিজের শরীরের সাথে, আরেক প্রান্ত বাঁধল গোলকধাঁধার দরজায়। এতে গোলকধাঁধার যেখানেই যাক, সে সুতা ধরে দরজায় ফিরে আসতে পারল। পথ হারাল না। এক সময় সুযোগ মতো মিনোটরকে মেরে ফেলল। দৈত্যের হাত থেকে এথেন্স মুক্ত হলো। ফিরে আসার সময় থিসিয়াস বেশি আনন্দে জাহাজের কালো পতাকা নামাতে ভুলে গেল। তার বাবা রাজা এজিয়ান দূর থেকে জাহাজে কালো পতাকা দেখে ভাবলেন, ছেলে মারা গেছে। রাজা সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মারা গেলেন। সেই থেকে রাজা এজিয়ানের নামে সেই সাগরের নাম রাখা হলো এজিয়ান সাগর। তো থিসিয়াস ফিরে এসে এথেন্সের রাজা হলো।
তার প্রতিজ্ঞা মতো এক জাহাজ উপহার প্রতি বছর এথেন্সে থেকে ডিলোস দ্বীপে যায় দেবতা এপোলোর জন্য। প্রতি বছর গ্রীষ্মের সময় এক জাহাজ উপহার পাঠায়। জাহাজ ছাড়ার দিন থেকে এথেন্সে ফিরে আসা পর্যন্ত এথেন্সে ‘পবিত্র সময়’। এই সময় এথেন্স যুদ্ধ করে না। কাউকে হত্যা করে না। কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয় না।
এই বছর সেই জাহাজ মাত্র গতকাল এথেন্স থেকে ছেড়েছে। যেকোনো দিন ফিরে আসতে পারে। যেদিন ফিরবে, তার পরদিনই সক্রেটিসকে হেমলক পান করতে হবে। সেজন্য এই মুহূর্তে কেউ জানে না ঠিক কোন্ দিন সক্রেটিসের মৃত্যু হবে।
এই কয়দিন সক্রেটিস কারাগারে থাকবেন। তার পায়ে শিকল পরানো হয়েছে।
***
সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডের খবর শুনে তরুণরা দলে দলে আসছে। এথেন্স থেকে, এথেন্সের বাইরের নানান নগর থেকে প্রতিদিন লোক আসছে। সক্রেটিসের শিয়রে মৃত্যু বসে আছে। কয়দিনের মধ্যেই জীবন প্রদীপ নিভে যাবে। নিভে যাওয়ার আগে সমস্ত শক্তি দিয়ে জ্বলে উঠেছে সেই প্রদীপ। হ্যাঁ, সক্রেটিস জ্বলছেন। তার আত্মা টগবগ করে ফুটছে। তিনি সারাদিন কথা বলছেন।
জেলখানার নিচু গদিটার মাঝখানে জুবুথুবু হয়ে বসেছেন বৃদ্ধ সক্রেটিস। হাসিমুখে কথা বলছেন। তাকে ঘিরে অনেকগুলো তরুণ। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে, কেউ হাঁটুগেড়ে একমনে কথা শুনছে। এই তরুণরা এসেছে গ্রিসের দূর দূর প্রান্ত থেকে। এদের কেউ কেউ সারাদিন এখানে বসে থাকে। একদল যায়, একদল আসে।
সারাদিনই সক্রেটিস তাদের সাথে আলাপ করছেন। রাজনীতি, বিজ্ঞান, জীবন, প্রেম কিচ্ছু বাকি নেই— সবকিছু নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন সক্রেটিস। আর তরুণরা গোগ্রাসে গিলছে।
মৃত্যুর পূর্বে মানুষ যা বলে, তা গভীর বিশ্বাস থেকেই বলে। তাতে ভড়ং থাকে না। তাই এই মুহূর্তে সক্রেটিস যা বলছেন, তা একেবারে জীবন্ত বাণী I প্রতিটি কথা যেন লাফাচ্ছে। লাফানো কথাগুলো কার আগে কে ধরবে, তা নিয়ে তরুণরা ব্যস্ত।
সক্রেটিসের বিচার সবচেয়ে আঘাত করেছে প্লেটোকে। সে বাড়িঘর এক রকম ছেড়ে দিয়েছে। প্রতিদিন এখানে আসে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কারাগারেই থাকে। এখন কারাগারই প্লেটোর ঘর। প্লেটো বেশি কথা বলে না। সে সবাইকে দেখে।
প্লেটো ভাবে, এটি কি জেলখানা? ডাক দাও এথেন্সের গুণী-মানী লোকদের। কেউ বলবে না এটি জেলখানা। এই মুহূর্তে এটি একটি স্কুল। দর্শনের স্কুল, জ্ঞানের স্কুল। এমনই একটি স্কুলের স্বপ্ন প্লেটো দেখতেন, যেখানে সক্রেটিস তাদেরকে শেখাবেন। কিন্তু সক্রেটিস জীবনে কোনোদিন কোনো পেশাদারী কাজ করেননি। তিনি কোনো স্কুল বানাননি। কিন্তু আশ্চর্য, মৃত্যুর আগে তার জেলখানাটাই হয়ে গেছে এথেন্সের সর্বশ্রেষ্ঠ স্কুল।
এই স্কুলের বিশেষত্ব হলো শিক্ষককে কোনো পয়সা দিতে হয় না। পয়সা দিতে হয় দারোয়ানকে। ঘুষ না পেলে দারোয়ান কাউকে ঢুকতে দেয় না। ক্রিতো ব্যবস্থা করেছেন। তিনি সব ক’জন দারোয়ানকে ঠিক করে রেখেছেন, কেউ সক্রেটিসের সাথে দেখা করতে এলে, যেন দেখা করতে দেওয়া হয়। খরচ সব ক্রিতোর।
জেলে বসে সক্রেটিস তরুণদের সাথে মজা করছেন। তিনি বললেন, ওরা আমাকে শাস্তি দিল। হেমলক খেয়ে মরতে হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে, আনো তোমার হেমলক। এক টানে খেয়ে ফেলি। কাহিনি খতম। তখন বলল, না না, এখনও কাহিনি খতম নয়। আপনি কিছু বাড়তি সময় পেয়েছেন। জাহাজ ডিলোস দ্বীপ থেকে না ফেরা পর্যন্ত আপনার সময় আছে। আমি ভাবলাম, এ আরেক সমস্যা! এখন এই বাড়তি সময় নিয়ে আমি কী করব? জেলে বসে একলা একলা ঘাস চিবাবো? কিন্তু ঘটনা দেখো— তোমরা আমাকে এমন করে ঘিরে ধরেছ, বাড়তি সময় তো দূরের কথা, নাওয়া-খাওয়ার সময়ই নাই
প্লেটো বলল, আমাদের সৌভাগ্য, আমরা আপনাকে কদিন পাচ্ছি। সেই কদিনে নানান নগর থেকে ছেলেরা আসছে। তারা সব দার্শনিক। আপনার কথা সারা পৃথিবীতে নিয়ে যাবে। মৌমাছির মতো আসছে। আপনার মুখের মধু চায়।
ক্রিতো বললেন, হ্যাঁ, মধু। আমরা জীবনভর সক্রেটিসের কাছ থেকে মধু নিলাম। আর বিনিময়ে তাকে দিলাম হেমলক বিষ।
সকল তরুণ আহা করে উঠল। পরিবেশ আবার গম্ভীর হয়ে গেল।
সক্রেটিস বললেন, ক্রিতো, তুমি কিন্তু ভীষণ ঝামেলাবাজ। ছেলেপেলেগুলোকে নিয়ে মজা করছি, আর তুমি সুযোগ পেলেই দুঃখের প্যাঁচালি শুরু করো। তুমি একটি দুঃখজীবী প্রাণী ।
ক্রিতো বললেন, হ্যাঁ, বুড়ো হলে সবাই দুঃখজীবী হয়ে যায়। সবাই তো সক্রেটিস না। সক্রেটিস হলো চিরতরুণ। সে দুঃখজীবী না, সে চিরকাল সুখজীবী। শোন সুখজীবী, আমি যাচ্ছি, বিকেলে আসব। আমার ছেলে ক্রিতোবুলাস এখানে রইল। কিছু লাগলে ওকে বললেই হবে।
সক্রেটিস বললেন, সেটিই ভালো। তুমি বাড়ি গিয়ে দুঃখ-দুঃখ মুখে একটি গোসল দাও। ক্রিতোবুলাস থাকুক। সে তরুণ, সে এখনও সুখজীবী। তার মুখে তাকালে আমি সেই তরুণ ক্রিতোকে দেখতে পাই।
ক্রিতোবুলাস মুচকি করে একটু হাসলেন।
সক্রেটিস বললেন, ক্রিতোবুলাস, নতুন কোনো খবর আছে?
ক্রিতোবুলাস বলল, জেনোফোন নামের এক লোকের খবর আছে। তিনি বাবার কাছে আপনার কথা জানতে লোক পাঠিয়েছেন। তিনি নাকি প্লেটোর বন্ধু। প্লেটোর কাছেও তার লোক গেছে।
প্লেটো বলল, জেনোফোন বই লিখবে। সক্রেটিসকে নিয়ে বই।
সক্রেটিস বললেন, তাই নাকি! এই জেনোফোন ছেলেটা বড় অদ্ভুত। সে আমার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরত। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করত না। কোনো কথা বলত না। তার হাতে সব সময় থাকত লম্বা একটি পেপিরাস টুকরা। ঝোলার মধ্যে দোয়াত। আমি যার সাথে যা বলতাম, সে খসখস করে লিখে ফেলত। আমি বলতাম, ‘জেনোফোন, এই যে লিখছো, এগুলো দিয়ে কি হবে?’ জেনোফোন উত্তর করত, ‘আমার স্মৃতিশক্তি কিঞ্চিত দুর্বল। তাই আমি লিখে রাখি। পরে মনে করে দেখি, সক্রেটিস আসলে কী বলেছিলেন। এগুলো আমাকে পথ দেখায়। এগুলো আমার কাজে লাগে।’
প্লেটো বলল, কাজে লাগছে। জেনোফোন বই লিখতে শুরু করেছে। সক্রেটিসের বিচারের বিস্তারিত জানতে চেয়ে আমার কাছে লোক পাঠিয়েছে। সে ডায়লগ লিখবে।
সক্রেটিস বললেন, কিন্তু সে এখন কোথায়?
ক্রিতোবুলাস বলল, তিনি এখন স্পার্টায় থাকেন।
প্লেটো বলল, সে স্পার্টার রাজার উপদেষ্টা। এথেন্সে যতদিন গণতন্ত্র আছে, ততদিন সে ফিরতে পারবে না। ফিরলে জীবন যাবে। তাই সে স্পার্টাতেই বসতি নিয়েছে।
সক্রেটিস বললেন, জেনোফোন যে লেখালেখি করে জানতাম না তো।
প্লেটো বলল, তার লেখার হাত খুবই ভালো। স্পার্টায় গিয়ে লেখা শুরু করেছে। ঘোড়া পালনের ওপর চমৎকার একটি বই লিখেছে।
সক্রেটিস বললেন, বাহ, তার উন্নতি দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। ক্রিতোবুলাস বলল, জেনোফোন নাকি একটি অদ্ভুত বই লিখবেন। এমন বই আগে কেউ লিখেননি
‘কী বই?’
‘ঘর-গৃহস্থালী, ধন-সম্পদ, কৃষি নিয়ে। বইয়ের নাম দিয়েছে ঐকোনোমিকাস (Oeconomicus)[১৩৬]। ঐকো (Oeco) মানে ঘর-গৃহস্থালি, আর নোমো (nomo) মানে ব্যবস্থাপনা বা নিয়মকানুন। গৃহস্থালি ঠিক ভাবে চালানো নিয়ে জেনোফোন এই বই লিখছে। মজার কথা কথা হলো, এই বই নাকি শুরু হবে এভাবে :
‘আপনি আর আমি দুজন কথা বলছি।’
‘মানে কী? তুমি আর আমি কথা বলছি?’
প্লেটো বলল, মানে হলো, জেনোফোনের ঐকোনোমিকাস বইয়ে দুটি চরিত্র হলো সক্রেটিস আর ক্রিতোবুলাস। বইয়ের শুরুতে সক্রেটিসকে ক্রিতোবুলাস জিজ্ঞেস করে, কীভাবে গৃহস্থালি চালাতে হয়? তার উত্তরে সক্রেটিস তাকে বোঝাচ্ছেন— সম্পদ কী জিনিস, সম্পদ সংসারের জন্য কত দরকারি, কীভাবে সংসার চালানো উচিত এসব।
সক্রেটিস বললেন, তাই নাকি? আমরা গ্রিকরা তো সম্পদ, গৃহস্থালি এসব নিয়ে লিখি না। আমরা শুধু জ্ঞান খুঁজি। এটি একটি নতুন কাজ। এই বইয়ের মাধ্যমে শুধু সক্রেটিসই না, আমাদের ক্রিতোবুলাসও অমর হয়ে গেল।
ক্রিতোবুলাস লজ্জামাখা হাসি দিল।
প্লেটো বলল, জেনোফোন ‘সক্রেটিসের স্মৃতিকথা’ লিখবে। আপনার বিচারের সময় সে এথেন্সে ছিল না। আমাদের কাছে লোক পাঠিয়েছে। বিচারের বিস্তারিত জানার জন্য।
সক্রেটিস বললেন, জেনোফোন ভালো লিখবে। কিন্তু তুমি লিখলে, আরও ভালো হবে। সারা পৃথিবীতে তোমার মতো লেখার হাত আর কারও নেই। তুমি লেখালেখি ছেড়ে দিও না।
প্লেটো গম্ভীর। কিছু বলছে না।
ক্রিতোবুলাস বলল, সক্রেটিসকে নিয়ে সবাই বই লিখতে শুরু করেছে। জেনোফোন লিখছে, ফিদো লিখছে। আমার বাবা ক্রিতো, এন্টিস্থিনিস, ইউক্লিড আরও অনেকে। যে সক্রেটিসকে দেখেছে, সেই নাকি বই লিখবে।
সক্রেটিস বললেন, এরা সবাই আমার অন্তরের প্রিয় মানুষ। আমি খুব খুশি। এরা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। তবে আমি বলব, প্লেটোর মতো আমায় কেউ বোঝেনি। যদি প্লেটো লিখে সেটিই পূর্ণাঙ্গ হবে।
প্লেটো জানে, সক্রেটিসকে যদি কেউ বুঝে থাকে, সেটি প্লেটো। সে কলম হাতে নিলেই লেখা আসে। ঝরঝর বৃষ্টির মতো লেখা। কিন্তু অনেকদিন থেকে সে কিছুই লিখছে না। যেদিন সে তার সব কবিতা, নাটক পুড়িয়ে দিয়েছে, তার পর থেকে আর কিছুই লেখেনি। তবে অনেক নোট নিয়েছে। সক্রেটিসের অনেক কিছু খসড়া লিখে রেখেছে। এখনও লিখছে।
লোকে যতটুকু লিখে বই বের করে, প্লেটোর খসড়াই তার থেকে বড়। যে কাজে প্লেটো হাত দেয়, সে কাজ অন্য কেউ করলে লাভ হবে না। যদি প্লেটো সত্যি সক্রেটিসকে নিয়ে লিখতে শুরু করে, তাহলে আর কেউ দর্শনশাস্ত্রে পাত্তাই পাবে না। প্লেটো অমিত প্রতিভাধর কবি। তার লেখা মানুষ পড়তে বাধ্য হয়। এত মিষ্টি হাত সবার হয় না।
তবে সমস্যা হলো, এই মুহূর্তে তার মন খুবই বিক্ষিপ্ত। সক্রেটিসের প্রতি অবিচার তার সবকিছু থামিয়ে দিয়েছে। তার মনে হয়— কার জন্য লিখব? যে এথেন্সের মানুষ সক্রেটিসের মতো মানুষকে খুন করছে, তাদের জন্য লিখে কী হবে! তবু চোখ বুজলেই প্লেটোর মনে নানান ভাবনা আসে। কল্পনায় সুন্দর সুন্দর সংলাপ আসে।
প্লেটো সক্রেটিসের দিকে তাকাল। একটু আগে সক্রেটিস কি তাকে লেখার আদেশ দিলেন? সক্রেটিসকে নিয়ে লেখা শুরু করা উচিত?
***
১৩৫. ক্রিত দ্বীপের রাজা মিনোস আর মিনোটরের কাহিনি যে সময়ের, সেই সময়েই এই দ্বীপে শুরু হয় ইউরোপের সর্বপ্রথম সভ্যতা। রাজা মিনোসের নাম থেকে সভ্যতাটির নাম মিনোয়ান সভ্যতা (Minoan civilization)। সময় খ্রি. পূ. ৩০০০ থেকে ১৪৫০ অব্দ, ব্রোঞ্জ যুগ। এই সভ্যতা মিশর থেকে ক্রিত দ্বীপে, সেখান থেকে গ্রিসের মূল ভূ-খণ্ড হয়ে ইউরোপে যায়। গ্রিক মিথোলজির বিখ্যাত গোলকধাঁধা বা Labyrinth এই সভ্যতার সময়ের। ক্রীত দ্বীপে মাটি খুঁড়ে নসোস (Knossos Palace) রাজপ্রাসাদে সেই ল্যাবিরিন্থটি পাওয়া গেছে। এথেন্সের হিরো থিসিয়াস ল্যাবিরিন্থের রহস্য ভেঙে মিনোটরকে হত্যা করে। তাই এটি ক্রিত দ্বীপের উন্নত সভ্যতাকে হারিয়ে এথেন্সের উত্থানের গল্প। এথেন্সবাসী এই গল্প নিয়ে গর্ব করত এবেং গল্প অনুযায়ী ‘পবিত্ৰ সময়’ মেনে চলত। এই সময় রক্তপাত হতো না। সক্রেটিসের বিচার এই সময়ে হওয়ায় তিনি জেলখানায় বেঁচে ছিলেন আরও ২৯ দিন। এই ২৯ দিনেই সক্রেটিস তার দর্শনের একটি বড় অংশ প্লেটো ও অন্য শিষ্যদের কাছে বলেন। প্লেটোর রচনার সবচেয়ে বিখ্যাত অংশের পটভূমি এই ২৯ দিন।
১৩৬. জেনোফোনের (Xenophon) এর ঘর-গৃহস্থালি বিষয়ক গ্রিক বইয়ের নাম Oeconomicus, এই ঐকোনোমিকাস শব্দটি থেকেই ইকনোমিকস বা অর্থনীতি শব্দটি এসেছে।