1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৪৯

৪৯

‘ভাগ্য প্রত্যেক মানুষকে কষ্টের ভাগ দিতে
ঠিক সময়ে খুঁজে নেয়।’

— ইউরিপিডিস

***

সক্রেটিস ও ইউরিপিডিস চিঠি পড়ছেন। তাদের নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছেন থেসালির রাজা। রাজার নাম আর্চিলস। তার রাজ্য এথেন্স থেকে প্রায় পাঁচশ কিলোমিটার উত্তরে, মেসিডোনিয়ার পাশে। এই রাজা জ্ঞানের জন্য পাগল। তার বিশেষ জ্ঞানতৃষ্ণা আছে। তিনি প্রায়ই দেশ-বিদেশের জ্ঞানীদের ডাকেন। জ্ঞানীরা তার রাজসভা আলোকিত করেন। সেখানে কবিরা গিয়ে আনন্দে কবিতা লেখেন, নাট্যকারগণ মহাসুখে নাটক লেখেন, পণ্ডিতেরা ভালো ভালো কথা বলেন। তার সভায় গুণী লোকের কদর আছে। তিনি আশা করেন তার সভায় পৃথিবীর সব জ্ঞানী একবার হলেও আসুক। তাই তিনি সক্রেটিস ও ইউরিপিডিসকে নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছেন।

তিনি ইউরিপিডিসকে লিখেছেন—

জিউস ও এথিনা ভরসা

পরম পূজনীয় নাট্যকার,

আমি আপনার অতীব গুণমুগ্ধ। আপনি জানিয়া সাতিশয় প্রীত হইবেন যে, আমার রাজ্যে প্রায়শই আপনার নাটক অভিনীত হইয়া থাকে। আমার প্রজাগণ উক্ত নাটক অতিশয় আনন্দের সহিত আস্বাদন করিয়া থাকে। এই অবস্থায় আপনি কিয়ৎকালের জন্য থেসালি নগরে আমার রাজভবনে আতিথ্য গ্রহণ করিলে আমি বিশেষ কৃতার্থ হইব। আমার রাজ্যে আসিয়া আপনি যদি একখানা নাটক রচনা করেন, আমরা নিজেদেরকে অত্যধিক ধন্য মনে করিব। যদি আপনার বিশেষ অসুবিধা না থাকে, আমার বিশেষ রাজবাহন প্রেরণ করিয়া আপনার থেসালি আগমনের ব্যবস্থা করিতে পারি। থেসালির জনগণ তাহাদের চর্মচক্ষে আপনাকে দেখিবার নিমিত্ত অত্যধিক উদগ্রীব হইয়া আছে। আপনি যদি সম্মানী বা অন্য কিছু লইয়া কোনোরূপ ভাবনায় থাকেন, আমি নিশ্চয়তা দিয়া অবহিত করিতেছি যে, থেসালি আপনাকে নিরাশ করিবে না। আপনার ব্যগ্র হইবার প্রয়োজন নাই। ধীরে-সুস্থে ভাবনা-চিন্তা করিয়া সিদ্ধান্ত লইয়া আমাকে অবগত করিলেই হইবে। আমার বিশেষ দূত আগামী চন্দ্রের একাদশ দিবসে আবার আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবে। তৎকালে চূড়ান্ত কথা জানাইলেই চলিবে।

ইতি,
আপনার অতিশয় গুণমুগ্ধ
আৰ্চিলস,
থেসালি নগর

সক্রেটিসের কাছে পাঠানো চিঠিতেও রাজা একই রকম কথা লিখেছেন। শুধু নাট্যকারের জায়গায় দার্শনিক।

চিঠিখানা দুবার পড়ে সক্রেটিস তাকালেন ইউরিপিডিসের দিকে। তার চোখে হাসি। রহস্যের হাসি। এই রহস্যে ইউরিপিডিস বিরক্ত হলেন। তিনি বললেন, আসলেই তুমি যাবে না? এমন প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবে? ভেবে দেখো— সারা জীবন অভাবের মধ্যে কাটালে, এখন শেষ বয়সে সুযোগ এসেছে একটু সুখে দিন কাটানোর। রাজার অতিথি হয়ে থাকবে। চলো, আমরা দুজন মিলে যাই।

সক্রেটিস শান্ত চোখে ইউরিপিডিসের দিকে তাকালেন। নাট্যকার মিথ্যে বলেননি। রাজা আন্তরিকভাবেই নিমন্ত্রণ করেছেন। সেখানে মহাসুখে দিন কাটানো যাবে। কিন্তু ‘সুখ’ শব্দটি মনে হতেই সক্রেটিসের মাথা ভনভন করে উঠল। কোন সুখের কথা ভাবছেন তিনি? টাকা-পয়সা? এথেন্স থেকে দূরে গেলে টাকা-পয়সা কি তাকে সুখ দেবে? এথেন্স থেকে বাইরে যাওয়ার কথা মনে হলেই তার প্রাণ কেঁদে ওঠে। এর আগেও অনেকেই তাকে নিতে চেয়েছে। কিন্তু সক্রেটিস যাননি।

সক্রেটিস ইউরিপিডিসের হাত ধরে বললেন, এই জীবনে শুধু যুদ্ধ করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে এথেন্স ছেড়ে কোথাও যাইনি। তো এই বুড়া বয়সে গিয়ে আর কী হবে! আমি এখানেই থাকি।

ইউরিপিডিস ভাবছেন, সক্রেটিস কি আসলে একজন বোকা মানুষ? কিছুদিনের জন্য এথেন্সের বাইরে যেতেও তিনি রাজি হচ্ছেন না! নাকি সক্রেটিস ভীরু? এথেন্সের পরিচিত জীবন থেকে বের হওয়ার সাহস তার নেই!

সক্রেটিস আবার বললেন, আমি এথেন্সকে ভীষণ ভালোবাসি। এই সারা এথেন্স আমার বাড়ি, এথেন্স ছেড়ে আমি কোথাও থাকতে পারব না।

ইউরিপিডিস নিরাশ হয়েছেন। তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। নাট্যকারকে কষ্ট দিয়ে সক্রেটিসেরও মন খারাপ। কিন্তু তিনি এথেন্স ছেড়ে যেতে পারবেন না। কোনো কিছুর লোভেই নয়।

সক্রেটিস বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকতে চান না। মন ভালো করার জন্য উপায় খুঁজতে লাগলেন তিনি। সবচেয়ে ভালো উপায় হলো জেনথিপির সাথে রাগ-অনুরাগ খেলা। সক্রেটিস ঠিক করলেন, রাজার চিঠি নিয়ে জেনথিপিকে মজা করে একটু খোঁচা দেবেন। খোঁচায় জ্বলে উঠবেন জেনথিপি। তখন সক্রেটিস অভিনয় করে বলবেন, আমি সব ছেড়ে এক্ষুনি থেসালি চলে যাব। জেনথিপি করুণ চোখে বলবেন, না না, তুমি কিছুতেই যেতে পারবে না। সক্রেটিসের হবে মিথ্যা-মিথ্যি রাগ, আর জেনথিপির হবে সত্যি সত্যি অনুরাগ। এই রাগ-অনুরাগের খেলায় মন ভালো হয়ে যাবে।

এই ভেবে তিনি জেনথিপিকে পিন দিয়ে বললেন, বুঝলে, এথেন্সের মানুষ তো আমাকে চিনল না, দূরের মানুষ ঠিকই চিনেছে। দেশ-বিদেশের রাজারা পর্যন্ত আমাকে চিনেছে। দেখ, বিরাট এক রাজা দাওয়াত করেছে। চিঠি পড়ে দেখো?

জেনথিপির মাথায় সারাদিন সংসারের হাজারো চিন্তা। তিনি বললেন, চিঠি-টিঠি পড়ার সময় আমার নেই। তিনি বিষয়টিকে পাত্তাই দিলেন না। সক্রেটিসের কাছে কত লোকে চিঠি লেখে, কত লোক দাওয়াত করে। ওসব চিঠিতে থাকে ভারী ভারী কথা, মোটা মোটা আলাপ। ওসব চিঠি পড়ে জেনথিপির লাভ নেই।

সক্রেটিস দেখলেন, বউ মজা বুঝছে না। ঘটনা জমছে না। তখন তিনি শব্দ করে চিঠিটা পড়ে বললেন, বিষয়টা বুঝেছ? দাওয়াত করেছেন একজন রাজা। সেই রাজা খুবই দিলদার লোক। একবার গেলে জীবনে আর টাকা- পয়সার চিন্তা থাকবে না। আমি যাই, কদিন রাজার কাছে আরাম-আয়েশ করে আসি।

জেনথিপি নিশ্চিত নন, থেসালি যাওয়া ভালো, নাকি না যাওয়া ভালো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাজাকে কোনো টাকা দিতে হবে না?’

সক্রেটিস বললেন, ‘টাকা দিতে তো হবেই না, উল্টা রাজাই আমাদেরকে টাকা দেবেন।’

এবার জেনথিপি লাফ দিয়ে বললেন, ‘তাহলে এত ভাবাভাবির কী আছে! বসে বসে টাকা পেলে কেন যাব না? যাব, অবশ্যই যাব।’

জেনথিপি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তিনি পারলে এখুনি রওয়ানা করেন। সক্রেটিসের বুঝলেন, তিনি ধরা খেয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন, বউয়ের সাথে একটু মজা করবেন, রাগ-অনুরাগের খেলা হবে। কিন্তু সেটি বুমেরাং হয়েছে। জেনথিপি থেসালি যাওয়ার জন্য গুছানো শুরু করে দিয়েছেন।

এখন সক্রেটিসকে না যাওয়ার জন্য বুদ্ধি করতে হবে। এত সময় যা বলেছেন, এখন সেটির উল্টা বলতে হবে। সক্রেটিস বললেন, থেসালির মেয়েরা নাকি দেখতে মন্দ নয়।

জেনথিপি বললেন, সেখানের মেয়েদের কথা উঠল কেন? আপনাকে তো দাওয়াত করেছেন রাজা। কোনো মেয়ে তো দাওয়াত করেনি।

সক্রেটিস বললেন, হ্যাঁ, সেই রাজা খুবই ভালো মানুষ। অতিথিদের অনেক খাতির-যত্ন করেন। অতিথিদের জন্য প্রতি রাতে আনন্দ ফূর্তির ব্যবস্থা আছে। আনন্দ-ফূর্তিতে মেয়েরাও থাকে। বোঝোই তো, রাজা-রাজড়াদের ব্যাপার। অন্য রকম আমোদ-প্রমোদ।

সক্রেটিস বলছেন আর জেনথিপির দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছেন। জলপাই তেলের কুপি নিভু নিভু জ্বলছে। কুপির চেয়ে বেশি জ্বলছে জেনথিপির চোখ একটু পরেই সেই চোখ থেকে আগুন বের হবে।

সক্রেটিস আবার বললেন, সেই রাজদরবারে নাকি কয়েকজন কবি আছেন। তারা সেখানে গিয়ে আর ফিরেননি। সেখানেই বিয়ে করে ঘর-সংসার করছেন। রাজা ভালোই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যাই হোক, আমি বুড়ো মানুষ, তিনকাল গিয়ে চারকাল এলো বলে। আমার আর বিয়ে-শাদি কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমি গেলে কিছু টাকা-পয়সা আসবে। সংসার ভালো চলবে। আগামী পরশু শুভদিন। পরশুই যাত্রা করি।

জেনথিপি চিৎকার করে উঠলেন, খবরদার বলছি, চুলায় যাক তোমার টাকা-পয়সা। সেখানে তোমার যাওয়া হবে না। কাল থেকে তুমি ঘরে বন্দি।

সক্রেটিস বললেন, বন্দি? জেনথিপির কারাগারে?

‘হ্যাঁ, জেনথিপির কারাগারেই বন্দি। থেসালির নাম একবার মুখে আনলে এক বছর হাজত বাস। মনে থাকে যেন।’

সক্রেটিস মনে মনে হাসতে হাসতে খাওয়া শেষ করলেন। খাওয়ার সময় এই আলাপের পরেই জেনথিপির মধ্যে একটু পরিবর্তন দেখা গেল। আজ তিনি একটু হেসে হেসে কথা বলছেন। কোন ফাঁকে একটু সাজুগুজু করে নিয়েছেন। স্বামীর আশেপাশে ঘুরঘুর করছেন। অকারণে হাসছেন। সক্রেটিস দেখলেন, বিষয়টা মন্দ নয়। এখন মাঝে মাঝে থেসালির আলাপ করতে হবে। শেষ কবে যে জেনথিপি এমন অকারণে হেসেছিলেন, সক্রেটিস মনে করতে পারছেন না।

.

ইউরিপিডিস সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি থেসালি চলে যাবেন। তিনি রাজার আতিথ্য গ্রহণ করবেন। অনেক দিন থেকেই এথেন্স তার অসহ্য লাগছে। এখানের মানুষ তাকে অকারণে জ্বালায়। সারা জীবন জ্বালিয়েছে, এখন বুড়ো বয়সেও ছাড়ছে না। ব্যঙ্গবিদ্রূপের শেষ নেই। আর কত! তিনি ভাবছেন, আমি এদের জন্য লিখেই যাচ্ছি, আর এরা অপমান করেই যাচ্ছে। আমাকে নিয়ে এখনও কৌতুক করছে। আমি থাকব না এখানে। রাজা আর্টিলস নাকি সজ্জন মানুষ। তিনি গুণীর কদর করেন। সেখানে মন ভালো থাকবে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। ইউরিপিডিসের মনে হচ্ছে— আজই এথেন্স ছেড়ে চলে গেলে ভালো হয়। তিনি বাঁধা-ছাঁদা শুরু করলেন। তার জিনিসপত্রের বহর দেখে মনে হচ্ছে, তিনি আর কোনোদিন এথেন্সে ফিরতে চান না। অনেক বইপত্র নিয়ে তিনি থেসালি নগরে চলে গেলেন।

থেসালিতে অনেক শীত। আশি বছরের বৃদ্ধ ইউরিপিডিস ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে পড়লেন। কিন্তু থেসালিতে অন্তত একটি নাটক তাকে লিখতেই হবে। বুড়ো বয়সে অভিনয় করতে অন্যরকম চরিত্র লাগবে, পাগলের চরিত্র হলে মন্দ হয় না। লম্বা চুলের পাগল হলে ভালো হয়।

ইউরিপিডিস ভাবছেন, তিনি পাগল চরিত্র করবেন। কিন্তু সারা জীবন তিনি নারীদের নিয়ে লিখেছেন। বুড়ো বয়সে আর অন্য কিছু করে কী হবে? তাহলে পাগল নয়, নাটক হোক পাগলি নিয়ে। আনন্দের দেবতা ডিওনিসাসকে নিয়ে লিখলেন কাহিনি। এই দেবতাকে থেসালি শহরের লোকেরা বলে বাক্কাই। তিনি নাটকের নাম দিলেন ‘বাক্কাই’[১১৯]। কাহিনি এমন-

থিবসের রাজা (আনন্দের দেবতা) ডিওনিসাসকে দেবতা হিসেবে মানেন না, তার অনুষ্ঠান করতে দেন না। দেবতা তাদের চরম শাস্তি দিলেন। মেয়েরা সব উন্মাদ হয়ে গেল, রাজাকে হত্যা করল। ইউরিপিডিস অভিনয় করলেন পাগলি নারী রাজমাতার চরিত্রে। এই মা উন্মাদ হয়ে নিজের ছেলেকে হত্যা করে।

উত্তর গ্রিসে তীব্র শীত। এই শীত ইউরিপিডিসের সহ্য হলো না। প্ৰথম শীতেই মারা গেলেন তিনি[১২০]। সক্রেটিসের প্রিয় বন্ধু, প্রিয় নাট্যকার চলে গেলেন চিরতরে। এথেন্সের বিপ্লবী নাট্যকার, যিনি নাটক দিয়ে সমাজ বদলানোর স্বপ্ন দেখতেন, তিনি বিদায় নিলেন।

ইউরিপিডিস মারা গেছেন। এথেন্সে খবর এসেছে। লোকজন সারা জীবন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে। মরণেও সেটি বন্ধ হলো না। রাস্তাঘাটে লোকজন বলছে, সে কি নাট্যকার ছিল নাকি? সে মঞ্চে উঠে দার্শনিক আলাপ করত। ঐ ব্যাটা মারা গেছে, ঝামেলা গেছে। কবিরাও হাসি-ঠাট্টা করছে। এত বড় কবি যে, সে দেশের মাটিতে মরতেও পারল না। মনে হচ্ছে ইউরিপিডিসের মৃত্যুতে এথেন্সের শিক্ষিত সমাজ কোনো দুঃখ পায়নি।

কিন্তু হঠাৎ বাইরে বের হলেন সফোক্লিস। নব্বই বছরের বৃদ্ধ। পেপিরাস নিয়ে বের হলেন। দাসকে ডেকে বললেন, ‘সবাইকে খবর দাও। আমি ইউরিপিডিসের জন্য গান গাইব। তার জন্য শোক র‍্যালি হবে। তাতে আমি গাইব। আয়োজন করো।’

মানুষ অবাক! সারা জীবন ইউরিপিডিসকে হারিয়ে মজা নিয়েছেন সফোক্লিস। রসিয়ে রসিয়ে তার কষ্ট উপভোগ করেছেন। জীবনভর একটি শত্রুতা ছিল দুজনের। এখন মরার পরে তাকে নিয়ে গান গাইবেন সফোক্লিস?

ইউরিপিডিসের জন্য শোক র‍্যালি বের হলো। তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সফোক্লিস। নব্বই বছরের বৃদ্ধ গান গাইছেন। গলা কাঁপছে। স্বর বের হতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু গলার স্বর এখনও মিষ্টি। চিকন একটি সুন্দর সুর-

কবি চলে গেছে চিরতরে, কাঁদো, এথেন্স কাঁদো
কবি হারিয়ে গেছে বহু দূরে, বুক ভাসিয়ে কাঁদো।

সফোক্লিসের চোখে পানি। দরদর করে পড়ছে পানি। পানি থামছে না। সফোক্লিস সারা জীবন অভিনয় করেছেন। তিনি চাইলেই কাঁদতে পারেন। কিন্তু আজ এমনি এমনিই চোখের পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছে। তার সাথে সবাই কাঁদছে। প্রতিটি তরুণ কাঁদছে—

কবি চলে গেছে চিরতরে,
কাঁদো রে ভাই, কাঁদো।

সফোক্লিস জোরে হাঁটতে পারেন না। তাই শবযাত্রা খুবই ধীরে ধীরে চলছে। সফোক্লিস নিজেও জানেন না, তিনি কেন এমন করে কাঁদছেন। তিনি সারাজীবন ইউরিপিডিসকে হারিয়েছেন। ইউরিপিডিস যত ভালোই নাটক লিখুক, তিনি প্রথম হতে পারতেন না। এথেন্সের বিচারকরা সব সময় সফোক্লিসকেই প্রথম করে দিত। প্রতি বছর বিজয়ীর মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুরস্কার হাতে নিয়ে করুণার চোখে তিনি তাকাতেন ইউরিপিডিসের দিকে। তীব্র আনন্দে উপভোগ করতেন পরাজিত ইউরিপিডিসের বিষণ্ণ চেহারা। আর আজ? আজ ইউরিপিডিস চোখ বুজে আছে, মরণে তিনি প্রথম হয়ে গেছেন। মরণে সফোক্লিসকে হারিয়ে দিয়েছেন। এই মরণে যদি কেউ সত্যিকার কষ্ট পেয়ে থাকেন, তিনি হলেন সফোক্লিস। তার মনে হচ্ছে বেলা শেষ হয়ে আসছে। এথেন্সে যে মারাত্মক আনন্দ নিয়ে নাটক লিখে গেছেন সারা জীবন, সেই সোনালি দিন শেষ হয়ে আসছে। শেষের সূর্য অন্য আলো নিয়ে বিদায় নিচ্ছে। ইউরিপিডিস যে কত বড় নাট্যকার ছিলেন, সেটি সফোক্লিস বুঝতেন। এথেন্সের মানুষ বোঝেনি যে তিনি যুগের থেকে আগানো সাহিত্যিক ছিলেন।

সফোক্লিস ভাবছেন, পেরিক্লিসের মৃত্যুর সময় আমি খুব খারাপ আচরণ করেছি, সেটি ঠিক হয়নি। এথেন্সের জন্য তার মতো মানুষই দরকার ছিল। আমি সারা জীবন ইউরিপিডিসকে তাচ্ছিল্য করে যে অপরাধ করেছি, এখন তার প্রায়শ্চিত্ত করছি।

সক্রেটিসও হাঁটছেন প্রথম সারিতে। তার গানের গলা ভালো নয়। তিনি গাইছেন না। কাঁদছেনও না। মন খারাপ। কিন্তু চোখে পানি নেই। তার চারপাশে বেশ কয়েকটি তরুণ হাঁটছে। ফিদো, প্লেটো নিঃশব্দে হাঁটছে।

সক্রেটিস বারবার সফোক্লিসের দিকে তাকাচ্ছেন। এই লোক এমন করে কাঁদছেন কেন? তার দিনও কি শেষ হয়ে আসছে? তিনি মৃত্যুর সংগীত গাইছেন। এই গান কি ইউরিপিডিসের জন্য, নাকি নিজের মৃত্যুর বার্তা পেয়ে গেছেন সফোক্লিস। এত করুণ গান তিনি জীবনে শোনেন নি।

কেমন একটি গম্ভীর কান্নার আওয়াজ আসছে—

কবি চলে গেছে চির তরে,
কাঁদো রে ভাই, কাঁদো।

শোকযাত্রা থেকে ফিরে সফোক্লিস গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। ভাবছেন এথেন্স আর কতদিন টিকতে পারবে স্পার্টার সাথে। যুদ্ধ চলছে। নৌশক্তি শেষ হয়ে গেছে সিসিলির যুদ্ধে। কোনো নেতা নেই। এখন এথেন্সের পরাজয় শুধু সময়ের ব্যাপার। তবু তারা লড়ছে।

বৃদ্ধ সফোক্লিস চোখের সামনে দেখছেন এথেন্স শেষ হয়ে যাচ্ছে। যুবকদের মনে বল নেই। কারও কোনো সাহস নেই। তার মনে পড়ে— পারস্যকে হারানোর পরে এথেন্সের রাস্তায় বিশাল মিছিল। সেই মিছিলে গান গাইছিল তরুণ সফোক্লিস। সেদিন কী টগবগ করছিল তরুণরা। আর আজ? তরুণদের মনে কোনো সাহস নেই। সব মাজাভাঙ্গার মতো হাঁটে।

কী করা যায়! অস্ত্র হাতে নেওয়ার বয়স নেই। তবে কলম আছে। এখনও চাইলেই লিখতে পারেন। কয়েক বছর কিছু লিখেন নি। এবার লিখতে হবে। সামনে নাটক উৎসব। সারা জীবনই তিনি এই উৎসবে নাটক করেছেন। কয়েক বছর ক্ষান্ত দিয়েছেন। এবার আবার নামবেন। এবার এথেন্সের গৌরবের কথা বলতে হবে। নাটক এমন হবে যাতে তরুণদের মনে হয়, এথেন্সের জন্য চাইলেই কিছু করা যায়।

সফোক্লিস নাটকের প্লট ভাবছেন। কোন প্লটে লিখবেন। নাটক জনপ্রিয়ও হতে হবে। মানুষের মনে ধরতে হবে। তার যে নাটকটা মানুষের সবচেয়ে মনে ধরেছিল, সেটি হলো ‘রাজা ইদিপাস’। ইদিপাসের ট্র্যাজেডি মানুষকে কাঁদিয়েছে। নিজের মায়ের সাথে সন্তান ইদিপাসের বিয়ের কাহিনি খুব চলছিল। গ্রামে গঞ্জে এখনও মানুষ অভিনয় করে সেই নাটক। ‘রাজা ইদিপাস’ নাটকের বইটা অনেক কপি বিক্রি হয়েছে। তাহলে নতুন নাটকে রাজা ইদিপাসকে এথেন্সে নিয়ে এলে কেমন হয়! ইদিপাস শেষ বয়সে এথেন্সে এলো। এথেন্সের মানুষ তাকে আশ্রয় দিল। এই কাহিনি নিয়ে লিখলে কেমন হয়?

সফোক্লিস কলম নিলেন, একটানা লেখা শুরু করলেন। কাহিনি দাঁড়াল এরকম—

অন্ধ বৃদ্ধ ইদিপাস কোনো জায়গায় আশ্রয় পাচ্ছে না। সে অভিশপ্ত, নিজের বাবাকে খুন করেছে, নিজের মাকে বিয়ে করেছে, তাদের সন্তান হয়েছে। সে মারাত্মক রকমের অভিশপ্ত। তার মতো অভিশপ্তকে কেউ জায়গা দেবে না। ঘুরতে ঘুরতে সে এলো এথেন্সে। এথেন্স একটি মহৎ নগর। এখানের মানুষের মন অনেক বড়। সে এথেন্সে আশ্রয় পেল। এথেন্সের রাজা থিসিয়াস তাকে জায়গা দিলেন। ভরসা দিলেন। শেষ কয়টা দিন ইদিপাসের ভালো কাটল। ইদিপাস মারা গেল। এথেন্স তাকে কবর দেওয়ার জায়গাও দিল। অভিশপ্ত রাজার শেষ আশ্রয় হলো এথেন্স।

কাহিনি শেষ করে সফোক্লিস নাটকের নাম দিলেন ‘ইদিপাস এথেন্সে’। নামটা লিখে তার কেমন যেন মনে হলো। লোকে মনে করবে এথেন্সের ফুটানি দেখাতে ইচ্ছে করে এই নাটক। নাটকের নামে এথেন্স শব্দটা দেওয়া যাবে না। সফোক্লিস থাকেন এথেন্সের উপশহরে। তার পাড়ার নাম কলোনাস। তিনি ভাবছেন তাহলে কাহিনিতে রাজা ইদিপাসের কবর হোক কলোনাসে। তো নাটকের নাম হোক ‘ইদিপাস কলোনাসে’।

আর কদিন পরেই নাটক নিয়ে মঞ্চ উঠতে হবে। তার আর তর সইছে না। মনে হচ্ছে এক্ষুনি ছুটে গিয়ে সবাইকে ডেকে অভিনয় শুরু করে দেন। তার মনের মধ্যে গুনগুন করছে নতুন নতুন সংলাপ। এমন সময় খবর এলো, থিয়েটারে নয়, তাকে যেতে হবে আদালতে। তার নামে মামলা হয়েছে। মামলা করেছে তার নিজের ছেলে। অভিযোগ : তার নাকি মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। তিনি পাগল হয়ে গেছেন। তাকে যেন কোনো পাবলিক প্রোগ্রামে অংশ নিতে দেওয়া না হয়।

লেখক স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি জীবনে অনেক শত্রুর সাথে লড়েছেন, কিন্তু কেউ তাকে আদালতে ডাকতে সাহস করেনি। সেটি করল তার নিজের ছেলে ইওফোন (Iofon)। তার ছেলেও লেখক, সেও নাটক করে। গভীর বেদনায় সাগর তীরে গেলেন, সাগরের স্থির পানিতে ছায়া পড়েছে তার বৃদ্ধমুখের। তিনি ভাবছেন, আমি কি প্রয়োজনের চেয়ে বেশিদিন বেঁচে আছি? আমার বেঁচে থাকা কি ওদের সহ্য হচ্ছে না? বৃদ্ধ পিতা কি সমস্যা করছেন ছেলেকে? তিনি নিজেই লিখেছিলেন, ‘তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু তুমি নিজেই।’ তার নিজের ছেলেই তাকে শত্রু ভাবছে।

তিনি আদালতে শুনানিতে গেলেন। তেমন কথা বললেন না, শুধু তার নতুন নাটক থেকে সংলাপ আবৃত্তি করতে লাগলেন। আদালতে কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বললেন ইদিপাসের সংলাপ,

‘এই মহতী এথেন্স আমাকে আশ্রয় দিল। আমি এথেন্সের মাটিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করব। এক টুকরো পবিত্র মাটিতেই আমার কবর হবে। আমাকে কেউ জায়গা দেয়নি, সবাই অভিশপ্ত বলেছে, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আশ্রয় দিয়েছে মহান নগরী এথেন্স। ‘

তার সুললিত সংলাপে আদালতের সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল। এই নব্বই বছর বয়সেও তিনি যেভাবে মুখস্থ আবৃত্তি করছেন, সেটি তরুণদের পক্ষেও সম্ভব নয়। বিচারক নিশ্চিত যে তার মামলাকারী যুবক ছেলেও তার মতো করে পারবে না। বিচরকগণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সফোক্লিসের নাটক দেখছেন। লেখক শেষ করা মাত্র ওই কক্ষের সবাই দাঁড়িয়ে তাকে কুর্নিস জানাল। প্রধান বিচারক তার ছেলেকে বলল, তোমাকে ধন্যবাদ ইওফোন, তুমি বেকুবের মতো তোমার বাবাকে পাগল ঘোষণা করতে এখানে নিয়ে এসেছ বলেই আমরা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা নাট্যকারের চমৎকার অভিনয় চোখের সামনে দেখতে পেলাম। এখন আমাদের উচিত তোমাকে বিশাল জরিমানা করা। কিন্তু তুমি সফোক্লিসের পুত্র, সেই বিবেচনায় তোমাকে মাফ করা হলো। পিতার কাছে ক্ষমা চেয়ে তার আশীর্বাদ নিয়ে নাও। চোখের জল মুছে সফোক্লিস ছেলেকে ক্ষমা করলেন। ছেলে বুঝল, তার পিতা কেন জীবনে কোনো প্রতিযোগিতায় হারেননি।

তার দুদিন পরে থিয়েটারের মঞ্চে সফোক্লিস আবার অভিনয় করলেন ‘ইদিপাস কলোনাসে’। আবার প্রথম হলেন। পুরস্কার নিলেন।

কিন্তু মঞ্চ থেকে ফিরতে পারলেন না নাট্যকার। জীবনের শেষ নাটকের প্রথম পুরস্কার হাতে নিয়ে মঞ্চেই মারা গেলেন সফোক্লিস[১২১]। মধু ছড়াতে ছড়াতেই পৃথিবী ছেড়ে গেলেন এথেন্সের মধুকর। মৃত্যুতেও তিনি আরেকটি নতুন কাজ করে গেলেন। তিনি লিখে গেলেন, তার মৃত্যুতে যেন কোনো অনুষ্ঠান করান হয়, একেবারে অনাড়ম্বরে নিয়ে যাওয়া হয় সমাধিতে। তিনি সারা জীবন অনেক অনেক আড়ম্বরে ছিলেন, এবারে একাকী নিশ্চিন্তে ঘুমুতে চান।

কয়েক মাসের মধ্যে চলে গেলেন এথেন্সের ট্র্যাজেডির প্রধান দুই মানুষ – সফোক্লিস আর ইউরিপিডিস। সক্রেটিস ফুল দিলেন সফোক্লিসের কফিনে।

ইউরিপিডিস ও সফোক্লিস মারা গেছেন। এরিস্টোফানিস তাদের নিয়ে নাটক লিখবে। নাটকের নাম ‘ব্যাঙ’[১২২]।

এরিস্টোফানিস সারাজীবন ইউরিপিডিসকে ব্যঙ্গ করে নাটক লিখেছে, এখন মরণেও ছাড়বে না। সে প্লট বানাল —

মরার পরে নাট্যকার এস্কিলাস পাতালের সভাকবি হয়েছেন। এস্কিলাস পাতাল থেকে অন্য কোথাও যাবেন। তো পাতালের সভাকবি কে হবেন? এর মধ্যে ইউরিপিডিস মারা গেছেন, তিনি হতে পারেন। এই খবরে মানুষ দুঃখিত। ইউরিপিডিসের মতো নাট্যকার হবেন সভাকবি? ছিঃ ছিঃ ছিঃ। কিন্তু খবর এলো সফোক্লিসও মারা গেছেন। তাহলে পাতালের সভাকবি অবশ্যই হবেন সফোক্লিস। ইউরিপিডিস নন।

এই কাহিনি দিয়ে কমেডি বানিয়ে ফেললেন এরিস্টোফানিস। মঞ্চে আনলেন। সক্রেটিস গেলেন নাটক দেখতে। তিনি শুনেছেন, ইউরিপিডিসকে নিয়ে নাটক। তাই তিনি দেখতে গেছেন। নাটক দেখে তিনি নাট্যকার এরিস্টোফানিসের উপর ছিঃ ছিঃ করতে লাগলেন। মরার পরেও ওরা ইউরিপিডিসকে ব্যঙ্গ করে লিখছে।

নাটকে দেখিয়ে দিয়েছে, সফোক্লিস পাতালে গিয়েও ইউরিপিডিসকে হারিয়ে দিয়েছেন। মানুষ যাতে ভুলেও কোনোদিন ইউরিপিডিসকে বড় নাট্যকার না ভাবে, সেটি নিশ্চিত করে দিয়েছে এই নাটক

মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে সক্রেটিস সুসংবাদ পেলেন।

জেনথিপি দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিয়েছে। এটিও ছেলে। এবার ছেলের নাম সক্রেটিসের বাবার নামে রাখা হলো ‘সফ্রোনিকাস’।

***

১১৯. ইউরিপিডিসের শেষ নাটক। খ্রি. পূ. ৪০৬ অব্দে থেসালি নগরে অভিনীত হয়।

১২০. ইউরিপিডিস খ্রি. পূ. ৪০৬ অব্দে উত্তর গ্রিসের থেসালি নগরে মৃত্যুবরণ করেন।

১২১. ইউরিপিডিসের মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যেই খ্রি. পূ: ৪০৬ অব্দে সফোক্লিস মৃত্যুবরণ করেন।

১২২. ইউরিপিডিস এবং সফোক্লিসের মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই এরিস্টোফানিস খ্রি. পূ. ৪০৫ অব্দে ডিওনিসাস উৎসবে ‘ব্যাঙ’ বা Frogs কমেডি নাটকটি মঞ্চস্থ করেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *