৪৮
‘শক্তিকে সুপথ না দেখালে তা ক্ষতিই ডেকে আনে।’
—ইউরিপিডিস
***
এথেন্সে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা হচ্ছে। নারীদের নয়, পুরুষদের। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ বাছাই করা হচ্ছে। সে হবে মিস্টার এথেন্স।
প্রতিযোগী হিসেবে খোলা আকাশের নিচে অনেক অল্পবয়সী ছেলে স্বল্প বসনে লাইন ধরে দাঁড়িয়েছে। বিচারকরা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাপ নিচ্ছেন। ছেলেদের চলন-বলন পরীক্ষা হচ্ছে। সারাদিন বিস্তর মাপামাপির পর শেষ বিকেলে ঘোষণা হলো, ‘এ বছর মিস্টার এথেন্স হয়েছে এথেন্সের অহংকার এলসিবিয়াডিস।’ তাকে জলপাই শাখার মুকুট পরিয়ে দিচ্ছে আগের বছরের মিস্টার এথেন্স। তার উপর ফুল বর্ষণ হচ্ছে। সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে। তার চারদিকে এখন প্রশংসার বন্যা।
সক্রেটিস নীরবে শিষ্যের বিজয় দেখছেন। দেখতে দেখতে ভাবছেন সৌন্দর্য কী জিনিস? তার পাশে হিপ্পিয়াস’[১১৭] নামের একটি ছেলে। সক্রেটিস দুম করে ছেলেটিকে প্রশ্ন করলেন, সৌন্দর্য মানে কী?
হুট করে এমন প্রশ্নে ছেলেটি ঘাবড়ে গেছে। উত্তরে খুঁজে পাচ্ছে না। একটু ভেবে লাজুক লাজুক মুখে বলল, সুন্দরের কথা ভাবলে আমার শুধু মেয়েদের ছবি মনে আসে। একটি সুন্দর মেয়েই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস।
সক্রেটিস হাসতে হাসতে বললেন, মনের সত্য কথাটাই বলেছ। তবে মেয়েদের মতো সুন্দর আরও অনেক কিছুই আছে। মেয়েদের চেয়ে দেবীরা আরও বেশি সুন্দর। এই তুলনার শেষ নেই। দেহের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। আজ যে মেয়েকে সুন্দর ভাবছো, কালকে তাকে অসুন্দর ভাববে। পরদিন আরেক মেয়েকে তার চেয়ে বেশি রূপবতী মনে হবে। তাই দেহের সৌন্দর্য দিয়ে কিছুকে সুন্দর বলা যায় না। দেহের সৌন্দর্য ফুরিয়ে যায়।
ছেলেটি ভাবছে রূপ ফুরিয়ে যায়? রূপ ক্ষণস্থায়ী, তাহলে দীর্ঘস্থায়ী কী আছে? ভেবে বলল, সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা এগুলোর মূল্য ফুরায় না। এগুলোই হলো সুন্দর জিনিস।
সক্রেটিস আঙ্গুল দিয়ে দেবী এথিনার মূর্তি দেখিয়ে বললেন, মূর্তিটিতে স্বর্ণ আছে, আবার হাতির দাঁতের কারুকাজও আছে। সোনার চেয়ে হাতির দাঁতের কারুকাজ বেশি সুন্দর। ধন-সম্পদ একটির চেয়ে অন্যটি বেশি মূল্যবান। তুমি রুপাকে সুন্দর বললে সোনা রাগ করবে, আবার সোনাকে সুন্দর বললে হীরা রাগ করবে। এর শেষ নেই।
ছেলেটি বলল, তাহলে আপনিই বলুন সুন্দর মানে কী?
সক্রেটিস হতাশ। ছেলেটির সাথে প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা জমল না। তিনি বললেন, তাহলে শোনো :
‘কোনো একটি বস্তুর যে কাজ, বস্তুটি যদি ঐ কাজ যথার্থভাবে করতে পারে, তাহলেই বস্তুটি সুন্দর। যেমন : চোখের কাজ হলো দেখা। যে চোখ যত ভালো দেখতে পায়, সেই চোখ তত সুন্দর।’
ছেলেটি সক্রেটিসের চোখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে একটি হাসি দিল সক্রেটিসের চোখগুলো বিশাল বড় বড়, একেবারে গরুর চোখের কাছাকাছি। বন্ধুরা তার চোখ নিয়ে অনেক হাসাহাসি করে। তার নাকও মোটা, থেবড়ানো।
সক্রেটিস বললেন, আমার চোখ ইয়া বড় কিন্তু এই চোখ সুন্দর কারণ এই চোখ দিয়ে আমি অনেক বেশি দেখতে পাই। আমার নাক বোঁচা কিন্তু এই নাক সুন্দর কারণ এই নাক দিয়ে আমি বেশি ঘ্রাণ নিতে পারি।
ছেলেটি হা করে সক্রেটিসের নাক, চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সক্রেটিস বললেন, যা আমাদের কাজে লাগে, যা আমাদের প্রিয়, আর যা দেখে বা শুনে আমরা আনন্দিত হই, সেসব জিনিসই সুন্দর।
ছেলেটি ভাবছে, সক্রেটিস সুন্দরের যে সংজ্ঞা দিলেন তাতে পৃথিবীতে অসুন্দর কিছুই নেই। সে সাহস করে বলে ফেলল, তাহলে অসুন্দর কী?
সক্রেটিস বললেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস হচ্ছে জ্ঞান আর সবচেয়ে অসুন্দর জিনিস হচ্ছে অজ্ঞানতা। জ্ঞানের আলোয় সবকিছু সুন্দর। অজ্ঞানতার অন্ধকারে সবকিছু অসুন্দর। জ্ঞান থাকে অন্তরে। তাই সৌন্দর্য বাইরের কোনো বিষয় নয়, সৌন্দর্য হলো অন্তরের উপলব্ধির বিষয়।
পাশ থেকে তাদের আলাপ খেয়াল করছিল মিস্টার এথেন্স এলসিবিয়াডিস। চ্যাম্পিয়ন হওয়া উদযাপনের মধ্যেও সে সক্রেটিসকে খেয়াল করছিল। সে চিৎকার করে বলল, কী শোনালে গুরু! সৌন্দর্য বাইরের বিষয় নয়, ভেতরের বিষয়। শরীরের সৌন্দর্য তো বাইরের জিনিস! তাহলে আমি শরীরের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ভুল করেছি।
এর পরে সে যেটি বলল সেটি একেবারে শব্দ বোমা। সে বলল, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এই মুকুট ফিরিয়ে দেব। যে দ্বিতীয় হয়েছে, আমি তাকে মিস্টার এথেন্স বলে ঘোষণা করছি।
সকলে স্তুম্ভিত। এই ছেলে কী বলছে? সক্রেটিস সৌন্দর্য নিয়ে কী না কী বললেন, আর তাতেই এত বড় সম্মান ফিরিয়ে দেবে! পুরস্কার হিসেবে সে পেয়েছে একশো এম্ফোরা জলপাই তেল। এম্ফোরা মানে বিরাট বড় মাটির মটকি। একশো এম্ফোরা জলপাই তেলের অনেক দাম, দুখানা বিশাল জাহাজ কেনা যায় সেই দামে। এই বিশাল অর্থ ফিরিয়ে দেবে?
সকলকে অবাক করে দিয়ে সে সেটিই করল। হাজার হাজার মানুষ দেখছে তার দাসেরা একশ মটকি জলপাই তেল তার গাড়ি থেকে নামিয়ে অন্য গাড়িতে তুলে দিচ্ছে। প্রতিযোগিতার প্রধান বিচারক বললেন, এরকম ঘটনা এথেন্সে আর কোনোদিন ঘটেনি। এত বড় সম্মান আর এত টাকার তেল ফিরিয়ে দিচ্ছে? এলসিবিয়াডিসের কলিজা আছে। এই ছেলে সত্যিকার বীর। এই তো আমাদের একিলিস। একজন বলল, পদক ফিরিয়ে দিয়ে তুমি প্রমাণ করলে যে, তুমিই এথেন্সের চিরকালের সুন্দর মানুষ। তুমি সর্বকালের সেরা সুন্দর।
তবে কিছু দুষ্ট মানুষ বলল, ‘সক্রেটিস তো ওর প্রেমিক, প্রেমিকের কথায় সবকিছু ত্যাগ করল।’ যাই হোক দুষ্ট লোক সব জায়গাতেই থাকে, তারা ছাড়া বাকি সবাই তার প্রশংসার শুধু পঞ্চমুখ নয়, একেবারে সপ্তমুখ হয়ে গেল।
সবাই ঘাটে পথে সব জায়গায় এলসিবিয়াডিসের প্রশংসা করে, কিন্তু সে শুধু একজনেরই প্রশংসা করে, তিনি হলেন সক্রেটিস। সে যেখানে যায়, সবখানেই সক্রেটিসের প্রশংসা করে। সবখানে বড় গলায় বলে, আমি যা কিছু করি, সব সক্রেটিসের কথায় করি। কেউ যদি বড় হতে চাও, সক্রেটিসের পথ ধরো। এথেন্সে একজনই শিক্ষকই আছেন। তিনি হলেন সক্রেটিস।
সক্রেটিস সামনে থাকলে তাকে থামিয়ে দেন। কিন্তু সামনে না থাকলে, এলসিবিয়াডিস যা খুশি বলতে থাকে। প্রশংসার বন্যায় সক্রেটিসকে ভাসিয়ে দেয়। সে বলে, সক্রেটিসের কথা প্রথমে শুনলে মনে হবে অকাজের কথা, দরকারবিহীন কথা। মনে হবে ঠাট্টা করে খোঁচা মারছে। কিন্তু ভালো করে মনোযোগ দিলে বোঝা যায় কত সূক্ষ্ম সেই খোঁচা। তার সহজ কথার মধ্যে কত কিছু লুকিয়ে আছে!
যে সূক্ষ্ম খোঁচার কথা সে বলছে সেটি হলো আয়রনি (Irony), আয়রনির এমন ব্যবহার সক্রেটিসের আগে কেউ করতে পারেনি। সে সব সময় মানুষকে হাসাচ্ছে, হাসতে হাসতে এমন গভীর কথা বলছে যাতে জীবনের অর্থ বদলে যাচ্ছে। নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে মানুষকে।
***
এলসিবিয়াডিসের একটি মারাত্মক দোষ আছে। সুন্দর মানুষ খুব সহজেই যে দোষে দুষ্ট হয়, সেও সেই দোষে আক্রান্ত। সে অত্যধিক রকম স্ত্রী-ক্ষীণা মানুষ। মেয়েদের প্রতি ভীষণ দুর্বল। তার চরিত্র ভয়াবহ। তার নামে রগরগে কাহিনি মানুষের মুখে মুখে। সেসব কাহিনির অনেকগুলোই সত্য। এটি জানে তার মামি আসপাশিয়া। পেরিক্লিস মারা যাওয়ার পর এলসিবিয়াডিস এখন সংসারের কর্তা। তাকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। সে সারা রাত কোথায় কোথায় থাকে কেউ জানে না। আসপাশিয়া গভীর রাত পর্যন্ত বসে থেকে বুঝতে পারে এই ছেলে আর আসবে না।
তাকে সুপথে আনতে সক্রেটিস আর আসপাশিয়া বুদ্ধি করে তার বিয়ে দিয়ে দিল। উচ্চ ঘরের সুশীলা বউ এলো তার ঘরে। মেয়েটিকে তার স্বামীর চরিত্র নিয়ে মানুষ নানা কথা বলে। কিন্তু মেয়েটি বিশ্বাস করে না। কিন্তু দিনে দিনে বুঝতে পারল মানুষ ঠিকই বলে। অনেক দিন ধৈর্য ধরে অবশেষে স্ত্রী তার নামে ডিভোর্সের মামলা করল। এলসিবিয়াডিস গেল সক্রেটিসের কাছে। সক্রেটিস পরামর্শ দিলেন, ‘স্ত্রীকে প্রেমে ভুলিয়ে ঘরে নিয়ে এসো।’ এলসিবিয়াডিস সেটিই করল, কিন্তু অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে। ডিভোর্স আদালতে সবার সামনে স্ত্রীকে চুমো দিয়ে বলল, ‘বউ ভুল করেছি, মাফ করে দাও, আর করব না, বাড়ি চলো।’ বিস্ময়ে হতবাক মেয়েটি স্বামীর সাথে ঘরে ফিরে এলো। কিন্তু এলসিবিয়াডিস বদলাল না। সে তার একই রকম জীবন চালিয়ে গেল। কয়েক মাসের মধ্যেই স্ত্রী ডিভোর্স নিয়ে এলসিবিয়াডিসকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেল।
আলোয়-কালোয় মিলিয়ে এক বর্ণিল জীবন এলসিবিয়াডিসের। সে জীবনকে নিংড়ে নিংড়ে উপভোগ করছে। পেরিক্লিসের অনেক সম্পদের মালিক সে। ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। সে উদ্ধত, কাউকে মানে না। সে সংসদে বক্তৃতা করতে উঠলে চারদিক জ্বলে ওঠে। অনেকেই বলে পেরিক্লিসের উত্তরসূরি পাওয়া গেল। কিন্তু একটি বড় পার্থক্য হলো পেরিক্লিস গণতন্ত্র ভালোবাসতেন। কিন্তু এই ছেলে সেসবের মধ্যে নেই। তার মনের মধ্যে একজন একনায়ক আছে। সে যা ভালো মনে করে তাই করবে।
এত কিছু হচ্ছে, তার মধ্যে যুদ্ধও হচ্ছে। এথেন্স আর স্পার্টার মধ্যে থেমে থেমে যুদ্ধ চলছে। পেরিক্লিস ছাড়া এথেন্স এখন দুর্বল। স্পার্টা ভেবেছিল দুৰ্বল এথেন্সকে তারা তুড়ি মেরে হারিয়ে দেবে। কিন্তু তা হয়নি। এথেন্স দুর্বল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু যারা বেঁচে আছে, তারা দ্বিগুণ সাহসে উঠে দাঁড়িয়েছে। পেরিক্লিসের স্বপ্ন তারা ধূলিসাৎ হতে দেবে না। এখন যুদ্ধে এক নম্বর হলো এলসিবিয়াডিস। সে সিংহের মতো সাহসী আর শিয়ালের মতো ধূর্ত। সে কাউকে পরোয়া করে না। তার যুদ্ধ কৌশল আর সাহস সবাই পছন্দ করছে। সে এখন এথেন্সের তরুণ নেতা।
নেতার মতোই তার ভাবসাব, সে কাউকে পাত্তা দেয় না, শুধু সক্রেটিসের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। সক্রেটিস তাকে বুদ্ধি দেন। ভালো মানুষ করার পরামর্শ দেন। নেতা হওয়ার কৌশল শেখান। সক্রেটিস তার জীবন বাঁচিয়েছেন। এথেন্সে সক্রেটিসই একমাত্র মানুষ যিনি কথা আর কাজে এক। তিনি শুধু মুখেই ভালো ভালো কথা বলেন না, কাজেও একই রকম। তার মতো জীবন শুধু বইতে পাওয়া যায়, কাহিনিতে পাওয়া যায়। বাস্তবে এরকম পাওয়া যায় না। এথেন্সের দেবতারাও সুসময়ে ভালো, আর অসময়ে খুব খারাপ। কিন্তু সক্রেটিস সুসময় আর অসময় সবটাতেই একই রকম। সে সারাদিন সক্রেটিসের সাথে আঠার মতো লেগে থাকে।
এলসিবিয়াডিস একদিনও সক্রেটিসের আড্ডা মিস করে না। সিম্পোজিয়ামে সে নিজে এসে সক্রেটিসকে নিয়ে যায়। তার ঘোড়া আছে। কিন্তু সক্রেটিস ঘোড়ার চড়ে না, তিনি হেঁটেই যাবেন। তাই এলসিবিয়াডিসও এখন হেঁটেই যায়।
তার কারণে সক্রেটিসের সুনাম দুর্নাম দুইই বাড়ছে। সক্রেটিস এসব নিয়ে মাথা ঘামান না। তিনি শিক্ষক, এলসিবিয়াডিসকে গভীর মায়া করেন। বাচ্চা যতই দুষ্টামি করুক, মা তাকে মৃদু বকুনি দিয়ে একটু পরেই বুকে নেন; তেমনই এলসিবিয়াডিস যতই দুষ্ট হোক, সক্রেটিস তাকে আগলে রাখেন, আশ্রয় দেন। এথেন্সে সবাই জানে যে এলসিবিয়াডিসের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হলো সক্রেটিস আর সক্রেটিসের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র হলো এলসিবিয়াডিস।
***
এলসিবিয়াডিস এথেন্সে নিত্য নতুন চমক দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় চমক দিচ্ছে অলিম্পিক প্রতিযোগিতায়। অলিম্পিকে স্পার্টাই চ্যাম্পিয়ন হয়। স্পার্টার সাথে এথেন্স কিছুতেই পারে না। এটি এলসিবিয়াডিসের সহ্য হয় না। তার অলিম্পিক পদক চাই। পদক পাওয়ার উপায়ও সে বের করে ফেলল। অলিম্পিকে ঘোড়ার রথের একটি খেলা আছে। টাকা থাকলেই এই খেলায় জেতা যায়। এলসিবিয়াডিসের কাছে টাকা কোনো সমস্যা নয়। সে অনেক টাকা দিয়ে পৃথিবীর সেরা ঘোড়া কিনল, নিয়োগ দিল পৃথিবীর সেরা প্রশিক্ষক। তার প্লান কাজে এলো। সে চ্যাম্পিয়ন হলো। এথেন্স পেল অলিম্পিক পদক। একবার দুইবার নয়, সে টানা সাত বছর ধরে প্রথম হলো।
এথেন্সের ইতিহাসে কেউ কোনোদিন সাতটি অলিম্পিক পদক পায়নি। সে নতুন যুগের বীর, সে নতুন একিলিস, নতুন হারকিউলিস। সে যেখানে হাত দেয় সেখানেই সোনা ফলে। সে ভাবছে অলিম্পিক জয় তো হলো, এখন স্পার্টার সাথে যুদ্ধটা জেতা দরকার। সে যুদ্ধ বিষয়ে একটি নতুন পরিকল্পনা করল। এথেন্স সিসিলি[১১৮] দ্বীপ আক্রমণ করবে। সিসিলি দখল করলে অনেক সম্পদ পাওয়া যাবে, সেই সম্পদ দিয়ে সেনা ভাড়া করে স্পার্টাকে হারাবে। সে সংসদে বলল, ‘শুধু এই একটি উপায়েই আমরা স্পার্টাকে হারাতে পারি।’ এই মুহূর্তে তার চেয়ে জনপ্রিয় মানুষ কেউ নেই। সে যা বলে সবাই তার সাথে হয় হয় করে। তার প্রস্তাব সংসদে পাস হলো। এথেন্স সিসিলি আক্রমণ করবে।
সবাই খুশি। সক্রেটিস খুশি নন। এই ছেলেটি সব সময় হিরো হতে চায়। শুধু শুধু ঝুঁকি নেয়। সক্রেটিস এত বড় ঝুঁকি নিতে তাকে নিষেধ করলেন। কিন্তু এলসিবিয়াডিস শুনবে না। সে হিরো হবে।
রাত পোহানোর আগে এলসিবিয়াডিস এথেন্সের বিশাল নৌবাহিনী নিয়ে ভেসে চলল সিসিলি অভিমুখে। কিন্তু দিনের আলো ফুটতেই দেখা গেল ভয়াবহ অঘটন। এথেন্সের সবার বাড়ির সামনে দেবতা হার্মিসের মূর্তি থাকে, সেগুলো সব ভাঙা। ভয়াবহ অধর্মের কাজ। এত বড় দুঃসাহস কার? কয়েকজন সাক্ষী দিল, ‘এই কাজ এলসিবিয়াডিসের। কাল রাতে তাকে বন্ধুদের নিয়ে রাস্তায় মদ খেতে দেখা গেছে। তারা মাতালামি করছে আর দেবতাদের গালি দিয়েছে। তারাই নিশ্চয়ই দেবতার মূর্তি ভেঙ্গেছে। এই ভয়ংকর কুকর্ম তার দলবলই করেছে।’ তার নামে বিচার বসল। দ্রুত বিচার। তার অনুপস্থিতিতেই রায় হলো : মৃত্যুদণ্ড।
সে তখন সিসিলির পথে। তো আরেকটা জাহাজ পাঠাও, তাকে ধরে এনে হত্যা করো। এক মুহূর্তে সে সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ থেকে সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষ হয়ে গেল। শত্রুরা তার নামে যা খুশি বলতে শুরু করল। সারা এথেন্সে তার নামে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেল। জাহাজ গেল তাকে ধরে আনতে। তার বন্ধুরা গোপনে অন্য জাহাজে খবর পাঠাল, ‘পালিয়ে যাও। ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। এথেন্সে আর এসো না। পালাও।’ এলসিবিয়াডিস জানতেও পারল না কারা তাকে ফাঁসাল। তার মনে হলো এক সকালে ঘুম ভেঙে দেখছে সে হঠাৎ হিরো থেকে জিরো হয়ে গেছে। সে পালিয়ে গেল। ছোট্ট নৌকা নিয়ে ভেসে পড়ল অজানা সাগরে। শুরু হলো তার অন্য এক জীবন।
এই ঘটনায় জাহাজের সৈনিকরা হতবাক, তারা আর সিসিলি আক্রমণ করতে চায় না। নতুন সেনাপতি নিকিয়াস এথেন্স সংসদে অনুরোধ পাঠাল, ‘সিসিলি আক্রমণের সমস্ত পরিকল্পনা ছিল এলসিবিয়াডিসের, সে ওই এলাকা চিনত, আমরা কেউ ওই দ্বীপ চিনি না, তাকে ছাড়া আক্রমণে যাওয়া বোকামি হবে, যুদ্ধ বন্ধ থাকুক।’ এই চিঠি পেয়ে এথেন্সে সংসদে গর্জে উঠল গণতন্ত্রের নেতারা, ‘বলে কী এসব! এলসিবিয়াডিস ছাড়া কি এথেন্স যুদ্ধও করতে পারবে না? আমরা শয়তান এলসিবিয়াডিসকে শাস্তিও দেব, আর তাকে ছাড়া যুদ্ধও করব।’ এথেন্স থেকে নিকিয়াস আদেশ পেল, যুদ্ধ হবেই, আর সেটি তোমাকেই করতে হবে সেনাপতি হিসেবে। একটি অনিচ্ছুক যুদ্ধ করতে তারা গেল সিসিলিতে। সেখানে এথেন্স বাহিনী শোচনীয়ভাবে হেরে গেল। নিকিয়াস মারা গেল সেখানেই। এই নিকিয়াসও ছিল সক্রেটিসের শিষ্য।
এই পরাজয়ের জন্য সবাই দায়ী করল এলসিবিয়াডিসকে। এথেন্সে এখন এলসিবিয়াডিস একটি গালির নাম। কোনো হটকারী যুবক দেখলেই লোকে বলে, তুই একটি এলসিবিয়াডিস 1
চোখের জলে বুক ভাসিয়ে সক্রেটিস ক্রিতোকে বললেন, এই কাজ সে করেনি। এথেন্সের নিয়ম সে জানে। দেবতার অপমান করা তার কাজ নয়। তাকে কেউ ফাঁসিয়েছে।
ক্রিতো বললেন, সমস্যা হলো, তার কাজের জন্য এখন সবাই দোষী করছে তোমাকে। সবাই বলছে, সক্রেটিসই এলসিবিয়াডিসকে কুশিক্ষা দিয়েছে।
সক্রেটিস শান্তভাবে বললেন, শিষ্য ভালো কিছু করলে যেমন গুরুর সুখ্যাতিতে মানুষের মুখে খই ফোটে, তেমনই শিষ্য মন্দ কিছু করলে মানুষের নিন্দাটাও গুরুকে সহ্য করতে হবে। মানুষের নিন্দা নিয়ে আমি ভাবছি না। আমি ভাবছি, ছেলেটা এখন কোথায় আছে?
ক্রিতো বললেন, চিন্তা নেই। সে পারস্যে আছে। সেখানে রাজাকে পরামর্শ দেওয়ার চাকরিও পেয়ে গেছে। সে পারস্যের রাজার মিলিটারি উপদেষ্টা।
সক্রেটিস বললেন, এই কদিনের মধ্যেই সে আমাদের শত্রু পারস্য রাজার এমন বিশ্বাসী লোক হয়ে গেল যে একেবারে মিলিটারি উপদেষ্টা করে ফেলল!
ক্রিতো হেসে বললেন, চক্ষের নিমেষে মানুষকে মুগ্ধ করার গুণ সে তোমার কাছ থেকেই শিখেছে। তার মুখের কথা বিশ্বাস না করে উপায় নেই।
কিন্তু না, এলসিবিয়াডিস কী করবে, সে নিজে ছাড়া কেউ জানে না। অল্প কদিনেই সে পারস্যের রাজার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এথেন্সের আরেক শত্রু নগর স্পার্টায় হাজির হলো। স্পার্টার রাজা দেখল, ‘এথেন্সের সেরা যোদ্ধা এখন আমার কাছে। ও এথেন্সের ঘরের খবর জানে। ওর বুদ্ধিতেই আমি এথেন্সকে হারিয়ে দেব।’ রাজা এক মুহূর্তে তাকে সম্মানের সাথে নিজের উপদেষ্টা করে ফেলল। এথেন্সে খবর এলো এলসিবিয়াডিস স্পার্টার পক্ষে যোগ দিয়েছে। এথেন্সবাসী ছিঃ ছিঃ করতে লাগল, ‘এ কী রকম বিশ্বাসঘাতকতা? এত বছর ধরে আমাদের সাথে স্পার্টার যুদ্ধ চলছে, আর আমাদের সবচেয়ে চৌকশ জেনারেল চলে গেল তাদের পক্ষে? ওর তো দেশপ্রেম বলতে কোনো জিনিসই নেই। সে আমাদের সব যুদ্ধকৌশল স্পার্টাকে বলে দেবে, আর আমাদের ওরা আমাদের কচুকাটা করবে। এথেন্সের জেতার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। এক এলসিবিয়াডিসই বুদ্ধি দিয়ে আমাদের হারিয়ে দিবে।’ আরেক দল বলল, ‘এলসিবিয়াডিস আসলে আমাদের শত্রুদের লোক, এতদিন এথেন্সে গোপনে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। সে অন্য দেশের গুপ্তচর।’ আরেক দল বলল, ‘এলসিবিয়াডিস খারাপ হলে তার বন্ধুরা কেমন? তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ সক্রেটিস কেমন? তাদের বন্ধুচক্রের সবাই স্পার্টার লোক। তাদের এক নম্বর পাণ্ডা সক্রেটিস।’
মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই স্পার্টায়ও এলসিবিয়াডিস ঝামেলায় পড়ল। এবারের ঘটনা হৃদয়ঘটিত। স্পার্টার রানির সাথে তার গোপন প্রেম হয়ে গেছে। এমন গভীর প্রেম যে রানি তার সাথে পালিয়ে যাবে। আর একবার হেলেন আর প্যারিসের ঘটনা ঘটবে স্পার্টার রাজমহলে। রাজা দেখলেন, মহা বিপদ উপস্থিত। তিনি দুধকলা দিয়ে সাপ পুষেছিলেন। দুষ্ট সাপ এলসিবিয়াডিসকে হত্যার আদেশ দিলেন রাজা। কিন্তু চতুর এলসিবিয়াডিস ততক্ষণে স্পার্টা থেকে অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে। এবার সে এথেন্সে ফিরে আসবে। খবর দিল, ‘আমি আসলে বুদ্ধি করে স্পার্টার গোপন খবর আনতে সেখানে গিয়েছিলাম। স্পার্টাকে হারানোর সব গোমর এখন আমি জানি। আমি আসছি এথেন্সে।’ এখন তার সাথে অনেক টাকা। টাকা দিয়ে এথেন্সের নেতাদের কিনে ফেলল সে। তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ বাতিল করা হলো। বীরের মতো আবার এথেন্সে ফিরলো এলসিবিয়াডিস। এথেন্সে ফিরেই যুদ্ধের জন্য তৈরি হলো। আবার শত্রু স্পার্টার সাথে লড়বে সে। কয়েকটি ছোট যুদ্ধে জিতেও গেল। কিন্তু আবারও একটি বড় যুদ্ধে হেরে গেল স্পার্টার কাছে। এবারও সবাই তাকেই দায়ী করল। সবাই বলল, সে ইচ্ছে করে এথেন্সকে হারানোর জন্য এমন করেছে, সে একজন বিশ্বাসঘাতক। তার বিচার হবে। সে আবার পারস্যে পালিয়ে গেল। এবার আর পারস্যের রাজা তাকে দরবারে জায়গা দিল না। দূরে এক ছোট্ট দ্বীপে সরদার করে পাঠিয়ে দিল। সেই দ্বীপে প্রেম করার নিয়ম নেই। পারস্যের রাজা তাকে বলে দিয়েছিল, ‘ঐ দ্বীপে যাই করো, কোনো সমস্যা নেই। শুধু ওখানের মেয়েদের দিকে নজর দিও না। ওরা একেবারে প্রাণে মেরে ফেলবে।’ কিন্তু এলসিবিয়াডিস তো নিয়ম মানার লোক নয়। নতুন দ্বীপে গিয়েও সে ভাব করল সরদারের মেয়ের সাথে। এক রাতে সে প্রেমিকার কাছে গিয়েছে, আর লোকজন তাকে ঘেরাও করল। ন্যাংটা অবস্থায় সে পালানোর জন্য দৌড় দিল। কিন্তু একটি বর্শা এসে লাগল তার বুকে অনেকে বলে, স্পার্টা থেকে ভাড়াটে খুনি তাকে হত্যা করেছে। যখন সে মারা গেল, তার পরনে কিছুই নেই। ন্যাংটা অবস্থায় মৃত্যু হলো তার। শাস্তি হিসেবে সেভাবেই তার দেহ পাঠিয়ে দিল এথেন্সে। এথেন্সে এসে পৌঁছল এলসিবিয়াডিসের ন্যাংটা লাশ।
লাশ দেখে সবাই বলে, কেন ছেলেটার এমন হলো? জীবনে কি কোনো শিক্ষা পায়নি? উত্তর হলো, শিক্ষা পেয়েছে। সক্রেটিস শিক্ষা দিয়েছে। সক্রেটিসের কাছে এর কোনো উত্তর নেই। এলসিবিয়াডিস সবার কাছে উচ্চ স্বরে বলে বেড়াত, সে সক্রেটিসের সবচেয়ে বড় ভক্ত। সক্রেটিসের কথায়ই সে ওঠে বসে। শিষ্য পাপ করলে, সেই দায় নিতেই হবে। এথেন্সের মানুষের কাছে এখন সক্রেটিসের একমাত্র পরিচয়, সে নষ্ট যুবক এলসিবিয়াডিসের গুরু।
.
এলসিবিয়াডিস মারা যাওয়ার পর সবচেয়ে বিপদে পড়েছে আসপাশিয়া পেরিক্লিসের মৃত্যুর পর সে ছিল সংসারের পুরুষ। আসপাশিয়া সন্তানকে বড় করার কাজে মনোযোগ দিয়েছিল। এক রকম দিন কাটছিল। কিন্তু এলসিবিয়াডিস মারা যাওয়ার পর সত্যিকার বিপদ এলো। বড় বিপদ। আসপাশিয়া তো এথেন্সের নাগরিক নয়। সে একা ভদ্রভাবে জীবন কাটাতে পারবে না। লোকজন উৎপাত শুরু করল। পেরিক্লিস নেই, তার ভরসাও নেই। সে একা বিধবা যার সহায় কেউ নেই। এমনকি আইনও নেই। যেহেতু সে এথেন্সের নাগরিক নয়, তার সাথে খারাপ কিছু হলে এথেন্সের আইনে বিচার হবে না।
প্রতিদিন নানান প্রস্তাব আসছে। অনেক পুরুষই ঘরে নিতে চায় বুড়ি আসপাশিয়াকে। কেউই বিয়ে করতে পারবে না। তাই নেওয়ার লোকের অভাব নেই। বিষয় একটিই— আসপাশিয়া একা থাকতে পারবে না। তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হোক, অত্যাচারে হোক তার জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। অনেক দিন একলা থাকলেও আর পারল না। অবশেষে এক মহিষের খামারের মালিকের ঘরে চলে গেল আসপাশিয়া। ছেলে রইল পেরিক্লিসের বাড়িতে, ছেলে মোটামুটি বড় হয়ে গেছে। এখন নিজেই চলতে পারে।
যেভাবে একদিন এসেছিল এই ঘরে, সেভাবেই এক গাধার গাড়িতে করে পেরিক্লিসের বাড়ি ছেড়ে গেল। সে অনেক উচ্চ পর্যায়ের দার্শনিক। কিন্তু নারী পেরিক্লিস মারা যাওয়ার পর তার দার্শনিক পরিচয় মুছে গেছে, নারী হিসেবেই তাকে ছেড়ে যেতে যেতে হলো এই ঘর। এথেন্সের জীবন থেকে আসপাশিয়া মোটামুটি মুছে গেল।
***
১১৭. প্লেটোর Hippias Major ডায়ালগে সক্রেটিস তার সাথে আলোচনায় সৌন্দর্যের সংজ্ঞা দেন।
১১৮. ভূমধ্যসাগরের বড় দ্বীপ সিসিলি, যেটি বর্তমানে ইতালির অন্তর্গত।