৪৭
‘সময়ের থেকে কিছু লুকিও না,
ও সব দেখতে পায়, সব শুনতে পায়;
একদিন সব প্রকাশও করে দেয়।’
— সফোক্লিস
***
আজ জেনথিপি তার ভালোবাসার শক্তি পরীক্ষা করবেন।
গত কিছুদিন ধরে জেনথিপি খুব ভালো আছেন। তিনি বেশি বেশি বাইরে যাচ্ছেন। আগে বাইরে যেতে পারতেন না। এখন পুরুষের সংখ্যা কমে গেছে। এখন মেয়েরা নিয়মিতই বাইরে যায়। বাইরে গিয়ে তিনি টের পেলেন সক্রেটিস আসলে খুব জনপ্রিয় মানুষ। তার অনেক ছাত্র। অনেক শিষ্য। তার কথায় ওঠে বসে, এমন মানুষের সংখ্যা এথেন্সে অনেক। রাস্তা দিয়ে জেনথিপি হাঁটলে, লোকজন ফিসফিস করে, ঐ যে সক্রেটিসের বউ যায়। তার স্বামী এথেন্সের খুবই পরিচিত মানুষ। জীবিত মানুষদের মধ্যে তার মতো শ্রদ্ধার মানুষ খুব অল্প আছে। এথেন্সের যেকোনো নেতার চেয়ে এখন সক্রেটিসকে মানুষ বেশি ভালোবাসে। যারা শ্রদ্ধা করে না, তারা গালি দেয়; কিন্তু সক্রেটিসকে সমীহ করে না এমন মানুষ খুব কম আছে। খুব অল্প বয়সে যারা সক্রেটিসের ভক্ত হয়েছিল, তারা এখন মধ্যবয়সী। তারা সক্রেটিসকে চেনে। তারা তাকে আপন ভাবে। তবে শত্রু কমেনি। কিছু মানুষ আগে যেমন শত্রু ছিল, এখনও তাই আছে।
এখন দেশ-বিদেশের অনেক ছেলে আসে সক্রেটিসের সাথে আলাপ করতে। অন্য দেশ থেকে অনেকেই তাকে নিমন্ত্রণ করে। সক্রেটিস যে বিশেষ কেউ, সেটি দেশ-বিদেশের লোক জানে।
স্বামীর জন্য গর্ব হলো জেনথিপির। এত বছর এই ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। সক্রেটিসের ঘরের জীবন আর বাইরের জীবনের সূত্র হতে পারেননি। এখন সময় এসেছে। স্বামীর প্রতি নজর দেওয়া দরকার।স্বামী এখন প্রায় ষাট বছরের বুড়ো।
বুড়ো স্বামীকে সাজাতে চান জেনথিপি। অনেক বছর আগে একজোড়া চটি কিনেছিলেন। সক্রেটিস ছুঁয়েও দেখেননি। সেই চটি জোড়া বের করলেন। আজ তিনি স্বামীকে জুতা পরাবেনই। দেখি ভালোবাসার শক্তি কতখানি!
আজ বিকেলে সক্রেটিসের দাওয়াত আছে। একটি সিম্পোজিয়াম আছে। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। সিম্পোজিয়ামে সবাই অনেক সেজেগুজে যায়। তার স্বামী কোনোদিন সাজেন না। আজ তিনি স্বামীকে সাজাবেন। একটি নতুন কাপড় বের করলেন। আর চিরুনিটা সামনে রাখলেন। নিজের হাতেই যা করার করতে হবে।
সক্রেটিস কিছুই বুঝতে পারছেন না। কী ভূত চেপেছে স্ত্রীর মাথায়!
জেনথিপি নিজের হাতেই নতুন কাপড় পরিয়ে স্বামীর চুল আঁচড়ে দিলেন। এবার চটি পরার সময়। চটি দেখেই সক্রেটিসের মুখ কালো হয়ে গেল। এতক্ষণ যা করেছেন, তা না হয় হলো। কিন্তু জুতা? সবাই জানে তিনি জুতা পরেন না। এখন লোকে কী বলবে? তাছাড়া তার জীবনের লক্ষ্য হলো— যথাসম্ভব কম জিনিসে সুন্দর জীবন।
এখন বউয়ের জন্য জীবনের একেবারে মৌলিক জিনিস ত্যাগ করতে হচ্ছে। তিনি জেনথিপির মুখের দিকে তাকালেন। সেই মুখে একটি মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে আছে। হাসিতে আবদার আছে। স্বামী কথা রাখবেন সেই আবদার।
সক্রেটিসের মনে পড়ল সফোক্লিসের সংলাপ, ‘আমি পৃথিবীতে এসেছি শুধু ভালোবাসার জন্য’। তিনি মাঝে মাঝেই বন্ধুদের বলেন, ‘আমি শুধু একটি জিনিসই বুঝি, সেটি হলো ভালোবাসা’। সেই ভালোবাসার জন্য তিনি একবেলা জুতা পায়ে দিতে পারবেন না? লাফ দিয়ে উঠলেন তিনি। জীবনে প্রথমবারের মতো জুতা পায়ে দিলেন।
সক্রেটিস বললেন, তোমার মান রাখতে আমি সাজলাম। জুতা পরলাম। সেজেগুজে সিম্পোজিয়ামেও যাচ্ছি। তোমার জন্য আমি সব করতে পারি। এখন আমার একটি কথা রাখবে? তুমি সক্রেটিসকে বদলে ফেলো না। সক্রেটিস যেমন আছে, সেরকম থাকলেই পৃথিবীর ভালো হবে। তাই আজকের পরে আর জুতা পরব না।
জেনথিপি প্রথমে একটু হতাশ হলেন। পরে বুঝলেন, সক্রেটিস বদলে গেলে লোকে আর তার কাছে সুন্দর জীবনের উপায় জানতে চাইবে না। তাই তিনি যেমন আছেন, সেরকমই থাকুন। আজ তো কথা রেখেছেন।
জেনথিপির ভালোবাসা জয়ী হয়েছে। চটি পরে রাস্তায় নেমেছেন সক্রেটিস।
.
সক্রেটিস চটি পায়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন।[১১৬]। তিনি জীবনে কোনোদিন পায়ে চটি পরেননি। আজই প্রথম। ছোট বাচ্চা ছেলে প্রথম চটি পরলে যেমন শব্দ করে হাঁটে, সেরকম হাঁটছেন। শব্দ হচ্ছে টাস-টুস। শব্দে লোকজন তাকাচ্ছে। এই অবস্থায় সক্রেটিসকে দেখার ভাগ্য আগে কারও হয়নি।
দেখা হলো তার এক ছাত্রের সাথে। ছেলেটি বিশ্বাস করতে পারছে না। দুইবার চোখ ঘষে সে নিশ্চিত হলো, এটি সক্রেটিসই। সক্রেটিসের বেশভূষা দেখে সে ভিড়মি খেয়েছে। কাঁচুমাচু হয়ে সামনে এলো ছেলেটি। সে হাসবে, না কী করবে বুঝতে পারছে না। তার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে সে যদি সবাইকে ডেকে দেখাতে পারত। তার বলতে ইচ্ছে করছে, এই যে ভাই, শুনুন। চটি-পায়ে সক্রেটিসকে দেখতে হলে এখুনি আসুন। এই সুযোগ হেলায় হারাবেন না। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারল না।
সক্রেটিস হাসি দিয়ে বললেন, কবি আগাথনের বাড়ি যাচ্ছি। সিম্পোজিয়ামে। গতকাল সে ট্র্যাজেডি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। আজ তার বাড়ি সিম্পোজিয়াম।
ছেলেটি বলল, আপনার এই সাজগোজ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এই বেশে আপনাকে কেউ চিনবে না। ভাবীও চিনবেন না। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, সন্ধ্যায় কিন্তু ভাবী বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না।
সক্রেটিস মনে মনে ভাবলেন, মেয়েদের বোঝা এত সহজ নয়। সেটি বললেন না। একটি লজ্জার ভাব মুখে এনে বললেন, সুন্দর হয়ে সুন্দরের কাছে যাচ্ছি। যাবে নাকি বিনা নিমন্ত্রণে সিম্পোজিয়ামে খেতে?
ছেলেটি বলল, আপনি যদি বলেন, তো যাব।
সক্রেটিস একা থাকতে পারেন না। একা থাকলেই তার হাঁসফাঁস লাগে। তিনি মানুষ খোঁজেন। তিনি বললেন, তো চলো আমার সাথে। যার বাড়িতে অনুষ্ঠান, সেই আগাথন ভালো মানুষ। কবি মানুষ। বিনা নিমন্ত্রণে গেলেও বেজার হবে না। তার কলিজা বড়।
ছেলেটিকে ভুংভাং দিয়ে সক্রেটিস সিম্পোজিয়ামে নিয়ে চললেন। তারা দুজনে চলছেন। চলতে চলতে কোনো এক ফাঁকে যেন সক্রেটিস পেছনে পড়ে গেছেন। ছেলেটি আগাথনের বাড়ির সামনে যেতেই বাড়ির দাস তাকে ভেতরে নিয়ে গেল। তাকে সমাদরে স্বাগত জানিয়ে আগাথন বলল, তুমি তো সব সময় সক্রেটিসের পিছে পিছে ঘোর। তুমি এলে, আর সক্রেটিসকে আনলে না।
ছেলেটি পেছনে তাকিয়ে দেখে, সেখানে কেউ নেই। সে অবাক হয়ে বলল, সক্রেটিস তো আমার পেছনেই ছিলেন। কোথায় গেলেন?
আগাথন সক্রেটিসকে খুঁজতে তার দাসকে পাঠাল। দাস এসে বলল, সক্রেটিস পাশের বাড়ির বারান্দায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে কত ডাকাডাকি করলাম। কোনোরকম টু শব্দও করছেন না।
আগাথন খুব চিন্তায় পড়ে হাঁকডাক শুরু করল, ওরে তাড়াতাড়ি যা, সক্রেটিসকে ধরে নিয়ে আয়।
ছেলেটি বলল, না, না। সক্রেটিসকে। কছুক্ষণ একা থাকতে দিন। মাঝে মাঝে তার এরকম হয়। তিনি একটা কিছু চিন্তা শুরু করেন। এক রকম ধ্যানের পর্যায়ে চলে যান। আবার ঠিক হয়ে যান। আমার মনে হয় একটু পরেই উনি চলে আসবেন।
সিম্পোজিয়াম শুরু হয়েছে। তক্তপোষের উপর আধাশোয়া হয়ে অতিথিরা পান করছে। খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা চলছে। আয়োজক আগাথন বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে— কখন সক্রেটিস আসবেন? খাওয়া প্রায় শেষ হয় হয়, সক্রেটিস ঘরে ঢুকলেন। সকলে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানাল।
আগাথন বলল, আপনাকে কিন্তু আমার পাশে বসতে হবে। আপনার একটু ছোঁয়ায় আমার মধ্যে জ্ঞানের কণা প্রবেশ করবে।
সক্রেটিস তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, নাও তোমাকে জাপটে ধরলাম, যত জ্ঞান আছে, শুষে নাও। কিন্তু আহার-পানীয় যা আছে, তাড়াতাড়ি দাও। এমন ক্ষুধা লেগেছে, আজকে আমি সাগর খেয়ে ফেলব।
সবাই জানে, সক্রেটিস ঠাট্টা করছেন। তিনি একেবারেই পরিমিত আহার করেন। কোনোদিন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কিছু নেন না।
হাসি-ঠাট্টা চলতে চলতে খাওয়া শেষ হলো। আগাথন প্ৰস্তাব দিল, বন্ধুরা, আপনারা রাজি হলে, আজ আমরা একটি জটিল বিষয় নিয়ে কথা বলব।
সবাই অবাক। সিম্পোজিয়ামে জটিল বিষয়?
আগাথন বলল, জটিল বিষয়টি হলো— প্রেম। উপস্থিত সবাই একে একে বলবে, প্রেম কী জিনিস?
সবাই হই হই করে উঠল। প্রেম আবার কোনো জটিল বিষয় নাকি! এই বিষয়ে সবাই ওস্তাদ। সবাই বলতে রাজি। সিম্পোজিয়ামের গান-বাজনা বন্ধ করা হলো। বিদায় দেওয়া হলো শিল্পীদের। সক্রেটিস বললেন, তাহলে সুরা পানও বন্ধ হোক। নেশামুক্ত পরিবেশে আলাপ হোক।
সুরা পান বন্ধ করতে ছেলেদের ইচ্ছে করছে না, তবু মেনে নিল। সক্রেটিস জীবনে কোনোদিন মাতাল হননি। তাকে ছোটবেলা থেকে কেউ কোনোদিন মাতাল হতে দেখেনি।
আজ এখানে আছে নাট্যকার এরিস্টোফানিস। সে সক্রেটিসকে নিয়ে ‘মেঘ’ নাটকটি লিখেছিল। কিন্তু পরে সে ভুল বুঝতে পেরেছে। এনিতাসের পরামর্শে এই নাটক লিখেছিল, তখন সে সক্রেটিসকে জানতই না। এখন সক্রেটিসকে জেনেছে এবং ভুল স্বীকার করেছে।
সক্রেটিস তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। ক্ষমা করার মাঝে যে আনন্দ আছে, সেটি সক্রেটিস ভালোবাসেন। সবাই প্রস্তুত। প্রেমের আলাপ শুরু হবে।
তারা বারান্দায় বসেছে। আকাশে রুপালি চাঁদ। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। চাঁদের আলোতে কয়েকজন যুবক একটি গোলটেবিল বৈঠকে বসেছে। বৈঠকের বিষয়— ভালোবাসা কাকে বলে?
সবাই মনের কথা উজাড় করে বলছে, ভালোবাসা কী জিনিস। মনে হচ্ছে এরা সবাই ভালোবাসার স্কুলের শিক্ষক।
সবশেষে সক্রেটিসের পালা। সক্রেটিস বলবেন। সবাই নড়েচড়ে বসল। সক্রেটিস সবার কথাবন্ধু, কথার জাদুকর। তিনি কথা শুরু করলে সবাই গভীর মনোযোগ দেয়, একেবারে পিনপতন নীরবতা।
সক্রেটিস শুরু করলেন-
‘ভালোবাসা বিষয়ে আমার গুরু হলেন ডিওটিমা। ভালোবাসা নিয়ে আমি যা কিছু শিখেছি, সেটি তার কাছ থেকেই। অনেক বছর আগে তিনি এথেন্সে এসেছিলেন। তিনি আমাকে ভালোবাসা নিয়ে অনেক কিছু বলেছিলেন। আজ সব মনে নেই। যতটুকু মনে আছে বলছি—
ভালোবাসার বাবার নাম ঐশ্বর্য। আর মা হলেন দারিদ্র্য বা অভাব। ভালোবাসা তার বাবা-মা দুজনের বৈশিষ্ট্যই পেয়েছে। ভালোবাসার বাবা ঐশ্বর্য মানে সম্পদ, ঐশ্বর্য মানে ক্ষমতা। সেজন্য ভালোবাসার অনেক ক্ষমতা, অনেক শক্তি। তুমি ভালোবাসা দিয়ে বিশ্ব জয় করতে পারবে। পৃথিবীতে ভালোবাসার মতো শক্তিশালী জিনিস আর নেই। আর ভালোবাসার মা হলেন অভাব। সেজন্য ভালোবাসার চারপাশে সবসময় একটি অভাব। মানুষ প্রেমে পড়লে শুধু চাই আর চাই। তাই ভালোবাসার সাথে সব সময়ই একটি অভাব জড়িয়ে থাকে, সব সময় একটি না পাওয়ার ব্যাপার থাকে। ভালোবাসার জন্ম হয়েছে সৌন্দর্যের দেবীর জন্মদিনে। সেজন্য ভালোবাসা সব সময় সুন্দরের খোঁজ করে। যেখানেই সুন্দর কিছু আছে, সেখানেই ভালোবাসা। ভালোবাসা হলো ঐশ্বর্য আর অভাবের সন্তান। এই দুটো হলো পুরোপুরি বিপরীত। ঐশ্বর্য সুন্দর আর অভাব অসুন্দর। ভালোবাসার যেমন সুন্দর করার ক্ষমতা আছে, তেমনই কিছু অসুন্দর করার ক্ষমতাও আছে। ভালোবাসা যেমন মঙ্গল করে, তেমনই হিংসারও জন্ম দেয়। তাই ভালোবাসা শান্তি আনে, তেমনই ভালোবাসা থেকে যুদ্ধও হয়।
সক্রেটিস বললেন, আমার গুরু ডিওটিমা ভালোবাসার ধাপ বলেছেন। সেটিও চমৎকার। তিনি বললেন—
মানুষ প্রথমে দেহের সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসে। সবাই এভাবেই শুরু করে। এরপর আর একটু জ্ঞান বাড়লে, আর শরীরের সৌন্দর্য নয়, মনের সৌন্দর্য খোঁজে। সেটি আর একটু উচ্চ পর্যায়ের ভালোবাসা। মানুষ যখন আরও একটু বুঝতে শেখে, তখন সে জ্ঞানকে ভালোবাসতে শুরু করে। এক সময় সে হয়ে যায় জ্ঞানের প্রেমিক। আর জ্ঞানের প্রতি প্রেমই হলো সবচেয়ে উচ্চ পর্যায়ের ভালোবাসা। জ্ঞানের প্রেমিক হলেন দার্শনিক বা ফিলোসফার (Philosopher)। ফিলিন (philein) মানে ভালোবাসা আর সফি (Sophie) মানে জ্ঞান। ফিলোসফার হলেন যিনি জ্ঞানকে ভালোবাসেন। জ্ঞানপ্রেমিক। তাই ভালোবাসার সর্বোচ্চ পর্যায়ে মানুষের জ্ঞানতৃষ্ণা হয়, মানুষ দার্শনিক হয়ে যায়।’
সবাই হাততালি দিল। প্রেমের এমন ব্যাখ্যা কেউ আগে শোনেনি।
সক্রেটিস যখন কথা বলছিলেন, তার মাঝখানে সেখানে এসে হাজির এলসিবিয়াডিস। সে খুব চমৎকার সাজসজ্জা করে এসেছে। তার মাথায় বেগুনি ফুল। সে এসে দেখে, সক্রেটিস কথা বলছেন।
সক্রেটিস শেষ করতেই এলসিবিয়াডিস বলল, অন্য কারও কথায় আমরা তেমন পাত্তা দেই না। কিন্তু যখন শুনি সক্রেটিস বলছেন, তখন শ্রোতা নারী- পুরুষ, শিশু যেই হোক না কেন, সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। আমি নিজে যখন সক্রেটিসের কথা শুনি, আমি কেঁপে উঠি, কেমন যেন রোমাঞ্চ লাগে। আমি রোমাঞ্চিত হই, আমার বুক ধড়ফড় করে, আমার চোখে পানি চলে আসে।
আজকের সিম্পোজিয়ামে সক্রেটিস খাওয়া-দাওয়ার মাঝখানে এসেছিলেন। তিনি যে জুতা পরেছেন, সেটি কেউ লক্ষ করেননি। এলসিবিয়াডিস লক্ষ করলেন। মহা-হট্টগোল শুরু হলো সক্রেটিসের চটি নিয়ে। সক্রেটিস যে জীবনে কোনোদিন চটি পরবেন, সেটি কেউ ভাবেনি। সবাই জিজ্ঞেস করল, শেষ জীবনে এই জুতা পরার রহস্য কী?
সক্রেটিস লাজুক স্বরে বললেন, জেনথিপি।
সবাই হা হয়ে গেল। সক্রেটিসের হলুদ ঘোড়া তাকে যে এমন ভালোবাসে, সেটি কারও বিশ্বাসই হচ্ছে না।
সক্রেটিস বললেন, জেনথিপির কথায় পরতে হলো। তবে চুক্তি হয়েছে মাত্র এক দিনের জন্য চটি। আজই প্রথম, আজই শেষ।
****
সিম্পোজিয়ামে কী কথা হয়েছে, সেটি প্লেটো শুনেছে। অনেকে তার কাছে এসে বর্ণনা দিয়েছে। তার খুব ভালো লেগেছে। প্রেমের এমন ব্যাখ্যা আর কেউ দিতে পারেনি। কোনো নাট্যকার এমন করে প্রেমের কথা বলতে পারেনি। কেমন আলতো ছুঁয়ে দেওয়ার মতো করে প্রেমকে বর্ণনা করলেন। তাই প্লেটো মনে করছে, সক্রেটিস আসলে অনেক বড় নাট্যকার। প্লেটোর ভালো লাগল।
বিষয়টি নিয়ে সক্রেটিসের কাছে সে বারবার জিজ্ঞেস করেছে। অনেক দিন আলাপ করেছে। প্রেমের এই দিকটা প্লেটোর খুব মনে ধরল। জ্ঞানের প্রতি প্রেম বিষয়টি তার খুবই ভালো লাগল। প্লেটো ঠিক করল সে নিজে একটি প্রেমের তত্ত্ব বানাবে। মানুষের প্রেম কেমন হওয়া উচিত সেটি বের করবে। সক্রেটিসের সিম্পোজিয়ামের কথা শোনার পর সে শুধু এটি নিয়েই ভাবছে। সে কিছুদিন চিন্তা করল। তারপর সে প্রেমের একটি নতুন ধারণা বলল। সেই প্রেমে কোনো কামনা নেই। কোনো শরীরের আকর্ষণ নেই।
প্লেটোর বন্ধু ফিদো বলল, এরকম প্রেমের ভাবনা এসেছে প্লেটোর মাথা থেকে। তো এই প্রেমের নাম হোক প্লেটোনিক প্ৰেম।
এই ধরনের প্রেমের কথা গ্রিকরা জানে না। ইউরোপে এমন প্রেমের কথা কেউ বলেনি। এখানে দেবতারা প্রেমে পড়েন, খুব ঘন ঘন তাদের প্রেম পায়। সেই প্রেম এরকম— কোনো দেবতার কোনো মেয়েকে ভালো লাগলে, সাথে সাথে তাকে তুলে নিয়ে যায়। আগু-পিছু ভাবার সময় নেই। দেবতাদের রাজা জিউস ইউরোপাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইউরোপার নাম থেকেই ইউরোপ নাম এসেছে। দেবতাদের প্রেম ঐরকম। ধর-মারো-ছাড়ো রকমের প্রেম। কাউকে পছন্দ হয়েছে, তুলে আনো, কিছু দিন পরে ছেড়ে দাও— ভুলে যাও।
দেবতাদের ছাড়া মানুষের প্রেমের কথা তুললে মনে পড়বে বীর একিলিসের প্রেম। একিলিস ট্রয় যুদ্ধে গিয়ে ট্রয়ের রাজার মেয়ে ব্রিজিতকে লুট করে আনে। সে যুদ্ধে পাওয়া নারী। একসাথে থাকতে গিয়ে সেই যুদ্ধ-নারীকে একিলিস পছন্দ করে। কিন্তু তাকে নিয়ে যায় রাজা আগামেমনন। সেই রাগে গ একিলিস অনেক দিন ট্রয়ে যুদ্ধ করেনি। এই হলো বীরের প্রেম
হোমারের আরেক বীর অডিসিয়াস প্রেমের জন্য বিখ্যাত। সে দশ বছর ভীষণ কষ্ট করে তার স্ত্রীর কাছে ফিরে আসে। একটি সুন্দর প্রেমের মতো বিষয়। কিন্তু এই দশ বছর সে স্ত্রীর জন্যই বসে থাকেনি। নানান নারী এসেছিল তার কাছে। সে তাদের না করতে পারেনি। ট্রয়যুদ্ধের পর ট্রয়ের রানি হেকুবাও তার যুদ্ধ-নারী হিসেবে বরাদ্দ ছিল। তাই তাকে একজনের জন্য নিবিষ্ট প্রেমিক বলা যায় না।
এখানে প্রেম মানে শুধু পুরুষের ব্যাপার, মেয়েদের জন্য প্রেম-ট্রেমের কোনো বিষয় নেই। সাধারণ মানুষের প্রেমের কথা তেমন শোনা যায় না। একজনের প্রেম কাহিনি খুব বিখ্যাত। তিনি অবশ্য সাধারণ মানুষ নন। একেবারে অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। তিনি হলেন পেরিক্লিস। পেরিক্লিস প্রেম করেছেন। তিনি আসপাশিয়াকে ঘরে নিয়ে এসেছিলেন। তারা বিয়ে করতে পারেননি কিন্তু একসাথে সংসার করেছেন। প্রেমের কথা উঠলেই মানুষ তাদের কথা বলত, আবার ছিঃ ছিঃ করত।
আরেক ধরনের ঘটনার ফিসফাস শোনা যায় এথেন্সে। এখানের বুড়োরা নাকি তরুণ ছেলেদের পছন্দ করে। কেউ এসব কথা প্রকাশ্যে বলে না। তবু ফিসফাস চলে।
কিন্তু প্লেটো সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি প্রেমের কথা ভাবছে। সক্রেটিসকে ডিওটিমা যেরকম প্রেমের কথা বলেছিলেন, সে রকম প্রেম।
কোনো কামনা নেই। শরীর কোনো বিষয়ই নয়। প্রেম হবে একটি আত্মার ব্যাপার। পবিত্র একটি অনুভূতি। যাকে ছোঁয়া যায় না। যে ছুঁতে চায়ও না। কবিরা বলেন, খাঁটি প্রেমে নাকি একটুকু ছোঁয়া লাগে, কিন্তু প্লেটোনিক প্রেমে একটুকুও ছোঁয়া লাগে না। একেবারে-
‘প্রেমের পবিত্র শিখা চিরদিন জ্বলে,
স্বর্গ হতে আসে প্রেম, স্বর্গে যায় চলে’
***
১১৬. প্লেটো Symposium ডায়ালগে সক্রেটিসের চটি পায়ে হাঁটার কথা উল্লেখ করেছেন। কবি আগাথনের বাড়িতে সিম্পোজিয়াম এবং ভালোবাসা বিষয়ে সংলাপও এই বইয়েই আছে।