৪৪
‘সময়ের সেরা হও, প্রতিদিন নিজেকে ছাড়িয়ে যাও
বিপদের ভয়ভরা পথে সাহস বিছিয়ে দাও
পথ কঠিন? নিজের পথ তৈরি করে লও।’
-হোমার // (একিলিসের প্রতি তার পিতার উপদেশ)
***
প্লেগে এথেন্সের জ্ঞানী-গুণীরা মারা গেছেন। জ্ঞানী লোকের অভাব পূরণের জন্য প্লেগ সমাপ্ত হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই একটি শিশুর জন্ম হলো। অনন্যসাধারণ প্রতিভাধর শিশু।
শিশুটিকে আসল নামে কেউ ডাকে না। ডাকনামেই ডাকে। ডাকনাম প্লেটো[১১০]। প্লেটো শব্দের অর্থ চওড়া। এই ছেলের কপাল চওড়া, কাঁধ চওড়া, আর এই বয়সেই বুকের সিনাও বিশাল চওড়া। সবকিছু চওড়া দেখে তার নামই হয়ে গেছে চওড়া বাবু বা প্লেটো।
অতি পিচ্চিকাল থেকেই সে সবাইকে চমকে দিচ্ছে। নতুন নতুন বিনোদন দিচ্ছে। তার ইঁচড়ে পাকা কাণ্ডে সবাই চমৎকৃত হচ্ছে। প্লেটো নিত্যনতুন চমক দিচ্ছে। সে যা করে, তা-ই দেখার মতো।
একবার যা শোনে, আর ভোলে না। তোতাপাখির মতো বলতে থাকে। তোতাপাখিকে নিয়ে তার মা মাঝে মাঝেই বিপদে পড়েন। তখন তার বয়স মাত্র চার বছর। মা একদিন দুষ্টুমি করে স্বামীকে একটি অশ্লীল কথা বললেন। স্বামী-স্ত্রী ধরনের অশ্লীল কথা। কথাটি শুনে ফেলল প্লেটো। শোনামাত্রই উচ্চ স্বরে বলতে শুরু করল। কী লজ্জার কথা! অতটুকু বাচ্চা সবার সামনে অমন মারাত্মক অশ্লীল কথাটি বলছে। সুর করে করে বলছে। বাড়িতে নতুন লোক এলে বেশি করে বলছে। লজ্জায় মায়ের মাথা কাটা যাচ্ছে।
এই ঘটনায় অবশ্য আখেরে মা-বাবার লাভই হয়েছে। তারা সব রকম বাজে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। চার বছরের ছেলের ভয়ে বাবা-মা অশ্লীল থেকে সুশীল হয়েছেন। বাবা টিপ্পনি কেটে মাকে বলেন, এভাবে চললে তোমার ছেলে একদিন সারা পৃথিবীর মানুষকে সুশীল হতে শেখাবে।
প্লেটোর বাবার নাম এরিস্টোন, মায়ের নাম পেরিকটোন। তার মায়ের দাদার বাবা ছিলেন প্রখ্যাত আইন-প্রণেতা সলোন। খুবই উচ্চবংশ তাদের। এথেন্সের সেরা পাঁচটি অভিজাত পরিবারের একটি তাদের পরিবার। আত্মীয়- স্বজন সবাই বড় বড় রাজনীতিক, যোদ্ধা, সরকারি চাকুরে। বাড়িও শহরের প্রাণকেন্দ্রে, আগোরার একেবারে লাগোয়া।
একেবারে পিচ্চিকাল থেকেই প্লেটো সবাইকে চমকে দিচ্ছে। তখন তার বয়স মাত্র তিন। প্লেটোর বাবা লিখতে বসেছেন। সামনে একটি পেপিরাস কাগজ। তিনি একটি অনুষ্ঠানে হোমারের লেখা আবৃত্তি করবেন। পেপিরাস কাগজের উপর লিখলেন ‘হোমার’।
মন নেই লেখায়। কী যেন ভাবছেন। হঠাৎ দেখলেন, পেপিরাস কাগজে তার লেখার পাশেই আর একটি হোমার লেখা। কলম প্লেটোর হাতে। বাবা ভাবছেন আর একটি ‘হোমার’ লিখল কে? প্লেটো কি লিখতে জানে?
বাবা ডাক দিলেন মাকে, প্লেটোকে লেখা শিখিয়েছে কে?
তার মা অবাক! কী আবোল-তাবোল বকছেন? প্লেটোকে লেখা শেখাবে কে? ওর কি লেখার বয়স হয়েছে?
‘এসে দেখে যাও।
বাবা প্লেটোকে বললেন, আবার লিখ্ তো।
প্লেটো একটি খিলখিল হাসি দিয়ে বাঁকা বাঁকা করে লিখল, হোমার
বাবা-মা দুজনেই একেবারে স্তম্ভিত।
বাবা বললেন, তোমার ছেলে তো একখান প্রতিভার হাঁড়ি। এজন্যেই ওর কপালটা এত বড়। এই ছেলে একদিন রাজা হবে।
মা বললেন, ধুর, কী যে বলো, এথেন্স তো গণতন্ত্র। রাজা-রানি নেই। ছেলে রাজা হবে কী করে?
বাবা বললেন, শুধু কি দেশেরই রাজা হয়! জ্ঞানের রাজাও হতে পারে। তোমার ছেলে হবে জ্ঞানের রাজা। হোমারকেও ছাড়িয়ে যাবে।
.
ছেলে জ্ঞানের রাজা হবে কিনা সেটি দেখে যাওয়া বাবার কপালে ছিল না। কিছুদিন পরেই বাবা মারা গেলেন। মা আবার বিয়ে করলেন। প্লেটোর সৎ-বাবা একজন কূটনীতিক। তিনি পেরিক্লিসের দূত হিসেবে পারস্য রাজার দরবারে ছিলেন। পেরিক্লিস মারা যাওয়ার পর এখন রাজনীতি করেন।
দিনে দিনে দেখা গেল— প্লেটোর মতো শ্রুতিধর ছেলে তার আশেপাশে কেউ নেই। ছয় বছরেই হোমারের সব কবিতা মুখস্থ। সে গড়গড় করে বলে যেতে পারে। আট বছর হতেই সে নিজে কবিতা লেখা শুরু করল। দিন যায়, আর ছেলের গুণে সবাই চমৎকৃত হয়। কারও সন্দেহ নেই যে, এই ছেলে একদিন অনেক বড় কবি হবে, নামি নাট্যকার হবে। সে নাটক লিখবে, কবিতা লিখবে। প্রথম পুরস্কার পাবে।
তার মুখটা খুব মিষ্টি। শুধু মিষ্টি নয়, মুখের রেখায় একটি অন্যরকম আভিজাত্য, একটি পাণ্ডিত্য। উজ্জ্বল নীল চোখ। তাকালে মনে হয় ওই চোখ এই পৃথিবীর কিছু দেখছে না, অন্য কোনো দুনিয়ার রহস্য খুঁজছে। লম্বা চুল ছড়িয়ে পড়েছে চওড়া কাঁধে। সব মিলিয়ে একেবারে দেবকান্তি। দেখলেই মনে হয়, এই ছেলে শুধু সোনার চামচ নয়, একেবারে হীরের চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে। সেই চামচ থেকে বুদ্ধি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে।
প্লেটো যা ধরে তাতেই সে এক নম্বর। ব্যায়ামের মাঠে সে সবার সেরা। বড় বড় পালোয়ানদের তুলে আছাড় মারছে। গণিত, জ্যামিতিতে সে সবার সেরা। কী সুন্দর সুন্দর জ্যামিতির আকৃতি বানায়! যুদ্ধ কৌশলেও সে খুবই ভালো। কিন্তু যুদ্ধ তার ভালো লাগে না।
বারো বছর হতে না হতেই তার ঘর ভরে গেছে নিজের লেখা নাটকে। পেপিরাসের পর পেপিরাস লিখে ফেলেছে প্লেটো। সে বসলেই লেখা হয়। অন্যরা কষ্ট করে লেখে, আর তার নাকি লেখা পায়। লেখা পেলে তার আর হুঁশজ্ঞান থাকে না; কে মা, কে বাবা কিচ্ছু বোঝে না, খাওয়া-দাওয়া নেই; মাথায় যা আছে, পেপিরাস কাগজে না আঁটা পর্যন্ত সে থামতে পারে না।
জ্ঞানের জগতে এমন মানুষ এথেন্সের লোকেরা আর দেখেনি। সবাই একবাক্যে বলে, এই ছেলে একদিন দুনিয়া জোড়া নাম করবে। একদিন সারা দুনিয়ার মানুষ তাকে এক নামে চিনবে। সে মুখে মুখে ডায়ালগ লেখে। তার মাথায় সব সময় নাটকের প্লট ঘোরে।
.
প্লেটোকে অনেক কিছু শেখায় তার মায়ের দুই মামাতো ভাই। তার দুই মামা। তাদের নাম ক্রিটিয়াস ও কারমিড। তারা রাজনীতি করে। কিন্তু গণতন্ত্রের রাজনীতি নয়, তারা স্পার্টার মতো রাজতন্ত্র চায়। এথেন্সের ক্ষমতায় আছে তাদের বিরোধীরা, গণতন্ত্রের লোকেরা। তাই ক্রিটিয়াসরা গোপনে রাজনীতি করে।
ক্রিটিয়াস আর কারমিড দুজনেই সক্রেটিসের ভক্ত। তারা গর্বের সাথে সবাইকে বলে বেড়ায় যে, ‘সক্রেটিস যা বলেন, তারা সেভাবেই কাজ করে।’ তারা সারাদিন সক্রেটিসকে নিয়ে আলাপ করে। তাই প্লেটোর কাছে ছোটবেলা থেকেই সক্রেটিস খুবই পরিচিত নাম। সক্রেটিস দুনিয়ার সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি, তা সে কুট্টিকাল থেকেই জানে। তার মামারা সক্রেটিসের নাম শ্রদ্ধার সাথে নেয়। তাই প্লেটোও সক্রেটিসকে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু কোনোদিন সামনে যায়নি।
প্লেটোর মন চায় আর একটু বড় হলে একদিন চুপি চুপি একা গিয়ে সক্রেটিসকে বলবে ‘আপনি নাকি সত্যিই দুনিয়ার সেরা জ্ঞানী? কিন্তু পথে পথে ঘুরে কয়জনকে শেখাবেন? তারচেয়ে একটি স্কুল দেন, বাচ্চাদের স্কুল নয়, বড়দের জন্য উচ্চশিক্ষার স্কুল।
***
উঠানের এক কোণে বসে আছেন সক্রেটিস।
ঘরের ভিতর থেকে চিৎকার করছেন জেনথিপি, ‘ঘরে আর মাত্র তিন দিনের খাবার আছে। এক্ষুনি বাজারে গিয়ে কিছু রুটি নিয়ে আসেন।’
কথাটি শুনেও শুনলেন না সক্রেটিস। তিনি ভাবছেন তার মনের সাম্রাজ্যের কথা। কী করলে মানুষ আর একটু ভালো থাকে সেই চিন্তায় তিনি মশগুল। জেনথিপির মতো সাধারণ একটি নারীর কথায় মনোযোগ দেওয়ার সময় তার নেই। তিনি আরাম করে চিন্তা করছেন।
জেনথিপি চিৎকার করছেন, এথেন্স শহরে এমন মানুষ কি আর একটিও আছে? নিজের ঘরে ভাত নেই, উনি রাস্তার ধারের চ্যাংড়া পোলাপানের সাথে আড্ডা মারেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাবর কাটেন। এমন মানুষ বিয়ে করবে কেন? আমাকে দেবী এথিনা অভিশাপ দিয়েছেন। না হলে আমার কপালে এমন লোক জুটবে কেন?
সক্রেটিস আকাশের দিকে চেয়ে আছেন। মনে হচ্ছে আজ দুপুরে খাবার জুটবে না। এখুনি বেরিয়ে পড়তে হবে। আবার ভাবছেন, আর একটু দেখি, যদি রাগ কমে যায়। এই ভেবে তিনি আবার চিন্তায় মগ্ন হলেন।
জেনথিপি চিৎকার করেই যাচ্ছেন। স্বামী নির্বিকার।
জেনথিপির মনে হলো, সক্রেটিস অনেকক্ষণ ধরে তার কথা কিছুই শুনছেন না। ভীষণ জিদ লাগছে, ‘এত কষ্ট করে চেঁচাচ্ছি, আর তিনি শুনবেন পর্যন্ত না?’
জেনথিপি আর সহ্য করতে পারলেন না। সামনে বড় একটি বালতিতে রাখা ছিল রান্নারঘরের কালি-ঝুলি মাখা ময়লা পানি। সেই বালতিটি তুলে ঢেলে দিলেন সক্রেটিসের মাথায়।
শীতের দুপুরে এক বালতি ময়লা পানিতে আপাদমস্তক ভিজে গেল সক্রেটিসের সক্রেটিস হতভম্ব, কিন্তু কিছুই বললেন না। উঠেও দাঁড়ালেন না, পুরো পানিটা মাথায় ঢালতে দিলেন। এবার জেনথিপি ভাবলেন, এতটা বোধহয় ঠিক হলো না। এবার নিশ্চয়ই সক্রেটিস রেগে যাবেন।
কিন্তু না, সক্রেটিস মিষ্টি হেসে বললেন, সকাল থেকে আমার ঘরের আকাশটা গর্জন করছে। আকাশের নিয়ম হলো, গর্জনের পরে একটু বর্ষণ হয়। মেঘ ডাকাডাকির পরে বৃষ্টি হয়েছে। তাই আমার মাথা কিঞ্চিৎ ভিজে গেছে।
জেনথিপি কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। এই মানুষকে ভালো কথা বললে, কানে নেন না। মন্দ কথা বললে শোনেন না। মাথায় পানি ঢেলে দিলে, হেসে মশকরা করেন। একে নিয়ে কী করা যায়!
কী করবেন বুঝতে না পেরে জেনথিপি কেঁদে ফেললেন। তার কান্নাও মারাত্মক। একেবারে মরাকান্না। চিৎকার করে শুধু একটি শব্দই বলছেন, সক্রেটিস! সক্রেটিস!
সক্রেটিস দেখলেন, সর্বনাশ! জেনথিপি যেভাবে কাঁদছে, দূর থেকে শুনলে যে কেউ ভাববে যে, সক্রেটিস মারা গেছেন। এই কান্না এখুনি থামাতে হবে। কিন্তু কান্না থামানোর উপায় তিনি জানেন না। তিনি বাইরের মানুষের মনের নীরব কান্না দূর করার উপায় জানেন। ঘরের বউয়ের চিৎকার করে কান্না থামাতে জানেন না।
জেনথিপি কেঁদেই যাচ্ছেন। স্বামীর মাথায় ময়লা পানি ঢেলে দিয়েছেন, এখন সেই দুঃখে কাঁদছেন।
একটু ভেবে সক্রেটিস জেনথিপির মাথায় হাত রেখে বললেন, ভালোই হয়েছে, এখন দুজনের গায়েই পানি। আমার মাথায় পানি, আর তোমার চক্ষে পানি। চলো, এবার দুজনে মিলে গোসল করি।
তারা দুজনে মিলে স্নান-ঘরে গেলেন। অনেকদিন পর আজ দুপুরে সক্রেটিস দুপুরের খাবার জেনথিপির হাতে খেলেন। দুপুরটা ভালোই কাটল। অনেক দিন পর তার সংসারে একটি ভালোবাসার ছোঁয়া লাগল। আজকের ভালোবাসাকে বলা যায় গর্জন-বর্ষণ ভালোবাসা। জেনথিপির গর্জন আর বর্ষণ থেকে এর উৎপত্তি।
কান্নার পরে ভালোবাসা বদলে যায়, চোখের জল ভালোবাসার মধ্যে লবণ ঢেলে দেয়, সেজন্য কান্নার পরে ভালোবাসা একটু নোনতা নোনতা, একটু মিষ্টি-মিষ্টি, একটু অন্যরকম।
সক্রেটিস বাজার করতে গেলেন। জেনথিপি তার হাতে কিছু টাকা দিলেন। টাকা-পয়সার হিসাব জেনথিপিই করেন। শাশুড়ি তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়ে গেছেন। বাড়ির পাশে জলপাই বাগান। সেই বাগান সারা বছরের জন্য ঠিকা দিয়ে দেন, এককালীন টাকা পান। দূরে পাহাড়ের নিচেও কয়েকটা জলপাই বাগান কিনেছিলেন তার শ্বশুর। সেগুলো থেকেও কিছু আসে। সবকিছু ভালো করে দেখে শুনে রাখতে পারলে, খাওয়া-পরার কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, সক্রেটিস এসব কিছুতেই মন দেন না। সবকিছু জেনথিপিকেই করতে হয়। ক্রিতো তাকে সাহায্য করেন। ক্রিতো তার দাসদের বলে দিয়েছেন, জেনথিপি যেকোনো কাজে ডাকলে, সাথে সাথে যেন করে দেয়।
এই গর্জন-বর্ষণ ভালোবাসার কিছুদিন পরেই জেনথিপি একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। ছেলে হয়েছে সক্রেটিসের। বন্ধুরা ধরেই নিয়েছিলেন, এই দম্পতির ছেলে-মেয়ে হবে না। তাও তাদের পুত্র হলো। দেরিতে হলেও সন্তান হলো। পঞ্চান্ন বছর বয়সে সক্রেটিস প্রথম পিতা হলেন। এতদিনে জেনথিপি করার মতো একটি কাজ পেলেন। তিনি খুশি, মহাখুশি। সক্রেটিসও খুশি। মহাখুশিতে দুজন মিলে ছেলের নাম রাখতে বসলেন।
গ্রিসে সন্তানের নাম রাখার অদ্ভুত নিয়ম আছে। সবাই এই নিয়ম মানে। প্রথম ছেলে হলে নাম রাখে বাবার বাবার নামে। দ্বিতীয় ছেলে হলে নাম রাখে মায়ের বাবার নামে। প্রথম মেয়ে হলে নাম বাবার মায়ের নামে। তারপরের মেয়ের নাম মায়ের মায়ের নামে। এভাবে দাদা-দাদি, নানা-নানিরা নিজেদের নামটা রেখে যান বংশের তৃতীয় প্রজন্মের মাঝে
সক্রেটিসের প্রথম সন্তান ছেলে। তো নিয়ম মতো নাম রাখা উচিত সক্রেটিসের বাবার নামে। মানে সফ্রোনিকাস। কিন্তু সক্রেটিস উদার মানুষ। মেয়েদের ব্যাপারে তার মতো উদার এথেন্সে কেউ নেই।
তিনি বললেন, সন্তান জন্ম দিতে মা যে কষ্ট করে, বাবার কষ্ট তার কাছে কিছুই নয়। এই সন্তানের প্রথম দাবি জেনথিপির। তাই আমরা নাম রাখব জেনথিপির বাবার নামে। আমাদের প্রথম ছেলের নাম হবে লেমপ্রোক্লিস।
জেনথিপি মহাখুশি। তার স্বামী সক্রেটিস যে অনেক বড় মনের মানুষ, সেটি তার মনে থাকে না। মাঝে মাঝে দু’এক ফোঁটা টের পান। আজ ছেলের নাম রেখে মনে হচ্ছে, সে স্বামীর সোহাগে সোহাগিনী। মনে হচ্ছে বাবার নামে নাম রেখে তার স্বামী তার বাবাকেই তার কোলে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
আনন্দে জেনথিপি সাত দিনের ছেলেকে বলছেন, জানিস, তুই যেদিন জন্ম নিলি, সেদিন এথেন্সের দেয়ালের বাইরে যুদ্ধ হচ্ছিল। বিশাল যুদ্ধ।
ছেলে বলল, ওয়া।
মা বললেন, সেই যুদ্ধের মধ্যে সন্ধ্যার পর তোর জন্ম। সেই সময় তোর বাবা ছিলেন না ঘরে। না, তিনি যুদ্ধে যাননি। তার বয়স হয়েছে। এখন আর যুদ্ধে যাওয়া লাগে না। তিনি তখন জ্ঞান বিতরণ করছিলেন।
ছেলে বলল, ইয়া।
মা বললেন, ভেবে দেখ, ঘরে তার স্ত্রী সন্তান জন্ম দিচ্ছে, আর তিনি রাস্তার মোড়ে জ্ঞানের জন্ম দিচ্ছেন। ঘটনাটা মজার নয়?
মজার কিনা ছেলে জানে না। ছেলের ঘুম পাচ্ছে।
জেনথিপির ঘুম পাচ্ছে না। গল্প করতে তার ভালো লাগছে। তিনি বললেন, জানিস, এখন যদি তোর বাপেরে বলি, ছেলে হয়েছে, আনন্দ করো। তিনি বলবেন, ঠিক আছে। ছেলে হয়েছে, তো সেই আনন্দে জ্ঞানের বাত্তি জ্বালাই। এই বলে তিনি আগোরার দিকে হাঁটা ধরবেন। জানিস কেন? কেন আবার— জ্ঞানের বাত্তি কিনতে!
ছেলে হেসে দিল।
মা-ছেলের এই আনন্দে সক্রেটিস নেই। তিনি এখন সত্যি সত্যিই জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন। হয়তো সিমনের দোকানে অথবা জিমনেসিয়ামে।
কিন্তু ছেলের সাথে সময় কাটানো হলো না সক্রেটিসের। এর মধ্যেই ডাক এলো আবার যুদ্ধে যেতে হবে। এথেন্স ও স্পার্টার যুদ্ধ শেষ হয়নি। শিশুপুত্রকে রেখে এথেন্স থেকে টানা দুই দিন উত্তর দিকে মার্চ করে করিন্থ সাগর পার হয়ে সক্রেটিস পৌঁছলেন ডিলিয়ন নামক এক জায়গায়। কিন্তু তার যুদ্ধ ভাগ্য ভালো নয়। ভয়াবহ যুদ্ধের পর এখানেও হেরে গেল এথেন্স। নির্মমভাবে মারা গেল তার অনেক সঙ্গী। আহত হয়ে কোনোরকমে জান নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি। কিন্তু বিশ্রামের সুযোগ নেই। কিছু দিন পরেই আবার যেতে হলো যুদ্ধে। এবারও উত্তর দিকে, জায়গার নাম এম্ফিপলিস। এখানে স্বর্ণের খনি দখল নিতে চায় এথেন্স, কিন্তু পারল না। এখানেও হেরে গেল এথেন্স। নির্মম যুদ্ধে মারা গেল হাজার হাজার মানুষ। আহত রক্তাক্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি। জীবনে তিনটি যুদ্ধ করলেন সক্রেটিস। তিনবারই রক্তাক্ত হয়ে ফিরেছেন। তিনি প্রতিবারই দেখেছেন যুদ্ধের নির্মমতা, চোখের সামনে দেখেছেন মানবতার অপমান।
***
১১০. প্লেটো খ্রি. পূ. ৪২৭/৪২৮ অব্দে এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রিক ভাষায় তাকে বলা হয় Platon (প্লাতন)। আরবের পণ্ডিতদের কাছে তিনি আফলাতুন নামে পরিচিত ছিলেন। তার রচিত আটত্রিশটি ডায়ালগ এবং তেরোটি চিঠি ইউরোপীয় দর্শনের সূচনা করে। প্লেটোর লেখাই সক্রেটিস ও তার দর্শনকে জানার প্রধান উৎস। আমিও এই বইয়ে প্লেটোর ডায়ালগগুলোকেই প্রধান রেফারেন্স হিসেবে নিয়েছি।