৪০
‘তুমি যা চাও, তা না পেলে কষ্ট পাও;
যেটি চাও না, সেটি পেলেও কষ্ট পাও;
যেটি চাও সেটি পেলেও কষ্ট, কারণ চিরকাল রাখতে পারবে না;
তাই যত সমস্যা সব তোমার ভেতরেই।’
—সক্রেটিস
***
পেরিক্লিস রাত-দিন মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন।
এক সন্ধ্যায় পিরাউস বন্দরের পাশের কয়েকটা বাড়িতে প্লেগের রোগী দেখে বাড়ি ফিরলেন পেরিক্লিস। মনে হচ্ছে তার গা গরম গরম লাগছে। মাথাটা ধরেছে। আসপাশিয়াকে কিছুই বললেন না। শুধু বললেন, রাতে খেতে ইচ্ছে করছে না। আসপাশিয়া জোর করল না।
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল আসপাশিয়ার। কে যেন কোঁকাচ্ছে। অস্ফুট একটি গোঙানি। অন্ধকারে পেরিক্লিসকে ছুঁতেই ভিরমি খেল আসপাশিয়া। পেরিক্লিসের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মাথায় হাত দেওয়া যাচ্ছে না। সে প্রায় অচেতন। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। আসপাশিয়া তাকে ধাক্কা দিল। পেরিক্লিস চোখ খুলতে পারছেন না। চোখ জ্বলছে, তীব্রভাবে জ্বলছে।
আসপাশিয়া চিৎকার করে উঠল I
প্লেগ ধরেছে পেরিক্লিসকে।
আসপাশিয়া পেরিক্লিসকে মরতে দেবে না। তাকে বাঁচাতেই হবে। সে সবাইকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাছের মানুষজন দাস-দাসী সব উঠে-
চ-পড়ে লাগল। যে যা বলে, আসপাশিয়া সেটিই করতে শুরু করল। ঝাড়ফুঁক চলছে, দেবীর কাছে পশু বলি দেওয়া হচ্ছে সকাল বিকাল, চলছে নানান মানত। কেউ বলে এথেন্সের বাতাস খারাপ হয়ে গেছে। বাতাস দূরে রাখতে আসপাশিয়া সব সময় দরজা-জানালা বন্ধ রাখে।
আসপাশিয়া সারা জীবন নিজেকে বিজ্ঞানের মানুষ মনে করেছে। আজেবাজে কুসংস্কার সে মানে না। কিন্তু এবার আর পারছে না। পেরিক্লিস চলে গেলে, তার জীবনের আলো নিভে যাবে। এথেন্সের সবাই তার শত্রু। শুধু পেরিক্লিসই তাকে আগলে রেখেছেন। পেরিক্লিস না থাকলে সে এথেন্সে থাকতেই পারবে না। তাই প্রাণান্ত চেষ্টা করছে পেরিক্লিসকে ভালো করতে। এথেন্সের দূর-দূরান্ত থেকে ওঝা আনা হচ্ছে। নানান তুকতাক চলছে।
কিন্তু ভালো হচ্ছেন না পেরিক্লিস। মারাও যাচ্ছেন না।
পেরিক্লিসের কাছে মনে হচ্ছে, তিনি প্রতিদিন একটু একটু করে মারা যাচ্ছেন। একটু একটু করে শক্তি শেষ হয়ে আসছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। এখানে শীতকালে প্রায়ই বৃষ্টি হয়। পেরিক্লিসের খুব ইচ্ছা করে বৃষ্টির আঁচে দাঁড়িয়ে এথেন্সকে দেখতে। কিন্তু সেটি হবে না। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। আসপাশিয়া কিছুতেই দরজা খুলবে না।
দলে দলে মানুষ আসে পেরিক্লিসকে দেখতে। সক্রেটিসও এসেছে। তার সাথে কথা বলে আসপাশিয়া সিদ্ধান্ত নিল, কস দ্বীপের বড় চিকিৎসক, যিনি চিকিৎসা শাস্ত্র নতুন করে লিখেছেন, সেই ডাক্তার হিপোক্রাটিসকে আনতে বিশেষ দূত পাঠাবে। আসপাশিয়ার দূত জাহাজ নিয়ে গেল কস দ্বীপে। অনেকগুলো তাগড়া জোয়ান নাবিক। তারা ঝড়ের বেগে জাহাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাথে অনেক উপহার। আসপাশিয়ার আদেশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে ফিরতে হবে।
কস দ্বীপে জাহাজ পৌঁছতে অন্তত দশ দিন লাগবে। যেতে আসতে বিশ দিন। ততদিন পেরিক্লিস বাঁচবে কিনা, কেউ জানে না।
.
ডাক্তার হিপোক্রাটিস আগেই খবর পেয়েছিলেন। তিনি জানতেন, এথেন্সে এরকম কিছু একটা হবে, একটি বড় মহামারী আসবে এথেন্সে। তিনি এথেন্সে দেখেছিলেন জায়গায় জায়গায় খুব নোংরা, আবর্জনা। জীবাণু কিলবিল করছে। সাধারণ মানুষ না ধুয়েই জিনিসপত্র খাচ্ছে। কারও কোনো সচেতনতা নেই। পেরিক্লিস ব্যস্ত ছিলেন নগর সুন্দর করতে। কিন্তু দেয়ালের বাইরেই সাধারণ মানুষ যে নোংরা বস্তিতে থাকছে, সেটি নিয়ে কেউ ভাবেনি।
এথেন্সের উপহার দেখে ডাক্তার বললেন, কেউ স্পর্শও করবে না। আলাদা করে ঐ দূরে রাখো। এগুলো এক্ষুনি আগুনে জ্বলিয়ে দাও।
এথেন্সের দূত তো ভীষণ অবাক। এ কী কথা! ডাক্তার সাহেব তাদের অপমান করছেন? এথেন্সের উপহার নেবেন না! তাই বলে আগুনে পুড়িয়ে দেবেন? দামি দামি জিনিসগুলো আগুনে ঝলসে যাচ্ছে, তাদের চোখের সামনে।
ডাক্তার বললেন, অতিথিরা কষ্ট পেলেন?
দূতেরা কোনো কথা বলতে পারছে না। ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে।
ডাক্তার স্মিত হাসি দিয়ে বললেন, যা করলাম, সবার ভালোর জন্য করলাম। এথেন্সের আকাশে-বাতাসে এখন জীবাণু। জীবাণুগুলো তো উপহার বোঝে না, তারা উপহারের মধ্যেও ঢুকে পড়ে।
এরপর দাসদের ডেকে বললেন, শোনো, অতিথিদের জামাকাপড় পুড়িয়ে দাও। তাদের গোসলখানায় নিয়ে যাও। নগ্ন হয়ে আগুন-গরম পানিতে গোসল দাও।
এরপর ডাক্তার অতিথিদের বললেন, আপনাদের জাহাজটা চলে যেতে হবে, এক্ষুনি।
দূতরা বাকরুদ্ধ। এই উন্মাদ ডাক্তার আর কী করবে? একজন ভয়ে ভয়ে বলল, আপনি যাবেন না এথেন্সে? তাহলে আর ন্যাংটা গোসল করে লাভ কী?
ডাক্তার হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, আমি চিকিৎসক। মানুষের জীবন বাঁচানোর ডাক এলে, আমি বসে থাকতে পারি না। আমাকে যেতেই হবে। আমি অবশ্যই যাব। তবে আপনাদের জাহাজে নয়, আমি আমার নিজের জাহাজে যাব।
দূত হাত জোড় করে বলল, আপনার অনেক দয়া, ডাক্তার বাবু। এখন আর একটু মেহেরবানি করেন। আজই যাত্রা করেন। পেরিক্লিস সাহেবকে বাঁচাতে হবে।
ডাক্তার বললেন, যথাশীঘ্রই যাব। কিন্তু আজ নয়। খালি হাতে গিয়ে কোনো কাজ হবে না। কিছু ওষুধপথ্য নিতে হবে। সেটির জোগাড়-যন্ত্ৰ আছে। দিন দুয়েক সময় লাগবে। পরশু ঊষালগ্নে যাত্ৰা।
আপনাদের জাহাজ এক্ষুনি আমার কস দ্বীপ থেকে চলে যেতে বলুন। বলে দিন, আমার বিধান হচ্ছে এথেন্সে চারদিকে যত ময়লা-আবর্জনা আছে, সব পুড়িয়ে ফেলতে। কোনোখানে যেন কোনো পচা, গন্ধময় কিছু না থাকে। যে ঘরে প্লেগ হয়েছে, তাদের জামা-কাপড়ও যেন পুড়িয়ে ফেলে। সবকিছু অগ্নি দেবতাকে দিয়ে দাও, প্লেগ আপনা-আপনি চলে যাবে। আপনারা গোসলে যান। আপনাদের গা ভর্তি প্লেগের জীবাণু। যত দেরি করবেন, আমার দ্বীপ তত দূষিত হবে।
ডাক্তার সাহেব দেরি করেননি। তিনি সময় মতোই তার জাহাজ ভাসিয়ে দিয়েছেন এজিয়ান সাগরে। একটি খবর এসেছে। এথেন্সের শত্রু স্পার্টা জেনে গেছে যে, পেরিক্লিসের চিকিৎসা করতে ডাক্তার সাহেব এথেন্সে যাচ্ছেন। ডাক্তার যাতে পৌঁছতে না পারেন, সেজন্য স্পার্টার সেনারা নাকি যেকোনো সময় ডাক্তারের জাহাজ আক্রমণ করতে পারে।
ডাক্তার বিশ্বাস করেন না। সারা গ্রিসে এমন খারাপ লোক নেই যে তার ক্ষতি করতে পারে। তাও সাবধান হওয়া দরকার।
হিপোক্রাটিসের জাহাজখানা হলো একটি ভাসমান হাসপাতাল। এই জাহাজে কী নেই! নানান ওষুধি গাছপালা, লতা-পাতা, কাটা-ছেঁড়ার যন্ত্রপাতি নিয়ে সে এক মহা কারবার। দূর থেকে এক নজরেই বলে দেওয়া যায়, ঐটা হিপোক্রটিসের জাহাজ। জাহাজে আলো ঝলমলে করছে, বেশ জাঁকজমক আছে। জাহাজে পতাকাও আছে। পতাকায় স্বাস্থ্যের দেবতা এসক্লিপিয়াসের প্রতীক সাপের চিত্র আঁকা। তিনি এখন সারা দুনিয়ার এক নম্বর ডাক্তার। এক নগর থেকে অন্য নগরে গেলে তাকে বরণ করতে অনেক লোক হাজির হয়।
নাবিকেরা ভয় পাচ্ছে। স্পার্টার সেনারা হানা দিতে পারে। পতাকা নামিয়ে ফেলা দরকার। শুধু শুধু বিপদ ঘাড়ে আনার দরকার কী! ডাক্তার বললেন, ঠিক আছে, তোমরা যদি ভাবো একটি পতাকা নামালে তোমরা বাঁচতে পারবে, তো পতাকার আর কাজ কী, নামিয়ে ফেলো।
পতাকা নামলো কিন্তু বিপদ দূর হলো না। স্পার্টার সেনা আসেনি, জাহাজ আটকে গেল অন্য কারণে। সাগরে হঠাৎ শুরু হলো উল্টা বাতাস। জাহাজ উল্টো দিকে যেতে চাচ্ছে, নাবিকরা অনেক চেষ্টায় আটকে রাখছে। তাই জাহাজ নড়ছে না। দিনের পর দিন যাচ্ছে। জাহাজ এগোচ্ছে না। এর মানে কী? দেবতা মহারুষ্ট হয়েছেন। এথেন্সে প্লেগ তো দিয়েছেনই, এখন ডাক্তার সাহেব যাতে সেখানে পৌঁছতে না পারেন, সেজন্য জাহাজ আটকে রেখেছেন মাঝ সাগরে। সাগরের দেবতা ক্ষেপেছে, প্লেগের দেবতা ক্ষেপেছে। এই প্লেগ এথেন্সকে নিশ্চিহ্ন না করে যাবে না। জাহাজে বসেই নাবিকরা দেবতা এপোলো আর তার ছেলে স্বাস্থ্যের দেবতা এসক্লিপিয়াসের উদ্দেশ্যে বলি দিল। তাও কিছু হলো না। এথেন্সকে দেবতারা ভালোই শাস্তি দিচ্ছেন। পেরিক্লিসের শেষ না দেখে তারা ছাড়বেন না। এজিয়ান সাগরের মাঝে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে আছে হিপোক্রাটিসের জাহাজ।
দিন যাচ্ছে আর একটু একটু করে শক্তি কমছে পেরিক্লিসের। তিনি এখন উঠেও দাঁড়াতে পারেন না। শুয়ে শুয়ে অন্ধকারে চোখ বুজে এথেন্সের কথা ভাবেন। কয়েক মাস হয়ে যাচ্ছে তিনি শয্যাশায়ী। কিন্তু এখন যেন বেশি ক্লান্ত লাগে। মাথা কাজ করছে না। বারবার পায়খানা করতে করতে তার শরীরের আর কিচ্ছু বাকি নেই। তিনি এথেন্সের সবচেয়ে লম্বা মানুষ। এখন মনে হয় তিনি প্রতিদিন ছোট হয়ে যাচ্ছেন। মুখ চুপসে গেছে, চোখের দীপ্তি হারিয়ে গেছে।
আসপাশিয়া মিনিটে মিনিটে ডাক্তারের খবর নিচ্ছে। না, হিপোক্রাটিস এসে পৌঁছেননি। তার জাহাজ আসেনি। দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে পেরিক্লিসের। ডাক্তার আসছে না। ঝাড়ফুঁকে কাজ হচ্ছে না।
সারাদিন ঘুমের মতো পড়ে থাকেন পেরিক্লিস। ঘুম আসে না। চোখ জ্বলে। এর মধ্যেই এথেন্সের খবর নেন। একজন এসে প্রতিদিন সকাল আর সন্ধ্যায় তাকে সব খবর শুনিয়ে যায়। কোনো ভালো খবর নেই। হাজার হাজার মানুষ মরছে, গোরস্তানে তিল ধারণের জায়গা নেই, লাশ নিয়ে ভয়ংকর বিপদ, সৎকারের মানুষ নেই। যেসব দাস সৎকার করত, ভয়ে তাদের অনেকেই পালিয়ে গেছে। কয়েকজন দাস পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তাদের বিচার হচ্ছে। সারা শহরে একটি লাশ লাশ গন্ধ, মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। এগুলোই হলো খবর। প্রতিদিন একই খবর। একই বিষয়।
সক্রেটিস মাঝে মাঝে আসে পেরিক্লিসকে দেখতে। আসপাশিয়ার সাথে প্লেগ নিয়ে কথা বলে। এথেন্সের অল্প কিছু যুবকের একজন সক্রেটিস, যে এখনও প্লেগে আক্রান্ত হয়নি। সফোক্লিস আসেননি একবারও। তিনি উল্টা পেরিক্লিসকে ইদিপাসের সাথে তুলনা করে বিশ্রী আক্রমণ করে নাটক লিখেছেন। নাটকের নাম ‘রাজা ইদিপাস’।
আসপাশিয়া ভাবছে, সফোক্লিসকে কতবার নিজের হাতে পুরস্কার দিয়েছেন পেরিক্লিস। আর সেই সফোক্লিস বিপদের দিনে পেরিক্লিসকে এমন আক্রমন করে নাটক লিখেলেন! কবিরা তো মহৎ হওয়ার কথা। তাহলে কবি এমন করছেন কেন? বিপদে বন্ধু না হয়ে, শত্রু হলে তিনি কেমন কবি?
পেরিক্লিসের অসুস্থতা ছয় মাস হয়ে গেল। প্লেগ ধরার পর এতদিন কেউ বেঁচে রয়েছে, এমন শোনা যায়নি। তিনি যে কীভাবে টিকে আছেন, সেটি এক রহস্য। এই যাত্রায় বেঁচেও যেতে পারেন পেরিক্লিস। সবাই আশায় বুক বাঁধছে। পেরিক্লিস নিজেও ভাবছেন, সত্যিই কি প্লেগকে হারিয়ে দিলাম! জীবনে অনেক কিছুতেই তিনি জিতেছেন, প্লেগের সাথে জেতাও অস্বাভাবিক নয়।
আজ সকাল থেকে তার বেশ চাঙ্গা লাগছে। মনে হচ্ছে হাতে-পায়ে শক্তি ফিরে এসেছে, মাথা ধরাও নেই, বুকের ধড়ফড়ানি কমে গেছে। হঠাৎই যেন মনটা ফুরফুরে লাগছে। তিনি একটু পর পর আসপাশিয়াকে ডাকছেন, কারণে- অকারণে ডাকছেন। হাত ধরে বলছেন, তুমি তাহলে খেলা দেখিয়ে দিলে? আমাকে ভালো করেই তুললে! আমার এই নতুন জীবন তোমার ভালোবাসার দান। আসপাশিয়া লজ্জা পাচ্ছে। পেরিক্লিস সবার সামনে কেমন করে বলছে। অনেক দিন পর তার গালে লজ্জা রং ফুটে উঠল।
অনেক দিন পর আজ পেরিক্লিস বিছানা ছেড়ে উঠেছেন। দরজা বন্ধ, ফাঁকা দিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করেছেন। এথেন্সকে দেখতে ইচ্ছে করছে, এতদিন সামনের জিনিসও দেখতে পাচ্ছিলেন না। এখন মনে হচ্ছে চোখের দৃষ্টি ফিরে এসেছে। তিনি ভালো হয়ে যাচ্ছেন। শুধু মাঝে মাঝে একটু তন্দ্রার মতো আসছে। ঘুম ঘুম ভাব হলেই বারবার শিল্পী বন্ধু ফিডিয়াসের কথা মনে পড়ছে। ফিডিয়াসকে যেন দেখতে পাচ্ছেন। মনে হয়, শিল্পী যেন কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না। কী বলতে চায় শিল্পী? সে তো মারা গেছে অনেক দিন হলো, এক সময় তার জন্য পেরিক্লিস প্রতিদিন কাঁদতেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন তার কথা মনেই আসেনি। আজ হঠাৎ শিল্পীর মুখটা বারবার ভেসে উঠছে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দুই পাহাড়ের ফাঁকা দিয়ে ডুবছে সূর্য। আজকের সূর্য বুঝি একটু বেশিই লাল, একেবারে রক্তমাখা লাল। পেরিক্লিস দরজার ফাঁকা দিয়ে সূর্যাস্ত দেখছেন। রক্তমাখা সূর্যটা ডুবি ডুবি করেও ডুবছে না। যেন থেমে আছে। যেন কিছু বলতে চাইছে। বলা হচ্ছে না দেখে ডুবতে পারছে না। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে কখন যেন পেরিক্লিসের ঘুম ঘুম এসে গেছে।
ঘুমের ঘোরে তিনি বিড়বিড় করছেন। কার সাথে যেন কথা বলছেন। তিনি দেখতে পাচ্ছেন, তার বন্ধুরা তাকে ডাকছে। শিল্পী ফিডিয়াস, গায়ক ডেমন, নাট্যকার এস্কিলাস, গুরু সবাই তাকে ডাকছে। তারা একসাথে হাত তুলে ডাকছে। পেরিক্লিস সাড়া দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। কে যেন গলাটা চেপে ধরেছে। হাঁসফাঁস লাগছে। নিশ্বাস নিতে পারছেন না। তিনি চোখ খুলতে চাইছেন, কিন্তু খুলতে পারছেন না। অনেক চেষ্টায় পিটপিট করে চোখ খুললেন। কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছেন না কেন? চারদিকে আঁধার, ভয়াবহ আঁধার। জগতের সকল আলো নিভে গেছে। এত আঁধার কেন? ভীষণ ভয় লাগছে। আবার চিৎকার করতে চাচ্ছেন, কিন্তু স্বর বের হচ্ছে না। প্রাণপণ চেষ্টা করছেন আসপাশিয়াকে ডাকতে। কিন্তু ডাকতে পারছেন না। কিচ্ছু করতে পারছেন না, শুধু অনেকের ডাক শুনতে পাচ্ছেন। সবাই তাকে ডাকছে, অজানা এক সুদূরের দিকে ডাকছে।
কেন ডাকছে? এটিই কি মৃত্যু ডাক?
হঠাৎ তীব্র ব্যথা শুরু হলো বুকে। তার বুক ফেটে যাচ্ছে। জোরে জোরে শব্দ করে বড় বড় নিশ্বাস নিতে শুরু করলেন। নিশ্বাসের শব্দ পেয়ে ছুটে এলো আসপাশিয়া। অবস্থা দেখে হাউমাউ করে পেরিক্লিসকে জড়িয়ে ধরল। ধরতেই পেরিক্লিসের গলায় স্বর ফিরে এলো।
অনেক কষ্টে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন, ওই যে পার্থেনন, ওই যে এথিনার মূর্তি, দেবী এথিনা হাসছেন। এখনও দেবী ঝলমল করছে, এখনও এথেন্স ঝলমল করছে। আমি এমন এথেন্স দেখতে দেখতেই মরতে চেয়েছিলাম।
হঠাৎ চোখ বন্ধ হয়ে গেল। চোখ কি খুলবে না? একটু পর অস্ফুট স্বরে আবার বললেন, ফিডিয়াস! ঐ যে শিল্পী ফিডিয়াস। ফিডিয়াস ডাকছে, আমাকে ডাকছে। পাতালপুরী থেকে ডাকছে।
আসপাশিয়া বুঝল, আর বেশি সময় নেই। সে পেরিক্লিসের মাথাটা কোলে নিয়ে বসল। চারপাশে অনেক মানুষ। সবাই কাঁদছে। এথেন্সের এক নম্বর নাগরিক চলে যাচ্ছেন। তার স্বপ্নের এথেন্স ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছেন। পৃথিবীর নিকষ কালো অন্ধকার গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছেন স্বপ্ন পুরুষ পেরিক্লিস।
আসপাশিয়ার চোখ থেকে দুফোঁটা পানি পড়ল পেরিক্লিসের কপালে। পেরিক্লিস আসপাশিয়ার হাতটা চেপে ধরলেন। তার চোখ পার্থেননের দিকে। চোখের জ্যোতি স্পষ্ট। হঠাৎ বলে উঠলেন, আসপাশিয়া, হোমারের সেই লাইনগুলো একবার বলবে! মরণ নিয়ে লেখা কথাগুলো—
আসপাশিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,
‘সবখানে মরছে মানুষ, লাশগুলো করে আছে চুপ
মরণ, বল না রে, কতো রকম তোর রূপ
সামনে-পিছনে ডানে বাঁয়ে, যে দিক পানে চাই
আসছে মরণ, চোরা গলি দিয়ে, বাঁচার উপায় নাই।’
পেরিক্লিসও তার সাথে বলছেন, ‘সবখানে মরছে মানুষ, লাশগুলো করে আছে চুপ… আসছে মরণ, চোরাগলি দিয়ে, বাঁচার উপায় নাই’।
পেরিক্লিস চোখ বুজলো।
দূরের আলো-ছায়ায় একটি পাখি কাঁদছে। ঝরঝর বৃষ্টি নেমেছে। মহাকালের করুণতম সুরে সন্ধ্যার বাতাস বলছে, আসছে মরণ, চোরাগলি দিয়ে, বাঁচার উপায় নাই…।
এথেন্সের এক নম্বর নাগরিককে কেড়ে নিল ভয়ংকর প্লেগ। নিভে গেল এথেন্সের স্বপ্ন। গণতন্ত্র হারাল তার প্রধান মানুষ।
ঠিক তখুনি দূত এসে খবর দিল চিকিৎসক হিপোক্রাটিস এসে গেছেন ডাক্তার শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলেন, তার চোখের সামনে দিয়ে পেরিক্লিসের লাশ সৎকারের জন্য নিয়ে যাচ্ছে।