৩৮
‘তুমি যাকে খুঁজছো, সেটি তুমি নিজেই।
তুমি নিজেই তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু।’
—সফোক্লিস
***
কোথাও খারাপ কোনো কিছু ঘটলে মানুষ প্রথমেই খোঁজে দায়ী কে? কারও ঘাড়ে দোষটা দিতে না পারা পর্যন্ত মানুষ শান্তি পায় না।
সফোক্লিস ভাবছেন, শহরে প্লেগ এসেছে। মানুষ কী শুনতে চায়? শুনতে চায়— এজন্য দায়ী কে? কার দোষে এই প্লেগ?
সবাই কারণ খুঁজছে। অনেকেই ভাবছে, কারণ হলেন পেরিক্লিস। সফোক্লিসও বিশ্বাস করেন, এই প্লেগের কারণ হলেন পেরিক্লিস। কিছু দিন ধরে তিনি পেরিক্লিসকে খুবই অপছন্দ করছেন। এখন তার কাছে পেরিক্লিসের সবকিছু খারাপ লাগছে।
কিছুদিন আগে তাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। সফোক্লিস আর পেরিক্লিস একসাথে সামোস দ্বীপে গিয়েছিলেন যুদ্ধ করতে। সেখানে এক দুষ্টুমি থেকে দুজনের শত্রুতা শুরু হয়। পেরিক্লিস সফোক্লিসকে শত্রু ভাবেন না। কিন্তু সফোক্লিস তাকে ভয়াবহ দুশমন মনে করেন। ঘটনাটা ছিল এমন—
যুদ্ধের অবসরে দুজন গল্প করছিলেন। অনেকেই পাশে ছিল। সেখানে একটি অল্প বয়সী ছেলে ব্যায়াম করছিল। ছেলেটিকে দেখে সফোক্লিস বললেন, ‘বাহ, ছেলেটি তো সুন্দর! মুখখানা বড় নিষ্পাপ।’ এথেন্সে তরুণ ছেলেদের প্রতি বুড়োদের আকর্ষণ নিয়ে অনেক আজেবাজে কানাঘুষা আছে। পেরিক্লিস সেদিকে ইঙ্গিত করে কঠিনভাবে বললেন, ‘সফোক্লিস, তুমি একজন সেনানায়ক, একজন জেনারেল। একজন জেনারেলের হাত যেমন নিখুঁত হওয়া উচিত, তেমনই তার চোখও পরিষ্কার থাকা উচিত। তোমার চোখ ঠিক করো।’ কথাটি শুনে লজ্জায় হেঁট হয়ে গিয়েছিলেন সফোক্লিস। পেরিক্লিস এটি বলতে পারলেন? এতগুলো লোকের সামনে তার মতো সেরা নাট্যকারকে এভাবে বললেন! সেই মুহূৰ্ত থেকেই সফোক্লিস ঠিক করেছেন, এই জীবনে যেদিন সুযোগ পাবেন, সেদিনই পেরিক্লিসকে শিক্ষা দেবেন। অপমানের প্রতিশোধ নেবেন।
এবার সময় এসেছে পেরিক্লিসকে শিক্ষা দিতে হবে। সফোক্লিস নাটক লিখবেন। পেরিক্লিসকে নিয়ে নাটক। নাটকের মাধ্যমেই তার চেহারা সবার সামনে খুলে দেবেন। কাহিনি কী হতে পারে? নাটকের প্লট খুঁজছেন সফোক্লিস। ভালো প্লটের কথা মনে হলেই তার মাথায় আসে রাজা ইদিপাসের কাহিনি।
তিনি ইদিপাসের কাহিনি খুব ভালোবাসেন। রাজা ইদিপাসকে নিয়ে লিখতে বসলেই তার কলমে সোনা ঝরে। মুক্তার মতো সংলাপ বের হয়। তিনি আবার ইদিপাস লিখবেন।
কয়েক বছর আগে ইদিপাস নিয়ে লিখেছিলেন নাটক এন্টিগনি। ইদিপাসের মেয়ে এন্টিগনিকে নিয়ে ছিল কাহিনি। সেই নাটকের সংলাপ এখনও মানুষের মুখে মুখে। এবার সরাসরি রাজা ইদিপাসের কাহিনি। নাটকের নামও হবে ‘রাজা ইদিপাস’। কাহিনি সবাই জানে—
থিবসের রাজপুত্র ইদিপাস না জেনে নিজের বাবাকে হত্যা করে রাজা হয়। না জেনেই নিজের মাকে বিয়ে করে ফেলে। তাদের ছেলেমেয়েও হয়। অনেক বছর পরে আসল ঘটনা জানতে পেরে অনুতাপে ইদিপাস নিজেকে অন্ধ করে ফেলে। তার মা আত্মহত্যা করে।
সফোক্লিস ভাবছেন, কীভাবে ইদিপাসের সাথে পেরিক্লিসকে মিল করা যায়। সফোক্লিস অমিত প্রতিভাধর। তিনি সর্বকালের সেরা নাট্যকার। প্রতি বছর বসন্ত উৎসবে তার নাটক প্রথম হয়। সে কাশি দিলেও দু’একটি কাহিনি বের হয়ে যায়। তার কাছে পেরিক্লিস আর ইদিপাসকে মিলানো কোনো ব্যাপারই নয়। জানালায় হাত দিয়ে ভাবছিলেন সফোক্লিস।
একটু পরেই চিৎকার করে উঠলেন, পেয়েছি, এটি তো আমার বাঁ হাতের খেল্। তার মাথায় রাজা ইদিপাস নাটকের প্লট এসে গেছে।
উত্তেজনায় সফোক্লিস কাঁপছেন। এই নাটক দিয়ে তিনি পেরিক্লিসের মুখোশ খুলে দেবেন। এটি তার প্রতিশোধের নাটক। এটিকে খুব ভালো করতেই হবে। নিজের সবটুকু ঢেলে তিনি এই নাটক বানাবেন। তিনি প্লট লিখতে বসলেন।
ইদিপাসকে হিসেবে তিনি পেরিক্লিসকে এথেন্সের মানুষের কাছে তুলে ধরবেন। এথেন্সে এখন প্লেগ চলছে। তাই রাজা ইদিপাসের কাহিনিও শুরু করতে হবে প্লেগ দিয়ে। মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, এটি আসলে এথেন্সের কাহিনি। সফোক্লিস ভাবছেন ইদিপাসের শহর থিবস। তো নাটকের শুরুতেই থিবস শহরে এথেন্সের মতো প্লেগ আসুক। ভয়াবহ প্লেগ।
থিয়েটারে সবাই শুরুতেই বুঝে যাবে যে, নাটকের থিবস শহর আসলে এথেন্স। এথেন্সের প্লেগকে বোঝাতেই নাট্যকার থিবস শহরে প্লেগ দেখাচ্ছে। নাটকে প্লেগের ভয়াবহতা দেখে সবাই নিজেদের কষ্টের কথা মনে করবে। অভিনেতার সাথে সবাই কাঁদবে।
সফোক্লিস প্লট বানাচ্ছেন :
থিবস শহরে সবাই প্লেগের কারণ খুঁজছে? রাজা ইদিপাসও খুঁজছেন। রাজা লোক পাঠাচ্ছেন ডেলফিতে— প্লেগের কারণ জানার জন্য। জানা গেল রাজা নিজেই এই প্লেগের কারণ। জানা গেল ইদিপাস নিজেই একটি পাপ। সে নিজেই একটি অভিশাপ। তার নিজের জন্যই শহরে খরা এসেছে। তার জন্যই মড়ক লেগেছে। রাজা নিজেই দায়ী।
এটি দেখলে, মানুষ এথেন্সের সাথে মিলাতে চাইবে। তারা ভাববে— এথেন্সেও এমন কিছু হয়েছে। এজন্য কে দায়ী? কার পাপে এথেন্সে প্লেগ এসেছে? মানুষের মনে প্রশ্ন আসবে— এথেন্সে কে রাজা? রাজা তো নেই, কিন্তু প্রধান নেতা আছেন। তিনি হলেন পেরিক্লিস। সবাই ভাববে, এথেন্সের প্লেগের জন্য পেরিক্লিস নিজেই কি দায়ী?
সফোক্লিস কাহিনি লিখছেন— প্লেগের জন্য ইদিপাস কীভাবে দায়ী? উত্তর হলো ইদিপাস ব্যভিচারী। সে নিজের মাকে বিয়ে করেছে। তাদের সন্তান হয়েছে। একইভাবে— পেরিক্লিসও ব্যভিচারী। সে বিয়ে না করেই আসপাশিয়াকে ঘরে এনেছে। তাদেরও ছেলে আছে।
ইদিপাস অন্যায় করেছে না জেনে। আর পেরিক্লিস করেছে জেনে। পেরিক্লিস আসলে ইদিপাসের চেয়েও খারাপ। ইদিপাসের পাপে থিবস শহরে প্লেগ এসেছে। আর পেরিক্লিসের পাপে এথেন্সে প্লেগ এসেছে।
এবার কাহিনি শেষ করতে হবে। সফোক্লিস ভাবছেন নাটকের শেষ কি হবে? পেরিক্লিসের পরিণতি কি দেখানো যায়? মৃত্যু? না, মৃত্যু বেশি হয়ে যায়। পেরিক্লিসের মৃত্যু দেখালে এথেন্সের মানুষ মানবে না। সবচেয়ে ভালো হয় নির্বাসন। যদি পেরিক্লিস এথেন্স থেকে চলে যায়, সেটি সবচেয়ে ভালো হবে। যদি ভোট দিয়ে তাকে এথেন্স থেকে নির্বাসিত করা হয়, তাতেও চলবে। তিনি ঠিক করলেন নাটকের কাহিনিতে ইদিপাস তার শহর থেকে চলে যাবে। রাজা চলে গেলে শহর পাপমুক্ত হবে। পেরিক্লিস বিদায় নিলে এথেন্স পাপমুক্ত হবে।
এভাবে কাহিনি শেষ হবে।
সফোক্লিসের মন খচখচ করছে। কী যেন হয়নি। কিছু একটি বাকি রয়ে গেল। অনেক ভেবে সফোক্লিস মনে করল, সামোস দ্বীপে পেরিক্লিস তার চোখ ভালো করতে বলেছিল।
চোখ! চোখ শব্দটা বারবার মনে আসছে। আমার চোখ ভালো করতে চায় পেরিক্লিস! আমার চোখ খারাপ? তো পেরিক্লিসের চোখ নষ্ট হোক। তার নাটকে পেরিক্লিস হলো ইদিপাস। তিনি কাহিনি ঠিক করলেন— অনুশোচনায় ইদিপাস নিজের চোখ নষ্ট করে ফেলল। অন্ধ হলো ইদিপাস।
প্লট বানানো শেষ। এবার নাটকের শিল্পগুণ ঠিক করতে হবে। ট্র্যাজেডির সব গুণ দিয়ে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলতে হবে। প্লট সেভাবেই হয়েছে। এত বছর ধরে নাটক লিখছেন সফোক্লিস। এখন আর ট্র্যাজেডির গুণ নিয়ে তাকে ভাবতে হয় না। এমনিতেই চলে আসে। ট্র্যাজেডিতে নায়কের পরিণতি হয় ভয়াবহ। অনেক উঁচু থেকে ধপাস করে পড়ে যায় নায়ক। কাহিনিতে সেটি হয়ে গেছে। রাজা ইদিপাস ছিল সবার চোখের মনি। সে হয়েছে ঘৃণিত অভিশাপ। হয়েছে অন্ধ, নির্বাসিত। এর চেয়ে করুণ আর কিছুই হতে পারে না।
এখন দৃশ্য আর সংলাপ দিয়ে ট্র্যাজেডিকে প্রাণবন্ত করতে হবে।
সফোক্লিস সংলাপ লেখেন আর অভিনয় করেন। তার নাটক লেখার দৃশ্যটিও একটি নাটকের মতো। তিনি লিখছেন রাজা ইদিপাস—
ইদিপাসের দরবারে অনেক মানুষ এসেছে প্লেগের কারণ জানতে। তারা খুব দুঃখ নিয়ে বলছে—
লাশ আর লাশ, চারিদিকে লাশ
পুষ্পবনে লাশ, শস্যক্ষেতে লাশ
প্রতি মায়ের কোল জুড়ে শুধুই লাশ[৯৮]
সফোক্লিস ভাবছেন এই কথা শুনলেই দর্শকরা এথেন্সের প্লেগের কথা মনে করবে। তিনি ঝড়ের বেগে লিখছেন—
রাজা ইদিপাস তার শ্যালক ক্রিয়নকে ডেলফিতে পাঠিয়েছেন, প্লেগের কারণ জানতে। ডেলফির ওরাকল বলেছে— ‘একটি দুষ্ট পাপ আছে এই নগরেই। সে আমাদের মাটিকে দূষণ করছে। তাকে তাড়াতে পারলেই শুধু আমরা বাঁচতে পারব।’
ক্রিয়ন খুলে বলল, এই নগরের আগের রাজা লাইয়াসের খুনি এখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেটিই হলো অভিশাপ। সেই অভিশাপেই এই প্লেগ। খুনিতে তাড়াতে হবে, অথবা খুনের বদলে খুন করতে হবে। কিন্তু কেউ জানে না কে সে খুনি। ইদিপাস শপথ নিল খুনিকে খুঁজে শাস্তি দেবে। খুনির খবর জানতে নগরের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ অন্ধ বৃদ্ধ তেইরেসিয়াসকে নিয়ে আসা হলো। তিনি সব জানেন। কিন্তু বলবেন না। জেনেও বলবেন না দেখে ইদিপাসের ভীষণ রাগ হলো। ইদিপাস তাকে অন্ধ আর অজ্ঞান বলে অপমান করল। অন্ধ বৃদ্ধ তখন ক্রদ্ধ হয়ে জানালেন, মূর্খ ইদিপাস, তুমি নিজেই সেই খুনি।
এখানে সফোক্লিস সংলাপ দিলেন জ্ঞানী বৃদ্ধের মুখে :
‘তুমি যাকে খুঁজছো, সেটি তুমি নিজেই। তুমি নিজেই তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু।’
কথা দুটি লিখে খুব ভালো লাগল তার। কথাগুলোর ভালো অর্থ আছে। খুব দার্শনিক কথা হয়েছে। তিনি এই কথা দুটি কয়েকবার অভিনয় করলেন।
সফোক্লিস লিখে চলছেন— ইদিপাস জ্ঞানী তেইরেসিয়াসের কথা বিশ্বাস করল না। সে ক্রিয়নকে বলল, ‘তুমি এই অন্ধ লোককে দিয়ে মিথ্যা বলাচ্ছ।’ শুরু হলো ক্রিয়নের সাথে ঝগড়া। সেই ঝগড়া থামাতে এলো তার স্ত্রী রানি জোকাস্টা। সে আবার ক্রিয়নের বোন। সব শুনে রানি বলল, ভয় নেই। তুমি খুনি হওয়ার কোনো কারণ নেই। ডেলফির ওরাকল বলেছিল, রাজা খুন হবে তার নিজের ছেলের হাতে। সেজন্য আমাদের যখন ছেলে হয়, আমরা তাকে মেরে ফেলতে এক মেষপালকের কাছে দিয়ে দিই। মেষপালকের কথা শুনেই চমকে উঠলেন ইদিপাস। তিনিও বড় হয়েছেন মেষপালকের কাছে। ইদিপাস ডাকল মেষপালককে। তার সাথে অনেক আলাপের পর তারা নিশ্চিত হলো, ইদিপাস আসলে রাজা লাইয়ুস আর রানি জোকাস্টার সন্তান। তার জন্মের পর বাবা-মা মেষপালককে দিয়ে দিয়েছিল মেরে ফেলার জন্য। মেষপালক তাকে বড় করেছে। বড় হয়ে সে একদিন না জেনে পথের মধ্যে নিজের বাবাকে খুন করে। তারপর থিবস শহরে এসে দেখে ভয়ানক দৈত্য স্ফিংস শহরকে কব্জা করে রেখেছে। দৈত্যের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সে থিবস শহরের মানুষকে বাঁচায়। তারা তাকে থিবসের রাজা করে। বিধবা রানির সাথে তার বিয়ে হয়। তার মানে তার স্ত্রী আসলে তার মা। এই ভয়াবহ সত্য সামনে এলে রানি জোকাস্টা অপমান ও অনুশোচনায় আত্মহত্যা করেন। প্রচণ্ড অপমানে কাঁদতে কাঁদতে ইদিপাস বললেন,
‘চারিদিকে যা দেখি সবকিছুই কুৎসিত। এই চোখ দিয়ে আর কিচ্ছু দেখতে চাই না’।
নষ্ট হোক চোখ। তিনি কাঁটা দিয়ে নিজেকে অন্ধ করে ফেললেন। অন্ধ হলেন ইদিপাস। শুরু হলো তার ভয়াবহ কষ্টের জীবন। একা, অন্ধ, পাশে কেউ নেই। নিজে কোনো অপরাধ করেননি, কিন্তু এমন ঘটনায় জড়িয়ে গেছে তার জীবন যেখানে তাকে সমবেদনা জানাতেও কাউকে পাবেন না। সে চিৎকার করে বলল :
অন্ধকার, সবখানে কালো নিকষ অন্ধকার,
জড়িয়ে আমায় তমসামাখা ভয়াল চাদরে
নিয়ে যাচ্ছে, অন্তহীন এক আঁধার-নগরে
.
অন্ধ হয়েও ইদিপাসের শান্তি নেই। অতীত জীবনের স্মৃতি তাকে কাঁদায়। সব সময় কাঁদায়। সফোক্লিস আবার লিখলেন—
আহারে জীবন,
অন্ধ হয়েও কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে রাখি
তবু নেই মুক্তি-
পেছনে ছুটছে সারা জীবনের দুর্বিষহ স্মৃতি।
ইদিপাসের রাজত্ব শেষ। রাজা হলো তার শ্যালক ক্রিয়ন। ইদিপাস রাজ্য ছেড়ে নির্বাসনে গেলেন।
বসন্ত-উৎসবে ‘রাজা ইদিপাস’ নাটক অভিনীত হলো। সফোক্লিস ফাটাফাটি অভিনয় করলেন। দর্শকরা খুবই পছন্দ করল। আর প্রত্যেক বছরের মতো তার নাটক আবারও প্রথম হলো।
পেরিক্লিস আর আসপাশিয়া থিয়েটারে বসে দেখলেন, তাদের বন্ধু সফোক্লিস কী নির্মমভাবে পেরিক্লিসকে রাজা ইদিপাস সাজিয়েছেন।
পেরিক্লিস বললেন, এখন এথেন্সের এমন অবস্থায় সফোক্লিস আমাকে এথেন্স ছেড়ে যেতে বলছে? আমি চলে গেলে কে বাঁচাবে এথেন্সকে?
বাড়ি ফিরে আসপাশিয়া অনেকক্ষণ কাঁদল। সে কি নাটকের জোকাস্টা? তার কি আত্মহত্যা করা উচিত?
.
ইউরিপিডিস নাটকটির গঠন আর সংলাপ খুব পছন্দ করল। এমনিতে তার সফোক্লিসের নাটক ভালো লাগে না। কিন্তু এই নাটকটি ভালো লাগল। ইউরিপিডিসের নাটক ছাড়া সক্রেটিস থিয়েটারে যায় না। এই নাটক দেখতেও সে যায়নি। তাতে কোনো সমস্যা নেই। ইউরিপিডিস তার কাছে পুরো নাটকের বিবরণ দিয়ে দিয়েছে।
নাটকের ঘটনা শুনে সক্রেটিস বলল, সফোক্লিসের চিন্তা-ভাবনা খুবই পুরনো। ইদিপাস খুনি, তাই তাকে তাড়িয়ে দিতে হবে। অথবা খুন করতে হবে। খুনের বদলে খুন। প্রতিশোধ নিতে হবে। আমি যে সুন্দর জীবনের কথা বলি এটি সেই সুন্দর জীবন নয়। সুন্দর জীবনে প্রতিশোধ বলতে কিছুই নেই। আছে ক্ষমা, আছে মানবিকতা।
ইউরিপিডিস বলল, তবে সফোক্লিস কিন্তু এই নাটকে তোমার মতো সংলাপ দিয়েছেন। রাজা ইদিপাসের মুখে তিনি বলেছেন— ‘তুমি যাকে খুঁজছো, সেটি তুমি নিজেই।’ আরেক জায়গায় বললেন, ‘তুমি নিজেই তোমার শত্রু’। কথাগুলো ঠিক তোমার কথার মতো। তুমি যে বলো— ‘নিজেকে জানো’ সেরকমই কথাগুলো।
সক্রেটিস ভাবছে, সফোক্লিসও তাহলে তার মতো ভাবতে শুরু করেছেন!
এথেন্সের সাধারণ মানুষ সব সময় সফোক্লিসের নাটক অনেক পছন্দ করে। তারা বিশ্বাস করল, এথেন্সের প্লেগের জন্য পেরিক্লিস নিজেই দায়ী। পরের নির্বাচনে পেরিক্লিস হেরে গেলেন। জীবনে প্রথমবার ভোটে হারলেন পেরিক্লিস। তার নামে মামলা হলো। তিনি নাকি এথেন্স সরকারের টাকা সরিয়েছেন। তিনি জরিমানা দিলেন। কিন্তু মানুষ অল্প দিনেই ভুল বুঝতে পারল। সেজন্য পরের বছর ভোটে তিনি আবার নির্বাচিত হলেন।
এত কিছু হচ্ছে। কিন্তু প্লেগ কমছে না। যুদ্ধও থামছে না। থামছে না মানুষের মৃত্যু।
***
৯৮. এই অধ্যায়ে ‘রাজা ইদিপাস’ এর যেসব সংলাপ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ (Robert Fagles, Penguin Books) থেকে বাংলা করা হয়েছে।